ৎহি অথবা তহি

অলংকরণ: এস এম রাকিব

রায়হান আজ খুব খুশি। তাকে স্কুলে যেতে হবে না। সে অসুস্থ। সত্যি সত্যি অসুস্থ নয়, মিথ্যা মিথ্যা অসুস্থ। আজ স্কুলে গেলেই সমাজ পড়া ধরতেন ফারহানা মিস। পাল রাজবংশ নিয়ে পড়তে কার ভালো লাগে? কেন এসব ইতিহাস পড়তে হবে? কে কবে জন্মগ্রহণ করল, কার পিতার নাম কী ছিল, কে কবে যুদ্ধ করল—এসব পড়ে কী লাভ?

এই তো কদিন আগে বড় বোন দীপার সঙ্গে অনেক ঝগড়াঝাঁটি করল রায়হান। সে তো কাউকে বলেনি তারা দুজন কীভাবে ঝগড়া করেছে, কবে ঝগড়া করেছে, এসব মনে রাখতে?

মাঝে মাঝে এসব প্রশ্ন ফারহানা মিসকে করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো সব করা যায় না। ফারহানা মিস যা রাগী! প্রশ্নগুলো করলেই প্যারেন্টস কল করবে। আজ অবশ্য রায়হান বেঁচে গিয়েছে। স্কুলে না যাওয়ার জন্য অসুস্থ হওয়ার ভান ধরেছে সে।

আজকে এমনিতেই বোধ হয় স্কুলে যাওয়া লাগত না। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে অনেক। বৃষ্টির দিন খুব ভালো লাগে রায়হানের। বৃষ্টির গন্ধ পাওয়া যায়, আকাশ মেঘলা থাকে, শোনা যায় বৃষ্টির শব্দ, প্রচণ্ড গরমে আবহাওয়া ঠান্ডা হয়ে যায়। এই সময় শুধু বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

‘রায়হান, বাবা...ঘুমিয়ে পড়েছিস তুই?’ মা বললেন।

‘না...মা। এখনো...খুক খুক...জেগে আছি...খুক খুক।’ রায়হান কাশার শব্দ করল।

‘আহা রে, কাশি তো অনেক বেড়ে গিয়েছে। নিশ্চয়ই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আইসক্রিম খেয়েছিস, তাই না? এ জন্যই এত কাশি।’

‘আমার কি মনে হয় জানো, মা? আমার মনে হয়, এগুলো সব ওর ঢং। স্কুলে যাবে না, তাই ঢং শুরু করেছে।’ চেঁচিয়ে বলে উঠল রায়হানের বড় বোন দীপা।

আবার খুক খুক করে কাশার শব্দ করল রায়হান।

‘কী যে বলিস তুই, দীপা। বেচারা এত কাশছে আর তুই কী সব যা-তা বলছিস! নে বাবা, তোর জন্য গরম-গরম দুধ এনেছি, খেয়ে ফেল। এই দীপা! তুই বের হয়ে যা তো ওর রুম থেকে! ও একটু দুধটা খেয়ে ঘুমাক। চল আমরা যাই।’

ভেংচি দিয়ে রুম থেকে বের হলো দীপা। দীপা যে কী খারাপ! আরেকটু হলেই মায়ের কাছে ধরা খেয়ে যেত রায়হান। ওকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।

টেবিল থেকে দুধের গ্লাস নিল রায়হান। কিন্তু ওমা! দুধ কই? এ তো খালি কাপ! কাপটা এখনো গরম আছে, কিন্তু দুধ নেই। আশ্চর্য তো! রায়হান বোধ হয় মনের ভুলে এক ঢোকে সব দুধ খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। এত গরম দুধ খেতে গেলে রায়হানের জিব পুড়ে যেত।

তাহলে কি মা মনের ভুলে কাপে দুধ ঢালতে ভুলে গিয়েছে? কিন্তু কাপটা তো এখনো গরম আছে!

