চাঁদের মানুষদের শৈশব–কৈশোর নেই

অলংকরণ: আরাফাত করিম
ইউরোপীয় রসসাহিত্যের এক অসাধারণ চরিত্র ব্যারন মুনশাউজেন, যার স্রষ্টা জার্মান সাহিত্যিক রুডলফ এরিখ রাসপে। ব্যারন মুনশাউজেন প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৭৮৩ সালে। মজার এই চরিত্র নিজের বিচিত্র অভিযানের কথা বলে যায় পাঠকদের। কখনো তার উপস্থিত বুদ্ধিতে ভালুক বিস্ফোরিত হয়ে যায়। গাছে চামড়া ঝুলিয়ে রেখে দৌড়ে পালায় শিয়াল। ব্যারন কখনো লাফ দেয় তিমির পেটে, কখনো আবার চলে যায় চাঁদে। এটি সেই চাঁদে অভিযানের গল্প। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষায়ই অনূদিত হয়েছে ব্যারনের অভিযানের গল্প। বাংলায় গল্পগুলো অনুবাদ করেছেন খ্যাতিমান লেখক, গবেষক ফরহাদ খান। পুরো অভিযানের কথা পাবে ব্যারন মুনশাউজেনের রোমাঞ্চকর অভিযান বইয়ে। চলো তাহলে, ব্যারনের সঙ্গে চলে যাই চাঁদের দেশে।

‘ভ্রমণের সঙ্গে প্রয়োজন যুক্ত হলে, সে ভ্রমণকে বলা হয় পরিদর্শন। পরিদর্শনের মধ্যে কোনো আনন্দ থাকে না। আমার প্রথম চন্দ্রভ্রমণ নিরানন্দ ছিল। কারণ, তা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। দ্বিতীয় চন্দ্রভ্রমণ অনাকাঙ্ক্ষিত না হলেও অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে গেল। দুর্ঘটনার ফলে আমরা একত্রিশজন মানুষ কোথাও কোনো জায়গা না পেয়ে অবশেষে চাঁদে অবতরণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে দ্বিতীয় চন্দ্রভ্রমণ আনন্দদায়ক ছিল। আমি অনবদ্য অভিজ্ঞতা অর্জন করে পৃথিবীতে ফিরে আসি।

প্রসঙ্গত, আপনাদের বলে নেওয়া ভালো, দুর্ঘটনা না ঘটলে কখনোই আমার চাঁদে যাওয়া হতো না। চাঁদে মানুষ বেড়াতে যায় না, বাজার করতেও যায় না। বস্তুত মানুষের পক্ষে চাঁদে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু দুর্ঘটনা অনেক কিছুই সম্ভব করে তুলতে পারে।

চাঁদে আমাদের অনেক দিন থাকতে হয়েছিল। ফলে চাঁদের সবকিছুই দেখা হয়ে যায়। স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, আশা করি, চাঁদের গল্প পুরোটা আপনাদের বলতে পারব। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের এ গল্প শোনা প্রয়োজন। দুর্ঘটনা প্রত্যহ ঘটলেও সব দুর্ঘটনা যে সব মানুষকে চাঁদে নিয়ে যাবে, এমন আকাশকুসুম কল্পনা না করাই ভালো।

বিশ্বভ্রমণ শেষে, এক আত্মীয়ের অনুরোধে আমি আবিষ্কার-অভিযানে বের হতে বাধ্য হই। গ্যালিভারের ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়ে আমার এক আত্মীয়ের ধারণা জন্মেছিল, লিলিপুট ও ব্রবডিগনাংগদের দেশ আছে পৃথিবীতে এবং তারা ছাড়া তাদের চেয়ে আরও অনেক বিচিত্র মানুষ কিংবা প্রাণী বাস করে পৃথিবীর অজ্ঞাত দেশসমূহে। তিনি গ্যালিভারের জীবন্ত অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। যদিও আমি জানি, গ্যালিভারের ভ্রমণসমূহ অলীক, তবু আমার এই বিশ্বাসের কথা তাকে জানাইনি। তিনি বিত্তবান ছিলেন। বয়সজনিত মৃত্যুকালও প্রায় সমাগত ছিল। তা ছাড়া তিনি আমাকে তার সমুদয় স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন।

