রোবটের দীর্ঘশ্বাস (চতুর্থ পর্ব)

অলংকরণ: সাদাত

ছয়

চোখের পলকে খোলা জায়গাটুকুর মাঝখানে চলে এল দানবটা। ইউসুফের ফুট দশেক সামনে থমকে দাঁড়াল। একমুহূর্ত স্থির চোখে দেখল ইউসুফকে। যেন তার শক্তির পরিমাণ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল জানোয়ারটা। ধীরে ধীরে সামনের দিকে ঝুঁকছে। কোমর বাঁকা করে দুই হাতের আঙুলের ডগা মাটিতে ছোঁয়াল। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিটা অনেকটা গরিলার মতো।

দানবটা ঠিক কতখানি বুদ্ধিমান, জানা নেই ইউসুফের। হয়তোবা মানুষের পরপরই ওর স্থান। কিন্তু কী করে বোঝা যাবে সেটা? মানুষের কথা বুঝতে পারে কি না, কে জানে। কথা বলল ইউসুফ, ‘মানুষের কথা বোঝো তুমি?’

উত্তরে দপ করে জ্বলে উঠল দানবটার চোখ। দৃষ্টি দিয়েই ইউসুফকে জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে ভস্ম করে দেবে যেন।

‘কোন জাতের জীব তুমি?’ আবার জিজ্ঞেস করল ইউসুফ। বিকট দাঁত বের করে ভেংচাল দানবটা।

‘রাগ কোরো না’, নরম গলায় বলল ইউসুফ। ‘বুঝে থাকলে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।’

নড়ে উঠল জীবটা। সরাসরি আক্রমণ করল না। ইউসুফকে কেন্দ্র করে চক্কর দিতে আরম্ভ করল।

‘কী হলো, এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছ?’

বুঝল ইউসুফ, জীবটা টের পেয়ে গেছে, সে সাধারণ মানুষ নয়। একটা ব্যাপারে ইউসুফ নিশ্চিত হলো, দানবটা অত্যন্ত বুদ্ধিমান।

ইউসুফের কথায় আরেকবার বিকট ভঙ্গিতে দাঁত ভেংচাল সে।

‘হ্যাঁ, ভালো কথা, আমাদের শারিতা নিশ্চয় তোমার কাছে আছে? ওই মেয়েটা, যাকে ক্যাম্প থেকে...’

হঠাৎ এক লাফে একেবারে সামনে চলে এল জীবটা। হাত বাড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করল ইউসুফকে।

হুঁশিয়ার হয়েই আছে ইউসুফ। বিদ্যুৎ–গতিতে ছিটকে পেছনে সরে গেল সে। সামনে ছুটে এল দানবটা। পাশ কাটাল ইউসুফ। তার পাশ দিয়ে দমকা হাওয়ার মতো ছুটে গেল জীবটা।

পাল্টা–আক্রমণ করল না ইউসুফ। কথা বুঝতে পারলে বুঝিয়ে–শুনিয়ে জীবটাকে কায়দা করার ইচ্ছা তার।

ঘুরে দাঁড়িয়েছে দানবটা।

‘দেখো, মারপিট মোটেও পছন্দ না আমার,’ কথা বললেও আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তৈরি হয়েই আছে ইউসুফ। ‘তবে ইচ্ছা করলে তোমার মতো এক–আধজনকে পিটিয়ে লাশ করে দিতে পারি আমি। এখন দয়া করে বলো তো, মানুষের কথা বোঝো নাকি তুমি?’

লাফিয়ে কাছে চলে এল দানবটা। ইউসুফকে ধরতে চায়। কায়দা করে তার নাগালের বাইরে থাকল ইউসুফ।

‘দেখো, আমরা দুজনে বন্ধু হয়ে যেতে পারি...।’

এবারে আর লাফ দিল না জীবটা। ধাঁ করে সোজা ছুটে এল। পেছাতে গিয়ে একটা ছোট্ট গাছের চারায় পা বেঁধে গেল ইউসুফের। পড়ল না, কিন্তু বাধা পাওয়ায় সময়মতো সরে যেতেও পারল না। তার একটা হাত ধরে ফেলল দানবটা। টান মেরে ছুড়ে দিল ওপর দিকে।

শূন্যে থাকতেই ভারসাম্য ঠিক করে ফেলেছে ইউসুফ। আলতভাবে এসে নামল মাটিতে। ছাড়া পাওয়া স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিল পরক্ষণেই। একেবারে দানবের মুখোমুখি। ‘ভালো কথায় শুনবে না। ধোলাই দরকার তোমার!’

লাফিয়ে এসে তাকে ধরতে চেষ্টা করল দানবটা। সামান্য পাশে সরল ইউসুফ। পরক্ষণে বায়োনিক হাতে প্রচণ্ড জোরে জীবটার পেটে ঘুষি মারল। বাতাস ভরা রাবারের টায়ারের ওপর যেন লাগল ঘুষিটা। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই আজব জীবটার। অথচ এই আঘাতে গরিলার মতো জানোয়ারও মাটিতে শুয়ে পড়ার কথা। শুধু হাপর থেকে বাতাস বেরোনোর মতো একটা আওয়াজ করে উঠল দানবটা।

তড়াক করে পেছনে সরে এল ইউসুফ। আবার আঘাত হানার জন্য তৈরি হলো।

তীব্র গতিতে সামনে ছুটে আসছে দানবটা। লাফ দিল ইউসুফ। শূন্যে ডিগবাজি খেল। চক্কর পুরো হতেই সোজা করল দুই পা। ভয়ংকর ফ্লাইং কিক লাগল জীবটার সোলার প্লেক্সাসে। ঠেসে ভরা ময়দার বস্তায় লাফ দিয়ে পড়ল যেন সে। পেছনে উল্টে পড়ল দানবটার ভারী শরীর। দেহের ভারে চ্যাপ্টে গেল বিশাল এক ঝোপ।

লাথি মেরেই কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল ইউসুফ, কিন্তু চোখের পলকে উঠে দাঁড়াল আবার।

নিজের ভারী দেহ টেনে তোলার চেষ্টা করছে দানবটা।

‘মারপিটের শখ মজেছে?’ জিজ্ঞেস করল ইউসুফ। ‘এবার বলো তো, জীবটা আসলে কী তুমি?’

