বরফ বিভীষিকা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এক

তুষারে ছাওয়া রাস্তার ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। একটা মোড় পেরোনোর সময় চাকা পিছলে দুলে উঠল গাড়ির পুরো কাঠামো। অস্ফুট আওয়াজ করল জিমি পারকার, খপ করে আঁকড়ে ধরল দরজার হাতল।

‘সাবধানে, রনি ভাই!’ বলে উঠল ও।

‘সাবধানেই চালাচ্ছি,’ জানাল রনি স্টিভেনস। গাড়ি ড্রাইভ করছে সে। ‘কিন্তু রাস্তা যা পিছলা! চাইলেও ঠেকাতে পারছি না। তবে পৌঁছে যাব শিগগিরই, এটাই বাঁচোয়া। রাস্তা বেশি বাকি নেই আর।’

রনির পাশে বসেছে জিমি। জানালা দিয়ে তাকাল বাইরে। বরফে ছাওয়া চারপাশের পাহাড়ের সারি দেখে মুগ্ধ হলো। ‘মনে হচ্ছে, বরফের রাজ্যে পৌঁছে গেছি। স্কিয়িং আর স্লেজিং করে উইকএন্ডটা জমবে ভালো।’

‘আমার আগ্রহ আইস স্কাল্পচার, মানে বরফ-ভাস্কর্য নিয়ে,’ এবার মুখ খুলল অয়ন হোসেন। পেছনের সিটে আয়েশ করে বসে আছে ও। হাতে বুকলেট। কোথাও যাওয়ার আগে সেই জায়গা সম্পর্কে পড়াশোনা করা ওর অভ্যাস। ‘বেশ কজন আইস আর্টিস্ট জড়ো হয়েছে ওখানে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বানাচ্ছে নানা ধরনের ভাস্কর্য। বরফ দিয়ে কিছু বাড়িও বানানো হচ্ছে, চাইলে থাকা যাবে সেগুলোয়।’

‘দরকার নেই বরফের বাড়িতে থাকার,’ বেরসিকের মতো বলল রনি। ‘ধসেটসে পড়লে মরব।’

‘সে ভয় নেই। এগুলো হলো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিস্ময়। এস্কিমোদের ইগলুর কথা শোনেননি? বরফের চাক দিয়ে বানায়। তবে শুধু ইগলু নয়, বরফ দিয়ে বানানো বহু বাড়িঘর, এমনকি হোটেল আছে দুনিয়ায়। আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন...এসব দেশে তো আছেই; আমাদের পাশের দেশ—কানাডার কুইবেকেও আছে বরফের তৈরি এক হোটেল। হোটেল ডি গ্লাস নাম ওটার।’

‘লেকচার শুরু করে দিলি, না?’ বিরক্ত গলায় বলল জিমি।

‘লেকচার দিলাম কোথায়?’ অয়ন বলল। ‘রনি ভাই বরফের বাড়িতে থাকতে ভয় পাচ্ছেন বলে খানিকটা আশ্বস্ত করলাম আরকি।’

‘এই প্রথম শুনলাম, লেকচার শুনলে মানুষের ভয় কেটে যায়।’

‘ফাজলামি করছিস? খাবি এক গাঁট্টা!’

ওদের কথা শুনে মুচকি হাসল রনি। অয়ন-জিমির বড় ভাইসম বন্ধু সে। পড়ে কয়েক ক্লাস ওপরে। মাঝেমধ্যে ওদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে। এবার যেমন চলেছে জায়ান্টস রিজ নামে এক ছোট্ট শহরে। শহরটা বহুদিন থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল, সম্প্রতি এক রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার কিনে নিয়েছে ওটা। ঘরবাড়ি মেরামত করে আবারও মানুষ বসবাস শুরু করতে চাচ্ছে। লোকজনকে আকর্ষণ করার জন্য আয়োজন করেছে আইস ফেস্টিভ্যাল বা বরফ উৎসবের। সেখানে রয়েছে শীতকালীন নানা ধরনের খেলাধুলা আর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। সেসবই দেখতে চলেছে ওরা।

একটু পরে গাড়ির নাক ঘুরিয়ে একটা সংকীর্ণ পথে নেমে এল রনি। ম্যাপ চেক করল, তারপর ইশারা করল সামনে। ‘ওই যে, ওই পাহাড়টার নামই বোধ হয় জায়ান্টস রিজ। পাহাড়ের নামেই শহরের নাম।’

তাকাল অয়ন-জিমি। চোখে পড়ল দুর্লঙ্ঘ্য এক পাহাড়, সারা গায়ে বরফের সাদা চাদর মেখে ধবধব করছে। চূড়াটা ঢাকা পড়ে আছে ঘন কুয়াশায়।

‘বাপ রে!’ বলল জিমি। ‘উৎসবটা পাহাড়ের নিচে হচ্ছে তো? ওপরে উঠলে তো ঠান্ডায় জমে যেতে হবে মনে হচ্ছে।’

‘পাহাড়ের ওপরে কখনো শহর থাকে? গাধার মতো কথা বলিস কেন?’ পেছন থেকে বলল অয়ন।

অবাক ব্যাপার, খেপল না জিমি। শরীর অর্ধেকটা ঘুরিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, ‘এবার কিন্তু তুই একটা ভুল কথা বললি। গাধা কি কথা বলতে পারে?’

থতমত খেয়ে গেল অয়ন।

শব্দ করে হেসে ফেলল রনি।

সোজা হয়ে বসল জিমি। ‘পাহাড়ের নামটা কিন্তু বেশ অদ্ভুত। জায়ান্টস রিজ...দানবের পাহাড়। এমনতরো নাম কেন?’

‘কয়েক রকম ব্যাখ্যা আছে,’ বুকলেটে চোখ বোলাল অয়ন। ‘অনেকে বলে, পাহাড়ের সারিটাকে দূর থেকে ঘুমন্ত একটা দানবের মতো দেখায়; তাই এই নাম। আবার কারও কারও ধারণা, সত্যি সত্যি একটা বরফের দানব ওই পাহাড়ের ভেতর কয়েক হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে।’

‘অ্যাঁ!’ চমকে গেছে জিমি। ‘এসব কথা আগে বলিসনি কেন?’

‘বললে কী হতো? আসতি না? তোর কি ধারণা, সত্যি সত্যি দানব আছে ওখানে?’

‘না, মানে...সতর্ক থাকতে ক্ষতি কী?’

‘সতর্ক থাকায় ক্ষতি নেই, ক্ষতিটা আজগুবি কথাবার্তায় কান দেওয়ায়। যা শুনিস, তা–ই বিশ্বাস করিস কেন?’

‘যা রটে, তার কিছুটা তো বটে—শুনিসনি প্রবাদটা? দানব না থাকুক, ভয়ংকর কোনো বুনো জানোয়ারও তো থাকতে পারে পাহাড়ে!’

‘সাধারণ একটা পাহাড়ি এলাকায় যা থাকে, তা-ই। ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়। আর ওই দানবটানব তো সম্পূর্ণ বোগাস। স্রেফ একটা মিথ। দুনিয়ার যে প্রান্তেই যাস, এ ধরনের কোনো না কোনো মিথ সব জায়গাতেই পাবি।’

কিছুক্ষণের মধ্যে পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল ওরা। রাস্তার ধারে অন্যান্য গাড়ির পাশে নিজের গাড়ি পার্ক করল রনি। নেমে পড়ল অয়ন আর জিমিকে নিয়ে।

পার্কিং এরিয়ার পাশে বড় বড় গাছ, তার মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটা হাঁটাপথ। সেটা ধরে এগিয়ে চলল তিনজন। পথের দুই পাশে ঝোলানো হয়েছে রঙিন বাতির সারি। কিছুদূর পরপর চোখে পড়ছে নানা ধরনের সাইনবোর্ড আর ব্যানার—জায়ান্টস রিজ আর আইস ফেস্টিভ্যালে স্বাগত জানানো হচ্ছে অতিথিদের, বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে উৎসবের বিভিন্ন আকর্ষণের। সেসব দেখতে দেখতে এগোচ্ছে ওরা। হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো।

একটা বাঁক ঘুরতেই শীতের ভারী পোশাক পরা এক মহিলাকে দেখতে পেয়েছে ওরা, ওদের দিকে পেছন ফিরে রয়েছে। মহিলার পায়ে স্নো শু, হাতে একটা স্প্রে ক্যান। সেই ক্যানের লাল রং দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটছে একটা সাইনবোর্ডের গায়ে, মুছে দিচ্ছে বড় করে লেখা ‘স্বাগত’ শব্দটা।

‘আরে, আরে!’ বলে উঠল রনি। ‘করছেন কী আপনি!’

চমকে উঠে পাঁই করে ঘুরল মহিলা। ওদের জরিপ করল কয়েক পলক, তারপর আবার উল্টো ঘুরে যা করছিল, তা-ই করতে থাকল।

‘যা করছি, ঠিকই করছি,’ বলল সে। ‘সব কটি সাইনবোর্ড আর ব্যানার নষ্ট করে দিতে হবে। মানুষজন আসার কোনো দরকার নেই এখানে। সবাই চলে গেলেই বরং খুশি হব আমি।’

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল অয়ন, জিমি আর রনি।

জিমি জিজ্ঞাসা করল, ‘আইস ফেস্টিভ্যাল পছন্দ করেন না আপনি?’

‘কিসের ফেস্টিভ্যাল?’ ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টি হানল মহিলা। ‘পরিবেশ নষ্ট করার? শয়ে শয়ে লোক যখন বনবাদাড়ে ঘুরবে, হইচই করবে, বন্য প্রাণীদের কী দশা হতে পারে, ভেবে দেখেছ? শীতনিদ্রা ভাঙলে কেমন লাগবে এখানকার ভালুকদের?’

