পরীক্ষার খাতা খেতে খুব মজা

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

টুলটুকে আমার খুব হিংসে হয়। ওর পোস্টিং রঙিন বিদ্যানিকেতন স্কুলে। স্কুলের বাথরুমে যে বেসিন আছে, সেই বেসিনের পেছনে একটা ফোকরের ভেতর ও বেশ আরাম করে থাকে। সরকারি বাসা। আলো-হাওয়ার উপদ্রব নেই। নিরিবিলি থাকা যায়। সারা দিন টুলটু গা এলিয়ে আয়েশ করে। রাত হলে বাসা থেকে বের হয়। অফিসে যায়। টুকটাক কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ে। তারপর কুট কুট করে কাগজ খায়।

স্কুলের ভেতর কত কাগজ! এখানে কাগজ, সেখানে কাগজ। অফসেট, নিউজপ্রিন্ট, আর্ট পেপার, কার্ট্রিজ পেপার—একটা স্কুলে মোটামুটি সবই পাওয়া যায়। খেয়েদেয়ে টুলটু এখন ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। ভাঁজ না-করা কাগজের মতো মসৃণ ওর ত্বক! দেখে আমার হিংসে হয়। খুব হিংসে হয়। ওর কী সৌভাগ্য!

আমার পোস্টিং একটা গয়নার দোকানে। ঝকমকে চকচকে গলার হার, কানের দুল, নাকফুল, চুড়ি, ঘড়ি—সব এখানে আছে। শুধু কাগজ প্রায় নেই বললেই চলে। কী বিচ্ছিরি জায়গা! এক টুকরো খাবারের জন্য আমাকে মাঝেমধ্যে অনেক দূর যেতে হয়। তা-ও সব তরকারির ঝোল লাগানো, ধুলোবালিমাখা কাগজ। খেলেই পেট খারাপ করে। কতবার সরকারি দপ্তরে ই-মেইল করেছি, ‘আমাকে একটা ভালো জায়গায় পোস্টিং দেন। একটু ভালো কাগজ খাই। কত দিন অফসেট খাইনি!’ ফল শূন্য। আজকাল ঘুষ ছাড়া সরকারি দপ্তরে কাজ হয় না।

আমার দুঃখ আরও একটু উসকে দিতে সেদিন সকালবেলা বাসায় টুলটু এসে হাজির। আমাকে দেখেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘দোস্ত, কেমন আছিস?’

ওকে দেখেই হিংসায় আমার গা জ্বলে গেল। গলার শ্লেষটুকু লুকানোর চেষ্টা না করেই বললাম, ‘আমাদের আর থাকা। এই কোনোমতে খেয়ে-পরে বেঁচে আছি আরকি।’

টুলটু বলল, ‘আহা রে, তোর কষ্টটা বুঝি। একটা ভালো পোস্টিংয়ের অভাবে বিয়েটাও করতে পারছিস না।’

আমি বললাম, ‘তা তুই বিয়ে করছিস না কেন?’

‘আহা, সুখবরটা দিতেই তো এলাম। শোন, আগামী সপ্তাহে শুভকাজটা সেরে ফেলব ভেবেছি। তোর নিমন্ত্রণ। অফিস থেকে মনে করে ছুটি নিয়ে নিস।’

এই খবরটা শুনে আমার মনটা একটু ভালো হলো। অনেক দিন পর একটু ভালোমন্দ খাব। বললাম, ‘বাহ্। অভিনন্দন।’

টুলটু মনে হলো আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছে। বলল, ‘মিস করিস না কিন্তু। বিয়েতে এবার খুব ভালো খাওয়াব, দেখিস। ০ দশমিক শূন্য ৭ মিলিমিটারের পুরু, মসৃণ কাগজ! আহা, দাঁতের নিচে দিলেই কিচ কিচ শব্দ হয়। চোখ বুজে আরাম করে খেতে পারবি।’

শুনেই আমার চোখ বুজে আসছিল। বললাম, ‘ভালো ভালো খেয়ে তুই কিন্তু দেখতে সুন্দর হয়ে গেছিস। তোর ওখানে কোন কাগজটা সবচেয়ে টেস্টি বল তো?’

