দ্য ট্রেজার ইন দ্য ফরেস্ট

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

ডিঙিনৌকাটা এখন ডাঙার দিকে এগোচ্ছে। খাঁড়িটা দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে এল। ছোট্ট নদীটা যেখানটায় সাগরের সঙ্গে মিলেছে, সেই জায়গাটা দেখা যাচ্ছে ফেনিল ঢেউয়ের ফাঁকে ফাঁকে। আর দেখা যাচ্ছে দূরের পাহাড়ের ঢালে গজিয়ে ওঠা শ্যামল অরণ্য।

বন এখানে সৈকতের খুব কাছাকাছি পর্যন্ত চলে এসেছে। এখান থেকে বহুদূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতমালা। স্পষ্ট দেখাও যায় না। কেমন মেঘাচ্ছন্ন। সমুদ্র স্থির—একটু শুধু ফুলে আছে, তা-ও খুব সামান্য, খালি চোখে ধরা যায় না। আকাশে গনগনে রোদ।

দাঁড় বাইছিল যে লোকটা, সে থেমে গেল। ‘এখানেই কোথাও আছে ওটা,’ বলল সে। দাঁড় নামিয়ে রেখে দুই হাত বাড়িয়ে দিল সামনে।

তার সঙ্গী বসে আছে ডিঙির সামনের অংশে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ডাঙা। তার হাঁটুতে এক তা হলুদ কাগজ।

‘এটা দেখ তো, ইভান্স,’ বলল সে।

দুজনেই কথা বলছে নিচু গলায়। তাদের ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে খটখট করছে।

ইভান্স নামের লোকটা এগিয়ে এসে সঙ্গীর কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিল।

কাগজটা দেখতে খসড়া ম্যাপের মতো। এত বেশিবার ভাঁজ করা হয়েছে যে আরেকটু হলেই ছিঁড়ে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। বিবর্ণ ম্যাপের যেসব অংশ ছিঁড়ে পড়ার উপক্রম, ওই জায়গাগুলো দুহাতে ধরে রেখেছে দ্বিতীয়জন। আবছাভাবে বোঝা যায়, ম্যাপটিতে পেনসিল দিয়ে খাঁড়ির নকশা আঁকা হয়েছে।

‘এই এখানে,’ এক জায়গায় আঙুল রাখল ইভান্স, ‘খাঁড়িটা। আর এখানে ফাঁকা জায়গাটা।’ চার্টের ওপর বুড়ো আঙুলের নখ বোলাল সে। ‘আর এই আঁকাবাঁকা, মোড় নেওয়া রেখাটা হলো নদী। আর তারকা চিহ্নটা হলো ওই জায়গা।’

‘ফুটকিওয়ালা লাইনটা দেখছ?’ ম্যাপ ধরা লোকটা বলল। ‘খাঁড়ি যেখানে উন্মুক্ত হয়েছে, সেখান থেকে একটা পামগাছের ঝাড় পর্যন্ত চলে গেছে সরলরেখাটা।’

‘ব্যাপারটা অদ্ভুত,’ খানিকক্ষণ নীরব থাকার পর বলল ইভান্স। ‘এই ছোট দাগগুলো এখানে কেন? কোনো বাড়ি বা ও রকম কোনো কিছুর প্ল্যান মনে হচ্ছে। কিন্তু এই ড্যাশগুলো কী? বুঝতে পারছি না। আর এই লেখাগুলো?’

‘চীনা,’ ম্যাপওয়ালা জবাব দিল।

‘আচ্ছা! ব্যাটা তাহলে চীনি ছিল।’

‘ওরা সবাই-ই চীনি ছিল,’ বলল ম্যাপ ধরা লোকটা।

ডাঙার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ মিনিট কয়েক বসে রইল দুজনে। নৌকাটা ধীরে ধীরে সামনে এগোচ্ছে। দাঁড়ের দিকে চোখ চলে গেল ইভান্সের।

