ঘূর্ণিবলের গল্প
১.
ক্রিকেট বলটা সুমনের হাতে দেখাচ্ছে ফুটবলের সাইজের একটা কিছু! গ্রিপ করবে কি, এক হাতে বলটাকে ধরতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সে।
ওপাশে দাঁড়িয়ে হেলমেটটা খুলে ঢকঢক করে পানি খেল জেলা স্কুলের নামকরা ব্যাটসম্যান রহিম। ক্লাস টেনে পড়ে। সামনের আন্তজেলা লিগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া দলে ডাক পাওয়ার কথা। বোলিং ক্রিজ থেকে মাত্র ছয় পা দূরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সুমনকে জিজ্ঞেস করল—কী রে, স্পিন বোলিং করবিনি?
সুমন বলল—হ, লেগস্পিন করুম।
—কস কী? লেগস্পিন করবি? লেগস্পিন কারে কয় জানস তো?
টেপটেনিসে বোলিং করার অভ্যাস, ক্রিকেট বলটা হাতে নিয়েই ভয় ভয় লাগছে সুমনের। কালকে প্র্যাকটিসের সময় মাটিতে ড্রপ দিয়ে দেখেছে বল বাউন্স খায় না। এই বলে জান দিয়ে জোরে বল না করলে এক ড্রপে ব্যাটসম্যানের কাছে নেওয়াই কষ্ট হয়ে যাবে।
প্রথম বল হলো। মিডলস্ট্যাম্প বরাবর ফেলে লেগস্পিন করাতে চেয়েছিল সুমন। অফ স্ট্যাম্পের পাশ দিয়ে বের করার টার্গেট। কোনো টার্ন খেল না বল, আস্তে করে ডিফেন্স করল ব্যাটসম্যান। পরের বলও একই রকম, ব্যাটসম্যান খেলল না। টার্ন করল না তৃতীয় বলটাও। ততক্ষণে বুদ্ধিমান ব্যাটসম্যান রহিম ধরতে পেরেছে, এই পিচ্চি বোলারের টার্ন করানোর ক্ষমতাই নেই। যেখানেই বল পড়ুক, ওখান থেকে একেবারে সোজা যাবে। নিশ্চিন্ত মনে একটা ছক্কা মারল সে। পরের বলটা একটু টেনে দিল সুমন, ওটা ছক্কা না হয়ে চার হলো।
অন্নদা স্কুলের ক্যাপ্টেন তারেক ভাই। টেনে পড়ে, এখনই দাড়ি-গোঁফে মুখ ঢেকে গেছে। সুমনের কাছে গিয়ে বলল—কী রে সুমন, হইতাছে কী?
সুমন বলল—বল তো ঘুরে না ভাই!
—ঘুরানির কাম নাই। জুরতে বল মার। একটা বল আছে, আর চাইর-ছক্কা খাইস না। স্যাররে কত কইলাম আনোয়াররে নিতে, হের পেস বোলিং থিকা আমরার নাকি লেগস্পিনার দরকার!
সুমন চুপ করে রইল। অভিমানই হচ্ছে স্যারের প্রতি। কী দরকার ছিল কালকে ডেকে একেবারে স্কুল টিমে ঢুকিয়ে দেওয়ার? মোটে সেভেনে পড়ে, নাইন-টেনের দানবের মতো শক্তি নিয়ে যে ছেলেপেলে খেলে, তাদের সাথে ও পারবে কেমন করে?
—কী রে, বোলিং করতে যা!
ক্যাপ্টেনের কথায় সংবিৎ ফিরল সুমনের। রানআপটা একটু লম্বা করে অনেকটা পেস বোলারের মতো করেই ছাড়ল শেষ বল দুইটা। সিঙ্গেল হলো দুই বলেই।
বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং করতে এসে দেখে দড়ির সামনে রঞ্জিত স্যার দাঁড়িয়ে। সুমনদের স্কুলের পিটি শিক্ষক। স্কুলের ক্রিকেট টিমের কোচ। স্যারের সঙ্গে কোনো কথা না বলে খেলার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল সুমন।
রঞ্জিত স্যারের গলা শোনা গেল—কী রে, অক্করে সুজা বল করলি ক্যান?
