অভিমান

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এই কুয়ার একটা দুর্নাম আছে।

সেটা কী, কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারে না। কেউ জানে বলেও মনে হয় না।

মনসুরকে কুয়ায় নামতে হবে। কোথাও নামার ব্যাপারে মনসুরের কোনো দক্ষতা নেই। তার সব দক্ষতা ওঠার ব্যাপারে। যেভাবে সে তরতর করে নারকেলগাছ বেয়ে উঠে যেতে পারে, সেটা একটা দেখার মতো দৃশ্য। দক্ষিণচণ্ডী গ্রামে একমাত্র গাছাল মনসুর।

কিন্তু যে লোক ওভাবে উঠতে পারে, সে নামতে পারবে না কেন? বিশেষ করে কুয়ায়? ওঠা আর নামা তো একই জিনিস।

কিন্তু মনসুর কেমন গাঁইগুঁই করছে। নামবে না, এ কথা বলছে না। বলছে, কুয়াল হলে ভালো হতো। ‘কুয়াল’ মানে যারা কুয়ায় নামে। সারা গ্রামে একজন কুয়াল আছে। তার বয়স আশির ওপরে। মনসুর তরতাজা যুবক।

নামতে বলার পরও মনসুর যে এককথায় রাজি হলো না, এতে আনোয়ার খান নাখোশ হলেন। নামতে মনসুরকে হবেই। গ্রামের লোকেদের হাবিজাবি কুসংস্কারকে পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই।

আনোয়ার খানের কথা শুনতে মনসুর বাধ্য। খান পরিবারের বর্গা দেওয়া জমিতে মনসুরের বাপ-চাচারা চাষাবাদ করে আসছে কয়েক প্রজন্ম ধরে। তাদের দান করা জমিতেই ঘর তুলে মনসুররা থাকে। তাদের পুকুরে মাছ মেরে খায়। জমিদারি প্রথা কবে উঠে গেছে, তবু মনসুররা ২০টি বাড়ি এখনো খান পরিবারের একপ্রকার প্রজাই। এখনো তারা সেভাবেই খানদের শ্রদ্ধা–সম্মান করে। পথ থেকে সরে দাঁড়ায়।

ফলে আনোয়ার খান মনসুরকে কুয়ায় নামতে বলা মানে, এটা একধরনের আদেশ। না করা যাবে না।

মনসুরকে নামতে রাজি হতে হলো।

খানবাড়ির পেছনে, মূল বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন একটা পেয়ারাবাগানের মাঝখানে শানবাঁধানো কুয়া।

খানবাড়ি বেশ কিছুদিন ধরে পরিত্যক্ত। কেউ থাকে না। খানদের সব কটি পরিবার এখন শহর ও বিদেশকেন্দ্রিক। কেয়ারটেকাররা বাসা দেখাশোনা করে।

আনোয়ার খান ঢাকা শহরের জাঁদরেল উকিল। ছুটিতে পরিবারকে গ্রাম দেখাতে এনেছেন। গত ১০ বছরে এই প্রথম খানবাড়িতে আলো জ্বলেছে।

খানবাড়ি যতটা পরিত্যক্ত, তার চেয়ে বেশি পরিত্যক্ত তাদের পেছনের পেয়ারাবাগান। পাঁচিলঘেরা বিশাল বাগান। তাতে পেয়ারাগাছ ছাড়াও উঁচু উঁচু গগনশিরীষ, সেগুলোর ছায়াছায়া অন্ধকার। হলুদ পাতা পড়ে থাকে মাটিতে, ঝোপঝাড়ে।

খানবাড়িতে তালা পড়ারও বহু আগে থেকে এই কুয়ার ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে এখন টিউবওয়েল।

কেয়ারটেকার প্রামাণিক আর পাহারাদার ইমানকে সঙ্গে নিয়ে মনসুর যখন এই কুয়ার পাড়ে এল, তখন আসরের আজান পড়ছে। বিকেলের একটা তেরছা রোদ এসে কেমন হাঁ করা একটা বোয়াল মাছের মুখের আকার দিয়েছে কুয়ার মুখটাকে। উঁচু পাড় গালিচার মতো আবৃত কালচে-সবুজ ঘন শেওলার স্তরে। বিকেলের রোদে সেটা কমলা আগুনের মতো দেখাচ্ছে।

