সায়েন্স ফিকশন ‘ভক্ষক’

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

‘কফি চলবে মি. ড্যারেন?’ মৃদু হাসলেন ড. ফেলিক্স।

‘না, প্রফেসর। আমি কফি খাই না,’ মাথা নাড়লেন ড্যারেন।

বেশ অভিজ্ঞ লোক ড. রিচার্ড ফেলিক্স। আমেরিকার সেরা মহাকাশবিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বয়স ষাটের কাছাকাছি, ভদ্রলোক এখনো অবিবাহিত। ওদিকে ড্যারেন বেশ তরুণ, বয়স মেরেকেটে আটাশ হবে।

‘বুঝলে ড্যারেন, মার্কিন সরকার জানতে চায় মহাবিশ্বের কোন কোনায় কী আছে…কোনো সম্ভাবনাকেই কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এই যেমন ধরো, মঙ্গলে বসতি স্থাপন নিয়ে আমরা কত কাজ করছি। যা-ই হোক, আশা করি তোমার সঙ্গে বেশ জমবে আমার,’ ড্যারেনের চোখে চোখ রেখে বললেন ড. ফেলিক্স।

‘অবশ্যই প্রফেসর, আপনার সঙ্গে কাজ করতে পারাটা খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার।’

‘সৌভাগ্যের কী আছে? হাজারখানেক আবেদন এসেছিল এই প্রজেক্টে কাজ করার জন্য। তার মধ্য থেকে তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। নিজেকে প্রমাণ করেই তো এসেছ, তা-ই না?”

‘তারপরও…’

‘আচ্ছা, মঙ্গলের দুটি চাঁদ নিয়ে তোমার কী মতামত?’ ড্যারেনকে কথা শেষ করতে দিলেন না ফেলিক্স।

‘ফোবস আর ডেইমস? চাঁদ হিসেবে ওগুলো খুবই ছোট…আমাদের চাঁদের তুলনায় একেবারেই পুঁচকে। দেখতেও কিছুটা গ্রহাণুর মতো।’

‘হুম? ওরা এল কোথা থেকে? কী মনে হয়?’

‘প্রফেসর…এই নিয়ে বেশ কতগুলো তত্ত্ব রয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত মত অনুযায়ী, ওরা এককালে মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝের “গ্রহাণু বেল্ট”-এর মধ্যে ছিল। পরে বৃহস্পতির প্রভাবে মঙ্গলের দিকে সরে আসে, তারপর ওটাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে।’

‘ওদের ভবিষ্যৎ?’

‘ফোবস মঙ্গলের বেশি কাছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছর এই চাঁদ দুই মিটার করে এগিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে আর প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর পর হয় ওটা টুকরো টুকরো হয়ে একটা বলয় সৃষ্টি করবে...অথবা মঙ্গলের বুকে আছড়ে পড়বে! ওদিকে ডেইমস ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। একটা সময়ে ওটা মঙ্গল গ্রহের আওতার বাইরে চলে যাবে। তাই ভবিষ্যতে মঙ্গলের আর কোনো চাঁদ থাকবে না। অদ্ভুত লাগে জানেন, প্রফেসর...’

‘কী কারণে?’

‘এইচ পি লাভক্র্যাফট, ওনার কতগুলো ছোটগল্পে বলেছিলেন, “মঙ্গল হবে চন্দ্রহীন।” আসলেই ব্যাপারটা সেদিকে যাচ্ছে...’

‘উফ্‌! কল্পবিজ্ঞান! তা-ও আবার সেই গাঁজাখুরি লেখকের যে মহাবিশ্বের কোণে কোণে অদ্ভুত সব মহাজাগতিক সত্তাদের ব্যাপার কল্পনা করত! তুমি এত মেধাবী একজন ছেলে...এসব গল্প কেন পড়ো? কল্পবিজ্ঞান আর বিজ্ঞান এক নয়। একবার ভেবে দেখো, পৃথিবীতে একটি গ্রহাণু আছড়ে পড়ার কারণে ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ফোবসেরও মঙ্গলের বুকে আছড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে...তত দিনে যদি মানুষ মঙ্গলে বসতি স্থাপন করে ফেলে, তাহলে? ফোবসের আঘাতে তো সব শেষ হয়ে যাবে...আমাদের ভাবা উচিত এই ব্যাপার নিয়ে! কোনো উদ্ভট কল্পবিজ্ঞান নিয়ে নয়।’

‘হুম,’ মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন ড্যারেন।

‘যা-ই হোক, আমার প্রজেক্ট মঙ্গলের চাঁদ নিয়ে নয়। অন্য একটা বিষয়ে। বেশ গোপন ব্যাপার...তুমি যেহেতু এখন আমার সহকারী, তোমাকে সব খুলে বলতে হবে। তবে বাইরের কাউকে বলবে না, ঠিক আছে?’

