আরেকটা আমি ও দাবড়উদ্দিন স্যার

অলংকরণ: মাহফুজ রহমান

প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় আমি অঙ্কে ১০০ তে ১২ পেয়েছি। ১০০ তে ১২ মানে এফ মাইনাস গ্রেড। আমাদের ইদ্রিস খাঁ রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলে এফ মাইনাস নামেও আরেকটা গ্রেড আছে। এফ মাইনাস গ্রেড পেলে এক বেলা খাবার দেওয়া হয় না। সকাল-বিকেল দুই বেলা মাঠের ঘাস কাটতে হয়। আমাদের মাঠে অবশ্য ঘাসের ‘ঘ’-ও নেই। ঘাস না পেলে মাঠ থেকে ময়লা বাছতে হয়। ফলে আমাদের মাঠটা সারা বছর ঝকঝকে-তকতকে থাকে। মাঠ বাদে বাকি স্কুলের চেহারা ঠিক পোড়োবাড়ির মতো। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, স্কুল বিল্ডিংটা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

অঙ্কে ১২ পাওয়ার মতো অত খারাপ ছাত্র নই আমি। ১২ পেয়েছি অন্য এক কারণে। কারণটা কাউকে বলিনি। বললে কেউ বিশ্বাসও করবে না। অঙ্ক পরীক্ষার দিন লিখছি লিখছি, অন্তত ষাট নম্বর পাওয়ার মতো উত্তর দিয়েছি। খাতা জমা দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে মনে হলো, কেমন করে যেন উত্তরগুলো ওলট-পালট হয়ে গেছে। মাথাটা ঘুরে গেল আমার! আবার ঠিক করতে যাব, এমন সময় ছোঁ মেরে খাতাটা নিয়ে গেলেন দবিরউদ্দিন স্যার। দবিরউদ্দিন স্যারকে আমরা ডাকি দাবড়উদ্দিন স্যার নামে। দাবড় মানে হলো ধমক-ধামক, বকাবকি। দাবড়উদ্দিন স্যার ধমক ছাড়া কথা বলেন না। গত বছর পিটিয়ে তিনটা ছেলের হাত ভেঙে দিয়েছিলেন!

২.

রাত তখন কয়টা বাজে জানি না। স্বপ্নে দেখছিলাম, আমি একটা মোরগের পিঠে চড়ে স্কুলের ছাদ থেকে উড়তে শুরু করেছি। এমন সময় দেখি, নিচে দাবড়উদ্দিন স্যার খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘ওই বেত্তমিজ, নিচে নেমে আয়! কত্ত বড় সাহস আমার মোরগ নিয়ে মশকরা!’

আমি তখন ভয় পেয়ে মোরগটাকে ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে পড়লাম। আর মোরগটা সোজা স্যারের মাথার ওপর গিয়ে টুপ করে একটা ডিম পেড়ে দিল! ফটাস করে ফেটে গেল ডিমটা। ডিমের কুসুম দিয়ে স্যারের মুখ মাখামাখি! স্যার তখন একটা লাঠি নিয়ে আমাকে তাড়া করতে লাগলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি সোজা গিয়ে ঢুকলাম আমার ৫৩২ নম্বর রুমে। দরজাটা আটকাতে না-আটকাতেই ধাম ধাম করে বাড়ি দিতে লাগলেন দাবড়উদ্দিন স্যার, ‘এই বদমাশ, দরজা খোল বলছি! খোল দরজা!’

তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। আর শুনলাম সত্যি সত্যিই দরজায় শব্দ হচ্ছে। দাবড়উদ্দিন স্যার সমানে চেঁচাচ্ছেন, ‘এই বদমাশ, দরজা খোল বলছি! খোল দরজা!’

ভয়ে ভয়ে দরজা খুললাম। খুলতেই দেখলাম, দাবড়উদ্দিন স্যার ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা বেত, মুখজুড়ে বিশ্রীরকমভাবে লেগে আছে ডিমের কুসুম! আমার কান ধরে প্রায় শূন্যে তুলে ফেললেন স্যার। মাঝরাতে সবাই ঘুম ঘুম চোখে দৃশ্যটা দেখে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। লুঙ্গিতে গিট্টু দিতে দিতে আমাদের হাউজ টিউটর স্যারও ছুটে এলেন। বিকট একটা হাই তুলতে তুলতে জিগ্যেস করলেন, ‘দবির স্যার, এর বিষয় কী?’

‘বিষয় গুরুতর। বদমাইশের হাড্ডিটা ছাদ থেকে আমার মুখে পচা ডিম ছুড়ে মেরেছে! আজকে ওর পাছার ছাল তুলে ফেলব!’

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। স্বপ্নের ঘটনাটা সত্যি হলো কী করে!

৩.

ঘটনাটি পরিষ্কার হলো আজ সন্ধ্যায়। প্রতি সন্ধ্যাবেলা দাবড়উদ্দিন স্যার তাঁর বিখ্যাত বেতটা হাতে নিয়ে নাচাতে নাচাতে পুরো স্কুলটা টহল দেন। আজও টহল দিতে দিতে লাইব্রেরির পেছন দিকটায় গেলেন। আমি তখন ছাদে। নিচে নামতে যাব এমন সময় মনে হলো, আমার মতোই একজন দাবড়উদ্দিন স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠল! ভালো করে লক্ষ করলাম, সত্যিই আরেকটা আমি! কী যেন কথা হচ্ছে দুজনের মধ্যে। হঠাৎ করেই স্যার ভীষণ খেপে গেলেন। বেত তুলে সপাং করে একটা মার বসালেন আরেকটা আমির পায়ে। আর ঠিক তখনই আরেকটা আমি নাই হয়ে গেল! ফস করে আগুন ধরে গেল স্যারের বেতটায়! কয়েক সেকেন্ড লাগল বিষয়টা বুঝতে। দাবড়উদ্দিন স্যার ‘ইয়া মাবুদ’ বলে জ্ঞান হারালেন।

পুনশ্চ

সেই রাতেই স্কুল ছাড়লেন দাবড়উদ্দিন স্যার। যাওয়ার আগে কিছুই বলতে পারছিলেন না। ডাঙায় তোলা কাতল মাছের মতো মুখটা একবার হা করছিলেন, একবার বন্ধ করছিলেন। ছেলেরা সেটা দেখে ফিক ফিক করে হেসে দিল। কেবল আমার চোখে চোখ পড়তেই স্যার আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন! তখনই একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হলো। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর স্কুলের নাম মুখে নেননি! অনেক জিগ্যেস করার পর নাকি বলেছেন, ‘স্কুলে ভূতের আছর আছে!’ এদিকে আরেক আমিকে আর কখনো চোখে পড়েনি। এই কথাটা কাউকে বলতেও পারি না। বললে কেউ বিশ্বাস করবে নাকি!

(কিশোর নববর্ষ ১৪২০ সংখ্যায় প্রকাশিত)