মাকড়সা

‘মিজান ভাই, চা খাবেন?’

মিষ্টি হেসে বলল সামিয়া।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জুনিয়র অফিসার আফজাল নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। সামিয়ার সামনে বসে আছে কুখ্যাত সন্ত্রাসী নাককাটা মিজান। ২১টা খুন, ৩৭টা অপহরণ, ৪৮টা জমি দখলসহ আরও বেশ কয়েকটি মামলা আছে তার নামে। এ রকম একজন বদ লোকের সঙ্গে এত সুন্দর করে কথা বলা একমাত্র সামিয়ার পক্ষেই সম্ভব।

সামিয়া গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র অফিসার। অল্প সময়েই দ্রুত পদোন্নতি পেয়েছে। তাকে দেখে অবশ্য পুলিশ অফিসার মনে হয় না, মনে হয় সিনেমার নায়িকা। আজ সে পরেছে জিনস, টি-শার্ট, তার ওপর ডিবি পুলিশের জ্যাকেট। পনিটেইল করে বেঁধে রাখা চুল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। সামিয়ার গায়ের পারফিউমের ঘ্রাণটা ইনটেরোগেশন রুমের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না একেবারেই।

ঘরের ভেতর একটা টেবিল, দুটো চেয়ার। মাঝামাঝি ঝুলছে একটা বাল্ব। ঘরে আলো-আঁধারের খেলা। মুখোমুখি বসেছে সামিয়া আর নাককাটা মিজান। ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখা যায়। বেশির ভাগ সময় এই ঘরটা অবশ্য খালিই থাকে। আসামিদের মেঝেতে বসিয়ে ‘আপ্যায়ন’ করা হয়। আজ সামিয়ার নির্দেশে চেয়ার-টেবিল আনা হয়েছে। দেয়াল আর মেঝের এখানে-ওখানে রক্তের খয়েরি দাগ। দেখে বোঝা যায়, এই ঘরে এর আগে যারা ‘অতিথি’ হয়ে এসেছে, তাদের সময়টা ভালো কাটেনি।

মিজানের মুখে কথা নেই। সামিয়াকেই আবার মুখ খুলতে হলো। হাতের পেনসিলটা দুই আঙুলে ধরে নাড়াতে নাড়াতে সে বলল, ‘দেখুন মিজান ভাই, আমি জানি আপনি সহজে মুখ খোলার লোক নন। আমার সহকর্মীদের হাতে ব্যাপারটা ছেড়ে দিলে তারা বিশ্রীভাবে অত্যাচার করবে। আপনার নাকটা আগে থেকেই নেই। চোখ, কান, আঙুলগুলোও যদি অকেজো হয়ে যায়, তাতে কার কী লাভ হবে বলুন? এর চেয়ে বরং আমরা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে এই আলাপটা শেষ করি। আপনি আমাকে একটা নাম বলবেন। স্রেফ একটা নাম।’ একটু বিরতি নিয়ে সামিয়া ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বলুন, শিল্পপতি আহসান আহমেদকে গুম করার নির্দেশ আপনাকে কে দিয়েছিল?’

রুমের ভেতর পিনপতন নীরবতা। বর্গাকৃতি ঘরটার একটা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে জুনিয়র অফিসার আফজাল, শামীম আর মোহন। সামিয়ার পেছনে দাঁড়ানো আরেক সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা রবিউল। কারও মুখে কথা নেই।

ছোট্ট করে মুখ খুলল নাককাটা মিজান। ফিসফিস করে বলল, ‘আদা’।

দুই হাত টেবিলের ওপর রেখে একটু এগিয়ে গেল সামিয়া। ‘সরি? শুনতে পাইনি। আবার বলুন।’

‘দুধ, লেবু চলে না। আদা হইলে ঠিক আছে। লিকার হালকা। চিনি আধা চামচ।’ বলে মিজানও মিষ্টি করে হাসার চেষ্টা করল। নাক ছাড়া মানুষটার হাসি দেখাল ভয়ংকর।

ততক্ষণে রবিউল অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ‘সামিয়া, তুমি অযথা সময় নষ্ট করছ। ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। ঠিক জায়গায় বাড়ি পড়লে গড় গড় করে সব বলে দেবে,’ বলল সে। বাচ্চা মেয়েটার কাজকারবার তার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না।

সামিয়া অবশ্য তখনো মুখে হাসি ধরে রেখেছে। আফজালের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল সে। কিন্তু আফজাল বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে বলে সামিয়াকে কথাটা বলতেই হলো, ‘কই যান, চা নিয়ে আসুন।’

জুনিয়র অফিসার আফজালের কান গরম হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কিনা একটা দাগি আসামির জন্য তাকে চা আনতে হবে! গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। রাগ দেখানোর জন্য দরজাটা লাগাল দড়াম করে।

‘আপনার সঙ্গে আমি কী কী করতে পারি জানেন?’ প্রশ্নটা সামিয়ার। উত্তর দেওয়ার কোনো আগ্রহ মিজানের আছে বলে মনে হলো না। অতএব সামিয়াই বলল, ‘আপনার নখগুলো উপড়ে ফেলতে পারি, কানের ভেতর গরম তেল ঢেলে দিতে পারি...’