মনসুর কুয়ার গহ্বরে মুখ রেখে ‘হোই’ বলে একটা চিৎকার দিল। সেই শব্দ নিচে নেমে গিয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে আর ফিরে এল না। মনসুর ভেবেছিল, তার শব্দে একঝাঁক চামচিকা বা বাদুড় ছিটকে বেরিয়ে আসবে। কিছুই না।

কত গভীর এ কুয়া? কেউ জানে না।

কেয়ারটেকার প্রামাণিক এক টুকরা পাটকেল জোগাড় করে সেটা ছুড়ে দিল কুয়ার গহ্বরে। দুজনে কান পেতে অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। ‘ঝুপ’ করে কোনো আওয়াজ এল না। শুধু একটা গোল অন্ধকার তাকিয়ে থাকল তাদের তিনজনের দিকে।

ইমান এবার পকেট থেকে একটা টর্চ বের করল। সেটা অন করে সে তাক করল কুয়ার অন্ধকারে। একটা ছুরির ফলার মতো সেটা নেমে গেল নিচে। কিন্তু নেমেই গেল। কোথাও বাধা পেল না। নামতে নামতে ফিকে হয়ে একসময় হারিয়ে গেল একটা ধূসরতায়।

টর্চ বন্ধ করে সেটা মনসুরের হাতে চালান করে দিল ইমান। এবার নামতে হবে।

লুঙ্গি মালকোঁচা করে বাঁধল মনসুর। গায়ের ফতুয়াটা খুলে ফেলে উদোম হলো। কুয়ায় নামতে খালি গা কেন হতে হবে, এটা বোঝা গেল না। হয়তো গাছে ওঠার অভ্যাসে।

দুই গাছি দড়ি আনা হয়েছে। সেটা একটার সঙ্গে আরেকটা বাঁধা হলো। দেড় শ ফুট দড়ি। দুনিয়ার যেকোনো কুয়ার জন্য অতিরিক্ত। তবে দড়ি গোছানোর সময় তিনজনেরই মনে হলো, এ কুয়ার জন্য হয়তো এ দৈর্ঘ্য যথেষ্ট নয়।

দড়ির একটা প্রান্ত বাঁধা হলো লোহার আঁকশিতে। সেই আঁকশি আটকে দেওয়া হলো কুয়ার বাঁধানো শানে। অপর অংশ কোমরে বেড় দিয়ে বাঁধল মনসুর। তারপর উঠে বসল কুয়ার পাড়ে। শেওলার মখমলে শিরশির করে উঠল পায়ের পাতা। টর্চটা মুখে কামড়ে ধরল মনসুর।

তাকাল দুজনের দিকে। বিদায় নিচ্ছে যেন।

প্রামাণিক বলল, ‘সমস্যা হইলে আওয়াজ দিস। টাইনা তুলুম।’

মাথা নাড়ল মনসুর। তারপর আলতো করে শরীর গলিয়ে দিল অন্ধকার গুহামুখে। প্রামাণিক ও ইমানের হাতে দড়ির গাছা। সেখান থেকে তারা একটু একটু করে ঢিল ছাড়ছে।

কুয়ার দেয়ালে পা রেখে একটু বাঁকা হয়ে নামতে শুরু করল মনসুর। যেন সে চাঁদের মাটিতে পেছন দিকে হাঁটছে।

মনসুরকে এই কুয়ার তলা খুঁজে বের করতে হবে। সেই তলায় পড়ে আছে একটা কাপড়ের পুতুল। খেলনা। আনোয়ার খানের মেয়ে সমর্পিতার পুতুল। খেলতে গিয়ে সেটা এই কুয়ায় পড়েছে। সমর্পিতার প্রিয় পুতুল। এমনই প্রিয় যে সে তুলকালাম কান্নাকাটি করছে। আনোয়ার খান নানাভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মেয়েটার কী যেন একটা সমস্যা আছে। জেদ উঠলে তাকে থামানো মুশকিল। ফলে মনসুরকে কুয়ায় নামানো ছাড়া আনোয়ার খানের উপায়ও ছিল না। না হলে তিনি এমন অবিবেচক লোক নন।

