দীপ্রর বয়স ১৪, কপালে ব্রণ। নাকের নিচে ঈষৎ গোঁফের রেখা, নাক উঁচু। দীপ্র নামের ছেলেদের নাক উঁচু হয়েই থাকে। তাদের সামনের দাঁত দুটো রোনালদিনিওর মতো সামান্য উঁচু হলে ভালো। আমার দুটো অবশ্য অত উঁচু নয়।
দীপ্ররা থাকে মিরপুর সরকারি কর্মচারীদের কলোনিতে। বিশাল মাঠ। চারদিকে উঁচু দেয়াল। এ রকম উঁচু দেয়াল গার্লস স্কুলের বাউন্ডারিতেও থাকে না। সম্ভবত জেলখানার চারদিকে থাকে। দীপ্র অবশ্য কোনো দিন জেলখানা দেখেনি। মিরপুরে থাকে, মিরপুরেরই একটা স্কুলে পড়ে; পুরান ঢাকার দিকে যাওয়ার সুযোগ পায় না। দীপ্রর জানি দোস্ত নিশান। সে শুকনা-পটকা, উচ্চতা ৪ ফুট ৩ ইঞ্চি, তার বডি বিড়ালের তৈরি। মানে হলো, ওর শরীরে কোনো ব্যথা লাগে না। তিনতলার ছাদ থেকে ওকে ফেলে দিলে নিচে পড়ে সে প্রথমে চার হাত-পায়ে দাঁড়ায়, তারপর মাথা তুলে ছাদের দিকে তাকায়, তারপর দুপায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে। দীপ্র নিশানকে বলল, ‘দোস্ত, কোনো দিন জেলখানা দেখিনি। চল, দেখি। তুই তো সব কাজের কাজি। ব্যবস্থা কর।’
নিশান বলল, ‘ব্যবস্থা খুবই সহজ। তুই সোজা হেডস্যারেরর রুমে ঢোক। রুমে টেলিফোন সেট আছে। সেটা বগলে নিয়ে ঘর থেকে বের হ। দারোয়ান থামতে বললেই দিবি দৌড়। দারোয়ান দৌড়াচ্ছে। তুইও দৌড়াচ্ছিস। দারোয়ান তোর সাথে পারবে না। তুই পাড়ার ফোনের দোকানে গিয়া বলবি, এইটা বেচব। ২০০ টাকা দেন। দোকানদার বলবে, ৫০। তুই ১০০ টাকায় রাজি হবি। টাকা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে দারোয়ান এসে যাবে। এরপর আর কোনো চিন্তা নেই। তুই সোজা জেলখানা চলে যাবি।’
‘যদি জেলখানায় না নেয়?’
‘কই নিবে?’ নিশান আঙুল ফোটাতে ফোটাতে বলল।
দীপ্র করুণ গলায় বলল, ‘হেডস্যারের রুমে নিবে। আব্বাকে খবর দিবে। আব্বা আসবে। আমি ফোন সেট চুরি করছি শুনে আম্মা ফিট হয়ে যাবে। তার ফিটের ব্যামো আছে। আম্মা যদি স্কুল পর্যন্ত ছুটে আসতে পারে, তখন থানা–পুলিশ বাদ দিয়ে ডাক্তার–অ্যাম্বুলেন্স করতে হবে।’
‘তুই একটা হোপলেস দীপ্র! তোকে দিয়ে কিছু হবে না।’
ওরা আড্ডা দিচ্ছিল কলোনির ৩ নম্বর বিল্ডিংয়ের ছাদে। ছাদের এক কোণে দুইটা বড় পানির ট্যাংক। ট্যাংক দুইটাকে জোড়া দিয়ে রেখেছে, মানে কানেকটেড রেখেছে এক জোড়া স্টিলের পাইপ। ওরা সেই পাইপে বসে আছে। এটা ওদের আড্ডাখানা। পাশের শিরীষগাছের চূড়া চারতলার ছাদ পর্যন্ত চলে এসেছে। বাকি গাছগুলোর মাথা দেখা যায়। ওদের আড্ডার বুদ্ধিজীবী পাভেল একটু পরে এসে যোগ দিল। পাভেল এই দলের কলঙ্ক। সে ক্লাসের ফার্স্টবয়। তার চোখে অনেক পাওয়ারের চশমা। সে সালোকসংশ্লেষণ বলতে পারে না, এই ব্যাপারটাকে বলে ‘ফটোসিনথেসিস’।