উঠে দাঁড়িয়েছে দানবটা। ভয়ংকর এক হাঁক ছাড়ল। আওয়াজটা যান্ত্রিক মনে হলো ইউসুফের কাছে। ক্রমেই তাকে আরও বিস্মিত করছে আজব জীবটা। ওটা কী, তা–ই বুঝতে পারছে না এখনো।

আবার এগিয়ে আসছে দানবটা। কিন্তু এবারে আর একরোখার মতো নয়। বুঝেশুনে, গার্ড রেখে। অপেক্ষা করছে ইউসুফ। তার ৩ ফুটের মধ্যে এসে হঠাৎ বাঁয়ে সরল জীবটা। তারপর ডানে। আচমকা প্রচণ্ড ঘুষি চালাল।

ইউসুফের বুকে লাগল আঘাতটা। উড়ে গিয়ে একটা গাছের চারার ওপর পড়ল সে। শব্দ করে ভাঙল চারাটা। হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল ইউসুফ।

এগিয়ে আসছে দানবটা।

সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ইউসুফ। মুখোমুখি হলো দুজনে। আবার ইউসুফের বুকে ঘুষি মারার চেষ্টা করল দানবটা। কিন্তু এবারে আর সুযোগ দিল না ইউসুফ। চট করে বসে পড়ল। ঘুষিটা তার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। ভারসাম্য হারাল দানবটা। একটু কাত হয়ে গেল। বেকায়দা ভঙ্গি। ভয়ানক ঘুষি খেল পেটে। সামনের দিকে একটু কুঁজো হয়ে গেল তার শরীর। কায়দামতো পেয়ে জীবটার ডান চোয়ালে বায়োনিক হাতের এক সাংঘাতিক ঘুষি লাগাল ইউসুফ। ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল দানবটা। কিন্তু আশ্চর্য! সামান্যতম গোঙানি বেরোল না তার মুখ থেকে এবারও। ব্যথা পাওয়ার কোনো লক্ষণই নেই।

ইউসুফের অবচেতন মনে ছিল চিন্তাটা এতক্ষণ, এবারে স্বচ্ছ হতে আরম্ভ করল। তারই মতো বায়োনিক কোনো সৃষ্টি নয়তো জীবটা? সে নিজে যেমন মানব-সাইবর্গ, জীবটা হয়তো গরিলা-সাইবর্গ? কিন্তু সাইবর্গ বানানোর জন্য এত বড় গরিলা কোথায় পেল নির্মাতারা?

অন্ধকার সেন্সর ডিসপ্লে রুমে বসে টেলিভিশনের পর্দায় যুদ্ধ দেখছে তিনজনে।

‘দারুণ! চমৎকার!’ হেসে বলল হিগ।

‘শক্তিতে কেউ কারও চেয়ে কম না,’ বলল রাটিন।

‘আমার সন্দেহ আছে,’ টোরা বলল।

‘এখনো বাজি রাখতে পারি, ভিটুই জিতবে,’ জোর দিয়ে বলল হিগ।

আরেকটা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য তৈরি হচ্ছে ইউসুফ। আচমকা তেড়ে এল দানবটা। কিন্তু অর্ধেক এসেই কী মনে করে থেমে গেল। আড়চোখে ডানে তাকাল। প্রায় আধমণ ওজনের একটা বিশাল পাথর পড়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে পাথরটা তুলে ধাঁ করে ছুড়ে মারল সে। বায়োনিক হাতের তালু দিয়ে অতি সহজেই পাথরটা ঠেকিয়ে দিল ইউসুফ।

মাথা নিচু করে ডাইভ দিল দানবটা। প্রচণ্ড গুঁতা মারল ইউসুফের পেটে। পড়ে গেল ইউসুফ। পেটের চামড়ার নিচে রাবারের পেশি লাগানো থাকায় ব্যথা পেল না। কিন্তু উঠতে আধা সেকেন্ড বেশি সময় লাগল। এই সময়েই তৈরি হয়ে গেল দানবটা। ইউসুফ উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে। দানবীয় হাতের চাপ বাড়াল।

ভয়ানক চাপে দম ফেলতে পারছে না প্রচণ্ড ক্ষমতাধর রোবটমানব। ঝাড়া মেরে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল ইউসুফ। পারল না। অনেক কষ্টে দানবের আলিঙ্গন থেকে বাঁ হাতটা বের করে এনেই পিস্টনের মতো তীব্রবেগে পেছনে চালাল। একটু ঢিল হলো আলিঙ্গন। এই সুযোগে ঝাড়া মেরে নিজেকে মুক্ত করে নিল সে।

তার বায়োনিক কনুইয়ের এই ভয়ংকর গুঁতায় সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারাত যেকোনো গরিলা, কিন্তু এ দানবের কিছুই হলো না। দুই পা পিছিয়ে গেছে সে। চোখ দুটি আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে।

আধা সেকেন্ড ইউসুফের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকল দানবটা, তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। না, যুদ্ধে হেরে চলে যাচ্ছে না সে। একটি ইঞ্চি চারেক পুরু গাছের চারার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দুই বিশাল থাবায় চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে উপড়ে আনল চারাটা। এটা দিয়েই ইউসুফকে পেটানোর ইচ্ছা। স্থির দাঁড়িয়ে অদ্ভুত জীবটার গতিবিধি লক্ষ করছে ইউসুফ।