কিছু দূর নেমে মনসুর ওপরের দিকে তাকাল।

বেশ উঁচুতে কুয়ার মুখটা একটা আলোর বৃত্ত হয়ে আছে।

বিকেলের রোদ পড়ে আসছে। অন্ধকার নামার আগেই এই কুয়ার তল পেতে হবে।

মনসুর নামার গতি বাড়িয়ে দিল।

ওপরের আলোর বৃত্ত ক্রমে ছোট হয়ে আসছে।

মনসুরের মুখে ধরা টর্চ। সেটার আলোয় কুয়ার দেয়াল দেখা যাচ্ছে। দেয়ালে শেওলা আর নানা রকম ফার্নের ঘন ঝোপ। শুরুর দিকে শেওলার রং ছিল কালচে সবুজ। ধীরে ধীরে রং ধূসর হয়ে এল। কমে এল শেওলা আর ঝোপের ঘনত্ব। তারপর একসময় সেগুলো নাই হয়ে গেল। কারণ, বাঁধানো দেয়ালও শেষ।

এরপর মাটির দেয়াল।

কেমন একটা মেটেল গন্ধে ভরে আছে চারপাশ।

মনসুর টর্চটা মুখ থেকে হাতে নিতে গিয়ে সেটা ফসকে গেল। নিচে অন্ধকারের দিকে ছুটে গেল টর্চ। একসময় সেটা হারিয়ে গেল অন্ধকারে।

মনসুর এখন নিশ্চিত, এ কুয়ার তল নেই।

প্রামাণিক ও ইমান রশি ছাড়ছে একটু একটু করে।

মনসুরকে আর দেখা যাচ্ছে না। তার টর্চের আলোও ওপর থেকে আর দৃশ্যমান নয়।

দেড় শ ফুট রশির আর খুব বেশি বাকি নেই।

প্রামাণিক রশি টান দিল। মনসুরকে একটা সিগন্যাল দিতে চায় সে।

কিন্তু রশি আলগা হয়ে খুলে এল। অপর প্রান্তে ভারী কিছু নেই।

প্রামাণিক কুয়ার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল, ‘মনসুর!’

কোনো আওয়াজ নাই।

গ্রামের বয়স্করা জড়ো হয়েছে কুয়ার পাড়ে।

রাত ১১টা বেজে গেছে।

আনোয়ার খান শহরে ফিরে গেছেন পরিবার নিয়ে। পুতুলের জন্য তার মেয়ে এমন জেদ করতে শুরু করেছে যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে নিতে গ্রাম ছেড়েছেন আনোয়ার খান। পথে থানা সদরে তিনি ফায়ার ব্রিগেডকে খবর দিয়ে যাবেন বলে আশ্বাস দিয়ে গেছেন।

গ্রামের লোকেরা এখন ফায়ার ব্রিগেডের জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের অনেক যন্ত্রপাতি, ক্রেন, কপিকল।

রাত তিনটাতেও ফায়ার ব্রিগেড থেকে কেউ এল না। আনোয়ার খান ভুলে গেছেন।

বেশিরভাগ রাতে ঘুম ভেঙে যায় প্রামাণিকের। বিশেষ করে যেসব রাতে জ্যোৎস্না ওঠে। ঘুম ভাঙলে সে বিছানায় উঠে বসে। বোঝার চেষ্টা করে, কেউ তাকে ডেকেছে কি না।

খানবাড়ির নিচতলার ছোট্ট ঘরটা থেকে সে বেরিয়ে আসে। বারান্দা পেরিয়ে উঠানে নামে। উঠান পেরিয়ে পেছনের খিরকি খুলে সে পা রাখে পেয়ারাবাগানে।

জ্যোৎস্নার আলোয় পেয়ারাবাগান ভেসে যায় সেসব রাতে।

প্রামাণিক এসে দাঁড়ায় কুয়ার পাড়ে।

কুয়ার মুখে মুখ এনে সে নিচের অন্ধকারের দিকে তাকায়।

তারপর ডাকতে থাকে, ‘মনসুর! মনসুর!’

কেউ সাড়া দেয় না।

প্রামাণিক জানে, মনসুর তাকে শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু সাড়া দিচ্ছে না।

অভিমানে।