‘আপনি কে, বলুন তো?’ জানতে চাইল অয়ন। ‘পরিবেশ নিয়ে আপনি এত চিন্তিত কেন?’

‘পরিবেশ রক্ষার জন্য আলাদা কোনো পরিচয়ের দরকার হয় না,’ বলল মহিলা। ‘তারপরও যদি জানতে চাও...আমার নাম এড্রিয়ান ওয়েলস। আমি একজন জুওলজিস্ট। বহুদিন থেকেই গবেষণা করছি এই এলাকার বুনো পশুপাখি নিয়ে। ২০ বছর ধরে সুখে-শান্তিতে রয়েছে এরা। কিন্তু এখন? দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করেছে, বন আর পাহাড় থেকে খেদিয়ে ছাড়বে ওদের। যাবে কোথায় ওরা?’

প্রশ্নটার জবাব দিতে পারল না ওরা। জবাবের জন্য অপেক্ষা অবশ্য করলও না এড্রিয়ান। ওদের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে ঢুকে পড়ল গাছগাছালির ভেতর।

বড় করে শ্বাস ফেলল অয়ন। ‘হুম, দেখা যাচ্ছে আইস ফেস্টিভ্যাল পছন্দ করে না, এমন মানুষও আছে এখানে।’

‘বেটির কথাবার্তাও বিশেষ সুবিধার মনে হলো না আমার কাছে,’ বলল জিমি। ‘আস্ত অভদ্র।’

‘ওকে নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই,’ বলল রনি। ‘চলো, এগোই।’

আবার হাঁটতে শুরু করল ওরা। একটু পরেই বন পেরিয়ে পৌঁছে গেল জায়ান্টস রিজের মূল সড়কে। ছোট্ট, ছিমছাম একটা শহর। রাস্তার দুই ধারে দোকানপাট আর বাড়িঘরের সারি। মোড়ে মোড়ে ভ্যান নিয়ে বসে পড়েছে খাবার বিক্রেতারা। সব কটি বাড়ি সাজানো হয়েছে রঙিন বাতি দিয়ে, ঝুলছে নানা ধরনের ব্যানার।

‘হ্যাঁ, এখন সত্যিই মনে হচ্ছে একটা ফেস্টিভ্যালে এসে ঢুকেছি,’ মন্তব্য করল জিমি।

‘আরে, ওটা কী!’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রনি। ওপর দিকে ইশারা করছে সে।

ঝট করে মাথা তুলল অয়ন-জিমি। একপলকের জন্য চোখে পড়ল সাদাটে একটা আকৃতি। পরক্ষণে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল ওটা।

দুই

‘ওরে বাবা!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল জিমি। ‘কী ওটা?’

‘বুঝতে পারলাম না তো,’ বলল অয়ন। ‘মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল।’

‘কিন্তু কী হতে পারে?’ ভুরু কুঁচকে বলল রনি।

‘বোধ হয় চোখের কারসাজি,’ অনুমান করল অয়ন। ‘বাতাসে পাক খাচ্ছে তুষার, হঠাৎ করে একটা জন্তুর মতো লেগেছে।’

‘সত্যি সত্যি জন্তু হতে পারে না?’ বলল জিমি। ‘এড্রিয়ান তো বললই, পাহাড়ে ভালুক আছে।’

‘ভালুকের মতো তো লাগল না। তা ছাড়া এড্রিয়ান এ-ও বলেছে, ভালুকেরা এখন শীতনিদ্রায়। নাহ, চোখের ভুল ছাড়া আর কিছু নয়।’

‘তিনজনই চোখে ভুল দেখলাম?’

কী বলবে, ভেবে পেল না অয়ন। তাকিয়ে রইল ওপর দিকে। ঠিক তখনই পেছনে পায়ের আওয়াজ হলো। শোনা গেল একটা মিষ্টি গলা।

‘পাহাড়টা সুন্দর না?’

ঘুরল তিনজন। শীতের ভারী পোশাক, আর পশমি বুট পরা এক তরুণী এসে হাজির হয়েছে। মুখভরা হাসি। বলল, ‘স্বাগত। আমি টিফানি টিরেল—চমৎকার এই উইন্টার ভিলেজের ডেভেলপার। আশা করছি আইস ফেস্টিভ্যালটা ভালো লাগবে তোমাদের।’

‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মিস টিরেল,’ বলল রনি। ‘আমি রনি স্টিভেনস, আর এরা হলো অয়ন হোসেন ও জিমি পারকার।’

‘প্লিজ, আমাকে শুধু টিফানি বলে ডাকো,’ একে একে ওদের সঙ্গে হাত মেলাল মেয়েটা। ‘জায়ান্টস রিজে আমরা সবাই সবার বন্ধু।’

‘তাই নাকি?’ খনখনে গলায় বলে উঠল কেউ। ঘাড় ফেরাতেই লম্বা লম্বা পা ফেলে মাঝবয়সী এক মহিলাকে এগিয়ে আসতে দেখল ওরা। গায়ে ওভারকোট, মাথায় পশমের টুপি। টুপির তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে কাঁচা–পাকা চুলের গোছা। চেহারায় রুক্ষতা।

‘হাই, বারবারা!’ বেজার মুখে সম্ভাষণ জানাল টিফানি। ‘কখন এলে?’

জবাব না দিয়ে মুখ বাঁকা করল বারবারা নামের মহিলাটি। বলল, ‘বড় বড় কথা তো বহুত বলছ। কিন্তু আমি বলে দিচ্ছি, হ্যাভারশ্যাম রিসোর্টের সামনে দুই দিনও টিকবে না তোমার এই শহর। লাটে উঠবে ব্যবসা। তখন দেখব আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো কি না।’

‘হ্যাভারশ্যাম রিসোর্ট?’ জিমির চোখে জিজ্ঞাসা।

‘হ্যাঁ, আমার রিসোর্ট,’ বলল বারবারা। ‘এই এলাকার সেরা রিসোর্ট। আনন্দে সময় কাটানোর সব ব্যবস্থা তো আছেই, ওখানে বরফ দানবের উৎপাতও নেই।’

‘বরফ দানব মানে?’ চমকে উঠল রনি।

‘বাজে কথা বন্ধ করো, বারবারা,’ বিরক্ত গলায় বলল টিফানি। ‘গুজব শুনিয়ে আমার গেস্টদের ভয় দেখিয়ো না।’

‘গুজব না সত্যি, তা তুমি খুব ভালো করেই জানো,’ বারবারা নির্বিকার। ‘ঘুম ভেঙেছে পাহাড়ের ওই দানবের, গত কদিনে অনেকেই দেখেছে ওটাকে। যেকোনো মুহূর্তে একটা খারাপ কিছু ঘটে যাবে।’

‘কচু দেখেছে। সবার সঙ্গে কথা বলেছি আমি। ভালুকটালুক দেখেছে হয়তো, ভাবছে অন্য কিছু। যাক গে, এসব নিয়ে তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। কী চাও, তা-ই বলো।’

‘ও মা! আমার কি আসা নিষেধ? আইস ফেস্টিভ্যাল দেখতে পারি না আমি?’

‘ফেস্টিভ্যালে এসে থাকলে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি ঝামেলা পাকাবার চেষ্টা করো, ভালো হবে না।’

‘বাপ রে, কী হুমকি! ভয়ে মরে যাই!’ হাসতে হাসতে চলে গেল মহিলা।

অয়নদের দিকে ঘুরল টিফানি।

‘ব্যাপারটা কী?’ জানতে চাইল জিমি। ‘কে উনি?’

‘নাম তো শুনলেই—বারবারা হ্যাভারশ্যাম। কয়েক মাইল দূরের হ্যাভারশ্যাম রিসোর্টের মালিক। শুরু থেকেই লেগে আছে আমাদের পেছনে। ২০ বছর ধরে একচেটিয়া ব্যবসা করছে এই এলাকায়, এদিকে আর কোনো ভ্যাকেশন স্পট নেই কিনা। এখন জায়ান্টস রিজ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠায় ভয় পাচ্ছে—কাস্টমার হারাবে। তাই শুরু করেছে শয়তানি।’

‘দানব-টানবের কথা বললেন...’

