২৪৩০ সাল

অলংকরণ: সাঈফ মাহ্‌মুদ
মাঝরাত ও ভোরের মাঝামাঝি সময়ে যখন ঘুম আসে না, পুরোনো সব যন্ত্রণা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, আমি তখন প্রায়ই ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নে থাকে কোটি কোটি মানুষ। প্রত্যেক মানুষের আছে নম্বর আর রেজিস্ট্রেশন। কিন্তু কোথাও কোনো প্রতিভার চিহ্ন নেই। নেই কোনো সত্যিকারের মন, প্রখর ব্যক্তিত্ব। পৃথিবীর সর্বত্রই এই দশা।
জে বি প্রিস্টলি

‘ও কথা বলবে,’ বান্টিং দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতেই বলল আলভারেজ।

‘ভালো,’ বলল বান্টিং। ‘সামাজিক চাপের মুখে শেষতক হার মানতে ও বাধ্য। আজব একটা চিজ। কী করে যে জেনেটিক অ্যাডজাস্টমেন্ট থেকে গা বাঁচাল, কখনো জানতে পারব না। …তবে কথা কিন্তু তোমাকে চালাতে হবে। আগেরবার ব্যাটা আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে।’

এক্সিকিউটিভ ট্রেইল বরাবর করিডর ধরে এগোল দুজনে। এদিকটা বরাবরের মতোই ফাঁকা। মুভিং স্ট্রিপস ব্যবহার করতে পারত, কিন্তু আলভারেজ হাঁটতে পছন্দ করে বলে বান্টিং আর জোরাজুরি করেনি। তা ছাড়া মাইল দুয়েকের পথই তো।

দীর্ঘ, ছিপছিপে গড়ন আলভারেজের। অ্যাথলেটদের মতোই শরীর। কায়িক পরিশ্রম পছন্দ তার। সর্বক্ষণ নড়াচড়া করছেই। অন্যদিকে বান্টিং গোলগাল গড়নের মানুষ। একটু মোটাসোটা। বাইরে তেমন একটা বেরোয় না। পাণ্ডুর চেহারা।

‘আশা করি, কাজটার জন্য আমরা দুজনই যথেষ্ট,’ বিষণ্ন গলায় বলল বান্টিং।

‘হ্যাঁ, তা-ই যেন হয়,’ সায় দিল আলভারেজ। ‘দারুণ একটা কাজ হবে। যদি করতে পারি আরকি। একবারে চূড়ায় পৌঁছে যাব আমরা। পৌঁছে যাব গন্তব্যে। পুরো মানবজাতি। আর সেটা করব আমরা।’

উজ্জ্বল হয়ে উঠল বান্টিংয়ের চেহারা। ‘তোমার ধারণা, মানুষ ওভাবেই দেখবে ব্যাপারটাকে?’

‘ওভাবেই যেন দেখে সে ব্যবস্থা করতে হবে।’

পায়ে চলা পথটা টুকরো পাথরে তৈরি। পাথরগুলো আবার প্লাস্টিক দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ফলে ওরা হাঁটার সময় শব্দ হচ্ছে না। পথের প্রায় অর্ধেকটা পাড়ি দেওয়ার পর মুভিং স্ট্রিপগুলোতে অগুনতি মানুষের ভিড় দেখতে পেল ওরা। বাতাসে নানা রকমের গন্ধ। প্রতিটা গন্ধই আলাদা করে চেনা যাচ্ছে।

ওদের গন্তব্য করিডরের একেবারে শেষ মাথার একটা আবাসিক রুম। তবে ওই ঘরটা একটু অন্য রকম। ওখানকার বাতাসে কেমন বিটকেলে একটা গন্ধ।

‘গন্ধটা পাচ্ছ?’ বিড়বিড় করে বলল বান্টিং।

‘আগেও এই গন্ধ শুঁকেছি আমি,’ আলভারেজ বলল। ‘অমানবিক।’

‘আসলেই!’ সায় দিল বান্টিং। ‘ও চায় না আমরা ওদের ওপর নজর দিই, তাই না?’