ওর পা ধোয়া পানি খাওয়ার প্রেসক্রিপশন শুনতে শুনতে দীপ্রদের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে।
দীপ্রর আম্মা বলেন, ‘অঙ্কে ৩৩ পাইছ। পাভেল পাইছে ১০০। ওর পা ধোয়া পানি খাও।’
অঙ্কে ৩৩ পাওয়ার বান্দা দীপ্র না। ১৮ পাওয়ার বান্দা। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে একটা সরল অঙ্ক ছিল। দীপ্র সেটা প্রশ্নপত্র থেকে কপি করেছে। তারপর সেই একই লাইন লিখেছে বারবার। প্রতিবার একটু কম করে ছোট করেছে। শেষে এসে লিখে রেখেছে মাত্র একটা পদ।
একইভাবে জ্যামিতিতে সরলরেখাকে দুই ভাগ করতে বলেছে। খাতা বরাবর একটা সরলরেখা এঁকেছে দীপ্র। তারপর পাতা দুই ভাঁজ করে ভাঁজ বরাবর টান দিয়ে দুই ভাগ করেছে সরলরেখাকে।
হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা ছিল। স্যার খাতা দেখানোর সময় দীপ্র দেখল, সরল অঙ্কে ফুল মার্কস দিয়েছেন। কেন দিয়েছেন, তিনিই জানেন। স্যাররা মন দিয়ে খাতা দেখেন, এমন ধারণাই ছিল দীপ্রর। কিন্তু এই অদ্ভুত সরলে ফুল মার্কস দিয়ে স্যার প্রমাণ করলেন, তিনি খাতা দেখার সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন।
কিন্তু সরলরেখাকে দুই ভাগ করা নিয়ে তিনি বিপদে পড়েছেন।
তিনি বললেন, ‘কীভাবে করলি?’
দীপ্র বলল, ‘স্যার, স্কেল দিয়ে খাতায় আড়াআড়ি একটা সরলরেখা এঁকেছি। এরপর পাতাটাকে ভাঁজ করেছি সমানভাবে।’
ক্লাসের সবাই হাসতে লাগল।
স্যার বললেন, ‘তুই ১৮-এর বেশি পেতে পারিস না। কিন্তু তোকে ৩৩ দিচ্ছি। কারণ, তুই নিজের মাথা খাটিয়ে একটা সমাধান করেছিস। তোর উত্তর সঠিক হয়েছে।’
দীপ্র ওর বাঁ কান তৈরি করছে। স্যারের ডান হাতে শক্তি বেশি। ওর কানে এখনই একটা চড় নেমে আসবে। এই চড়ের গতি মহাকাশ থেকে নেমে আসা ধূমকেতুর চেয়েও বেশি হবে। তা হলো না। তিনি এসে দীপ্রর চুল নেড়ে দিলেন। ওর কপালে চুল পড়ে থাকে। স্যার আদর করে চুল সরিয়ে দিলেন।
এমন একটা গৌরবের ঘটনা ওর আম্মাকে বলতে গেল দীপ্র, ‘আম্মা, আজকে হয়েছে কী জানো! অঙ্ক স্যার খাতা দেখাচ্ছেন...’
‘কত পাইছিস?’
‘৩৩। সেটা বড় কথা না। আসল কথা হলো, স্যার আমাকে অনেক আদর করেছেন।’
‘পাভেল কত পাইছে?’