‘পাত্তা দিয়ো না ওসবে। গুজব ছড়িয়ে আমাদের বদনাম করতে চাইছে। আর কিছু না।’

‘শহরটা সত্যিই সুন্দর,’ চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল অয়ন। ‘মিস হ্যাভারশ্যাম কেন ভয় পাচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।’

‘ওর সেই ভয় অমূলক। দুটো ভ্যাকেশন স্পট থাকলেও কাস্টমারের অভাব হবে না। এককালে তো নামকরা ট্যুরিস্ট স্পট ছিল এই জায়ান্টস রিজ। প্রচুর মানুষ আসত। এখানেই জন্ম আমার। ছোটবেলায় দেখেছি ট্যুরিস্টদের আনাগোনা।’

‘সে অবস্থা বদলে গেল কেন? শুনেছি, শহরটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল।’

‘বলতে পারো আমাদেরই দোষে। ট্যুরিস্টদের বিনোদনের জন্য আধুনিক কোনো ব্যবস্থা ছিল না এখানে, কেউ কখনো মাথাই ঘামায়নি। কিন্তু বছর বিশেক আগে হ্যাভারশ্যাম রিসোর্ট চালু হওয়ার পর দেখা দিল সমস্যা। ট্যুরিস্টরা সবাই গিয়ে ভিড় জমাল ওখানে। দিন দিন লোকজন আসা কমতে থাকল শহরে, আয়রোজগারও কমতে থাকল শহরবাসীর। আয় না থাকলে শহরের উন্নয়ন হবে কীভাবে, আর রিসোর্টের সঙ্গে পাল্লাই–বা দেওয়া যাবে কীভাবে? ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো, ধীরে ধীরে রোজগারের খোঁজে শহর ছেড়ে চলে যেতে হলো সবাইকে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল টিফানি।

‘দুঃখজনক,’ মন্তব্য করল রনি।

‘কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি,’ বলল টিফানি। ‘মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি কোনো দিন পারি, এই শহরকে আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাব। এত বছর পর এসেছে সেই সুযোগ। ডেভেলপার হিসেবে নামডাক হয়েছে, হাতে টাকাপয়সাও জমেছে। তাই ছুটে এসেছি জায়ান্টস রিজে।’

‘হুম,’ সমঝদারের মতো মাথা ঝাঁকাল অয়ন, ‘আপনি তা হলে ছেলেবেলার আবেগের টানে ছুটে এসেছেন, আর বারবারা ভাবছেন আপনি এসেছেন তাঁর ব্যবসার বারোটা বাজাতে—ঝামেলাটা এখানেই।’

‘ঠিকই ধরেছ,’ সায় জানাল টিফানি। ‘যাক গে, এসব নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। বারবারাকে কীভাবে সামলাতে হয়, তা আমি জানি। তোমরা বেড়াতে এসেছ, মন খুলে বেড়াও।’

‘তা-ই করব,’ বলল রনি। ‘বরফ ভাস্কর্যের প্রদর্শনীটা কোথায় হচ্ছে?’

‘রাস্তা ধরে এগিয়ে যাও। শেষ মাথায় বিশাল একটা চত্বর আছে—ওখানে। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পীরা এসেছে ভাস্কর্য বানাবার জন্য। আগামীকাল সেরা ভাস্কর্য বাছাই করবেন বিচারকেরা। পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানও হবে। যে জিতবে, সে ৫০ হাজার ডলার পাবে।’

‘ওরেব্বাপরে!’ বলে উঠল জিমি। ‘সে তো অনেক টাকা!’

‘অনেক টাকা পাওয়ার মতোই কাজ করছে ওরা,’ হাসল টিফানি। ‘গেলেই বুঝবে। ওখান থেকে সেরাটা খুঁজে বের করা কঠিনই হবে। আমি আসি, কেমন? কিছু প্রয়োজন হলে জানিয়ো আমাকে।’

চলে গেল সে।

রনি বলল, ‘চলো, আমরাও যাই।’

কিন্তু নড়ল না অয়ন। কপালে ভাঁজ পড়েছে ওর।

‘কী রে, তোর আবার কী হলো?’ জানতে চাইল জিমি।

চিন্তিত গলায় অয়ন বলল, ‘এখানকার আইস ফেস্টিভ্যাল পছন্দ করছে না, এমন দু–দুজনের দেখা পেলাম আমরা। বরফ দানবের গুজব শুনলাম, পাহাড়ের মাথায় কিছু একটা দেখতেও পেলাম।’ ধীরে ধীরে বন্ধুর দিকে তাকাল ও। ‘ভাবগতিক সুবিধার ঠেকছে না রে। মনে হচ্ছে আরেকটা রহস্য পেয়ে গেলাম।’

তিন

অয়নের সঙ্গে তর্কে গেল না জিমি। সিক্সথ সেন্স–জাতীয় কিছু একটা আছে ওর বন্ধুটির, রহস্যের গন্ধ পায়। বলছে যখন, নির্ঘাত একটা কিছু আছে এর ভেতরে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ও বলল, ‘রহস্য থাকলে থাকুক। এখনো তো কিছু ঘটেনি। ঘটলে নাহয় তদন্ত করা যাবে। এখন চল, বরফ-ভাস্কর্যের প্রদর্শনী দেখে আসি।’

‘চল,’ মাথা ঝাঁকাল অয়ন। রনির পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল দুই বন্ধু।

শহরের চত্বরে পৌঁছে গেল ওরা খুব শিগগিরই। অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে ওখানে। ঘুরে ঘুরে দেখছে প্রদর্শনীর ভাস্কর্যগুলো। বরফের বাড়িগুলো বানানো হয়েছে চত্বরের চারধারে, মাঝখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অন্যান্য ভাস্কর্য। নানা রকম পশুপাখি আর বিমূর্ত ভাস্কর্য বানিয়েছে শিল্পীরা, ঢেলে দিয়েছে নিজেদের সৃজনশীলতার পুরোটা। খুবই সুন্দর। ঘুরতে থাকল ওরা।

খানিক পর জলদস্যুদের জাহাজের আদলে বানানো বিশাল এক ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়াল ছেলেরা। জাহাজটার এক মাথায় সত্যিকার একটা মাছধরা জালও ঝুলছে। মজা করার জন্য জাহাজটার দিকে এগিয়ে গেল জিমি। ওটার গায়ে হাত রেখে ভারী গলায় বলল, ‘অ্যাহয়, মেইটি! আমি হলাম ব্ল্যাক বিয়ার্ড দ্য পাইরেট। ক্যারিবিয়ানের ত্রাস।’

‘ত্রাস বলে মনে হচ্ছে না তোকে,’ নীরস গলায় বলল অয়ন। ‘ক্যারিবিয়ানের হাঁস বলা যেতে পারে। হাঁসের মতো প্যাঁক প্যাঁক কর একটু। দেখি, মানায় কি না।’

‘কী–ই-ই!’

হেসে ফেলল রনি।

আর তখুনি হই হই করে ছুটে এল এক লোক। ‘অ্যাই, অ্যাই, করছ কী! জলদি সরে এসো ওখান থেকে! নষ্ট করে ফেলবে তো!’

লোকটার দিকে ফিরল অয়ন। ‘এটা আপনি বানিয়েছেন? খুব সুন্দর হয়েছে।’

‘আরও সুন্দর লাগবে,’ বলল লোকটা। হাসল ওর দিকে তাকিয়ে। ‘কাজ এখনো শেষ হয়নি। রং করা বাকি। পতাকাটা কালো রং করে দেব। জাহাজটার রং হবে লাল, আর চারদিকের তুষারে নীল রং দেব। মনে হবে, সত্যি সত্যি সাগরে ভাসছে।’

‘শুনতেই ভালো লাগছে,’ বলল জিমি, কাছে এগিয়ে এল। ‘এ জিনিস তৈরি করা খুব সহজ হওয়ার কথা না। কত দিন লেগেছে?’

‘প্রায় দুই সপ্তাহ,’ বলল লোকটা। ‘আমি জেমস হারডিন—দুনিয়ার সেরা বরফশিল্পী। দেখো, আগামীকাল আমিই প্রথম পুরস্কার পাব।’

‘হ্যাঁ, পুরস্কার পাওয়ার মতো জিনিসই বানিয়েছেন বটে,’ সায় জানাল রনি।

‘থ্যাংকস। এখন যাই, পেইন্টের ক্যানগুলো নিয়ে আসি গে। এখনই রঙের কাজ শুরু না করলে কালকের আগে শেষ করতে পারব না।’

চত্বর থেকে বেরিয়ে গেল হারডিন। ছেলেরা পা বাড়াল অন্যদিকে।

‘বেশ আত্মবিশ্বাস ভদ্রলোকের,’ হাঁটতে হাঁটতে মন্তব্য করল অয়ন। ‘যেভাবে বললেন, মনে হলো ফার্স্ট প্রাইজটা পেয়েই গেছেন।’

‘সমস্যা কী?’ বলল জিমি। ‘জাহাজটা কত সুন্দর করে বানিয়েছেন...পুরস্কার তো আশা করতেই পারেন।’

‘হ্যাঁ, সুন্দর,’ স্বীকার করল অয়ন। ‘তবে সেরা বলা যায় কি? ওই যে, ওটাই দেখ। আরও সুন্দর না?’

চত্বরের আরেক পাশে ইশারা করছে অয়ন। বিশাল এক বরফের প্রাসাদ মাথা তুলেছে ওখানে, ঝলমল করছে বিকেলের রোদে। কাছে গেল ওরা। সত্যিই অপূর্ব। শিল্পী কতটা খেটেছে, তা বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিটা জিনিস ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রাসাদের গায়ে, দেখা যাচ্ছে প্রতিটা ইটের খাঁজ। চার কোণে মিনার রয়েছে প্রাসাদের, রয়েছে পানিভরা পরিখা, এমনকি ড্র-ব্রিজও আছে। পরিখার পানি থেকে মাথা তুলেছে একটা ড্রাগন।

‘ওয়াও!’ মুগ্ধ গলায় বলল জিমি।

‘ভালো লাগছে তোমাদের?’ এক তরুণী এগিয়ে এল। হাবভাবে বোঝা গেল, সে-ই প্রাসাদটার শিল্পী।

‘না লেগে উপায় আছে? বাপ রে, কী জিনিস বানিয়েছেন! জলদস্যুর ওই জাহাজটার চেয়েও ভালো হয়েছে আপনারটা।’

‘কী যে বলো না!’ বিব্রত হলো মেয়েটা। ‘জেমস হারডিন তো নামকরা শিল্পী, তার চেয়ে আমারটা ভালো হয় কী করে? আমি নিতান্তই অ্যামেচার, শখের বশে বরফের ভাস্কর্য বানাই। এই প্রথম কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি।’

‘প্রথমবারেই বাজিমাত করে দিয়েছেন। মিথ্যা প্রশংসা করছি না, সত্যি!’