‘এবার তোমার দাঁড় বাওয়ার পালা, হুকার,’ বলল সে।

চুপচাপ ম্যাপটা ভাঁজ করে পকেটে পুরল ওর সঙ্গী। তারপর সাবধানে ইভান্সকে পেরিয়ে গিয়ে দাঁড় বাইতে আরম্ভ করল। নির্জীবের মতো চলাফেরা তার, যেন শরীরের সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে এসেছে।

অর্ধনিমীলিত চোখে বসে থাকল ইভান্স। প্রবালপ্রাচীরটাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখছে। মধ্যগগনে উত্তপ্ত চুল্লির মতো উত্তাপ বিলাচ্ছে সূর্য। গুপ্তধনের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। কিন্তু যতখানি ভেবেছিল, ততটা খুশি হতে পারছে না ইভান্স। পুরো পরিকল্পনাটা করার কষ্ট আর কোনো রসদ ছাড়াই ডিঙিতে করে মূল ভূখণ্ড থেকে এখানে আসার কষ্টকর নৈশভ্রমণটা ওর ভেতর থেকে সব আবেগ, উত্তেজনা শুষে নিয়েছে।

চীনা লোকটা মূল্যবান যে ধাতুর বারের কথা বলেছিল, সে কথা ভেবে নিজেকে চাঙা করার চেষ্টা করল ইভান্স। কিন্তু কাজ হলো না। বরং ওর চিন্তায় বারবার ঘুরেফিরে আসছে নদীটির তরঙ্গায়িত মিষ্টি পানি আর ঠোঁট ও গলার প্রায় অসহনীয় শুষ্কতা। এখন সে প্রবালপ্রাচীরের গায়ে আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউয়ের ছন্দোবদ্ধ আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ভালোই লাগছে শুনতে। কয়েক মুহূর্ত বাদেই ঘুমে ঢুলতে লাগল ও।

দ্বীপটা এখনো ওর মাথার মধ্যে আছে আবছাভাবে। কিন্তু ইভান্সের মনে হচ্ছে, ও যেন কোনো অদ্ভুত স্বপ্নের মধ্যে বিচরণ করছে। আবারও রাত নেমে এসেছে, চীনা লোকটার গোপন রহস্য জেনে গেছে ও আর হুকার। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া গাছগুলো দেখতে পেল ও। দেখল ছোট্ট অগ্নিকুণ্ড আর তিন চীনার কালো অবয়ব। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলছে ওরা। তিনজনে চীনের তিন এলাকা থেকে এসেছে বলে ইংরেজিই ওদের ভাবের আদান–প্রদানের ভরসা। হুকারই ওদের কথা শুনতে পেয়ে ইভান্সকে ইশারায় দেখায়। লোকগুলোর আলোচনার কিছুটা ঠিকমতো শোনা যায়নি, কিছু অংশ শুনলেও অর্থ ঠিকমতো উদ্ধার করা যায়নি।

চীনা লোকগুলো গল্প করছিল এক স্প্যানিশ গ্যালিয়ন নিয়ে। জাহাজটা ফিলিপাইনে ডুবে গিয়েছিল। গ্যালিয়নে যত ধনসম্পদ ছিল, সব লুকিয়ে রাখা হলো। কথা ছিল, পরে ফিরে এসে ওগুলো তুলে নেওয়া হবে। জাহাজডুবির শিকার হওয়া সিংহভাগ নাবিক কোনো রোগে ভুগে বা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মারা পড়ে। যারা বেঁচে ছিল, তারা নৌকা নিয়ে জনবসতি আছে, এমন তীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এরপর আর ওদের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

এরপর, এক বছর আগে, ডাঙায় ঘোরাঘুরির সময় চ্যাং-হি দুই শ বছর ধরে লুকিয়ে রাখা মূল্যবান ধাতুর বারগুলো পেয়ে যায়। জিনিসগুলো সে এক জায়গায় মাটিতে পুঁতে রেখে যায়। ওগুলো নিরাপদেই থাকবে বলে বিশ্বাস ছিল ওর। এখন ওগুলো তুলে নেওয়ার জন্য তার সাহায্যের প্রয়োজন। এরপর ওদের কণ্ঠ আরও নিচু হয়ে আসে। একটা দ্বীপে আটকা পড়া দুই ব্রিটিশ বদমাশের জন্য গল্পটা যথেষ্ট লোভনীয়।

