টুনটুনি ও ছোটাচ্চু (চতুর্থ পর্ব)

প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ছোটাচ্চুর প্রথম কাজ হচ্ছে তার ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা, কেউ তার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে তার জন্য কোনো কেস দিয়েছে কি না। প্রায় দিনই কিছু না কিছু থাকে কিন্তু সেগুলো দেখে ছোটাচ্চুর মেজাজ গরম হয়ে যায়। যে রকম একদিন একজন লিখেছে:

‘তোমার কামের অভাব হইছে? রংবাজী করো?’

ছোটাচ্চু কিছুতেই বুঝতে পারে না সে যদি একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খোলে, তাতে অন্য মানুষের সমস্যা কী? সবচেয়ে বড় কথা, প্রশ্নটা যদি সত্যিই করতে চায়, শুদ্ধ বাংলায় করলে কী দোষ হতো?

আরেক দিন আরেকজন লিখল:

‘আমার হৃদয় চুরি গিয়েছে। কে আমার হৃদয় হরণ করেছে, খুঁজে বের করে দিতে পারবেন?’

এটা শুদ্ধ ভাষায় লেখা ছিল কিন্তু তার পরেও ছোটাচ্চুর মেজাজ খুবই খারাপ হলো। সবচেয়ে মেজাজ গরম হয় যখন কেউ তার কাজ নিয়ে প্রশ্ন করে। যেমন একদিন এ রকম একটা লিখল:

‘তুমি ডিটেকটিভ বানান করতে পারবা যে ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলছ?’

ছোটাচ্চু অবশ্যি তার এই চিঠিপত্রগুলো কাউকে দেখায় না। যখন বাসার ছেলেমেয়েরা আশপাশে থাকে তখন বড় বড় কথাবার্তা বলে। তার প্রিয় বক্তৃতাটা এ রকম হয়, ‘আমরা এখন একটা ক্রান্তিকালে আছি। সবকিছু হবে ভার্চুয়াল জগতে, সে জন্যই তো এই অসাধারণ ওয়েবসাইটটা তৈরি করেছি।’

তখন ত্যাঁদড় শান্ত বা অন্য কেউ বলে, ‘এটা অসাধারণ কেমন করে হলো? দুনিয়ার সব ওয়েবসাইটই তো এ রকম।’

ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলে, ‘তুই জানিস এই ওয়েবসাইটটা কে তৈরি করেছে?’

বাচ্চারা জিজ্ঞেস করে, ‘কে?’

‘একজন সুপার জিনিয়াস। গুগলে চাকরির অফার দিয়েছে, সে নেয় নাই। ফেসবুক তার পেছনে পেছনে ঘোরে, সে পাত্তা দেয় না। মাইক্রোসফট দিনে দুইবার ফোন করে, সে ফোন ধরে না।’

যারা ছোট তারা ব্যাপারটা খুব ভালো করে বুঝতে না পারলেও ছোটাচ্চুর গম্ভীর মুখ দেখে মাথা নাড়ে। শুধু শান্ত বলে, ‘এত বড় জিনিয়াস হলে সে বসে বসে ওয়েবসাইট কেন তৈরি করে? আমাদের ক্লাসের ফাক্কুও ওয়েবসাইট বানায়।’

ফাক্কু নামের স্কুলের একজন ছাত্রের সঙ্গে এত বড় জিনিয়াসের তুলনা করার জন্য ছোটাচ্চু খুব রেগে গেল, ধমক দিয়ে বলল, ‘যেটা বুঝিস না সেটা নিয়ে কথা বলবি না।’

তখন একজন একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কিন্তু ছোটাচ্চু, তোমার ওয়েবসাইটের রংটা ভালো হয়নি। দেখলে মনে হয় ইনফেকশন হয়ে গেছে।’

ছোটাচ্চু তখন আরও জোরে ধমক দিয়ে বলে, ‘ইনফেকশন? ইনফেকশনের আবার রং আছে নাকি?’

‘কেমন যেন ঘা হয়ে গেছে মনে হয়।’

ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলে, ‘আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করিস, ওয়েবসাইটের ইনফেকশন হয়েছে?’

আলাপ আরও এগিয়ে যেত কিন্তু টুনি পুরো ব্যাপারটাতে ঠান্ডা পানি ঢেলে দেয়, আস্তে আস্তে বলে, ‘ওয়েবসাইট ভালো না খারাপ, তাতে কিছু আসে-যায় না। আসল কথা হচ্ছে কেস আসছে কি না।’

তখন সবাই ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ছোটাচ্চু, কেস আসছে?’

ছোটাচ্চু তখন একটু আমতা আমতা করে বলে, ‘মানে, এখনো সে ভাবে আসতে শুরু করেনি। লোকজন খোঁজখবর নিচ্ছে। ভালো করে একবার প্রচার করতে পারলে তখন কেস নিয়ে কূল পাব না।’

একজন বলল, ‘তুমি যদি কেস সলভ করো, তাহলে প্রচার হবে।’

আরেকজন বলল, ‘প্রচার হলে তোমার কাছে কেস আসবে।’

জ্ঞানী টাইপের একজন বুঝিয়ে দিল, ‘কেস হচ্ছে মুরগি আর প্রচার হচ্ছে ডিম। মুরগি আগে, না ডিম আগে?’

যারা হাজির ছিল তাদের অর্ধেক চিৎকার করতে লাগল, ‘ডিম। ডিম।’ অন্য অর্ধেক চিৎকার করতে লাগল, ‘মুরগি। মুরগি।’ ছোটাচ্চু তখন দুই দলকেই ধমক দিয়ে তার ঘর থেকে বের করে দিল।

প্রতিদিন মোটামুটি একই রকম ঘটনা, তার মধ্যে একদিন একটা অসাধারণ ঘটনা ঘটে গেল, ছোটাচ্চু ঘুম থেকে উঠে তার ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখল, একজন সেখানে তার জন্য একটা লম্বা চিঠি লিখেছে, যে ফরমটা রাখা আছে তার সবকিছু ঠিক ঠিকভাবে পূরণ করেছে। যেখানে ঠিকানা লেখার কথা সেখানে ঠিকানা লিখেছে, যেখানে টেলিফোন নম্বর লেখার কথা সেখানে টেলিফোন নম্বর লিখেছে, যেখানে সমস্যার বর্ণনা দেওয়ার কথা সেখানে সমস্যার বর্ণনা দিয়েছে। ছোটাচ্চু একবার পড়ল তারপর দুইবার পড়ল তারপর তিনবার পড়ল তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘ইয়াহু উ উ উ...।’

বাসার বাচ্চাকাচ্চারা যে যেখানে ছিল সেখান থেকে ছুটে এল। একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে ছোটাচ্চু?’

ছোটাচ্চু তার বুকে থাবা দিয়ে বলল, ‘তোরা ভেবেছিলি আমার ওয়েবসাইটে কোনো দিন কেস আসবে না। এই দেখ কেস এসে গেছে। হানড্রেড পারসেন্ট খাঁটি কেস।’

একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কী কেস ছোটাচ্চু? মার্ডার? সিঙ্গেল না ডাবল?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘না, মার্ডার না। কিন্তু মার্ডার থেকেও জটিল।’

সবাই জিজ্ঞেস করতে শুরু করল, ‘কী কেস? কী কেস?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘ঠিক আছে, আমি পড়ে শোনাই।’

তখন তার ইনফেকশনওয়ালা ওয়েবসাইট থেকে চিঠিটা পড়ে শোনাতে আরম্ভ করল:

‘মহোদয়: আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা, যথেষ্ট উচ্চ পদে আছি। আমি একটা বিশেষ বিপদে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আমাদের দেশে প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে আমার জানা ছিল না, জেনে খুব খুশি হয়েছি।

প্রথমে আমার পরিবার সম্পর্কে বলি। আমি, আমার স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। আমার স্ত্রী একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। আমার মেয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী, আমার ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে। আমার সমস্যাটি আমার ছেলেকে নিয়ে।

আমার ছেলে এবং মেয়ে দুজনেই মেধাবী ছাত্রছাত্রী। আমার ছেলে একাধিকবার বিভিন্ন গণিত অলিম্পিয়াডে মেডেল পেয়েছে। গণিত এবং বিজ্ঞান তার খুবই প্রিয় বিষয়। আমি আপনাদের এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করছি আমার ছেলের সমস্যা নিয়ে।

আমি সব সময়ই স্বপ্ন দেখেছি আমার ছেলে একজন বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে। একটি ভালো ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য সে প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় না, সে একজন বিজ্ঞানী হতে চায়। যখন ছোট ছিল আমি ভেবেছি এটা তার একটা ছেলেমানুষি স্বপ্ন। কিন্তু যখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ঘোষণা দিল সে ইঞ্জিনিয়ারিং কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেবে না, সে বিজ্ঞানী হতে চায়, তাই কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হবে, তখন তার সঙ্গে আমার একধরনের গোলমাল শুরু হয়। প্রথমে আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, সে বুঝতে রাজি না হওয়ায় আমি বাধ্য হয়ে তাকে শাসন করা শুরু করি। কথাবার্তার একপর্যায়ে আমি তাকে বলি, যেহেতু সে আমার উপার্জনে আমার বাসায় আছে, তাই তাকে আমার কথা শুনতে হবে। সে যদি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তাহলে তাকে আমার বাসা থেকে বের হয়ে নিজের খরচ নিজে উপার্জন করতে হবে।

আমি রাগের মাথায় কথাটি বলেছিলাম কিন্তু আমার ছেলে আন্তরিকভাবে নিয়েছে এবং দুই সপ্তাহ আগে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। তার নিজের ল্যাপটপ ছাড়া সে আর কিছুই নেয়নি।

বাস্তব জীবনে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ আমার ছেলে দুই-এক দিনের মধ্যেই চলে আসবে বলে আমার ধারণা ছিল কিন্তু আজ প্রায় দুই সপ্তাহ হলো সে ফিরে আসেনি এবং সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সব জায়গায় তাকে খুঁজে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমি এখন আমার ছেলের নিরাপত্তার কথা ভেবে চিন্তিত। আমার স্ত্রী খুব ভেঙে পড়েছেন এবং পারিবারিকভাবে আমি অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত। আমার মেয়েটিও আমার সঙ্গে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।

এ রকম অবস্থায় ইন্টারনেটে আপনার প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়ে যোগাযোগ করছি। অনুগ্রহ করে আমার ছেলেকে খুঁজে বের করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব। এ জন্য প্রয়োজনীয় যেকোনো ফি দিতে আমি প্রস্তুত।’

ছোটাচ্চু এতটুকু পড়ে আনন্দে আবার চিৎকার করে উঠল কিন্তু তাকে ঘিরে থাকা বাচ্চাকাচ্চারা সেই আনন্দে অংশ নিল না, সবাই শীতল চোখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল। বাচ্চাদের মধ্যে যে একটু বড় সে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ছোটাচ্চু, এ রকম একটা চিঠি পড়ে তোমার আনন্দ হচ্ছে? তুমি কি গোলাম আযমের ভাতিজা?’