রোববার, গির্জার প্রার্থনা অনুষ্ঠানে তিনি শুনেছিলেন, অতৃপ্ত জ্ঞান নিয়ে মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তি স্বর্গলাভে বঞ্চিত হয়। তাই তিনি তার জ্ঞান সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে আমাকে তার উদ্দিষ্ট অজ্ঞাত অঞ্চলের সম্ভাব্য বিচিত্র মানুষ সম্পর্কে তথ্য আহরণের উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচন করলেন। খ্যাতির বিড়ম্বনার কারণে, আমাকে বাধ্য হয়ে সেই অদ্ভুত দেশের সন্ধানে বহির্গত হতে হলো। কিন্তু আমি দুঃখিত, তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা পরিতৃপ্ত হয়নি। পর্যাপ্ত জ্ঞান সঞ্চয় করে আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই তিনি মৃত্যুর করাল গ্রাসে নিপতিত হন।

যাহোক, আমি তো সেই আবিষ্কার-অভিযানে বের হলাম। সমুদ্রপথেই শুরু হয়েছিল যাত্রা। সঙ্গী ছিল ত্রিশজন সবলদেহী দুর্ধর্ষ নাবিক। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল দক্ষিণসাগর। চার দিনের মধ্যেই আমার চেনা পৃথিবী দূরে সরে গেল। গন্তব্য অজ্ঞাত। গন্তব্যপথও অজানা। আবিষ্কার-অভিযানে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে না, তাই কম্পাসটা বাক্সে বন্দী করে রাখলাম। পথে এমন কিছুই চোখে পড়ল না। উড়ন্ত কিছু মানব–মানবী ছাড়া। তারা দেখতে ব্যাঙের মতো। উড্ডীয়মান অবস্থায় তারা ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছিল।

আঠারো দিন পর আমরা ক্যাপ্টেন কুক–বর্ণিত তাহিতি দ্বীপপুঞ্জ অতিক্রম করলাম। ঊনবিংশতিতম দিনে উঠল প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ের অভাবনীয় ধাক্কায় আমাদের জাহাজ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার মাইল উঁচুতে উঠে এল। নাবিকেরা দাঁড় টানা বন্ধ করল। শূন্যে দাঁড় টানা যায় না। এ রকম শূন্যাবস্থায় আমরা মিনিট পাঁচেক ছিলাম। কিন্তু ঝড়ের আরেকটি নতুন ঝাপটা আরও ওপরে ঠেলে পাঠাল। যেখানে পৌঁছালাম, সেখানে শুধুই মেঘ। সাগরের ঢেউয়ের মতো মেঘের ঢেউ। নাবিকেরা পুনরায় দাঁড় টানা শুরু করল। সাগরে যে গতি ছিল আমাদের জাহাজের, মেঘের ঢেউ ওঠা সাগরে সে গতি যেন শতগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলো। কী হলো এরপর, কিছুই আমরা জানি না। কারণ, আমরা শুধুই ছুটেছি। এক সপ্তাহ পর আমাদের জাহাজ মাটির ধাক্কা খেল। অসীম শূন্যতা পেরিয়ে আমরা যে কোনো দিন মাটির স্পর্শ পাব, সে আশা আমরা সবাই পরিত্যাগ করেছিলাম। মাটির ধাক্কায় যেন আমাদের আচ্ছন্ন অবস্থা দূরীভূত হলো। নতুন এক আবিষ্কারের আনন্দ নিয়ে দেখলাম, আমরা পৌঁছে গেছি এক অত্যাশ্চর্য অজানা দ্বীপে। দ্বীপের সব কিছুই রুপালি। মাটি রুপালি, ঘরবাড়ি রুপালি, গাছপালা রুপালি, দ্বীপে ঘরবাড়ি থাকার অর্থ, ঘরবাড়ি তৈরি হয় এবং ব্যবহৃত হয়। কারা ব্যবহার করে, তাদের দেখা গেল না।