ইভান্সের স্বপ্নের মধ্যে চ্যাং-হি ফিরে এসেছে। চীনা লোকটার চুলের ঝুঁটি ধরে টানছে সে। ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেছে চ্যাং-হির চেহারা, তারপরও হাসছে দাঁত বের করে। শেষের দিকে দুর্বোধ্য এক হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। স্বপ্নে ইভান্স আরও দেখল রাশি রাশি স্বর্ণের স্তূপ। ওই সোনার কাছে যেন যেতে না পারে, সে জন্য প্রাণপণে ইভান্সকে বাধা দিচ্ছে চ্যাং-হি। দুজনের মধ্যে শুরু হলো ধস্তাধস্তি। কিন্তু চ্যাং-হি আকারে ক্রমেই বড় হতে লাগল। আর উজ্জ্বল সোনাগুলো হয়ে গেল জ্বলন্ত চুল্লি।

‘ইভান্স, অ্যাই ইভান্স, গর্দভ!’ কে যেন চেঁচিয়ে ডাকল ওকে। হুকার নাকি?

ঝটকা খেয়ে জেগে গেল সে। লেগুনের মুখে চলে এসেছে ওদের ডিঙি।

‘তিনটে পামগাছ আছে। ওই ঝাড়ের পাশেই এক সারিতে থাকবে গাছগুলো,’ বলল ওর সঙ্গী। ‘খেয়াল রেখো। ওই ঝোপগুলোর ভেতর দিয়ে সোজা এগোলে জলধারাটা পেয়ে যাব।’

নদীর প্রান্তটা এখন ওদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে এসেছে। ওটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে চাঙা হয়ে উঠল ইভান্স। সঙ্গীকে বলল, ‘জলদি করো, ভাই, নইলে সাগরের পানিই খেয়ে ফেলব। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে।’ পর্বত ও অরণ্যের ফাঁক গলে আসা রুপালি ঝিলিক দেখতে লাগল সে হাত কামড়াতে কামড়াতে।

খানিক বাদে হিংস্র চোখে হুকারের দিকে ফিরল সে। বলল, ‘দাঁড়টা আমাকে দাও।’

নদীর মুখে পৌঁছে গেছে ওরা। খানিকটা পানি তুলে নিল হুকার হাতের তালুতে। চেখে দেখল। মুখ থেকে ফেলে দিল। আরেকটু এগিয়ে ফের পানির স্বাদ নিয়ে দেখল। এবার সন্তুষ্ট হয়ে বলল, ‘ভালো হয়েছে।’ তারপর ঢকঢক করে গিলে ফেলল বেশ খানিকটা পানি।

‘ধুত্তোর!’ আচমকা চেঁচিয়ে উঠল ইভান্স। ‘অনেক বেশি সময় লাগছে।’ ডিঙির সামনের অংশে ঝুঁকে পড়ল সে। তারপর জিব দিয়ে কুকুরের মতো চুকচুক করে খেতে লাগল নদীর মিষ্টি পানি।

আশ মিটিয়ে পানি পান করল দুজনে। খানিক বাদে ছোট একটা খাঁড়িতে নৌকা ঢোকাল। গাছপালায় ভরপুর একটা জায়গায় নামতে যাচ্ছিল ওরা। পানির ওপর পর্যন্ত চলে এসেছে গাছের ডালপালা।

ইভান্স, ‘এই গাছপালার দঙ্গল ঠেলে সৈকতে পৌঁছে ঝোপটা খুঁজে বের করতে খুব কষ্ট হবে।’