রায়হান বোধ হয় অসুস্থ হওয়ার অভিনয় করতে করতে সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। উল্টাপাল্টা জিনিস দেখছে। ঘুমিয়ে পড়াই ভালো।

ঘুমিয়ে পড়ল ও। ঘুম থেকে উঠে দুধের কাহিনির কথা মনে পড়তেই হাসি পেল রায়হানের। অন্যমনস্ক থেকে কিছু খেলে সেটা গরম না ঠান্ডা, সেটা সাধারণত কারও মনে থাকে না। রায়হানেরও হয়তো তা-ই হয়েছে।

রায়হানদের স্কুলটা অনেক বড়। অনেকগুলো ক্লাসরুম, বিশাল মাঠ আছে স্কুলে। একটা অডিটরিয়ামও আছে। রায়হান এখন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। ক্লাসে গিয়ে সে দেখল, বন্ধুরা মিলে একটা বড় কাগজে কী সব যেন লিখছে।

‘কী লিখছিস রে তোরা?’ জিজ্ঞেস করল।

‘ফারহানা মিস আমাদের পাল রাজবংশ এবং সেন রাজবংশ নিয়ে পোস্টার বানাতে বলেছে। তুই কাল এলি না কেন? আমরা কাল কত কাজ করেছি, জানিস?’ বলল সামির।

‘ভালো হয়েছে কাল আসিনি। বেঁচে গিয়েছি।’ রায়হান মনে মনে বলল।

‘তুই কি পোস্টারটা বাসায় নিয়ে যেতে পারবি? কাল ক্লাসের দেয়ালে টাঙাতে হবে।’

‘ঠিক আছে। আমি নিয়ে যাব,’ রায়হান বলল।

বাসায় পৌঁছাল রায়হান। টেবিলে রাখল পোস্টারটি। তারপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসেই প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে যায় সে। নিজের অজান্তেই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল রায়হান। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যা ছটায়। পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েছে সে!

টেবিলের দিকে তাকাতেই হকচকিয়ে গেল সে। ওমা! এ কী হলো! পোস্টারটা কই গেল? ছোট ছোট কাগজের টুকরা পড়ে আছে এবং কাগজগুলো দেখে মনে হচ্ছে এগুলো চিবিয়েছে কেউ। কে চিবাবে? কে পোস্টার খাবে? এখন কী হবে? এখন কী হবে? এমন কোনো প্রাণীর কথা তো মনে পড়ছে না যে কাগজ খায় বা চাবায়। তাহলে এটা কে করেছে? বাবা-মা নিশ্চয়ই এই কাজ করবে না। কে করল তাহলে? দীপা? কিন্তু দীপা কাগজ খাবে কেন? এখন কী হবে? সে ফারহানা মিসকে কী বলবে এখন?

‘আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। কী বলছ, আবার বলো।’ গম্ভীর গলায় বললেন ফারহানা মিস।

‘মিস, আমার বড় বোন পোস্টারটা খেয়ে ফেলেছে।’

‘তোমার বড় বোন কোন ক্লাসে পড়ে?’

‘কলেজে পড়ে।’

‘কলেজে পড়া একটি মেয়ে তার ছোট ভাইয়ের পোস্টার খেয়ে ফেলেছে? ইন্টারেস্টিং! তো শুধু পাল রাজাকেই খেলো, নাকি সেনকেও খেয়েছে?’ গম্ভীর গলায় বললেন তিনি।

চুপ করে রইল রায়হান।

‘কী ব্যাপার? তুমি কি পাল রাজা কে, সেন রাজা কে, তা-ও ভুলে গেলে নাকি? বলো তো, সেন রাজা কে?’

রায়হান উত্তর দিতে পারছে না। কে যেন সেন রাজা? পোস্টারে দুজনের ছবি একসঙ্গে লাগিয়েছিল। তাহলে কি পালের ভাই? পালের ভাই হবে তাহলে।

‘পালের ভাই।’ রায়হান উৎসাহ নিয়ে বলল।

‘পালের ভাই? তাহলে পাল রাজা কে? তোমার শ্বশুর?’

