গ্রামারে গন্ডগোল

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

রবিন মারা গেছে, তা-ও পানিতে ডুবে! কথাটা কিছুতেই আমার বিশ্বাস হতে চাইল না।

ও ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। বয়সে ছোট। কিন্তু আমরা দুজন একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। ফিরতাম। এত দিন কেন একবারও ওর খোঁজ নিইনি, ভেবে ভীষণ অপরাধবোধ হলো আমার।

ক্লাস সেভেন পর্যন্ত তালবাড়িয়া গ্রামে বড় হয়েছি আমি। এখানকার স্কুলে পড়েছি। সিক্সে উঠে পুরো পরিবারসহ চলে গেলাম ঢাকায়। তারপর এই তালবাড়িয়া গ্রাম, শর্ষের খেত, বড় বড় পুকুর, টিনের চালাঘর—স্মৃতিতে সব একটু একটু করে ফিকে হয়ে গেল। শুরুর দিকে ঝুমবৃষ্টি নামলে গ্রামের কথা খুব মনে পড়ত। বৃষ্টি তো বৃষ্টিই। আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ে—এই তো। অথচ শহর আর গ্রামের বৃষ্টি একদম আলাদা। মেঘের গর্জনের শব্দ আলাদা, মাটির গন্ধ আলাদা, এমনকি বৃষ্টির পানির স্বাদও আলাদা। এই সব কিছুই আমি আগে জানতাম না। শহরে গিয়ে জেনেছি।

গ্রামে বৃষ্টি নামলে আমি আর রবিন একছুটে চলে যেতাম নদীতে। পানিতে দাপাদাপি করতাম। ওপরের দিকে মুখ তুলে হাঁ করে বৃষ্টির পানি খেতাম। রবিন খুব ভালো সাঁতার জানত। ডুবসাঁতার দিয়ে চলে যেত বড় ট্রলারগুলোর কাছে। ভীষণ ভয় লাগত আমার।

সেই রবিন মারা গেল পানিতে ডুবে!

‘বাজান তো ম্যালা বছর পর আইলা।’

ইকবাল চাচার কথায় আমার ধ্যান ভাঙে। ম্লান হেসে বলি, ‘জি চাচা। ১৫-১৬ বছর তো হবেই।’

‘তোমার আব্বা আছে কেমন?’

আমি তখনো চাচার কথায় ঠিক মন দিতে পারছিলাম না। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি।

‘আচ্ছা, রবিন পুকুরে ডুবল কীভাবে বলেন তো? ও তো খুব ভালো সাঁতার জানত।’

‘কী জানি। রবিনের সাইকেলটাও পুকুরেই পাওয়া গেছিল। ওর মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। হয়তো কোথাও ধাক্কাটাক্কা খাইছে। রবিন খুব দুষ্ট আছিল…তুমি তো জানো…।’

ওর হাসিমুখটা মনে পড়ে আমার মনটা কেমন ভার হয়ে গেল। সত্যিই খুব দুষ্টু ছিল রবিন। আর ভীষণ জেদি। পশুপাখির জন্য ওর খুব মায়া ছিল।

আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন শরাফত চাচারা। চাচা একবার মেরে একটা কুকুরের পা ভেঙে দিয়েছিলেন। রবিন কিছুতেই ব্যাপারটা মানতে পারেনি। এক রাতে চাচাদের বাড়ির উঠানে সে কী ঢেলে রেখেছিল কে জানে! পরদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে শরাফত চাচা এত বিকট শব্দে আছাড় খেয়েছিলেন যে আমরা আমাদের বাড়ি থেকেও শুনতে পেয়েছি।

আরেকজন লোক ছিল গ্রামে। ফাঁদ পেতে বক শিকার করত। তার ওপরও রবিনের রাগ ছিল খুব। একবার ঢিল ছুড়ে লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেই লোকের নাম এখন আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, তার লম্বা দাড়ি-গোঁফ ছিল। সে জন্য গ্রামের লোকে তাকে রবীন্দ্রনাথ বলে ডাকত।

‘আচ্ছা রবিন যে পানিতে পড়ে গেছে, খবরটা প্রথম পেলেন কী করে?’

‘১০ বছর আগের ঘটনা, বাজান। অত কিছু কী আর মনে আছে? যদ্দুর মনে পড়ে, শিবলী সবাইরে খবর দিছিল।’

‘শিবলী ভাই? মানে শরাফত চাচার ছেলে?’

‘হ হ।’

‘শিবলী ভাই থাকে কই এখন?’

‘ওই তো, স্কুলঘরের পাশেই। নতুন দুই তলা দালান হইছে না? ওইটাই শিবলীর বাড়ি। ঢেউটিনের ব্যবসা কইরা ভালো টাকা কামাইছে। বাজারে যাও। ওরে এহন দোকানে পাইবা।’

‘তুমি কি কোনো কারণে আমারে সন্দেহ করতেছ?’ শিবলী ভাই চোখ কুঁচকে তাকালেন।

‘না না, কী বলেন ভাই!’ আমি মুখে হাসি আনার চেষ্টা করলাম। চেষ্টা যে খুব একটা সফল হলো, তা নয়। শিবলী ভাইকে ছোটবেলায় আমরা খুব একটা পছন্দ করতাম না। স্কুলে আমাদের সিনিয়র ছিলেন। কথা বলার সময় রীতিমতো গায়ের ওপর এসে পড়তেন। আর তার মুখ থেকে বিকট গন্ধ আসত।

আমি শিবলী ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘এত বছর পর গ্রামে এসে শুনলাম, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাই নাই। আমার মনের অবস্থা তো বুঝতেই পারতেছেন।’

‘সেইটা বুঝছি। কিন্তু এত দিন পর পুরান ঘটনা নিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করতাছ, সেই জন্য বললাম। বসো না, চা খাও। … ওই সোলেমান, দুই কাপ চা আইনা দে তো। হ, কী জানি বলতেছিলা?’