‘ওই খাটাশটার কথা আর বোলো না। ১০০-এর নিচে কোনো দিন পায় না।’
‘হারামজাদা, পাভেল কোন দোকানের চাল খায় আর তুই কোন দোকানের চাল খাস? ও পায় ১০০ আর তুই পাস ৩৩। যা। পাভেলের পা ধোয়া পানি খা।’
‘আমি বললাম, জি আচ্ছা।’
পাভেলকে বাসায় ডেকে আনল দীপ্র। নিশানকেও ডেকে আনা হলো। ওরা ত্রিরত্ন। একসঙ্গে চলে। একটা বালতিতে পানি ঢালল দীপ্র। তারপর পাভেলকে বলল, ‘পাভেল, এই বালতিতে পা ডোবা।’ নিশান পুরো জিনিসটা তার মোবাইল ফোনে ভিডিও করতে লাগল।
পা ধোয়া হয়ে গেলে সেই পানি ঢালা হলো বোতলে। সেটারও ভিডিও করা হলো।
এইভাবে ভরা হলো তিন বোতল পানি। সেই পানি অবশ্যই ফেলে দেওয়া হলো। একই রকম দেখতে বোতলে রাখা হলো ফোটানো বিশুদ্ধ পানি। তার গায়ে লেবেলে লেখা, পাভেলের পা ধোয়া পানি। আরও তিনটা বোতলে পানি ভরে সেটার গায়ের লেবেলে লেখা হলো, ‘পাভেলের মায়ের পা ধোয়া পানি।’
দীপ্র ওর আম্মাকে ডেকে আনল ড্রয়িংরুমে। সেখানে নিশানও উপস্থিত। এ–জাতীয় দুষ্টুমিতে থাকতে রাজি হলো না পাভেল। ছেলেটা সব সময়ই স্বার্থপর। ভালো ছাত্ররা একটু স্বার্থপর হয়েই থাকে, ব্যাপার না।
‘পাভেলের পা ধোয়া পানি’ লেখা বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেল দীপ্র। তারপর বলল, ‘আম্মা, এই যে দেখো, আমি তোমার আদেশ পালন করলাম। পাভেলের পা ধোয়া পানি খেলাম।’
আম্মা বললেন, ‘ফাইজলামো করিস? আমার সাথে ফাইজলামো করিস? বোতলে ভালো পানি রেখে বলিস পাভেলের পা ধোয়া পানি?’
নিশান মিনমিন করে বলল, ‘এই যে আন্টি, আমি ভিডিও করে রেখেছি। দেখেন, পাভেলের পা ধোয়া পানি এই বোতলে ভরা হয়েছে। দেখেন দেখেন।’
আম্মা এক ঝটকায় নিশানের মোবাইল ছুড়ে মারলেন। দীপ্র বলল, ‘আম্মা, আমি আমার কাজ করেছি। এবার তোমার পালা। পাড়ার স্কলার কোচিং সেন্টারের হেড গাইড বলেছেন, শুধু তুমি পাভেলের পা ধোয়া পানি খেলে কাজ হবে না, তোমার আম্মাকে পাভেলের আম্মার পা ধোয়া পানি খেতে হবে। সেটাও রেডি।’
নিশান ‘পাভেলের মায়ের পা ধোয়া পানি’ লেখা বোতল দীপ্রর আম্মার দিকে এগিয়ে দিলেন। অমনি বোতল তিনটা কেড়ে নিয়ে দুটো আমার মাথায় আরেকটা নিশানের পিঠে ঠাস করে মেরে বসলেন তিনি। বোতলের মুখ খুলে গিয়ে ড্রয়িংরুম প্লাবিত হয়ে গেল।
*
ওদের মাথায় নতুন কোনো দুষ্টুমি আসছে না। দীপ্র আর নিশান ওদের ছাদের আড্ডাখানায় পাইপে বসে ভাবছে। পাভেল বোধ হয় তখন আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি নিয়ে ব্যস্ত। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে গোলাকার পথে না ঘুরে রাগবি ফুটবলের আকারে ঘোরে কেন, এইটা নিশ্চয়ই তাকে ভাবাচ্ছে। ভাবনার কথা বটে। হঠাৎ ওরা দেখল, একটা বিশাল আকারের বিড়াল ওদের ছাদের একটা ট্যাংকিতে বসে আছে। এত বড় বিড়াল ওরা আগে দেখেনি। দীপ্র বিড়ালটাকে ডাক দিল, ‘মিউ মিউ মিউ।’
বিড়ালটা বেশ লক্ষ্মী। একেবারে ওর পায়ের কাছে চলে এল।
নিশান বলল, ‘দীপ্র! দ্য আইডিয়া।’
‘কী।’
‘বিড়ালটাকে বাঘ বানাব। আমার কাছে ভালো কালার আছে। আমার আঙ্কেল মূকাভিনয় করেন। তার মুখে রং মাখতে হয়। সেই রং হার্মলেস। মানুষের ত্বকের কোনো ক্ষতি করে না। তার মানে আমাদের এই বিড়ালেরও কোনো ক্ষতি করবে না।’
‘দারুণ হবে।’
এর মধ্যে পাভেল এসে বলল, ‘প্রাণীদের কোনো রকমের ক্ষতি করলে পুলিশ ধরবে। আর পুলিশ ধরুক না ধরুক, আমি প্রাণীদের কোনো রকমের ক্ষতি করার চরম বিপক্ষে।’
দীপ্র বললাম, ‘আমি প্রাণী লাভার সমিতির সদস্য। কোনো প্রাণীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছা আমার নাই।’
‘ক্ষতি হবে না তো,’ বলল নিশান।
নিশান তার শার্ট খুলে বোতামগুলো লাগাল। তারপর বেঁধে ফেলল এক পাশ। ভালো একটা থলে হলো। থলের মধ্যে বিড়ালটাকে বসিয়ে দিল নিশান। এরপর নিশান তার আঙ্কেলের বাড়ি গিয়ে মূকাভিনয়ের কালি দিয়ে খুব সুন্দর করে হলদে রং লাগাল বিড়ালটার গায়ে। তারপর কালো কালো ডোরা দাগ দিতেই বিড়ালটা হয়ে গেল একটা আস্ত বাঘের বাচ্চা।
নিজেদের দক্ষতায় আশ্চর্য হয়ে গেল ওরা। ওদের মনে হতে লাগল, এটা সুন্দরবন থেকে আসা রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
এরপর ওদের কাজ হলো বিড়ালটাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসা। সেটাই করল ওরা। কিন্তু ঘটনা ঘটতে লাগল আপন গতিতে।
সন্ধ্যার সময় আম্মা বললেন, ‘দীপ্র, ঘর থেকে বের হবি না। চিড়িয়াখানা থেকে একটা বাঘ পালিয়ে গেছে। মিরপুরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। জানালা খুলছিস কেন? হারামজাদা, জানালা বন্ধ কর।’
আব্বা দরজায় তালা দিলেন। সেই তালার চাবি তাঁর কাছে রেখে দিলেন। আমাকে তিনি কিছুতেই বের হতে দেবেন না।
অগত্যা টেলিভিশন খুলল দীপ্র। টেলিভিশন খবরে একটাই কথা—মিরপুরে নাকি বাঘ দেখা গেছে। করোনার সময়ে আবিষ্কৃত ও প্রবর্তিত বিশেষ রকমের পিপিই, মাথায় হেলমেট, পায়ে ভারী জুতা পরা রিপোর্টাররা মিরপুর থেকে লাইভ প্রচার করছেন। ওদিকে সাংবাদিকেরা ভিড় করেছেন বন ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সামনে। মন্ত্রী মফিজ মিয়া সুক্কু বলছেন, ‘এটা আমাদের মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার না। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব।’ সিটি করপোরেশনের আবার দুই মেয়র। উত্তর আর দক্ষিণ। দক্ষিণের মেয়র বলছেন, ‘এটা আমার এলাকায় পড়ে না।’ উত্তরের মেয়র বলছেন, বাঘ যদি বেরিয়েই থাকে, সেটা এতক্ষণ কি এখানে বসে থাকবে নাকি? নিশ্চয়ই দক্ষিণে চলে গেছে। আর এটা তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। জাতিকে নিরাপত্তা দেওয়াই তো তাদের কাজ।
টিভিতে টক শো হচ্ছে। বিরোধী দলের টক শো–বিষয়ক বক্তা জনাব আশিক ফজলু বলছেন, ‘দেখুন, এটা সার্বিক নৈরাজ্যের ফল। চিড়িয়াখানায় বরাদ্দ কম। আর এই ঠিকেদারি করে বিশেষ একটি গোষ্ঠী। তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। বাঘ কখন বের হয়ে যায়? নিশ্চয়ই খেতে না পেয়ে বিড়ালের মতো হয়ে গেছে, ফলে ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কত কম খেতে পেলে একটা বাঘ বিড়াল হয়ে যেতে পারে? এটা আন্তর্জাতিক প্রাণী অধিকার আইনের ৬ নম্বর ধারার লঙ্ঘন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো করছেটা কী?’
