সূর্যঘড়ির সূত্র (তৃতীয় পর্ব)

বাড়ির ভেতরে ফিরে এল সবাই। লিভিং রুমে বসে অবিলিস্কটা ভালো করে দেখতে শুরু করল অয়ন। জিমির কথাই ঠিক, কিছু লেখা নেই জিনিসটার গায়ে, তবে বেশ কিছু ছবি খোদাই করা আছে—ফলমূলের ছবি। একেক পাশে তিনটা করে ফল, সব মিলিয়ে মোট বারোটা। ছবিগুলো বোতামের মতো উঁচু হয়ে আছে অবিলিস্কের গায়ে। একটার গায়ে টিপ দিল ও, বোতামের মতোই দেবে গেল ওটা। আঙুল সরাতে আবার উঠে এল। একে একে বাকিগুলো টিপল, প্রতিটারই একই বৈশিষ্ট্য।

‘কিছু বুঝতে পারলে?’ সাগ্রহে জানতে চাইলেন হলি।

‘জিনিসটা নিরেট নয়,’ বলল অয়ন। ‘চারপাশে যে ছবিগুলো আছে, সেগুলো আসলে একেকটা বোতাম।’

‘কাজ কী ওগুলোর?’

‘টিপলাম তো সব কটিই। কিছু ঘটল না। হয়তো কোনো সিকোয়েন্স আছে। অনেকটা কম্বিনেশনের মতো।’

‘কম্বিনেশন কোথায় পাব?’

‘বুঝতে পারছি না।’

‘অবিলিস্কের সঙ্গেই তো থাকা উচিত,’ বলল জিমি। ‘হয়তো কায়দা করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।’

‘যেখান থেকে আনলাম, সেই ফোকরে আর কিছু ছিল না,’ মাথা নেড়ে বলল অয়ন। ‘সূত্র কিছু থাকলে এটার মধ্যেই আছে।’ অবিলিস্কের তলাটা দেখল ও। পরক্ষণে চমকে উঠল। ‘আরে! আরেকটা ছবি আছে এখানে!’

‘কীসের ছবি?’

তলাটা সবাইকে দেখাল অয়ন। কোনো ফল নয়, ওখানে সমান্তরালভাবে খোদাই করা হয়েছে চারটা অর্ধবৃত্ত—একটার ভেতরে আরেকটা, বাইরেরটা সবচেয়ে বড়, ভেতরেরটা সবচেয়ে ছোট। এই ছবিটা অবশ্য টেপা গেল না। বোতাম নয় ওটা।

‘কী বোঝানো হচ্ছে ওটা দিয়ে?’ বোকা বোকা গলায় বলল ডিকন।

‘বাকিগুলোর চেয়ে একদমই আলাদা,’ অয়ন বলল। ‘এটাই হয়তো কম্বিনেশনের সূত্র।’

‘কীভাবে?’

নীরব হয়ে গেল সবাই। ভাবছে। হঠাৎ জিমি বলল, ‘আচ্ছা, ওটা কি রংধনু হতে পারে?’

‘সম্ভাবনা প্রবল,’ সায় জানাল অয়ন। ‘আমার কাছেও তা-ই মনে হচ্ছে।’

‘কিন্তু রংধনুর সঙ্গে ফলমূলের সম্পর্ক কী?’

‘কী কী ফলের ছবি আছে, তা আগে লিস্ট করে ফেলা যাক।’

পকেট নিজের নোটবুক বের করল অয়ন। অবিলিস্কের চারটা পাশের তালিকা লিখে ফেলল দ্রুত।

১. স্ট্রবেরি, আপেল, লেবু।

২. আঙুর, তরমুজ, কলা।

৩. রাস্পবেরি, পাল্ম, আনারস।

৪. কমলা, ব্লুবেরি, ক্যান্টালোপ।

‘কিছুই বুঝলাম না,’ মাথা নাড়ল জিমি। ‘একেকটা একেক ধরনের ফল। রংধনুর সঙ্গে কোনোটারই মিল নেই।’

কী যেন ভাবল অয়ন। তারপর বলল, ‘আছে। ভালো করে ভেবে দেখো, এই ফলগুলোর দিকে তাকালে প্রথমেই কী ভেসে ওঠে চোখে?’

ভুরু কোঁচকাল জিমি। ‘কী আবার আসবে? নাম দেখেই তো জিবে জল চলে আসছে। প্রায় সব কটিই রসাল ফল, বিশেষ করে আঙুর আর স্ট্রবেরি তো আমার খুবই প্রিয়...’