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তখন আরেকজন বলল, ‘আমরা তোমার সাথে আর কোনো দিন খেলব না। তুমি হচ্ছো হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর।’

আরেকজন বলল, ‘তোমার বুকে নিশ্চয়ই লোম নেই।’

বুকে লোম না-থাকা কিংবা গোলাম আযমের ভাতিজা হওয়া এই ব্যাপারগুলোর মধ্যে সম্পর্কটা ছোটাচ্চু পুরোপুরি ধরতে না পারলেও বিজ্ঞানী হতে চাওয়া ছেলেটার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা শুনে তার আনন্দ প্রকাশ করাটা ঠিক হয়নি সেটা বুঝতে পারল। ব্যাপারটা সামলানোর জন্য বলল, ‘আহা। আমি কি ছেলেটার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য আনন্দ করছি? আমি আনন্দ করছি কারণ এখন আমি ছেলেটাকে খুঁজে বের করে বাসায় নিয়ে আসব, তখন সবাই কত আনন্দ করবে, সেই কথা চিন্তা করে।’

ছোট একজন বলল, ‘কচু।’

আরেকজন বলল, ‘আলু ভর্তা।’

বড় একজন বলল, ‘আমরা তোমাকে ত্যাজ্য চাচু করলাম। তোমার সঙ্গে এখন আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ তারপর সেটা প্রমাণ করার জন্য সবাই লাইন ধরে বের হয়ে গেল। টুনি ছাড়া।

সবাই বের হয়ে গেলে টুনি ছোটাচ্চুর চেয়ারটায় বসে তার চশমাটা একটু ঠিক করে বলল, ‘কাজটা ঠিক হয় নাই, কিন্তু আমি তোমাকে এইবারের মতো মাপ করে দিলাম।’

ছোটাচ্চু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, ‘মাপ করে দিলি? তুই? আমাকে?’

‘হ্যাঁ। কেন বুঝতে পারছ তো?’

‘কেন?’

‘তোমার এখন সাহায্য দরকার। তা না হলে তুমি এই কেস সলভ করতে পারবে না।’

‘আমি পারব না?’

‘এইটা তোমার একটা সুযোগ। তাই ছোটাচ্চু, তোমার যদি কোনো সাহায্য লাগে, তাহলে আমাকে বোলো। লজ্জা কোরো না।’

ছোটাচ্চু টুনির কথাগুলো হজম করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে মিস টুনি। আমার যখন সাহায্য লাগবে আমি আপনার কাছে আসব, লজ্জা করব না।’

টুনি বলল, ‘থ্যাংকু।’ তারপর সেও বের হয়ে গেল।

ঘণ্টা খানেক পর দেখা গেল ছোটাচ্চু ফারিহার সঙ্গে কথা বলছে, গলার স্বর খুবই নরম আর কাঁচুমাচু। কথা শুরু হলো এভাবে:

‘ফারিহা, তোমাকে একটু বিশেষ দরকারে ফোন করছি।’

‘বলো। টাকা ধার দিতে হবে?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘না না। টাকা ধার দিতে হবে না। অন্য একটা দরকার।’

‘বলো, কী দরকার।’

ছোটাচ্চু কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘আমি আমার প্রথম কেসটা পেয়েছি। আমার ওয়েবসাইটে একজন কেস ফাইল করেছে।’

‘কংগ্রাচুলেশন।’

‘এই ব্যাপারে তোমার হেলপ লাগবে।’

ফারিহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘তোমার কেস সলভ করে দিতে হবে?’

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, ‘উঁহু। কেস আমি নিজেই সলভ করব—কিন্তু পার্টির কাছে যাওয়ার ব্যাপারে।’

‘গাড়ি দিতে হবে?’

ছোটাচ্চু একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘বুঝতেই পারছ, ক্লায়েন্টের কাছে যদি একটা রিকশা, না-হয় একটা সিএনজি দিয়ে যাই, ক্লায়েন্ট গুরুত্ব দেবে না। অনেক বাসা আছে গাড়ি ছাড়া ঢোকাই যাবে না।’

‘ঠিক আছে। কখন লাগবে বলো—আব্বুকে বলে ম্যানেজ করে দিতে হবে। আর কিছু?’

‘গাড়ি হচ্ছে একটা। বলতে পারো সোজা বিষয়টা। তোমার আরেকটু সাহায্য লাগবে।’

ফারিহা বলল, ‘বলো, কী সাহায্য?’

‘বুঝতেই পারছ আমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে আমি একা।’

‘তোমাদের টুনি আছে। খুবই স্মার্ট মেয়ে।’

ছোটাচ্চু এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল, টুনি তার কথা শুনে ফেলল কি না, তারপর বলল, ‘কিন্তু টুনি তো বাচ্চা মেয়ে, তাকে তো আমার কাজে লাগাতে পারি না। তুমি যদি একটু সাহায্য করো।’

‘ঝেড়ে কাশো। পরিষ্কার করে বলো।’

ছোটাচ্চু এবারে ঝেড়ে কাশল অর্থাৎ পরিষ্কার করে বলল, ‘আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গে তুমি যদি একটু কথা বলো। ভান করো তুমি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সেক্রেটারি। টিশ টাশ করে একটু ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলবে। একটু অ্যাপয়েন্টমেন্ট করবে। প্রফেশনাল একটা ভাব দেখাবে।’

‘আমাকে কী দেবে?’

‘তুমি কী চাও?’

ফারিহা এবার হেসে ফেলল, ‘তোমার দেওয়ার মতো কী আছে?’

‘আউল ফাউল কয়টা সিম আছে। লাগলে দিতে পারি।’

‘থাক। আমার নিজের টেলিফোনের যন্ত্রণাতেই বাঁচি না। এখন যদি আউল ফাউল সিমের যন্ত্রণা শুরু হয়, তাহলেই গেছি।’

‘তাহলে কী চাও?’

‘প্রথম বিল পেয়ে আমাকে দোসা খাইয়ে দিয়ো। খুব ভালো একটা দোসার দোকান হয়েছে—ভয় পেয়ো না, বেশি বিল উঠবে না।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আমি মোটেই ভয় পাচ্ছি না।’

সেদিন বিকেলেই ফারিহা ছোটাচ্চুর কাছে চলে এল। ছোটাচ্চু তাকে টেলিফোন নম্বর দিয়ে কী বলতে হবে বুঝিয়ে দিল। ফারিহা নম্বরটা ডায়াল করে টেলিফোন কানে লাগায়, দুটো রিং হওয়ার পরই কেউ একজন ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো।’

ফারিহা জিজ্ঞেস করল, ‘মিস্টার হোসেন? আকবর হোসেন?’

‘কথা বলছি।’

‘হায়। আমি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে বলছি। আমাদের ডেটাবেইসে আপনার একটা এন্ট্রি হয়েছে। আইএম সরি, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেরি হলো। আমরা সাধারণত আরও তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করি—লাস্ট ফিউ ডেজ হঠাৎ করে কাজের চাপ বেড়ে গেছে।’

ওই পাশ থেকে আকবর হোসেন বললেন, ‘ইট ইজ অলরাইট।’

ফারিহা বলল, ‘আপনার কেসটা প্রসেস করার জন্য আমাদের একজন রিপ্রেজেনটেটিভের আপনার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কখন আপনি সময় দিতে পারবেন?’

‘এখনই চলে আসতে পারেন। আমরা আসলে খুবই অস্থির হয়ে আছি।’

ফারিহা বলল, ‘আমি একটু দেখি আজকে কেউ ফ্রি আছে কি না।’ তারপর ছোটাচ্চুর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, একটু খুটখাট শব্দ করল, তারপর বলল, ‘আই এম সরি মি. হাসান। আজকে কেউ ফ্রি নেই। কাল বিকেলের আগে আসলে কেউ যেতে পারবে না।’

ওই পাশের আকবর হোসেন একটু হতাশ হলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে কাল বিকেলেই।’

ফারিহা খুটখাট শব্দ করে বলল, ‘আমাদের সিস্টেমে যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেটা আপটুডেট তো?’

‘জি। এটা আপটুডেট।’

‘ভেরি গুড। কাল বিকেলে একজন যাবে।’

‘কে আসবে? কী নাম?’

‘এক সেকেন্ড, আমি দেখি কাল কে ফ্রি আছে।’ ফারিহা খুটখাট একটু শব্দ করে বলল, ‘আপনার কাছে যাবে মিস্টার শাহরিয়ার। এ ভেরি ইয়াং এনার্জেটিক চ্যাপ। অলরেডি সে দুটো কেস সলভ করেছে।’ ছোটাচ্চুর আসল নাম শাহরিয়ার। এই বাসার বাচ্চাকাচ্চারা মনে হয় সেটা জানেও না।

আকবর হোসেন অন্য পাশ থেকে বলল, ‘থ্যাংক ইউ। কাল বিকেলে আমি মিস্টার শাহরিয়ারের জন্য অপেক্ষা করব।’

ফোনটা রেখে দেওয়ার পর ছোটাচ্চু হাতে কিল দিয়ে বলল, ফ্যান্টাস্টিক। ফারিহা, ‘তুমি না থাকলে যে আমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কী হতো।’

ফারিহা বলল, ‘কথাটা মনে রেখো।’

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছোটাচ্চু যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে তার হলুদ বইটায় হারানো মানুষ কেমন করে খুঁজে বের করতে হয় সেটা পড়ছে, তখন টুনি এসে হাজির হলো। ছোটাচ্চু বই থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খবর টুনি?’

‘তুমি হারিয়ে যাওয়া ছেলেটার বাবার কাছে কখন যাবে?’

‘কালকে বিকেলে।’

‘আমাকে নিয়ে যাবে?’

‘তোর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। তুই ভাবছিস এটা টুম্পার টিফিন চুরির কেস?’

