এক
২৯ ডিসেম্বর ২০২২। বৃহস্পতিবার।
গবেষণাগারে বসে আছেন মহসিন শারমিন। ঈষৎ হাঁ হয়ে আছে তাঁর মুখ। অবাক তো হয়েছেন বটেই, তবে এখন তিনি আসলে চিন্তা করছেন গভীরভাবে। কোড সাজাচ্ছেন মাথায়। সিমুলেশন নিয়ে ভাবছেন।
গবেষণাগারটির অবস্থান রাজধানী ঢাকা থেকে খানিকটা দূরে, সাভারের বলিভদ্র এলাকায়। সাধারণত ঢাকার বাইরে এ রকম বড় গবেষণাগার বানানো হয় না। কিন্তু এই গবেষণাগারটি বুঝেশুনে, পরিকল্পনা করেই বানানো হয়েছে এখানে। ব্যক্তিমালিকানাধীন এ গবেষণাগার বাইরের মানুষের কাছে কৃষি গবেষণাগার হিসেবে পরিচিত। কৃষি নিয়ে কাজও করা হয় এখানে। এই কিছুদিন আগেই নতুন একধরনের ধানের বীজ কৃত্রিমভাবে বানিয়েছেন তাঁরা। বছরে মোট ১২ বার ধান হয় এই বীজে, মাসে একবার। বীজটির নাম রাখা হয়েছে ‘সুপ্তরাগ’। শিগগিরই এটি বাজারে আসতে পারে। হয়তো দেশের মানুষের খাদ্যের অভাব মেটাতেও ভূমিকা রাখবে এ বীজ।
তবে আরও নানা রকম গবেষণা হয় এই গবেষণাগারে। বিভিন্ন অণুজীব আর প্রাণীর জিন নিয়ে যেমন গবেষণা হয়, তেমনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান, সৃষ্টিতত্ত্বের নানা বিষয় নিয়েও গবেষণা করেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশে বসে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে, সংগৃহীত তথ্য নিয়ে গবেষণা করা কঠিন। আকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য যে ধরনের উন্নত দুরবিন বা নভোদুরবিন লাগে, তা এ দেশের টাকা ডলারে বদলে নিয়ে কেনা কিংবা বানানো আর আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখা একই কথা। তা ছাড়া আলোকদূষণের বিষয় তো রয়েছেই। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করে যেসব তথ্য পান, সেসব তথ্যের কিছু এমনিতেই সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। গোপনীয় তথ্যগুলোর কিছু আবার অল্প মূল্যে কিনে নেওয়া যায়। টাকা জিনিসটা সবখানে একই ভাষায় কথা বলে। এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য।
মহসিন শারমিন এ গবেষণাগারের একমাত্র নারী জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী। ইংরেজিতে বলে কম্পিউটেশনাল অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট। মূলত কম্পিউটারেই তাঁর কাজ। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলোর মানে বের করেন তিনি। সে অনুযায়ী বানান সিমুলেশন। চালিয়ে দেখেন, সিমুলেশন কতটা কাজ করল। তিনিসহ মোট চারজন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী কাজ করেন এ গবেষণাগারে। কিছুদিন আগে এমআইটির একদল গবেষকের সঙ্গে যুগ্মভাবে ওয়ার্মহোলের একটি কৃত্রিম সিমুলেশন বানানোর কাজ করলেন তিনি। সুবিধা হলো পুরো সিমুলেশনটা রান করা যায় ওদের সার্ভারে। তাঁর কম্পিউটার শুধু ইনপুট ডিভাইস, কোডে টুকটাক এদিক-ওদিক করে দিলেই হলো। ওয়ার্মহোলের সেই গবেষণায় তাঁর নাম কোথাও প্রকাশিত হয়নি। কারণ, এই গবেষণাগারের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান তা চান না। বিনিময়ে তাঁরা যদি নিজেরা কিছু আবিষ্কার করেন, সেগুলো অনেক সময় কোথাও প্রকাশিত হয় না। চড়া দামে বিক্রি হয়ে যায় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে। যেমন চ্যাটজিপিটি নামের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছে ওপেন এআই নামের একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটি একটা চ্যাটবট। আপনি প্রশ্ন করলে জবাব দেবে, কথা চালিয়ে যাবে আপনার সঙ্গে। বাংলা ভাষা যেন বুঝতে পারে বুদ্ধিমত্তাটি, সেটা নিয়ে কাজ করছেন এ গবেষণাগারের চারজন কম্পিউটারবিজ্ঞানী। বাংলা বুঝলে লাভ হলো, গুগলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পাওয়া যাবে দারুণ একটি সার্চ ইঞ্জিন। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও বাংলা ভাষাভাষী ক্রেতার কেনার ইচ্ছেটাও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সুকৌশলে।
যে রিপোর্টটি এখন মহসিন শারমিনের সামনে, তা একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের তথ্য। মহাবিশ্বের উজ্জ্বলতম সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়েছে চলতি বছরের অক্টোবর। সেই বিস্ফোরণ থেকে সবচেয়ে বেশি আর বৈচিত্র্যময় তথ্য সংগ্রহ করেছে চীন। চিনের সিচুয়ান প্রদেশে অবস্থিত লার্জ হাই অলটিচ্যুড এয়ার শাওয়ার অবজারভেটরি। উচ্চশক্তির কণা পর্যবেক্ষণ করা এই অবজারভেটরির অন্যতম কাজ। সে কাজ তারা করেছে বটে, তবে এখনো প্রকাশ করেনি সব তথ্য। এর মধ্যে বেশ কিছু কণার যে পরিমাণ শক্তি এবং কোনো বস্তুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করে ছুটে চলার যে বৈশিষ্ট্য, তা থেকে মনে হচ্ছে, এটি ডার্ক ম্যাটার কণা হতে পারে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পাওয়া গেছে এই তথ্য। তা ছাড়া বেশ কিছু গবেষণায় গোপনে চীনা বিজ্ঞানীদের সাহায্য করার বিষয়টি তো আছেই।
ঝামেলাটা হলো শনাক্ত করা গেছে কণাগুলোকে। কিন্তু ডার্ক ম্যাটারের কণাকে তো শনাক্ত করাই সম্ভব হওয়ার কথা নয়! কারণ, এরা কোনো কিছুর সঙ্গেই মিথস্ক্রিয়া করে না। তার মানে, ডিটেকটরের সঙ্গেও এদের মিথস্ক্রিয়া করার কথা নয়।
কিন্তু প্রমাণ আরও আছে। অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত আইসকিউব অবজারভেটরি। মূলত নিউট্রিনো শনাক্ত করার কাজ করে এটি। কিন্তু ডার্ক ম্যাটার শনাক্ত করার মতো কিছু ডিটেকটরও বসানো আছে ওতে, বরফের নিচে। এ রকম কয়েকটি ডিটেকটরেও একই ধরনের কণার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। চীনারা অবশ্য এখনো জানে না এই কথা। জানলে হুলুস্থুল বেঁধে যাবে পৃথিবীতে। কারণ, এক ডার্ক ম্যাটার কণা ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড মডেলের আর কোনো কণার সঙ্গে এদের মিল নেই। কণাগুলোর ভর অতিসামান্য, প্রচণ্ড শক্তি, আবার ২.৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে এত দূরে এসেছে কারও সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করে—ডার্ক ম্যাটার ছাড়া আর কী হতে পারে!
অন্যান্য অবজারভেটরি থেকেও তথ্য আসছে মহসিন শারমিনের কাছে। তিনি সেসব তথ্য দেখেশুনে একটি সিমুলেশন মডেলে ইনপুট দিচ্ছেন। সুপারনোভা বিস্ফোরণটি সিমুলেশন করার ইচ্ছে তাঁর। দেখতে চাচ্ছেন, এই কণাগুলো ঠিক কোন জায়গা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এ রকম নিখুঁত সিমুলেশন করার মতো অ্যালগরিদম পৃথিবীর আর কারও কাছে নেই। এমআইটির একটি সার্ভারে এর প্রাথমিক বিষয়গুলো রান করবেন তিনি। এরপর চলে যাবেন গুগলের টেন্সরে। নাহয় এ জিনিস করা যাবে না ঠিকভাবে। ধাপে ধাপে পুরো কাজটি শেষ করলে দেখা যাবে পুরো সিমুলেশন। ভিডিও হিসেবে সেটাকে নামিয়ে দেখতে হবে।