কাছে এসে গাছ ঘুরিয়ে বাড়ি মারল দানবটা। তৈরিই ছিল ইউসুফ। বায়োনিক বাহু দিয়ে আঘাতটা ঠেকাল। তারপর গাছটা চেপে ধরল দুই হাতে। কিন্তু রাখতে পারল না। গর্জন করে হ্যাঁচকা টানে গাছটা ছাড়িয়ে নিল দানবটা। টানের চোটে সামনে ঝুঁকে গেল ইউসুফ। সামলে নেওয়ার আগেই গাছ ঘুরিয়ে আবার মারল দানবটা। এবারে অন্য পাশে। বাড়িটা লাগল ইউসুফের রক্তমাংসের হাতে। তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল বাহুতে। অস্ফুট একটা শব্দ করে পড়ে গেল সে।

সেন্সর ডিসপ্লে রুমের তিনজনে অবাক। হতাশও যেন কিছুটা। ইউসুফের পতনটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। কৌতূহল আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

‘আরে!’ বলল হিগ, ‘ওর বাঁ হাতটাই তো শুধু অন্য রকম!’

‘তা–ই তো দেখছি!’ টোরা বলল।

ডান হাতে গাছের চারাটা উঁচু করে ধরল দানবটা। গোড়াটা সামনের দিকে। বল্লম ছোড়ার মতো করে ছুড়ে মারল ইউসুফের দিকে।

গড়িয়ে এক পাশে সরে গেল ইউসুফ। তার পেছনের একটা গাছের গুঁড়িতে গিয়ে প্রচণ্ড জোরে লাগল চারাটা।

উঠে দাঁড়িয়েছে আবার ইউসুফ। এগিয়ে এসেছে দানবটা।

দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে গার্ড রেখে ঘুরতে লাগল।

‘কী শুরু করেছ?’ বলল ইউসুফ। ‘পরিচয় দিতে এত আপত্তি কেন?’

সেই একই উত্তর। গর্জন করে ছুটে এল দানবটা।

পাশে সরে নুয়ে গেল ইউসুফ। তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় খপ করে দানবটার ডান হাতটা ধরে ফেলল। হ্যাঁচকা টান খেয়ে থেমে গেল দানবটা। মুচড়ে ওটার হাতটা পেছনে নিয়ে এল ইউসুফ, ঠেলে দিল ওপর দিকে। হাপর থেকে জোরে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার মতো একধরনের আওয়াজ করল দানবটা এবারও।

দানবটার পেছনে দাঁড়িয়ে ওর হাতটা আরও ওপর দিকে ঠেলে দিল ইউসুফ। ‘এখনো বলো, তুমি আসলে কী?’

নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল দানবটা। ইউসুফ যেমনভাবে তাকে মেরেছিল, তেমন করে পেছনে কনুই চালানোর চেষ্টা করল। পারল না। এতক্ষণ শুধু আত্মরক্ষা করে এসেছে ইউসুফ। মনে মনে ঠিক করল, আর না। এবারে এর পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। বেকায়দা অবস্থায় ফেলে দানবটা কী ধরনের জীব, জানতে হবে। প্রচণ্ড জোরে দানবটার হাতটা ওপরের দিকে ঠেলে দিল সে।

চিৎকার করে উঠবে দানবটা, ভেবেছিল ইউসুফ। কিন্তু কিছুই করল না ওটা। তার বদলে আশ্চর্য একটা ব্যাপার ঘটল। ফাঁপা ধাতব শব্দ করে হাতটা কাঁধের কাছ থেকে ছিঁড়ে এল দানবটার। রাবার ছেঁড়ার শব্দ হলো। কয়েকটা তীক্ষ্ণ শব্দ করে ওটার ভেতরে ইলেকট্রিক কানেকশন জ্বলে যাওয়ার আওয়াজ হলো বার কয়েক।

ভুরু কুঁচকে ছেঁড়া হাতটার দিকে তাকিয়ে রইল ইউসুফ। দানবের কাঁধের ছেঁড়া জায়গায় চামড়া নেই, মাংস নেই, রক্ত নেই, হাড় নেই। আছে কতগুলো জট পাকানো তার। রাবারের তৈরি কৃত্রিম মাংসপেশি। ভেতর থেকে হালকা ধোঁয়া বের হচ্ছে। পোড়া রাবারের গন্ধ নাকে লাগছে ইউসুফের। গরিলা-সাইবর্গ নয় দানবটা, অতি উন্নতমানের গরিলা-রোবট।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নিজের ছেঁড়া হাতটার দিকে তাকিয়ে রইল দানবটা। তারপর ফিরল ইউসুফের দিকে। হাপর থেকে বাতাস বেরোনোর মতো জোরালো আওয়াজ তুলে ছুটে এল। ইউসুফ কিছু বোঝার আগেই তার হাত থেকে নিজের ছেঁড়া হাতটা ছিনিয়ে নিয়ে বনের দিকে ছুটে পালাল।

পিছু নিল ইউসুফ। তার থেকে বড়জোর ৩০ গজ দূরে আছে এখন ওটা। একটা হাত হারিয়ে গতির দ্রুততাও যেন অনেকখানি কমে গেছে রোবটটার। কোনো ধরনের পাওয়ার লস নিশ্চয়ই।

হিমপাহাড়ের পশ্চিম ঢালের দিকে ছুটেছে দানবটা। বনসীমার হাজার ফুট নিচে, এক জায়গায় পড়ে থাকা কয়েকটা গাছ লাফিয়ে ডিঙাল সে। একটা খাদ ডিঙাল, এরপর হারিয়ে গেল আরেকটা বিশাল খাদের ভেতরে। খাদটার পাড়ে পৌঁছে দেখল ইউসুফ, নিচের পাহাড়ি গিরিখাতের মাঝখান দিয়ে দ্রুত ছুটছে দানবটা। পাহাড়ি ঢলে সৃষ্টি করেছে কয়েক শ গজ লম্বা ওই গিরিখাত। এপারে দাঁড়িয়েই খাদের ওপারে পাহাড়ের গায়ের বিশাল গুহামুখটা চোখে পড়ল তার। বড় জাতের গাছ আর গুল্ম জন্মে আছে ওখানটায়। গাছপালাগুলো প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। বায়োনিক চোখ ব্যবহার না করলে গুহামুখটা দেখতেই পেত না সে।

