লকডাউনের আগের দিন মা নতুন জুতা কিনে দিল। পরদিন বের হয়ে জানতে পারলাম, করোনার প্রকোপ বাড়ায় লকডাউন দিয়ে দিচ্ছে। কী আর করা, বাড়িতে এসে প্রায় এক বছর ধরে ঘরবন্দী হয়ে বসে রইলাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় প্রায় এক বছর পর প্রাইভেটগুলো খুলে দেওয়া শুরু হলো। তাই বাড়ি থেকে আবার বের হলাম মায়ের দেওয়া এক বছর পুরোনো সেই জুতা পরে। পুরোনো নয় ঠিক, মাত্র এক দিনই তো পরেছিলাম। দিন দশেক খুব ভালোই গিয়েছিল। তারপরই ঘটল বিপত্তি।
বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রাইভেট থেকে বাসায় ফিরছিলাম। কথায় দুজন এতটাই মগ্ন ছিলাম যে আশপাশে কী ছিল, দেখতেই পাইনি। যা হওয়ার তা–ই হলো, হাঁটতে হাঁটতে খেলাম বড়সড় একটা হোঁচট। হোঁচট খেয়ে নিজেকে সামলে নিলেও একটা জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেল। পুরোটা নয়, অর্ধেক। ওদিকে জুতার এই অবস্থা দেখে বান্ধবী তো হেসে রাস্তায় লুটোপুটি খায় প্রায়।
ছেঁড়া জুতা নিয়েই বাড়িতে ফিরলাম। মা তো আমার জুতার এ অবস্থা দেখে বেজায় রেগে গেলেন। প্রায় আধা ঘণ্টা আমাকে বকাঝকা করার পর বললেন, পুরো জুতা ছেঁড়েনি। অর্ধেক ছিঁড়েছে। পুরোপুরি ছেঁড়ার আগে নতুন জুতা পাব না। সে কী কষ্ট, বলে বোঝানো যাবে না। অর্ধেক ছেঁড়া জুতা নিয়ে প্রাইভেটে যেতে হবে। রাস্তার মানুষ, বান্ধবীরা সবাই দেখবে আর হাসাহাসি করবে। তবু মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম, জুতার যা অবস্থা, এটা দুই দিনও টেকে কি না, সন্দেহ। মনকে শান্ত করে এই আধছেঁড়া জুতা নিয়ে আবার প্রাইভেটে যাওয়া শুরু করলাম।
এভাবে ২০ দিন চলে গেল। আমি তো রীতিমতো অবাক। এই আধছেঁড়া জুতা কীভাবে এত দিন ঠিক থাকতে পারে? আমার ছোট মাথায় এই বড় বিষয়টা কোনোভাবেই ঢুকছে না। অন্যদিকে ঘটল আরেক বিপত্তি। এত দিনে আমার বান্ধবীরাও লক্ষ করতে শুরু করল আমার আধছেঁড়া জুতাকে। সে কী লজ্জা! কিন্তু বান্ধবীদের তো তা বুঝতে দেওয়া চলবে না, তাই প্রতিবার কোনো না কোনো বাহানা দিয়ে দিতাম। এমনকি একদিন রাস্তায় এক আন্টি বলে বসলেন, ‘তুমি এমন ছেঁড়া জুতা পায়ে কেন হাঁটছ?’ আন্টির কথাটা সেদিন গায়ে লেগেছিল খুব। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকেই কিছু একটা করে এই আধছেঁড়া জুতাকে পুরো ছেঁড়া বানিয়ে ফেলতে হবে। তাই ভাবা শুরু করলাম, কী করা যায়।
প্রথমে ভাবলাম বাকি অর্ধেকটা কেটে দিই। পরেই মনে হলো, আমার মা সিআইডি সদস্য থেকে কোনো অংশেই কম নয়, জুতা দেখেই বুঝে যাবে যে আমি ইচ্ছা করে কেটেছি। তাই কাটাকাটির চিন্তা বাদ দিলাম। তারপর ভাবলাম, জুতাটা কোথাও রেখে আসি আর এসে বলি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তাহলেও তো আমার মা ভাববে আমি কোনো একটা কারসাজি করেছি। তাই এটাও বাদ। অবশেষে মাথায় এল আইডিয়া। এক হোঁচট খেয়ে যদি জুতার অর্ধেকটা ছিঁড়ে থাকি, তাহলে আরেক হোঁচট খেয়ে বাকি অর্ধেকটা ছিঁড়তে পারব। যেই ভাবা সেই কাজ। পরদিন রাস্তায় বেরিয়ে ইচ্ছা করে হোঁচট খাচ্ছি, বান্ধবী তো কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু আমার কাণ্ডকারখানা দেখছে। বান্ধবীকে বুঝিয়ে বলার পর সে তো হাসতে হাসতে শেষ। এভাবে টানা দুই দিন রাস্তায় হোঁচট খেতে খেতে আমার পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আধছেঁড়া জুতা আর ছিঁড়ল না।
পরদিন বান্ধবী অসুস্থ থাকায় আমার সঙ্গে আর যেতে পারল না। প্রাইভেট থেকে একা একা বাড়ি ফিরছিলাম। ভাবছিলাম, এত হোঁচট খাওয়ার পরও কীভাবে জুতা ঠিক থাকে? আমাকে আরও বড় হোঁচট খেতে হবে। এসব ভাবছি আর হাঁটছি। হঠাৎ এক প্রকাণ্ড ইটের সঙ্গে হোঁচট খেলাম। এত জোরেই হোঁচট খেলাম যে একদম রাস্তায় পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়ে কোথায় ব্যথা পেলাম, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই, আমি শুধু একদৃষ্টে দেখছি আমার আধছেঁড়া জুতা ছিঁড়েছে কি না। এবারও আমাকে হতাশ করে দিয়ে জুতা ছিঁড়ল না।
