আপনালয় আবাসন

অলংকরণ: এস এম রাকিব

দিব্যি ছিলাম নিউ ইস্কাটনে। একটা একতলা বাড়ির চিলেকোঠায় থাকতাম। একপাশে বাড়িওয়ালার কবুতরের খোপ, অন্যদিকে আমার থাকার একটা রুম। ঘুম ভাঙলে চোখের সামনে হাতিরঝিল। ঘুমুতে যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে অগণিত তারা দেখতে দেখতে ঘুমানো যায়। গলির মধ্যে কাঁচাবাজার, সেলুন, লন্ড্রি ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। বাসা থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম হাঁটলে মেট্রোরেল স্টেশন। অফিসে যেতে বিন্দুমাত্র ঝক্কি নেই। বাড়িভাড়াও একেবারে নাগালের মধ্যে। সব মিলিয়ে ব্যাচেলরের জন্য একটা ছোটখাটো স্বর্গ। প্যাঁচ লাগাল অফিসের ম্যানেজমেন্ট। আনাড়িপনার কারণে কোম্পানিটাই উঠে গেল। চাকরি হারিয়ে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় নিলাম আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে। ওখানে কেটে গেল ছয় মাস। এরপর একটা চাকরি পেলাম বটে। তবে ইস্কাটনের ওই চমৎকার বাড়িটা আর পেলাম না। বনশ্রীতে এক বন্ধুর বাসায় উঠে বাসা খুঁজতে শুরু করলাম।

ঢাকা শহরে একটা ভালো বাসা পাওয়া বিরাট ঝামেলার ব্যাপার। প্রতি বর্গফুটে এত মানুষ পৃথিবীর আর কোনো শহরে থাকে না। মাথা গোঁজার একটা যা-তা জায়গা পেলেই বর্তে যাওয়ার মতো মানুষ আমি নই। মনের মধ্যে ইস্কাটনের বাসাটা এখনো ছাপ ফেলে আছে। অমন কিছু না পেলে উঠব না। অফিস শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ি খুঁজতে শুরু করি, মাঝরাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি। এভাবেই কেটে গেল এক মাস।

বন্ধুর বাসায় বেশি দিন থাকা যায় না। এক সন্ধ্যায় আদাজল খেয়ে বাসা খুঁজতে বেরোলাম। রামপুরার ওয়াপদা রোডের মুখে অনেকগুলো ব্যাচেলর বাসার বিজ্ঞাপন। তার মধ্যে একটা দেখে চমকে উঠলাম। বিজ্ঞাপনে বড় করে লেখা, ‘অযথা বাড়তি খরচ কেন করবেন?’ তার নিচে ছোট করে লেখা, ‘আপনালয় আবাসন। কম টাকায় ভালো বাসা চাইলে নিচের নাম্বারে যোগাযোগ করুন।’

আমি দ্রুত মুঠোফোনে নম্বরটা তুলে নিয়ে ফোন করলাম। রিং হলো, কিন্তু কেউ ধরল না। ভাবলাম কেউ বোধ হয় মজা করছে। রসকষহীন এই শহরে কেউ কেউ নিষ্ঠুর রসিকতা করে বৈকি। অন্য একটা বিজ্ঞাপনে নক দেব, এমন সময় ওই নম্বর থেকে ফোন এল। শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় একজন প্রশ্ন করল, ‘আপনি ব্যাচেলর?’

চমকে উঠে বললাম, ‘আপনি কী করে জানলেন?’

লোকটা হা হা করে হেসে বলল, ‘ফ্যামিলি থাকলে মানুষ কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। নতুন কিছু করার সাহস পায় না।’

আমি বললাম, ‘শোনেন, আমি কোনো ঝামেলা চাই না। শুধু ভালো একটা বাসা চাই।’

লোকটা বলল, ‘পাবেন। ভালো বাসা পাবেন। আপনার হাতের ডানে একটা গলি ধরে সামনে এগিয়ে আসুন। শেষ মাথায় একটা ফটোস্ট্যাটের দোকান আছে। ওই দোকানে সুমন নামের একজন বসে। তাকে গিয়ে বলবেন, ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই/ কুঁড়ে ঘরে থাকি করো শিল্পের বড়াই।’

আমি রেগে গিয়ে বললাম, ‘আপনি বোধ হয় ফাজলামি করছেন?’

লোকটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘এতটুকু বলতে না পারলে আপনার আসার দরকার নাই।’

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি গলির মধ্যে ঢুকলাম। মনের মধ্যে একটা ‘কিন্তু’ কিলবিলিয়ে উঠছে। মন বলছে ও–পথে না যেতে, আর মগজ বলছে, ‘একবার গিয়েই দ্যাখ না!’

গলিটা বেশ দীর্ঘ। শেষ দিকে একেবারে অন্ধকার। বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে সত্তর বা আশির দশকে বানানো। দেয়ালে হলুদ রং করা, সামনের দিকে লাল ইটের নকশা। গলিতে কেবল রোড লাইট জ্বলছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ এখানে থাকে না। তা কী করে হয়? ঢাকায় আবার পরিত্যক্ত বাড়ি আছে নাকি!

লোকটার কথামতো শেষ মাথায় গিয়ে একটা ফটোস্ট্যাটের দোকান পেলাম। ঢাউস সাইজের একটা সিআরটি মনিটরে একটা বছর কুড়ির ছেলে কাজ করছে। আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল সে। খানিকটা ইতস্তত করে বললাম, ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই/ কুঁড়ে ঘরে থাকি করো শিল্পের বড়াই।’

সুমন বলল, ‘আপনার হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস বা ডিমেনশিয়া আছে?’

মহা মুসিবতে পড়া গেল তো! রাগ হয়ে বললাম, ‘থাকলে কোনো সমস্যা আছে কি? রোগ হলে কি বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে না?’

সুমন মাথা নেড়ে বলল, ‘সেটা কথা নয়। অসুখ থাকলে অন্য বাসা দেব। আপনার কী রকম বাসা চাই?’

আমার মাথায় কেবল ইস্কাটনের বাসাটা ঘুরছে। বললাম, ‘চিলেকোঠা হলে ভালো হয়। জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যাবে। গলির মধ্যে সব পাওয়া যাবে; কিন্তু গোলমাল থাকবে না।’

সুমন একটা চাবি এগিয়ে দিয়ে ভেতরের ঘরে যাওয়ার ইঙ্গিত করল। বলল, ‘ভাড়া এক হাজার টাকা। রাত ১২টার মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে। দেরি করলে কোনো অবস্থাতেই বাসায় ঢুকতে পারবেন না।’

আমার ভীষণ রাগ হলো। চিলেকোঠা এখানে কোথায়? এই গলিতে মোটেই কোনো চিলেকোঠাওয়ালা বাড়ি দেখিনি। তা ছাড়া গলিটা সাংঘাতিক ভুতুড়ে। বাজার দূরে থাক, এখানে একটা চায়ের দোকানও নেই। সুমনের ওপর রাগ দেখাতে পারলাম না। সে ব্যস্ত হয়ে কম্পিউটারে কী সব টাইপ করছে।

পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরটা বেশ বড়। একসময় হয়তো গুদামটুদাম ছিল। জমাট অন্ধকার পুরো ঘরজুড়ে। তার মাঝে কী সব মেশিন চলছে। বিপ বিপ শব্দ পাচ্ছি। মাঝেমধ্যে লাল নীল রঙের আলো ঝলক দিয়ে উঠছে।

ঘরের অবস্থা দেখে মোটেই ভরসা পেলাম না। এটা কী ধরনের রসিকতা হচ্ছে? বাড়ি ভাড়া দেওয়ার কথা বলে কোথায় নিয়ে এল আমাকে? বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মাত্র উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় ছাদের লাইটগুলো একে একে জ্বলে উঠল। ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে একজন লোক শ্লেষ্মাজড়ানো গলায় বলে উঠল, ‘ভয় পাবেন না মিস্টার শাহনেওয়াজ। আপনার বাসা এখানেই আছে।’

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। লোকটা বলল, ‘ভালো করে দেখুন। এই ঘরে অনেকগুলো ক্যাপসুল আছে। এগুলোই আপনাদের বাসা।’

দেখলাম ঘরজুড়ে আট-দশটা ক্যাপসুল কফিনের মতো রাখা হয়েছে। তাতে নানা রকম তারের সংযোগ দেওয়া। স্বচ্ছ কাচের ওই সব ক্যাপসুলে জনা তিনেক ঘুমন্ত মানুষকে দেখা যাচ্ছে। বাকিগুলো ফাঁকা।

বললাম, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এসব কফিন কীভাবে আমার ঘর হবে?’

