শব্দসমুদ্র ১

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

শিক্ষাসফরে গিয়ে কুয়াকাটা সৈকতে অনেকক্ষণ বসে ছিল সমুদ্র। হ্যাঁ, ওর নাম সমুদ্রই। বন্ধুদের সঙ্গে এসেছে সাগরতীরে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখতে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে কিন্তু সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। বন্ধুরা দৌড়েছে, সাগরের পানিতে পা ভিজিয়েছে, হইহুল্লোড় করেছে। সমুদ্র এক্কেবারে চুপ! বালুর ওপর বসে সাগরের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবছিল সে। এর আগে বাসায় কেনা বিশাল আকারের মানচিত্রের দিকে চেয়ে চেয়ে ‘প্রশান্ত মহাসাগর’, ‘ভারত মহাসাগর’, ‘আটলান্টিক মহাসাগর’, ‘বঙ্গোপসাগর’ শব্দগুলো সে দেখেছে। আজ বঙ্গোপসাগর তার হাতের নাগালে! হঠাৎ অস্ফুটভাবে সে বলে ফেলে, ‘আমিও তো সাগর, সমুদ্রই তো সাগর!’ আগে যে কেউ ওর নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে এ কথাই বলত সে। আজ হঠাৎ কেন যেন তার মনে হচ্ছে, সাগর মানে ‘সমুদ্র’ বললেই সব হচ্ছে না। আরও কিছু আছে। এই যে বিশালত্ব, এই যে পাহাড়সমান ঢেউ, এই যে গর্জন—অন্য কিছু আছে!

এ সময় হঠাৎ সমুদ্র লক্ষ করে, রতন স্যারের নেতৃত্বে সাগরের তীর থেকে বন্ধুরা অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা তাদের গাড়ির দিকে ছুটছে। একটু পিছিয়ে পড়ে সে। হঠাৎ সে অনুভব করে, কোনো একজন তার হাত ধরেছেন এবং গাড়ির দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। সমুদ্র নিমেষেই বুঝতে পারে, তিনি একজন বিদেশি পর্যটক। স্নেহবশত এই বালকের হাতে হাত রেখেছেন। হয়তো তিনি আগে থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন, একটি বালক একাকী সমুদ্রতটে বসে ছিল, বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড় করেনি। ভেবেছেন, বালকটিকে সাহায্য করা দরকার। এরই মধ্যে আবার দেখলেন, বালকটি উঠে চলে যাচ্ছে। তাই হয়তো এগিয়ে আসা।

হাত ছেড়ে বিদেশি পর্যটক সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়াট অয়্যার ইউ থিংকিং?’

সমুদ্র ছোটবেলা থেকেই বাংলা ভাষা ব্যবহারে সচেতন। ইংরেজিটাও বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করছে ধীরে ধীরে। তাই বিদেশির এই প্রশ্নে সে মোটেও ঘাবড়ে না গিয়ে উত্তর দেয়—

‘অ্যাবাউট আ ওয়ার্ড—সাগর।’

আর বেশি কথা বলেন না সেই বিদেশি পর্যটক। নিজের ছোট্ট বিদেশি ব্যাগ থেকে একটি হাতে লেখা চিরকুট তুলে দেন তিনি সমুদ্রের হাতে। বলেন—

‘টেক দিজ ম্যাজিক লাইন অ্যান্ড রিড। ইউ উইল ফাইন্ড আ ওয়ে।’

চিরকুটটি খুলে সমুদ্র দেখে আঁকাবাঁকা ঢেউয়ের মতো কী যেন হাতে লেখা—এক লাইনে। সেই ঢেউয়ের ওপরে আবার চারটি বিন্দু দেওয়া। সহজে পড়া গেল না। কিন্তু পড়ার চেষ্টা করে চোখ তুলে সমুদ্র দেখে, সেই বিদেশি পর্যটক হাওয়া! বিশাল সাগরতীরে এত মানুষের ভিড়ে তাঁকে আর খুঁজে পায়নি সে। কোথায় মেলালেন সেই পর্যটক?

রাতের খাবার সেরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুমাতে গিয়েও ‘সাগর’ নিয়ে ভাবনাটি তার পিছু ছাড়ে না। সাগর যে শুধু সমুদ্র নয়, আরও কিছু—এটি তাকে পেয়ে বসে। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার জন্য শুয়ে শুয়ে চিরকুটটি খুলে নেয় সমুদ্র। এবার হ্যাঁ; সেই এক লাইনের হাতের লেখা—যাকে ম্যাজিক লাইন বলেছিলেন লোকটি—সেটি অন্তত পড়তে পারে সে; কিন্তু কিচ্ছু বোঝে না। সমুদ্র দেখে সেখানে লেখা ‘ম্যাজিক লাইন’ হলো: inim-inim-ma। হাতে লেখা বলে প্রথমে সে ঠিকঠাক পড়তে পারছিল না। এবার সে দুবার পাঠ করে: ‘ইনিম-ইনিম-মা’, ‘ইনিম-ইনিম-মা’। এরপরই বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে সমুদ্র। পাশের বিছানায় শুয়ে পড়া শিশিরকে প্রায় চিত্কার দিয়ে ডেকে তুলে বলে, ‘এই শিশির, শোন—।’

অনেকক্ষণ ধরে প্রিয় বন্ধু শিশির সমুদ্রের হাবভাব পর্যবেক্ষণ করছিল। সে ভেবেছিল, আজ রাত যাক। কাল সকাল থেকে সমুদ্রের সেই থ ধরা ভাব সে ছোটাবে! ওমা, সমুদ্রের পানি যে বরফ হয়ে ছিল, এরই মধ্যে তা আবার গলতে শুরু করল? শিশির খানিকটা ভাব নিয়ে বলল, ‘কী হলো?’