খেলার দিকে চোখ রেখে সুমন বলল—বল তো ঘুরে না স্যার!
—ঘুরে না মানে? তুই বলডা ধরছিলি ক্যামনে?
—ওইত্তো, প্যাট বরাবর আঙ্গুল দিয়া প্যাঁচাইয়া ধরছি।
—গাধার গাধা। প্যাটের উপ্রে ধরবি ক্যান? গ্রিপ ধরবি বলের সুতার উপর।
—বুঝি নাই তো স্যার। আমি তো মনে করছি সুতার উপ্রে খালি পেস বোলাররা গ্রিপ ধরে। বাড়ি তো খাইয়ালাইছি, অহন কী করুম? বল করতে দিব আর তারেক ভাই?
—মন খারাপ করিছ না। শেষের দিকে বল করিছ। তারেকরে কইয়া দিমুনে। আগে ওই রহিম আউট হইয়া নেক। খুব ছাতাইতাছে পোলাডা। আইজকা অন্নদা হারলে কোয়ার্টার ফাইনাল বাদ।
স্যার হতাশায় মাথা নাড়েন। সুমনও মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ কিপার চিৎকার তুলল, ক্যাচ...ক্যাচ...সুমইন্যা ক্যাচ ছাড়িছ না!
রহিম তুলে মেরেছে। বাউন্ডারির ঠিক ওপরে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করল সুমন, অন্তত এক ফুট ওপর দিয়ে বল চলে গেল সীমানার ওপারে। রঞ্জিত স্যার দড়ির পেছনে বিমর্ষ মুখে লাফ দিয়ে ক্যাচটা ধরে ফেরত দিলেন সুমনকে। তারপর বললেন—যা, আরেকবার চেষ্টা কইরা দ্যাখ। সুতার উপ্রে আঙ্গুল ধরবি। আর খবরদার, লোপ্পা বল দিবি না।
সুমনের হাতে আবার বল দেওয়া হয়েছে। তারেক ভাই গজগজ করছে—যা বল কর। খাবি তো চাইর আর ছক্কা। ওই মইন্যা পিছে যা। আবুল সাত পা পিছা। সিঙ্গেল আটকানির দরকার নাই, চাইর-ছক্কা আটকা।
প্রথম বলটা একটু ঝুলে গিয়ে পড়ল ঠিক লেগ স্ট্যাম্প বরাবর, রহিম হিসাবমতো লেগের দিকে দুই পা সরে গিয়ে তুলে মারতে গিয়েই দেখে মিডল স্ট্যাম্প হাওয়া! সুমন একটা চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠল, আমার বল ঘুরছে, আমার বল ঘুরছে। লাফ দিয়ে নিচে পড়ার আর উপায় নাই। তারেক ভাই কোলে তুলে নিয়েছে। কোলে তুলে বিড়বিড় করে বলছে—আমরার সুমনের বল ঘুরে, আমরার সুমনের বল ঘুরে!
২.