‘একদম, প্রফেসর।’

***

‘মহাবিশ্বের অসংখ্য “ভয়েড” নিয়ে তোমার কী ধারণা ড্যারেন?’ কফির কাপে চুমুক দিলেন ফেলিক্স।

‘মহাবিশ্বকে ভালো করে দেখলে দুই প্রকার জায়গা দেখা যায়। সুপারক্লাস্টার আর ভয়েড। আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ে যেমন ভারগো সুপারক্লাস্টারের অংশ, ভারগো সুপারক্লাস্টার আবার বৃহত্তর ল্যানিয়াকেয়া সুপারক্লাস্টারের অংশ। সুপার ক্লাস্টারগুলোতে থাকে অসংখ্য ছায়াপথ। ভয়েড হলো সুপারক্লাস্টারের বিপরীত…এখানে শুধুই শূন্যতা।’

‘তোমার ধারণা ভুল…“ভয়েড” বলেই যে ওখানে কিছুই নেই, এমন নয়। ভয়েডগুলোতেও কিছু ছায়াপথ থাকে। তবে খুবই অল্প…সেগুলোর মধ্যকার দূরত্বও অনেক…ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক। সবচেয়ে বিখ্যাত ভয়েড হলো “বুয়োটিস ভয়েড”। ১৯৮১ সালে একদল বিজ্ঞানী খুঁজে পান এটি...আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে এটি অবস্থিত। অনেকে এটাকে সুপারভয়েডও বলে থাকেন। আমার গবেষণা মূলত এই বুয়োটিস ভয়েড নিয়ে।’

‘অসাধারণ!’

‘একদম...সরকারি অর্থায়নে বিশেষ একটি সুপারস্পেস টেলিস্কোপ বানানো হয়েছে। এটা খুবই ক্ষমতাশালী। গোটা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের কাছে এমন প্রযুক্তি নেই। এই যন্ত্র দিয়ে আমি বুয়োটিস ভয়েডকে পর্যবেক্ষণ করছি। আজ থেকে তুমিও আমাকে সাহায্য করবে...’

‘প্রফেসর...বুয়োটিস ভয়েডের ব্যাপারে আমিও শুনেছি। জায়গাটা নাকি একদমই অন্ধকার?’

‘তা ঠিক, তবে আমি ওখানকার বিশেষ একটা ছায়াপথ চিহ্নিত করেছি...যা তুলনামূলকভাবে উজ্জ্বল। ওটাকেই পর্যবেক্ষণ করছি এখন। একটা ব্যাপার কি জানো? এই ভয়েডে এখন পর্যন্ত মাত্র ষাটটির মতো ছায়াপথের সন্ধান পাওয়া গেছে...এটার যে আকার, তাতে ১০ হাজার ছায়াপথ আরামসে থাকতে পারত! কিন্তু ভয়েডগুলো এমন কেন? এগুলোতে এত কম ছায়াপথ কেন থাকে?’

‘হুম...’

‘এমনটা কি হতে পারে যে বুয়োটিস ভয়েডও এককালে সুপারক্লাস্টার ছিল...পরে কোনো কারণে এটার গ্যালাক্সিগুলো হারিয়ে গেছে? বা কোনো কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে?’

‘এমনটা কেন মনে হচ্ছে, প্রফেসর?’

‘যে ছায়াপথটাকে আমি পর্যবেক্ষণ করছি, ওটার ক্ষেত্রে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি? বুঝলে? দাঁড়াও তোমাকে দেখাই। ’

পকেট থেকে দুটি ছবি বের করলেন ড. ফেলিক্স, তারপর ওগুলো এগিয়ে দিলেন ড্যারেনের দিকে।

‘দেখো, ভালো করে দেখো।;

প্রথম ছবিতে অন্ধকার একটা জায়গায় ক্ষুদ্র একটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। পরের ছবিটাও একই।

‘দুটি ছবি তো একই, স্যার,’ অবাক হলেন ড্যারেন।

‘না, ভালো করে খেয়াল করো, আলোর বিন্দুটার ডান দিকে...’