কিন্তু মহসিন শারমিন ঠিক শান্তি পাচ্ছেন না। কিছুদিন আগে মিউয়ন জি-২ কণা শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সেটা আশা জাগিয়েও পূর্ণ করতে পারেনি। তাঁর মনে হচ্ছে, এবারে হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা বোধ হয় খুব ভালো কিছু হবে না।
***
কোডটা সাজিয়ে নিয়ে, গুগলের সার্ভারে টেন্সর ইঞ্জিনকে কাজে লাগিয়ে দিলেন তিনি। এরপর উঠে পড়লেন। ঘড়িতে রাত দুইটার বেশি বাজে। একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। ঘণ্টা দুয়েক পর পাওয়া যাবে সিমুলেশন। ততক্ষণ বসে থেকে লাভ নেই।
নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন মহসিন শারমিন। নতুন আবিষ্কারের উত্তেজনা ছাড়া এসব আর কিছু না।
দুই
শোবার ঘরটা গবেষণাগারের পাশেই। বিছানায় শুয়ে বালিশের পাশে রাখা বইটা টেনে নিলেন শারমিন। মারিয়ো পুজোর গডফাদার বহুবার পড়া বই। তবু মাঝেমধ্যে এ বইটা খুলে পড়েন তিনি। বিচলিত বোধ কমে।
গডফাদার ডন কর্লিয়নি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। বসেছেন আর সব ডনের সঙ্গে। তিনি শান্তি চান। বক্তব্যে সে কথাটাই তুলে ধরবেন। উঠে দাঁড়ালেন ডন। বক্তব্য শুরু করলেন।
শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লেন মহসিন শারমিন। কপাল ঘামছে তাঁর। কারণ, ডন বক্তব্যে বলছেন, ‘মাইকেলের আত্মা শান্তি পাক! ছেলেটা আমার কখনো এসব সাতে-পাঁচে ছিল না। কেন যে ও এর মধ্যে ঢুকতে গেল! বোকা ছেলে, বয়স হয়নি তো, বুদ্ধিশুদ্ধিও হয়নি। আমি অবসর নেব। কারণ, আমি শান্তি চাই। সনিকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেব। ও যে শান্তিপ্রিয়, তা আপনারা জানেন। তবে শান্ত মানুষের রাগ প্রচণ্ড হয়। সনির হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর যদি ও কোনো দুর্ঘটনার মুখে পড়ে, তবে…’
এক হাতে কপালের ঘাম মুছলেন শারমিন। বইয়ে এ রকম কিছু লেখা ছিল না। বইয়ের বক্তব্য বদলে গেছে।
যেন সংবিৎ ফিরে পেয়েছেন হঠাৎ, এমনভাবে দ্রুত হাতে পুরো বই ওল্টাতে শুরু করলেন তিনি। সনি কর্লিয়নি বেঁচে আছে। মাইকেল কর্লিয়নি মারা গেছে। বদলে গেছে মারিয়ো পুজোর গডফাদার। নাকি তাঁর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে?
মহসিন শারমিন গবেষণাগারের দিকে ছুট দিলেন। মাথা ঘোরাচ্ছে তাঁর। বমি পাচ্ছে। তবু যন্ত্রের মতো ছুটছেন তিনি।
মিনিটখানেক পরই তিনি এসে দাঁড়ালেন কম্পিউটারের পর্দার সামনে। সিমুলেশন কেবল রান হচ্ছে। আইডিই ইন্টারফেসে কোডের মধ্যে লাল রঙের কালিতে চকচক করছে তার বিশেষ ইনপুট শব্দগুলো। কিন্তু একটি জায়গায় লাল দেখাচ্ছে না। অথচ তিনি কন্ডিশন দিয়ে এখানে বিশেষ ইনপুট, মানে ওই কণাগুলোর কথা লিখেছেন। যদি ওগুলোর উৎপত্তি সুপারনোভার কেন্দ্র থেকে না হয়ে একদম কিনারার দিকে হয়, তাহলে তিনি নিশ্চিত হতে পারবেন, ওগুলো ডার্ক ম্যাটার।
চোখ বন্ধ করে স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। শ্বাস ফেলছেন জোরে জোরে। চোখ খুলে আবার কোডের দিকে তাকাতেই তাঁর মনে হলো, আরও খানিকটা বদলে গেছে কোড।
স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন মহসিন শারমিন। তাঁর চেনা জগৎটা বদলে যাচ্ছে। অথবা তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন? এমন হচ্ছে কেন?