ওর মাথায় একটা চাঁটি মারল অয়ন। ‘পেটুক কোথাকার! আমি স্বাদের কথা বলিনি, দেখার কথা বলেছি। ফলগুলো দেখলে প্রথমেই কী চোখে পড়বে?’

দাঁত কিড়মিড় করল জিমি। ‘কচু! তুই এত জোরে চাঁটি মারলি আমাকে? দাঁড়া, আজ তোর একদিন কি...’ শার্টের হাত গোটাতে শুরু করল ও।

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, মারামারি বাধিয়ো না,’ তাড়াতাড়ি বললেন হলি। তাকালেন অয়নের দিকে। ‘হেঁয়ালি না করে কথাটা সরাসরিই বলছ না কেন তুমি, অয়ন? কী বলতে চাইছ?’

‘রঙের কথা বলছি, ম্যাম,’ বলল অয়ন। ‘একেকটা একেক রঙের। সত্যি সত্যি যদি এই ফলগুলো সামনে রাখা হয়, আমরা প্রথমেই বিভিন্ন রঙের বাহার দেখব।’

‘তো?’

‘রংধনুতেও রঙের বাহার দেখি আমরা। সাতটা রঙের বাহার।’

‘কিন্তু এখানে আছে বারোটা ফল,’ মনে করিয়ে দিল জিমি।

‘হয়তো সাতটা ফল খুঁজে নিতে হবে আমাদের,’ অনুমান করল অয়ন। ‘রংধনুর রঙের সাতটা ফল।’

‘তাতেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না,’ মাথা নেড়ে বললেন হলি। ‘শুধু সাতটা ফল পেলেই তো চলবে না, সেগুলোর একটা সিকোয়েন্সও থাকা চাই। যেকোনো কম্বিনেশনেরই একটা সিকোয়েন্স থাকে। এখানে তা পাচ্ছি কীভাবে?’

‘সিকোয়েন্স তো আছেই,’ মুখে হাসি ফুটল অয়নের। ‘বেনীআসহকলা।’

‘কী!’

‘রংধনুর সাত রঙের সিকোয়েন্স—বেগুনি, নীল, আসমানি বা আকাশি নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা আর লাল। সংক্ষেপে যাকে আমরা বেনীআসহকলা বলি।’

কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল সবাই। তারপরই হাঁটুতে চাপড় মেরে ডিকন বলল, ‘এই ছেলে জিনিয়াস। ঠিকই বলেছ, ওটাই কম্বিনেশনের সিকোয়েন্স হতে বাধ্য!’

‘তাহলে আর বসে আছি কেন?’ উত্তেজিত গলায় বলল জিমি। ‘আয়, বের করে ফেলি কোন রঙে কোন ফল হতে পারে।’

নোটবুকটা সেন্টার টেবিলে রাখল অয়ন। সবাই ঝুঁকল ওটার ওপর।

‘প্রথমে বেগুনি,’ বলল অয়ন। ‘আঙুরের রং বেগুনি হয়।’

‘ব্লুবেরি নীল,’ বলল জিমি। ‘কোনো সন্দেহ নেই।’

‘কিন্তু আসমানি?’ জিজ্ঞেস করল ডিকন।

লিস্টের ওপর চোখ বোলাল অয়ন। ‘বাজারে হালকা নীল রঙের পাল্ম পাওয়া যায়।’

‘তিনটা হয়ে গেল,’ খুশি খুশি গলায় বললেন হলি। ‘এরপর সবুজ...লেবু না হয়ে যায়ই না।’

‘কলার রং হলুদ,’ বলল ডিকন।

‘পাঁচটা হয়ে গেল,’ বলল অয়ন। ‘বাকি দুটি আরও সহজ। কমলা তো কমলাই। লাল দিয়ে নির্ঘাত স্ট্রবেরি বুঝিয়েছে।’

‘ব্যস, হয়ে গেল সাতটা,’ বলল জিমি। ‘আঙুর, ব্লুবেরি, পাল্ম, লেবু, কলা, কমলা আর স্ট্রবেরি।’

অবিলিস্কটা হলির দিকে বাড়িয়ে ধরল অয়ন। ‘বোতামগুলো টিপতে চান আপনি?’