গুহামুখের কাছে গিয়ে একবার থমকাল দানবটা। তারপর ঢুকে পড়ল ভেতরে।

লাফ দিয়ে খাদের তলায় নামল ইউসুফ। তীব্র গতিতে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল গুহামুখের সামনে। ভেতরে উঁকি দিল।

পাথুরে সুড়ঙ্গ। ১০ ফুট উঁচু, ১০ ফুট চওড়া। ৩০ ফুট সোজা এগিয়ে গিয়ে বেঁকে গেছে। তার মানে, শেষ হয়নি সুড়ঙ্গ।

চোখের ইনফ্রারেড স্ক্যানার চালু করল ইউসুফ। সন্দেহজনক কিছু দেখল না। সাবধানে গুহামুখের ভেতরে পা রাখল সে। ইনফ্রারেড পরিবর্তন করে ফটোমাল্টিপ্লেয়ার চালু করল। চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে গেল অন্ধকার। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে এখন সবকিছু।

গুহাটা খালি।

সাত

স্তব্ধ হয়ে গুহার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে ইউসুফ। স্পষ্ট দেখেছে, এই গুহাতেই ঢুকেছে দানবটা। বেরোনোর একটাই পথ দেখতে পাচ্ছে। সেটা আগলে দাঁড়িয়ে আছে সে। তাহলে গেল কোথায় রোবটটা?

সুড়ঙ্গ যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে এসে দাঁড়াল সে। বায়োনিক হাতের আঙুল দিয়ে টোকা দিল দেয়ালে। ফাঁপা জায়গা আছে কি না, খুঁজল। কিন্তু পেল না। আবার গুহামুখে ফিরে এল সে। ইনফ্রারেড সেন্সরটা আবার চালু করল। দানবটাকে আর খোঁজার চেষ্টা না করে আবহাওয়ায় কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না, বুঝতে চাইল। বেশিক্ষণ লাগল না। পেয়ে গেল। দেয়ালের এক জায়গা দুই ডিগ্রি বেশি গরম।

টোকা দিয়ে দেখল ওখানটায়। নিরেট মনে হলো না। বায়োনিক হাতে জোরে টোকা দিল আবার। খুদে এক টুকরা পাথর খসে পড়ল দেয়ালের গা থেকে। হাত দিয়ে খুঁচিয়ে ছিদ্রটা বড় করল। টোকা দিয়ে দেখল, শব্দ আরও বদলে গেছে। খোঁচাতে খোঁচাতে ছিদ্রটা এক ফুট গভীর করে ফেলল সে। একটা ধাতব দরজার অংশ চোখে পড়ছে এখন।

হাসল ইউসুফ। পিছিয়ে এল কয়েক পা। তারপর ছুটে গিয়ে শূন্যে লাফ দিল। জোড়া পায়ে লাথি মারল দেয়ালের গায়ে। মেরেই ডিগবাজি খেয়ে নেমে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল মাটিতে। ধাতব দরজার এপাশের পাথর চৌচির হয়ে মাটিতে খসে পড়ল। আবার পিছিয়ে এল সে। আবার ছুটে গিয়ে একই পদ্ধতিতে লাথি চালাল ধাতব দরজার গায়ে। কবজা থেকে ছুটে গিয়ে ছিটকে পড়ল দরজা। ওপাশে সুড়ঙ্গ।

ক্রিস্টালে তৈরি সুড়ঙ্গের দেয়াল, মেঝে, ছাদ—সবকিছু। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। মেঝেটা সমতল। ছাদ ধনুকের মতো বাঁকা। ছাদে কয়েক ইঞ্চি পরপর উজ্জ্বল ক্রিস্টাল আলো জ্বলছে। আইস টানেল বলে মনে হলো ইউসুফের। মানুষের বানানো। এ ধরনের জিনিস প্রকৃতির সৃষ্টি হতেই পারে না।

প্রচণ্ড কৌতূহল জাগল ইউসুফের। কী আছে ভেতরে? ঢুকে দেখবে? ভয়ংকর বিপদ ঘটার আশঙ্কা আছে এতে। সে নিশ্চিত, এই সুড়ঙ্গপথেই ঢুকে গেছে দানবটা, হয়তো তার স্রষ্টাদের কাছেই। যারা ওই গরিলা-রোবটের মতো জিনিস সৃষ্টি করতে পারে, তাদের অসাধারণ শক্তিকে খাটো করে দেখা উচিত হবে না কোনোমতেই। ঢুকলে হয়তো প্রাণ নিয়ে আর বেরোতে পারবে না কখনো। তবু শেষ পর্যন্ত কৌতূহলেরই জয় হলো। ভেতরে ঢোকা স্থির করল সে। দেখতে হবে, কী আছে ভেতরে। কারা সৃষ্টি করছে ওই রোবট। কেন? কী তাদের উদ্দেশ্য?