লোকটা চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে এল। মধ্যবয়সী মানুষ। গায়ের রং ফর্সা। মাথায় সিঁথিকাটা চুল। গালভর্তি চাপ দাড়ি। থুতনির অংশে পাক ধরেছে। বিগলিত হাসি হেসে লোকটা বলল, ‘আস্তে আস্তে সব বলছি।’

বললাম, ‘আমার নাম জানলেন কী করে?’

‘ট্রু কলার থেকে। তারপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আপনার একটা প্রোফাইল বানিয়ে ফেলেছি। আপনি কে, কেমন মানুষ, কী করেন, কী খেতে পছন্দ করেন, কী ধরনের সিনেমা দেখেন, বই পড়েন, গান শোনেন—সব জেনে ফেলেছি মাত্র পাঁচ মিনিটে। এই সফটওয়্যার আমার তৈরি করা।’

লোকটা এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসল। আমাকে আরেকটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, ‘বসুন।’

লোকটা ড্রয়ার থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে হঠাৎ বাগিয়ে ধরে বলল, ‘বাঁ হাতটা মুঠ করে ধরুন তো।’

আমার বিস্ময় তখনো কাটেনি। রেগে গিয়ে বললাম, ‘সাহস তো কম নয় আপনার। একে তো বাড়ি ভাড়া দেওয়ার কথা বলে লোক ঠকাচ্ছেন, তার ওপর আমার রক্ত নিতে চাইছেন। আপনার উদ্দেশ্যটা কী?’

লোকটা হেসে বলল, ‘আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আপনার বোঝা উচিত, এক হাজার টাকায় ঢাকায় একটা বাসা তো দূরের কথা, ফুটপাতেও এক টুকরা জায়গা পাবেন না। আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন।’

আমি হাত সরিয়ে নিয়ে বললাম, ‘আগে বলতে হবে আমার বাসাটা কোথায়। আমি এখানে কোনো বাসা দেখছি না। এই লোকগুলো কারা? ক্যাপসুলে কী করছে?’

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ঢাকা শহর আগে এমন ছিল না। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করত। আজকাল কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। যাহোক, আমি আপনাকে বাসা দেখাচ্ছি। তবে রক্তটা দিলে ভালো করতেন। আপনার শরীরের সঙ্গে বাসার আবহাওয়া অ্যাডজাস্ট করে নিতাম। এক হাজার টাকায় কিন্তু এসি পাওয়া যায় না। হা হা হা।’

আমার জেদ চেপে গেছে। বললাম, ‘আমার এসির দরকার নেই। আপনি আমাকে বাসা দেখান।’

লোকটা একটা ট্রে এগিয়ে দিয়ে বলল, এখানে আপনার ফোন, মানিব্যাগ, বেল্ট ও জুতা খুলে রাখুন। পকেটে চাবি থাকলে সেটাও রাখুন। ভয় নেই, কিছু খোয়া যাবে না।’

কোমরের বেল্ট খুলতে খুলতে বললাম, ‘আপনি কি আমাকে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটিতে নিয়ে যেতে চাইছেন?’

লোকটা একটা কম্পিউটারে কী সব সেটআপ করছিল। এন্টার বাটনে চাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপসুলের ঢাকনা খুলে গেল। বেশ কিছু ধোঁয়া ভেতর থেকে ভুস করে বেরিয়ে এল। সে বলল, ‘ঠিকই ধরেছেন। এটা একধরনের ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি। তবে এই ব্যাপারে বিজ্ঞান এখনো শিশুর স্তরে আছে। আমি অনেক দূর এগিয়ে গেছি। কত দূর এগিয়েছি, নিজেই দেখবেন। বাসা এত ভালো লাগবে যে আর ফিরতে ইচ্ছা করবে না।

আমি লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ‘সরকারি অনুমোদন নিয়েছেন কি?’

লোকটা আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘আমার কাজ বোঝার ক্ষমতা সরকারের নাই। ভয় নাই। আপনার যখন প্রয়োজন হবে বলবেন, “বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই/ কুঁড়ে ঘরে থাকি করো শিল্পের বড়াই”, সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠবেন।’

আমার মনে হলো মস্ত ভুল করতে যাচ্ছি। মন দিয়ে খুঁজলে যেনতেন একটা বাসা নির্ঘাত পেয়ে যেতাম। সেখানে এই সব এক্সপেরিমেন্ট করতে হতো না।

লোকটা একটা সানগ্লাস ও এক জোড়া ইয়ারবাড এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এগুলো পরে ক্যাপসুলে শুয়ে পড়ুন। যেমন বাসা চেয়েছিলেন, ঠিক তেমন বাসায় জেগে উঠবেন।’