‘মুখ ফুটে চাইলে বরং ওকে প্রত্যাখ্যান করাটা অনেক সহজ হতো।’

সংকেত পাঠিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। চারপাশে অগণিত জীবনের গুঞ্জন। তার মাঝে ওদের দিকে কারোরই নজর নেই। এখানকার পরিবেশ বরাবরই এ রকম।

দরজা খুলে গেল। ক্র্যানউইটজ অপেক্ষা করছে ভেতরে। গম্ভীর চেহারায়। তার পরনে হালকা ধূসর রঙের সাদাসিধে কাপড়। বিধ্বস্ত চেহারা। মাথায় লম্বা চুল। অস্থির চোখ জোড়া টকটকে লাল।

‘ভেতরে আসব?’ শীতল সৌজন্যের সঙ্গে বলল আলভারেজ।

একপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিল ক্র্যানউইটজ।

ভেতরে গন্ধটা আরও প্রকট। ক্র্যানউইটজ দরজা বন্ধ করে দিলে চেয়ারে বসল নবাগত দুজন। ক্র্যানউইটজ দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।

আলভারেজ বলল, ‘সেক্টর রিপ্রেজেন্টেটিভ ও ভাইস রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে আপনার কাছে জানতে চাওয়া আমাদের কর্তব্য—আপনি কি সামাজিক প্রয়োজন মেনে চলতে রাজি?’

খানিকক্ষণ বোধ হয় ভাবল ক্র্যানউইটজ। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘না। আমাকে মানতে হবে না। সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের চুক্তি আছে। আমাদের আমার পরিবারের অধিকার আছে…’

‘এসব আমরা জানি। জোরজবরদস্তির কোনো প্রশ্নই ওঠে না,’ বিরক্তকণ্ঠে বলল বান্টিং। ‘আমরা আপনাকে স্বেচ্ছায় রাজি হতে বলছি।’

তার হাঁটু স্পর্শ করল আলভারেজ। বলল, ‘বুঝতে পারছেন নিশ্চয়, আপনার বাবার আমল আর এখনকার পরিস্থিতি এক না। অথবা গত বছরের চেয়েও এ বছরের পরিস্থিতি কত বদলে গেছে, ভেবে দেখুন।’

ঈষৎ কেঁপে উঠল ক্র্যানউইটজের লম্বা চোয়াল। ‘আমি তো ও রকম কিছু দেখছি না। কম্পিউটারের হিসাবের সঙ্গে সংগতি রেখেই গত বছর জন্মহার কমেছে। পারিপার্শ্বিক অন্য সবকিছুও বদলেছে কম্পিউটারের হিসাবেই। কাজেই এ বছর আলাদা কেন হবে?’

মুখে এসব বললেও ক্র্যানউইটজের কণ্ঠে জোর নেই। আলভারেজ নিশ্চিত, লোকটা জানে এ বছর কেন আলাদা।

‘এ বছর আমরা লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি,’ কোমল গলায় বলল আলভারেজ। ‘জন্মহার আর মৃত্যুহার এখন সমানে সমান। জনসংখ্যার লেভেল এখন সম্পূর্ণ স্থির। বসবাসের জন্য বাড়িঘরের নির্মাণকাজও ঠিকঠাক হয়ে গেছে। স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে সি ফার্মগুলোও। এখন মানবজাতি এবং চরম উৎকর্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি…’

‘স্রেফ কয়েকটা ইঁদুরের জন্য?’

‘স্রেফ কয়েকটা ইঁদুর। এবং আরও কয়েকটা প্রাণী। গিনিপিগ। খরগোশ। কিছু পাখি আর গিরগিটি। সঠিক হিসাবটা নিইনি…’

‘কিন্তু গোটা পৃথিবীর বুকে এই কটা প্রাণীই তো অবশিষ্ট আছে। এরা থেকে গেলে কী এমন ক্ষতি হবে?’