আইস টানেলে পা দিল ইউসুফ। সাবধানে এগিয়ে চলল।

৫০ ফুটের মতো এগিয়ে শেষ হয়েছে আইস টানেল। ওপাশে হালকা অন্ধকার। সুড়ঙ্গের মাঝামাঝি এসে থামল ইউসুফ। অদ্ভুত একটা শব্দ কানে আসছে। হঠাৎ করেই ঘটতে শুরু করল ঘটনাগুলো। সুড়ঙ্গে আলোগুলো কাঁপতে শুরু করেছে। প্রথমে ধীরে, তারপর দ্রুত হতে লাগল কাঁপন। সেই সঙ্গে সাইরেনের মতো তীক্ষ্ণ শব্দ উঠল। ঘুমঘুম অনুভূতি হলো ইউসুফের। টলে উঠল। নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে প্রাণপণে। অবশ হয়ে আসছে দেহ। কিন্তু কোনো ব্যথা নেই শরীরের কোথাও। শঙ্কিত হয়ে পড়ল সে।

টলতে টলতে আরও তিন পা এগিয়ে গেল ইউসুফ। তারপর আর পারল না। হাঁটু ভেঙে বসল, পরক্ষণেই গড়িয়ে পড়ে গেল। আবছাভাবে চোখে পড়ল, হালকা অন্ধকারে ভেতর থেকে আলোয় এসে দাঁড়িয়েছে দুজন পুরুষ আর একজন মেয়ে।

চোখ মেলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে ইউসুফ। কিন্তু কিছুতেই পারল না। বুঝতে পারল, যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ঘুমপাড়ানো হচ্ছে তাকে। ইলেকট্রোশিপ। ঘুমিয়ে পড়ল সে।

‘অবিশ্বাস্য!’ ইউসুফের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল টোরা।

‘এই পৃথিবীর সবচেয়ে আজব মানুষ ও,’ হিগ বলল।

‘হ্যাঁ।’

‘ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখতে হবে ওকে।’

‘মেরে না ফেলে ঘুমপাড়ানো হয়েছে তো সে জন্যই।’

দুপুর। যথারীতি আবার কাজ শুরু হয়েছে হিমপাহাড় বেসে। দেখে মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে বেসের লোকজন। আর্মি জিপ আসছে–যাচ্ছে। আশপাশের বনাঞ্চল চষে ফেলা হচ্ছে। নতুন একটি জেনারেটর ট্রাক আনা হয়েছে। পোড়া ট্রাকটি ট্রাক্টর দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে জঙ্গলের পাশে। আধডজন সশস্ত্র লোক পাহারা দিচ্ছে বেস এলাকা। আগে ছিল না, কিন্তু এখন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে জায়গাটুকু। আবার হামলা আসার আশঙ্কা করছেন আশফাক খান। কিন্তু এবারে আর যাতে সহজে কৃতকার্য হয়ে ফিরে যেতে না পারে আক্রমণকারী, তার জন্যই এত সব ব্যবস্থা।

কর্কবোর্ডে বিশাল এক টপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপ আটকে নিয়েছেন তিনি। তার আশপাশে দাঁড়িয়ে আছেন আবু তাহের, সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন আর ফরেস্ট সার্ভিসের একজন রেঞ্জার।

‘এদিকে গেছে ইউসুফ,’ ম্যাপের এক জায়গায় পেনসিলের চোখা মাথা ছুঁইয়ে বললেন আশফাক খান। ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সার্চ পার্টিতে কজন লোক আছে এখন?’

‘৯৪ জন,’ উত্তর দিলেন ক্যাপ্টেন।

‘আমার লোক আছে আরও ২৭ জন,’ বললেন রেঞ্জার। ‘ওরাও খুঁজছে।’

‘গুড। আকাশ থেকে খোঁজার ব্যবস্থা হয়েছে?’

‘দুটি আর্মি হেলিকপ্টার ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে,’ বললেন রেঞ্জার। ‘ওদের সেরা দুজন পাইলট আছে দুটিতে।’

‘রাতের আগেই ওদের খুঁজে বের করব আমরা,’ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন।

‘থ্যাংক ইউ। খোঁজ পেলেই জানাবেন আমাকে।’

পেনসিলটা বোর্ডে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন আশফাক খান। তারপর আবু তাহেরকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তাঁবু থেকে।

‘ইউসুফের জন্য ভাবনা হচ্ছে, না?’ আশফাক খানের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললেন আবু তাহের।

‘হ্যাঁ, হচ্ছে।’

‘সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার লোক নয় ও।’

‘কী জানি!’ অনিশ্চয়তা আশফাক খানের কণ্ঠে।

‘মিস্টার খান, আরেকটা সমস্যা কিন্তু মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।’

‘কী?’

‘ব্যাপারটা সিরিয়াসই।’

‘সিরিয়াস!’ দাঁড়িয়ে পড়লেন আশফাক খান। আবু তাহেরের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’

‘সেন্সরে বেশির ভাগ ডেটা কালেকশন হয়ে গেছে আমাদের ইতিমধ্যেই। টেলিমেট্রি বলছে,’ কথাটা কীভাবে বোঝাবেন, নিজেই বুঝতে পারছেন না আবু তাহের। উসখুস করতে লাগলেন।

‘কী বলছে?’

‘এখনো শিওর নই আমি। আমাদের ব্যবহৃত ইনস্ট্রুমেন্টসগুলোতে কোনো গোলমাল না থাকলে, অর্থাৎ ভুল রিডিং না দিলে, ভয়ের ব্যাপারই।’

‘ভয়? কিসের ভয়?’ ভুরু কোঁচকালেন আশফাক খান।

‘ব্যাপারটা ভৌগোলিক। মহাদেশগুলোর ক্রমবিবর্তনের কথা তো জানেনই আপনি?’

‘হ্যাঁ। কোথায় যেন পড়েছিলাম, হয়তো কোনো সায়েন্স ম্যাগাজিনেই, প্রতিটি মহাদেশ একটি করে রকপ্লেটে চড়ে আছে। এই প্লেট আবার অন্য আরেকটা মহাদেশের রকপ্লেটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। শুনেছি, নিউ ইংল্যান্ডের উপকূল একসময় আফ্রিকা মহাদেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল।’

‘ঠিকই শুনেছেন। এই প্লেটগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে অনবরত ঘষা খাচ্ছে,’ বলে গেলেন আবু তাহের, ‘চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এতে। আর এটাই অনেক পাহাড়-পর্বত উৎপত্তির কারণ।’

‘কিন্তু এসব ভূবিজ্ঞানীদের ব্যাপার আমাকে শুনিয়ে লাভ কী?’