‘মিস, আমি তো এখনো বিয়ে করিনি।’

‘তোমার বিয়ে আমি দিয়ে দিচ্ছি।’ রেগে বললেন ফারহানা মিস।

চুপিচুপি বাসায় ঢুকল রায়হান। আজ বাসাটা কেমন নিশ্চুপ লাগছে। সাধারণত রায়হান যখন কোনো অপরাধ করে, তখন একটা বড় ঝড় অপেক্ষা করে তার জন্য। বাসা এ রকম নিশ্চুপ হয়ে যায়। গম্ভীর হয়ে যায় মা-বাবা। কথা বলে শীতল স্বরে। আর দীপার মুখে দেখা যায় মুচকি হাসি।

প্রতিটা ভয়ংকর দিনে দীপা বলে ওঠে, ‘আজ তো তোকে ছেঁচা দেওয়া হবে!’

আজও দীপা একই কথা বলল। দীপার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের রুমে ঢুকল রায়হান।

দীপা আবার বলে উঠল, ‘তুই নাকি ফারহানা মিসকে বলেছিস যে তোর বিয়ে করার খুব ইচ্ছা! হি হি!’ হেসে বলল দীপা।

নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিল রায়হান। যেকোনো মুহূর্তে বাবা-মা ডাকবে ওকে। তারপর রুমের দরজা বন্ধ করে ঠান্ডা গলায় খানিকক্ষণ বকবে।

ঠান্ডা গলায় যখন বকা দেয়, তখন যা ভয় করে! এর থেকে তার চিৎকার করে বকা দিলেই ভালো হতো।

কেন সবাই তার সঙ্গে এ রকম করে? যা সত্যি, তা-ই তো বলেছে সে। দীপা না খেলেও, কেউ তো একজন পোস্টারটা খেয়েছে। সেই একজনটা কে?

‘রায়হান!’ শীতল গলায় ডাকলেন মা। শেষ! রায়হান এখন শেষ হয়ে যাবে। দুই ঘণ্টা ধরে বকা শুনতে হবে ওকে। ভাবতে ভাবতে কেঁদে ফেলল সে। খুব দ্রুত চোখ মুছে ঘর থেকে বের হলো সে। ঢুকল মা-বাবার রুমে। মা দরজা আটকে দিল।

‘রায়হান, তোমার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে। তুমি বোধ হয় জানো যে আমরা কী ব্যাপারে কথা বলব। জানো না?’ গম্ভীর গলায় বললেন বাবা।

‘হ্যাঁ...বাবা।’

‘রায়হান, তুমি যে প্রতিদিন গোসলের পর গিজার বন্ধ করো না, এটা কি ঠিক? বিদ্যুতের অপচয় হয় এভাবে। তুমি এখন থেকে গোসল করার পর গিজার বন্ধ করে দেবে। ঠিক আছে?’ বাবা বললেন। চমকে গেল রায়হান। ব্যাপার কী? রায়হান তো ভেবেছিল ফারহানা মিস মা-বাবাকে নালিশ করেছেন। তাই মা-বাবা বকবে। কিন্তু তারা তো বকছে অন্য কারণে। আচ্ছা, প্রথমে ছোট ছোট ব্যাপারে বকবে। তারপর যাবে বড় ব্যাপারে। একটু পর শুরু হবে অ্যাটাক।

‘আর কখনো যেন এ রকম না হয়।’ মা বললেন।

‘আ...আচ্ছা।’ রায়হান ভয়ে ভয়ে বলল।

রুমের দরজা খুলে দিল বাবা। মা-ও উঠে পড়ল।

‘কী? তুই এখনো বসে আছিস কেন?’ মা অবাক হয়ে বলল।

‘এতটুকুই?’

‘এতটুকুই মানে?’