‘থ্যাংকস,’ হাসি ফুটল মেয়েটার ঠোঁটে। ‘আমি ক্যারেন ব্যাঙ্কস। তোমরা?’

যার যার নাম বলল অয়ন, জিমি আর রনি।

‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম,’ বলল ক্যারেন। ‘প্রশংসার জন্যও ধন্যবাদ। আগামীকাল পর্যন্ত থাকছ তো?’

‘সে রকমই ইচ্ছা,’ বলল রনি।

‘ভালো। করার মতো অনেক কিছুই আছে এখানে। আশা করি সময় ভালো কাটবে। আমাকে এবার যেতে হয়। প্রাসাদে ফিনিশিং টাচ দেওয়া বাকি।’

ঘুরে চলে গেল ক্যারেন।

রনি বলল, ‘প্রদর্শনী তো দেখা হলো, এখন চলো, এখানে আর কী কী করার বন্দোবস্ত আছে, খোঁজ নেওয়া যাক।’

‘তার আগে কিছু খেয়ে নিলে কেমন হয়?’ রাস্তার ধারে দাঁড়ানো ফুড কার্টগুলোর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাল জিমি। ‘সেই কখন লাঞ্চ করেছি, পেটে ছুঁচো দৌড়াতে শুরু করেছে।’

‘অথচ তুই-ই লাঞ্চে সবচেয়ে বেশি খেয়েছিস,’ খোঁটা দিল অয়ন।

চোখ পাকাল জিমি। ‘বেশি খেলাম কখন? না হয় দুবার স্যুপ নিয়েছি, সেটাকে বেশি বলে?’

‘শুধু স্যুপ? সবই তো ডাবল ডাবল নিলি।’

রেগেমেগে কিছু বলতে চাইছিল জিমি, থমকে গেল গুরুগম্ভীর একটা শব্দ শুনতে পেয়ে। প্রথমে মনে হলো মেঘ ডাকছে, এক সেকেন্ডের মধ্যেই ভুল ভাঙল। মেঘের ডাক নয়, অন্য কিছু। গুমগুম আওয়াজ তুলছে পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে।

ঝট করে চারদিকে তাকাল ছেলেরা, কিন্তু শব্দটার উৎস দেখতে পেল না। শুধু ওরাই নয়, চত্বরের সব মানুষই বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছে চারপাশে।

‘কিসের আওয়াজ?’ হতভম্ব গলায় বলল রনি। ‘আসছে কোত্থেকে?’

‘কোনো জানোয়ারের গর্জন বলে মনে হচ্ছে,’ এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল অয়ন।

‘কোন জানোয়ার? এ রকম গর্জনওয়ালা জানোয়ার তো কোনো দিন দেখিনি।’

‘আজ দেখবেন,’ ভয়ার্ত গলায় বলল জিমি। ‘ওই যে!’

ঘাড় ফিরিয়ে চমকে উঠল অয়ন আর রনি। চত্বরের শেষ প্রান্তে, যেখানে শহর শেষ হয়ে পাহাড়ি অরণ্যের শুরু, সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক প্রাণী। এমন প্রাণী কেউ কোনো দিন দেখেনি। সারা দেহ বড় বড় লোমে ঢাকা, লোমের ওপরে পড়েছে বরফের আস্তর। হাতের আঙুলগুলোয় বড় বড় নখ। মুখটা বীভৎস, ভয়ংকর। সেই মুখ তুলে হাঁ করল প্রাণীটা, আবারও শোনা গেল অপার্থিব-হিংস্র গর্জন।

আতঙ্কের ঢেউ বয়ে গেল চত্বরে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে উঠল দর্শক, শিল্পী, সবাই। শুরু করল ছোটাছুটি, পালাতে চাইছে। অয়ন, জিমি আর রনি নড়ল না। যেন শিকড় জমে গেছে ওদের পায়ে, দাঁড়িয়ে রইল বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়ে। ওদের চোখের সামনে ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল প্রাণীটা। হাত নেড়ে কী যেন ছিটাচ্ছে, সেটা ভাস্কর্যগুলোর গায়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গলতে শুরু করছে বরফ।

‘এ...এ অসম্ভব!’ কোনোমতে বলল অয়ন।

‘আয়,’ অয়নের হাত ধরে টানল জিমি। ‘পালাতে হবে আমাদের।’

ঘুরতে গিয়েও থেমে গেল অয়ন। চোখ পড়ল একটা ছোট বাচ্চার ওপর। দৌড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে বরফ-প্রাসাদের ভাস্কর্যটার সামনে। কাঁদছে তারস্বরে। বাপ-মা কোথায় ছিটকে গেছে, কে জানে, কেউ এগোচ্ছে না তাকে সাহায্য করতে। দানবটা পায়ে পায়ে ওর দিকেই যাচ্ছে।

‘মাই গড!’ বলল অয়ন। ‘বিপদে পড়েছে বাচ্চাটা!’

ওদিকে একপলক তাকাল জিমি, তারপর তাকাল আরেক দিকে। ওদের কাছেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফেস্টিভ্যালের এক সিকিউরিটি গার্ড। তার দিকে ছুটে গেল ও। বলল, ‘আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাচ্চাটাকে সাহায্য করুন!’

‘মাথা খারাপ?’ খেপাটে গলায় বলল লোকটা। ‘ওটা পাহাড়ের দানব। ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। ওর সামনে গিয়ে মরব নাকি?’

দাঁত কিড়মিড় করল জিমি। চোখ পড়ল লোকটার কোমরে। বেল্টের সঙ্গে ঝোলানো খাপে শোভা পাচ্ছে একটা রিভলবার। ছোঁ মেরে তুলে নিল ওটা।

‘আরে, আরে! করো কী!’ চেঁচিয়ে উঠল লোকটা।

জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না জিমি। ‘অয়ন, রনি ভাই, জলদি আসুন!’ বলেই দৌড়াতে শুরু করল বাচ্চাটার দিকে।

‘যাচ্ছ কোথায়?’ জানতে চাইল রনি।

‘বাচ্চাটাকে সরান, আমি দানবটাকে আটকাচ্ছি।’

রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল জিমি, যেন পথ রোধ করল দানবের। বাচ্চাটার কাছে ছুটে গেল অয়ন আর রনি, ধরাধরি করে ওঠাল তাকে। এক পাশে সরিয়ে নেওয়ার সময় ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, দানবটা এখনো এগোচ্ছে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে।

রিভলবার উঁচু করল জিমি। থরথর করে কাঁপছে হাত। হ্যামার টেনে টিপে দিল ট্রিগার। গুলির বিকট আওয়াজ হলো।

থমকে দাঁড়াল দানব। না, গুলি লাগেনি। তাড়াহুড়ায় মিস করেছে জিমি। কিন্তু স্পষ্টতই ঘাবড়ে গেছে দানবটা। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে আচমকা ছুট লাগাল। চত্বর পেরিয়ে ঢুকে পড়ল গাছপালার ভেতরে। হারিয়ে গেল চোখের আড়ালে।

ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল জিমি। কাঁপছে সে। হাত থেকে ফেলে দিল রিভলবার। বাচ্চাটাকে একটা বাড়ির সামনে রেখে তার কাছে ছুটে এল অয়ন আর রনি।

‘দেখালে বটে!’ প্রশংসার সুরে বলল রনি। ‘শাবাশ!’

‘সত্যি, তোর সাহসের তুলনা হয় না,’ অয়নও মুগ্ধ। ‘খামোকাই ভূত-প্রেত আর দৈত্য-দানোর ভয়ে কাবু হয়ে থাকিস।’

‘কিসের সাহস?’ বলল জিমি। ‘আরেকটু হলেই প্যান্ট খারাপ করে ফেলতাম, জানিস?’

ওর বলার ভঙ্গি শুনে হাসি চাপতে পারল না অয়ন আর রনি।

চার.

এক ঘণ্টা পর।

প্রায় খালি হয়ে গেছে জায়ান্টস রিজ। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটকেরা। যারা এখনো যায়নি, তারাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রয়ে গেছে স্রেফ ফেস্টিভ্যালের কিছু কর্মী, আর বরফ ভাস্কর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শিল্পীরা। তারাও দোনোমনা করছে থাকবে কি থাকবে না, এ নিয়ে। ইতিমধ্যে পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, দুজন অফিসার এসেছে। কয়েকজনের জবানবন্দি নিয়েছে তারা, এরপর তল্লাশি চালাতে গেছে আশপাশের এলাকায়। তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় চত্বরে জমায়েত হয়েছে সবাই। চলছে উচ্চ কণ্ঠে আলোচনা।

ভিড় থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন, জিমি আর রনি। আপাতত ওদের দিকে নজর নেই কারও, তবে শুরুতে বিপদে পড়া বাচ্চাটাকে সাহায্য করার জন্য যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছে ওরা। বাচ্চাটা ফেস্টিভ্যাল দেখতে এসেছিল তার চাচার সঙ্গে, সেই চাচাও এসে বারবার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে ওদের। ভদ্রলোক তার ভাতিজার জন্য খাবার আনতে গিয়েছিলেন, তার মধ্যে এই কাণ্ড। ওরা না থাকলে ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারত। প্রশংসা আর পিঠ চাপড়ানোর পর্ব শেষ হওয়ার পর ওদের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে লোকে। এখন নিজেদের মধ্যে করছে তর্কবিতর্ক। দূরে দাঁড়িয়ে সবার কথাবার্তা শুনছে এখন ওরা।

‘...আমি আবার বলছি,’ সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করল টিফানি, ‘এর পেছনে অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে। পাহাড়ি দানবের ব্যাপারটা স্রেফ একটা গল্প। ওটা সত্যি হতে পারে না।’

‘জন্তুটাকে দেখেননি আপনি?’ তর্কের সুরে বলল এক শিল্পী। ‘তারপরও বলছেন ওটা গল্প? গল্পের দানব জ্যান্ত হয়ে এভাবে হামলা চালাতে পারে?’