এদিকে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, পায়ের অনেকটা ছাল উঠে গেছে, রক্ত পড়ছে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এ আবার কী ধরনের জুতা? তখনই পেছন থেকে অনেক মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুরু করল। আশপাশে তাকিয়ে দেখি, আমি ছেলেদের স্কুলের সামনে আর স্কুল থেকে ছেলের দল (এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করে হয়তো) আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এবার আমি পড়লাম মহাবিপদে। একদিকে ছেলের দল, অন্যদিকে আধছেঁড়া জুতা আর কাটা পা নিয়ে উঠেও দাঁড়াতে পারছি না। এসব ভাবতে ভাবতেই ছেলের দল আমার সামনে এসে গেল আর আমাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে সবাই দাঁত কেলিয়ে হাসতে শুরু করল। ওদের হাসি দেখে রাগটা আমার হাজার গুণ বেড়ে গেল। ইচ্ছা হচ্ছিল, প্রত্যেকের দাঁত খুলে হাতে ধরিয়ে দিই। কিন্তু উপায় নেই। একে তো পা কাটা, আধছেঁড়া জুতা, তার ওপর এতগুলো ছেলে। হাসতে হাসতে ছেলেগুলো চলে গেল। আমিও কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। একটা রিকশা নিয়ে এলাম বাসায়। বাসায় ঢোকার পর আমার অবস্থা দেখে মা তো চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিল, ‘এত বড় মেয়ে, এখনো নিজের খেয়াল রাখতে পারে না...।’ কিন্তু মা তো জানে না যে আমি ইচ্ছা করে হোঁচট খাচ্ছি। তবে এ ঘটনার পর হোঁচট খাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে একদম ঝেড়ে ফেললাম। আর এত বড় হোঁচট খেয়ে এটা বুঝলাম যে এই জুতা ছেঁড়া আমার দ্বারা সম্ভব নয়। এই আধছেঁড়া জুতা পরেই আমাকে সারা জীবন কাটাতে হবে ভেবে ভেবে ডিপ্রেশনে চলে গেলাম আমি। কী আর করা, হাল ছেড়ে আবার সেই আধছেঁড়া জুতা নিয়েই বের হওয়া শুরু করলাম।
দুই দিন পর ঘরে বসে গান শুনছিলাম। হঠাৎ দেখি ছোট বোন কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। হাতে কী যেন লুকিয়ে রেখেছে পেছনে। নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর অপরাধ করে এসেছে। আমার আবার আমার বোনকে শাস্তি পেতে দেখলে খুব ভালো লাগে। তাই কৌতূহল মেটাতে আর মজা দেখতে ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী লুকাচ্ছিস?’ আমার কথা শুনে ছোট বোন কান্না শুরু করে দিল। আমারও মেজাজ গেল বিগড়ে। দিলাম এক প্রকাণ্ড ধমক। ধমক খেয়ে তো কান্না দুই শ চল্লিশ ভোল্ট বেড়ে গেল। বোনের এই মাইকমার্কা গলার কান্না আমার মায়ের কানে না গিয়ে কি পারে? মা দৌড়াতে দৌড়াতে এল তার আদরের ছোট মেয়ের কী হয়েছে, তা দেখতে। এসে আদর করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে আমার ভালো মেয়েটার?’ আমার মা আর বোনের এসব ঢং দেখে আমি অভ্যস্ত। তাই আমার কোনো বিকারই নেই। মাকে দেখে আমার বোনের কান্না আরও বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে পেছন থেকে হাতটা সামনে আনল সে। দেখি আমার আধছেঁড়া জুতার এক পাটি তার হাতে। এটা দেখে বুঝতে আর বাকি রইল না, ছোট বোনটা আবার নিজের অভ্যাসবশত আমার জুতা পরে মডেলিং করার চেষ্টা করছিল। এবার আমার বোন কান্না করতে করতে মুখ খুলল। ও বলল, সে শুধু আমার জুতা পরে দেখছিল। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা কুকুর তাড়া করাতে দৌড়াতে গিয়ে আমার আধছেঁড়া জুতাটা হারিয়ে ফেলেছে সে। আর এটা জেনে নাকি আমি তাকে ধমক দিয়েছি। সব শুনে আমি হাসব না কাঁদব, কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আধছেঁড়া জুতার হাত থেকে রক্ষা পেলেও বোন তো আবার আমাকে ফাঁসিয়ে দিল। যা ভেবেছিলাম, তা–ই হলো। বোনের কথা শুনে মা আমায় কিছু বকা উপহার দিল। কিন্তু তবু এই প্রথম আমি আমার বোনের ওপর একটু খুশি হলাম। ওর জন্য তো অন্তত আমাকে সারা জীবন আর আধছেঁড়া জুতা পরে চলতে হবে না। অবশেষে আমি আমার আধছেঁড়া জুতা থেকে মুক্তি পেলাম।