বাসায় বিচার বসেছে। শক্ত বিচার। সুমনের আব্বা জেলা জজকোর্টের পেশকার হাফিজ সাহেব। ঘুষ খেতে পারেননি বলে টাকাপয়সা হয়নি। আজকে কী একটা কাজে অন্নদা স্কুলের ওখানে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে স্কুলে সুমনের খোঁজ করায় শুনতে পেয়েছেন স্কুল টিমের হয়ে খেলতে গেছে সুমন! বাসায় ফিরে তাই বিচার বসিয়েছেন।
সুমন খাটের কাছটায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বার মারের ইস্টিশন নাই। মাস ছয়েক আগে বিকেলবেলা খেলতে গিয়ে মাগরিবের আজানের পর বাসায় এসেছিল সে। শক্ত মার খেয়েছিল সেদিন। ওই মারের ধকল যেতেই সময় লেগেছিল সপ্তাহখানেক। আজকেও অমন মার খেলে বিছানা থেকে আর ওঠা লাগবে না।
আব্বা চুপ করে আছেন। তার মানে সামনে বিপদ। যেকোনো সময় মুখ খুলবেন। তার একটু পরে হাত। বিপদ বুঝে পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন আম্মাও। তেমন কিছু হলে ঠেকাতে হবে।
আব্বা ধরা গলায় বললেন—সারা দিন পাগলের মতোন খাটি। ক্যান খাটি? তোরে ঠিকমতোন মানুষ করার লাইগ্যাই তো! তোর আম্মার ঠান্ডা পানি খাওনের নেশা, তারে এই পর্যন্ত একটা ফ্রিজ কিন্যা দিতে পারলাম না। তুই মানুষ হইয়া চাকরিবাকরি কইরা কিন্যা দিবি এই আশায় আছি। আর তোর ইস্কুলে গিয়া দেখি খেলতে গেছোছ গা? এমুন পুলা আমার দরকারই নাই। বলেই আব্বা একটা কচি জিংলা বের করলেন। সুমনের আম্মা ‘করেন কী, করেন কী’ বলে সুমনের আব্বার হাত ধরতে গেলেন।
এমন সময় জানে ঠান্ডা কোক আসার মতোই সুমন শুনতে পেল রঞ্জিত স্যারের গলা—সুমন আছোছ নাকি? সুমন?
লাফ দিয়ে বাইরে এল সুমন। রঞ্জিত স্যার এসেছেন। পেছনে তারেক ভাই।
স্যার বললেন—কী রে, আজকে তো ভালাই বল করলি!
ঘরের ভেতর জিংলা হাতে আব্বা আর বাইরে স্যারের একেবারে বাড়িতে এসে প্রশংসা, সুমন কী বলবে বুঝতে না পেরে মাথাটা চুলকাল একটু।
এর মধ্যে আব্বা বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। সুমন আড়চোখে দেখল, হাতের জিংলাটা নেই।
স্যার বললেন—আদাব ভাই সাহেব। আপনার লগেই কথা কইতে আইছি। আপনের পোলাডা লেগস্পিন ভালা পারে। আমি দেখছি তো, আমার এই সব চিনতে ভুল হয় না।
আব্বা মারের মুডে ছিলেন, হুট করে এই সব ক্রিকেটের কথায় কী বলবেন বুঝতে পারলেন না।
স্যার বললেন—তিন মাস পরে একটা স্পিনার হান্ট আছে। সারা দেশের থিক্কা বাছাই কইরা স্পিনার নেওয়া হইব। ঘষামাজা করন গেলে সুমনের ভালা একটা চান্স আছে। এই তিনডা মাস ওরে একটু প্র্যাকটিস করনের সুযোগ দিয়েন।
আব্বা অস্ফুট স্বরে বললেন—কিন্তু হের পড়াশুনা...
