চশমার চিঠি

অলংকরণ: আপন জোয়ার্দার

পরীক্ষার আগে,
ব্যাটা চশমা যায় ভেগে।
‘ব্যাটা চশমা ভেগেছে!’

আমার কথা শুনে আব্বু-আম্মু আর ছোট বোনটি এতই অবাক হয় যে মহাকাশ থেকে এলিয়েন নেমে নিজেকে রবীন্দ্রনাথ বলে পরিচয় দিলেও এতটা অবাক হতো না।

‘চশমা কী করে ভাগে? হারিয়েছে বড়জোর। আমরা তো খুঁজছিই। পেয়ে যাব নিশ্চয়ই।’ আব্বু কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাস থেকে নয়। তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। এর মধ্যে পুরো বাড়ি খোঁজা হয়ে গেছে। চশমা তো দূর, তার ডাঁটাটিও কারও নজরে পড়েনি।

আমি আগের কথার পুনরাবৃত্তি করলাম, ‘হারায়নি। ব্যাটা জোচ্চোর ভেগেছে।’ আব্বু আর কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আম্মুর নজরে পড়ল আমার হাতের কাগজটায় যেটা কিছুক্ষণ আগে আমি অতিকষ্টে চোখের ৮-১০ ইঞ্চি কাছে নিয়ে পড়ছিলাম। নিষিদ্ধ প্রেমপত্রের মতো সেটা একঝটকায় নিজের দখলে নিল আম্মু। জোরে জোরে পড়ল,

‘প্রিয়,

আমি চলে যাচ্ছি।

তোমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। প্রথম প্রথম ভালোবাসলেও এখন তুমিও আমায় যত্ন করো না। যেখান–সেখানে ফেলে রাখো। নাকের গোড়ায় দাগ পড়েছে বলে আজকাল আমায় তুমি একপ্রকার ঘৃণাই করো বলতে গেলে। এ অবহেলা আমি আর নিতে পারছি না। তাই বিদায় নিচ্ছি তোমার এই জীবন থেকে।

সুখে থেকো, ভালো থেকো।

ইতি
তোমার চশমা।’

চিঠি পড়ে আম্মুর চক্ষু চড়কগাছ। দূরে হওয়ায় ছোট বোন আর আব্বুর চোখের ভাব বুঝতে পারছি না বটে, তবে এ রকম আজগুবি ব্যাপারস্যাপার দেখে তাদের অবস্থাও আম্মুর চেয়ে অভিন্ন হয়নি নিশ্চয়ই। আমার কথা বাদই দিলাম। আজ আমার এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন। আর আজই কিনা চশমা ব্যাটা ভাগল! রাগে-দুঃখে কান্না পেয়ে গেল আমার। এদিকে ঘড়িতে বাজে ৯টা ৫০। বান্ধবী নীলিমা এসে গেছে এর মধ্যেই, উদ্দেশ্য আমার সঙ্গে পরীক্ষা হলে যাওয়া। ঘটনা শুনে সে–ও থ। আব্বু ছুটল নতুন চশমা বানাতে। সেটাও এক ঘণ্টা আগে হওয়ার কাজ নয়।

যাহোক, চোখে দেখি আর না দেখি, পরীক্ষা তো দিতেই হবে। এসএসসি বলে কথা! এত বছরের সাধনা। একি বৃথা হতে দেওয়া যায়?

অন্ধের যষ্টির মতো সারাটা পথ নীলিমার হাত ধরে পৌঁছালাম হলে। ঘণ্টা বাজল, আমাদের পরীক্ষার খাতা, প্রশ্নপত্র দেওয়া হলো। প্রশ্নপত্রের ছোট ছোট অক্ষর দেখে আমি কেঁদে বুক ভাসাই, আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায়, চশমাটার প্রতি আমার নিদারুণ অবহেলার কথা। কত সাহায্য করেছে সে আমায়। তার জন্যই তো সুই-সুতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হই, দূর থেকে ঠিকমতো ঢিল ছুড়ে আম পেড়ে বন্ধুদের বাহবা পাই। ভাবতে ভাবতে ব্যাটা চশমাটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে ওঠে, হাউমাউ করার মাত্রাটাও বেড়ে যায় খানিক।

তখনই শুনতে পাই জানালা দিয়ে আসা রিনরিনে কণ্ঠস্বর। ‘জিন্তি, আমি ফিরে এসেছি!’

মাথা ঘোরাতেই দেখলাম, দুটো ডাঁট ঝুলছে। তার মাঝে কাচের মতো গোল গোল কী যেন। আরেহ! এটা চশমা না? হ্যাঁ, তাই তো! এ যে দেখছি আমারই ‘ব্যাটা চশমা’।

‘তুই ফিরে এলি? কীভাবে? কোথায় গিয়েছিলি তুই? আর চিঠিই-বা লিখলি কী করে?’ শত শত প্রশ্ন করে যাচ্ছি আমি তখন। আর ‘ব্যাটা চশমা’ এসে টুপ করে নিজেকে আমায় পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘সে ম্যালা কথা! আগে পরীক্ষাটা তো দাও।’

তারপর? তারপর আর কী? উসাইন বোল্টের গতিতে লেখা শুরু করার আগে পূর্বপ্রস্তুতিস্বরূপ আমি খানিকের জন্য চোখ বুজি।

‘এই জিন্তি ওঠ! ১২টা বেজে গেছে। পড়ালেখার তো নামগন্ধ নেই। পরীক্ষায় দিবিটা কী?’

আশ্চর্য! আম্মুর গলা! তা-ও আবার পরীক্ষার হলে? চরম বিস্ময় নিয়ে চোখ খুলে দেখি, ‘আরেহ! আমি বিছানায় শুয়ে! তাহলে এতক্ষণ কী চলছিল? গোটাটা স্বপ্ন ছিল!

বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়৷ বিছানার পাশেই আমার ‘ব্যাটা চশমা’। সেই যে মায়াভরা চোখ নিয়ে তাকালাম তার দিকে, আর কখনো ব্যাটাকে নিন্দেমন্দ করিনি।

সামনেই পরীক্ষা। কে জানে বাবা! রেগে গিয়ে যদি সত্যিই ভেগে যায় কোনো দিন!