‘লাভটাই–বা কী?’ পাল্টা প্রশ্ন বান্টিংয়ের।

‘এরা থাকার লাভটা হচ্ছে চোখের দেখা,’ জবাব দিল ক্র্যানউইটজ। ‘একটা সময় ছিল, যখন…’

এ গল্প আগেও শুনেছে আলভারেজ। গলায় যতটা সম্ভব সহানুভূতি ঢেলে (এবং আলভারেজকে অবাক করে দিয়ে সত্যিই কিছুটা সত্যিকারের সহানুভূতি এসেও পড়ল) সে বলল, ‘আমি জানি। ওসব কয়েক শতাব্দী আগের কথা! বিস্তর পশুপাখি ছিল দুনিয়ায়। তারও কয়েক মিলিয়ন বছর আগে ছিল ডাইনোসর। কিন্তু আমরা সব জীবজন্তুর মাইক্রোফিল্ম রেখে দিয়েছি। সব মানুষেরই এদের সম্পর্কে জানার সুযোগ আছে।’

‘মাইক্রোফিল্মের সঙ্গে আসল জিনিসের তুলনা করেন কীভাবে?’ ক্র্যানউইটজের প্রশ্ন।

‘মাইক্রোফিল্মে ওসব পশুপাখির শরীরের গন্ধ নেই,’ ঠোঁট বাঁকাল বান্টিং।

‘একসময় চিড়িয়াখানা ছিল অনেক বড়,’ বলল ক্র্যানউইটজ। ‘কিন্তু অসংখ্য চিড়িয়াখানা বন্ধ করে দিয়েছি আমরা। সব প্রাণী নির্মূল করেছি। নাই হয়ে গেছে সব মাংসাশী প্রাণী। বড় বড় গাছপালাও আর নেই। অল্প কিছু ছোট গাছ আর খুদে প্রাণী ছাড়া আর কিছুই নেই এখন। থাকতে দিন ওদের।’

আলভারেজ বলল, ‘এদের দিয়ে আপনি কী করবেন? কেউই এদের দেখতে চায় না। গোটা মানবজাতি আপনার বিরুদ্ধে।’

‘সামাজিক চাপ…’

‘এ রকম বিকৃতি লোকে দেখতে চায় না। এই প্রাণীগুলো দেখলেই অসুস্থ লাগে। এদের নিয়ে আমরা করবটা কী?’ ভর্ৎসনার সুরে বলল আলভারেজ।

বসে পড়ল ক্র্যানউইটজ। লালচে হয়ে উঠেছে দুগাল। ‘একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছি আমি। একদিন আমরা পৃথিবীর সীমা ছাড়াব। অন্যান্য গ্রহে বসতি গড়বে মানুষ। ওই নতুন, শূন্য গ্রহগুলোতে মানুষ তখন অন্য প্রজাতির প্রাণীর সঙ্গ চাইবে। নতুন এক ইকোলজি শুরু হবে। মানুষ…’

অপর দুজনের খরদৃষ্টির সামনে মিইয়ে গেল ক্র্যানউইটজের কণ্ঠ।

বান্টিং বলল, ‘আর কোনো নতুন পৃথিবীতে আমরা বসতি গড়ব?’