‘তার চেয়ে বরং দাঁড় বেয়ে আরেকটু এগোই,’ বলল হুকার।

কাজেই নৌকা নিয়ে ফের পিছিয়ে গেল ওরা। এবার একেবারে ঝোপগুলো যেখানে গজিয়ে উঠেছে, সেখানে গিয়ে নৌকা ভেড়াল। ওখানে নেমে হালকা ডিঙিটা টেনে সৈকতে উঠিয়ে ফেলল। তারপর হাঁটা ধরল জঙ্গলের দিকে। প্রবালপ্রাচীর আর ঝোপগুলো যেখানে এক সারিতে উন্মুক্ত হয়েছে, সেখানে গিয়ে থামল ওরা। ডিঙি থেকে একটা কোদালমতো জিনিস নিয়েছে ইভান্স, নেটিভরা ব্যবহার করত ওটা। ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির জিনিসটার বাঁকানো অংশটুকু চকচকে পাথরের তৈরি। হুকারের হাতে নৌকার দাঁড়। ‘এখান থেকে সিধে যেতে হবে,’ বলল সে। ‘জলধারায় পৌঁছে ওখান থেকে খোঁজা শুরু করব।’

নলখাগড়ার ঘন ঝাড় আর নিচু গাছপালা ঠেলে এগোচ্ছে ওরা। প্রথমে খুব কষ্ট হচ্ছিল। খানিক এগোতেই অবশ্য গাছগুলো বড় হয়ে গেল। পাতলা হয়ে এল নলখাগড়ার বনও। মাথার ওপর সূর্যের খরতাপও নেই, শীতল ছায়া বিলাচ্ছে গাছপালার আচ্ছাদন। গাছগুলো বড় হতে হতে শেষে বিশাল পিলারের আকার ধারণ করল। মাথার ওপর ছাতার মতো সবুজ আচ্ছাদন তৈরি করেছে ডালপালা দিয়ে। নাম না–জানা হালকা সাদা ফুল ধরেছে গাছগুলোতে। এ ছাড়া গাছগুলোকে জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে নানান লতা। যত এগোল, ততই গাঢ় হলো ছায়া।

শিউরে উঠল ইভান্স। ‘এখানে রীতিমতো শীত লাগছে।’

‘আশা করি, সোজা পথেই চলছি,’ বলল হুকার।

দূরে, প্রায়ান্ধকারের মাঝে একটা উন্মুক্ত জায়গা দেখতে পেল ওরা। উষ্ণ সূর্যালোক খেলা করছে বনের ওই ফাঁকা অংশে। রংবেরঙের ফুলও দেখা যাচ্ছে ওখানটায়। খানিক বাদেই ওরা শুনতে পেল পানিপ্রবাহের আওয়াজ।

‘এই যে নদী। কাছাকাছি চলে এসেছি বোধ হয়,’ হুকার বলল।

গাছগাছড়া ঘন হয়ে জন্মেছে নদীতীরে। বড় গাছগুলোর শিকড়ের ফাঁকে জন্মেছে নাম না–জানা ছোট গাছগাছড়ার দঙ্গল। চারদিকে রংবেরঙের ফুলের মেলা বসেছে যেন। প্রশস্ত, শান্ত জলাধারের পানিতে ভাসছে বড়, ডিম্বাকার, মোমের মতো চকচকে গোলাপি-সাদা ফুল। দেখতে জলপদ্মের মতো। এখানে এসে নদীটা সহসা বাঁক নিয়ে দূরে সরে গেছে। আচমকা বাঁক নেওয়ার ফলে এখানে পানিপ্রবাহের আওয়াজ গেছে অনেক বেড়ে।

‘এখন?’ সঙ্গীর দিকে ফিরে প্রশ্ন করল ইভান্স।

‘পথ থেকে একটু সরে গেছি আমরা,’ হুকার জবাব দিল। ‘সেটা অবশ্য স্বাভাবিক।’

ঘাড় ফিরিয়ে পেছনের শীতল ছায়া-অন্ধকার বনের দিকে চাইল সে। ‘জলধারা ধরে একটু এগোলেই কিছু একটা পাব আশা করি।’

‘তুমি বলেছিলে…’ কথা শেষ করতে পারল না ইভান্স।

‘সে বলেছিল,’ হুকার বলল, ‘পাথরের একটা স্তূপ আছে।’

‘প্রথমে ভাটির দিকে দেখি চলো,’ খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর বলল ইভান্স।

ধীরে ধীরে এগোতে লাগল ওরা, সাবধানে নজর রাখছে আশপাশে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল ইভান্স। ‘ওটা কী?’

