কালবৈশাখীর খেলা

অলংকরণ: আবু হাসান

স্কুলে আসার সময় রোদ ঝলমল করছে। যেন সকালের কাঁচা-সোনা রোদ। গির্জার পাশের সাদা ফুলের গাছগুলো রোদের ছোঁয়ায় ধবধবে সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের ওপর এই গির্জাটা মেইন রোড থেকে আড়াল করে রেখেছে স্কুলটিকে। গির্জার পাশের পথটি ধরে ওরা প্রতিদিন ভোরে স্কুলে যায়। তবে কেউ একা নয়, বাবা-মা নয়তো অন্য কেউ ওদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে যায়। তখন পথটিতে ছড়িয়ে থাকে ঝরে পড়া সাদা ফুলেরা।

তন্বী প্রায় প্রতিদিন দুটি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘একটি আম্মুর জন্য, আরেকটি ছোট্ট ভাইয়ের জন্য। তুমি কিন্তু ঠিক ঠিক দেবে আব্বু। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আমি জিজ্ঞেস করব।’

‘আচ্ছা বাপু, দেব। এখন তুমি তাড়াতাড়ি চলো, ঘণ্টা পড়ে গেছে। দেখো না, লাইন হয়ে যাচ্ছে।’

সবাই ছোটাছুটি করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।

হেডমিস্ট্রেস মাইকে বলেন, ‘মুখে আঙুল। কথা বেশি হচ্ছে। যে যেখানেই আছো, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।’

চঞ্চল ছেলেমেয়েরা এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই লাইন হয়ে যায়। এ সময় একটু তাড়াহুড়া হয়। গেটের ওখানে খুব ভিড় হয়ে যায়। অভিভাবকদের কেউ কেউ গেটের সিঁড়ি থেকে সরতে চায় না। তন্বী সিঁড়ির ওপর এসে বাবাকে ‘খোদা-হাফেজ’ বলে ভেতরে ঢুকে যায়। খানিকটা দৌড়ে নিজের লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখতে না দেখতে অনেক লম্বা হয়ে যায় লাইনগুলো। টিচাররা লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে সোজা করে নেন।

জাতীয় সংগীত গাইতে শুরু করেন নার্সারির টিচার আইরিনদি। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ তন্বীরাও সমবেত কণ্ঠে সুর মিলিয়ে গায়। খুব ভালো লাগে। স্কুলের এই মাঠটিতে এসে লাইনে দাঁড়ালে যেন তাদের সব জড়তা কেটে যায়। ভোরের ঘুমঘুম ভাবটাও কোথায় উধাও হয়ে যায়। মনটা সজীব হয়ে ওঠে।

বৃষ্টি থাকলে অ্যাসেম্বলি হয় না। সরাসরি ক্লাসে ঢুকে যায় ওরা। তন্বীকে নিয়ে বাবা বারান্দায় উঠে হেডমিস্ট্রেসকে সালাম দেন। ছাতা বন্ধ করে তন্বীর রেইনকোট খুলে নিয়ে ভাঁজ করে স্কুলব্যাগে ঢুকিয়ে দেন। পকেট থেকে চিরুনি বের করে মেয়ের চুলগুলো আঁচড়ে দিয়ে বলেন, ‘তাড়াতাড়ি যাও। টিচার ক্লাসে ঢুকে যাচ্ছেন।’

তন্বী হেড টিচারকে খুব ভয় পায়। তাই তাঁর সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যায়।

ঘণ্টা পড়তেই শুরু হয়ে গেল ক্লাস।

টিচার পড়াচ্ছেন ঠিকই কিন্তু অনেকের দৃষ্টি জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেছে। হঠাৎ বাতাস ছুটছে। বাতাসে গাছের শুকনো পাতা উড়ে উড়ে জানালা দিয়ে ক্লাসে ঢুকে যাচ্ছে। পথে পাতা পড়লে ওরা তুলে নিতে চায়। এখন পড়ার টেবিলে পাতা উড়ে এসেছে। ওদের খুশি আর কে দেখে।

তন্বী একটি পাতা হাতে নিয়ে টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মতো ফুঁ দিয়ে বলে, শুকনো পাতার মতো।

প্রথমে টিচার কয়েকবার ওদের দৃষ্টি ফেরাতে চান। পারেন না। ওরা বাইরের বাতাসের দিকে তাকিয়ে আনন্দ পায় আবার ভয়-ভয়ও লাগছে যেন ওদের।

স্কুলের পেছনে পাহাড়ের লম্বা গাছগুলো বাতাসে একবার এ পাশে ঝুঁকে পড়ে আবার অন্য পাশে নুয়ে পড়ে। বাতাসের বেগ আরও বেড়ে যায়। শোঁ শোঁ শব্দ কানে আসে। গাছের বড় বড় ডালপালা বাতাসের তোড়ে যেন পাহাড়ের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় যেন রাতের আঁধার নেমে আসে। ছেলেমেয়েরা সবাই চিৎকার করতে থাকে।

টিচার সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হয়েছে।’

ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ ভয়ে কাঁদতে থাকে। এরই মধ্যে তন্বী জানতে চায়, ‘টিচার, কালবৈশাখী মানে কী?’

টিচার উচ্চ কণ্ঠে বলেন, তোমরা একটু থামো, আমি তোমাদের কালবৈশাখী কী বলছি।’

টিচার, আমাদের খুব ভয় পাচ্ছে। আমরা আব্বু-আম্মুর কাছে যাব।

‘তোমাদের বাবা-মায়েরা এখন তো কেউ এখানে নেই। আর বাইরে যেভাবে বাতাস কীভাবে তোমরা যাবে? এখন ধৈর্য ধরে বসো। আমি তোমাদের কালবৈশাখীর গল্প বলছি।’

‘গল্প’ শব্দটা শুনে অনেকে কিছুটা শান্ত হলেও কেউ কেউ কান্না থামাতে পারেনি।

টিচার উঁচু গলায় বলেন, ‘এখন কী মাস তোমরা জানো?’ কয়েকজন একসঙ্গে বলে, ‘এপ্রিল মাস।’

‘ওটা তো খ্রিষ্টীয় মাস। বাংলা মাসের কথা জানতে চাচ্ছি।’ কেউ বলতে পারে না। তখন টিচার বলেন, ‘এখন হলো বৈশাখ মাস। বৈশাখ হলো বাংলা বারো মাসের প্রথম মাস। কিছুদিন আগে আমাদের স্কুল পয়লা বৈশাখের ছুটি ছিল, তা কি তোমরা ভুলে গেছ?’

তন্বী বলে, ‘টিচার, ওই দিন আমরা বৈশাখী মেলায় গিয়েছিলাম।’ এই তো তন্বীর মনে আছে। বৈশাখ মাসে কালবৈশাখীর ঝড় হঠাৎ করে গাছপালা উপড়ে ফেলে। ঘরবাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যায়।

বাইরে বাতাসের বেগ আরও বেড়ে যায়। কয়েকটি গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ কানে আসে। ওরা কালবৈশাখীর গল্প না শুনে কালবৈশাখী দেখতে চায়। কেউ কেউ ভয়ে জানালা বন্ধ করে দিতে বলে। বাতাসের সঙ্গে এখন বৃষ্টিও পড়ছে। ঝোড়ো হাওয়ায় একটি গাছ ভেঙে দুমড়েমুচড়ে যায়।

আকাশে বজ্রপাতের শব্দ হয় কয়েকবার। তন্বীরা এবার সত্যি সত্যি ভয় পায়।

টিচার বলেন, তোমরা ভয় পেয়ো না। আমি তোমাদের কাছে আছি। একটু পরে বাতাস কেটে গেলে দেখবে চারদিক ফরসা হয়ে গেছে।

দু-একজন বলে ওঠে, টিচার, আমরা ভিজে যাচ্ছি। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছিটা আসছে।

তখন টিচার একবার ভাবেন, জানালা বন্ধ করে দেবেন কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে তাঁর ছোটবেলার কথা। ছোটবেলায় ঝড় হলেই আম কুড়োতে যেতেন দল বেঁধে। বৃষ্টিতে ভিজে আম কুড়ানোর আনন্দটাই আলাদা। তাঁর মনে হলো ঝড়ের সৌন্দর্যটা দেখা উচিত ওদের।

ঝড় তখনো চলছে। দু-একটা ডাল পাতাসহ এসে জানালার কাছে আছড়ে পড়ে। হুট করে অন্ধকার হয়ে যায় পুরো ক্লাস। ভয় পেয়ে যায় সবাই। টিচার বলেন, তোমরা কবি জসীমউদ্দীনের ‘মামার বাড়ি’ ছড়াটা পড়েছ?

জি টিচার।

কী বলেছিলেন কবি? কেউ বলতে পারবে?

ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ/ পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।’

‘আজ ক্লাস না করে চলো সবাই মিলে আম কুড়াতে যাই। যাবে?’

‘যাব! যাব!’—একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে সবাই।

‘চলো তাহলে।’

টিচারের কথা শেষ হওয়ার আগেই অবশ্য দৌড় শুরু করে দিয়েছে তন্বী। খুব আনন্দ হচ্ছে তার। হুড়মুড় করে মাঠে বেরিয়ে এল ওরা। ওদের দেখাদেখি অন্য ক্লাসগুলো থেকেও বেরিয়ে ছেলেমেয়েরা। টিচাররাও এলেন, এলেন অভিভাবকেরাও। হেডমিস্ট্রেস শুধু বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে। মাঝেমধ্যে বললেন, ‘এই ঠান্ডা লেগে যাবে, ভেতরে এসো তোমরা।’ তবে তাঁর চোখে রাগের কোনো চিহ্নও দেখল না তন্বী। মনে হলো তাঁর চোখেও আনন্দ।