‘না, তুমিই টেপো,’ বললেন হলি। ‘সম্মানটা তোমারই প্রাপ্য।’

মাথা ঝাঁকিয়ে একে একে সাতটা বোতাম চাপল অয়ন। সঙ্গে সঙ্গে খুলে পড়ে গেল অবিলিস্কের তলাটা। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা কাচের টিউব। টিউবের ভেতরে রয়েছে গোল করে পাকানো একটুকরা কাগজ। কাগজটা বের করল ও, ভাঁজ খুলল সাবধানে।

‘কী লিখেছে?’ জানতে চাইল ডিকন।

‘দেখুন।’ কাগজটা সমান করে টেবিলে বিছাল অয়ন। সেটায় এই কথাগুলো লেখা:

‘ফ্রেড ইনক্রিজিংলি নিডস ডায়মন্ডস দ্যাট হ্যাভ এমারেল্ডস ফিচার্ড অ্যাজ লাভলি লিলিজ এমবেডেড নিয়ার গ্র্যান্ট’স ইমেমাবাইল অ্যান্ড ন্যারো টুম।’

চোয়াল ঝুলে পড়ল সবার। জিমি বলল, ‘মানে কী এ কথার?’

‘ফ্রেড নামে কারও কথা বলছে,’ চিন্তিত গলায় বলল ডিকন। ‘হিরের চাহিদা বাড়ছে তার। তা-ও আবার যে সে হিরে নয়, যেটার গায়ে সুন্দর পদ্মফুলের মতো করে পান্না বসানো। হিরের কোনো অলংকার হতে পারে। সেটা পুঁতে রাখা হয়েছে গ্র্যান্ট নামের আরেকজনের কবরের কাছে, যেটা সংকীর্ণ আর অনড়।’

‘কবর তো অনড়ই হওয়ার কথা,’ বলল জিমি।

‘সেটা কথা নয়। কথা হলো, গ্র্যান্টের কবরটা কোথায়?’

‘গ্র্যান্ট নামে কাউকে চেনেন আপনি?’ হলিকে জিজ্ঞেস করল জিমি। ‘কিংবা ফ্রেডকে?’

‘না,’ মাথা নাড়লেন হলি। ‘আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ওসব নামের কেউ নেই। বাবার বন্ধুবান্ধবের কেউ হতে পারে, কিন্তু তাদের কাউকে চিনি না। আমি তো অনেকদিন থেকেই বাড়ির বাইরে।’

অয়নকে কনুইয়ের গুঁতা দিল জিমি। ‘কী রে, কিছু বলছিস না কেন?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল অয়ন। তারপর বলল, ‘খুব সরলভাবে ভাবছেন আপনারা। লাইনটায় যা বলা হয়েছে, তা-ই যদি করতে হয়, তাহলে তো কোনো চ্যালেঞ্জ থাকে না। সূর্যঘড়ির লাইনটায় ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে সংকেত দেওয়া হয়েছিল, কাজেই এখানেও একই ধরনের প্যাঁচ থাকাটাই যুক্তিসংগত।’

‘তার মানে, অন্য কিছু বোঝানো হয়েছে লাইনটা দিয়ে?’ বললেন হলি। ‘সেটা কী হতে পারে?’

কাগজে চোখ বোলাল জিমি। ‘এখানে পদ্মফুলের কথা বলা হয়েছে...পুকুরে পদ্মফুল ফোটে! পেছনের পুকুরটাতেও আছে।’

‘ভালভ খুলে সব পানি বের করে দিতে পারি আমরা,’ প্রস্তাব দিল ডিকন। ‘হয়তো পানির নিচে...’

মাথা নাড়ল অয়ন। ‘পদ্ম দেখেই পুকুরের দিকে ছোটার কোনো মানে হয় না। আরও অনেক কিছুই রয়েছে ধাঁধাটায়। যেমন ধরুন, কবর।’

‘আশপাশে কারও কবর আছে?’ জানতে চাইল জিমি। ‘কিংবা কোনো গোরস্তান?’

‘না, নেই,’ বললেন হলি।

‘হুম। সে ক্ষেত্রে ফ্রেড বা গ্র্যান্ট দিয়ে মানুষের বদলে অন্য কিছু বোঝাতে পারে। হয়তো কোনো জায়গার নাম...’

‘উঁহু, এদিকে কোনো জায়গার নামও ফ্রেড বা গ্র্যান্ট নয়,’ বলল ডিকন। ‘থাকলে আমিই জানতাম।’

হতাশ হয়ে অয়নের দিকে তাকাল জিমি। ওর বন্ধুর তুখোড় মগজই এখন ভরসা।

মাথার ভেতরে ঝড় চলছে অয়নের। ধাঁধার কয়েকটা জিনিস খটকা জাগাচ্ছে ওর মনে। প্রথমত, পুরোটাই একটা বাক্য। ভেঙে ভেঙে ছোট কয়েকটা বাক্য লিখলে কথাগুলো বুঝতে সুবিধে হতো, কিন্তু তা করা হয়নি। কেন? তা ছাড়া বিশাল বাক্য লিখতে গিয়ে পুরোটাই গড়বড়ে হয়ে গেছে, পুরোপুরি অর্থবহ হয়নি। কবরের বর্ণনাটাও সন্দেহ জাগানোর মতো। কবর মানেই স্থির, অনড় এবং সংকীর্ণ। সেগুলো আবার লিখে দেওয়ার মানেটা কী? শব্দ বাড়ানো হয়েছে বাক্যের? কিন্তু কেন?