স্যার বললেন—আরে, এইডা আমার উপ্রে ছাইড়া দ্যান। পড়াশুনা ক্যামনে এর মধ্যে কাভার করব, হেইডা আমি বুঝুম।
আব্বা বললেন—কিন্তু স্যার, তিন মাস পরে হান্ট না কী কইলেন, ওইডার পরে কিন্তু আমি হেরে খেলাধুলায় আর দেখতাম চাই না।
স্যার বললেন—হান্টে টিইক্যা গেলেগা তো হেরে নিয়া আপনের আর চিন্তা করনই লাগব না। আপনে খালি তিনডা মাস হেরে সুযোগটা দ্যান।
পরদিন বেলা দুইটায় ছুটির পরে শুরু হলো সুমনের যুদ্ধ। স্যার বললেন—তোরে নিয়া আমি চেষ্টা করতাছি কিয়ের লেইগ্যা জানস? কারণ, আমরার স্পিনার আছে বহুত, লেগ স্পিনার খুব কম। আর যারা আছে, সবডি কবজির স্পিনার। তোরেই দেখলাম খালি আঙ্গুলের স্পিনার।
সুমন নিজের আঙুলের দিকে তাকাল। কবজির স্পিনার কী, আর আঙুলের স্পিনার কী—এই ব্যাপারটা সে বোঝেনি এখনো।
স্যার বললেন—লেগস্পিনের সবথিকা বড় অসুবিধা হইল আলগা বল। বলের কন্ট্রোল থাকতে হইব সবথিকা বেশি। আইজকা তোর ট্রেনিং হইব পয়সা দিয়া। আমি পিচে একটা পয়সা রাখুম, তুই বোলিং কইরা ওই পয়সার উপ্রে বল ফালাইবি।
শুরু হলো সুমনের ট্রেনিং। অন্নদা স্কুলের সবাই দেখল, পাগলাটে পিটি শিক্ষক রঞ্জিত স্যার ছুটির পর থেকে সন্ধ্যা হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই সুমনকে নিয়েই পড়ে থাকেন। এমনিতেই স্যার একা মানুষ, বিয়েশাদি করেননি। সুমনকে সময় দিতে অসুবিধা নেই তাঁর।
তিন দিন একটানা বল করে সুমনের মনে হতে লাগল মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। চার নম্বর দিনে ওভার চারেক বল করেই পিচে বসে হাঁপাতে লাগল সে। স্যার বললেন—হাঁপাস ক্যান? বল নাই শইল্লে?
সুমন বলল—দিশা পাই না স্যার। মাথা ঝিমঝিম করে।
স্যার বললেন—দুধ খাস না যে, এমনই তো হইব। আমি তিনু গোয়ালারে কইয়্যা দিতাছি, সক্কালবেলা তোর বাড়িতে এক লিটার কইরা দুধ দিয়া যাইব। দাম আমি দিমু! উইঠ্যা খাড়া, এই ওভারে পয়সার উপ্রে সবডি বল ফালাইতে পারলে পয়সা তোর।
প্রতিদিন দুধ খাওয়ানোর সংগতি সুমনের বাবার নেই। সংসার চালিয়ে দাদা-দাদির জন্যও খরচ পাঠাতে হয় গ্রামে। কিন্তু স্যারের কাছ থেকে পয়সা নিতে সুমনের বাধো বাধো ঠেকছিল। স্যারকে বারণ করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু স্যার ওই প্রসঙ্গে কথা বলার সুযোগই দিলেন না। সারা দিনে টানা ছয়টা বল পয়সার ওপরে ফেলতে পারল দুইবার। দুই টাকা নিয়ে সুমন ঘরে ফিরল, ক্রিকেট খেলে তার জীবনের প্রথম রোজগার।
...
মাসখানেক পর একদিন টিফিন টাইমে স্যার টিচার্স রুমে ডাকলেন সুমনকে।
—কী রে, পড়াশুনার কী অবস্থা?
—চালাইতাছি স্যার। সন্ধ্যাবেলায় টাইম নষ্ট করি না। নাইলে আব্বা আর খেলতে দিব না।
—অহন বল দ্যাখতাছি কন্ট্রোলে আইছে তোর। একটা নতুন জিনিস দেহি শিখন যায় কিনা। আমার হাতে এইডা কী, ক তো?