প্রশ্নকর্তা বললেন, ‘এটা কি মানবাধিকার না পশু-অধিকার?’ ফজলু সাহেব বললেন, ‘এই দেশে পশুদেরই অধিকার নেই আর মানুষের অধিকার...’ তার মুখ থেকে থুতু উগরে উঠল।
পরদিন মিরপুর এলাকায় স্কুল–কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। সবাই নাকি বাঘ দেখেছে। কেউ বলছে বাঘটা বিড়ালের সমান। কিন্তু ক্রমেই বাঘের আকৃতি বাড়তে লাগল। রাতের দিকে শোনা গেল, চিড়িয়াখানার সবচেয়ে বড় বাঘটাই বেরিয়ে গেছে।
এক পুলিশ ভদ্রলোক তখন বাজার করে জ্যান্ত মুরগি কিনে সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন একটা বাঘ বিআরটিসির দোতলা বাসের সিঁড়িতে বসে আছে। পুলিশের কোমরে ছিল রিভলবার। পুলিশকে বাঘও ভয় পায়। ফলে তিনি তো আর বাঘকে ভয় পাওয়ার পাত্র নন। তিনি ভাবলেন, হাতের ব্যাগ দুটো হাতবদল করা উচিত। মুরগিটা তিনি যেই না বিআরটিসি বাসের সিঁড়িতে রাখলেন, অমনি বাঘটা এক থাবায় মুরগিটাকে কবজা করে ফেলল।
পুলিশ ভদ্রলোক তখন পড়িমরি করে দৌড় দিতে শুরু করলেন। সামনে ছিল খোলা ম্যানহোল। সেটা লাফ দিয়ে পার হলেন তিনি। কিন্তু তার পরেই ছিল খোলা নর্দমা। তিনি সেই খোলা নর্দমাতে পড়ে গেলেন।
দীপ্ররা তো এত কিছু জানত না। ফেসবুকে প্রচারিত ভাইরাল ভিডিওতে ওরা দেখল, এক ভদ্রলোক বিআরটিসি বাসের গেটে বাঘ দেখে দৌড়াচ্ছেন। তারপর লাফ দিলেন। তারপর তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ওদের তো মাথায় হাত। ওদের বানানো বাঘ এত বড় হলো কী করে! ও তো ছিল একটা বিড়াল!
বুদ্ধিজীবী পাভেল মাথা নেড়ে বলল, ‘মাঝেমধ্যে বিড়ালও বাঘ হয়ে যায়।’
ততক্ষণে দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ। বাঘকে কবজা করার জন্য অ্যানেসথেসিয়া বুলেট জোগাড় করা হচ্ছে।
এটা আছে গাজীপুরে। গাজীপুর থেকে আনতে হবে। আনতে গিয়ে দেখা গেল, তিন বছর আগেই এগুলোর মেয়াদ পার হয়ে গেছে।
বিরোধী দল চট্টগ্রামে প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছে। ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকা ঠিক হবে না। কারণ, ঢাকার মানুষ ভয়ে রাস্তায় বের হয় না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘এখানে কোনো বিদেশি ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সাজওয়ানা হাসিন বলেছেন, ‘সরকারের গাফিলতিতে বাঘ চিড়িয়াখানার বাইরে গেছে আর সেই বাঘকে চেতনানাশক দিয়ে গুলি করা হবে, এটা পশু-অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’
পাভেল বলল, ‘দীপ্র, একটা কিছু কর।’
নিশান বলল, ‘চল করি।’
দীপ্র বলল, ‘কী করব?’