‘তাই বলে আপনারা নিশ্চয়ই এটা বিশ্বাস করছেন না যে হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা একটা দানব হঠাৎ জেগে উঠেছে?’

‘তা হলে কী ওটা? আপনিই বলুন।’

‘আমি বলব কী করে? আমি তো বিশেষজ্ঞ নই। ওই যে ওকে জিজ্ঞেস করুন।’

সবার চোখ ঘুরে গেল প্রাণিবিদ এড্রিয়ান ওয়েলসের দিকে। ভিড়ের মাঝে সে-ও আছে।

‘আমি ওটাকে দেখিনি,’ সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে বলল এড্রিয়ান। ‘আমি এখানে ছিলাম না তখন। তবে বর্ণনা শুনে পরিচিত কোনো প্রাণী বলে মনে হচ্ছে না।’

‘কিছুই কি বলতে পারেন না?’ জিজ্ঞেস করল একজন। ‘মানে, প্রাণীটা কতটা বিপজ্জনক, বা আবারও এখানে হামলা করার আশঙ্কা আছে কি না...’

‘কোণঠাসা যেকোনো প্রাণীই বিপজ্জনক,’ জানাল এড্রিয়ান। ‘এখানে এই ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করে বন্য পশুপাখিকে বিরক্ত করছেন আপনারা, তাদের বসবাসের পরিবেশ নষ্ট করছেন। হামলা তো হতেই পারে। এ ব্যাপারে শুরু থেকেই সবাইকে সতর্ক করার চেষ্টা করছি আমি।’

‘এত মিষ্টি করে বলার কোনো প্রয়োজন নেই,’ পরিচিত একটা কণ্ঠ শোনা গেল। বারবারা হ্যাভারশ্যাম...কখন যেন হাজির হয়েছে সে। ‘ওটা কোনো বুনো জন্তু না, পাহাড়ের হিংস্র দানব। ঘুম ভাঙায় খেপে গেছে। এখান থেকে সবার পাততাড়ি গোটানোই মঙ্গল।’

রাগে জ্বলে উঠল টিফানির চোখ। ‘এসে গেছ তুমি? আগুনে ঘি না ঢাললে বুঝি চলছে না? আমার তো ধারণা, এসব তোমারই শয়তানি।’

রাগল না বারবারা। বাঁকা সুরে বলল, ‘কপাল! এলাম দুটো ভালো কথা বলতে, আর আমাকেই কিনা দোষ দিতে শুরু করলে? আমি কি দানব তৈরির কারিগর? আর শয়তানি করব কেন, আমি তো আগেই বলেছিলাম সতর্ক হতে। শয়তানি করতে চাইলে কি আর সতর্ক করতাম তোমাকে?’

‘তোমার ভালোমানুষির নমুনা দেখা আছে আমার,’ বলল টিফানি। ‘দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে। জায়ান্টস রিজে যেন আর না দেখি তোমাকে।’

‘আমারও কোনো শখ নেই দানবের শিকার হওয়ার। চলে যাচ্ছি।’ শিল্পীদের দিকে তাকাল বারবারা। ‘আপনারাও আসতে পারেন আমার সঙ্গে। হ্যাভারশ্যাম রিসোর্টে আর যা–ই থাকুক, বরফ দানব নেই।’

‘সেটাই বোধ হয় ভালো,’ বলল এক শিল্পী। ‘বিপদ জেনেও এখানে বসে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।’

‘না, প্লিজ!’ অনুনয় করল টিফানি। ‘আপনারা চলে গেলে পুরো ফেস্টিভ্যাল পণ্ড হবে, বদনাম হয়ে যাবে শহরের। অনেক টাকা খরচ করেছি জায়ান্টস রিজের পেছনে, সব হারাব। একটু সাহায্য করুন আমাকে। একটা দিনই তো...কালকেই তো ভাস্কর্য প্রতিযোগিতা শেষ। তারপর চলে গেলে কেউ কিছু মনে করবে না। তা ছাড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে আপনাদেরও লাভ। ৫০ হাজার ডলারের প্রথম পুরস্কার রয়েছে আপনাদের জন্য।’

‘পুরস্কার পাওয়ার কোনো উপায় তো রাখেনি দানবটা,’ বিরক্ত গলায় বলল একজন। ‘কতগুলো ভাস্কর্য নষ্ট করে দিয়ে গেছে, দেখছেন না? এক রাতের ভেতর এসব মেরামত করা অসম্ভব।’

‘আমি বিচারকদের অনুরোধ করব, তারা যাতে পরিস্থিতিটা বিবেচনায় রাখেন।’

‘আমার মনে হয় মিস টিরেল খুব একটা অন্যায্য কথা বলছেন না,’ বলে উঠল জেমস হারডিন, এতক্ষণ চুপ করে ছিল সে। ‘যদি সবাইকেই সমান সুযোগ দেওয়া হয়, তা হলে কালকের দিনটা থেকে যেতে ক্ষতি কী? তা ছাড়া দুঃসময়ে একজন ভদ্রমহিলাকে একাকী ফেলে যাওয়াও তো ঠিক নয়।’

‘সবই বুঝলাম,’ বলল দাড়িওয়ালা এক শিল্পী। ‘কিন্তু কাল পর্যন্ত যে আমরা নিরাপদ থাকব, তার কী গ্যারান্টি?’

‘সেদিকটা আমি দেখব,’ বলল টিফানি। ‘রাতটা যদি সবাই এক জায়গায় কাটাতে রাজি হন...যেমন ধরুন এখানকার সরাইখানায়...আমি পাহারার ব্যবস্থা করব। দানবটা যদি আসেও, গুলি ছুড়ে তাড়াতে পারব। দেখেননি, গুলির একটা আওয়াজে কীভাবে তখন পালিয়ে গেল? ছোট্ট একটা ছেলেই তাড়িয়ে দিল ওটাকে!’

কথাটা ঠিক। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একমত হলো সবাই। দাড়িওয়ালা এক শিল্পী বলল, ‘কিন্তু সরাইখানায় তো সবার জায়গা হবে না।’

‘এক কাজ করা যেতে পারে,’ বলল হারডিন। ‘যাদের ভাস্কর্য নষ্ট হয়নি, তারা চলে যাক। হ্যাভারশ্যাম রিসোর্ট বা অন্য কোথাও রাত কাটিয়ে আসুক। প্রতিযোগিতার আগে ফিরে এলেই হবে। টুকটাক কাজ কিছু বাকি থাকলে তখনো করে নিতে পারবে। আর যারা সকাল সকাল উঠে ভাস্কর্য মেরামত করতে চায়, তারা থাকুক এখানে। কী বলেন?’

‘ভালো প্রস্তাব,’ সায় জানাল টিফানি।

‘কিন্তু আমাদের অনুপস্থিতিতে যদি আবার ভাস্কর্য নষ্ট হয়ে যায়?’ বলল সেই দাড়িওয়ালা শিল্পী। ‘কিংবা যদি কেউ সময়মতো ফিরতে না পারে?’

‘বললাম তো, সবার ভাস্কর্যই পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হবে। কেউ যদি এখানে হাজির না-ও থাকে, তাকেও বাদ দেওয়া হবে না। কথা দিচ্ছি আমি।’

নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিল শিল্পীরা। কয়েক মিনিট পর রাজি হয়ে গেল টিফানির কথায়।

সাইরেন শোনা গেল, রাস্তা ধরে এগিয়ে এল পুলিশের গাড়ি। ফিরে এসেছে দুই অফিসার। চত্বরের ধারে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ল। এগিয়ে এল জটলার দিকে।

‘কিছু জানা গেল?’ জিজ্ঞেস করল টিফানি।

‘রিপোর্ট লিখে নিয়েছি,’ জানাল এক অফিসার, তার নাম সার্জেন্ট ন্যাশ। ‘আশপাশে ঘুরেও এলাম, তবে দেখতে পাইনি জন্তুটাকে। যদ্দুর বুঝলাম, কেসটা আসলে পুলিশের নয়, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের। বুনো প্রাণী নিয়ে ওরাই কাজ করে।’

‘বলতে চাইছেন, এখানে কোনো অপরাধ ঘটেনি?’

‘কেউ আহত-নিহত হলে সেটা বলা যেত। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখলাম, তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কাজেই...’

চোখ কপালে তুলল টিফানি। ‘এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, অথচ আপনারা কিছুই পেলেন না?’

বিব্রত হলো সার্জেন্ট। ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করেছি, এমন দাবি করব না। ঘুরেফিরে যা দেখলাম, তার ভিত্তিতে বলছি। কতজন ট্যুরিস্ট এসেছিল, তা তো জানা নেই। আপনার অফিস থেকে লিস্ট পেয়েছি শুধু এখানকার স্টাফ আর শিল্পীদের। তারা সবাই ঠিকঠাক আছে কি না, তা-ই খোঁজ নিলাম। অস্বাভাবিকতা বলতে...’ নোটবই দেখে নিল সে, ‘...ক্যারেন ব্যাঙ্কস নামের একজন শিল্পীকে খুঁজে পেলাম না।’

ঝট করে নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল শিল্পীরা। ক্যারেন সত্যিই নেই ওদের মধ্যে। ব্যাপারটা এতক্ষণ খেয়াল করেনি কেউ। উঠল গুঞ্জন।

‘গেল কোথায়?’