‘১৯৬৯ সালে চাঁদে পা রেখেছিলাম আমরা,’ জবাব দিল ক্র্যানইটজ।

‘হ্যাঁ। ওখানে আমরা বসতি গেড়েছিলাম। কিন্তু ওখান থেকে চলেও এসেছি। সৌরজগতে আর কোনো গ্রহে মানবজীবন টিকে থাকার মতো পরিবেশ নেই।’

ক্র্যানউইটজ বলল, ‘অন্য কোনো তারকাকে ঘিরে পাক খাচ্ছে অন্যান্য গ্রহ। আমাদের পৃথিবীর মতো পৃথিবী আছে লাখ লাখ। নিশ্চয় আছে।’

মাথা নাড়ল আলভারেজ। ‘ওগুলো নাগালের বাইরে। আমরা তো শেষমেশ পৃথিবীকেই ব্যবহার করছি। পৃথিবী এখন মানুষে গিজগিজ করছে। বসবাসের জন্য পৃথিবীকেই বেছে নিয়েছি আমরা। আলোকবর্ষ দূরত্ব পাড়ি দিয়ে মহাশূন্যের অন্য কোনো গ্রহে যাওয়ার মতো স্টারশিপ বানানোর ক্ষমতাও আমাদের নেই। বিশ শতকের ইতিহাস সম্পর্কে জানেন?’

‘ওটাই ছিল উন্মুক্ত পৃথিবীর শেষ শতাব্দী,’ বলল ক্র্যানউইটজ।

‘হ্যাঁ,’ শুকনো গলায় বলল আলভারেজ। ‘আশা করি, ওই শতাব্দী নিয়ে অতিকল্পনা করবেন না। আমি এর পাগলামি নিয়েও ভেবেছি। ওই সময়ের পৃথিবী বলতে গেলে ফাঁকাই ছিল। অথচ তারা ভাবত, গোটা গ্রহ মানুষে ভরে গেছে। সংগত কারণও ছিল এই ভাবনার পেছনে। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি সম্পদ ওরা ব্যবহার করে ফেলেছিল যুদ্ধে আর যুদ্ধের প্রস্তুতিতে। চিন্তাভাবনা ছাড়াই পয়সা ওড়াত ওরা। “জনসংখ্যা বিস্ফোরণ” নামের জিনিসটাকে ভয় পেত যমের মতো। এর হাত থেকে বাঁচতে পৃথিবী থেকে পালিয়ে অন্য পৃথিবীতে আবাস গড়ার স্বপ্ন দেখতে লাগল তারা। আমরাও এখন অনেকটা ও রকম পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি।

‘নানা ঘটনা আর বিজ্ঞানের অগ্রগতি মিলে সবকিছু যে বদলে দেয়, এ কথা নিশ্চয় আপনাকে বলে দেওয়ার দরকার নেই। তবু বলছি। এর মধ্যে বিশ্বসরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ফিউশন পাওয়ার আবিষ্কৃত হয়েছে, তরতর করে উন্নতি হয়েছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের। শান্তি আর শক্তির প্রাচুর্য নিয়ে গোটা গ্রহে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল মানুষ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলল বিজ্ঞান।’

‘কতসংখ্যক মানুষ পৃথিবীতে বাস করতে পারবে, তা নিখুঁতভাবে জানা গেল। পৃথিবীতে কত ক্যালরি সূর্যের আলো আসে, সেই ক্যালরির কতটুকু ব্যবহৃত হয়, প্রতিবছর পৃথিবীর সবুজ উদ্ভিদের জন্য কত টন কার্বন ডাই–অক্সাইড লাগে, আর কত টন পরিমাণ প্রাণীর জীবন ওসব উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল—এই সবকিছুই এখন মানুষের জানা। দুই ট্রিলিয়ন টন পরিমাণ প্রাণীর ভার বওয়ার সামর্থ্য রাখে পৃথিবী…’

‘আর এই দুই ট্রিলিয়ন টন পরিমাণ প্রাণীর সব কটাই মানুষ হতে হবে, তা–ই না?’ মুখ খুলল ক্র্যানউইটজ।

‘ঠিক তা-ই।’

‘প্রয়োজনে অন্য সব প্রাণী মেরে ফেলে হলেও মানুষ রাখতে হবে, না?’

