ব্যাংকে একদিন

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ব্যাংকে গেলেই আমার সবকিছু কেমন যেন গড়বড় হয়ে যায়। ব্যাংকের ক্লার্ককে দেখলে নার্ভাস হয়ে যাই। এমনকি ব্যাংকের দরজা-জানালা, কাউন্টারে টাকাপয়সা—সবকিছু আমাকে ভীষণ নার্ভাস করে দেয়।

ব্যাংকের সীমানা পেরিয়ে ভেতরে কোনো কাজ করতে ঢুকলেই আস্ত একটা বোকা হয়ে যাই আমি।

এসব লক্ষণ আমার নিজের কাছে খুব চেনা। কিন্তু হুট করে আমার মাসিক আয় পঞ্চাশ ডলার বেড়ে গেল সেবার। ভেবে দেখলাম, এই বাড়তি টাকা জমানোর জন্য ব্যাংকই হতে পারে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা।

তাই একদিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও পা টেনে টেনে ব্যাংকে ঢুকলাম আমি। ক্লার্কের দিকে ভীরু চোখে তাকালাম। আমার ধারণা ছিল, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে ম্যানেজারের সঙ্গে অবশ্যই আলাপ করতে হয়।

‘অ্যাকাউন্ট্যান্ট’ লেখা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। অ্যাকাউন্ট্যান্ট মানুষটা বেশ লম্বা-চওড়া। ঠান্ডা মাথার ধুরন্ধর স্বভাবের বলে মনে হলো তাকে। তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যে আমি ভিরমি খেয়ে গেলাম। আমার গলা বসে গেল।

গলায় যথাসম্ভব গাম্ভীর্য টেনে এনে বললাম, ‘আমি কি ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে পারি, একা?’ কিন্তু ‘একা’ কথাটা কেন বলতে গেলাম নিজেও বুঝতে পারলাম না।

‘অবশ্যই পারেন,’ বলে ম্যানেজারের খোঁজ নিতে গেলেন অ্যাকাউন্ট্যান্ট।

ব্যাংকের ম্যানেজারকে দেখে মনে হলো রাশভারী লোক। আমার পকেটের দলাপাকানো ছাপ্পান্ন ডলার শক্ত করে চেপে ধরলাম আমি।

ম্যানেজারকে বোকার মতো প্রশ্ন করলাম, ‘আপনিই কি ম্যানেজার?’ অথচ তিনিই যে ম্যানেজার, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।

‘হ্যাঁ,’ সন্দেহের সুরে জবাব দিলেন তিনি।

‘আমি কি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি, একা?’ এবারও আমি ‘একা’ বলতে চাইনি। শুধু শুধু কেন আবার ‘একা’ যোগ করলাম, নিজেই বুঝতে পারলাম না।

আমাকে সতর্কভাবে জরিপ করলেন ম্যানেজার। তার ধারণা হলো, আমি বোধ হয় চরম গোপন কোনো কিছু ফাঁস করতে এসেছি।

‘ভেতরে আসুন,’ বলে আমাকে তার ব্যক্তিগত কামরার দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। তারপর দরজার তালা লাগিয়ে দিলেন তিনি।

এবার আমার দিকে ঘুরে ম্যানেজার বললেন, ‘এখানে আমরা নিরাপদ। কেউ বিরক্ত করতে আসবে না। ওখানটায় বসুন।’

আমরা বসে পরস্পরের দিকে তাকালাম। কিন্তু তাকে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না আমি।

ম্যানেজার বললেন, ‘আমার ধারণা, আপনি সম্ভবত পিংকারটন থেকে এসেছেন।’

আমার রহস্যময় আচরণের কারণে ম্যানেজার আমাকে ডিটেকটিভ ভেবে বসেছেন। সেটা বুঝতে পেরে আরও ঘাবড়ে গেলাম আমি।

ফ্যাসফেসে গলায় বললাম, ‘না, না, পিংকারটন থেকে নয়,’ আমার এ রকম জবাবে তিনি হয়তো ভেবে বসবেন, আমি পিংকারটনের না হলেও অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী এজেন্সির ডিটেকটিভ। তাই তড়িঘড়ি করে বললাম, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমি ডিটেকটিভ নই। আসলে একটা অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য এসেছি। আমার সব টাকা এই ব্যাংকে জমা রাখতে চাই।’

স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন ম্যানেজার। এখন তাকে বেশ সিরিয়াস মনে হলো। এখন সম্ভবত তিনি ভাবতে শুরু করেছেন, আমি হয়তো কোনো ব্যারন রথচাইল্ড কিংবা কোনো ধনী ব্যারনের ছেলে।

তিনি বললেন, ‘ধারণা করছি, আপনি খুব বড় অঙ্কের জমা টাকা রাখবেন।’

‘অবশ্যই বড় অঙ্কের’, ফিসফিস করে বললাম। ‘এখন ছাপ্পান্ন ডলার রাখতে চাই। আর প্রতি মাসে পঞ্চাশ ডলার করে জমা রাখব।’

আর একটা কথাও না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিলেন ম্যানেজার। তারপর অ্যাকাউন্ট্যান্টকে ডাকলেন। বেশ চড়া গলায় জানালেন, ‘মিস্টার মন্টোগোমারি, এই ভদ্রলোক অ্যাকাউন্ট খুলতে চান। তিনি এখন ছাপ্পান্ন ডলার জমা দেবেন।’

তিনি আমার দিকে ফিরে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘গুড মর্নিং।’

ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম আমি। ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে ‘গুড মর্নিং’ বলে ব্যাংকের টাকা রাখার লোহার সেফের মধ্যে ঢুকে গেলাম।

ম্যানেজার শান্তভাবে বললেন, ‘ওদিকে নয়, ওখান থেকে বের হয়ে আসুন।’ তারপর আমাকে তার ঘর থেকে বের হওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।

অ্যাকাউন্ট্যান্টের সঙ্গে গেলাম আমি। তার সামনে গিয়ে পকেটের দলাপাকানো টাকাগুলো জাদুর কৌশল দেখানোর ভঙ্গিতে টেবিলের ওপর ছুড়ে দিলাম। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল আমার।

কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘এই টাকাগুলো আমার অ্যাকাউন্টে জমা রাখুন।’

অ্যাকাউন্ট্যান্ট কোনো কথা না বলে টাকাগুলো পাশের ক্লার্কের দিকে ছুড়ে দিলেন। একটা ফরম বের করে আমাকে সই করতে বললেন তিনি। তা–ই করলাম। কিন্তু আমি কী করছি, কিছুই বুঝতে পারলাম না। পুরো ব্যাংক আমার চোখের সামনে ঘুরতে লাগল। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার টাকা কি জমা হয়ে গেছে?’

অ্যাকাউন্ট্যান্ট বললেন, ‘হ্যাঁ, হয়ে গেছে।’

‘তাহলে আমাকে একটা চেক দিন, কিছু টাকা তুলব।’ আমি আসলে হাতখরচের জন্য ছয় ডলার তুলতে চাচ্ছিলাম।

কেউ একজন আমার হাতে একটা চেকবই ধরিয়ে দিলেন। আরেকজন বুঝিয়ে দিলেন কোথায় কী লিখতে হবে। আমাকে বোধ হয় অবৈধ কোটিপতি ভেবে মুগ্ধ চোখে তাকাতে লাগলেন ব্যাংকের লোকজন। কোনোমতে চেকটা লিখে ক্লার্কের হাতে দিলাম। চেকটা দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেল। ‘আশ্চর্য! আপনি কি সব টাকা তুলে নিতে চান?’

তখন বুঝতে পারলাম, ছয় ডলারের বদলে ভুল করে ছাপ্পান্ন ডলার লিখে ফেলেছি। ভুলটা এখন তাকে বুঝিয়ে বলা অসম্ভব ব্যাপার। অন্য ক্লার্করা কাজ থামিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকাতে লাগলেন আমার দিকে।

যা হওয়ার হবে ভেবে, বেপরোয়া স্বরে বললাম, ‘হ্যাঁ, পুরো টাকাই তুলতে চাই।’

‘ব্যাংক থেকে আপনার সব টাকা তুলে নিতে চান?’

‘সব।’

ক্লার্ক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি এখানে আর টাকা জমা রাখবেন না।’

‘কক্ষনো না।’

ক্লার্ক হয়তো ভাবছেন, তাদের কথায় বা আচরণে আমি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছি, তাই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে চাইছি। তারা যেন সে রকমই ভাবে, তাই মুখে ক্রুদ্ধ ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম।

ক্লার্ক আমাকে টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করলেন। তিনি বললেন, ‘টাকাগুলো কত নোটে দেব?’

‘কী বললেন?’

‘আপনি কত ডলারের নোট চান?’

এবার বুঝতে পারলাম। চিন্তা না করেই উত্তর দিলাম, ‘ও, পঞ্চাশ ডলারের নোটে দিন।’

তিনি আমাকে একটা পঞ্চাশ ডলার নোট দিয়ে শুষ্ক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাকি ছয় ডলার?’

বললাম, ‘ছয় ডলারের নোটে দিন।’

তিনি আমার হাতে টাকাটা দিতেই তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।

ব্যাংকের বড় দরজা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে সমবেত কণ্ঠে প্রচণ্ড অট্টহাসি শুনতে পেলাম। বিল্ডিংটাই যেন হাসির শব্দে ফেটে পড়বে।

এ ঘটনার পর থেকে আমি আর ব্যাংকে যাই না। এখন আমার টাকা ট্রাউজারের পকেটেই রাখি। আর জমানোর মতো টাকা হলে একটা মোজার মধ্যে রেখে দিই।

স্টিফেন বাটলার লিকক (১৮৬৯-১৯৪৪) কানাডিয়ান লেখক ও অর্থনীতিবিদ। তিনি ইংল্যান্ডের সোয়ানমোরে জন্মগ্রহণ করেন। শিশু অবস্থায় তিনি মা–বাবার সঙ্গে কানাডায় পাড়ি জমান। তিনি স্যাটায়ারধর্মী ননসেন্সে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলো হচ্ছে লিটারারি ল্যাপস, ননসেন্স নভেল, আর্কেডিয়ান অ্যাডভেঞ্চার উইথ দ্য আইডল রিচ ইত্যাদি।