ও যেদিকে আঙুল তুলেছে, সেদিকে চোখ ফেরাল হুকার। ‘নীল রঙের কিছু একটা,’ বলল সে। খানিক এগিয়ে উঁচুমতো একটা জায়গায় পৌঁছাতেই জিনিসটা দৃষ্টিগোচর হলো ওদের।

হনহন করে এগিয়ে গেল হুকার। এবার স্পষ্ট বুঝতে পারল, একটা মানুষ পড়ে আছে সামনে। উপুড় হয়ে। ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তার আর হারানোর কিছু নেই। প্রাণটাই যে বেরিয়ে গেছে তার শরীর থেকে।

গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে দুই গুপ্তধনশিকারি। নীরবে তাকিয়ে আছে মৃতদেহটার দিকে। গাছে নিচে পরিষ্কার একটা জায়গায় পড়ে আছে দেহটা। পাশেই পড়ে আছে চীনা ধাঁচের একখানা কোদাল। তার থেকে খানিক দূরে, নতুন খোঁড়া একখানা গর্তের পাশে, ওরা দেখতে পেল একটা পাথরের স্তূপ।

‘আমাদের আগে কেউ এসেছে এখানে,’ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল হুকার।

তারপরই হঠাৎ গালির তুবড়ি ছোটাল ইভান্স। মাটিতে পা ঠুকতে লাগল প্রচণ্ড রাগে।

হুকারের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, কিন্তু কিছু বলল না। মৃতদেহটার দিকে এগিয়ে গেল সে। দেখতে পেল, ঘাড়টা ফুলে বেগুনি হয়ে গেছে। হাত-পাও ফুলে গেছে। আচমকা ঘুরে খোঁড়া গর্তটার দিকে এগোল হুকার। বিস্মিত চিৎকার বেরিয়ে এল ওর গলা চিরে।

‘গাধা! এখনো কিছু খোয়া যায়নি,’ ইভান্সের উদ্দেশে চেঁচাল সে।

তড়িঘড়ি গর্তটার দিকে ছুটে এল ইভান্স। অনেকগুলো হলদেটে ধাতুর বার উঁকি মারছে গর্ত থেকে। গর্তের ওপর ঝুঁকে পড়ে খালি হাতে আলগা মাটি সরাতে লাগল সে। তারপর টেনে ওপরে ওঠাল সব কটি ভারী বার। কাজটা করার সময় ছোট্ট একটা কাঁটা বিঁধল ওর হাতে। ছোট্ট কাঁটাটা আঙুল থেকে খুলে বারগুলো তুলে ধরল সে। আনন্দে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘সোনা বা সিসা ছাড়া আর কোনো কিছুর এত ওজন হয় না।’

হুকারের চোখ তখনো স্থির মৃত চীনা লোকটার ওপর। ওর বিহ্বল ভাব এখনো কাটেনি।

‘ব্যাটা বন্ধুদের ফাঁকি দিয়ে একা এসেছিল এখানে,’ অবশেষে মুখ খুলল হুকার। ‘তারপর কোনো বিষধর সাপের কামড়ে টেঁসে গেছে। …লোকটা এই জায়গা খুঁজে পেল কী করে ভাবছি।’

বারগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইভান্স। একটা চীনা এখানে মরে পড়ে থাকার মানে কী? ‘এগুলো মূল ভূখণ্ডে নিয়ে কিছুদিন মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে। একে নৌকা পর্যন্ত বয়ে নেব কী করে?’

গা থেকে জ্যাকেট খুলে মাটিতে বিছিয়ে বেশ কিছু বার ছুড়ে ফেলল ওটার ওপর। আরেকটা কাঁটার খোঁচা খেল সে।

‘এর বেশি বইতে পারব না। অনেক ওজন,’ বলল ইভান্স। তারপর হঠাৎ বিরক্ত হয়ে উঠল সে। ‘কী দেখছ এভাবে?’

ওর দিকে ফিরল হুকার। ‘ওকে সহ্য করতে পারছি না…’ ইশারায় মৃতদেহটা দেখাল। ‘লোকটা দেখতে…’

‘ফালতু কথা!’ খেঁকিয়ে উঠল ইভান্স। ‘সব চীনাই দেখতে এক রকম।’

ওর মুখের দিকে তাকাল হুকার। ‘সে যা-ই হোক, এই জিনিসে হাত দেওয়ার আগে আমি ওকে কবর দেব।’

‘গাধার মতো কথা বোলো না তো,’ ধমকে উঠল ইভান্স। ‘ও কাজ পরেও করতে পারবে।’

খানিকক্ষণ ইতস্তত করল হুকার। তারপর ওর চোখ চলে গেল ওদের চারপাশের বাদামি মাটিতে। ‘কেন যেন ভয় লাগছে।’

‘এখন কথা হচ্ছে,’ সঙ্গীর দুশ্চিন্তায় পাত্তা দিল না ইভান্স, ‘এই বারগুলোর কী গতি করব? এখানেই আবার পুঁতে রাখব নাকি নৌকায় নিয়ে যাব?’

ভাবছে হুকার। ওর বিভ্রান্ত দৃষ্টি মাথার ওপরের গাছগুলোর ডালপালায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোখ দুটো ঘুরতে ঘুরতে চীনা লোকটার নীলচে শরীরের ওপর স্থির হতেই আবার কেঁপে উঠল সে। গাছগুলোর ধূসর ফাঁকা জায়গাগুলোতে কিছু একটা খুঁজছে ওর দুচোখ।

‘তোমার হয়েছেটা কী, হুকার?’ ইভান্স বলল। ‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

‘আগে সোনাগুলো এখান থেকে বের করি চলো,’ অবশেষে মুখ খুলল হুকার।

জ্যাকেটের কলারের প্রান্ত ধরল সে, ইভান্স ধরল অপর প্রান্ত।

কয়েক কদম হাঁটার পরই ইভান্স বলে উঠল, ‘দাঁড় বেয়ে হাতটা ব্যথায় টনটন করছে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না।’

ব্যথা গ্রাহ্য না করে আরও কয়েক কদম এগোল সে। কিন্তু তারপর আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘ধুত্তোর! ব্যথা কমছে না! একটু জিরাতে হবে।’

জ্যাকেটখানা নামিয়ে রাখল ওরা। ইভান্সের চেহারা সাদা হয়ে গেছে, বিন্দু বিন্দু স্বেদ জমেছে কপালে। ‘বনের ভেতরটা কেমন গুমোট লাগছে।’

পরক্ষণে কোনো কারণ ছাড়াই খেপে গিয়ে বলল, ‘সারা দিন এখানে বসে থেকে ফায়দাটা কী? ধরো তো! মরা চীনাটাকে দেখার পর থেকে কোনো কাজেই হাত লাগাওনি তুমি।’

স্থিরদৃষ্টিতে সঙ্গীর মুখের দিকে চেয়ে আছে হুকার। বারসহ জ্যাকেটখানা তুলে নীরবে এক শ গজমতো এগোল দুজনে। ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে শুরু করেছে ইভান্স। ‘কথা বলতে পারো না?’ রুক্ষ স্বরে বলল সে।

‘তোমার কী হয়েছে বলো তো?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল হুকার।

হোঁচট খেল ইভান্স। তারপর হঠাৎ জ্যাকেট ছেড়ে দিল হাত থেকে। সোনার বারগুলো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। দীর্ঘ এক মুহূর্ত হুকারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইভান্স, তারপর গুঙিয়ে উঠে দুহাতে নিজের গলা খামচে ধরল।

‘আমার কাছে এসো না,’ একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বলল সে। তারপর আগের চেয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘এক মিনিটে ঠিক হয়ে যাব।’