আবার তাকালেন ড্যারেন। কোনো পরিবর্তন তাঁর চোখে পড়ল না।

‘বুঝতে পারছ না, তাই না?’ হাসলেন ড. ফেলিক্স, ‘আসলে অভিজ্ঞ চোখ ছাড়া বোঝা মুশকিল। প্রথম ছবিটার ডান দিকটার থেকে দ্বিতীয় ছবিটার ডান দিক একটু বেশি অন্ধকার...ওই আলোর বিন্দুটা বুয়োটিস ভয়েডের একটা ছায়াপথ। এটাকেই পর্যবেক্ষণ করছি আমি। কোনো এক অজানা কারণে...ওটার একদিক ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে! দ্বিতীয় ছবিটা প্রথম ছবিটা তোলার ছয় ঘণ্টা পর তোলা।’

‘কেন এমনটা হচ্ছে, প্রফেসর?’

‘সেটা জানি না...তবে কোনো কারণ তো আছে। একটা পুরো গ্যালাক্সির এক পাশ ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, এ আবার কেমন কথা?’

‘হুম!’

‘হয়তো এককালে এই ভয়েড একটা সুপারক্লাস্টারই ছিল। এই ছায়াপথ কেন ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, সেই রহস্য যদি আমরা বের করতে পারি...তবে ওই সূত্র ধরে এটাও বুঝতে পারব যে “কেন” এই ভয়েডগুলো সৃষ্টি হয়। বুঝলে?’

‘একদম, প্রফেসর! ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা উচিত। আচ্ছা ব্ল্যাকহোল…’

‘আরে না না, ব্ল্যাকহোল তো ছায়াপথের ভেতরেই থাকে। আর তা ছাড়া একটা পুরো ছায়াপথকে শেষ করা যেমন তেমন কথা নয়…প্রতিটি ছায়াপথের কেন্দ্রেই একটি করে অতিকায় ব্ল্যাকহোল থাকে। ছায়াপথকে শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা শুধু এগুলোরই থাকে। তবে সে ক্ষেত্রে ঝামেলা শুরু হবে ছায়াপথের ভেতর থেকে…কিন্তু এখানে তো সমস্যা হচ্ছে বাইরে থেকে। যেন অন্ধকার কিছু একটা ধীরে ধীরে ছায়াপথটাকে গ্রাস করছে!’

‘অদ্ভুত ব্যাপার!’

‘সেটাই। ভেবো না, সমাধান আমরা করে ফেলব। তবে সময় লাগবে প্রচুর...কোনোভাবেই হাল ছাড়া যাবে না। তুমি প্রস্তুত তো, নাকি ড্যারেন?’

‘একদম, প্রফেসর!’

‘আচ্ছা, তোমার ব্যাপারে যত দূর শুনেছি...আমার বন্ধু থমসনের প্রিয় ছাত্র ছিলে। ও ব্যাটাও তো কল্পবিজ্ঞানের বেশ ভক্ত।’

‘সেটাই,’ হাসলেন ড্যারেন, ‘ড. থমসনকে যখন জানালাম যে আপনার সহকারী হিসেবে আমি নির্বাচিত হয়েছি...উনি তো বেজায় খুশি।’

‘আমরা দুজন অনেক আগে থেকেই বন্ধু। এরপর ও পদার্থবিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়ল আর আমি মহাকাশ নিয়ে মেতে উঠলাম। তা তোমার বাড়ি কোথায় যেন?’

‘পেনসিলভানিয়াতে, প্রফেসর। ওখানকার এক এতিমখানাতেই বেড়ে উঠেছি।’

‘আহা...’

‘আসলে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আমার ছোটবেলা থেকেই, বিশেষ করে মহাকাশ নিয়ে কোনো বই পেলে তো সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে ফেলতাম। তারপর কলেজে পেলাম ড. থমসনকে...এখন আবার আপনার সহকারী হিসেবে কাজ করব। সৌভাগ্যই বলতে হবে!’