‘মানে...তোমাদের ফারহানা মিস ফোন দেননি?’ রায়হান বলে উঠল।

‘ফারহানা মিস কেন ফোন দেবেন? তুই কি আবার কিছু করেছিস নাকি?’ মা বলল।

‘না, ওই যে ফারহানা মিস বেতন দিতে বলেছিলেন তো, তাই আরকি।’

‘ঠিক আছে, কাল দিয়ে দেব।’ বাবা বললেন।

ঘাবড়ে গেল রায়হান। ব্যাপারটা কী? ফারহানা মিস ওর চোখের সামনেই তো বাবা-মাকে ফোন দিয়েছিলেন! বাবা-মা কি কোনো কারণে ভুলে গিয়েছে? কেন ভুলে যাবে? দীপার রুমে ঢুকল রায়হান।

‘এই! মা–বাবা তো আমাকে ছেঁচা দেয়নি।’ রায়হান বলল।

‘তো আমি কী করব? মা–বাবাকে গিয়ে বলব যেন তোকে ছেঁচা দেয়?’ গম্ভীর স্বরে বলল দীপা। একটু আগে শয়তানি হাসি দিচ্ছিল ও। তবে এখন তার মুড খুব খারাপ। এর কারণ কী?

‘কিন্তু তুমি যে বললে বাবা-মা আজ আমাকে ছেঁচা দেবে?’

‘বিরক্ত করবি না, রায়হান। আমি একবারও এই কথা বলিনি। যা ভাগ! আমার পড়া আছে।’

রুম থেকে বের হলো রায়হান। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। ওরা কি সবাই বিষয়টি ভুলে গিয়েছে? কেউ কি ওদের ভুলিয়ে দিয়েছে? কে ভুলিয়ে দিয়েছে?

রায়হান চিন্তিত মুখে তার রুমে ঢুকল। হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পেল সে। কে কাঁদে? টেবিলের নিচ থেকে আসছে কান্নার শব্দটা। টেবিলের নিচে বসে কে কাঁদবে? দীপা? কিন্তু দীপা তো নিজের রুমে। সেখানেও টেবিল আছে। রায়হান টেবিলের কাছে গেল। নীল রঙের কী যেন একটা পেছন ফিরে আছে। ভয় পেয়ে গেল ও। নীল রঙের কোনো প্রাণী ওর টেবিলের নিচে ঢুকল কীভাবে? বাবা-মাকে কি ডাকা উচিত? নাকি নিজেই তাড়াবে প্রাণীটিকে?

আশ্চর্য! প্রাণীটি অবিকল মানুষের মতো কাঁদছে। হাতে একটি স্কেল নিল রায়হান। স্কেলটি নাড়িয়ে বলল, ‘হুশ! হুশ!’

এবার সামনে ফিরল প্রাণীটি।

কিন্তু একি! এ তো কোনো জন্তু নয়। এ তো মানুষ। ৭-৮ বছরের একটি বাচ্চা। তবে গায়ের রং নীল। ওমা! একি! ধীরে ধীরে তার গায়ের রং বেগুনি হয়ে গেল। প্রাণীর মতো মানুষটি চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে রায়হানের দিকে।

‘হ্যা..লো’ প্রাণীর মতো মানুষটি বলল। কথাও বলতে পারে এটা? ইংলিশ বলছে। জিনিসটা আসলে কী?

‘তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?’ প্রাণীর মতো মানুষটি বলল। বাংলাও বলছে। ব্যাপারটা কী?

‘তুমি কে?’ রায়হান বলল।

‘আমি ৎহি।’

‘তহি?’

‘তহি না! ৎহি’, হালকা লাল হয়ে বলল ৎহি।

‘তুমি কী?’

‘আমি কী মানে?’ লাল হয়ে বলল ৎহি।

‘মানে তুমি জিনিসটা কী?’

‘ও আচ্ছা। আমি হলাম ভূত।’

‘ভূত?’

‘হ্যাঁ।’ সাদা হয়ে গেল ৎহি।

‘তুমি তাহলে এ রকম রং পরিবর্তন করছ কীভাবে?’

‘এটা আমাদের নিয়ম।’

‘কাদের নিয়ম?’

‘ভূতদের!’ ৎহি আবার লাল হয়ে গেল।

‘এ রকম নিয়ম কেন?’