জাহাজ নোঙর করার চমৎকার জায়গা পাওয়া গেল।

আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের নিচে ভিন্ন এক পৃথিবী। দূর থেকে দেখা গেল, শহর, বন্দর, গাছপালা, পাহাড়, নদী, সমুদ্র সবই, অর্থাৎ সে পৃথিবী আমাদেরই, যেখান থেকে আমরা চলে এসেছি বা ঝড়ের ধাক্কায় উৎক্ষিপ্ত হয়েছি এই নতুন পৃথিবীতে। অনতিবিলম্বে জানা গেল, আমরা এখন যেটাকে নতুন পৃথিবী বলছি, তা আদৌ কোনো পৃথিবী নয়, এ হলো সেই চাঁদ, যে তার শুক্লপক্ষের শেষ দিনগুলোয় আমাদের পৃথিবীতে আলো পাঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।

পৃথিবী থেকে চাঁদের কোনো কিছুই এত দিন দেখতে পাইনি। এবার প্রাণভরে দেখার সুযোগ এল। চাঁদের আকাশ আমাদের পৃথিবীর মতোই নীল। আকাশে শকুনের মতো দেখতে একধরনের পাখি ওড়ে। পাখির তিনটি মাথা। আমাদের জাহাজের সবচেয়ে বড় যে পাল, সেই পালের মতো বড় তাদের একেকটি পাখা। আমরা যেমন পৃথিবীতে ঘোড়ার পিঠে করে চলাফেরা করি, চাঁদের অধিবাসীরাও এই সব পাখি ঘোড়ার মতো করে ব্যবহার করে, অর্থাৎ পাখির পিঠে চড়ে তারা হাটবাজার, যুদ্ধ–বিগ্রহ সবই করে। তফাত শুধু এ–ই যে পৃথিবীর ঘোড়া স্থলচর, চাঁদের পাখিরূপী ঘোড়া উভচর।

চাঁদের দেশ, মহাদেশ বলে কোনো অঞ্চল ভাগাভাগি নেই। চাঁদ নিজেই একটি দেশ অথবা মহাদেশ। মহামান্য রানা লুনা চাঁদে রাজত্ব করেন। শূন্যে ভাসমান অন্যান্য পৃথিবী বা অন্য কিছুর সঙ্গে চাঁদের দেশের কোনো বিরোধ নেই। চাঁদের একমাত্র শত্রুদেশ হলো সূর্য। চন্দ্রে এবং সূর্যে সর্বদাই লড়াই চলে।

চাঁদের দেশের সবকিছুই বৃহদাকৃতির। সাধারণ মাছিও মাছি নয়। মাছির দেহ পৃথিবীর মেষের দেহের সমান। চাঁদের আকাশে অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীরাও বেড়াতে আসে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে। চাঁদের প্রতিবেশী এক দেশের অধিবাসীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। লোকটাকে মানুষ বলা ঠিক হবে না, সে জন্যই অধিবাসী বললাম। অধিবাসীটি লম্বায় প্রায় ছত্রিশ ফুট। অদ্ভুত আকৃতি। মুখের চেহারা কুকুরের মতো। নাক নেই। চোখ দুটো ঠোঁটের একটু ওপরে। দুই চোখের মাঝখানে ফুটো। এটাই নাকের কাজ করে।

অধিবাসীটির নিকট থেকে আরও জানা গেল, তারা বৎসরে বারোবার মাত্র আহার করে, অর্থাৎ তারা মাসে একবার খায়। খাওয়ার ব্যাপারে তারা মোটেও সময় নষ্ট করে না। মুখে কোনো দাঁত নেই। খাবার চিবাতে হয় না। পুরো এক প্লেট খাবার একবারে তারা মুখের মধ্যে ঢেলে দেয়। চোয়াল বেশ বড়। মাঝেমধ্যে প্লেটও ভেতরে চলে যায়। তাতে কোনো সমস্যা হয় না। প্লেট মলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসে। যেহেতু তাদের পেটে মল তৈরি হয় না, সে জন্য প্লেট নিয়ে কোনো ঝামেলা হয় না। চোখে তাদের পাতা নেই। যেহেতু জিব তাদের বেশ লম্বা, ঘুমানোর সময় তারা জিবের অগ্রভাগ দিয়ে চোখ ঢেকে রাখে।