—ইস্মার্ট ফোন।
—হ, হেডস্যারের এইডা। ধার আনছি আধা ঘণ্টার লাইগ্যা। এইডার মইধ্যে ইউটিউব বইল্যা একটা জিনিস আছে। ওইহানে দেখলাম শেন ওয়ার্ন গুগলি বোলিং শিখাইতাছে। হেডস্যার আমারে বাইর কইর্যা দিছে মুবাইলে। আমি দেহাইতাছি খাড়া।
ছাত্র-শিক্ষক মিলে বিশ মিনিট তন্ময় হয়ে দেখল শেন ওয়ার্নের ক্লাস। ধর্ম শিক্ষক ওয়ালিদ স্যারের গলা খাঁকারিতে হুঁশ ফিরল। ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেছে। শিক্ষকেরা সবাই ক্লাস নিতে যাচ্ছেন।
সেই দিন ছুটির পরে শুরু হলো নতুন অধ্যবসায়। গুগলি বোলিং। এই বোলিং লেগস্পিনের ভঙ্গিতেই করতে হয়, কিন্তু বল পিচে পড়ার পরে দিক বদলে অফস্পিন হয়ে যায়। ওয়ার্ন পই পই করে বলে দিয়েছেন, খুব ঘন ঘন গুগলি করা যাবে না। এটা দিতে হবে হুট করে, যেন ব্যাটসম্যান বোকা বনে যায়।
ওয়ার্নের হাতে যেটা মনে হচ্ছিল মোয়ার মতো সহজ, হাতে-কলমে করতে গিয়ে দেখা গেল কিছুই হচ্ছে না! উল্টো হাতের থেকে ছুটে গিয়ে ফুলটস হয়ে গেল। রঞ্জিত স্যারের কড়া নিয়ম। ভুল হলেই দশটা বুকডন। আজকে শ দুয়েকের মতো বুকডন জমা হয়ে গেছে। এক দিনে অত করা যাবে না। কিস্তিতে শোধ করতে হবে।
রঞ্জিত স্যার বিড়বিড় করে বললেন—গাধার গাধা। তোরে ইউটিউব দেহানোই ভুল হইয়া গেছে। যা ঠিক কইরা বল কর।
সুমন আবার চেষ্টা করল। বল দেড় হাত দূর দিয়ে ওয়াইড হলো। সুমন মনে মনে গুনল ‘দুইশো দশ’। একটু দূর থেকে অস্পষ্টভাবে শুনল রঞ্জিত স্যারের গলা—গাধার গাধা।
৩.
গুচ্ছের বাচ্চা বাচ্চা স্পিনার জড়ো হয়েছে। আজকে স্পিনার হান্টের প্রাথমিক রাউন্ড। কোচ শফিউল গণির হাতে এক কাপ চা। শীতে হাত-পা জমে যাওয়ার অবস্থা, বাচ্চাগুলো বল গ্রিপ করবে কীভাবে?
শফিউল গণির আজকে আসার কথা না। প্রাথমিকভাবে সিলেক্টেড বাচ্চাদের নিয়ে মাস তিনেক তিনি কাজ করবেন। তারপর ফাইনাল রাউন্ড। তার পরও বিভাগীয় পর্যায়ের সবগুলো হান্টেই তিনি আসছেন। জহুরির চোখে দেখে নিচ্ছেন হীরা-মানিক।
রঞ্জিত স্যারের ধারণা ছিল, যে প্রস্তুতি হয়েছে, তাতে সহজেই প্রাথমিক রাউন্ড উতরানো যাবে। আসার পর অবস্থা দেখে দমে গেছেন। অনেক বাচ্চাকাচ্চা আছে ছোটবেলা থেকেই সিরিয়াসলি ক্রিকেট নিয়ে আছে। এরা স্পিনার হান্টে অংশ নিচ্ছে, সামনে বিকেএসপিতে অ্যাডমিশন টেস্ট দেবে। ক্রিকেট এদের লাইফ কালচার।
শফিউল গণির চোখ কুঁচকে আছে। স্পিনার যা পাওয়া যাচ্ছে মান খারাপ না। এত ছোট বয়সে আর কী-ই বা আশা করা যায়। এদেরই গড়েপিটে নিলে মানুষ হয়ে যাবে। পরিচর্যাটাই আসল কথা।
কিন্তু তারপরও জাত প্লেয়ার বলে একটা কথা আছে। ওই জিনিসটা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। খুলনার হান্টে একজন পেয়েছেন, চায়নাম্যান বোলার। এখানে এখনো কিছু দেখেননি।