‘সেটাই তো বিবর্তনের নিয়ম,’ রাগী গলায় বলল বান্টিং। ‘সবচেয়ে যোগ্যরাই টিকে থাকে।’

আবার তার হাঁটু স্পর্শ কর আলভারেজ। ‘বান্টিং ঠিকই বলেছে, ক্র্যানউইটজ। পৃথিবীতে চিরকালই দুর্বলদের জায়গা দখল করেছে শক্তিশালীরা। উভচরদের হটিয়েছে সরীসৃপরা। তাদের জায়গা নিয়েছে স্তন্যপায়ীরা। আর এখন এই দখলের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। পৃথিবীর বুকে বাস করছে ১৫ ট্রিলিয়ন মানুষ…’

‘কিন্তু কীভাবে?’ প্রশ্ন করল ক্র্যানউইটজ। ‘গোটা স্থলভাগে একটামাত্র বিশাল দালানে একসঙ্গে থাকছে পৃথিবীর সব মানুষ। তাদের সাথে নেই কোনো গাছপালা, নেই কোনো প্রাণী। একমাত্র ব্যতিক্রম আমি। আর পৃথিবীর সমস্ত সাগর-মহাসাগর হয়ে গেছে প্লাঙ্কটন স্যুপ। কোনো প্রাণী নেই, স্রেফ প্লাঙ্কটন। মানুষের খাবার জোগানোর জন্য এই প্লাঙ্কটনের চাষ করছি আমরা। তারপর মানুষের বর্জ্য খাওয়াচ্ছি প্লাঙ্কটনকে।’

‘আমরা খুব ভালোভাবে জীবন কাটাচ্ছি,’ বলল আলভারেজ। ‘কোনো যুদ্ধ নেই, অপরাধ নেই। আমাদের জন্ম নিয়ন্ত্রিত, মৃত্যু শান্তিময়। আমাদের বাচ্চারা জিনগতভাবেই এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। আর পৃথিবীতে এখন স্বাভাবিক মস্তিষ্ক আছে সর্বমোট ২০ বিলিয়ন টন।’

‘এত ওজনের এসব মস্তিষ্ক কী কাজে আসছে?’

প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল বান্টিং। কিন্তু আলভারেজ শান্ত গলায় বলল, ‘আমাদের যাত্রার গন্তব্য আপনি গুলিয়ে ফেলছেন, বন্ধু। আপনার প্রাণীগুলোর জন্যই বোধ হয় এভাবে গুলিয়ে যাচ্ছে সব। পৃথিবীতে যখন উন্নয়নের প্রক্রিয়া চলছিল, তখন জীবনের প্রয়োজনেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ঝুঁকি নেওয়া জরুরি ছিল। ওসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল না হলেও একেবারে জলে যায়নি। পৃথিবী তখন ফাঁকা ছিল। জায়গা ছিল বিস্তর। লাখ লাখ প্রজাতির প্রাণী এসেছে পৃথিবীর বুকে—কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে গেছে কেবল মানুষই। অর্থাৎ পৃথিবী তার বুকে জায়গা দেওয়ার জন্য যোগ্য প্রাণী খুঁজে পেয়েছে।

‘এমনকি মানুষকেও পৃথিবীতে আগমনের পর অনেক কিছু শিখতে হয়েছে টিকে থাকার খাতিরে। ঝুঁকি নিতে হয়েছে। অসম্ভব সব উদ্যোগ নিতে হয়েছে বোকার মতো।…অজস্র অগ্নিপরীক্ষা পেরিয়ে অবশেষে নিজ গন্তব্যে পৌঁছেছে মানুষ। পৃথিবী ভরে উঠেছে মানুষে মানুষে। এখন শুধু প্রয়োজন এই চরম উৎকর্ষ, অর্থাৎ পরিপূর্ণতাকে উপভোগ করা।’