‘ওকে অনেকক্ষণ থেকেই দেখিনি।’

‘দানবের হামলার সময়ও ছিল না।’

দুই হাত তুলে সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করল সার্জেন্ট ন্যাশ। ‘উত্তেজিত হবেন না। মিস ব্যাঙ্কসকে জন্তুটার কবলে পড়তে দেখেনি কেউ। তাই আমরা ধারণা করছি, ভয় পেয়ে হয়তো পালিয়ে গেছেন তিনি। অনেকেই তো পালিয়েছে।’

‘শিওর না হয়ে এ রকম কথা বলা ঠিক নয়,’ বলল এড্রিয়ান। ‘সে তো বিপদেও পড়তে পারে!’

‘শিওর হওয়ার উপায় আছে,’ বলল সার্জেন্ট। ‘আপনাদের কারও কাছে ওর সেলফোন নম্বর নেই?’

‘আমার কাছে আছে,’ বলল হারডিন। পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে ডায়াল করল ক্যারেনের নম্বরে। খানিক পর জানাল, ‘সুইচড অফ।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘হুম,’ মাথা ঝাঁকাল সার্জেন্ট ন্যাশ। ‘ঠিক আছে, চেষ্টা চালিয়ে যান। যদি শেষ পর্যন্ত ভদ্রমহিলাকে না পাওয়া যায়, আমাদের জানাবেন। এমনিতেও ২৪ ঘণ্টা না পেরোলে কাউকে মিসিং পারসন হিসেবে গণ্য করি না আমরা।’

বিদায় নিয়ে সঙ্গীসহ চলে গেল সে।

‘দেখেছেন অবস্থা?’ বিরক্ত গলায় বলল টিফানি। ‘পুলিশ ডেকে কোনো লাভই হলো না। তা হলে এরা থেকে লাভটা কী?’

‘ওদের অবশ্য দোষ দিয়ে লাভ নেই,’ বলল হারডিন। ‘বন্য প্রাণীর ব্যাপারে কিছু করতে চাইলে ফরেস্ট রেঞ্জার ডাকুন।’

‘কিন্তু ক্যারেন?’

‘খামোকা চিন্তা করছেন,’ অভয় দেওয়ার চেষ্টা করল হারডিন। ‘সার্জেন্টের কথাই বোধ হয় ঠিক। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। মেয়েটা ভীষণ ভীতু। গত কয়েক দিনে দেখলাম তো। পোকামাকড় দেখলেও ভয় পায়। আর আজ তো দেখেছে দানব!’

‘কী জানি,’ কাঁধ ঝাঁকাল টিফানি। ‘কী যে করব এখন, তা-ই বুঝতে পারছি না।’

‘কী করবেন, তা তো ঠিক করাই হয়েছে। যারা যেতে চায়, তাদের বিদায় দিয়ে দিন। বাকিরা গিয়ে উঠুক সরাইখানায়।’ সঙ্গীদের দিকে ফিরল হারডিন। ‘চলুন, চলুন, এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে কাজ নেই।’

জটলা ভেঙে গেল।

রনি বলল, ‘চলো, আমরাও চলে যাই। উইকএন্ডটা মাটি হলো আরকি। কী আর করা।’

ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাল অয়ন। ‘আপনি সিরিয়াস? সত্যি সত্যি চলে যেতে চাইছেন?’

‘যাব না? কেন, তুমি কি থাকতে চাইছ নাকি?’

‘এটাও আবার জিজ্ঞেস করছেন?’ বলল জিমি। ‘রহস্যের গন্ধ পেয়েছে অয়ন হোসেন, এখন ওকে হাতি দিয়ে টেনেও এখান থেকে সরাতে পারবেন না।’ বন্ধুর দিকে ফিরল। ‘তোর ধারণাই সত্যি হলো শেষ পর্যন্ত। সত্যিই একটা রহস্য পেয়ে গেছি আমরা।’

‘কিসের রহস্য?’ বলল রনি। ‘বন্য একটা প্রাণী হামলা করেছিল শহরে। এর ভেতর রহস্য কোথায়?’

‘পুরোটাই রহস্য,’ বলল অয়ন। ‘অচেনা ওই প্রাণী কোত্থেকে উদয় হলো? ক্যারেনই–বা উধাও হলো কোথায়?’

‘তাতে আমি কোনো রহস্য দেখছি না। নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে পালিয়েছি। আমিও তো পালাতেই চাইছি।’

‘নাহয় পালালই। কিন্তু দানবটা? এ রকম প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। কেউ কোনো দিন শোনেনি এমন দানবের কথা।’

‘ভুল বললে। পাহাড়ি ওই দানবের গল্প বহু বছর ধরেই জানে এখানকার লোকে।’

‘কাম অন, রনি ভাই। সেটা মিথ...কিংবদন্তি। কিংবদন্তির দানব কখনো সত্যি হয় না।’

‘তা হলে? কী দেখলাম আমরা?’

‘সাজানো ঘটনা। দানব সাজিয়ে শহরের লোকজনকে ভয় দেখানোর জন্য পাঠানো হয়েছিল ওটাকে।’

‘ধ্যাৎ, কী যে বলো না!’ কথাটা উড়িয়ে দিল রনি। ‘সাজ অত নিখুঁত হয় নাকি?’

‘হয়। সিনেমায় দেখেননি? কত রকম দৈত্য-দানো যে দেখায়! আসলে সব মেকআপের কারসাজি।’

‘ওসবের জন্য আলাদা এক্সপার্ট লাগে,’ যুক্তি দেখাল জিমি। ‘এখানে তেমন এক্সপার্ট কোথায়?’

‘গুড পয়েন্ট,’ স্বীকার করল অয়ন। ‘খোঁজ নিতে হবে, এখানকার কারও সে রকম ব্যাকগ্রাউন্ড আছে কি না।’

‘বেশ, যদি ধরেও নিই যে, দানব সেজে কেউ হামলা করেছিল, তার পেছনে উদ্দেশ্যটা কী?’ জানতে চাইল রনি।

‘উদ্দেশ্য তো আমরা জানি,’ বলল অয়ন। ‘শহরটায় মানুষের আনাগোনা থামানো। অন্তত দুজন মানুষের দেখা পেয়েছি আমরা, যারা সেটা চাইছে।’

‘এড্রিয়ান ওয়েলস আর বারবারা হ্যাভারশ্যাম,’ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল জিমি। ‘বিশেষ করে বারবারা তো আগে থেকেই বলে আসছিল দানবটার কথা। যেন জানত ওটা হামলা করবে শহরে।’

‘এড্রিয়ানের আচরণও সন্দেহজনক,’ বলল অয়ন। ‘বিজ্ঞানী হয়েও আজগুবি একটা দানবের কথা শুনে কোনো প্রতিবাদ করল না। বরং এমন সব কথা বলল, যাতে লোকে আরও ভয় পেয়ে যায়।’

‘হুম, ঠিক বলেছ,’ একমত হলো রনি। ‘এই দুজনই আমাদের সাসপেক্ট?’

‘আপাতত। তবে অন্য কেউও থাকতে পারে এসবের পেছনে। এমনকি টিফানিকেও সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখা উচিত হবে না।’

‘টিফানি!’ অবাক হলো রনি। ‘সে কেন শহরের সর্বনাশ চাইবে? কত টাকা খাটিয়েছে এখানে, শোনোনি?’

‘ওটাই মোটিভ,’ ব্যাখ্যা করল অয়ন। ‘এসব আগেও দেখেছি আমরা। কোনো ইনভেস্টর যখন অনেক টাকা খাটানোর পর টের পায় যে টাকাটা উঠে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই, কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটায়। তারপর টাকা দাবি করে বসে ইনস্যুরেন্সের কাছে। ইনস্যুরেন্স ফ্রড বলে এসব অপরাধকে।’

‘বাপ রে! এত সব সম্ভাবনা...কোনটা ঠিক, তা বুঝবে কী করে?’

‘তদন্ত করে,’ বলল অয়ন। ‘সরাইখানায় উঠব আমরা। আজ রাতে এখানকার সবাই থাকবে ওখানে। জেরা করতে পারব।’

‘সরাইখানায় কামরা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। উঠব কীভাবে?’

‘কামরার দরকার নেই। মেঝেতে ঘুমাতে পারব। প্রয়োজনে এক রাত নাহয় না ঘুমিয়েই কাটালাম।’

‘বুঝেছি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রনি। ‘তোমাকে ঠেকানো যাবে না।’

‘অনেক কথাই তো বললি,’ জিমি বলল এবার। ‘তারপরেও একটা সম্ভাবনা কিন্তু এড়িয়ে গেছিস তুই।’

‘কোন সম্ভাবনা?’ ভুরু নাচাল অয়ন।

‘ওটা সত্যিকার দানব হতে পারে,’ গম্ভীর গলায় বলল জিমি। ‘আর বোকার মতো সেই দানবের বিরুদ্ধে নামতে চলেছি আমরা।’

পাঁচ

পার্কিং এরিয়ায় গেল তিনজন। গাড়ি থেকে নিজেদের ব্যাগ নেবে। জায়ান্টস রিজে এমনিতেই রাত কাটাবার প্ল্যান ছিল ওদের, সেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। ব্যাগে রয়েছে বাড়তি জামাকাপড় আর টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস।

গাড়ির কাছে পৌঁছে পেছনের ডালা খুলল রনি, বের করতে শুরু করল ওদের ব্যাগ। অয়ন নজর বোলাল চারদিকে। পার্কিং এরিয়া প্রায় খালি। ট্যুরিস্টরা অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে। রয়েছে কেবল স্টাফ আর শিল্পীদের গাড়িগুলো। যারা রাতে থাকবে না, তারা ইতিমধ্যে গাড়িতে উঠে চলে যেতে শুরু করেছে, আর যারা থাকবে, তারাও ওদের মতো গাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে এসেছে। সব ছাড়িয়ে লটের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটা সবুজ সেডানের ওপর চোখ গেল ওর। নিঃসঙ্গ পড়ে আছে ওটা। কেউ যাচ্ছে না গাড়িটার কাছে।

‘কী দেখছিস?’ জিজ্ঞেস করল জিমি।

‘ওই গাড়িটা,’ আঙুল তুলে দেখাল অয়ন। ‘মনে হচ্ছে মালিক নেই।’

‘তা হবে কেন? মালিক নিশ্চয়ই শহরের ভেতরে।’

‘কী জানি। সব গাড়ির কাছে লোক আছে, শুধু ওটার কাছেই নেই। অস্বাভাবিক না?’