ফিচিক করে হাসল মিজান। যেন খুব মজার একটা কৌতুক শুনেছে।

আরও পড়ুন

সামিয়ার কথা তখনো শেষ হয়নি। হাতের পেনসিলটা টেবিলের ওপর রেখে সে বলল, ‘কিন্তু আমি এসবের কোনোটাই করব না। স্রেফ আপনাকে একটা ছোট্ট ঘরে আটকে রাখব। যে ঘরের জানালা নেই, বাতাস ঢোকার মতো তেমন কোনো জায়গা নেই। বদ্ধ। গুমোট...’

এবার মিজানের চেহারায় খানিকটা পরিবর্তন দেখা গেল। স্থির দৃষ্টিতে সামিয়ার চোখের দিকে তাকাল সে।

‘ভয় নেই মিজান ভাই, আপনাকে একা রাখব না। একটা ছোট্ট, বদ্ধ ঘরে...আপনাকে সঙ্গ দেবে কতগুলো মাকড়সা। কিলবিলে মাকড়সা। বড় বড় লোমশ পা, কুতকুতে চোখ, কালো রং...’

এই প্রথম নাককাটা মিজানের চোখে ভয় দেখা গেল।

আফজাল ততক্ষণে চা নিয়ে ফিরে এসেছে। টেবিলের ওপর ঠকাস করে চায়ের কাপ রাখল সে।

মিজানের ভয়টা খানিকক্ষণ উপভোগ করে সামিয়া মুখ খুলল আবার, ‘মিজান ভাই, আপনি যা ভাবছেন সেটা ঠিক। হোমওয়ার্ক না করে আমি আপনার সামনে বসিনি। আপনার মা, ছোট বোন, ছোটবেলার বন্ধু...সবার সঙ্গে কথা বলেছি। আমি জানি, আপনার সাফোকেশনের সমস্যা আছে। বদ্ধ ঘরে থাকলে আপনার শ্বাসকষ্ট হয়। আমি জানি, আপনি মাকড়সা ভয় পান। আমি এ-ও জানি, বড় বড় নেতা, এমনকি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বড় কর্তাদের সঙ্গেও আপনার খুব ভালো সখ্য। শিল্পপতি আহসান আহমেদকে গুম করার নির্দেশ সম্ভবত এদের মধ্য থেকেই কেউ দিয়েছে। অতএব আপনাকে বাঁচাতে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করবে। রিমান্ডে নিয়ে আমি আপনাকে খুব বেশি কিছু করতে পারব না। কিন্তু আপনার বদ্ধ সেলে কয়েকটা মাকড়সা ছেড়ে দেওয়ার কাজটা খুব সহজ। সে জন্য আমাকে কাগজে-কলমে কারও অনুমতি নিতে হবে না।’

আরও পড়ুন

মিজানকে দেখে মনে হলো সে এখনি সামিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু না। খুব ধীরে হাত বাড়াল সে। টেবিলের ওপর থেকে পেনসিলটা নিল। বিপদ টের পেয়ে আফজাল হোলস্টারে হাত দিচ্ছিল পিস্তল বের করবে বলে, সামিয়া ইশারায় মানা করল।

কাঁপা কাঁপা হাতে টেবিলের ওপর পেনসিল দিয়ে কী যেন আঁকল মিজান। আঁকা শেষ হওয়ার পর পেনসিলটা চায়ে ডোবাল। তারপর পেনসিলের গায়ে লেগে থাকা চাটুকু বিশ্রীভাবে চেটে খেল।

‘নাহ্, আপনাগো চা মিষ্টি বেশি।’ বলে চোখ টিপল মিজান। স্থির দৃষ্টিতে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার নাক আছে, আমার নাক নাই। আমার চোখ আছে, আপনার চোখ নাই। মাকড়সার চোখ কয়টা জানেন? আটটা। আপনে যদি মানুষ না হইয়া মাকড়সা হইতেন, তাইলে কিন্তু আপনার প্রশ্নের উত্তর আপনি নিজেই পাইতেন। হা হা হা হা!’

মিজানকে সেলে নিয়ে যাওয়া হলো।

সামিয়া অবাক হয়ে দেখল, টেবিলের ওপর একটা অদ্ভুত নকশা এঁকে রেখে গেছে নাককাটা লোকটা। কী বোঝাতে চাইছে সে? কারও নাম? কারও ঠিকানা? নাকি স্রেফ হেঁয়ালি?

উত্তর

মিজান আসলে ঘরের ভেতরের মানুষগুলোর ছবি এঁকেছে। সামিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে রবিউল। তার উপর ক্রস চিহ্ন দেওয়া। সে-ই গুম করার নির্দেশ দিয়েছিল।