খানিক বিরতি নিয়ে ফের বলতে শুরু করল আলভারেজ। ‘আমরা এটাই চাই, ক্র্যানউইটজ। গোটা দুনিয়াই পরিপূর্ণতা চায়। আমাদের প্রজন্মেই মানুষ সেই পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছে। আর একমাত্র আমরাই চাই এই সাফল্যের কৃতিত্ব। আপনার প্রাণীগুলো আমাদের সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

একগুঁয়ে ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ক্র্যানউইটজ। ‘ওরা তো খুব কম জায়গা নেয়। শক্তিও খরচ করে একেবারেই কম। ওদের সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হলে ওদের ঘরটা নিয়ে আপনারা কী করবেন? আরও ২৫ জন মানুষকে জায়গা দেবেন ওখানে। ১৫ ট্রিলিয়নের মধ্যে মাত্র ২৫ জনকে?’

বান্টিং বলল, ‘এই ২৫ জন মানুষ মানে আরও ৭৫ পাউন্ড মানবমস্তিষ্ক। ২৫ জন মানুষের ৭৫ পাউন্ড মস্তিষ্কের মূল্যটা একবার ভেবে দেখুন।’

‘কিন্তু আপনাদের কাছে বিলিয়ন বিলিয়ন টন মস্তিষ্ক তো আছেই।’

‘তা আছে,’ সায় দিল আলভারেজ। ‘কিন্তু নিখুঁত আর অনিখুঁত বলে দুটো জিনিস আছে। ঠিক সে পর্যায়ে পৌঁছে গেছি আমরা। নিখুঁত অবস্থা থেকে একচুল দূরত্বে। গোটা পৃথিবী ২৪৩০ সাল উদ্‌যাপনের জন্য প্রস্তুত। কম্পিউটার বলছে, এই সেই বছর, যখন পৃথিবী পরিপূর্ণভাবে ভরে গেছে মানুষে। বিবর্তনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করেছি আমরা। জায়গা দখলের লড়াইয়ে সিংহাসনের দখল পেয়ে গেছে মানবজাতি। মাত্র এই ২৫ জন মানুষের জন্য কি এখন আমরা পিছিয়ে থাকব? খুঁতটা অতি সামান্য হলেও খুঁত তো খুঁতই!

‘ভেবে দেখুন তো, ক্র্যানউইটজ, পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য পাঁচ বিলিয়ন বছর ধরে অপেক্ষা করছে পৃথিবী। আমাদের কি আর দেরি করা উচিত হবে? আপনার ওপর জোর খাটানোর অধিকার আমাদের নেই। তা আমরা করবও না। তবে আপনি যদি স্বেচ্ছায় রাজি হন, তাহলে সবার কাছে নায়ক হয়ে যাবেন।’

‘হ্যাঁ,’ সায় দিল বান্টিং। ‘ভবিষ্যতে মানুষের মুখে মুখে থাকবে আপনার নাম। লোকে বলবে, ক্র্যানউইটজের একটা কাজেই চরম পরিপূর্ণতা পেয়েছে মানবজাতি।’

‘আরও বলবে, আলভারেজ আর বান্টিং মিলে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ওকে দিয়ে কাজটা করিয়েছিল,’ বিদ্রূপের সুরে বলল ক্র্যানউইটজ।

‘যদি সফল হই আরকি!’ শান্ত গলায় বলল আলভারেজ। ‘কিন্তু একটা কথা বলুন তো, ক্র্যানউইটজ। ১৫ ট্রিলিয়ন মানুষের এই আলোকিত ইচ্ছাটাকে কি আপনি আজীবনের জন্য দাবিয়ে রাখতে পারবেন? ধরে নিলাম, আপনি আদর্শবাদী। কিন্তু এত এত মানুষের পরিপূর্ণতা লাভের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন আপনি?’

কিছু না বলে মুখ নামিয়ে বসে রইল ক্র্যানউইটজ। গড়িয়ে গড়িয়ে মন্থর গতিতে পেরোতে লাগল সময়।

বহুক্ষণ পর ক্র্যাউইটজ ফিসফিস করে বলল, ‘আমার প্রাণীগুলোর সঙ্গে আর একটা দিন কাটাতে পারি?’