টুনি কথাটা না শোনার ভান করে বলল, ‘তুমি ইন্টারভিউয়ে কী জিজ্ঞেস করবে?’

‘সেটা তোর জানার দরকার নেই।’

‘ছেলেটার ফটো, ই-মেইল অ্যাড্রেস, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট—এসব নিয়ে এসো।’

‘তোকে সেটা বলে দিতে হবে না। আমি জানি।’

‘বন্ধুবান্ধবের নাম। ফোন নম্বর।’

‘আমি জানি।’

‘যদি ওর ডায়েরি থাকে। চিঠিপত্র।’

ছোটাচ্চু মেঘ স্বরে বলল, ‘আমি জানি।’

‘তুমি কেমন করে জানো?’

ছোটাচ্চু হাতের বইটা দেখিয়ে বলল, ‘এই বইয়ে সব লেখা আছে।’

টুনি বলল, ‘বইটা আমাকে পড়তে দেবে?’

‘ইংরেজি বই। পড়তে পারবি?’

‘আস্তে আস্তে পড়ব। ডিকশনারি দেখে দেখে।’

ছোটাচ্চু একটু নরম হলো, বলল, ‘ঠিক আছে।’

টুনি যখন চলে যাচ্ছে ছোটাচ্চু তখন বলল, ‘টুনি শোন।’

‘কী?’

‘আমার চেহারার মধ্যে কি একটা ডিকেটটিভ ডিটেকটিভ ভাব আছে?’

‘নাই। তোমাকে দেখে স্কুলের বাচ্চার মতো লাগে।’

‘তাহলে?’

‘মোচ রেখে দাও। মোচ থাকলে বয়স্ক লাগে।’

ছোটাচ্চু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘কাল বিকেলের মধ্যে মোচ উঠবে না। তা ছাড়া—’

‘তা ছাড়া কী?’

ফারিহা যে গোঁফ দুই চোখে দেখতে পারে না সেটা আর বলল না। ছোটাচ্চু কথাটা এড়িয়ে বলল, ‘তাহলে কি একটা টাই পরে যাব?’

‘হ্যাঁ। টাই পরলে বয়স্ক লাগে। আর চশমা।’

‘আমার চোখ খারাপ না, চশমা কীভাবে পাব?’

‘জিরো পাওয়ারের চশমা পাওয়া যায়।’

পরদিন বিকেলে ছোটাচ্চু ফারিহার ব্যবস্থা করা গাড়িতে জিরো পাওয়ারের চশমা আর টাই পরে আকবর হোসেনের বাসায় হাজির হলো। ছোটাচ্চুর বুক ধুকধুক করছে কিন্তু মুখের মধ্যে একটা গাম্ভীর্য ধরে রেখে সে দরজার বেলে চাপ দিল। যে মানুষটি দরজা খুলে দিল ছোটাচ্চু অনুমান করল সে নিশ্চয়ই আকবর হোসেন। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স, চেহারার মধ্যে একটু সরকারি অফিসারের মতো ভাব। মানুষটা জিজ্ঞেস করল, ‘শাহরিয়ার সাহেব?’

ছোটাচ্চু তার চশমাটা ঠিক করে বলল, ‘জি। আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে এসেছি। আমাদের একটা অ্যাসাইনমেন্টের জন্য পাঠানো হয়েছে।’

‘আমি আকবর হোসেন, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। ভেতরে আসেন।’

ছোটাচ্চু ভেতরে ঢুকল। ভেতরে একটা সোফা, সেই সোফায় একজন মহিলা বসে আছে। ছোটাচ্চু ঘরে ঢোকার পর মহিলা ঘুরে তাকাল এবং তাকে দেখে ছোটাচ্চুর রক্ত হিম হয়ে গেল। মহিলাটি ডলি খালা, সেই ফরসা, নাদুসনুদুস চেহারা, সেই সিল্কের শাড়ি, সেই লিপস্টিক। চেহারাটা শুধু অন্য রকম। একটা হিংস্র বাঘিনীর মতো। ছোটাচ্চুকে দেখেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘দুলাভাই। আমি যেটা সন্দেহ করেছিলাম, তা-ই। এই সেই ছেলে। এর থেকে সাবধান।’

ছোটাচ্চু কী করবে বুঝতে পারল না। একবার মনে হলো একটা দৌড় দেয়, কিন্তু তার জন্য দেরি হয়ে গেছে। ডলি খালা বলল, ‘আমাদের জোবেদা বুর ছেলে। জোবেদাবু হচ্ছে ফেরেশতার মতো মানুষ। সব ছেলেমেয়ে মানুষ হয়েছে, এইটা ছাড়া (ডলি খালা এই সময় আঙুল দিয়ে ছোটাচ্চুকে দেখাল) সব ছেলেমেয়ে বড় বড় চাকরিবাকরি করে আর ছোট ছেলের যা হয় তা-ই হয়েছে। টেনেটুনে পরীক্ষায় কোনোমতে পাস করেছে, চাকরিবাকরি পায় না, তখন এই ডিটেকটিভগিরি শুরু করেছে। আমি যখন প্রথম শুনেছি তখন ভাবলাম ভালোই তো, সব দেশে থাকে আমাদের দেশে থাকবে না কেন? ও মা, খোঁজ নিয়ে আমার মাথা ঘুরে আছে। বুঝলে দুলাভাই (ডলি খালা এই সময়ে আকবর হোসেনের দিকে তাকাল), এর ডিটেকটিভ এজেন্সি কি জানো? এই ছেলে পকেটে একটা মোবাইল ফোন আর কয়েকটা বেআইনি সিম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর কিছু নেই। কয়টা মেয়েবন্ধু আছে তাদের দিয়ে মাঝেমধ্যে ফোন করায়। আমি সোজা-সরল মানুষ (ডলি খালা এই সময় নিজের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল)। আমার মেয়ের জন্য জামাই খুঁজছি, এই ছেলেকে বিশ্বাস করে একটু খোঁজখবর নিতে দিয়েছি। তখন তো বুঝিনি তার কিছু নেই। ভেবেছিলাম আসলেই বুঝি অফিস আছে, লোকজন আছে, সরকারের পারমিশন আছে। সে আমার সর্বনাশ করে ছেড়ে দিয়েছে। সোনার টুকরা একটা ছেলে, আমেরিকা থেকে দেশে বিয়ে করতে এসেছে, তাকে এমন ভয় দেখাল। সেই ছেলে (এই সময় ডলি খালার গলা ধরে এলে, ডলি খালা হেঁচকি তোলার মতো একটা শব্দ করল, তারপর তার হতে পারত জামাইয়ের সব ঘটনা স্মরণ করে কেমন যেন শিউরে উঠল।)’

অলংকরণ: সাদাত

ছোটাচ্চু পুরোপুরি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ডলি খালার দিকে তাকিয়ে রইল। এখানে যে ডলি খালা থাকবে আর তার এত বড় সর্বনাশ করবে, সেটা ছোটাচ্চু একবারও ভাবেনি। একজন মানুষ যে টানা এতক্ষণ একভাবে কারও বিরুদ্ধে এত খারাপ খারাপ কথা বলতে পারে, ছোটাচ্চু নিজের চোখে না দেখলে সেটা বিশ্বাস করত না। ছোটাচ্চু একবার ভাবল, প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলে, কিন্তু সে বুঝতে পারল, বলে কোনো লাভ নেই, সে কখনোই এ রকম তীব্র ভাষার বক্তব্যের ধারে-কাছে যেতে পারবে না। তাই ছোটাচ্চু হাল ছেড়ে দিয়ে ডলি খালার দিকে পরের আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করে রইল।

ডলি খালা ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল, তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘বুঝলে দুলাভাই, যখন খবর পেয়েছি সুমন হারিয়ে গেছে তখন আমার বুকটা ভেঙে গেছে। (ছোটাচ্চু বুঝতে পারল সুমন নিশ্চয়ই আকবর হোসেনের পালিয়ে যাওয়া ছেলের নাম) আমরা সব জায়গায় সুমনকে খুঁজে বেড়াচ্ছি তখন খবর পেলাম তুমি ইন্টারনেট থেকে ডিটেকটিভ এজেন্সি বের করে তাদের লাগাচ্ছ। তখন আমি পাগলের মতো ছুটে এসেছি তোমাকে সাবধান করার জন্য। এই ছেলে আমার সর্বনাশ করেছে, তোমার যেন সর্বনাশ করতে না পারে। (এই সময় ডলি খালার গলা আবার ধরে এল, চোখ থেকে মনে হলো দুই ফোঁটা পানিও বের হলো)। ডলি খালা তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি গেলাম দুলাভাই, তুমি পরে আমাকে বোলো না যে আমি তোমাকে সাবধান করি নাই। এই ছেলে আজকে গলায় টাই আর চোখে চশমা লাগিয়ে এসেছে, আসলে ভুসভাস টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়। চোখে নিশ্চয়ই জিরো পাওয়ারের চশমা। যে গাড়ি তাকে নামিয়ে দিয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখো নিশ্চয়ই ভাড়া গাড়ি না হলে কারও কাছ থেকে ম্যানেজ করেছে।’

ছোটাচ্চু এখন একধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে ডলি খালার দিকে তাকিয়ে রইল। যখন বুঝে গেছে এখানে তার সর্বনাশ হয়ে গেছে, তখন এই পুরো নাটকটা উপভোগ করা যেতেই পারে।

ডলি খালা ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ছোটাচ্চু লক্ষ করল চোখ মুছল খুব কায়দা করে, যেন চোখের রং লেপ্টে না যায়। একটু পরেই গাড়ির শব্দ শোনা গেল, বোঝা গেল ডলি খালা চলে গেছে।

আকবর হোসেন চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলেন, তারপর এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে বসলেন। ছোটাচ্চুও তা-ই করল। তখন হঠাৎ মনে হলো গলায় টাইটা ফাঁসের মতো আটকে আছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাই তখন টাইয়ের নটটা প্রথমে একটু ঢিলে করল তারপর খুলেই ফেলল। আকবর হোসেন তখন এক পায়ের ওপর তুলে রাখা অন্য পা’টা সরিয়ে বসল, ছোটাচ্চুও তার পা’টা সরিয়ে নিল। ছোটাচ্চুর তখন মনে হলো সবকিছু মনে হয় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে, তখন জিরো পাওয়ারের চশমাটা খুলে ফেলল। তার চশমা চোখে দিয়ে অভ্যাস নেই তাই চশমাটা খুলতেই কানের ওপর আর নাকের ওপর থেকে চাপটা কমে গেল বলে মনে হলো।

আকবর হোসেন একটু কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। বললেন, ‘ডলি যা যা বলেছে সব সত্যি?’

ছোটাচ্চু কী বলবে একটু চিন্তা করল, তারপর বলল, ‘অনেক কিছু সত্যি কিন্তু যেভাবে বলেছেন সেভাবে সত্যি না।’

‘যদি সত্যি হয় তাহলে আমি তোমাকে দায়িত্বটা দিতে চাই।’

ছোটাচ্চুর মনে হলো সে কথাটা ঠিক করে শোনেনি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বললেন।’

‘বলেছি যে ডলির কথা সত্যি হলে আমি তোমাকে দায়িত্বটা দিতে চাই। তুমি করে বলছি দেখে কিছু মনে করোনি তো? তোমার টাই আর চশমা খোলার পর তোমাকে একটা বাচ্চা মানুষের মতোই লাগছে।’

ছোটাচ্চু জোরে জোরে মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, না কিছু মনে করিনি। তুমি করেই তো বলবেন।’ আসলে ছোটাচ্চুকে অপরিচিত কোনো মানুষ তুমি করে বললে সে খুব বিরক্ত হয়, এখন অবশ্যি অন্য ব্যাপার।

আকবর হোসেন আবার তাঁর একটা পায়ের উপর আরেকটা পা তুলে বললেন, ‘ডলির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তোমার এই ডিটেকটিভ এজেন্সি একটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ। আমি আসলে ঠিক এ রকমই চাইছিলাম, যে একটু সময় দেবে। আমার মনে হয় একটু সময় দিয়ে ঠিকভাবে খোঁজাখুঁজি করলেই সুমনকে বের করে ফেলা যাবে।’

হঠাৎ করে ছোটাচ্চুর ভেতরে হুড়হুড় করে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করল। হাতে কিল দিয়ে বলল, ‘অবশ্যই বের করে ফেলব।’

আকবর হোসেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘পাগল ছেলেটা কেমন যে আছে। আমার মতো হয়েছে। মাথায় একটা কিছু ঢুকে গেলে আর বের করা যায় না।’

‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা, মানে আমি বের করে ফেলব।’

‘থ্যাংক ইউ শাহরিয়ার। তুমি কেমন করে অগ্রসর হতে চাও?’

‘প্রথমে ঘটনাটা আরেকটু বিস্তারিত বলেন, তারপর তার ঘরটা একটু দেখতে চাই। তার খাতাপত্র, ডায়েরি যদি থাকে, সেগুলো দেখতে চাই। তার বন্ধুবান্ধব যাদের আপনারা চেনেন তাদের নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর যদি থাকে সেগুলো নিতে চাই। আপনাদের আত্মীয়স্বজন, যাদের কাছে সে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, তাদের নাম-ঠিকানা চাই। মোটামুটি এগুলো হলেই কাজ শুরু করে দিতে পারব।’

‘গুড।’ আকবর হোসেন সোফায় হেলান দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তাহলে শুরু করি।’ আকবর হোসেন তখন সবকিছু বলতে শুরু করলেন। ছোটাচ্চু খুবই গম্ভীরভাবে তার নোট বইয়ে কিছু কিছু কথাবার্তা টুকে নিতে লাগল।

ছোটাচ্চু যখন বাসায় ফিরে এল তখন বাসার সব বাচ্চা তাকে ঘিরে ধরল, জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘কী হয়েছে ছোটাচ্চু? কী হয়েছে বলো।’

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, ‘তোরা না আমাকে ত্যাজ্য চাচু করে দিয়েছিস—এখন আবার আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিস?’

একজন বলল, ‘আমরা তোমাকে মাফ করে দিয়ে আবার চাচু হিসেবে নিয়ে নিয়েছি।’

‘তোরা নিলেই তো হবে না। আমি এখনো নেইনি।’ ছোটাচ্চু তার মুখটা শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।

বাচ্চারা তখন ছোট ছোট লাফ দিতে দিতে বলতে লাগল, ‘প্লিজ, ছোটাচ্চু। প্লিজ।’

‘আগে বল, আর কোনো দিন আমাকে গোলাম আযমের ভাতিজা বলে গালি দিবি?’

‘দেব না।’

‘কানে ধর।’

সবাই কানে ধরে ফেলল, ছোটাচ্চুর কাছ থেকে এ ধরনের শাস্তি তাদের জন্য কোনো বিষয়ই না। শুধু একজন মিনমিন করে বলল, ‘আমরা এইগুলো করি তোমাকে লাইনে রাখার জন্য। এইভাবে তোমাকে শাসন না করলে তুমি বেলাইনে চলে যাও তো—সেই জন্য।’

ছোটাচ্চু হুংকার দিল, ‘আমি বেলাইনে যাই?’

সবাই হি হি করে হাসতে লাগল বলে ছোটাচ্চু আর বেশিক্ষণ রেগে থাকার ভান করতে পারল না।

ছোটাচ্চু তখন আকবর হোসেনের বাসায় কী হয়েছে সেটা বাচ্চাদের বলল। যেটুকু বলল তার থেকে বেশি অভিনয় করে দেখাল। ডলি খালার নাকিকান্নার অভিনয়টা এত ভালো হলো যে বাচ্চাদের অনুরোধে সেটা কয়েকবার করে দেখাতে হলো।

সব বাচ্চা চলে যাওয়ার পর টুনি বলল, ‘ছোটাচ্চু।’

‘বল।’

তুমি কি ছেলেটার বাসায় দরকারি কিছু পেয়েছ?’

‘কিছু খাতাপত্র পেয়েছি।’

‘ডায়েরি কি আছে?’

‘একটা ডায়েরি আছে কিন্তু সেটা কোনো কাজে লাগবে না।’

‘কেন?’

‘ডায়েরির মধ্যে নিজের কোনো কথা নেই, শুধু বিজ্ঞানের কথা।’

‘বিজ্ঞানের কথা?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘হ্যাঁ, পড়ে আমি কিছু বুঝিও না।’

টুনি বলল, ‘তোমার বোঝার কথা না। বিজ্ঞানের কিছু দেখলে তোমার জ্বর ওঠে।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘শুধু জ্বর না, কেমন যেন অ্যালার্জির মতো হয়। চামড়ার মধ্যে লাল র্যাশ বের হয়। মাথা ঘোরায়।’

টুনি বলল, ‘ওই ছেলেটার খাতাটা আমাকে একটু দেখাবে?’

‘তুই দেখে কী করবি? তুই কি কিছু বুঝবি?’

‘তোমার থেকে বেশি বুঝব।’

টুনি তখন পালিয়ে যাওয়া ছেলেটার ডায়েরিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল। ভেতরে নানা রকম বিজ্ঞানের প্রশ্ন, যেন এক জায়গায় লেখা, ‘প্রোটন আর ইলেকট্রন একটা আরেকটাকে আকর্ষণ করে, তাহলে ইলেকট্রন কেন প্রোটনের ভেতরে পড়ে যায় না, কেন চার্জবিহীন কিছু একটা তৈরি হয় না? কেন হাইড্রোজেন পরমাণু হয়ে থাকে? কেন?’

আরেক জায়গায় লেখা, ‘গতিশীল বস্তুর কাছে দৈর্ঘ্যকে সংকুচিত মনে হয়। তাহলে কি আলোর কাছে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সংকুচিত হয়ে একটা দ্বিমাত্রিক সমতল ভূমি হয়ে যায়?’

আরেকটা জায়গায় লেখা, ‘পৃথিবী থেকে কয়টা ইলেকট্রন চাঁদে নিয়ে গেলে চাঁদ প্রবল আকর্ষণে পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে?’

খাতার অনেক পাতায় নানা রকম হিসাব, হিসাবের শেষে মাঝেমধ্যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। মাঝে মাঝে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন। মাঝে মাঝে গোল বৃত্ত এঁকে তার মাঝে হাসিমুখের ছবি। টুনি কিছুই বুঝল না, শুধু টের পেল এই ছেলেটা ছোটখাটো একটা বৈজ্ঞানিক এবং তার মনের মধ্যে নানা ধরনের প্রশ্ন। অনেক প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পেয়েছে, অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়নি।

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বুঝলি?’

‘উহ্। মনে হচ্ছে এখানে অনেক রকম বিজ্ঞানের প্রশ্ন।’

‘বিজ্ঞানের প্রশ্ন দিয়ে আমার কী লাভ? আমার দরকার তার ঠিকানা। তার নিজের সম্পর্কে তথ্য।’

টুনি কিছু বলল না, ভুরু কুঁচকে খাতাটার দিকে তাকিয়ে রইল।

ছোটাচ্চু পরদিন সকাল থেকেই কাজে লেগে গেল। আকবর হোসেনের কাছ থেকে তার পালিয়ে যাওয়া ছেলে সুমনের বেশ কয়েকজন বন্ধুর নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর নিয়েছিল, ছোটাচ্চু একজন একজন করে তাদের সবাইকে খুঁজে বের করল, তাদের সঙ্গে কথা বলল কিন্তু লাভ হলো না। তারা কেউ সুমনের খোঁজ দিতে পারল না। একজন বলল, ‘দুই সপ্তাহ আগে যখন দেখা হয়েছে তখন কথাবার্তা বলছিল না। চুপ করে বসে থাকত। মনে হয় কিছু একটা চিন্তা করত। পালিয়ে যাবে আমাদের কাউকে বলেনি।’

আরেকজন বলল, ‘আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ভাত কেমন করে রান্না করতে হয় আমি জানি কি না। আমি বললাম, তোর আম্মুকে কেন জিজ্ঞেস করিস না। ‘উহু, আম্মুকে জিজ্ঞেস করা যাবে না।’

আরেকজন বলল, ‘সুমন কোথায় আমি জানি না। কিন্তু আমি যদি জানতাম, আমি আপনাকে বলতাম না। সুমনের ফিজিক্স পড়ার এত শখ, অথচ তার আব্বু তাকে জোর করে ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। তার আব্বুর একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।’

কাজেই ছোটাচ্চু সারা দিন পরিশ্রম করে সন্ধ্যাবেলা মোটামুটি বিধ্বস্ত হয়ে ফিরে এল। রাত্রি বেলা ছোটাচ্চু তার বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করছিল, তখন টুনি এসে হাজির হলো। ছোটাচ্চু টুনির পায়ের শব্দ শুনে টুনির দিকে ঘুরে তাকাল। টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘সুমনের কোনো খোঁজ পেলে?’

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, ‘এখনো পাই নাই। তার বন্ধুরা হয় কিছু জানে না, না হলে আমাকে কিছু বলছে না।’

টুনি কিছু না বলে চুপ করে বসে রইল। ছোটাচ্চু আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বুঝলি টুনি, কোনো কেস সলভ করার আগে একটা ক্লু দরকার হয়। সেই ক্লু দিয়ে শুরু করলে সেখান থেকে অন্য ক্লু বের হয়ে আসে। সেখান থেকে অন্য ক্লু। তখন ক্লুতে ক্লুতে সয়লাব হয়ে যায়। কেস সলভ করা তখন পানির মতো সোজা।’

টুনি এখনো কিছু বলল না। ছোটাচ্চু তখন আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সেটা আগের থেকেও লম্বা। তারপর বলল, ‘কিন্তু এই কেসটায় কোনো ক্লু নেই। ১৬ কোটি মানুষের মাঝ থেকে একজনকে খুঁজে বের করা কি সোজা কথা? যদি খালি একটা ক্লু থাকত।’

অলংকরণ: সাদাত

টুনি বলল, ‘একটা ক্লু তো আছে।’

ছোটাচ্চু সোজা হয়ে বসে বলল, ‘কী ক্লু?’

‘সুমন তার ল্যাপটপ নিয়ে গেছে—তার মানে নিশ্চয়ই ইন্টারনেটে হাজির আছে।’

‘ইন্টারনেটে বাংলাদেশের কত মানুষ আছে তুই জানিস?’

‘কিন্তু সুমনের তো একটা আলাদা শখ আছে। সেই শখটা তো খুব বেশি মানুষের নেই।’

‘কী শখ?’

‘বিজ্ঞান। তার মানে ইন্টারনেটে যারা বিজ্ঞান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, তার মধ্যে নিশ্চয়ই সুমন আছে।’

‘থাকলে আছে। কিন্তু আমি খুঁজে বের করব কেমন করে?’

টুনি সুমনের ডায়েরিটা হাতে নিয়ে বলল, ‘এই যে এই ডায়েরিটা দিয়ে।’

‘এই ডায়েরিটা দিয়ে? কীভাবে?’

‘এর মধ্যে অনেক প্রশ্ন। তার মানে সুমন এই প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করে। তুমি এই প্রশ্নগুলো তোমার নিজের মতো করে ইন্টারনেটে দাও। জিজ্ঞেস করো। তাহলে একদিন যখন সুমনের চোখে পড়বে, সে উত্তর দেবে।’

‘সুমনের চোখে যদি না পড়ে?’

তোমার পরিচিত একজন আছে না যে এইগুলো খুব ভালো বোঝে, তোমার ইনফেকশনওয়ালা ওয়েবসাইট তৈরি করে দিয়েছে?’

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, ‘মোটেই ইনফেকশনওয়ালা না।’

‘ঠিক আছে। তুমি সেই ছেলেকে বলো সে যেন তোমার প্রশ্নগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে দেয়, যেন অনেক মানুষের চোখে পড়ে। সে নিশ্চয়ই পারবে।’

ছোটাচ্চুর মুখে প্রথমে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব চলে এল, আস্তে আস্তে তাচ্ছিল্যের ভাবটা চলে গিয়ে সেখানে উৎসাহের ভাব চলে আসতে থাকে। তারপর তার চোখ-মুখ উত্তেজনায় চকচক করতে থাকে, হাতে কিল দিয়ে বলে, ‘টুনটুনি। তুই একটা জিনিয়াস।’

টুনি বলল, ‘তোমার সঙ্গে তুলনা করলে যেকোনো মানুষ জিনিয়াস।’

ছোটাচ্চু তখনই কাজে লেগে গেল। সে যেহেতু বিজ্ঞানের ‘ব’ পর্যন্ত জানে না, তা ছাড়া বিজ্ঞান নিয়ে তার একটা অ্যালার্জির মতো ভাব আছে, তাই সে সুমনের ডায়েরিটা নিয়ে গেল তার বিজ্ঞান জানা একজন বন্ধুর কাছে। সে ডায়েরি থেকে বেছে বেছে ১০টা প্রশ্ন নিয়ে সেটা টাইপ করিয়ে নিল, তারপর সেগুলো নিয়ে গেল তার ইন্টারনেটের এক্সপার্ট বন্ধুর কাছে। সে ব্যবস্থা করে দিল যেন ইন্টারনেটে তার প্রশ্নগুলো অনেকে দেখতে পায়। যারা প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় তাদের উত্তর পাঠানোর জন্য একটা ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে রাখা হলো। তারপর ছোটাচ্চু সেই ই-মেইলে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর আসতে শুরু করল। বেশির ভাগই বাচ্চা, কেউ কেউ উত্তর হিসেবে কিছু একটা লিখে পাঠিয়েছে, কেউ কেউ জানতে চেয়েছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে ছোটাচ্চু কী করবে। দ্বিতীয় দিনে ছোটাচ্চু সুমনের কাছ থেকে উত্তর পেল। ই-মেইল ঠিকানা বা চিঠির শেষে কোথাও সুমনের নাম লেখা নেই কিন্তু ছোটাচ্চুর বুঝতে কোনো অসুবিধে হলো না, এটা সুমন। কারণ, এখানে লেখা:

‘এই দশটা প্রশ্ন দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি। কারণ, এই প্রশ্নগুলো আমারও প্রশ্ন। আমি কয়েকটা উত্তর চিন্তা করে বের করেছি। অন্য প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করার চেষ্টা করছি। তুমি বের করতে পারলে আমাকে জানিও।’

চিঠিটা পেয়ে ছোটাচ্চুর উত্তেজনার শেষ নেই। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সে উত্তর পাঠাল:

‘তুমি যে প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করেছ, সেগুলো কি আমাকে পাঠাবে?’

উত্তরে সুমন লিখল:

‘পাঠালাম।’

ছোটাচ্চু লিখল:

‘ফ্যান্টাস্টিক। তুমি কী করো? কলেজ-ইউনিভার্সিটির মাস্টার?’

সুমন লিখল: ‘হা হা হা। আমি কলেজ-ইউনিভার্সিটির মাস্টার না। ইউনিভার্সিটিতে ঢুকব।’

ছোটাচ্চু অবশ্যি শুধু ই-মেইল চালাচালি করে বসে রইল না, ইউনিভার্সিটির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে দুইটা প্রশ্নের উত্তর বের করে নিয়ে এসে সুমনকে লিখল: ‘আমি আরও দুইটা প্রশ্নের উত্তর বের করেছি। তুমি কি দেখতে চাও?’

সুমন লিখল:

‘অবশ্যই।’

ছোটাচ্চু তখন অনেক চিন্তা-ভাবনা করে লিখল: ‘হাতে লেখা উত্তর। ই-মেইলে কেমন করে পাঠাব?’

সুমন লিখল: ‘স্ক্যান করে পাঠাতে পারো।’

‘ছোটাচ্চু লিখল: ‘ধারে-কাছে স্ক্যানার নেই। তোমার বাসা কোথায়? ধারে-কাছে হলে হাতে হাতে দিতে পারি।’

সুমন পুরো এক দিন এর উত্তর দিল না। তারপরে লিখল: ‘তুমি কে? কী করো?’

ছোটাচ্চু তখন বিপদে পড়ে গেল। সে এখন কী লিখবে? যখন চিন্তা করতে করতে ঘেমে গেল তখন টুনি তাকে সাহায্য করল। বলল, ‘লেখো, তুমি বিজ্ঞানের একটা বই লেখার চেষ্টা করছ। সেই জন্য বিজ্ঞানের মজার মজার প্রশ্ন আর তার উত্তর খুঁজে বের করছ।’

ছোটাচ্চু চিন্তিত মুখে বলল, ‘যদি আমাকে বিজ্ঞানের কোনো একটা প্রশ্ন করে বসে?’

‘সামনাসামনি তো তোমাকে পাচ্ছে না। কেমন করে প্রশ্ন করবে?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘তা ঠিক।’ তারপর সুজনকে লিখল: আমি একটা বিজ্ঞানের বই লিখছি। বইমেলায় বের করার ইচ্ছা। সেই জন্য মজার মজার প্রশ্ন আর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি।’

সুমন লিখল: ‘আমার কাছে আরও মজার প্রশ্ন আছে।’

ছোটাচ্চু লিখল: ‘আমাকে দিবে?’

সুমন লিখল: ‘হাতে লেখা প্রশ্ন। আমার কাছেও স্ক্যানার নেই। হা হা হা।’

ছোটাচ্চু আবার তার বাসা বের করার চেষ্টা করল: ‘তোমার বাসা কোথায়? কাছাকাছি হলে হাতে হাতে দিতে পারো।’

সুমন যেখানেই তার বাসা লিখুক না কেন, ছোটাচ্চু লিখবে তার বাসা ঠিক সেখানেই। তারপর সেখানে চলে যাবে। কিন্তু সুমন তাকে বিপদে ফেলে দিল, পাল্টা প্রশ্ন করল:

‘তোমার বাসা কোথায়?’

এখন তার বাসা যদি কাছাকাছি না হয়, তাহলে তো বিপদ হয়ে যাবে। টুনি আবার তাকে সাহায্য করল, বলল, ‘ছোটাচ্চু তুমি তোমার বাসাটা কোথায় লেখো। যদি তার বাসা থেকে দূরে হয় তখন ভান করবে ঠিক সেখানে একটা কাজে গিয়েছ।’

ছোটাচ্চু লিখল: ‘আমার বাসা মিরপুর।’

সুমন লিখল: ‘আমার বাসা উত্তরা। সরি।’

ছোটাচ্চু হাতে কিল দিয়ে বলল, ‘অন্তত বাসাটা কোথায় বের করে ফেলেছি। সুমন উত্তরায় আছে।’

টুনি বলল, ‘এখন তুমি লেখো, কাল-পরশু তুমি উত্তরা যেতে পারো। তখন ইচ্ছে করলে তুমি তাকে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারো, তার প্রশ্নগুলো নিতে পারো। বেশি উৎসাহ দেখিয়ো না, তাহলে সন্দেহ করবে।’

ছোটাচ্চু লিখল: ‘উত্তরায় আমার ডেন্টিস্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমি কাল উত্তরায় যাব। তুমি চাইলে তখন দিতে পারো।’

টুনি জিজ্ঞেস করল, ‘এত কিছু থাকতে ডেন্টিস্ট অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা কেন বলছ?’