তিন
রাত তিনটার দিকে তাঁর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বন্ধু নাজিম উদ্দিনকে ফোন দিলেন মহসিন শারমিন। কিছুটা ধাতস্থ হয়েছেন তিনি। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশন হচ্ছে তাঁর।
চীনা যে বিজ্ঞানী তাঁকে তথ্যগুলো দিয়েছিলেন, তাঁর নাম ঝাও শি বো। ঝাওয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। ঝাও বলেছেন, যেসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিমুলেশন চালাচ্ছেন শারমিন, সেসব তথ্য তাঁরা দেননি। একটি ভরশূন্য কণার কথা তাঁরা বলেছিলেন রিপোর্টে। নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে মহসিন শারমিনের। এ কথা শোনার পর তাঁর স্নায়ু শান্ত হয়ে গেছে আচমকাই। এতক্ষণ তিনি বুঝতে পারছিলেন না কী করা উচিত। এখন বুঝতে পারছেন।
নাজিম ফোন ধরে বললেন, ‘কী রে, এত রাতে! সব ঠিক আছে?’
সামান্য হাসার চেষ্টা করলেন শারমিন। ‘ঠিক আছে। তোর বউ কি ঘুমে? একটু কথা বলব, পাশের রুমে যাবি?’
নাজিম জবাবে বললেন, ‘বউ বাপের বাড়ি ঘুরতে গেছে। আমি আপাতত ব্যাচেলর। বই পড়ছিলাম। বলে ফেল।’
সব খুলে বললেন শারমিন। নাজিম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ রকম কি আগে কখনো হয়েছে?’
‘না।’
‘আমেরিকানদের সঙ্গে কথা বলে ডেটা চেক করেছিস?’
‘তা করিনি। কিন্তু গডফাদার যে বদলে গেছে…আমি নিশ্চিত, ভুল দেখতে পাচ্ছি বা স্মৃতিভ্রংশ…’
‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক বলেছিস। আমার কাছেও তো একটা কপি আছে। দাঁড়া দেখি…’
‘কেন, তুই তো পড়েছিস। বললিই তো, সনির মারা যাওয়ার কথা। আর গডফাদারের…’
ফোনের ওপাশ থেকে নাজিমকে আঁতকে উঠতে শুনে থেমে গেলেন শারমিন।
‘কিন্তু আমার বইটাতেও তো এটাই লেখা। মাইকেল মারা গেছে…’
শারমিন থেমে থেমে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ম্যান্ডেলা ইফেক্ট?’
কিছু বললেন না নাজিম। তিনি বুঝতে পারছেন, কিসের কথা বলছে শারমিন। ম্যাস হ্যালুসিনেশনের একটা ধরন এই ম্যান্ডেলা ইফেক্ট। ২০১০ সালের ঘটনা। ফিওনা ব্রুম নামের এক ভদ্রমহিলা অনলাইনে প্রথম বিষয়টি তুলে ধরেন। এক গবেষণার কাজে তিনি অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেন নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে। সে সময় বেশির ভাগ মানুষ দাবি করে, ১৯৯৩ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা মারা গেছেন। অথচ ম্যান্ডেলা তখনো বেঁচে। তিনি মারা যান ২০১৩ সালে। প্রায় লাখো মানুষের এ রকম ভুল স্মৃতি বা ফলস মেমোরির ঘটনার নাম দেওয়া হয় ম্যান্ডেলা ইফেক্ট। তাঁদেরও কি এ রকম হচ্ছে?
নাজিম ধীর গলায় বললেন, ‘একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। সকালে উঠে দেখিস। আমি আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখি। ঘটনাটা বোঝা দরকার।’
‘ঠিক আছে,’ ফোন নামিয়ে রাখলেন শারমিন। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর মাথায় ভিন্ন এক চিন্তা পাকিয়ে উঠতে শুরু করেছে।
চার
কম্পিউটার স্ক্রিনে সিমুলেশনটা প্রস্তুত। মাউসে ক্লিক করে ওটা চালু করে দিলেন মহসিন শারমিন। স্ক্রিনে দেখা গেল প্রচণ্ড সুপারনোভা। বিস্ফোরিত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তিনি দেখলেন, একসঙ্গে কোটি কোটি ভার্চ্যুয়াল কণা তৈরি হলো সুপারনোভার কিনারার দিকে। পরমুহূর্তেই আবার ধ্বংস হয়ে গেল সংঘর্ষে। কণাগুলোর ভর, বেগ, চার্জ ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনের কোণে। সব কটি কণার ভর দেখাচ্ছে অতিসামান্য, ঠিক ওই কণাটির ভরের সমান। সিমুলেশনে ভুল? নাকি তিনি ঠিক দেখছেন?