নিশান বলল, ‘অনেক মজা নেওয়া হয়েছে। এখন বাসস্ট্যান্ডে যাই। বিআরটিসি বাসের পাদানিতে বসা বিড়ালটাকে মাছ খাওয়াই। তারপর থলেতে ভরে নিয়ে এসে গা ধুয়ে বিড়াল বানিয়ে দিই।’
পাভেল বলল, ‘ব্যাপারটা লাইভ প্রচার করা হবে। সবাই যখন জানবে, এটা বাঘ না, বিড়াল, তখন? সবাই আমাদের অ্যারেস্ট করবে।’
দীপ্র বলল, ‘আমাদের বয়স ১৪। আমাদের অ্যারেস্ট করতে পারবে না। খালি পশুদের অধিকার আছে, মানুষের অধিকার নাই, তা তো হতে পারে না। আমাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠাবে। আমরা গেলে কিশোর সংশোধনাগার নিজেই সংশোধিত হয়ে যাবে।’
পাভেল বলল, ‘আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হব। বিদেশে যাব। নাসায় চাকরি করব। আমি দেশের জন্য এত বড় স্যাক্রিফাইস করতে পারব না।’
দীপ্র বলল, ‘আমি করব।’
নিশান বলল, ‘আমিও করব। কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।’
*
দীপ্র আর নিশান বাঘকে মাছ খাওয়াতে গেল। কিন্তু তারা জানে না কত বড় ঘটনা ঘটে গেছে। চিড়িয়াখানার প্রাণী হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা গুনে দেখলেন, বাঘের সংখ্যা ঠিক আছে। কোনো বাঘ হারায়নি। প্রথমে তাঁরা ঠিক করলেন, এই কথা সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে জানিয়ে দেবেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চাইলেন সেটার অনুমতি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলল, জগৎটা সত্য দিয়ে চলে না। জগৎ চলে পারসেপশন দিয়ে, ধারণা দিয়ে। তোমরা যদি বলো চিড়িয়াখানা থেকে বাঘ পালিয়ে যায়নি, তোমাদের কেউ বিশ্বাস করবে না; বরং তোমাদের মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করবে। তোমরা বরং দেখাও যে চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচার নিচে ওয়াসার পানির লাইনের কাজ চলছিল, সেই গর্ত দিয়ে একটা বাচ্চা বাঘ পালিয়ে গেছে। দুজন সিকিউরিটি গার্ডকে ক্লোজ করা হয়েছে।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাদের বাঘের খাঁচার নিচে গর্ত খুঁড়ল। তারপর আয়েশি ভঙ্গিতে দেখতে লাগল, গর্তটা কেমন হয়েছে। ঠিক তখন একটা খেতে না পাওয়া দুর্বল বেঙ্গল টাইগার সেই পথ বেয়ে বাইরে চলে গেল।
চিড়িয়াখানার সিকিউরিটির লোকেরা বাঘটাকে ধাওয়া করল। বাঘটা এক দৌড়ে চলে এল মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে। সেই বাঘটাকেই দেখা গেল বিআরটিসির একটা দোতলা বাসের সিঁড়িতে আরাম করে বসে থাকতে, যার ভয়ে পালাতে গিয়ে নর্দমায় পড়ে গেল পুলিশ।
দীপ্র আর নিশান বিকেল চারটার সময়, শরৎকালের তাল পাকা গরমের মধ্যে ‘পোলা ও পোলা তুই অপরাধী রে’ গান গাইতে গাইতে মিরপুর বাসস্ট্যান্ডে গেল। গিয়ে দেখে এলাহি কাণ্ড। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ব্যবহার্য আর্মার্ড কার আনা হয়েছে। সেটাতে চড়ে টিভি সাংবাদিকেরা ক্যামেরা তাক করে আছেন বাঘটার (নিশানরা যাকে বিড়াল ভাবছে) দিকে।
দীপ্র আর নিশান পলিথিনের ব্যাগে মাছ নিয়েছে। পাঙাশ মাছ। জ্যান্ত। বিড়ালটা মাছটাকে নিয়ে খানিক খেলা করুক—এটাই তাদের চাওয়া। ওদের হাতে একটা ছালাও আছে। ওরা ঠিক করেছে, বিড়ালটাকে এই ছালায় ভরবে।