‘ভাবছি, বঙ্গোপসাগরের নিচেও এ ধরনের পরিবর্তন শুরু হয়নি তো?’

‘তাতে কী?’ জানতে চাইলেন আশফাক খান।

‘হঠাৎ প্রচণ্ড ঠোকাঠুকি শুরু করবে দুটি প্লেট। ঠেকে যাবে, চাপ বাড়বে, তারপর হঠাৎই একে অন্যের থেকে আলগা হয়ে যাবে।’

‘এবং ঘন ঘন মারাত্মক ভূমিকম্প হতে থাকবে?’

‘ঠিক ধরেছেন। এই অঞ্চলে কেন অত ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে, অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে এসেছে এখন আমার কাছে। আগে তো এত ভূমিকম্প হতো না বাংলাদেশে, বিশেষ করে এই অঞ্চলে। এটা এড়ানোর বন্দোবস্ত করা যায়। উচ্চ চাপে পানির ধারা ছাড়তে হবে ফল্টগুলোতে, কিংবা ফল্টের কাছাকাছি মাটির গভীরে নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন ঘটাতে হবে। এতে কৃত্রিম পদ্ধতিতে প্লেটগুলো পরস্পরের গা থেকে সরিয়ে দিতে পারি আমরা। পো মুভমেন্ট ঘটবে। অতি সামান্যভাবে ভূমিকম্প হবে কয়েকবার। কারও কোনো ক্ষতি হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ভবিষ্যতে প্রলয়ংকরী ভূকম্পন এড়াতে পারব আমরা কাজটা করতে পারলে।’

‘কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না, এসব আমাকে বলে লাভ কী?’ অধৈর্য হয়ে পড়েছেন আশফাক খান।

‘সবটা না বললে বুঝতে পারবেন না। আমার বিশ্বাস, একটা ফল্টের সঙ্গে ঠেকে গেছে আরেকটা ফল্ট। আর ঠেকেছে ভালোমতোই।’

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন আশফাক খান। কোনো কথা বললেন না।

আশফাক খানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন আবু তাহের, ‘জানেন, ওই প্লেট দুটি হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কী ঘটবে?’

মাথা নাড়লেন আশফাক খান, ‘না!’ এতক্ষণে সত্যি সত্যি কৌতূহলী হয়ে পড়েছেন তিনি, ‘কী ঘটবে?’

‘ধ্বংস হয়ে যাবে সাগরের নিচের ওই ফল্টের কাছের বিস্তীর্ণ এলাকা। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এই জায়গাও বাদ পড়বে না।’

‘কীভাবে ধ্বংস হবে?’

‘ভয়ংকর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে ফল্টের তলায়। প্লেটগুলো সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে সাংঘাতিকভাবে। শিগগিরই বিস্ফোরিত হবে।’

‘বিস্ফোরিত হবে!’ কপালের পাশের শিরাটা সামান্য ফুলে উঠেছে আশফাক খানের।

‘হ্যাঁ, এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে প্লেট দুটি। এরপর কয়েক মিনিটও টিকবে না আর পার্বত্য চট্টগ্রামের এই এলাকা। কক্সবাজার তো বিপদ এড়াতে পারবেই না, চিটাগাংও বিপদ–মুক্ত নয়।’

‘খোদা!’ চাপা গলায় প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন আশফাক খান। কোন দিকে এগিয়ে চলেছে ঘটনাপ্রবাহ, বুঝতে পারছেন না তিনি।

আট

একটি ধবধবে সাদা অপারেটিং টেবিলে শুয়ে আছে ইউসুফ। তার ওপর ঝুঁকে রয়েছে টোরা। হিগ আর রাটিন তাকে সহযোগিতা করছে। অদ্ভুতদর্শন কতগুলো টেস্ট ইক্যুইপমেন্ট ঘরের দেয়ালে বসানো হয়েছে। আইস টানেলের ক্রিস্টাল আলোর মতোই আলো বেরোচ্ছে যন্ত্রপাতিগুলো থেকেও।

‘কাজ শুরু করব?’ জিজ্ঞেস করল হিগ।

‘হ্যাঁ,’ বলল টোরা। ‘ওর কনশাসনেস লেভেল থার্টি টুতে স্থির হবে।’

চোখ মেলল ইউসুফ। ঘুম ঘুম ভাব। ইলেকট্রোশিপ পদ্ধতিতে তাকে আধো ঘুমন্ত অবস্থায় রাখা হয়েছে। অচেতন নয়, আবার পুরোপুরি চেতনাও নেই।

‘কতটা নায়োসিনথেটিক বের করতে হবে আগে,’ বলল টোরা।

‘ঠিক আছে,’ বলল হিগ।

‘কাপড়জামাগুলোতে বায়োনিক কিছু আছে কি না, আমার মনে হয় তা-ও দেখা উচিত,’ বলল রাটিন। সব ব্যাপারেই অত্যন্ত সতর্ক সে।

‘কারেক্ট,’ সায় দিল টোরা।

রাটিনের নির্দেশে ইউসুফের গা থেকে সব পোশাক খুলে নিল হিগ। পরীক্ষা করে দেখার জন্য।

কালো গ্লাভস পরে নিয়েছে টোরা। অ্যানটেনাযুক্ত একটা চ্যাপ্টা প্রোব নিয়ে ইউসুফের ডান পায়ে চেপে ধরল। ছোট্ট ডায়ালে রিডিং দেখল। একইভাবে বাঁ পা-টাও পরীক্ষা করল।

‘পুরোনো পা-টা নায়োসিনথেটিক,’ ঘোষণা করল টোরা, ‘কিংবা ফার্স্ট জেনারেশন বায়োনিক। বাঁ পা-টাও ডান পায়ের মতোই। বাঁ হাতটাও।’

‘মারজারন পাওয়ার?’ জিজ্ঞেস করল হিগ।

‘না, নিউক্লিয়ার।’

‘চোখ?’