কয়েক মুহূর্ত বাদেই গাছের গোড়ায় ঢলে পড়ল সে। হাত দুটো ভয়ংকরভাবে কাঁপছে। যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে গোটা চেহারা। তড়িঘড়ি ওর দিকে এগোল হুকার।

‘ছোঁবে না! আমাকে ছোঁবে না!’ ফ্যাসফেসে গলায় বারণ করল ইভান্স। ‘সোনাগুলো জ্যাকেটে তুলে রাখো।’

‘তোমার জন্য আমি কিছু করতে পারব না?’ ব্যথিত কণ্ঠে বলল হুকার।

‘সোনাগুলো জ্যাকেটে তুলে রাখো।’

সোনার বারগুলো কুড়িয়ে জ্যাকেটে রাখার সময় বুড়ো আঙুলে ছোট্ট একটা খোঁচা খেল হুকার। হাতের দিকে তাকাতেই একটা ছোট্ট কাঁটা দেখতে পেল সে, লম্বায় ইঞ্চি দুয়েক হবে।

দুর্বোধ্য চিৎকার দিয়ে গড়ান দিল ইভান্স।

হুকারের চোয়াল ঝুলে পড়ল। কয়েক মুহূর্ত বিস্ফারিত চোখে দেখল আঙুলে ফোটা কাঁটাটি। তারপর চোখ ফেরাল ইভান্সের দিকে। ওর সঙ্গী এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, শরীর বেঁকে গেছে। খিঁচুনি উঠে গেছে।

পরক্ষণেই কয়েক শ গজ দূরে পড়ে থাকা চীনা লোকটার মরদেহের দিকে চোখ চলে গেল হুকারের। ম্যাপটায় আঁকা ছোট ড্যাশগুলোর কথা মনে পড়ল ওর। এবার সে ওগুলোর মানে বুঝতে পারছে।

‘ঈশ্বর! বাঁচাও!’ অস্ফুটে বলে উঠল হুকার। বোর্নিওর দায়াক গোত্রের লোক তাদের ব্লোয়িং-টিউবে এ রকম বিষ মাখানো কাঁটা ব্যবহার করে। এবার সে বুঝতে পারছে, চ্যাং-হি ওর গুপ্তধনের নিরাপত্তা নিয়ে অত নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিল কেন। বুঝতে পারছে চীনা লোকটার রহস্যময় হাসির অর্থ।

‘ইভান্স!’ চেঁচিয়ে উঠল সে।

কিন্তু ইভান্স ততক্ষণে নীরব, নিথর হয়ে পড়েছে। হাত-পা শুধু ক্ষণে ক্ষণে বীভৎসভাবে মুচড়ে উঠছে। নিস্তব্ধতার চাদরে মুড়ে আছে গোটা অরণ্য।

হুকার এবার উন্মত্তের মতো কাঁটার খোঁচায় বুড়ো আঙুলে তৈরি হওয়া ক্ষতটা চুষতে লাগল। চুষে চুষে পারলে সব দূষিত, বিষাক্ত রক্ত বের করে ফেলবে শরীর থেকে। হাতে আর কাঁধে এক অদ্ভুত, অপরিচিত যন্ত্রণা অনুভব করছে সে। আঙুলগুলো বাঁকাতে পারছে না ঠিকমতো। খানিক বাদেই বুঝে গেল, আঙুল চুষে কোনো লাভ নেই।

কোনো আশা নেই বুঝতে পেরে সে থেমে গেল। গালে হাত, হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে পড়ল বারগুলোর পাশে। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সঙ্গীর ভাঁজ হয়ে যাওয়া শরীরের দিকে। চ্যাং-হির হাসিটা আরেকবার ভেসে উঠল মনের পর্দায়। ভোঁতা যন্ত্রণাটা এখন গলা বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে যন্ত্রণার তীব্রতা। অনেক…অনেক দূরে ঝিরঝিরে বাতাসে দুলে উঠল অরণ্যানী। সেই বাতাসে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে নাম না–জানা সাদা ফুলের পাপড়ি।