ঠিক এ সময় এই ভার্চ্যুয়াল কণাদের একটি সাধারণ পজিট্রনের ধাক্কায় একদিকে সরে গেল। পজিট্রনটি ইলেকট্রনের সঙ্গে সংঘর্ষে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনো কারণে বিচ্যুত হয়ে গেছে গতিপথ থেকে। সে কারণে আরও কিছু কণার মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা গেল। তিনি দেখলেন, অদ্ভুত অতিসামান্য ভরের উচ্চশক্তির কণাগুলো কম্পিউটার সিমুলেশনে ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে…
এটাই কি হয়েছে? যে ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি, সেটাই ঘটেছে?
অসহায় বোধ করলেন মহসিন শারমিন। মহাবিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য তিনি এ মুহূর্তে জানেন। কিন্তু আর কেউ এটা জানে না। তিনি বুঝতে পারলেন, চাইলেও কাউকে এ কথা জানিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
প্রতিটি গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ও গ্রহের কিনারার দিকের কিছুটা অঞ্চলকে বিজ্ঞানীরা বলেন ডার্ক ম্যাটার হ্যালো। এই অঞ্চলগুলোতে ডার্ক ম্যাটার থাকে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ডার্ক ম্যাটার আসলে ভার্চ্যুয়াল কণা। প্রতি মুহূর্তে যে পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার তৈরি হয়, তার ঠিক পরমুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায় সেগুলো। তৈরি হয় একই পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার কণা। এই কণাগুলোর ভর এমনিতে অতিসামান্য। কিন্তু একসঙ্গে কোটি কোটি ভার্চ্যুয়াল কণা তৈরি হওয়ায়, তাদের মোট ভর হয়ে যায় অনেক। আবার এরা যেহেতু জন্মের পরমুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যায়, তাই কারও সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করার সুযোগ হয় না এদের। কিন্তু এদের সামান্য ভর আছে। তার মানে, হিগসক্ষেত্রের সঙ্গে এরা মিথস্ক্রিয়া করে বা করতে পারে। কথা হলো, হিগসক্ষেত্রের সঙ্গে যদি এরা মিথস্ক্রিয়া করেই, তাহলে আলো বা আর কিছুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে না কেন? যদি করত, তবে তো এদের শনাক্ত করা যেত আরও সহজে।
কিংবা হয়তো এদের কখনো না কখনো কোনো না কোনো বিজ্ঞানী শনাক্ত করেছেন, কিন্তু সে কথা কাউকে বলে যেতে পারেননি।
হয়তো মহাবিশ্বটা আসলেই স্ট্রিং দিয়ে তৈরি। স্ট্রিংগুলোকে আমরা বিভিন্ন কণা হিসেবে দেখি তাদের কম্পনের ভিন্নতার কারণে। হয়তো ডার্ক ম্যাটার কণার সঙ্গে কোনো কণার মিথস্ক্রিয়া ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সেটা বদলে যায়। হয়তো এর প্রভাব পড়ে পৃথিবীর অন্য অনেক কিছুতে। বাটারফ্লাই ইফেক্ট। সে কারণেই বদলে যেতে থাকে বিভিন্ন ঘটনা। বদলে যায় ইতিহাস।
আবারও সিমুলেশনটি প্লে করলেন মহসিন শারমিন। হতভম্ব চোখে তিনি দেখলেন, সুপারনোভার ঠিক কেন্দ্রে প্রচণ্ড বিস্ফোরণটা হলো। ভার্চ্যুয়াল কণাদের জন্ম-মৃত্যু হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়মে। স্ক্রিনের কোনায় নিট ভর দেখা যাচ্ছে শূন্য! একদল ভরশূন্য কণা ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে…
মাথা ঘোরাচ্ছে খুব। চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। মহসিন শারমিনের মাথাটা ঢলে পড়ল চেয়ারের হেডরেস্টে।
পাঁচ
মার্ক ক্রুজ একজন কম্পিউটেশনাল অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী হলেও তাঁর কাজ মূলত বিভিন্ন তথ্য থেকে কম্পিউটারে সিমুলেশন নির্মাণ করা। এমআইটির কেভিল ইনস্টিটিউটে কাজ করেন তিনি। গতকাল রাতে ঘুমটা কেমন ছাড়া ছাড়া হয়েছে তাঁর। কম্পিউটারটা ওপেন করে দিয়ে কফি মেকারের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। কড়া করে এক কাপ ক্যাপাচিনো খাওয়া প্রয়োজন। কফি নিয়ে এসে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তিনি চমকে গেলেন। সার্ভারে ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের সিমুলেশন চলছে। এ জিনিস কোত্থেকে এল? এটা তো তিনি ডিজাইন করেননি!