‘কী বলতে চাস?’

‘চল, দেখে আসি।’

ব্যাগের পর গাড়ির পেছন থেকে একটা ক্যানভাসের কাভার বের করছে রনি, গাড়িটা ঢেকে দেবে। ওদের পা বাড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় চললে?’

‘আপনি একটু দাঁড়ান, আমরা এখনই আসছি।’

‘তাড়াতাড়ি এসো। আমি এদিককার কাজ সেরে রাখছি।’

দ্রুত পা ফেলে সবুজ গাড়িটার পাশে পৌঁছাল দুই বন্ধু। চারপাশে ঘুরে এল একপাক। উল্লেখযোগ্য কিছু চোখে পড়ল না। কী মনে হতে জানালার কাছে গেল জিমি, হাত দিয়ে তুষারের আস্তর মুছে উঁকি দিল ভেতরে। পরক্ষণে চমকে উঠল।

‘এ কী!’

‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইল অয়ন।

‘ওই দেখ।’ সরে দাঁড়াল জিমি। দেখতে দিল বন্ধুকে। অয়নও চমকে উঠল।

পেছনের সিটের ওপর একটা খোলা স্কেচবুক পড়ে আছে, তাতে আঁকা আছে একটা প্রাসাদ—বরফের প্রাসাদ! চারদিকে মিনার, পরিখা আর পরিখার পানিতে একটা ড্রাগন। এই ছবির বাস্তব রূপ ওরা খানিক আগেই দেখে এসেছে ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে।

ঝট করে সোজা হলো অয়ন। ‘ওটা ক্যারেনের নোটবুক! তার মানে গাড়িটাও তার!’

‘কিন্তু সে না পালিয়ে গেছে?’ অসংগতিটা ধরতে পারছে জিমি। ‘গাড়ি ছাড়া পালাল কীভাবে?’

‘পালায়নি,’ কপালে ভাঁজ পড়েছে অয়নের। ‘অন্য কিছু ঘটেছে বেচারির ভাগ্যে।’

‘কিন্তু কী?’

জবাব দেবার সুযোগ পেল না অয়ন। রাগী গলায় ধমকাধমকির আওয়াজ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। খানিক দূরে, নিজের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে সেলফোনে চেঁচাচ্ছে জেমস হারডিন। কয়েকটা কথা শুনতে পেল অস্পষ্টভাবে।

‘...ফাজলামির আর জায়গা পাও না?...কাজ শেষ না করলে এক পয়সাও দেব না...যা খুশি করো, আমার জিনিস দিয়ে যাও...’

তার দিকে এগিয়ে গেল দুই বন্ধু। কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়াতেই ওদের মুখোমুখি হলো হারডিন। কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।

‘কোনো সমস্যা, মি. হারডিন?’ প্রশ্ন করল অয়ন।

চেহারায় বিরক্তি ফুটল হারডিনের। ‘আর বোলো না!’ বলল সে। ‘একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়েছিলাম কাজে সাহায্য করার জন্য। দানবের খবর শুনে বেঁকে বসেছে। এখানে আর আসতেই রাজি নয়।’

‘কোথায় আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট?’ জিজ্ঞেস করল জিমি। ‘এল কখন, দানব দেখল কখন, আর পালালই–বা কখন?’

‘না, না, এখানে নেই সে,’ হারডিন বলল। ‘একটা কাজে পাঠিয়েছিলাম। কীভাবে যেন এখানকার খবর পেয়ে গেছে। এখন আর ফিরতে চাইছে না। ভীতুর ডিম একটা!’

‘অ! তা, কোনো সাহায্য দরকার আপনার? গাড়ি থেকে কিছু নিয়ে যেতে হবে সরাইখানায়?’

‘উঁহু। আমি তো থাকছি না এখানে। চলে যাচ্ছি, সকালে ফিরব।’

‘থাকছেন না?’ একটু অবাক হলো অয়ন। ‘কিন্তু আপনার তো কাজ শেষ হয়নি। ভাস্কর্যে রং দেওয়া বাকি বলেছিলেন না?’

‘সামান্য কাজ। সকালে এসেও সেরে ফেলতে পারব। খামোকা সরাইখানায় ভিড় বাড়িয়ে তো লাভ নেই। এমনিতেই সব লোকের জায়গা হবে না ওখানে।’

গাড়ির পেছন দিকে চলে গেল হারডিন। ট্রাংক খুলে কাঁধের ব্যাগটা ঢুকিয়ে রাখল। চকিতে ট্রাংকের ভেতরটা দেখতে পেল অয়ন। ভাস্কর্য তৈরির হাতুড়ি-বাটালিসহ নানা রকম জিনিসে বোঝাই। একটা বস্তাও দেখতে পেল, গায়ে লেখা—ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট।

ট্রাংকের ডালা বন্ধ করে পকেট থেকে চাবির গোছা বের করল হারডিন। দরজা খুলে উঠে পড়ল গাড়িতে।

‘আসি, কেমন?’ বলে ইঞ্জিন চালু করল। কয়েক সেকেন্ড পরেই পার্কিং এরিয়া থেকে বেরিয়ে গেল গাড়িটা।

হারডিন চলে যাওয়ার পরও জায়গা থেকে নড়ল না অয়ন। ভুরু কুঁচকে আছে ওর।

‘কী হলো?’ জিজ্ঞেস করল জিমি। ‘অমন গুম মেরে রইলি যে?’

‘লোকটার ব্যাপারস্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না,’ অয়ন বলল। ‘সবাইকে থাকার জন্য যেভাবে চাপাচাপি করল...অথচ নিজেই থাকছে না।’

‘হুম,’ মাথা ঝাঁকাল জিমি। ‘কথাবার্তাতেও প্রচুর অসংগতি। আমাদের বলেছিল, তখনই রঙের কাজ শুরু না করলে সময়মতো শেষ করতে পারবে না। আর এখন আবার বলছে, সামান্য কাজ, সকালে এসে করলেও চলবে। মানে কী এসবের?’

‘মানে হচ্ছে, আরেকজন সাসপেক্ট বাড়ল।’

‘কিন্তু জায়ান্টস রিজ থেকে মানুষ তাড়িয়ে তার কী লাভ?’

‘সেটাই প্রশ্ন।’

রনির ডাক শোনা গেল। ‘অয়ন! জিমি! হলো তোমাদের?’

ঘুরল দুই বন্ধু। ‘আসছি,’ বলে এগিয়ে গেল তার দিকে।

ওদের ব্যাগগুলো হাতে তুলে দিল রনি। বলল, ‘ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছে রে, বাবা। চলো, সরাইখানায় গিয়ে গরম কিছু খাওয়া যাক।’

আপত্তি করল না অয়ন বা জিমি। রনির পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল। অস্বাভাবিক রকমের নীরব হয়ে আছে অয়ন, কী যেন ভাবছে। গাছপালার মাঝ দিয়ে হাঁটাপথটা পেরিয়ে শহরের রাস্তায় পৌঁছাল শিগগিরই। সরাইখানা চিনতে কষ্ট হলো না, অনেকেই যাচ্ছে ওটার দিকে। কিন্তু রনি সেদিকে পা বাড়াতেই জ্যাকেটের হাতা ধরে টান দিল অয়ন।

‘দাঁড়ান, ওখানে পরে গেলেও চলবে। আগে একটা জিনিস দেখা দরকার।’

‘এখনই?’ ভ্রুকুটি করল রনি। ‘কিছু খেয়েদেয়ে বেরোলে হয় না? তা ছাড়া ক্যারেনের খবরটাও জানাতে হবে সবাইকে।’

‘পরে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আলো থাকতে থাকতেই দেখে নিতে চাই।’

‘কী?’

‘ভাস্কর্য প্রদর্শনীটা।’

‘ওখানে আবার দেখার কী আছে? যা ছিল, সব তো দেখেছি আমরা।’

‘খুঁটিয়ে দেখা হয়নি,’ অয়নের চিন্তাধারা অনুসরণ করতে পারছে জিমি। ‘গোয়েন্দা হিসেবে ঘটনাস্থলটা ভালো করে দেখা উচিত আমাদের। সূত্র পাওয়া যেতে পারে।’ অয়নের দিকে তাকাল। ‘ঠিক বলেছি?’

মুচকি হাসল অয়ন। ‘হ্যাঁ। আমাকে আজ অবাক করে দিচ্ছিস তুই।’

‘অবাক হওয়ার কী আছে? এত দিন থেকে গোয়েন্দাগিরি করছি, আর এটুকু বুঝব না?’