চাঁদের অধিবাসীদের কথা বলা দরকার। আপনাদের সুবিধার জন্য তাদের মানুষ বলে চিহ্নিত করেছিলাম। তারা দেখতে অবশ্য আমাদের মতো নয়। তবু এদেরকে আমি চন্দ্রমানব বলব। এদের আচার-আচরণ, চেহারা ইত্যাদি বিষয়ে আপনাদের জ্ঞান থাকা দরকার। চাঁদে শিশু বলে কিছু নেই। চাঁদের মানুষদের শৈশব–কৈশোর নেই। যৌবন থেকে তাদের বয়স শুরু। বার্ধক্যে সমাপ্তি।

বিষয়টা আপনাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। চাঁদের মানুষ গাছ থেকে পাড়তে হয়। গাছের ফলের মধ্যেই তারা শৈশব ও কৈশোর স্তর শেষ করে। চন্দ্ররানির নির্দেশ ব্যতিরেকে এই মনুষ্যফল আহরণ করা হয় না। মনুষ্যফলের খোসা অতিশয় শক্ত। আকারে বেশ লম্বা। পাঁচ থেকে সাত ফুট পর্যন্ত।

চাঁদে যখন চন্দ্রমানবের ঘাটতি পড়ে, তখনই মনুষ্যফল পাড়া হয়। ফল বিশাল কড়াইয়ে সেদ্ধ করা হয়। দশ ঘণ্টা দশ সেকেন্ড পর ফলের মুখ খুলে যায়। আর অমনি ফটাফট দুজন চন্দ্রমানব সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ে মাটিতে। প্রতিটি ফলে দুজন করে চন্দ্রমানব থাকে।

বিশাল কড়াইটি যিনি জ্বাল দেন, অর্থাৎ মনুষ্যফল রন্ধনশালার যিনি পাচক, তিনিও চন্দ্রমানব। তার কাছ থেকে রোমাঞ্চকর এক তথ্য জানা গেল। মনুষ্যফলের জঠরে থাকতেই চন্দ্রমানবদের নিজ নিজ পেশা নির্দিষ্ট হয়ে যায়, অর্থাৎ তারা সব ফলের ভেতর থেকেই তৈরি হয়ে আসে। ফল থেকে বেরিয়ে তারা আপন আপন কাজে চলে যায়। তবে দুজন দুদিকে।

পাচক মহোদয় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পুরো ব্যাপারটি দেখালেন। কড়াইয়ে তখন পাঁচটি ফল সেদ্ধ হচ্ছিল। দশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। আর মাত্র দশ সেকেন্ড বাকি। আমরা সবিস্ময় দেখলাম, একেকটি ফল থেকে যথাক্রমে যাজক ও প্রতারক, উকিল ও বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক ও ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও তস্কর, সাহিত্যিক ও বিদুষক বেরিয়ে এল এবং আপন আপন কাজে চলে গেল। পাচক মহোদয় জানালেন, এগুলো সবই ছিল সুপক্ব ও পরিপক্ক ফল। এসব ফল থেকে কেবল পেশাজীবীগণ আবির্ভূত হন। অন্যদিকে অপক্ব ও অর্ধপক্ব ফল থেকে নির্গত হয় সৈনিকেরা।

চন্দ্রমানবেরা বৃদ্ধ হলে দেহত্যাগ করে না। তারা ধোঁয়া হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। এটাই হলো তাদের মৃত্যু। পৃথিবীর মানুষদের মতো তাদের মস্তক আছে, কিন্তু তা কাঁধের ওপরে নেই। বস্তুত মস্তকের জন্য জায়গাও নেই কাঁধে, সে জন্য মস্তকটি তারা ডান হাতে ধরে রাখে অর্থাৎ তাদের মস্তক দেহ থেকে বিযুক্ত। তারা যখন যুদ্ধ করতে যায়, তখন মস্তকটি তারা বাড়িতে রেখে যায়।

চন্দ্রমানবদের কাছে মাথা বাড়িতে রেখে যাওয়া অতি সাধারণ নৈমিত্তিক ঘটনা। এর উল্টোটাও আবার ঘটে। অনেকে আবার দেহটি বাড়িতে রেখে মস্তক পাঠিয়ে দেয় নানান কাজে। মস্তক প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে নানা দিকের খবরাখবর নিয়ে পুনরায় দেহের নিকট ফিরে আসে। চন্দ্রমানবেরা এতে কোনো অসুবিধা বোধ করে না। মস্তকের স্বতশ্চল গতির জন্য তারা অত্যন্ত আনন্দিত।

এই ফাঁকে আপনাদের একটা কথা বলি। আমার চন্দ্রাভিযানের কথা আরও অনেকে জানে। আমার দুঃখ, অনেকেই আমাকে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে নাজেহাল করার চেষ্টা করেছে। তাদের দাবি, আমার জাহাজের যে ত্রিশজন নাবিক, তারাও তো চাঁদের দেশে আমার সঙ্গেই ছিল, তারা সব গেল কোথায়? তারা সাক্ষ্য দিলে তবেই নাকি প্রশ্নকর্তারা আমার চন্দ্রাভিযানের কথা বিশ্বাস করবে। তাদের আমি কোথায় পাব? এক বিশাল তিমির পেটে তারা যে সবাই হজম হয়ে গেল, এই কথা কেউই বিশ্বাস করতে চায় না। আমি এই সব অবিশ্বাসীদের নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাতে রাজি নই। আমার বিশ্বাস, আপনারা যদি সেই ভয়ংকর তিমির কথা শোনেন, আপনারা অবশ্যই তখন আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন। মোটকথা, আমার চন্দ্রভ্রমণের কথা বিশ্বাস না হলে চাঁদে গিয়ে দেখে আসতে পারেন। কিন্তু তা কি আদৌ পারবেন?

চন্দ্রমানবদের দর্শনেন্দ্রিয় সম্পর্কে কিছু তথ্য আপনাদের জানা উচিত। তাদের দুটি চোখ। মানুষের চোখের অবস্থানের মতোই মস্তকে তাদের দুই চোখের অবস্থান। কিন্তু মজার ব্যাপার, মাথা থেকে দুই চোখই খুলে নেওয়া যায়। অনেককেই দেখা যায়, মাথা থেকে খোলা একটি চোখ তারা হাতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই চোখে কিন্তু দেখা যায়। এই চোখ দিয়ে তারা সাধারণত পেছন দিকের দৃশ্য, ঘটনা ইত্যাদি দর্শন করে। অনেককে আবার নিজের চোখ নিয়ে লোফালুফি করতেও দেখা গেছে।

কোনো দুর্ঘটনা অথবা অন্য কোনো কারণে যদি কোনো চোখ হারিয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়, তখন হৃতচোখ চন্দ্রমানব অন্যের কাছ থেকে চোখ ধার নিতে পারে অথবা বাজার থেকেও মাপসই একটি চোখ কিনে নিতে পারে। চাঁদে চোখের আলাদা বাজার আছে। চোখের বাজার সব সময়ই জমজমাট। চাঁদের সবচেয়ে বড় এবং লাভজনক ব্যবসা হলো চোখের ব্যবসা। চোখ পাইকারি ও খুচরা উভয় দরেই কিনতে পাওয়া যায়। খুচরা বাজারে দামাদামিটা একটু বেশি। আমি চাঁদে গিয়ে নিজের চোখে যা দেখেছি, প্রায় সবই আপনাদের বললাম এতক্ষণ। চাঁদে আমি তেত্রিশ দিন ছিলাম। বড় রকমের কোনো ঝামেলা আমার হয়নি।’

রুডলফ এরিখ রাসপে (মার্চ ১৭৩৬—নভেম্বর ১৭৯৪) জন্মগ্রহণ করেন জার্মানির হ্যানোভার শহরে। গ্রন্থাগারিক, লেখক ও বিজ্ঞানী—অনেকগুলো পরিচয় ছিল তাঁর। তবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর বিখ্যাত দ্য সারপ্রাইজিং অ্যাডভেঞ্চারস অব ব্যারন মুনশাউজেন বইটির জন্য।