‘সৌভাগ্য নয় ড্যারেন...এসবই তোমার পরিশ্রমের ফল। লেগে থাকো, আরও ভালো ফল আসবে...আমরা নতুন কিছু খুঁজে বের করব! আর কল্পবিজ্ঞান পড়া বাদ দাও...ওগুলো কোনো কাজের নয়।’

‘আচ্ছা, প্রফেসর।’

***

ছয় মাস পর।

চুপচাপ অবজারভেটরিতে বসে আছেন ড্যারেন। তাঁর চোখ কম্পিউটারের বিশাল পর্দায় আটকে আছে। একটু আগেই একটা ছবি এসেছে স্পেস টেলিস্কোপ থেকে।

ওই মিটমিটে বিন্দুটার প্রায় অর্ধেকটাই ঢেকে গেছে অন্ধকারে। খাতায় একটা ছোটখাটো হিসাব করলেন ড্যারেন। খাতা আর পেনসিল সব সময় কাছে রাখেন।

চিন্তায় পড়ে গেলেন ড্যারেন। যে জিনিসটা ওই ছায়াপথকে আড়াল করে ফেলছে, তা সম্ভবত প্রতি ঘণ্টায় ১০ আলোকবর্ষ বেগে এগিয়ে যায়!

এত দ্রুত!

আর তা ছাড়া স্পেস টেলিস্কোপে যে ছবি ড্যারেন দেখছেন, তা বুয়োটিস ভয়েডের হাজার হাজার বছর আগের ছবি। বাস্তবে বহু আগেই ওই ছায়াপথকে আড়াল করে ফেলেছে ওই জিনিস।

কিন্তু কী ওটা?

‘কী খবর ড্যারেন?’ ভেতরে ঢুকলেন ড. ফেলিক্স।

‘প্রফেসর, হয়তো এ বছরের শেষ নাগাদ ওই ছায়াপথের হারিয়ে যাওয়া আমরা দেখতে পাব…’

‘হাজার হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া এক দৃশ্য আমরা এত দিন পর দেখছি। মহাবিশ্ব আসলেই রহস্যময়…’

‘একটা কাজ করলে কেমন হয় প্রফেসর? আমি জানি, স্পেস ভয়েডগুলো দেখার কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। টেলিস্কোপের বিবর্ধনক্ষমতা খুব বেশি বাড়ানোর নিয়ম নেই…কারণ, ওখানকার কোনো অজানা রশ্মিতে আমাদের চোখের ক্ষতি হতে পারে…কিন্তু এই একটা জিনিসের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় টেলিস্কোপের সর্বোচ্চ বিবর্ধনক্ষমতা ব্যবহার করে আমাদের দেখা উচিত যে জিনিসটা আসলে কী? একটা ছায়াপথকে গ্রাস করছে! এত ক্ষমতা!’

‘কাজটায় বিপদ আছে, আর তা ছাড়া ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করলে টেলিস্কোপ বিকলও হয়ে যেতে পারে।’

‘প্রফেসর…একটা ঝুঁকি তো আমাদের নিতেই হবে। না হলে বুয়োটিস ভয়েডের রহস্য কীভাবে জানব?’

‘হুম…তা ঠিক বলেছ।’

‘কিন্তু জিনিসটা তো অন্ধকার…ওর নিজস্ব কোনো আলো নেই, আবার কোনো আলো প্রতিফলিতও করছে না। এমন একটা জিনিসের ছবি কি ঠিকমতো আসবে?’

‘তোমাকে বলা হয়নি, এই টেলিস্কোপে বিশেষ একটা প্রযুক্তি আছে। যেটার মাধ্যমে একদম অন্ধকার কোনো জিনিসেরও আকৃতি ফুটিয়ে তোলা যায়…কিন্তু সেটা প্রয়োগ করলে যন্ত্রটায় চাপ আরও বেশি পড়বে! যা-ই হোক, ঝুঁকি তো নিতেই হবে। তুমি বাড়ি চলে যাও…রাত অনেক হয়েছে। সকালে আবার এসো…’

‘আজ রাতটা এখানেই থাকি প্রফেসর?’

