গরুর গুগল

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

‘ঘুমাচ্ছিস?’ ফোনের ওপাশ থেকে বলল সোহেল।

চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে সময় দেখল শাহানা। রাত বাজে দেড়টা। গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে সে বলল, ‘কী চাস?’

‘শোন না দোস্ত। একটা বিপদে পড়েছি।’

‘কী বিপদ?’ শাহানা উঠে বসে।

‘ফোনে বলা যাবে না। সকালে তোর ভার্সিটিতে আসি?’

‘আয়। কিন্তু হয়েছে কী? তোর বাসার সবাই ভালো আছে তো?’

‘আরে বাসার সব ঠিক আছে। একটা কেস নিয়ে ঝামেলা।’

এবার আর বিরক্তি চেপে রাখা গেল না। ‘এ জন্য এত রাতে ফোন করেছিস? সকালে…’ শাহানা কথা শেষ করতে পারে না। সোহেল লাইন কেটে দেয়।

বাকি রাতটা শাহানার আর ঘুম আসে না। মনে মনে সোহেলকে ‍তুলাধোনা করতে করতেই ভোর হয়ে যায়।

শাহানা ঠিক করে রেখেছিল, সকালে সোহেল এলেই ওকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। নো হ্যালো, নো থ্যাংক ইউ। অনলি গেটআউট! কিন্তু বেচারার চেহারা দেখেই কেন যেন মায়া লাগল। চুল আউলা–ঝাউলা। চোখের নিচেও কালি পড়ে গেছে।

স্কুল, কলেজ, এমনকি ইউনিভার্সিটিতেও ওরা দুজন একসঙ্গেই পড়েছে। বাচ্চাকালের বন্ধু যাকে বলে। কিন্তু ইদানীং খুব একটা দেখাসাক্ষাৎ হয় না। অস্ট্রেলিয়া থেকে মাস্টার্স করে এসে শাহানা একটা ইউনিভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে। সপ্তাহে দুটি ক্লাস নেয়। বাকি সময়টা সে গবেষণা করেই কাটায়।

ওদিকে সোহেল ঢুকে পড়েছে পুলিশে। ছোটবেলা থেকেই সে বলত, বড় হয়ে পুলিশ হবে। কিন্তু সোহেল যে সত্যিই ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস, শাহানা কখনো ধরতে পারেনি।

‘তারপর? তোর গরুর গুগল কেমন চলছে?’ বলতে বলতে ল্যাবে পা রাখে সোহেল।

‘মানে?’ শাহানা ভ্রু কোঁচকায়।

‘গবেষণাই তো করিস, নাকি? গবেষণার সন্ধিবিচ্ছেদ করলে কী হয়? গো+এষণা। গো মানে গরু, এষণা মানে খোঁজা। গরুর গুগলই তো হলো!’ সোহেল এমনভাবে হাসে, যেন বিরাট একটা আবিষ্কার করে ফেলেছে। ‘বাইকে আসতে আসতে টার্মটা দাঁড় করালাম। ভালো হয়েছে না বল? হে হে!’

‘এই সব ফালতু টার্ম আবিষ্কার করার জন্য পুলিশে তোকে বেতন দেয়?’

সোহেল কিছু বলে না। হাসে।

‘তোর পোস্টিং কেরানীগঞ্জে ছিল না? ওখান থেকে তোকে ভাগিয়ে দিয়েছে শুনলাম। ইকবাল বলছিল…’

‘আর বলিস না। জয়েনিংয়ের এক মাসের মধ্যে এলাকার সব বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীকে সাইজ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু ওপর থেকে কলকাঠি নাড়িয়ে ওরাই আমাকে সাইজ করে দিল। এখন আমার কাজ রেকর্ড রুমে। আপাতত এখানেই কয়েক মাস আছি।’

‘আহারে…’

‘আহারে না। বল আহা কী আনন্দ! এখানে এসে আমি তো রীতিমতো গুপ্তধন পেয়ে গেছি।’

‘কী! কী রকম?’ শাহানা অবাক।

‘কত যে পুরোনো ফাইল! কত আনসলভ কেস! রোমহর্ষক একেকটা কাহিনি। প্রতিদিন অফিসে গিয়েই আমি ফাইলের পাহাড়ের মধ্যে ঝাঁপ দিই। রাত গভীর হয়ে গেলেও খেয়াল থাকে না…’