‘যেন সবার এক্সপ্রেশন বোঝা যায়। একটু আগে আমি নীল ছিলাম, কারণ আমার মন খারাপ ছিল, আমি কাঁদছিলাম। এরপর আমার রং বেগুনি হয়েছে। কারণ, তোমাকে দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম। তারপর আমি লাল হয়েছি। কারণ, তোমার কথায় রাগ হয়েছিলাম। এখন সাদা, কারণ আমি এখন নরমাল। আমার কোনো অনুভূতি নেই। যদি এখন খুশি হই, তাহলে আমি হলুদ হয়ে যাব। আর যদি আমি লজ্জা পাই, তাহলে হব গোলাপি। বুঝেছ?’

হাঁ করে তাকিয়ে থাকল রায়হান। মানুষদেরও এই পদ্ধতি থাকলে ভালো হতো। অনেক মানুষ আছে, বলে এক রকম কিন্তু তার মন থাকে অন্য রকম। এই পদ্ধতি থাকলে বোঝা যেত মানুষের আসল অনুভূতি।

‘তুমি কার ভূত? মানে কার মৃত্যুতে তুমি ভূত হয়েছ?’

‘এই যে! তোমরা মানুষেরা আরেকটা জিনিস ভুল ভাবো। তোমরা ভাবো, মানুষ যখন মারা যায়, তখন তারা ভূত হয়। এটা ঠিক নয়।’ হালকা লাল হয়ে বলল ৎহি।

‘তাহলে কোনটা ঠিক?’

‘আসলে মানুষদের যখন ১৮ বছর হয়, তখন তাদের একটা ছোট ভার্সন ভূত হয়ে যায়।’

‘মানে?’

‘তোমার যখন ১৮ বছর হবে, তখন তুমি ৭-৮ বছরে যে রকম ছিলে, সেটার একটা ভার্সন ভূত হয়ে ভূতের দুনিয়ায় চলে যাবে। সেখানে সব ভূতেরই বয়স ৭-৮ বছর। যেমন আমার বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানির বয়সও কিন্তু ৭-৮ বছর। তবে যেহেতু তারা অনেক আগে ১৮ বছর অতিক্রম করেছিল এবং অনেক আগেই ভূত হয়েছিল, এ জন্য তাদের বড় বলা হয়।’

‘আমি বুঝি নাই।’

‘না বোঝার মতো কিছু তো এখানে নাই।’

‘আচ্ছা, তহি! আমারও কি কোনো ছোট ভার্সনের ভূত আছে তোমাদের দুনিয়ায়?’

‘বললাম তো, তোমার এখনো ১৮ বছর হয়নি। তাই তোমার ভূতও এখনো আসেনি। তবে তোমার বোনের ভূত এসেছে। কারণ তার বয়স ১৮ হয়েছে।’

‘তাহলে দীপার ভূত কে? তুমি তাকে চেনো?’

‘আমি তাকে চিনব কীভাবে? একটা মানুষ থেকে ভূত হওয়ার পর তার চেহারাও পাল্টে যায়, নামও পাল্টে যায়। যেমন আমার নাম ৎহি, তবে আমার মানুষ ভার্সনের নাম কিন্তু ৎহি ছিল না।’

‘তহি, আমার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে, তুমি দীপার ভূত ভার্সন। কারণ দীপাও রাগী, তুমিও রাগী। হি হি হি হি হি হি!’ লাল ও গোলাপির মিশ্রণ দেখা গেল ৎহির মুখে। মানে সে লজ্জাও পাচ্ছে, আবার রাগও হচ্ছে।

‘আমার নাম ৎহি! তুমি তহি বলছ কেন?’

‘তোহি।’ রায়হান হেসে বলল।

‘ৎহি!’

‘তুহি’ ৎহি এবার একদম গভীর রক্তের মতো লাল রঙে পরিণত হলো। রায়হান বুঝতে পারল, আরও মজা করলে বিপদ হতে পারে। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টাতে হবে।

‘আচ্ছা, তুমি মানুষের দুনিয়ায় কেন এসেছ?’ ৎহি এবার পুরো গোলাপি হয়ে গেল। কী ব্যাপার? এত লজ্জা পাচ্ছে কেন সে?