‘না না…আমি সবকিছু করছি। বিবর্ধনক্ষমতা বাড়িয়ে দেব, একদম সর্বোচ্চ। তারপর ওই বিশেষ প্রযুক্তিতে ছবি উঠে আমাদের কাছে আসতে আসতে ভোর হয়ে যাবে। তুমি কাল সকাল সকাল এসে ছবিটা দেখে নিয়ো।’

***

পরদিন সকাল আটটায় এসে ড্যারেন অবজারভেটরির মেঝেতে প্রফেসর ফেলিক্সের প্রাণহীন মরদেহটা দেখতে পেলেন। বুকের বাঁ পাশটায় হাত দিয়ে রেখেছেন ভদ্রলোক, মুখটা বিকৃত…যন্ত্রণায়? নাকি কিছু দেখে ভয় পেয়েছিলেন?

পাশে কতগুলো পোড়া কাগজের টুকরা। একটা ছবি প্রথমে কুটি কুটি করে ছিঁড়েছেন প্রফেসর, তারপর আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন! এটাই কি তবে টেলিস্কোপের তোলা সেই ছবি?

এটা কেন ছিঁড়লেন প্রফেসর? পুড়িয়ে কেন দিলেন?

তাড়াতাড়ি কম্পিউটারের স্টোরেজ চেক করলেন ড্যারেন। সেখানেও ছবিটা নেই…ডিলিট করে দিয়েছেন প্রফেসর ফেলিক্স!

টেলিস্কোপটা কিন্তু দিব্যি সচল আছে!

***

দুই সপ্তাহ পর।

অবজারভেটরিতে বসে চুপচাপ অপেক্ষা করছেন ড্যারেন। এতগুলো দিন তিনি এখানে আসতে পারেননি। টপ সিক্রেট প্রজেক্টের কর্মকর্তা হওয়ায় ড. ফেলিক্সের মৃত্যুর তদন্ত করেছে স্বয়ং এফবিআই। জায়গাটা সিল করে রাখা হয়েছিল।

যত দূর বোঝা গেছে, হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন ড. ফেলিক্স। কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছিলেন তিনি।

আজ ড্যারেনকে প্রজেক্টের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ড. ফেলিক্সের জায়গাতে নতুন কাউকে সরকার নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত সবকিছুর দেখভাল তিনিই করবেন।

টেলিস্কোপের বিবর্ধনক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন ড্যারেন, তারপর অন্ধকার বস্তুর আকৃতি ফুটিয়ে তোলার সেই বিশেষ প্রযুক্তিও চালু করেছেন।

কেটে গেছে বেশ কয়েক ঘণ্টা। এই তো, কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্দায় ছবিটা ফুটে ওঠার কথা।

ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে শুরু করল ছবিটা। মাত্র কয়েক সেকেন্ড…হ্যাঁ, পরিপূর্ণ একটা ছবি। বহুদূরের বুয়োটিস ভয়েডের এক ছায়াপথের হারিয়ে যাওয়ার ছবি…হাজার হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা…

পর্দায় যেন চোখ আটকে গেছে ড্যারেনের! এ কী দেখছেন তিনি? কেন দেখতে গেলেন এই দৃশ্য!

কাঁপা কাঁপা হাতে ছবিটা কম্পিটারের স্টোরেজ থেকে ডিলিট করে দিলেন ড্যারেন। তারপর খাতা আর পেনসিল নিয়ে বসলেন।

অদ্ভুত একটা শব্দ ভেসে এল তখন…ঘরের ভেতরের একটা লাল আলো ক্রমাগত জ্বলছে আর নিভছে। এর অর্থ হলো, বিকল হয়ে গেছে টেলিস্কোপ।

‘ভালোই হয়েছে,’ উন্মাদের মতো হেসে উঠলেন ড্যারেন। তারপর কী যেন আঁকতে লাগলেন খাতায়।

এখন ড্যারেন জানেন কী ঘটতে যাচ্ছে ওই ছায়াপথের সঙ্গে…তিনি জানেন কেন ভয়েডগুলো সৃষ্টি হয়! এটাও বুঝতে বাকি নেই যে একসময় সব কটি সুপারক্লাস্টারই ভয়েডে পরিণত হবে…কিচ্ছু করার নেই, মানবজাতি খুব অসহায়। মহাজাগতিক শক্তির সামনে মানুষের জ্ঞান খুবই সামান্য।