‘আর সে জন্য রাতবিরাতে ফোন করে ফোন করে মানুষের কাঁচা ঘুম ভাঙাস।’

‘শোন না। ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে দুর্দান্ত একটা কেস পেয়েছি। পুরো ঘটনা শুনলে তোর আজকে রাতেও ঘুম হবে না…’

‘কোনো দরকার নাই। তোর এসব ফালতু কাহিনি নিয়ে তুই থাক। আমার অনেক কাজ আছে। এখন বিদায় হ…’

‘শোন না! জাস্ট ১০ মিনিট সময় নেব। পাক্কা।’

পাক্কা ২৫ মিনিট সময় নিয়ে হাত নেড়ে, চোখ বড় বড় করে সোহেল যা বলল, শুনে শাহানার ঘুম এসে যাচ্ছিল।

হাই তুলতে তুলতে সে বলল, ‘ব্যস। এই তোর কাহিনি?’

‘ইয়েস! ইন্টারেস্টিং না?’

‘না।’

‘কেন?’

‘প্রথমত দুই মিনিটের একটা ঘটনাকে তুই টেনে আধঘণ্টা লম্বা করেছিস।’

‘কী? মোটেই না।’

‘অবশ্যই হ্যাঁ। খুব জটিল কেস, তা তো না। শাজাহান আলী নামে এক বুড়ো। পুরান ঢাকায় বিরাট বাড়ি আছে। ছেলেমেয়ে সবাই বিদেশে থাকে। অতএব খালি বাড়িতে সে ছয়জন লোককে সাবলেট হিসেবে থাকতে দিয়েছিল। এদের মধ্য থেকে একজন তাকে খুন করে জমির দলিলটলিল সব হাতিয়ে নিতে চেয়েছিল। পারেনি। এই তো?’

কয়েক সেকেন্ড বোকার মতো তাকিয়ে রইল সোহেল। ‘তা ঠিক। ডিটেইলগুলো বাদ দিলে ঘটনাটা মোটামুটি এ রকমই। কিন্তু আসল কথাটাই কিন্তু তোকে বলা হয়নি।’ সোহেল রহস্যময় হাসি হাসে।

‘একটু সংক্ষেপে বল প্লিজ। আমার অনেক কাজ। তার ওপর তোর যন্ত্রণায় গত রাতে ঘুমাতে পারিনি। কাজ শেষ করে জলদি বাসায় যাব।’

‘খুনি শাজাহান সাহেবের মাথায় বাড়ি মেরেছিল, সেটা তো তোকে বলেছি।’

‘হুঁ’।

‘ভিকটিমের বডির পাশেই একটা ডায়েরি পাওয়া গিয়েছিল। হাতে কলম। ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের ধারণা, মাথায় বাড়ি খেয়ে শুরুতে জ্ঞান হারালেও কিছুক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরেছিল। খুনিকে তিনি দেখেছেন। এমনকি মৃত্যুর আগমুহূর্তে ডায়েরিতে তার নামও লিখে রাখার চেষ্টা করেছিলেন।’

‘তো? খুনির নাম পাওয়া গেছে?’ এবার শাহানা একটু আগ্রহী হয়।

‘না। কারণ, ডায়েরির ঠিক ওই পাতাটাই কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে।’

‘কে ছিঁড়ল?’

‘তা জানি না।’

‘উফ্‌! প্যাঁচাচ্ছিস কেন? পয়েন্টে আয়। তুই আমার কাছে কেন এসেছিস? কী চাস?’

চট করে আশপাশে একবার তাকায় সোহেল। কাঁধের ছোট্ট ব্যাগটা খুলে একটা ডায়েরি বের করে টেবিলের ওপর রাখে। বলে, ‘এই সেই ডায়েরি!’

ডায়েরির পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখে শাহানা। ‘ভাড়ার হিসাব, নাতি-নাতনিদের জন্মতারিখ, কিছু ফোন নম্বর, এই তো।’

‘ইন্টারেস্টিং কিছু দেখছিস না?’

শাহানা আরেকবার উল্টেপাল্টে দেখে। ‘না। জাস্ট…একটা পাতা ছেঁড়া।’

‘কারেক্ট। যে পাতাটা ছেঁড়া, সেখানেই কিছু লেখা হয়েছিল। তাই তো? সেই পাতাটা নেই। কিন্তু পরের পাতাটা তো আছে!’

শাহানা ভ্রু কোঁচকায়। ‘হুম। তো?’

‘আরে গাধা! এই বুদ্ধি নিয়ে তুই গরু খুঁজিস কীভাবে! মনে আছে, ছোটবেলায় আমরা একটা খেলা খেলতাম? খাতার পাতায় একজন কিছু একটা লিখতাম। তারপর…’

‘তারপর পরের পৃষ্ঠায় সেই লেখার ছাপ থেকে আরেকজন লেখাটা উদ্ধার করার চেষ্টা করতাম!’ শাহানা সোহেলের মুখের কথা কেড়ে নেয়।

‘রাইট! এই খেলায় আমি সব সময় হারতাম। কিন্তু তুই ছিলি বস।’

‘এ জন্য তুই আমার কাছে এসেছিস!’

সোহেল হাসে।

‘পারিসও!’ ছেলেবেলার কথা মনে করে শাহানাও হেসে ফেলে।

একটা পেনসিল হাতে নেয় সে। যে পাতাটা ছেঁড়া, তার পরের পাতায় পেনসিলটা কাত করে ধরে খুব আলতো করে দাগ দিতে শুরু করে। দাগ দিতে দিতেই বলে, ‘এত লোক থাকতে তুই আমার কাছে আসলি কেন? তোদেরই তো কী সব ফরেনসিক–টরেনসিক আছে না?’

‘মাথা খারাপ! এই কেস নিয়ে এমনিতেই কাজ করছি আনঅফিশিয়ালি। রেকর্ডরুম থেকে পুরোনো ফাইলপত্র বের করেছি, ডায়েরি ‍চুরি করেছি, জানলে আমার খবর আছে।’

‘কিসের মধ্যে যে আমাকে ফাঁসাচ্ছিস, আল্লাহ জানে!’ কাজ করতে করতেই শাহানা বলে।

‘জানিস, এই কেসের যে ৬ সাসপেক্ট, মানে শাজাহান সাহেবের ৬ ভাড়াটিয়া—শংকর, টিপু, তোফায়েল, মজনু, হিমেল আর জয়নাল; তাদের মধ্যে তিনজন এখনো জেলে। বাকিরা পলাতক। ভেবে দেখ, দোষ করেছে একজন, কিন্তু শাস্তি পাচ্ছে ছয়জন। তা-ও আট বছর ধরে। কেসটার একটা মীমাংসা হলে খুনির সাজা হোক বা না হোক, অন্তত নিরপরাধ মানুষগুলো মুক্তি পেত।’

শাহানা হাসল। মনে মনে ভাবল, সোহেলটা বদলায়নি। যতই পুলিশে চাকরি করুক, ওর মনটা খুব নরম। ছোটবেলা থেকেই।

শাহানার কাজ মোটামুটি শেষ। ড্রয়ার থেকে একটা ম্যাগনিফায়িং গ্লাস বের করে নেয় সে। এরপর দুই বন্ধু মিলে কাগজটা ভালো করে দেখে।

হ্যাঁ! লেখাটা একটু একটু বোঝা যায়! শাহানা একটা কাগজ টেনে নিয়ে লেখে:

| | | | | | |

‘ব্যস, এই?’ সোহেল অবাক।

‘হুম। আর কিছু তো দেখছি না।’ শাহানাও চিন্তায় পড়ে যায়।

প্রায় এক মিনিটের নীরবতা। বিরক্ত হয়ে সোহেল বলে, ‘ধ্যাৎ। শুধু শুধুই এত কষ্ট করলাম।’

‘আহা। মন খারাপ করছিস কেন? একটা কিছু তো পাওয়া গেল।’

‘একটা কিছুর যদি কোনো মানে না থাকে, পেয়ে কী লাভ?’

‘কোনোই মানে নেই?’ শাহানা কাগজটা ভালো করে দেখে, ‘কোনো কিছুর নম্বর না তো? ওয়ান ওয়ান ওয়ান ওয়ান ওয়ান ওয়ান ওয়ান।’

‘মৃত্যুর আগে একটা লোক কেন ওয়ান ওয়ান লিখতে যাবে?’

‘কোনো তারিখ, পাসওয়ার্ড, বাসার ঠিকানা…হয়তো কোনো দামি জিনিসের খোঁজ…’

‘নাহ। মনে হয় না। কেস রিপোর্ট বলছে, শাজাহান সাহেবের বাড়ির দলিলসহ সব মূল্যবান জিনিস আলমারির মধ্যে ছিল। খুনি তাড়াহুড়ার মধ্যে আলমারির চাবি খুঁজে পায়নি। পরে পুলিশ গিয়ে অবশ্য খুঁজে পেয়েছে।’

দুই বন্ধু আরও কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে থাকে। একসময় মন খারাপ করে উঠে পড়ে সোহেল।

‘ডায়েরিটা নিয়ে যা…’ শাহানা ডাকে।

‘নাহ। এমনিতেই তো ডায়েরির মধ্যে দাগাদাগি করে ফেলেছি। এভিডেন্স টেম্পারিংয়ের দায় নেওয়ার চেয়ে হারানোর দায় নেওয়া ভালো।’

৫.

‘ঘুমাচ্ছিস?’ ফোনের ওপাশ থেকে উত্তেজিত গলায় বলল শাহানা।

চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে সময় দেখে সোহেল। রাত বাজে দুইটা। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলে, ‘তুই কি শোধ নেওয়ার জন্য ফোন করেছিস? উফ্‌…কাঁচা ঘুমটা ভাঙলি।’

‘আমি তোর মতো গাধা না। শোন! শুয়ে শুয়ে ঘুম আসছিল না। তোর কেসের ডায়েরিটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা জিনিস মাথায় এল।’

‘কী?’

‘কয়েকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। প্রথমত, ডায়েরির অন্য সব লেখাই ইংরেজিতে। ক্যাপিটাল লেটারে। আর দ্বিতীয়ত…’

‘দ্বিতীয়ত কী?’

‘বাকি লেখাগুলো দেখে মনে হলো, শাজাহান সাহেবের একটা অভ্যাস ছিল। তিনি ভার্টিকেল স্ট্রেট লাইনগুলোর ওপর একটু জোর দিতেন।’

‘তো?’

‘মানে এমনও তো হতে পারে, পরের পৃষ্ঠার ছাপে শুধু ভার্টিকেল স্ট্রেট লাইনগুলোই ধরা পড়েছে। বাকি অংশটা আসেনি।’

‘তোর কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘আরে গাধা! ধর তিনি লিখলেন IT, অর্থাৎ ওপর থেকে নিচে আই এবং টি–এর স্ট্রেট লাইন দুটো একটু চাপ দিয়ে লেখা হলো। তাহলে পরের পৃষ্ঠায় ছাপ দেখে কী মনে হবে? স্রেফ দুটো লম্বা দাগ। ওয়ান ওয়ান।’

‘তার মানে… ধর, লিখলেন টিপু। মানে ৫টা ওয়ান?’

‘উঁহু। U–তো স্ট্রেট লাইন নয়। টিপু মানে তিনটা সোজাসুজি দাগ।’

ততক্ষণে সোহেল বিছানা থেকে উঠে বসেছে। পেনসিল দিয়ে সে লেখে, TIPU। এরপর ভার্টিকেল স্ট্রেট লাইনগুলো ছাড়া বাকি অংশগুলো পেনসিল দিয়ে মুছে ফেলে। যা দেখা যায়, তা অনেকটা এমন—।।।, দেখে মনে হয় ওয়ান ওয়ান ওয়ান। হুম। শাহানার কথাই ঠিক।

‘বুঝলাম।’ সোহেল বলে, ‘তাহলে সাতটা সোজা দাগ দিয়ে আসলে কী বোঝাচ্ছে? শাজাহান সাহেব কার নাম লিখেছিলেন?’

‘সেটাও আমি বের করে ফেলেছি বুদ্ধু!’ শাহানা হাসে।

‘সত্যি? কে?’

‘সেটা তো বলব না। রাতটা তুই ভাব। সকালে কথা হবে।’ বলেই লাইনটা কেটে দেয় শাহানা।

সোহেল পড়ে যায় মহা চিন্তায়। কার নাম লিখেছিলে মিস্টার শাজাহান?