‘তারপর?’

‘তারপর...আমি আর মানবজাতির পরিপূর্ণতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াব না।’

‘গোটা বিশ্বকে এ খবর জানাচ্ছি। আপনাকে সম্মাননা দেওয়া হবে,’ খুশিতে গদগদ হয়ে বলল আলভারেজ।

বিশাল জায়গাজুড়ে বিস্তৃত কন্টিনেন্টাল বিল্ডিংগুলো। এসব ভবনে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে পাঁচ ট্রিলিয়ন মানুষ। আয়েশ করে খাচ্ছে দুই ট্রিলিয়নের মতো মানুষ। বাকিরা গল্পগুজব করছে—তবে ঝগড়া হচ্ছে না কোনো—কিংবা চুপচাপ কাজ করছে কম্পিউটারের সামনে বসে। গাড়ি চালাচ্ছে অনেকে, নয়তো যন্ত্রপাতি নিয়ে গবেষণা করছে, কিংবা কাজ করছে মাইক্রোফিল্ম লাইব্রেরিতে। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মানুষ ঘুমাতে যাচ্ছে, জেগে উঠছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মানুষ। এ নিয়মের একচুল এদিক-ওদিক হয় না কখনো।

যন্ত্রপাতিগুলো স্বয়ংক্রিয়। আপনা থেকেই কাজ করছে, বিকল হয়ে গেলে নিজেই নিজেকে সারিয়ে নিচ্ছে। আর রোদে পুড়ে পৃথিবীর মহাসাগরগুলোর প্লাঙ্কটন স্যুপের কোষ ক্রমাগত ভাঙছে। তারপর সেগুলো তুলে নিয়ে শুকিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সীমাহীন দালানগুলোর কোনায় কোনায়।

আর দালানগুলোর প্রতিটা কোনায় জমছে মানববর্জ্য। ওগুলোকে বিকিরিত করে শুকিয়ে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে সাগরে, প্লাঙ্কটনের খাবার হিসেবে। এভাবেই চলছে দশকের পর দশক। এভাবেই চলবে হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দী।

শেষবারের মতো নিজের ছোট্ট প্রাণীগুলোকে খাওয়াল ক্র্যানউইটজ। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করল গিনিপিগটাকে। কোলে তুলে নিল একটা কাছিমকে। আঙুল বোলাল কিছু জীবন্ত ঘাসের গায়ে।

মানুষ আর মানুষের খাদ্যের বাইরে পৃথিবীর সর্বশেষ জীবিত জিনিসগুলো গুনে দেখল ক্র্যানউইটজ। তারপর ঘাসের জন্ম দেওয়া মাটি পুড়িয়ে দিল। মরে গেল সব ঘাস আর ছোট গাছ। এবার প্রাণঘাতী গ্যাস ছেড়ে দিল প্রাণীগুলোর ঘরে। পৃথিবীর সর্বশেষ প্রাণীগুলোও আর রইল না।

শেষে রইল শুধু ক্র্যানউইটজ। গোটা মানবজাতি এবং পরিপূর্ণতার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার চিন্তাচেতনা বাকিদের মতো নয়। আর এখনো বাকি রয়ে গেছে কিছু গ্যাস। বাঁচার ইচ্ছা ফুরিয়েছে ক্র্যানউইটজেরও।

আর তারপরই এল সত্যিকারের পূর্ণতা। ক্র্যানউইটজ চলে যাওয়ার পর গোটা পৃথিবীর ১৫ ট্রিলিয়ন মানুষ আর ২০ বিলিয়ন টন মানবমস্তিষ্কে রইল না আর কোনো প্রথাবিরোধী, অস্থির চিন্তাভাবনা। রইল না পৃথিবীর শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার মতো কোনো অস্বাভাবিক আইডিয়া।