***
নাজিম উদ্দিনের ঘুম ভাঙল মুঠোফোনের অ্যালার্মে। ঘুম ভেঙে তিনি দেখলেন, বুকের ওপর মারিও পুজোর গডফাদার বইটি পড়ে আছে। গডফাদার বক্তব্য দিচ্ছেন। সনি কর্লিয়নি মারা গেছেন। এলোমেলো হয়ে গেছে কর্লিয়নি পরিবারের রাজত্ব। মাইকেল কর্লিয়নি পালিয়ে গেছে। গডফাদার বলছেন তাঁকে ফিরিয়ে আনার কথা।
***
ঝাও শি বো নিজের হাতের রিপোর্টটা এক পাশে সরিয়ে রাখলেন। ২ দশমিক ৪ আলোকবর্ষ দূরের একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ নিয়ে তাঁরা খুব উত্তেজিত ছিলেন। ভেবেছিলেন, এ থেকে দারুণ কিছু পাওয়া যেতে পারে। অন্তত ভারী বা স্টেরাইল নিউট্রোনি পাওয়ার আশা ছিল। লাভ হয়নি। পাওয়া যায়নি নতুন কিছু।
***
সাভারের বলিভদ্রে অবস্থিত একটি গবেষণাগার। ‘সুপ্তরাগ’ নামের বীজটি বাজারে ছাড়া হবে শিগগিরই। এ নিয়ে সবাই খুব উত্তেজিত। দেশের মানুষের খাদ্যাভাব মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এটি। জৈব রসায়ন, আবহাওয়াবিদ থেকে শুরু করে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগারের গবেষকেরাও আজ এ নিয়েই ভাবছেন। একটু পর বীজটির আনুষ্ঠানিক উন্মোচন অনুষ্ঠান হবে গবেষণাগারের ভেতরে। বাইরের মানুষকে জানানোর আগে নিজেদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর জন্যই এ আয়োজন।
জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগারের তিন গবেষক একসঙ্গে গল্প করতে করতে পা বাড়ালেন অ্যাগ্রিডেমোনেস্ট্রেশন রুমের দিকে। তাঁদের হাতে একটি প্রস্তাবনা। চারজন গবেষকের কাজ করার সুযোগ রয়েছে, কিন্তু এত দিনেও চতুর্থ কাউকে পাওয়া যায়নি। গত সপ্তাহে তাঁরা একজনকে পেয়েছেন। রওশন আরা নামের এই নারী সদ্য অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশে ফিরেছেন। এ গবেষণাগারে কোনো নারী গবেষক নেই। তাঁরা তাই তাঁকে দলে নিতে আগ্রহী। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের নারী গবেষক—এটা তাঁদের জন্য ভালো। নারী গবেষক থাকলে ফান্ডিং পেতেও সুবিধা হয়। আর মানুষটি যোগ্যও বটে। ভারী নিউট্রিনো এবং ডার্ক ম্যাটার নিয়ে তিনি বেশ কিছু কাজ করেছেন। কম্পিউটেশনাল অ্যাস্ট্রোফিজিকসে তাঁর পিএইচডি গবেষণা অনেকেরই নজর কেড়েছে। এতে এমআইটির একদল গবেষকের সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি ওয়ার্মহোলের একটি কৃত্রিম সিমুলেশন বানিয়েছেন। আশা করা হচ্ছে, এ থেকে ওয়ার্মহোলের প্রকৃতি নিয়ে অনেক কিছু জানা যাবে। এ রকম একজনকে এখনই দলে ভেড়াতে না পারলে বিদেশি কোনো গবেষণাগার নিয়ে নেবে নিঃসন্দেহে।
আজকের অনুষ্ঠানে এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান আসবেন। তাঁরা তাঁকে এই প্রস্তাব দেবেন। তিনি সম্মতি দিলেই শুরু হবে নিয়োগপ্রক্রিয়া। গোপন এসব কাজে নিয়োগ দিতে নানা রকম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয় প্রত্যেককে। আশা করা যায়, রওশন আরা সেগুলোতে পাস করবেন। তাঁরা এই গবেষকের সঙ্গে কথা বলেছেন দুই দফা। খানিকটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বুদ্ধিমান। তাঁদের ইঙ্গিতটা সম্ভবত ধরতে পেরেছেন। সে জন্যই তাঁরা আশাবাদী।
তবে বাস্তব সব সময় আশানুরূপ হয় না। তাই তাঁরা অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। দেখা যাক, কী হয়।