সবার ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ওরা বাসের কাছে চলে গেল। পাদানিতে পা রেখে দীপ্র বলল, ‘মিউ মিউ।’
নিশান দ্বিতীয় সিঁড়িটাতে পাঙাশ মাছ ছেড়ে দিল। বাঘ আলস্যভরা চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে উঠল। আড়মোড়া ভাঙল। বাঘের লেজ দিয়ে কান চুলকানোর ভঙ্গি করে একটা সেলফিও তুলল নিশান।
বাঘটা দ্বিতীয় সিঁড়িতে এক থাবা মেরে মাছটাকে মেরে ফেলল। তারপর মাছটাকে খেয়ে নিল এক লহমায়। তারপর দীপ্রদের দিকে তাকিয়ে এমন একটা গর্জন দিল যে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, এমনকি নিউইয়র্কের সব বাংলা টিভির দর্শক লাইভে তা শুনতে পেল।
*
দীপ্র টের পেল, এটা ওদের সেই রং করা বিড়াল নয়। এটা আসল বাঘ। টের পেয়েই ওর প্যান্ট ভিজে গেল। নিশান তখনো টের পায়নি। আশ্চর্য! সে-ই রং করেছে, অথচ টের পেল না এখানে রঙের চিহ্নমাত্র নেই। আর বাঘের গন্ধই তো ভীষণ বিচ্ছিরি।
নিশান ছালাটা মেলে ধরে বলল, ‘মিউ, এটার মধ্যে ঢোকো। টাইগার, গো, গো।’
কী আশ্চর্য! বাঘটা ছালার মধ্যে ঢুকে পড়ল। নিশান তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিল ছালার মুখটা। ওর পকেটে সব সময় দড়ি থাকে।
অমনি চারদিক থেকে পিপিই পরা, বোমারোধী ড্রেস পরা, হেলমেট পরা, বুট পরা মানুষজন এসে পৌঁছাল আর একটা লোহার জালি দেওয়া বাক্সে বস্তাটাকে ভরে মুখটা খুলে দিল।
এই দৃশ্য লাইভ প্রচার করে, টিকটক করে, ইনস্টাগ্রাম ভিডিও করে কতজন যে সেলিব্রিটি হয়ে গেল।
ততক্ষণে দৌড়ে এসে গেছে পাভেল। এসে বলল, ‘দীপ্র, নিশান, তোরা কিছু বলবি না। যা বলার আমি বলব।’
টিভি সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করল, ‘তোমাদের এই সাহসের উৎস কী?’
পাভেল বলল, ‘ভালোবাসা।’
‘ভালোবাসা?’
‘হ্যাঁ। ভালোবাসা। প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা।’
‘প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা?’
‘হ্যাঁ। আর তা আসে মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে। আপনি যদি মানুষকে ভালোবাসেন, প্রাণীকে ভালোবাসতে হবে। বাঘ না থাকলে বন থাকবে না। বন না থাকলে পৃথিবী থাকবে না। তখন মানুষ কোথায় যাবে? বোঝা গেল জিনিসটা!’
দীপ্ররা রাতারাতি হিরো বনে গেছি। সবচেয়ে বড় হিরো হয়ে গেছে পাভেল। কারণ, সে–ই ওদের মুখপাত্র। অবশ্য তাতে ওদের কিছু যায়–আসে না। এরই মধ্যে সরকার তিনজনের নামে তিনটা প্লট দিয়েছে। পূর্বাচলে। দীপ্রর আম্মা অবশ্য খুশি না, ‘তিন কাঠা প্লট দিয়ে কী হবে? ১৫০০ স্কয়ার ফিটের তিনটা ফ্লোরও তো হবে না। পাভেলের পা ধুয়ে পানি খা। কী সুন্দর করে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিল। বন রক্ষার কথা বলল।’
নিশান বলল, ‘আন্টি, আমাদের কাছে আরেকটা বাঘ আছে। সেটা দেখালে আরও তিন কাঠা পেতে পারি।’
পাভেল বলল, ‘খবরদার। ওইটা কই?’
ছাদে গেল ওরা। দেখল, রং করা বিড়ালটা ওখানে, ওটাকে থলেতে ভরে বাড়ি নিয়ে গেল নিশান। সার্ফ এক্সেল দিয়ে গোসল করাবে। দাগ থেকে যদি এত কিছু হয়, দাগই তো ভালো।
একটু পরই নিশানের ফোন।
‘দীপ্র?’
‘কী?’
‘সর্বনাশ হয়া গেছে!’