সাধারণ মানুষের সামনে এই ভয়ংকর বাস্তবতা তুলে ধরার কোনো মানেই হয় না…সত্য জানলে অসংখ্য মানুষ উন্মাদ হয়ে যাবে…নষ্ট হয়ে যাবে সমাজের ভারসাম্য।

খাতায় আঁকা হয়ে গেছে! কেন এঁকেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর ড্যারেন নিজেও জানেন না।

‘যে চোখে ওই ভয়ংকর দৃশ্য দেখেছি, সেই চোখ দিয়ে আর মাটির পৃথিবী দেখার অধিকার রাখি না আমি…কখনোই না, কোনোভাবেই না…’ বিড়বিড় করতে করতে খাতাটা এক পাশে ছুড়ে ফেললেন ড্যারেন।

***

পরদিন,

সন্ধ্যা সাতটা, মাউন্ট ভিউ হাসপাতাল।

বিছানায় শুয়ে আছেন ড্যারেন, বিছানায় বসে নার্স একটা ইনজেকশন দিচ্ছেন। পাশে দাঁড়িয়ে ড. থমসন।

তখনই ঘরে এলেন হাসপাতালের প্রধান ডাক্তার ডা. চার্লি, সঙ্গে বেশ লম্বা আরেকটা লোক।

‘ড. থমসন,’ বলে উঠলেন ডা. চার্লি, ‘একটু বাইরে আসুন তো। এই ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’

তিনজন বাইরে এলেন।

‘আমি অফিসার মার্ফি, এফবিআই,’ আইডি কার্ড বের করে দেখালেন অফিসার।

‘হ্যালো অফিসার,’ করমর্দন করলেন ড. থমসন।

‘ভদ্রলোকের কেউ নেই, তা-ই না?’

‘না…ও এতিম। আমার প্রিয় ছাত্র ছিল কলেজে। কী থেকে যে কী হয়ে গেল!’

‘আসলে ব্যাপারটা রহস্যময়…একই প্রজেক্টে ড. ফেলিক্সের মৃত্যু, তারপর এই ভদ্রলোকের ঘটনা…আবার শুনলাম, ওই সুপার টেলিস্কোপটাও নাকি নষ্ট হয়ে গেছে!’

‘আমার মনে হয়, উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন,’ বলে উঠলেন ডা. চার্লি, ‘পেনসিল ঢুকিয়ে নিজের চোখ দুটি নিজেই গেলে দিয়েছেন!’

‘হতে পারে…’ মাথা নাড়লেন মার্ফি, ‘আচ্ছা, ড. থমসন…ড. ফেলিক্সও তো আপনার বন্ধু ছিলেন, তা-ই না?’

‘হ্যাঁ, মৃত দুজনেই আমার পরিচিত…’

‘হুম, আপনাকে একটা জিনিস দেখানোর আছে। ডাক্তার, আপনি একটু রোগীর কাছে যাবেন?’

‘অবশ্যই…’ ভেতরে চলে গেলেন ডা. চার্লি।

ফাইল থেকে ড্যারেনের খাতাটা বের করলেন মার্ফি। তারপর একটা পৃষ্ঠা বের করে মেলে ধরলেন ড. থমসনের সামনে, পৃষ্ঠার নিচে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে।

‘আমাদের ধারণা, ছবিটা এঁকেই তিনি চোখে পেনসিল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন,’ গম্ভীর গলায় বললেন অফিসার।

ভালো করে ছবিটা দেখতে লাগলেন ড. থমসন।

অদ্ভুত একটা ছবি। পুঁচকে একটা বিন্দুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এক অদ্ভুত প্রাণী…বিন্দুটা ঢুকে যাচ্ছে প্রাণীটার বিরাট মুখের মধ্যে…শুধু মুখই আছে ওই দানবটার…নাক, চোখ, কান কিছুই নেই…তবে হ্যাঁ, অনেকগুলো শুঁড় আছে…ওটার একটা আকৃতি একটা বলের মতো, শরীরের প্রায় সব জায়গা থেকে বেরিয়ে আসছে শুঁড়।

‘এ তো দেখছি লাভক্র্যাফটের কল্পনায় সৃষ্ট জীবগুলোর মতো দেখতে!’ আপনমনেই বলে উঠলেন ড. থমসন…

গল্পের মূল নাম—‘দ্য ক্রিয়েচার অব দ্য বুয়োটিস ভয়েড’