‘আমি...ফেল করেছি। তাই...পালিয়ে এসেছি।’ রায়হান হো হো হো হো করে হেসে দ্রুত সামলে নিল। অন্যরা শুনতে পেলে সন্দেহ করে বসতে পারে। গোলাপি হতে হতে কেমন জানি নীল হয়ে উঠল ৎহি।

‘কোন সাবজেক্টে ফেল করেছ?’

‘শারীরিক শিক্ষায়।’

‘এই সাবজেক্টে কেউ ফেল করে?’ আবারও হাসতে লাগল রায়হান।

‘কী করব বলো, আমি শারীরিক শিক্ষায় খুবই কাঁচা।’

‘তা-ই! তাহলে পাকা কোনটায়?’

‘মানুষের মাথার ভেতরে ঢুকতে পারাতে।’

‘কী! তুমি মানুষের মাথার ভেতরে ঢুকতে পারো?’

‘হ্যা, পারি। ওটা তো খুবই সহজ একটা ব্যাপার। আমি আজকেই তো তোমার বাবা, মা আর বোনের মাথায় ঢুকেছিলাম।’

‘কী বলছ তুমি এটা?’

‘হ্যাঁ...আমি আজ অবশ্য তোমার মাথাতেও ঢুকেছিলাম।’

‘আমার মাথাতে!’

‘হুম! তোমার মাথাতে ঢুকে যখন দেখলাম, আমি তোমার পোস্টার চিবিয়েছি বলে তুমি মিসের কাছে বকা খেয়েছ, তখন আমার খুব খারাপ লেগেছে...’

‘তুমি আমার পোস্টার খেয়েছ? তাহলে গ্লাসে রাখা দুধও তুমি খেয়েছ?’ চেঁচিয়ে উঠল রায়হান।

‘সে জন্যই তো সবাইকে আমি সব ঘটনা ভুলিয়ে দিয়েছি, যাতে তুমি বকা না খাও পোস্টারের জন্য। আর তখন আমার খুব খিদে লেগেছিল, কী করতাম?’

‘ও...এবার আমি সব বুঝতে পারছি। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে তহি।’ খুশি হয়ে বলে উঠল রায়হান। ‘কিন্তু তুমি শারীরিক শিক্ষায় কীভাবে ফেল করলে, এটা বলো তো…’

ঠিক তখনই রুমে ঢুকল দীপা।

‘কিরে রায়হান? তুই কার সঙ্গে কথা বলিস?’

‘কারও সঙ্গে কথা বলছি না তো।’

‘আর তুই কোন সাবজেক্টে ফেল করেছিস?’

‘কোনো সাবজেক্টে ফেল করিনি!’ আড়চোখে টেবিলের নিচে তাকাল রায়হান। ৎহি নেই! চলে গিয়েছে।

‘একদম মিথ্যা কথা বলবি না!’ আমি শুনেছি, কার সঙ্গে যেন বলছিলি যে তুই ফেল করেছিস। এই বয়সে ফেল করলি কীভাবে, রায়হান? আমি জীবনে একবার ফেল করেছিলাম। যখন আমার সাত বছর ছিল। আর তুই এই বুড়ো বয়সে এসে ফেল করছিস? ছি!’

‘তু...তুমি সাত বছর বয়সে ফেল করেছিলে?’

‘হ্যাঁ, কত আগে করেছিলাম। তোর মতো নাকি?’

‘কোন সাবজেক্টে ফেল করেছিলে?’

‘শারীরিক শিক্ষায়।’ লজ্জা পেল দীপা। চমকে গেল রায়হান। একি! একি! এটা কী হলো!

‘তহি!’ রায়হান চেঁচিয়ে বলল।

‘তহি মানে?’ দীপা জিজ্ঞেস করল।

‘দীপা, তুমিই তাহলে তহি!’ রায়হান খুশি হয়ে বলে উঠল।

‘কী বলছিস এসব তুই?’

‘আরে না! কিছু না, মজা করছি। হিহিহিহি।’

কিন্তু রায়হান জানে, মোটেই মজা করছে না সে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সপ্তম শ্রেণি, ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা