প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক অথবা একটি ন্যায়বিচারের গল্প

অলংকরণ: রাকিব

‘আপনি খুনটা কেন করলেন?’

আসামি-১: মহোদয়, আমার কোনো দোষ নেই। আমি বাদাম চিবুতে চিবুতে হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি দুজন মানুষ মারামারি করছে। অবশ্য ওরা দুজনই মানুষ ছিল কি না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। একজনের শরীর, মানে যে এখন মৃত, ছিল পুরোপুরি বেগুনি। তো, সচেতন ও শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে আমি তাদের মারামারি থামাতে গেলাম। হঠাৎ বেগুনি মানুষটি আমাকেই ঘুষি দিয়ে বসল। কেউ আমাকে কিছু দিলে আমিও কিছু ফেরত দিই—এটা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। ব্যস, মনে মনে মরহুম দাদাজানের নাম স্মরণ করে দিলাম পাল্টা ঘুষি। নাক বরাবর। কিন্তু সামান্য মিসটেকের কারণে ঘুষিটা লাগল তার কপালে। সঙ্গে সঙ্গে ফাটা কপাল দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত। আমি আঁতকে উঠলাম। ভয়ে নয়, অদ্ভুত এক আতঙ্কে। কারণ, রক্তের রংও ছিল বেগুনি। যাহোক, বেগুনি-ব্যাটা যে আমার মতো রোগাপটকা একজনের দেওয়া এক ঘুষিতেই ফট করে মরে যাবে, বিশ্বাস করেন, বুঝতে পারি নাই। ওই মুহূর্তে আমার করণীয় অন্য কিছু ছিল না। ওরা দুজন যদি ঝগড়া না করত, তাহলে আমি বৃহত্তর স্বার্থে এবং সমাজের শান্তি রক্ষার্থে তাদের থামাতে যেতাম না। আর বেগুনি-ব্যাটাও আমাকে ঘুষি দিত না। আমিও তাকে পাল্টা ঘুষি দিতাম না...

‘থামুন। যত্তসব উল্টাপাল্টা বকাবাজি। হাস্যকর কথাবার্তা। যদি আপনি নির্দোষই হয়ে থাকেন, তাহলে ওই মৃত্যুর জন্য কে দায়ী?’

আসামি-১: অবশ্যই অন্য লোকটি। কারণ, সে যদি ঝগড়া না করত, তাহলে আমি বাদাম চিবুতে চিবুতে বাসায় চলে যেতাম। ওদের থামাতে যেতাম না। ফলে কাউকে ঘুষি মারার প্রশ্নই উঠত না। আর ঘুষি না মারলে তো...

‘ঠিক আছে। অন্য আসামিকে হাজির করা হোক।’ আসামি-২: মহোদয়, আমাকে শুধু শুধু এখানে ডাকা হয়েছে। খুনটার জন্য আমি মোটেও দায়ী নই। ‘এটা তো সবাই বলে। আপনার যুক্তি ব্যাখ্যা করুন।’

আসামি-২: আমি যাচ্ছিলাম রেস্টুরেন্টে। হঠাৎ দেখি একটা বেগুনি রঙের গাড়ি উড়ে যাচ্ছে। আপনি জানেন মহোদয়, এ গ্রহে বেগুনি রঙের গাড়ি নিষিদ্ধ। তো, গাড়িটিকে আমি ইশারা করলাম। আমার চোখের সামনে এসে গাড়িটি ভাসতে লাগল। ড্রাইভিং সিটে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। আমার মতোই একজন মানুষ, কিন্তু তার পুরো শরীর বেগুনি। শুধু চুলগুলো হলুদ। তাকে বললাম, তুমি বেগুনি রঙের নিষিদ্ধ গাড়ি চালিয়ে বাতাস দূষিত করছ কেন? লাইসেন্স দেখি। আমার কথা শোনামাত্র হলুদচুলো বেগুনি রঙের ড্রাইভারের তিনটি চোখই লাল হয়ে গেল। মনে হয় দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। আমি এর আগে কখনো তিনচোখা প্রাণী দেখিনি। তো, সে করল কি, ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে লাফ দিয়ে আমার সামনে নামল। আমার দুই চোখের দিকে নিজের তিন চোখ রেখে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। আমি বিভ্রান্ত হয়ে বললাম, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? দেখি তোমার ড্রাইভিং লাইসেন্স...।

উত্তরে সে হড়বড় করে কীসব বলল, কিছুই বুঝলাম না, শুধু ‘লাইসেন্স’ শব্দটা ছাড়া। দেখলাম, ওর চোখ তিনটি আরও লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আমার মেজাজ আগে থেকেই গরম ছিল। ওর ভাবভঙ্গি দেখে আরও গরম হয়ে গেল।

‘আপনার মেজাজ কেন গরম ছিল? তার আগে বলুন, আপনি লাইসেন্স দেখতে চাওয়ার কে?’

আসামি-২: মহোদয়, এটাই মূল কথা। হাঁসের মাংস খেতে ইচ্ছে করছিল। স্ত্রী বলল, সম্ভব না। মুরগির মাংস খাও। ব্যস! মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গিয়েছিল। রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে রেস্টুরেন্টে যাচ্ছিলাম হাঁসের মাংস-ভুনা খাওয়ার জন্য। তারপরের ঘটনা তো বললামই...। বুঝতেই পারছেন, এসবের পেছনে দায়ী আসলে আমার স্ত্রী। সে যদি আমাকে হাঁসের মাংসের ভুনা করে দিত, তাহলে আমি বাসার বাইরে বের হতাম না। আর বাসার বাইরে বের না হলে ওই হলুদচুলো বেগুনি শরীরের অদ্ভুত মানুষরূপী প্রাণীটার সঙ্গে দেখা, ড্রাইভিং লাইসেন্স চাওয়া বা ঝগড়া কোনোটাই হতো না। অতএব, আমি নির্দোষ।

‘আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। ওনার স্ত্রীকে নিয়ে আসা হোক।’

আসামি-৩: অযথা হয়রানি করার জন্য আমাকে এখানে ডাকা হয়েছে মহোদয়। ওই খুনের ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।

‘সেটা সময়ই বলে দেবে। এখন বলুন, আপনি কেন আপনার স্বামীকে হাঁসের মাংস রান্না করে খাওয়াননি?’

আসামি-৩: কীভাবে রান্না করব বলুন। উনি যখন হাঁসের মাংসের ভুনা খেতে চেয়েছিলেন, ততক্ষণে আমার রান্না শেষ। তারপরও আমি রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু আনতে গিয়ে দেখি হাঁসটা খোঁয়াড়ে নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওটাকে দেখতে পেলাম সুপারিগাছের মাথায়।

‘হাঁস সুপারিগাছের মাথায়? মশকরা? আপনি জানেন, এখানে মিথ্যা বলা দণ্ডনীয় অপরাধ।’

আসামি-৩: জি মহোদয়, জানি। বিশ্বাস না হলে আমাদের বাড়ির পাশের সুপারিগাছটা চেক করে দেখতে পারেন। হাঁসটা এখনো নামেনি।

‘হাঁসটাকে সুপারিগাছ থেকে ধরে...সরি পেড়ে নিয়ে আসা হোক।’

সঙ্গে সঙ্গে তিনজনের চৌকস একটি দল দৌড়ে সুপারিগাছটার কাছে গেল। দেখল, ঘটনা সত্যি। হাঁসটা সুপারিগাছের মাথায় আয়েশ করে বসা। চৌকস দল বিভিন্নভাবে হাঁসটাকে প্রলুব্ধ করল। লাভ হলো না। শেষে বন্দুক তাক করে গুলির ভয় দেখানো হলো। তাতেও লাভ হলো না। নামল না হাঁসটি। অবশেষে ওপরমহলের নির্দেশে গোড়া থেকে কেটে ফেলা হলো সুপারিগাছটা। হাঁসটিকে নিয়ে আসা হলো পাকড়াও করে।

হাঁস: প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক...

‘আপনি...ইয়ে মানে জনাব হাঁস, অভিযোগ উঠেছে, বেগুনি রঙের একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?’

হাঁস: প্যাআ-আ-আ... প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক...

‘না বোঝার ভান ধরে লাভ হবে না। আপনাকে...ইয়ে মানে তোমাকে সত্যটা বলতেই হবে। বলো, তুমি কেন খোঁয়াড় থেকে পালিয়ে সুপারিগাছে উঠেছিলে?’

হাঁস: প্যাআ-আ-আ...প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক...। প্যাআ-আ-আ... প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক...।

‘দেখো হাঁস, যতই চালাকি করো না কেন, তোমাকে সব স্বীকার করতেই হবে। খুনের ঘটনাটি ঘটার আগে আগেই তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে, তার মানে তুমি জানতে এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তাই না?’

হাঁস: প্যা...প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক...। প্যা-আ-আ-আ...প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক...।

‘বুঝেছি, তুমি ঝেড়ে কাশবে না। কিছুই স্বীকার করবে না। তাই তো?’

হাঁস: প্যা-আ-আ-আ...প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক...। প্যা-আ-আ-আ...প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক...। প্যা-আ-আ-আ...

‘নাহ্। সামান্য একটা হাঁস, তার কত বড় সাহস। এত এত জ্ঞানী মানুষের সামনে প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক করেই যাচ্ছে। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, ও কিছু লুকাচ্ছে। এই বেয়াদব ও সন্দেহভাজন ভয়ংকর খুনি-হাঁসের পেট থেকে কথা বের করতে রিমান্ডের বিকল্প নেই।’

অতঃপর হাঁসটিকে রিমান্ডে নেওয়া হলো। কিন্তু হাঁসের পেট থেকে ডিম ছাড়া কোনো গোপন তথ্য উদ্ধার করা গেল না। অবশেষে সব দিক বিবেচনা করে চাঞ্চল্যকর খুনটার প্রধান অভিযুক্ত ও আসামি হিসেবে হাঁসটির মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হলো।

বেলা ফুরোনোর আগেই কার্যকর হলো রায়। ডিনারে উপস্থিত সবাই ওই হাঁসের ভুনা মাংস দিয়ে পরোটা খেতে খেতে এই মর্মে পরস্পরকে ধন্যবাদ দিল—অনেক দিন পর সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে।