কাকতালীয়

ছেলেটার এক চোখ রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে। নাক দিয়ে এখনো রক্ত পড়ছে। একটু আগে সে পিচিক করে থুতু ফেলেছে, থুতুর রং গাঢ় লাল। মুখের এখানে-ওখানে কেটে গেছে। রক্ত আর চোখের পানি মিশে গালের ওপর একটা অদ্ভুত রং খেলে যাচ্ছে।

দেখে কেমন যেন মায়া হলো সামিয়ার। রেগে যাওয়া তার অভ্যাসে নেই। তবু কণ্ঠস্বরে যথেষ্ট রাগ মিশিয়ে সে পাশে দাঁড়ানো আফজালকে বলল, ‘রিমান্ডে আনার আগেই তো মুখের নকশা বদলে ফেলেছেন। এরপর যদি আর কখনো আপনি আসামির গায়ে হাত তোলেন...আপনি তো আমাকে চেনেন।’

ইন্টারোগেশন রুমের ভেতরে বেশ গরম। তবু গোয়েন্দা পুলিশের জুনিয়র অফিসার আফজালের কেমন শীত শীত লাগল। সামিয়াকে সে ভয় পায়। মেয়েটার গলার স্বরে কী যেন একটা আছে। আফজালের চেয়ে সামিয়া বয়সে ছোট, কিন্তু পদের দিক থেকে সিনিয়র। প্রথম দিন সামিয়াকে দেখে মনে হয়েছিল, সিনেমার নায়িকা বুঝি ভুল করে গোয়েন্দা অধিদপ্তরে চলে এসেছে। এখন অবশ্য তাকে দেখলেই আফজালের কুলসুম ম্যাডামের কথা মনে পড়ে। কুলসুম ম্যাডাম স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন। প্রতিদিন পড়া ধরতেন আর কড়া ঝাড়ি দিতেন।

আফজাল মিন মিন করে বলল, ‘সরি, আসলে ওপরমহল থেকে এই কেসটার জন্য এত চাপ...।’

‘আর তাই আপনি ভাবলেন, একটা লোকের নাক-মুখ ফাটিয়ে দিলেই কেসের সমাধান হয়ে যাবে। বাহ্!’

আফজাল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, প্রয়োজন ছাড়া সে এই মেয়ের সঙ্গে আর একটা কথাও বলবে না। মুখ খুলে বিপদে পড়ার কোনো মানে হয় না।

শুধু ওপরমহল নয়। আলবার্ট ফ্রান্সিসকোর মৃত্যুর পর দেশি-বিদেশি মিডিয়াগুলোও উঠেপড়ে লেগেছে। পত্রিকায় নিয়মিত খবর ছাপা হচ্ছে। সামিয়ার সামনে, টেবিলের ওপর সেদিনের পত্রিকাটা রাখা। খবরটার ওপর আরও একবার চোখ বোলাল সে।

‘ফ্রান্সিসকোর মৃত্যু নিয়ে মুখ খুলছে না পুলিশ’ শিরোনামে যে প্রতিবেদনটা ছাপা হয়েছে, সেটা এ রকম:

বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও মালয়েশিয়ান ইনস্টিটিউট অব মডার্ন আর্ট অ্যান্ড হিস্ট্রির (মিমাহ) চিফ রিসার্চার আলবার্ট ফ্রান্সিসকোর মৃত্যুরহস্যের কোনো কূলকিনারা হয়নি এখনো। গত বুধবার বনানীর ভাড়া বাসায় বোমা বিস্ফোরণে তাঁর মৃত্যু হয়। ফ্রান্সিসকোর সঙ্গে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেছে। ঘটনার পরপরই হামিম শাহ নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাংলাদেশে গবেষণার কাজে ফ্রান্সিসকোকে সহায়তা করছিল সে। খুনের সঙ্গে হামিম জড়িত কি না, সে ব্যাপারে পুলিশ এখনো নিশ্চিতভাবে কিছু জানায়নি। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গবেষণার আড়ালে আলবার্ট ফ্রান্সিসকো গোপনে বিভিন্ন দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ পাচার করতেন। এমনকি দুই মাস আগে বাংলাদেশের ভিতরগড় থেকে আবিষ্কৃত দুই হাজার বছরের পুরোনো যে মূর্তিটি চুরি গেছে, এই চুরির সঙ্গে ফ্রান্সিসকোর জড়িত থাকার ব্যাপারেও গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে...।

পত্রিকাটা নামিয়ে রেখে মুখ খুলল সামিয়া, ‘আফজাল সাহেব, সাংবাদিকেরা আমাদের এত সব গোপন খবর কীভাবে জেনে ফেলেন বলেন তো? কার মাধ্যমে এগুলো বাইরে যায়?’

খুক খুক করে কেশে উঠল আফজাল। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেয়ে চুপ থাকাই নিরাপদ মনে হলো তার কাছে।

সামিয়া এবার সামনে বসা হামিমের দিকে ফিরল। ছেলেটা এখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সামিয়া তার দিকে একটা টিস্যু পেপার এগিয়ে দিল। কিন্তু হামিম সেটা নেওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাল না। নিচু স্বরে বলল, ‘বিশ্বাস করুন, আমি কিচ্ছু জানি না। আমি প্রতিদিন সকালেই স্যারের বাসায় যাই। সেদিনও যাচ্ছিলাম...।’ হামিম এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।

সামিয়ার কেন যেন মনে হলো, ছেলেটা সত্যিই নির্দোষ। কিন্তু এমনভাবে সে ফেঁসেছে, তাকে বাঁচানোর কোনো উপায় আছে বলে মনে হচ্ছে না।

ঘটনাটা খুবই জটিল। ভিতরগড়ের মূর্তি চুরির পেছনে যে ফ্রান্সিসকোর হাত আছে, এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত তথ্য আছে গোয়েন্দা বিভাগের কাছে। লোকটা মূর্তিটা পাচার করে দিয়েছেন, সেটাও সামিয়ারা জানত। কিন্তু পাচারটা কীভাবে, কোন পথে, কার মাধ্যমে হলো, সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। ফ্রান্সিসকোকে হাতেনাতে ধরতে একটা ফাঁদ পেতেছিল গোয়েন্দারা। কী ফাঁদ?

ফ্রান্সিসকোর সঙ্গে খাতির করেছিল গোয়েন্দা বিভাগের একজন সোর্স, ইকবাল। বেশ কয়েক দিনের আলাপে ফ্রান্সিসকোকে সে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল, তার কাছে হাজার বছরের পুরোনো একটা বহু মূল্যবান মূর্তি আছে। ফ্রান্সিসকো যদি জিনিসটা কিনতে চান, তো সে ব্যবস্থা করতে পারে। ইকবালের শার্টের কলারের পেছনে মাইক্রোফোন লুকানো ছিল। দুজনের সব কথাবার্তার রেকর্ড সামিয়াদের হাতে আছে।

গত বুধবার সকালে প্ল্যানমাফিক ফ্রান্সিসকোর বাসায় গিয়েছিল ইকবাল। মূর্তিটা কীভাবে, কার সাহায্যে অন্য দেশে পাচার করা হবে, কথায় কথায় জানতে চেয়েছিল সে। ফ্রান্সিসকো লোকটা ভীষণ চালাক। প্রশ্নটা শুনেই সম্ভবত সন্দেহ হয়েছিল তাঁর। ইংরেজিতে তিনি বলেছিলেন, ‘দেয়ালেরও কান আছে মিস্টার ইকবাল। আমার সিক্রেট তো আমি আপনাকে বলব না।’

ইকবাল হাল ছাড়েনি। সে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। ‘কিন্তু আপনি মূর্তিটা সফলভাবে দেশের বাইরে নিতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হব কী করে? আপনি ধরা পড়লে তো আমিও শেষ।’

কিছুক্ষণ ভেবে ঘরের এক কোণে রাখা হোয়াইট বোর্ডটা টেনে নিয়েছিলেন ফ্রান্সিসকো। মার্কার দিয়ে একটা কিছু লিখেছিলেন তিনি। তবু মুখ দিয়ে নামটা উচ্চারণ করেননি। ব্যাটা সম্ভবত সন্দেহ করেছিল, তাদের কথায় আড়ি পাতা হচ্ছে।

এর পরমুহূর্তে যা ঘটেছে, গোয়েন্দা বিভাগ সে জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছে। জানালার বাইরে, দূর থেকে টেলি লেন্স দিয়ে ছবি তুলছিল গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মী। সে ছুটে আসতে আসতে সব শেষ। ফ্রান্সিসকো আর ইকবাল দুজনই ততক্ষণে নিথর হয়ে গেছে। গোয়েন্দা বিভাগ পরে বুঝতে পেরেছে, তারা ছাড়াও অন্য কেউ নজর রাখছিল ফ্রান্সিসকোর ওপর। পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে আততায়ী বা তার দল।

হামিমকে আটক করা হয়েছে দুটো কারণে। প্রথমত, ঘটনাস্থলের একটু দূরেই পাওয়া গেছে তাকে। দ্বিতীয়ত, দূর থেকে তোলা ছবিতে ধরা পড়েছে, ইকবালের প্রশ্নের উত্তরে ফ্রান্সিসকো লিখেছিলেন হামিমের নাম। লোকটা ভীষণ ধুরন্ধর। বাইরে থেকে যেন কেউ দেখতে না পায়, সে জন্য জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি লেখেননি। কিন্তু বিধি বাম। ঘরের ভেতরে রাখা শোকেসের আয়নায় হোয়াইট বোর্ডটার ছায়া পড়েছিল। গোয়েন্দাদের ক্যামেরায় শোকেসের ছবি ধরা পড়েছে। সেখানে স্পষ্ট সব দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সিসকোর পুরো ঘর পুড়ে গেছে বলে অবশ্য আর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ছবিটা আর একবার হাতে নিয়ে দেখল সামিয়া। দেখা যাচ্ছে, ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে ফ্রান্সিসকো লিখেছেন, ‘HAMIM’।

ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সামিয়া। হঠাৎই চমকে উঠল সে। মুখে হাসি ফুটল। হামিমের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘আপনি বোধ হয় বেঁচে গেলেন। আশ্চর্য! একেবারেই কাকতালীয়ভাবে ফেঁসে গিয়েছিলেন।’

সামিয়া কেন এ কথা বলল? ফ্রান্সিসকো কার সাহায্যে পাচার করত?

উত্তর

আয়নায় MIMAH শব্দটার প্রতিবিম্ব ধরা পড়েছে, তার ফলে শব্দটা বদলে HAMIM হয়ে গেছে। মিমাহ বা মালয়েশিয়ান ইন্সটিউট অব মডার্ন আর্ট অ্যান্ড হিস্ট্রির সাহায্যেই ফ্রান্সিসকো মূর্তি পাচারে করেছেন।