রাত তখন ১২টা। চারদিক নিস্তব্ধ। মাঝেমধে৵ কুকুরের ডাক শোনা যায়। ইলহান তখনো ঘুমায়নি। বই পড়ছিল। হঠাৎ জানালার কাচে ঠক করে কিছু একটা আঘাত করে। ভয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে বাইরে তাকায়—কিছুই দেখতে পায় না। অন্ধকার এতটা ঘন ছিল, যেন আলোও সেখানে প্রবেশ করতে ভয় পায়।
হঠাৎ পেছন থেকে ঠান্ডা বাতাসের একটি ঝাপটা এসে তার ঘাড় ছুঁয়ে যায়। ইলহান চমকে পেছনে তাকায়—কেউ নেই! সে ভেবেছিল, হয়তো এসব কল্পনা। আবার বই পড়তে বসে। কিন্তু ঠিক তখনই দরজার নিচ দিয়ে একটি কাগজ সরে আসে। তাতে শুধু একটি বাক্য লেখা:
‘ঘরের বাইরে এসো, না হলে চিরতরে হারিয়ে যাবে।’
ইলহানের বুক কেঁপে ওঠে। কে এটা পাঠাল? সে জানত, খেলাচ্ছলে কেউ এটি করবে না। হাতে একটি টর্চ নিয়ে ধীরে ধীরে বের হয় সে। বাড়ির পেছনে যেতেই ইলহান দেখতে পায়—একটি কালো ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। লাল চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ইলহান টর্চ ফেলে দৌড়ে পালাতে থাকে। কিন্তু যতই দৌড়ায়, ততই যেন ছায়াটি তার সামনে চলে আসে।
একটি পুরোনো গাছের কাছে গিয়ে ছায়ামূর্তিটি বলে ওঠে:
‘তুমি আমাদের প্রতিশ্রুতি ভেঙেছ, ইলহান... এখন শোধ দিতে হবে!’ তারপর হঠাৎ চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়। আর ইলহানকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু তার ঘরের জানালার কাচে এখনো মাঝেমধে৵ ঠক করে কিছু একটা লাগে...যেন কেউ ফিরে আসতে চায়।
*
চার দিন কেটে গেছে। ইলহান নিখোঁজ। পুলিশ, পরিবার, বন্ধু—সবাই খুঁজেছে; কিন্তু কোনো খোঁজ মেলেনি। তার ঘরটা এখন যেন নিঃশব্দ এক রহস্যে মোড়ানো। ঠিক পঞ্চম রাতে, ইলহানের খাতার ভেতর থেকে একটি পৃষ্ঠা বেরিয়ে আসে—নিজেই যেন লেখা হয়েছে:
‘আমাকে তারা নিয়ে গেছে; কিন্তু আমি এখনো লড়ছি। সেই পুরোনো গাছটার নিচে... আমি অপেক্ষায় আছি।’
ইলহানের ছোট ভাই জুনায়েদ সেই চিরকুট পড়ে সাহস করে পৌঁছে যায় বাড়ির পেছনে, সেই পুরোনো গাছটির কাছে। হঠাৎ মাটির নিচ থেকে একরাশ কুয়াশা উঠে আসে। আর কুয়াশার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসে ইলহান—কিন্তু তার চোখ দুটি যেন শূন্য, ঠান্ডা। জুনায়েদ তাকে জড়িয়ে ধরতেই ছায়ামূর্তির কণ্ঠ শোনা যায়—
‘শেষ সুযোগ দিয়েছি তাকে। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেই মুক্তি—নইলে তুমি পরবর্তী।’
ইলহান তখন কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে: ‘আমি ফিরে যেতে চাই। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি।’
ছায়াটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। বেরিয়ে আসে এক করুণ মুখ—ইলহানের বন্ধু রুবেল, যে বছরখানেক আগে এই এলাকায় রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছিল। তার সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল ইলহান—একটি গোপন সত্যের বিনিময়ে এক রাতের জন্য অন্য জগতে প্রবেশ করেছিল তারা। কিন্তু ইলহান কথা রাখেনি। রুবেল সেই জগতে আটকা পড়ে যায়, আর প্রতিশোধ নিতে ফিরে আসে।
ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে বলে:
‘তুমি এখন বুঝেছ। আমি মুক্ত। তুমি বাঁচলে, আমি চলে যাব।’
একঝটকায় সব আলো ফিরে আসে, গাছটি ঝাপসা হয়ে ভেঙে পড়ে, আর ছায়ামূর্তিটি মিলিয়ে যায় বাতাসে। ইলহান ধীরে ধীরে নিজের ঘরে ফিরে আসে। চোখ দুটি আবার প্রাণ ফিরে পায়। সবাই আনন্দে কেঁদে ফেলে।
কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। প্রতিবছর সেই দিনে ঠক করে কিছু একটা লাগে জানালার কাচে। এখন আর ভয় করে না ইলহানের। ও জানে, প্রতিশ্রুতি কখনো ভাঙা যায় না; ভাঙলে ছায়া আবার ফিরে আসবে...
লেখক: শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, খুলনা জিলা স্কুল, খুলনা