সমুদ্র বলল, ‘আমাকে জিজ্ঞেস কর, সাগর মানে কী?’

শিশির বলে, ‘এ আবার জিজ্ঞেস করার কী? তুই তো অনেকবারই বলেছিস, সমুদ্র মানে সাগর আর সাগর মানে সমুদ্র। আর এ কথা কে না জানে?’

সমুদ্র বলে, ‘নাহ্ রে। সাগর শুধু সরলভাবে সমুদ্র নয়। সাগর শব্দের পেছনে আছে এক বিশাল গুহ্যকথা। তাহলে শোন—।’

এই বলে সমুদ্র বলতে শুরু করে। শিশির একবার ভাবে, এত রাতে তাকে থামিয়ে দেবে। আবার ভাবে, যাক, থ ভেঙে সে যখন মুখর হয়েছে, চলুক না। সমুদ্র বলতে শুরু করে, মুখে যেন খই ফুটছে।

‘শোন শিশির, “সাগর” শব্দটি এসেছে পৌরাণিক “সগর” রাজার নামানুসারে। এমনি এমনি বিপুল জলরাশিকে সাগর বলা হয় না।’

খানিকটা অবাক হয় শিশির! বলে, ‘তাই নাকি?’ জানতে চায় বন্ধু সমুদ্রের অব্যক্ত কথার ঊর্মি। শিশিরের আগ্রহ আছে বুঝে বলতে থাকে সমুদ্র।

‘পৌরাণিক ইতিহাসের ধারায় সূর্যবংশ ও চন্দ্রবংশ—এই দুই বংশের শাসনকার্য পাওয়া যায়। সূর্যবংশীয় রাজা বাহু শত্রুর আক্রমণে পরাজিত হয়ে হিমালয় অঞ্চলে আশ্রয় নেন। সেখানে বাহুর পত্নী গুর্বিণী এক পুত্রের জন্ম দেন। তাঁর নাম সগর। গর অর্থ বিষ। গুর্বিণীকে এক নারী গোপনে বিষ খাইয়েছিল, যাতে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়। পুণ্যবতী থাকায় সেই বিষ তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। বরং সেই বিষসহ পুত্রের জন্ম দেন গুর্বিণী। বিষ বা গরসহ জন্ম বলে পুত্রের নাম রাখা হয় “সগর”। এই সগর বড় হয়ে পিতার রাজ্য পুনরুদ্ধার করে শাসন করেন। রাজা সগরের বহু পুত্র ছিল। পুরাণে আছে, ষাট সহস্রের বেশি পুত্রের জনক ছিলেন তিনি। সগর রাজা শততম অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে সেই ঘোড়াকে পাতালে কপিল মুনির আশ্রমে লুকিয়ে রাখা হয়। অপহৃত ঘোড়ার খোঁজে সগর রাজার পুত্রেরা মাটির ওপরে তো তন্নতন্ন করেই, মাটির নিচেও চোখ দেয়। তাই সবাই এক যোজন দীর্ঘ ও এক যোজন প্রস্থ ভূমিতল খনন করে। সৃষ্টি হওয়া এই বিশাল খাত জলপূর্ণ হলে সগর রাজার নামানুসারে তাকে “সাগর” বলে অভিহিত করা হয়। সেই থেকে সুবিপুল জলরাশিকে বলা হয় সাগর—বুঝলি?’

সমুদ্রের কাছে এই মধ্যরাতে ‘সাগর’ শব্দের উত্পত্তি শুনে শিশির তো হতবাক! কী করে পারল সে, এই প্রশ্নই শিশিরের মাথায়। সমুদ্রকে বোকা বানানোর জন্য এবার পাল্টা প্রশ্ন করে শিশির—

‘বুঝলাম, সগর রাজা থেকে সাগর নাম হয়েছে। কিন্তু তোর নাম সমুদ্র—সমুদ্র কি তবে সমুনদর রাজার থেকে হলো? এখানে কি তোর কোনো পুরাণ কাহিনি আছে?’

সমুদ্র এবার চোখ বন্ধ করে। বিড়বিড় করে কী যেন বলে আর তারপরই শিশিরকে জানায়, ‘নাহ্ বন্ধু, এখানে কোনো পুরাণ কাহিনি নেই।’

‘তাহলে?’ হাঁক দেয় শিশির।

‘এটা শুধুই ব্যাকরণঘটিত শব্দ। চাঁদের আকর্ষণে যে জলস্থানের জলের অবস্থা ক্লিন্ন বা পরিবর্তিত হয়, সেটিকে সমুদ্র বলে। সমুদ্র শব্দের ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ হলো: সম্—উন্দ (ক্লিন্ন হওয়া)+রক্।’

কুয়াকাটায় শিক্ষাসফরে এসে পুরাণ, ব্যাকরণে সমুদ্রের এমন ব্যুত্পত্তি দেখে চমকে যায় শিশির। সে রাতে আর কোনো প্রশ্ন না করে ঘুমিয়ে পড়ে সে। সমুদ্রের চোখ তখনো পিটপিট করছিল।

চলবে...