‘স্পেকট্রানোলেজারটা চালু করো তো,’ আদেশ দিল টোরা।

দ্রুত কয়েকটা সুইচ টিপল হিগ। সিলিংয়ের এক জায়গা থেকে একটা তীব্র উজ্জ্বল আলোকরশ্মি সোজা এসে পড়ল ইউসুফের ডান চোখে। চোখটা পরীক্ষা করল টোরা। ইউসুফের মাথাটা সামান্য একটু ডানে কাত করে ধরে আলোকরশ্মি ফেলল বাঁ চোখে। পরীক্ষা করল এই চোখও।

‘ইনফ্রারেড,’ সঙ্গীদের জানাল টোরা।

নিজের দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা নেই ইউসুফের। চিন্তা করতে পারছে ঠিকই, কিন্তু একটা হাত নড়ানোরও ক্ষমতা নেই। এমনকি চোখের পাতা পর্যন্ত নড়াতে পারছে না। ঘুমানোর অনুভূতি হচ্ছে, কিন্তু ঘুমোচ্ছে না। ঘুমাতে পারছে না। ইলেকট্রোশিপ মেশিন এর জন্য দায়ী। ওটার মিটার হাফপিপ নির্দেশ করছে।

‘ওর মাংসপেশির স্পর্শকাতরতা পরীক্ষা করে দেখা যাক এবার,’ বলল টোরা। হিগকে আদেশ দিল সে, ‘লোহার বার নিয়ে এসো। স্কোলোমিটার চালু আছে?’

এগিয়ে গিয়ে দেয়ালে বসানো ইন্টারকমের সুইচ টিপল হিগ। কাউকে ডাকল। ঘরে এসে ঢুকল একজন টেকনিশিয়ান। তাকে লোহার বার আর দু–চারটি যন্ত্রপাতি আনার নির্দেশ দিল হিগ।

একটি দুই ইঞ্চি ডায়ামিটারের লোহার বার এনে ইউসুফের বায়োনিক হাতের পাশাপাশি রাখল টেকনিশিয়ান। অ্যাপ্রোনের পকেট থেকে একটা কালো ধাতব বাক্স বের করে রাখল বাহুর পাশে, লোহার বারের কাছেই।‍

‘রেডি,’ বলল হিগ। ‘সিকোয়েন্স শুরু। মেজারিং। হ্যাঁ, এইবার।’

আপনা–আপনি ইউসুফের বায়োনিক হাতের মুঠো চেপে ধরল লোহার বারটা, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। কোনো ধরনের চুম্বক যেন টেনে নিয়ে গিয়ে তার মুঠোকে লোহার বার চেপে ধরতে বাধ্য করেছে। ক্রমেই বারের ওপর শক্ত, আরও শক্ত হচ্ছে হাতের চাপ। আশ্চর্য! তার হাতের ভয়ানক চাপে ক্রমেই চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে বারটা।

‘ফোরটি ফাইভ ল্যাটস,’ মিটারের রিডিং পড়ে যাচ্ছে টোরা, ‘ফিফটি...ফিফটি ফাইভ...সিক্সটি...সিক্সটি ফাইভ...সিক্সটি সেভেন...সিক্সটি এইট পয়েন্ট ফো-ফোর...ম্যাক্সিমাম!’

‘দারুণ,’ চমৎকৃত হলো হিগ।

‘ভিজ্যুয়াল ম্যাক্রোডিনামিকস দেখতে হবে এবার!’

চিত হয়ে টেবিলে পড়ে আছে ইউসুফ। অসহায়। কিছুই করতে পারছে না। তার মাথার এক পাশে আরেকটা ধাতব বাক্স রাখল টেকনিশিয়ান। দেয়ালে বসানো একটা আই চার্টে বিচিত্র সব রেখা ফুটে উঠতে লাগল।

‘জুম চালু করো,’ টেকনিশিয়ানকে আদেশ দিল হিগ, ‘এখনই।’

রেখাগুলোর রং পরিবর্তিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আধমিনিট চেয়ে থাকল টোরা। ‘টোয়েন্টি টু ওয়ান,’ বলল সে। ‘মান অতি উন্নত।’

‘অবিশ্বাস্য!’ অবাক কণ্ঠে বলল রাটিন।

‘সত্যি একটা আজব সৃষ্টি লোকটা। নিউরোইউনাসিক স্ক্যান দেখতে হবে এখন।’

ইউসুফের চাঁদিতে দুটি যন্ত্র ঠেকানো হলো।

‘রেডি,’ বলল রাটিন।

মৃদু গুঞ্জন উঠল একটা বিশেষ কম্পিউটারে। দেয়ালের এক জায়গায় আবরণ সরে গেল। ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এল একটা মেটাল বোর্ড। কয়েকটি ইলেকট্রনিক ইক্যুইপমেন্ট বসানো তাতে। কোনোটার দেহে, কোনোটার মাথায় টুপটাপ জ্বলছে-নিভছে রঙিন আলো। টানা দশ সেকেন্ড আলোগুলো জ্বলল–নিভল। তারপর আচমকা থেমে গেল।

‘সিকোয়েন্স শেষ,’ ঘোষণা করল মেয়েটি। ‘ভেন্টিকুলার প্রোব করবে এখন। ওর চেতনাসীমা বিশের নিচে নামিয়ে দাও।’

একটি যন্ত্রের গোটা তিনেক সুইচ টিপল রাটিন। ‘নামছে।’

টের পাচ্ছে ইউসুফ, পুরো ঘুমিয়ে পড়ছে সে। জেগে থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

কয়েক ঘণ্টা পর জেগে উঠে ইউসুফ দেখল, ল্যাবরেটরি খালি। একটা যন্ত্রপাতিও চোখে পড়ল না কোথাও। সব জায়গামতো সরিয়ে রাখা হয়েছে নিশ্চয়ই। আবার জামাকাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। বার কয়েক চোখের পাতা মিটমিট করল সে, তারপর দুই হাতে রগড়াল।

অলংকরণ: সাদাত

হঠাৎই মনে পড়ল, তার হাত দুটি বাঁধা ছিল, এখন খোলা। এক লাফে উঠে বসল সে। প্রথমে বাঁ পাশে তাকাল। তার কাছ থেকে ১০ ফুট দূরে আরেকটা একই ধরনের অপারেটিং টেবিলে শুয়ে আছে দানবটা। হাত ছেঁড়া। আহত।

‘ঘুম ভেঙেই ওই বদখত চেহারা দেখতে চায় কেউ!’ আপনমনেই বিড়বিড় করল ইউসুফ। কণ্ঠে বিরক্তি। একবার দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। অন্য পাশে তাকাল। দেয়ালে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। তার দিকেই চেয়ে আছে। মেয়েটার হাত আর মুখের চামড়ার রং উজ্জ্বল পিঙ্গল। গলায় একটি হীরার নেকলেস। পরনে জাম্প স্যুট।

‘হ্যাঁ, এমন সুন্দর চেহারা দেখলে তবেই না ভালো লাগে,’ বলল ইউসুফ।

‘থ্যাংক ইউ,’ হাসল টোরা।

‘কে তুমি?’

‘টোরা।’

‘পুরো পরিচয়?’

‘ওসব পরে শুনবেন,’ হেসেই বলল মেয়েটা। ‘এখন শুধু জেনে রাখুন, আপনার কোনো ক্ষতি করা হবে না।’

‘সেটা বুঝতেই পারছি। নইলে এতক্ষণে লাশ হয়ে যাওয়ার কথা,’ এদিক–ওদিক তাকাল ইউসুফ, ‘শারিতা কোথায়?’

‘আছে। ভাববেন না, ভালোই আছে সে।’

‘ওকে কী করেছ তোমরা?’

‘আপনাকে নিয়ে যা করেছি। পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে ওকে।’

‘ওর কোনো ক্ষতি করলে ভালো হবে না বলে দিলাম।’ টোরার চোখে চোখে তাকাল ইউসুফ। ‘তা বললে না তো তুমি কে? কী কাজ করো? ওই রোবটটাই–বা কার সৃষ্টি?’ দানবটাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে।

‘ওকে ভিটু ডাকি আমরা,’ হেসে বলল টোরা। উঠে এসে দাঁড়াল ইউসুফের পাশে। ‘আমাদের অনেক কাজ করে দেয়।’

‘রোবট, না?’

‘হ্যাঁ।’

‘বায়োনিক?’

‘নায়োসিনথেটিক,’ টোরা বলল। ‘কয়েকটা বেসিক জিনিস আপনারই মতো, কিন্তু অনেক স্থূল।’

‘আমাদের বেস ক্যাম্প ধ্বংস করতে পাঠানো হয়েছিল কেন ওকে?’

‘আপনাদের বসানো সেন্সরে আমাদের অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছিল প্রায়,’ বলল মেয়েটা। ‘নিজেদের রক্ষা করার জন্যই আপনাদের ক্যাম্পটা ধ্বংস করতে পাঠিয়েছিলাম ভিটুকে।’

‘আমাকেও কি ধ্বংস করতেই পাঠিয়েছিলে?’

‘না, ধরে আনতে। আপনার ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম আমরা। সাধারণ মানুষের চেয়ে আপনি আলাদা, দেখেই বুঝেছিলাম। কাজেই পরীক্ষা করে দেখার লোভটা সামলাতে পারিনি।’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইউসুফের দিকে তাকাল টোরা। ‘আপনার মতো আরও কেউ আছে নাকি, মিস্টার ইউসুফ?’

‘আছে,’ ভয় দেখানোর জন্য বলল ইউসুফ। ‘পুরো এক ব্রিগেড বায়োনিক আর্মি আছে আমাদের।’

হঠাৎ দেয়ালের এক জায়গায় বসানো একটি লাল বাতি দপদপ করে জ্বলে উঠল। সেটা দেখিয়ে হাসল টোরা, ‘আপনি মিথ্যা কথা বলেছেন। সে জন্যই সংকেত দিল বাতিটা।’

চুপ করে রইল ইউসুফ।

টোরা বলল, ‘বিশ্রাম নিন এখন। আরও পরীক্ষা চালানো হবে আপনার ওপর। পরে। আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর জানা হয়ে যাওয়ার পর আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়া হবে।’

‘তোমাদের গোপন কথা জানাবে আমাকে? যদি বাইরে গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিই?’

‘পারবেন না,’ রহস্যময় হাসি হাসল টোরা।

‘অত শিওর হচ্ছো কীভাবে? বন্দীকে মেরে ফেলো নাকি?’

‘সেটা সময় হলেই জানতে পারবেন।’

ইউসুফের বেশি কাছে চলে এসেছে টোরা। আচমকা থাবা মারল ইউসুফ। কিন্তু ধরতে পারল না। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল টোরা। ভোজবাজি যেন।

চারপাশে তাকাতে লাগল ইউসুফ। ঘরের কোথাও দেখতে পেল না টোরাকে। কী করে কোন পথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে সে, বুঝতে পারল না।

তিন সেকেন্ড পরই আবার আগের জায়গায় টোরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ইউসুফ। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

ভুরু কোঁচকাল ইউসুফ, ‘জাদু জানো নাকি?’

উত্তরে শুধু হাসল টোরা।

‘কোনো কথারই তো জবাব দিচ্ছ না। আচ্ছা, ঠিক আছে, টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো জানতে চাইব না। শুধু বলো, বাড়ি কোন দেশে তোমার।’

‘কোনো দেশ নয়, বলুন কোন গ্রহ।’

‘বেশ, কোন গ্রহ?’

‘সবই জানতে পারবেন, মিস্টার ইউসুফ। ওই যে বললাম, পরে।’ আবার ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল টোরা।

(চলবে...)

আরও পড়ুন