সাতাশি নম্বর টোকেন নিয়ে বোলিং মার্কে এসে দাঁড়াল সুমন। রঞ্জিত স্যার হাসিমুখে বসে আছেন দর্শক সারিতে, দেখে মনে হচ্ছে খুব ফুর্তিতে আছেন। কিন্তু সুমন জানে, উৎকণ্ঠায় স্যার ফেটে যাচ্ছেন মনে মনে।
কোনো ব্যাটসম্যান ছাড়া স্ট্যাম্প টু স্ট্যাম্প বল করতে দেওয়া হয়েছে। প্রথম বলটা লেগ স্ট্যাম্প বরাবর পিচ করে সোজা লেগ স্ট্যাম্পের ওপর দিয়ে চলে গেল। পরেরটা ঘুরল, মিডল স্ট্যাম্প বরাবর বল চলে গেল অফ স্ট্যাম্প ঘেঁষে। শফিউল গণি এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কোচকে ডাকলেন—সাতাশি নম্বরটাকে আলাদা করো। একটা ব্যাটসম্যান দাও খেলতে।
স্থানীয় কোচ একটু তাকালেন। সাধারণত সবাইকে স্ট্যাম্প টু স্ট্যাম্প এক ওভার বল করার সুযোগ দেওয়া হয়, কোনো ব্যাটসম্যান থাকে না।
শফিউল গণি আবার বললেন—তুমি কি বুঝতে পারছ, কেন এই ছেলেটার জন্য বিশেষ পরীক্ষা করতে চাচ্ছি? এই ছেলেটার গ্রিপ ফিঙ্গার স্পিনারের। রেয়ার কেইস। একটা ব্যাটসম্যানকে কীভাবে ফেস করে, সেইটা দেখতে চাচ্ছি।
প্যাড-গ্লাভস পরে ব্যাটসম্যান নামল। গ্যালারিতে বসে থাকা রঞ্জিত স্যারের তো এত কিছু বোঝার উপায় নেই। ব্যাটসম্যানকে দেখে বিড়বিড় করলেন—গাধাটা কী করল আবার? ব্যাটসম্যান নামে ক্যান?
প্রথম দুইটা বল লেগ স্ট্যাম্পের একটু বাইরে পিচ করে মিডল স্ট্যাম্প বরাবর আনল সুমন। ফরোয়ার্ড ডিফেন্সে গিয়ে ব্লক করল ব্যাটসম্যান। তৃতীয় বলটা একটু ঝুলে গিয়ে পড়ল অফ স্ট্যাম্পের একটু বাইরে বরাবর। লোপ্পা বল দেখে সামনে এগোল ব্যাটসম্যান। আরও বাইরে যাওয়ার আগে লং অফে তুলে দিলেই ছক্কা...ঠক করে কী যেন শব্দ হলো, ব্যাটসম্যান তাকিয়ে দেখে তার মিডল স্ট্যাম্প উড়ে গেছে!
হতভম্ব ব্যাটসম্যান স্ট্যাম্পের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। যেই বল অফ স্ট্যাম্পের পাঁচ-ছয় ইঞ্চি দূরে দিয়ে যাওয়ার কথা, সেটা মিডল স্ট্যাম্পে এল কীভাবে? কাঁধ ঝাঁকিয়ে পরের বল খেলার জন্য স্ট্যান্স নিল। ওদিকে হতভম্ব হয়ে বসে আছেন শফিউল গণি। তাঁর চোখের সামনে তেরো বছরের এক বাচ্চা গুগলি ডেলিভারি দিয়ে বসেছে! শেন ওয়ার্নের মুনশিয়ানায় দুইটা বল ক্ল্যাসিক লেগস্পিন দিয়ে অভ্যস্ত করে নিয়েছে ব্যাটসম্যানকে। তারপর লোপ্পা বলের লোভ দেখিয়ে ব্যাটসম্যানকে টেনে বের করে এনেছে। লেগস্পিনের মতো ডেলিভারি, আসলে অফস্পিন। আর ছেলেটার পিচিং খুব সুন্দর, একেবারে যেখানে পড়া উচিত, সেখানেই বল পড়ছে।
শফিউল গণি বললেন—আমার যেটা দরকার ছিল, পেয়ে গিয়েছি। সাতাশি নম্বর রাখো লিস্টে। সাথে আরও দু-একজন ভালো পাইলে লিস্ট করে পাঠায়ে দিয়ো।
বোলিং শেষে সুমন চিন্তিত মুখে স্যারের কাছে গেল। রঞ্জিত স্যারের হাতে কাটা ডাব। সুমনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন—খা।
সুমন বলল—কেমুন হইল স্যার? চান্স পামু?