‘বলছিলাম আপনি কীভাবে জানলেন? আপনি কি ওকে ডুবতে দেখেছিলেন?’

‘নাহ। দেখি নাই। গ্রামের সবাই রবিনরে খুঁজতেছিল। শুনলাম ওরে নাকি পাওয়া যাইতেছে না। আমিও এদিক–ওদিক দেখতেছিলাম। তখন দেখা হইল ফরেন দাদুর সঙ্গে।’

‘ফরেন দাদু…? ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে।’

বুড়ো লোকটাকে আমার মনে আছে তাঁর দামি বিস্কুটগুলোর জন্য। বিদেশি মানুষ। যত দূর জানি, তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন কোনো একটা এনজিওর কাজে। বাংলাদেশটা এত ভালো লেগে গিয়েছিল, আর ফিরে যাননি। আমাদের গ্রামেই থাকতেন। একা। একসময় খুব ভালো বাংলা বলতে পারতেন। কিন্তু শেষ বয়সে বোধ হয় একটু পাগলাটে হয়ে গিয়েছিলেন। কারও সঙ্গে দেখা হলেই ইংরেজিতে কী সব বকতেন। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না। আমরা ছোটরা অবশ্য তাকে খুব পছন্দ করতাম। কারণ, আমাদের ডেকে তিনি বিস্কুট খাওয়াতেন।

‘ফরেন দাদু রবিনকে দেখেছিল?’ চায়ে চুমুক দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘হ। আমি রবিনের কথা জিগাইতেই বারবার একই কথা কইতাছিল।’

‘কী বলছিল?’

‘বলছিল, রবিন ড্রন অ্যাট দ্য পুকুর।’

‘পুকুর? পুকুর বলল?’

‘পুকুর না ঠিক। হের কথা তো ভালো বুঝা যাইত না। ইংরেজিতে অর্ধেক কথা কয়, অর্ধেক খায়া ফালায়। সেদিন কইতেছিল, “রবিন ড্রন অ্যাট দ্য কুর! রবিন ড্রন অ্যাট দ্য কুর!”’

‘কুর শুনে আপনি পুকুর বুঝলেন কীভাবে?’

‘তুমি মনে হয় আমারে আন্ডারএস্টিমেট করতাছ? শোনো, গ্রামে থাকি বইলা পড়ালেখা যে করি নাই, তা তো না। ইংরেজি তো আমরাও কিছুটা বুঝি, নাকি? আর সে এক আঙুল উঁচা কইরা বাড়ির সামনের পুকুরটা দেখাইতেছিল। না বুঝার তো কিছু নাই।’

‘না মানে…বলছিলাম, এত আগের ঘটনা, আপনার তো কিছু ভুলও হতে পারে। হয়তো ফরেন দাদু অন্য কিছু বলছিল…’

‘উঁহু। সেই সময় দুই-একটা লোকাল পত্রিকায় নিউজ হইছিল। খবরে আমার নাম আসছে। দুই-একটা পেপার কাটিং আমি এখনো নিজের কাছে রাখছি। তুমি চাও তো দেখাইতে পারি। ওইখানেও একই জিনিস পাবা। দেখতে চাও?’

মনে হলো শিবলী ভাই রেগে যাচ্ছেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না। বললাম, ‘উঠি ভাইয়া। অনেক দিন পর দেখা হয়ে ভালো লাগল।’

বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে হঠাৎ ডাকলেন শিবলী ভাই। ‘শোনো। উঠানে আছাড় খাইয়া আমার বাপ এক মাস হাসপাতালে ছিল। কামটা যে রবিনই করছে, আমি কিন্তু জানতাম। কোনো দিন কিছু বলি নাই। আমারে তোমরা পছন্দ করতা না জানি। কিন্তু আমি মানুষটা এতও খারাপ না।’

তালবাড়িয়া থেকে ঢাকায় ফিরেছি প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। রবিনের মুখটা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছে না। দুদিন আগে ওকে স্বপ্নেও দেখেছি।

কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথাও একটা ঘাপলা আছে। অফিসে কাজের ফাঁকে আনমনেই আমি একটা কাগজ টেনে লিখলাম, ‘Robin drown at the koor’।

কুর শব্দটার তেমন কোনো অর্থ নেই। গুগল করে নিশ্চিত হলাম। Core কি হতে পারে? নাহ।

ফরেন দাদু যদি ‘পুকুর’ বুঝিয়ে থাকেন, তবু মিলছে না। কারণ, ইংরেজি গ্রামার আমি যতখানি বুঝি, পুকুরের ক্ষেত্রে ‘at the’ না বলে ‘in the’ বলার কথা। তা ছাড়া drown শব্দটাও এখানে ভুল। drowned হওয়ার কথা। আর pond না বলে দাদু পুকুর বললেন কেন?

খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ফরেন দাদু মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হলো। অতএব তাঁর সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই। আধপাগল লোকটা কী বলেছিলেন, আর শিবলী ভাই কী বুঝেছিলেন, কে জানে!

কাগজটার দিকে স্থির দৃষ্টি তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল।

সোজা হয়ে বসলাম।

আমার বন্ধু রবিন কীভাবে মারা গিয়েছিল, আমি জানি!

উত্তর

‘রবিন ড্রন অ্যাট দ্য কুর’ নয়। ফরেন দাদু বলতে চেয়েছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। গ্রামের যে লোকটার লম্বা দাড়ি-গোঁফ ছিল, সবাই তাকে রবীন্দ্রনাথ বলে ডাকত। সে-ই কাজটা করেছে!