ছোটাচ্চু হে হে করে হেসে বলল, ‘বুঝলি না? ভান করব দাঁতে ব্যথা, কথা বলতে পারছি না। বিজ্ঞানের প্রশ্ন যদি করে ফেলে, ধরা পড়ে যাব না?’

সুমনকে শেষ পর্যন্ত টোপ খাওয়ানো গেল। সে উত্তরার একটা ফাস্টফুডের দোকানের ঠিকানা দিয়ে বলল, সন্ধ্যাবেলা সেখানে গেলে সে তার মজার প্রশ্নগুলো দিয়ে যাবে। সেই ই-মেইলটা পেয়ে সুমন একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল এবং সেই চিৎকার শুনে ছোটদের সঙ্গে সঙ্গে বড়রাও চলে এল। বড়রা যখন বুঝল কোনো বিপদ আপন হয়নি, তখন যে যার মতো চলে গেল, শুধু বাচ্চারা থেকে গেল।

একজন জিজ্ঞেস করল, ‘পালিয়ে যাওয়া ছেলেটাকে খুঁজে পেয়েছ?’

ছোটাচ্চু বুকে থাবা দিয়ে বলল, ‘ইয়েস। কাল সন্ধ্যায় দেখা হবে।’

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন করে খুঁজে বের করলে ছোটাচ্চু?’

ছোটাচ্চু গম্ভীর মুখে বলল, ‘এটা একই সঙ্গে বুদ্ধি, মেধা, বিশ্লেষণ, তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং কঠোর পরিশ্রমের ফসল।’

ছোটাচ্চুর গম্ভীর মুখ দেখে বাচ্চারাও মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়ল। শুধু টুনি মুখ টিপে হাসল।

শান্ত জিজ্ঞেস করল, ‘কালকে যখন দেখা হবে, তখন তুমি কী করবে?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আমি এখন তার বাবাকে জানাব। বাবা সেই ফাস্টফুডের দোকানের কাছে অপেক্ষা করবে, আমি যখন সুমনের সঙ্গে কথা বলব তখন তার বাবা এসে ক্যাঁক করে ধরে ফেলবে।’ ছোটাচ্চু আনন্দে হা হা করে হাসল। অন্যরা কেউ তার হাসিতে যোগ দিল না।

টুনি বলল, ‘কালকে তার বাবাকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।’

‘কেন?’

‘যদি কোনো কারণে সুমন না আসে, তাহলে তুমি লজ্জা পাবে। তুমি যদি তার ঠিকানাটা বের করে আনতে পারো, তাহলে সেই ঠিকানাটা পরে যেকোনো সময়ে তার আব্বুকে দিতে পারো।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘ঠিকই বলেছিস। কালকে কোথায় থাকে দেখে আসি।’ যখন হানড্রেড পারসেন্ট শিওর হব, তখন জানাব।’

সবাই চলে গেলে টুনি বলল, ‘ছোটাচ্চু’।

‘কী হলো?’

‘কালকে তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যেয়ো।’

‘তোকে? কেন?’

‘তুমি যদি সুমনের পেছনে পেছনে যাওয়ার চেষ্টা করো, সে ঝুলে যাবে। তাই তুমি বসে থাকবে। আমি ওর বাসাটা চিনে আসতে যাব।’

‘তু-তুই!’

‘হ্যাঁ। আমি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। মনে আছে?’

ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, ‘তুই যাবি?’

‘হ্যাঁ। সমস্যা কোথায়?’

ছোটাচ্চু চিন্তা করে দেখল, আসলে সে রকম সমস্যা নেই। রাস্তাঘাটে শত শত মানুষ হাঁটাহাঁটি করে, তার মাঝে একটা বাচ্চা মেয়ে তো হেঁটে হেঁটে যেতেই পারে। ছোটাচ্চু তো একেবারে একা ছেড়ে দিচ্ছে না, সে তো আশপাশেই আছে। সময়টা সন্ধ্যাবেলা, যখন মানুষজন হাঁটাহাঁটি করে।

অলংকরণ: সাদাত

ছোটাচ্চু ফাস্টফুডের দোকানে ঢোকার আগে তার মুখে কিছু তুলা ঢুকিয়ে নিল, যেন মুখের বাঁ পাশটা একটু ফুলে থাকে। ডেন্টিস্টের কাছে যারা যায়, তাদের দাঁতে ব্যথা থাকে, মুখ ফুলে থাকে। টুনি কোথায় অপেক্ষা করবে সেটা আগে থেকে ঠিক করা ছিল না কিন্তু কপাল ভালো, রাস্তার ঠিক উল্টো পাশে একটা বইয়ের দোকান পেয়ে গেল। টুনি সেখানে বই দেখতে দেখতে চোখের কোনা দিয়ে ছোটাচ্চুকে লক্ষ করতে লাগল।

ঠিক সাতটার সময় চোখে চশমা হালকা-পাতলা একটা ছেলে হাতে কিছু কাগজ নিয়ে ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকল। ছোটাচ্চু আর টুনি দুজনেই ছেলেটাকে চিনতে পারল, তার বাবা এই ছেলেটারই ছবি দিয়েছেন। ছেলেটা সুমন।

সুমন ফাস্টফুডের দোকানে যারা বসে খাচ্ছে তাদের সতর্ক চোখে লক্ষ করে, তখন ছোটাচ্চু হাত নেড়ে তাকে ডাকল। সুমন ছোটাচ্চুর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আপনি কি বিজ্ঞান লেখক?’

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, ‘গাবা গাবা গাবা—’

দাঁত ব্যথা সে জন্য মুখ খুলে কথা বলতে পারছে না এ রকম ভান করে অভিনয় করতে গিয়ে কোনো শব্দই বের হয় না এ রকম বিচিত্র কথা বলে ফেলেছে!

সুমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, বলল, ‘কী বললেন?’

ছোটাচ্চু হাত দিয়ে তার মুখ দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল যে তার দাঁতে ব্যথা, তাই কথা বলতে পারছে না। অস্পষ্টভাবে বলল, ‘আমা দাঁতা বাথা—কাথা বালতা পারা না।’

‘আপনার দাঁতে ব্যথা? কথা বলতে পারেন না?’

ছোটাচ্চু জোরে জোরে মাথা নাড়ল। সুমন বলল, ‘তাহলে কথা বলার দরকার নেই। এই যে আমার প্রশ্ন। বলে সে কাগজগুলো ছোটাচ্চুর দিকে বাড়িয়ে দিল।’

ছোটাচ্চু প্রশ্নগুলো নিয়ে তার কাগজগুলো এগিয়ে দিয়ে আবার দাঁত ব্যথার জন্য কথা বলতে না পারার কারণে কষ্ট করে কথা বলার অভিনয় করল, ‘তামার পাশ্নার আত্তার।’

‘আমার প্রশ্নের উত্তর?’

ছোটাচ্চু জোরে জোরে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, ‘চা কাফা খাবা?’

সুমন মাথা নাড়ল, ‘না, আমি চা-কফি খাব না। আমি যাই।’ বলে এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফাস্টফুডের দোকান থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে কয়েকবার পেছন ফিরে দেখল। ছোটাচ্চু বের হয়নি তাই সে সন্দেহজনক কিছু পেল না। টুনি পেছনেই ছিল, তাকে সে মোটেও সন্দেহ করল না। একটু সামনেই একটা ছয়তলা বিল্ডিংয়ের ভেতর সুমন তাড়াতাড়ি ঢুকে গেল। টুনি বিল্ডিংটা পার হয়ে গিয়ে আবার ঘুরে এল। ছোটাচ্চু ততক্ষণে ফাস্টফুডের দোকান থেকে বের হয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। টুনিকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘বাসাটা দাখা আসাছাস?’

টুনি বলল, ‘তোমার এখন আর দাঁত ব্যথার ভান করতে হবে না। ঠিক করে কথা বলতে পারো।’

ছোটাচ্চুর হঠাৎ করে সেটা মনে পড়ল, মুখের ভেতর থেকে তুলাটা বের করে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘বাসাটা দেখে এসেছিস?’

‘হ্যাঁ। কাছেই ছয়তলা বিল্ডিং। বাসার নম্বর তেতাল্লিশ।’

‘গুড! ফ্যান্টাস্টিক। আয় বাসায় যাই।’

টুনি কথা না বলে ছোটাচ্চুর সঙ্গে হাঁটতে থাকে।

‘আকবর হোসেনকে ফোন করে বলতে হবে তার ছেলের খোঁজ পেয়েছি। অসাধারণ!’

টুনি কোনো কথা বলল না।

‘ডলি খালার কেসটা গুবলেট হয়ে গিয়েছিল। এইটা হয়নি।’

টুনি এবারও কোনো কথা বলল না। ছোটাচ্চু বলল, ‘কত টাকা বিল করা যায় ঠিক করতে পারছি না। কম করা যাবে না, আবার বেশিও করা যাবে না। প্রতি ঘণ্টার একটা হিসাব দিতে হবে। কী বলিস?’

টুনি এবারও কোনো কথা বলল না। ছোটাচ্চু উৎসাহে টগবগ করতে থাকে, হাতে কিল দিয়ে বলল, ‘বাবাটা কত খুশি হবে!’

টুনি ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সুমনের বাবা এখন কী করবে ছোটাচ্চু।’

‘ধরে বাসায় নিয়ে যাবে।’

‘তারপর কী করবে?’

‘বাবাটা একটু কঠিন টাইপের মানুষ। ধরে পিটুনি দিতে পারে।’

‘তারপর?’

‘তারপর নিশ্চয়ই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি করে দেবে?’

‘তার মানে সুমন আর বৈজ্ঞানিক হতে পারবে না!’

‘মনে হয় পারবে না। বাবাটা খুবই কঠিন মানুষ।’

টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

বাসায় পৌঁছার সঙ্গে টুনি কয়েক সেকেন্ডের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ছোটাচ্চু যখন বাথরুমে হাত-মুখ ধুয়ে আকবর হোসেনকে ফোন করার জন্য ফোনটা নিয়েছে, তখন হঠাৎ তার ঘরে সব বাচ্চাকাচ্চা হাজির হলো। তাদের মুখ থমথম করছে। ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, ‘তোদের কী হয়েছে?’

বাচ্চাদের ভেতরে বড় একজন বলল, ‘ছোটাচ্চু, তুমি ফোনটা রাখো।’

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, ‘ফোনটা রাখব? কেন?’

টুনি বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা আছে।’

‘কথা থাকলে কথা বলবি। এখন বিরক্ত করিস না। যা সবাই। ভাগ।’

বাচ্চাগুলো যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখাল না বরং আরেকটু এগিয়ে এল। শান্ত বলল, ‘আমাদের কথা আছে ছোটাচ্চু।’

‘ফোনটা করে নিই। জরুরি ফোন।’

‘উহু। ফোন করার আগে কথা। আমরা তোমাকে ফোন করতে দেব না।’

ছোটাচ্চু এবার সত্যি সত্যি রেগে গেল, ‘আমাকে ফোন করতে দিবি না। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি?’

টুনি বলল, ‘তোমার নিজের ভালোর জন্যে বলছি।’

‘আমার নিজের ভালোর জন্য?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী রকম?’

‘তুমি এখন সুমনের আব্বুকে ফোন করতে যাচ্ছো। তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘ফোন করে তুমি ঠিকানাটা দেবে। তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি ঠিকানাটা জানো?’

‘জানব না কেন? তুই পেছন পেছন গিয়ে দেখে এসেছিস। তেতাল্লিশ নম্বর ছয়তলা বিল্ডিং।’

‘আমি তোমাকে সত্যিকারের ঠিকানাটা বলিনি।’

ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কী বললি!’

‘তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি।’

ছোটাচ্চু রাগের চোটে কথাই বলতে পারছিল না। বলল, ‘তু-তু-তুই?’

বাচ্চাদের ভেতরে যে বড় সে গম্ভীর গলায় বলল,

‘আমরা সবাই সুমনের পক্ষে। আমরা সুমনকে তার বাবার হাত থেকে রক্ষা করব।’

ছোটাচ্চু রাগের চোটে তোতলা হয়ে গেল, বলল, ‘র-র-র-রক্ষা করবি? বা-বা-বাবার হাত থেকে?’

‘হ্যাঁ।’

ছোট একজন বলল, ‘আমরা সুমন ভাইয়ার জন্য টাকা তুলতে শুরু করেছি, এর মধ্যে সাতাইশ টাকা উঠে গেছে।’

আরেকজন বলল, ‘বিশ্বাস না করলে তুমি গুনে দেখো।’ একজন ছোট একটা কৌটা তার দিকে এগিয়ে দেয়, সত্যি সত্যি তার ভেতরে দোমড়ানো-মোচড়ানো কিছু টাকা।’

ছোটাচ্চুর টাকাগুলো গুনে দেখার ইচ্ছে আছে বলে মনে হলো না। চোখ পাকিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত বলল, ‘আমরা সবাই চাই সুমন ভাইয়া বৈজ্ঞানিক হোক। বৈজ্ঞানিক হয়ে এমন যন্ত্র আবিষ্কার করুক, যেইটা দিয়ে স্বৈরাচারী বাবাদের শাস্তি দেওয়া যায়।’

একজন শুদ্ধ করে দিল, ‘বাবা আর মা।’

আরেকজন, যার লেখাপড়া করায় বেশি উৎসাহ নেই বলল, ‘এমন একটা যন্ত্র আবিষ্কার করবে, যেটা দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে না, মাথার মধ্যে নিজে নিজে লেখাপড়া ঢুকে যাবে।’

টুনি বলল, ‘তাই তুমি এখন সুমন ভাইয়ার বাবার পক্ষে কাজ করতে পারবে না। সুমন ভাইয়ার পক্ষে কাজ করতে হবে।’

ছোটাচ্চু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। বলল, ‘যদি না করি?’

শান্তর মুখে একটা ফিচলে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘তুমি করবে ছোটাচ্চু।’

‘তোর কেন সেটা মনে হচ্ছে?

‘তার কারণ, তুমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাও যে জিনিসটাকে, আমরা সেইটা ধরে এনেছি!

ভয়-ডর নেই সেই রকম একজন দেখাল সে ডান হাতে গোবদা একটা মাকড়সা ধরে রেখেছে। সে মাকড়সাটা ধরে রেখে ছোটাচ্চুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার ভান করল। ছোটাচ্চু ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে লাফ দিতে গিয়ে চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে পানির গ্লাসটা নিচে ফেলে একটা তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলল।

অলংকরণ: সাদাত

ভয়-ডর নেই সেই ছেলেটার হাতে আটকা পড়া মাকড়সটা কিলবিল করে নড়ছে, সেই দৃশ্য দেখে ছোটাচ্চুর প্রায় হার্টফেল করার মতো অবস্থা হলো। ছোটাচ্চু গড়িয়ে ঘরের এক কোনায় গিয়ে দুই হাত সামনে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘না, না, না, না—’

ছেলেটা বলল, ‘তুমি যদি সুমন ভাইয়ার জন্য কাজ না করো, তাহলে এই মাকড়সাটা আমি তোমার গায়ে ছেড়ে দেব।’

শান্ত বলল, ‘মাকড়সাটা এখনো জ্যান্ত, সেটা তোমার শরীরের ওপর দিয়ে তিরতির করে হেঁটে যাবে।’

আরেকজন বলল, ‘হয়তো তোমার কানের ফুটো দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে।’

‘আমাদের রান্নাঘরে এর চেয়ে বড় একটা মাকড়সা আছে। পেটে বিস্কুটের মতো একটা ডিম। এর পরে সেইটাও ধরে আনব।’

ছোটাচ্চু দুই হাত জোড় করে বলল, ‘প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ! মাকড়সাটা সরিয়ে নিয়ে যা। তোরা যা বলছিস সব শুনব। সব শুনব।’

মাকড়সা হাতে ভয়-ডরহীন ছেলেটা বলল, ‘বলো, খোদার কসম।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘খোদার কসম।’

তখন মাকড়সা হাতের ছেলেটা তার হাতটা নামিয়ে একটু পিছিয়ে আসে। ছোটাচ্চু ভাঙা গলায় বলল, ‘প্লিজ সোনামণি, মাকড়সাটা বাইরে ছেড়ে দিয়ে হাতটা ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেল। প্লিজ।’

‘তুমি আগে বলো কীভাবে কী করবে? তার পরে।’

ছোটাচ্চু ভাঙা গলায় বলল, ‘আমাকে বিশ্বাস কর। আমিও সুমনের পক্ষে। আয় সবাই মিলে ঠিক করি কী করা যায়। আগে মাকড়সাটা ফেলে দিয়ে আয়। প্লিজ।’

ভয়-ডরহীন ছেলেটা মাকড়সাটা বাইরে ছেড়ে দিতে গেল আর ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে তার বিছানায় উঠে বসল।

শান্ত বলল, ‘এখন বলো তুমি কী করবে?’

ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, ‘আমার মনে হয় ইয়ে মানে—’

টুনি বলল, ‘তুমি ফারিহা আপুকে ফোন করো। ফোন করে তার কাছ থেকে বুদ্ধি নাও। ফারিহা আপুর মাথায় চিকন বুদ্ধি। তোমার বুদ্ধি মোটা।’

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ফারিহা আপুর মাথায় চিকন বুদ্ধি।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তাহলে ফারিহার সঙ্গে কথা বলব।’

টুনি বলল, ‘এখনই বলো। সবার সামনে বলো।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘তোরা আমাকে বিশ্বাস করছিস না?’

‘করছি। কিন্তু আমরা ফারিহা আপুকে আরও বেশি বিশ্বাস করি।’

ছোটাচ্চু তখন মুখটা একটু ভোঁতা করে ফারিহাকে ফোন করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরে ফারিহা বলল, ‘কী খবর? কেস সলভ হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, হয়েছে।’

‘কংগ্রাচুলেশন্স’, তুমি তাহলে সচিত্র ডিকেটটিভ হয়ে যাচ্ছো। ওয়ান্ডারফুল। বাংলাদেশের শার্লক হোমস।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘কেস সলভ হওয়ার পর একটা নতুন কেস হয়েছে।’

‘নতুন কেস? সেটা কী রকম?’

ছোটাচ্চু ইতস্তত করে বলল, ‘আমাদের বাসার বাচ্চাদের তো তুমি জানো! তারা সবাই এসে আমাকে ধরেছে, আমি যেন সুমন ছেলেটিকে তার বাবার কাছে ধরিয়ে না দিই।’

‘ঠিকই তো বলেছে। আমিও কখনো চাইনি এই রকম একটা বাবা জোর করে তার ছেলের ওপর সবকিছু চাপিয়ে দেবে।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘বাচ্চারা সবাই চাইছে তোমার সঙ্গে কথা বলে আমরা বাবার হাত থেকে ছেলেটাকে রক্ষা করি।’

‘তাই চাইছে?’

‘হ্যাঁ। এরা সুমনের জন্য একটা ফান্ডও তোলা শুরু করেছে। এর মধ্যে সাতাইশ টাকা উঠে গেছে।’

‘ওদের বলো, আমি তাদের ফান্ডে আরও সাতাইশ টাকা দিয়ে দিলাম। সাতাইশ প্লাস সাতাইশ ইকুয়েলস টু চুয়ান্ন।’ বলল। এখন কী করা যায় বলো।’

ফারিহা বলল, ‘ছেলেটার ঠিকানা যেহেতু আমরা পেয়ে গেছি, এখন সেইটা দিয়েই তার বাবাকে টাইট করা যাবে।’

‘কীভাবে?’

‘এক শ একটা উপায় আছে। কালকে বিকেলে চল তার বাবার বাসায় যাই।’

‘তুমিও যাবে।’

‘কেন নয়। মহৎ কাজে আমাকে কখনো পিছিয়ে যেতে দেখেছ?’

‘ঠিক আছে।’

ফোনটা রাখার পর বাচ্চারা আনন্দের শব্দ করল। টুম্পা বলল, ‘ছোটাচ্চু তোমার মুখটা একটু নিচে নামাবে?’

‘কেন?’