‘সত্যি বলব?’

‘বল।’

‘আমার সবচেয়ে পছন্দ হলো পরীক্ষার খাতার কাগজ। কলমের কালি মিশে যা একটা স্বাদ হয় না...আহা! আমি একবার এটা নিয়ে ফুডব্লগে পোস্ট দিয়েছিলাম। অ্যাডমিন অ্যাপ্রুভ করেনি। আহা রে, লোকে জানলই না, পরীক্ষার খাতা খেতে কী মজা!’

‘কী বলিস? আমার তো কলমের কালি ভালো লাগে না। কেমন তিতকুটে।’

‘তুই পরীক্ষার খাতা খেয়েছিস কখনো?’

‘তা অবশ্য খাইনি।’

শুনে টুলটুর চোখমুখ ঝলমল করে উঠল। ‘জানতাম তুই খাসনি। তোকে যে আমি কাছের বন্ধু ভাবি, সেটা তো তুই মানিস না। বাইরে গিয়ে দেখ, তোর জন্য কী এনেছি।’

আমি দৌড়ে গেলাম। ও মা! একটা ছেঁড়া কাগজ। আধখাওয়া। তাতে কী? অন্তত গায়ে ধুলোবালি, তরকারির ঝোল লাগানো নেই। আমার চোখে প্রায় পানি এসে গেল। টুলটুকে বললাম, ‘থ্যাংক ইউ, দোস্ত।’

টুলটু হাসল। বলল, ‘পরীক্ষার খাতা থেকে কাগজটা ছিঁড়ে এনেছি। পুরোটা তো আর এত দূর বয়ে আনতে পারি না। যতটুকু পেরেছি আরকি। খেয়ে দেখিস, ভারি মজা।’

যাক, মোটকুটাকে যতটা খারাপ ভেবেছি, ও অতটাও খারাপ না। এবার আমিও টুলটুকে জড়িয়ে ধরলাম।

টুলটু যে কাগজের টুকরোটা এনেছে, সেটা মোটামুটি বড়ই বলা যায়। আমরা দুজন পেট ভরে খাওয়ার পরও বেশ খানিকটা রয়ে গেল। টুলটুকে বললাম, ‘দিনে থেকে যা।’ ও কিছুতেই মানল না। বিয়ের কেনাকাটা নাকি করতে হবে। ভোরের একটু আগে ও বিদায় নিল।

টুলটু চলে যাওয়ার পর আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম কাগজটার দিকে। আহা, পরীক্ষার খাতা খেতে সত্যিই খুব মজা। এই টুকরোটা খেয়ে আমার মোটামুটি দু-চারটা দিন চলে যাবে।

ছেঁড়া, খাওয়া কাগজটার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লক্ষ করলাম, ওটাতে একটা প্রশ্ন লেখা। কোন ক্লাসের, কোন পরীক্ষার প্রশ্ন কে জানে। তবে প্রশ্নটা খুব অদ্ভুত। লেখা আছে—

১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ ১০

মনোযোগ দিয়ে লক্ষ কবুন

ওপরে একটা ভুল আছে। ভুলটা কী?

মানুষের পরীক্ষা। মানুষের করা প্রশ্ন। কিন্তু আমরা তো ওদের চেয়ে কম বুদ্ধিমান নই। অতএব আমি প্রশ্নটা নিয়ে ভাবলাম। খুব ভাবলাম। ভুলটা কী? কোনো ভুলই তো চোখে পড়ছে না। নিচে উত্তরটা লেখা ছিল। কিন্তু সেই অংশটা আমরা খেয়ে ফেলেছি। মুশকিল।

উফ্। ভাবতে ভাবতে আমার আরও ক্ষুধা লেগে গেল। আরও একটুখানি কাগজ খেয়ে ফেললাম। প্রশ্নটা কিছুতেই মাথা থেকে নামছে না। কী ভুল? কী ভুল? আমি অপলক কাগজটার দিকে তাকিয়েই রইলাম...

উত্তর

মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য ‘করুন’ এর বদলে ‘কবুন’ লেখা ছিল। ভুলটা এখানেই।