স্যার বললেন—ক্যামনে কমু? ভগবান কপালে রাখলে হইব।
দুজনেই টেনশনে আছে। হান্টের রেজাল্ট আগামীকাল জানানো হবে। রেজাল্ট জেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রেন ধরবে দুজনে। কী হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
৪.
তিন মাস পরের ঘটনা। সুমনের ছোট্ট জীবনে একই সঙ্গে দুইটা অনেক বড় ঘটনা ঘটে গেছে। কোনোটাই ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
প্রাথমিক হান্টের পরদিন জেনেছিল চট্টগ্রাম বিভাগের দেড় শ বাচ্চার মধ্যে তিনজন সিলেক্ট হয়েছে। তার মধ্যে সুমনের নাম আছে! স্যারই দুই কেজি মিষ্টি কিনে তারপর সুমনের আব্বা-আম্মাকে মিষ্টি খাইয়ে এসেছেন।
তারপর তিন মাস ঢাকায় ট্রেনিং। কোচ শফিউল গণি কত কিছু শিখিয়েছেন! গুগলি কোন মোক্ষম সময়ে করলে আরও ভালো হয়, কোনটা ফ্লিপার, কোনটা টপস্পিন। সবচেয়ে যে বড় জিনিস, ব্যাটসম্যানের সঙ্গে মাইন্ডগেম খেলা।
মাঝখানে পনেরো দিনের ছুটিও দেওয়া হয়েছিল সবাইকে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা। এই কয়টা দিন মোটামুটি রঞ্জিত স্যারের বাড়িতেই কাটাতে হয়েছে। স্যার বলেছিলেন—এই সময় ক্রিকেট নিয়ে কথা কইলেই চড় খাইবি। পাস তোরে করতেই হইব।
আজকে এই তিন মাসের ট্রেনিং আর অ্যাসেসমেন্টের রেজাল্ট দিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সুমন হায়দার বারোজনের ফাইনাল দলের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বোর্ড সভাপতি নিজে তার হাতে ক্রেস্ট তুলে দিয়েছেন। আর পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক!
এটাই ছিল প্রথম ঘটনা।
এই সময়ে গ্যালারিতে থাকার কথা ছিল রঞ্জিত স্যারের। তিনি আসেননি। সুমনের আব্বা এসেছেন। আব্বার মুখ থেকেই সুমন শুনল দ্বিতীয় ঘটনাটা। রঞ্জিত স্যারের স্ট্রোকমতোন হয়েছে। মানে ধারণা করা হচ্ছে। ডাক্তার এখনো পরিষ্কার কিছু বলেনি। আব্বা স্যারের খবর পেয়ে নিজেই ঢাকায় এসেছেন সুমনকে নিতে।
সুমনের নিজেকে একবারে পাথরের মতোন লাগছে। শফিউল গণি স্যার এই যে আসার সময়ও বারবার বলে দিলেন, দিন পনেরো থেকে সুমনকে আবার চলে আসতে। ঢাকাতেই তার পড়াশোনার ব্যবস্থা হবে। সেকেন্ড ডিভিশনের একটা দলে ঢুকিয়েও দেওয়া যাবে। কিন্তু তাকে চালিয়ে যেতে হবে লেগস্পিনের ট্রেনিং। শফিউল গণি স্যারের কাছেই। দেশে নাকি লেগস্পিনারের এখন খুবই অভাব। কিন্তু কোনো কিছুই তাকে বিন্দুমাত্র আলোড়িত করতে পারেনি। কেবলই মনে হচ্ছে রঞ্জিত স্যার না থাকলে ক্রিকেট খেলে আর কী হবে? পয়সার ওপর পিচ করায়ে আর লাভ কী?
ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দের মধ্যেই সুমন একবার আস্তে করে ডাকল—আব্বা?
হাফিজ সাহেবের তন্দ্রামতোন এসেছিল। জবাব দিলেন—উঁ?
—আব্বা স্যারের তো জমিজমা বউবাচ্চা কিছু নাই। আম্মার লেইগ্যা একটা ফ্রিজ কিননের আপনের বহুত দিনের শখ, আমি জানি। আব্বা, স্যারের লেইগ্যা কিছু ট্যাকা রাখি?
আব্বা সুমনকে অবাক করে দিয়ে বললেন—আরে ব্যাডা, তোর ট্যাকা পাওনের লগে লগে আমি হেডস্যাররে ফোন দিয়া জানাইছি, ট্যাকা বিষয় না। আফনেরা স্যাররে ভালো মেডিকেলে ভর্তি করেন। লাখখানেক ট্যাকা লাগতে পারে সব মিলাইয়া, ইস্কুল দিতাছে অর্ধেক, বাকিডা তুই!
খুশিতে সুমনের চোখে পানি চলে এল। তারপরও বলল—আব্বা, আমি তাইলে আম্মার ফ্রিজটা পরে...
আব্বা বাধা দিয়ে বললেন—দিবিনে পরে। সেকেন্ড ডিভিশনে খেললে ট্যাকা পাইবি না? কয়েকটা মাস বরফের পানি না খাইলে তর আম্মা মরত না!
চলল ট্রেন, চলল সুমন জীবনের পথে ধীরে ধীরে। এভাবেই জীবনের পথ এগিয়ে যায় সমান্তরাল পথ ধরে।
আমরা যদি সেই সমান্তরাল পথে টাইম মেশিনে বছরখানেক এগিয়ে যাই, দেখব বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ দল নিজেদের মাঠে নিউজিল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৬-এর সঙ্গে খেলতে নেমেছে। এগারোজনের মধ্যে একজন আমাদের সুমন। আসলে সবাই এখানে একেকটা সুমন। কেউ হয়তো প্রাচুর্য থেকে উঠে এসেছে, কেউ দারিদ্র্য। কিন্তু প্রত্যেককেই পেতে হয়েছে রঞ্জিত স্যারের মতো কোনো না কোনো প্রেরণা। প্রত্যেকের অন্তরে কেউ না কেউ গেঁথে দিয়েছে স্বপ্ন। একেবারে পুঁইয়ের ডগার মতোই সতেজ তাদের মন, লিকলিকে দেহ। কিন্তু প্রত্যেকের চোখেই কী আত্মবিশ্বাস, কী অদম্য সাহস আকাশ ছোঁয়ার জন্য! ওই সময় সুমন জানবেও না, হেডস্যারের মোবাইল ঘেঁটে রঞ্জিত স্যার ঠিকই বের করে ফেলেছেন খেলার লাইভ স্ট্রিমিং। ইদানীং স্যার আবার হাঁটাচলা শুরু করেছেন, ক্লাস নেওয়া শুরু করেছেন। সুমন কখন বল হাতে নেবে, স্যার উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছেন। উত্তেজনায় হয়তো আবার বলে বসবেন, গাধার গাধা!
হয়তো বাচ্চাগুলোর মাঝেই কেউ হয়ে উঠবে আমাদের বাঘের মতোন হূদয় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মাশরাফির মতোন, সুপারম্যান সাকিবের মতো বিশ্ব জয় করবে কেউ, আবার কেউ-বা ব্যাটটাকে তলোয়ার বানিয়ে তুর্কি নাচন নাচাবে সারা বিশ্বকে, যেমনটা এখন করেন সাকিব-তামিম। বাংলাদেশের এখনো চোখের সামনে আদর্শ হিসেবে কোনো লেগস্পিনার নেই। সুমন কি পারবে ওটা হতে? কে জানে? টাইম মেশিনেরও যে অত দূর জানার ক্ষমতা নেই!