‘তোমার গালে আদর করে একটা চুমু দিয়ে দিই। তুমি খুবই সুইট।’

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ, ছোটাচ্চু। তুমি খুবই সুইট। অসাধারণ। পৃথিবীর বেস্ট ছোটাচ্চু।’

ছোটাচ্চু মুখটা নামাল, তখন শুধু টুম্পা নয় তার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাইও তার গালে ধ্যাবড়া করে একটা চুমু দিয়ে দিল।

ছোটাচ্চু আর ফারিহা গাড়ি থেকে নেমে আকবর হোসেনের দরজার বেল বাজাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আকবর হোসেন দরজা খুললেন, ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এসো শাহরিয়ার। তুমি বলেছ খবর আছে, আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘এ হচ্ছে ফারিহা। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। আজকে আমার সঙ্গে জোর করে চলে এল।’

সাংবাদিক শুনে আকবর হোসেন কেমন যেন থিতিয়ে গেলেন, দুর্বল গলায় বললেন, ‘আসেন, ভেতরে আসেন।’

দুইজন ভেতরে গিয়ে বসার আগেই সুমনের মা আর বোন ঘরে ঢুকল। সুমনের মা একধরনের ব্যাকুল গলায় বললেন, ‘আমার ছেলেটার খোঁজ পেয়েছ বাবা?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘জি, বলছি। আপনি বসেন।’

ভদ্রমহিলা বসলেন, তাঁর মেয়েটি মাকে ধরে পাশে বসে পড়ল। আকবর হোসেনও বসলেন, তাঁর মুখে কেমন যেন অপরাধী অপরাধী ছাপ ফুটে উঠেছে।

ছোটাচ্চু বলল, ‘আমার ধারণা, আপনাদের ছেলেকে আমরা খুঁজে বের করতে পেরেছি—’

ভদ্রমহিলা ব্যাকুল গলায় বললেন, ‘কোথায় আছে? কোথায়?’

মেয়েটা চিৎকার করে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।

ছোটাচ্চু বলল, ‘বলছি, কিন্তু এই কেসটা নিয়ে আমি একটা সমস্যায় পড়ে গেছি।’

আকবর হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী সমস্যা?’

‘আমার কাজের জন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। সাংবাদিকেরা এটার খোঁজ পেয়ে গেছে, এখন তাঁরা এটা নিয়ে একটা স্টোরি করতে চায়। পজিটিভ স্টোরি করলে আমার কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু স্টোরিটা নেগেটিভ। আমি যদি আমার ডিকেটটিভ এজেন্সিটাকে দাঁড় করতে চাই, এই সময়ে যদি নেগেটিভ স্টোরি করে—’

ফারিহা এই সময় ছোটাচ্চুকে থামিয়ে বলল, ‘আমি বিষয়টা বুঝিয়ে বলি। স্টোরি নেগেটিভ হয় না, পজিটিভও হয় না। স্টোরি হয় সত্যি। কাজেই আমরা সত্যি কথাটা বলতে চাই। সত্যি কথা হচ্ছে, একটা মেধাবী ছেলে বিজ্ঞানকে ভালোবাসে কিন্তু তার পরিবার তাকে বিজ্ঞান পড়তে দেবে না। তাকে বলা হয়েছে, যদি তাকে বিজ্ঞান পড়তে হয় নিজের উপার্জনে পড়তে হবে। ছেলেটি বিজ্ঞানকে এত তীব্রভাবে ভালোবাসে যে সে বাসা ছেড়ে চলে গেছে, নিজে নিজে উপার্জন করে পড়ছে। আমরা এই সত্যি কথাটা বলতে চাই যে পরিবার তাকে ঘরছাড়া করেছে—’

সুমনের মা তীব্র গলায় চিৎকার করে বললেন, ‘মা, তুমি পরিবার বোলো না। আমরা কিছু করিনি। সবকিছু করেছে সুমনের বাবা—’ আঙুল দিয়ে আকবর হোসেনকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই বাবা। আমরা কত বোঝানোর চেষ্টা করেছি। বোঝেনি। ছেলেটাকে ঘরছাড়া করেছে।’

ফারিহা ব্যাগ থেকে একটা নোটবই বের করে দ্রুত লিখতে থাকে, মুখে গম্ভীর করে বলল, ‘তাহলে বাবার একার ইচ্ছা। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই?’

আকবর হোসেন অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বললেন, ‘আমি ঠিক এসব ব্যক্তিগত তথ্য পত্রপত্রিকায় দেখতে চাই না।’

ছোটাচ্চু বলল, ‘আমিও চাই না। কিন্তু এখন সাংবাদিকেরা খবর পেয়ে গেছে। আমার পেছনে ছিনেজোঁকের মতো লেগে গেছে।’

ফারিহা হুংকার দিয়ে ছোটাচ্চুকে বলল, ‘আপনি কী বললেন? আমাকে ছিনেজোঁক বললেন?’

ছোটাচ্চু বলল, ‘না, মানে ইয়ে—আন্তরিকভাবে বলি নাই। কথার কথা বলতে গিয়ে—’

ফারিহা আরও জোরে হুংকার দিল, ‘কথার কথা বলতে গিয়ে আপনি অপমানসূচক কথা বলবেন? আপনি এই মুহূর্তে কথাটা প্রত্যাহার করেন, তা না হলে আপনার বিরুদ্ধে, আপনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

ছোটাচ্চু ফারিহার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলো। সেও অভিনয়ের চেষ্টা করতে লাগল। বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি ছিনেজোঁক কথাটা প্রত্যাহার করলাম। আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করছেন।’

ফারিহা মুখ শক্ত করে বলল, ‘থ্যাংকু।’

ছোটাচ্চু আবার আকবর হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একটা ভালো কাজ করতে গিয়ে আমি বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি। সাংবাদিকেরা পত্রিকার রিপোর্ট করার সময় আমার নাম দিয়ে দেবে, সবাইকে বলবে আমি টাকার বিনিময়ে মেধাবী বিজ্ঞানপিপাসু একটা ছেলেকে তার নিষ্ঠুর বাবার হাতে তুলে দিয়েছে। ভবিষ্যতে আমার একটা খারাপ পাবলিসিটি হয়ে যাবে। আমি সেটা চাই না।’

আকবর হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কী চান?’

‘আপনি এই সাংবাদিকদের বোঝান, তাঁরা যেন এই স্টোরিটা না করেন।’

ফারিহা মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলল, ‘আপনার ধারণা, আপনারা চাইলেই আমরা সাংবাদিকেরা সত্যি প্রকাশ করা বন্ধ রাখব? আপনি কি জানেন, আমাদের দেশে বাচ্চাদের তাদের বাবা-মায়েরা কী পরিমাণ যন্ত্রণার মধ্যে রাখে? তাদের কী পরিমাণ চাপ দেয়? কী রকম ভয়ংকর প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে রাখে? এটা তো শুধু একটা স্টোরি না, এ রকম অনেক স্টোরি আমাদের কাছে আছে। আমরা একটা একটা করে প্রকাশ করব।’

সুমনের ছোট বোনটি কোনো কথা না বলে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সবার কথা শুনছিল। এই প্রথম সে কথা বলার চেষ্টা করল, তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আব্বু, আমি একটা কথা বলি?’

‘কী কথা?’

‘তুমি ভাইয়াকে বলো তার যেটা ইচ্ছা সে পড়তে পারবে। তুমি বলো, ভাইয়া যদি সায়েন্টিস্ট হয়, তাহলে তুমি খুব খুশি হবে। তাহলেই এই সাংবাদিকেরা কিছু লিখবেন না।’ মেয়েটি ফারিহার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাই না আপু?’

ফারিহা বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়ার খুব চমৎকার অভিনয় করল, তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, তাহলে এই কেসটা নিয়ে লিখতে পারব না। কিন্তু আমাদের অন্য অনেক কেস আছে।’

মেয়েটা বলল, ‘সেগুলো নিয়ে লেখেন, বেশি বেশি করে লেখেন।’ তারপর আবার তার আব্বুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলো আব্বু, আমরা সবাই গিয়ে ভাইয়াকে নিয়ে আসি।’

সুমনের আম্মু আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন। আকবর হোসেন গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘আসলে কাজটা আমি বেকুবের মতোই করেছি। নিজের ছেলেকে বুঝতে পারিনি এ রকম একটা বাবা কেমন করে হলাম? চলো, সবাই মিলে যাই। ছেলেটাকে নিয়ে আসি।’

উত্তরার সাতাইশ নম্বর বাসাটির (তেতাল্লিশ নয়!) ছয়তলার একটা ছোট রুমে সুমন আর আরও দুজন ছেলে যখন ফ্লোরে খবরের কাগজ বিছিয়ে আলুভর্তা আর সেদ্ধ ডিম দিয়ে ভাত খাচ্ছিল তখন আকবর হোসেন, তাঁর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। তাঁদের দেখে সুমনের ছেলেমানুষি মুখটা হঠাৎ করে কঠিন হয়ে গেল।

আকবর হোসেন বললেন, ‘বাবা! আমার ওপর রাগ করিস না। বাসায় চল। আমি কথা দিচ্ছি, তোর যেটা ইচ্ছা তুই পড়বি। তুই চাইলে তোকে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে পিএইচডি করতে পাঠাব।’

সুমন একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বলল, ‘আমাকে কেমন করে খুঁজে পেলে?’

ছোটাচ্চু টুনির হাত ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। সেখান থেকেই বলল, ‘আমরা খুঁজে বের করেছি।’

‘বিজ্ঞান লেখক?’

‘আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি।’

সুমনের মা সুমনের পাশে বসে মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাবা, চল বাসায় গিয়ে খাবি।’ তারপর অন্য দুজনকে বললেন, ‘তোমরাও চলো, আজ আমার বাসায় খাবে। সরষেবাটা দিয়ে ইলিশ মাছ রেঁধেছি। ইলিশ মাছ খাও তো?’

একজন বলল, ‘জি, খাই। কিন্তু এখানে কী হচ্ছে? কিছুই বুঝতে পারছি না।’

সুমনের বোন বলল, ‘বাসায় চলো, যেতে যেতে বলব। অনেক লম্বা স্টোরি।’

সুমন দরজার দিকে বের হতেই টুনি তার দিকে একটা খাম এগিয়ে দিল। বলল, ‘সুমন ভাইয়া, এটা তোমার জন্য।’

‘কী আছে এখানে?

‘বাসায় গিয়ে দেখো।’

সুমন বাসায় গিয়ে দেখল, খামের ভেতরে চুয়ান্ন টাকা। কেন এখানে চুয়ান্ন টাকা, কেন একটা ছোট মেয়ে তার হাতে চুয়ান্ন টাকা ধরিয়ে দিল, সে কিছুই বুঝতে পারল না!

চলবে...

আরও পড়ুন