আমি যন্ত্রের মতো ইয়ারবাড দুটো কানে পরে নিলাম। চোখে দিলাম সানগ্লাস। ক্যাপসুলে শুয়ে পড়তেই আবাও বেশ কিছু ধোঁয়া এসে আমাকে ঢেকে নিল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই জেগে উঠলাম নিউ ইস্কাটনের বাসাতে। অবাক হয়ে ঘরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একদম আমার আগের বাসা। চুনকাম করা সাদা দেয়াল, মাথার ওপর সবুজ সিলিং ফ্যান, কাঠের আলনায় আমার জামাকাপড়, দেয়ালে ঝোলানো ব্যাডমিন্টন ব্যাট, একটা টেবিল, পানির ফিল্টার, শু র‌্যাক—সবকিছু ঠিক আগের মতো আছে। বাথরুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম আধখানা টুথপেস্ট ও বহু ব্যবহৃত ব্রাশ আগের মতোই বেসিনের ওপরে আছে। বাইরে ছাদে এসে দেখি সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে রাত নেমেছে। আকাশে মেঘের ফাঁকে আবছা হয়ে আছে মস্ত একটা চাঁদ। খোপের ভেতর কবুতরের দল কিচিরমিচির করছে। নিচের গলিতে ঢাকার ব্যস্ত জীবন অবিশ্রান্তভাবে চলছে। আমি কিছুক্ষণ ছাদের ওপরে থেকে ঘরে এসে ঢুকলাম। এসে কিছুক্ষণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস পড়লাম। মুঠোফোনে ফ্রি ফায়ার খেললাম কিছুক্ষণ। বাড়িতে ফোন করে কথা বললাম। মাকে বললাম নতুন বাসায় উঠেছি। ফোন করলাম বনশ্রীর বন্ধুকে। বললাম, আজ রাতে আর ফিরব না। কাল বিকেলে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসব। আমার ভীষণ ভালো লাগছে। সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক। গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম, ব্যথা পাচ্ছি। খিদে পেয়েছে প্রচণ্ড, এমন সময় কে যেন দরজায় নক করল। খুলে দেখি হাবিব। গলির জগবন্ধু হোটেলে আমার খাবারের বন্দোবস্ত করা আছে। হাবিব ওখানকার বয়। বয়স পনেরো-ষোলো হবে। সে ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকে টিফিন ক্যারিয়ার নামিয়ে রাখল। অন্যদিন হাবিব নানান রসিকতা করে। টিভিতে খেলা থাকলে স্কোর বলে যায়। আজ সে আমাকে কোনো পাত্তাই দিল না। ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আইজ হাঁসের ডিম নাই। মুরগির ডিম দিছি। মানিজাররে জানি কমপ্লেন করবাইন না।’

টিফিন বক্স খুলে দেখি চালের রুটি আর ডিমের ঝোল। খুব সাধারণ খাবার। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। ওটাই গপাগপ খেলাম। ীদেয়ালঘড়িতে ১১টা বেজে গেছে। সকাল ৯টা থেকে অফিস। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। সন্ধ্যার চাঁদটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। আকাশে ফুটে উঠেছে লাখ লাখ তারা। আমার জানালা দিয়ে তারাদের দিব্যি দেখা যায়। আমার খুব সুখের অনুভূতি হচ্ছে। অনেক দিন আমার এই অনুভূতি হয় না। ইস্কাটনের বাসাটায় সত্যি সত্যি কে উঠেছে জানি না। লোকটা খুব ভাগ্যবান। বাসাটা হারানোর পর তাকে আমার অনেক ঈর্ষা হতো। আজ আর হচ্ছে না।