‘কী হইছে?’
‘বিড়ালটা তো অন্য জায়গায়। এটা তো বাঘ। আমার বাথরুমে এখন একটা আসল বাঘের বাচ্চা।’
‘এইবার কী করব? পাভেলের শরণাপন্ন হইতে পারি। পাভেল বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবীরাই সংকটকালে জাতির ভরসা।’
‘মাথা খারাপ! পাভেলরে বললে এখনই একটা গোলটেবিল আয়োজন করবে। শোন, আমরা রাতের বেলা চিড়িয়াখানা যাব। ওরা নাকি গর্ত করছে? সেই গর্ত দিয়া বাঘরে ঢুকায়া দিব।’
রাতের অন্ধকারে চিড়িয়াখানার দেয়াল টপকে ভেতরে যাচ্ছে দীপ্র আর নিশান। ওদের ব্যাগে সত্যিকারের বাঘের বাচ্চা। হঠাৎ মানুষের গলায় কে যেন বলল, ‘ভাই, আপনেরা আমার জন্য যা করতেছেন, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’
নিশান বলল, ‘কে কথা কয়?’
থলের ভেতর থেকে আওয়াজ এলে, ‘আমি বাঘ। দ্য বেঙ্গল টাইগার।’
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না ওরা। দীপ্র বলল, ‘আপনি সত্যি বেঙ্গল টাইগার?’
বাঘ বলল, ‘আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমার বয়স মাত্র দুই বছর। তুমি করে বলেন।’
নিশান বলল, ‘আপনি কথা বলা শিখলেন কীভাবে?’
বাঘটা বলতে লাগল, ‘সেইটা লং হিস্ট্রি। আমার জন্মকালে মা চিড়িয়াখানায় মারা যায়। আমি এতিম। তখন চিড়িয়াখানার একজন কেয়ারেটকার আমার দায়িত্ব নেন। রোজ ফিডারে করে দুধ খাওয়াতেন। আমি তারেই মা ডাকতাম। তিনি আমার সাথে বাংলায় কথা বলতেন। তার কাছ থেকে শুনে শুনে আমি বাংলা শিখেছি। আমি কী জানি যে আমার মা আসলে বাঘ? জানি না। মানুষকে মা ভেবেছি। তাই মানুষের কথা শিখেছি।’
দীপ্র বলল, ‘তা আপনে মিরপুরের বাংলা না শিখে এই রকম কেতাবি বাংলা কোথায় শিখেছেন?’
বাঘ বলল, ‘আমার কেয়ারটেকার, যাকে আমি মা ডাকি, তিনি আসলে আবৃত্তি শেখান। আপনারা ফেসবুকে তার অনেক ভিডিও দেখবেন। তার কাছ থেকে আমি প্রমিত বাংলা শিখেছি। আসল উচ্চারণ উদ্যোগ, উদ্যোগ না। আপনারা জানেন? আচ্ছা বলুন তো, আষাঢ়ে গল্প কথাটা কোথা থেকে এসেছে?’
‘কোথা থেকে?’
‘আজারে গল্প থেকে।’
‘আজাইরা গল্প, হা হা হা।’ নিশান হাসতে লাগল।
বাঘটাকে চিড়িয়াখানায় রেখে এল দীপ্র আর নিশান। পরে পাভেলের সঙ্গে দেখা। তাকে সব খুলে বলতেই। পাভেল বলল, ‘চাপা মারোস? চাপা মারনের জায়গা পাস না!’
নিশান দীপ্রকে বলল, ‘বললাম না, সত্য কথার ভাত নাই। সত্য বলতাম না, সবাই বিশ্বাস করত।’
ঠিক সেই সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এল। আষাঢ় মাস। খুব বৃষ্টি হচ্ছে ইদানীং।
নিশান বলল, ‘বল তো পাভেল, আষাঢ়ে গল্প কথাটা কোত্থেকে এসেছে?’
পাভেল এই প্রশ্নের উত্তর জানে না। এখনই সে বাংলা একাডেমি, সংসদ, চলন্তিকা—সব ডিকশনারি বের করবে। চশমা মুছছে বারবার। বৃষ্টির চোটে তার চশমার কাচ ঘোলা হয়ে উঠছে।