ভাবতে ভাবতে আচমকা মাথার ভেতরে যেন হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠল ওর। শব্দ বাড়ানোর কারণ একটাই হতে পারে; এত বড় ও জটিল বাক্য লেখার কারণও সেটাই। উত্তেজিত ভঙ্গিতে নিজের নোটবুক টেনে নিল ও, একটা একটা করে সব কটা শব্দ লিখল ওপর থেকে নিচে। লেখাটা এ রকম দাঁড়াল:

Fred

Increasingly

Needs

Diamonds

That

Have

Emeralds

Featured

As

Lovely

Lilies

Embedded

Near

Grant’s

Immobile

And

Narrow

Tomb

‘কী লিখছিস?’ পাশ থেকে জানতে চাইল জিমি।

নোটবুকটা ওর দিকে ঠেলে দিল অয়ন। বলল, ‘সব কটি শব্দের প্রথম হরফ নে। সেগুলো পাশাপাশি সাজা।’

‘মাই গড!’ বুঝতে পেরে চমকে উঠল জিমি। ‘এ তো আরেকটা লাইন।’

‘কিসের কথা বলছ তোমরা?’ বোকা বোকা গলায় প্রশ্ন করলেন হলি।

‘শব্দগুলোর প্রথম হরফ নিলে আমরা পাই FINDTHEFALLENGIANT,’ ব্যাখ্যা করল অয়ন। ‘যদি জায়গামতো স্পেস বসান, তাহলে ওটাই হয়ে যাচ্ছে ফাইন্ড দ্য ফলেন জায়ান্ট। কোনো এক পতিত দৈত্যের কথা বলা হচ্ছে আমাদের।’

‘ফলেন জায়ান্ট!’ ভ্রুকুটি করল ডিকন। ‘সেটা আবার কী?’

‘বুঝতে পারছি আমি!’ এবার হলির গলাতেও উত্তেজনা ফুটল। ‘পুকুরের ধারে একটা সিডারগাছ ছিল আমাদের...বিশাল সাইজের। ওটাকে জায়ান্ট বলতাম আমরা। এখন অবশ্য আর নেই। একবার ভীষণ ঝড় হলো, তখন ওটা গোড়া উপড়ে পড়ে গেল মাটিতে। বাবা তখন ওটা কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন।’

‘ফলেন জায়ান্ট...পতিত দৈত্য,’ মাথা ঝাঁকাল অয়ন। ‘মিলছে।’

‘ঠিক কোথায় ছিল গাছটা?’ জানতে চাইল ডিকন।

‘পুকুরের উত্তর পাড়ে,’ বললেন হলি। ‘এখনো গাছের গোড়াটা পড়ে আছে ওখানে। গেলেই দেখতে পাবেন।’

‘বেশ, ফলেন জায়ান্ট পাওয়া গেল, তারপর?’

‘আমার ধারণা, মাটি খুঁড়তে হবে,’ বলল অয়ন। ‘ধাঁধায় এমবেডেড জুয়েলের কথা বলা হয়েছে। তার মানে, মাটির তলায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে ওগুলো।’

‘শাবাশ!’ প্রশংসার সুরে বলল ডিকন। ‘তাহলে ধাঁধার সমাধান তো হয়েই গেল।’

‘হ্যাঁ,’ সুর মেলালেন হলি। ‘আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম, ওরা রত্নগুলো খুঁজে বের করতে পারবে। আপনি বিশ্বাস করতে চাননি।’

‘ভুল করেছিলাম,’ বলল ডিকন। ‘তবে আর ভুল করব না।’ কথাটা বলেই ঝট করে কোটের ভেতর থেকে বের করে আনল একটা পিস্তল। তাক করল ওদের দিকে। মুখে কুটিল হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘থ্যাংক ইউ, খোকাবাবুরা। আমার কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছ তোমরা।’

থমকে গেল অয়ন-জিমি। চরম বিস্ময়ে ওরা তাকিয়ে রইল পিস্তলের কালো নলের দিকে।