ভালোই লাগছে এই ভার্চ্যুয়াল নিবাস, আপনালয় আবাসন। একবারও মনে হচ্ছে না আমার চোখের সামনের জগৎটা মিথ্যা। যন্ত্রের কলাকৌশলে বানানো নিছক মায়ামাত্র। আমি তো শুয়ে আছি ওয়াপদা রোডের সেই গুদামের মতো ঘরটিতে। ঠান্ডা, অন্ধকার সেই ঘরে আমার মতোই আচ্ছন্ন হয়ে আছে আরও কিছু মানুষ। ক্যাপসুলে শুয়ে তারা লাখ টাকার স্বপ্ন দেখছে। আমি না হয় ইস্কাটনের চিলেকোঠাটির স্বপ্ন দেখছি। ওই লোকগুলো কিসের স্বপ্ন দেখছে কে জানে! হয়তো ওরা শৈশবের কোনো বাড়িতে মা–বাবাসহ বাস করছে, যেখানে বৃষ্টি হলে টিনের চালে খই ফোটার মতো ঝমঝম আওয়াজ ওঠে। কেউ হয়তো মালদ্বীপের কোনো রিসোর্টে বাস করছে, যেখানে পায়ের কাছে দিনরাত নীল সমুদ্রের ফেনিল ঢেউ এসে চুমু দিয়ে যাচ্ছে। কেউ হয়তো এই ঢাকা শহরেরই ক্ষমতাবান কোনো মানুষের বাসায় বাস করছে, যেখানে থাকা তো দূরের কথা, কোনো দিন পা রাখারও সৌভাগ্য হবে না। এক হাজার টাকার বিনিময়ে এই অলীক জীবনযাপন সত্যি অভিনব।

সকালে ঘুম ভাঙল দরজায় শব্দ শুনে। খুলে দেখি হাবিব। বলল, ‘আইজ আপনের অফিস নাই? সাড়ে আটটা পার হইয়া যাইতাছে, অহনো যে বিছানা ছাড়েন নাই?’

দেয়ালঘড়িতে সাড়ে ছয়টা বেজে আছে। বোধ হয় ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে। কোনোরকমে নাশতা করে ছুট দিলাম বাংলামোটরে। স্টেশনে পৌঁছে দেখি ট্রেন চলে যাচ্ছে। পরের ট্রেন আধা ঘণ্টা পর। লেট করলে বসের গালমন্দ শুনতে হবে। কী যে মনে হলো, স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাস ধরতে ছুটলাম। হাতে সময় আছে এখনো। হয়তো একটা বাসে উঠতে পারলে অফিসে পাঞ্চ করতে পারব সময়মতো।

মাথার ভেতর অত চিন্তা নিয়ে রাস্তা পার হতে নেই। কথাটা মনে ছিল না। রাজ্যের যত দ্রুতগতির গাড়ি এড়িয়ে মাঝপথে গেছি, এমন সময় একটা প্রাইভেট কার এসে আমাকে ধাক্কা মারল। ব্যাপারটা সত্যি এত দ্রুত ঘটল কিছু বুঝতেই পারলাম না। শূন্যে ভাসমান অবস্থায় আমার হুঁশ হলো। আরে, এটা তো সত্যিকারের জীবন নয়। আমি আছি আপনালয় আবাসনের একটা ক্যাপসুলে। এটা শুধু একটা স্বপ্ন, একটা মধুর বিভ্রম। এক হাজার টাকার বিনিময়ে একটু আনন্দে থাকা।

মনে পড়ল, বাড়িওয়ালা আমাকে একটা কথা শিখিয়ে দিয়েছিল। রাস্তায় ধড়াস করে পড়ার পর লাইন দুটো মনে পড়ল, ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই/ কুঁড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই।’

রাস্তায় শুয়ে ধীরে ধীরে কবিতাটা আওড়ালাম। প্রথমে বিড় বিড় করে, তারপর গলা ফাটিয়ে। কিছুই হলো না। বাড়িওয়ালা বলেছিল এই দুটো লাইন বললে আমি জেগে উঠব। কিন্তু জেগে উঠছি কই? আমি যেখানে ছিলাম, সেখানেই আছি, মহাব্যস্ত বাংলামোটর সিগন্যালে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। ভয়ে-আতঙ্কে ঘাম ছুটে গেল আমার। কিসের মধ্যে আটকা পড়েছি আমি?

রাস্তায় ততক্ষণে যানজট বেধে গেছে। লোকাল বাসের এক হেলপার ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘ওই মিয়া, রঙ্গ করণের জায়গা পান না? রাস্তা থাইকা ফুডেন কইতাছি।’

আমি এক লাফে রাস্তা থেকে ফুটপাতে উঠে এলাম। অত জোরে ধাক্কা খেলেও শরীরে আঘাতের চিহ্ন মাত্র নেই। গায়ের বল যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। হাতঘড়িতে দেখলাম এখনো নয়টা বাজতে আট মিনিট বাকি আছে। দৌড়ে গেলে হয়তো এখনো পৌঁছাতে পারব।

ফুটপাতের জনারণ্য এড়িয়ে আমি দৌড়াতে শুরু করলাম।