‘সে কথা বলছি না। বলছি তোর সাহসের কথা। অন্য সময় হলে বরফ দানবের ভয়ে লেজ তুলে দৌড় দেবার কথা তোর। আর আজ রীতিমতো বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেলি ওটার সামনে, এখন আবার ঘটনাস্থলে যেতে আপত্তি করছিস না...দানবটার ফিরে আসার আশঙ্কা আছে জানার পরও।’

‘অ্যাঁ!’ আঁতকে উঠল জিমি। ‘এটা তো ভাবিনি!’

হো হো করে হেসে ফেলল রনি। তিনজন পা বাড়াল চত্বরের দিকে।

খাঁ খাঁ করছে প্রদর্শনীর জায়গাটা। বিকেলের সরগরম পরিবেশের সঙ্গে মিল নেই কোনো। নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্যগুলো। চত্বরে ঢুকে দাঁড়াল তিনজন।

‘ওই যে,’ আঙুল তুলে দেখাল জিমি, ‘ওখান থেকে এসেছিল দানবটা।’ আরেক দিকে দেখাল এরপর। ‘আর পালিয়ে গেছে ওদিক দিয়ে। কোনখান থেকে তল্লাশি শুরু করতে চাস?’

‘মূর্তিগুলো থেকে,’ বলে হাঁটতে শুরু করল অয়ন।

‘মূর্তি!’ এবার জিমিও অবাক হয়েছে।

নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা ভাস্কর্যের কাছে গেল অয়ন। হাঁটু গেড়ে বসল। দেখতে শুরু করল মনোযোগ দিয়ে। অনেকখানি অংশ গলে গেছে ওটার।

‘কী দেখছ?’ জানতে চাইল রনি।

‘অসংগতি,’ বলল অয়ন। আশপাশে ইশারা করল। ‘এগুলো গলে গেল কেন? দানবটা বরফের ছিল, আগুনের নয়।’

‘কী বলতে চাও?’

হাত থেকে গ্লাভস খুলে মূর্তির গলে যাওয়া অংশে আঙুল বোলাল অয়ন, তারপর আঙুলটা এনে ছোঁয়াল জিভে।

‘করিস কী!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল জিমি। ‘কত রকম জীবাণু থাকতে পারে...’

কিন্তু ওর কথা যেন কানে গেল না অয়নের। উঠে দাঁড়াল লাফ দিয়ে। জ্বলজ্বল করছে দুই চোখ। রনির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আপনার ফোনটা দিন।’

‘ফোন? কাকে ফোন করবে?’

‘করবিন আঙ্কেলকে।’ ওদের বান্ধবী রিয়ার মামা লেফটেন্যান্ট জন করবিন—লস অ্যাঞ্জেলেসের বড় পুলিশ কর্মকর্তা, তার কথাই বলছে অয়ন। ‘একটা ইনফরমেশন দরকার। তাড়াতাড়ি দিন।’

পকেট থেকে সেলফোন বের করল রনি। তুলে দিল অয়নের হাতে। ওটা নিয়ে একটু দূরে সরে গেল গোয়েন্দাপ্রধান, ডায়াল করল কাঙ্ক্ষিত নম্বরে।

‘ব্যাপারটা কী?’ জিমির দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা গলায় জিজ্ঞেস করল রনি। ‘কিছু বুঝতে পারছ?’

অয়নের এই চেহারা জিমি চেনে। কথা শেষ করে ও ফিরে এলে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে বল তো? তুই কি রহস্যটা সমাধান করে ফেলেছিস?’

অনাবিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল অয়নের মুখে। ‘অনেকটা সে রকমই বলতে পারিস।’

‘কী!’ রনি অবাক। ‘এত তাড়াতাড়ি! কিছুই তো তদন্ত করলে না!’

‘সরাসরি করিনি,’ স্বীকার করল অয়ন। ‘তবে ইনডাইরেক্টলি বেশ কিছু তথ্য এসেছে আমাদের হাতে। সেগুলো থেকেই একটা থিওরি খাড়া করেছি। সেটা ভুল হওয়ার আশঙ্কা খুব কম।’

‘বলিস কী!’ এবার জিমিও অবাক হয়েছে। ‘তোকে আগেও অনেক কম সময়ে রহস্য সমাধান করতে দেখেছি, কিন্তু এবার তো মনে হয় রেকর্ড করে ফেললি।’

‘রেকর্ড আসলেই হয়েছে কি না, তা আজ রাতে জানা যাবে,’ বলল অয়ন। ‘এখন সরাইখানায় চল। টিফানির সঙ্গে কথা বলতে হবে আমাদের।’

ছয়.

গভীর রাত। ঘড়িতে বাজে দুটো। গগনবিদারী গর্জনে প্রকম্পিত হলো পুরো জায়ান্টস রিজ। একটু পরেই পাহাড়ের গায়ে দেখা দিল শ্বেতশুভ্র এক ছায়ামূর্তি। পায়ে পায়ে নেমে আসছে নিচে।

বরফ দানব!

শহরের প্রান্তে এসে থামল দানবটা। চারদিকে চোখ বোলাল। জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। জীবন বাঁচানোর তাগিদে সবাই গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে সরাইখানায়। যা-ই ঘটুক, বেরোবে না। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর আবার চলতে শুরু করল দানব। নির্জন রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল চত্বরে, যেখানে আয়োজন করা হয়েছে ভাস্কর্য প্রদর্শনীর।

লক্ষ্য ঠিক করাই আছে, দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে চলল দানব। এগোচ্ছে বরফের প্রাসাদটার দিকে। যেতে যেতে শরীরের ভেতরে ঢোকাল দুই হাত, মুঠ করে বের করে আনল কিছু। প্রাসাদের কাছাকাছি পৌঁছে হাত দুটো উঁচু করে ছুড়তে চাইল জিনিসটা, কিন্তু তখনই খুব কাছ থেকে ভেসে এল তীক্ষ্ণ চিৎকার।

‘অ্যাটাক!’

থমকে দাঁড়াল দানব। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই বরফের একটা বাড়ির ভেতর থেকে দুটো ছেলেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে দেখল, তাদের দুজনের হাতেই দুটো বালতি। বিস্ময়ে চলনশক্তি হারাল, কাছে এসে ছেলেদুটো যখন বালতি থেকে পানি ছুড়ে দিল তার গায়ে, তখনো নড়ল না। নড়ল এক সেকেন্ড পরে...হিমশীতল পানির স্পর্শ পেয়ে। লাফাতে শুরু করল তিড়িংবিড়িং করে, চেঁচাতে শুরু করল ঠান্ডায়। তবে অপার্থিব কোনো পশুর কণ্ঠে নয়, মানুষের গলায়।

‘উ মাগো! ঠান্ডা...জমে গেলাম...বাঁচাও!’

কয়েক মুহূর্ত পর ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ কানে এল তার। লাফানোর ফাঁকে আড়চোখে দেখল, আরেকজন মানুষ তীব্র বেগে ছুটে আসছে তার দিকে, কয়েক গজ দূর থেকে ডাইভ দিল, রাগবি খেলোয়াড়ের মতো নিখুঁতভাবে ট্যাকেল করল তাকে।

বুকে প্রচণ্ড এক আঘাত পেয়ে দম আটকে এল দানবের, ছিটকে চিৎ হয়ে পড়ল মাটিতে। ব্যথায় কাতরে উঠল। তার গায়ের ওপর চড়ে বসল মানুষটা। দুই হাঁটু দিয়ে চেপে ধরল দুই হাত, শরীরের ওজন চাপিয়ে দিল বুকের ওপর। বালতি ফেলে দিয়ে প্রথম ছেলে দুটোও এগিয়ে এল, চেপে ধরল দানবের দুই পা। নড়বার কোনো উপায় রইল না তার।

‘ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে!’ মানুষের গলায় চেঁচিয়ে উঠল দানব। মুখোশের আড়ালে অস্পষ্ট শোনাল তার কণ্ঠ।

‘ধরেছি কি ছেড়ে দেবার জন্য, চাঁদ?’ বুকের ওপর থেকে কৌতুক মাখানো গলায় বলল রনি। ‘অয়ন, জিমি, পা দুটো ঠিকমতো ধরেছ তো?’

‘হ্যাঁ, রনি ভাই,’ বলল অয়ন। ‘ওনার খেল খতম।’

‘ছাড়লেও সহজে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না,’ বলল জিমি। ‘যা একখান ট্যাকেল করেছেন! স্কুলে এমনি এমনি রাগবিতে সেরা খেলোয়াড় হতেন না আপনি।’

‘এ...এসবের মানে কী!’ হতভম্ব গলায় জিজ্ঞেস করল দানব।

‘এখনই জানতে পারবেন,’ বলল অয়ন। তারপর গলা চড়িয়ে ডাকল, ‘বেরিয়ে আসুন সবাই।’

বরফের বাড়িরগুলো থেকে এবার পিলপিল করে বেরোতে শুরু করল মানুষ। সবার সামনে টিফানি। তার ইশারা পেয়ে দুজন সিকিউরিটি গার্ড এগিয়ে পিস্তল তাক করল বন্দীর দিকে, উঠে পড়ল অয়ন, জিমি আর রনি।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘কে এই লোক?’ জানতে চাইল টিফানি। ‘যাকে সন্দেহ করছ, সে-ই?’

‘আর কে? দেখছেন না, দানবের পোশাকটা কেমন ঢলঢল করছে গায়ে?’ টান দিয়ে মুখোশটা খুলে ফেলল অয়ন। দেখা গেল একটা পরিচিত চেহারা, তবে এখন সেটা বিধ্বস্ত। ‘জেমস হারডিন—বরফশিল্পী হিসেবে যতটা চালু, বরফ দানব হিসেবে ততটাই বেকুব।’

চুপ করে রইল হারডিন।

‘তা হলে তুমিই সব ঝামেলার হোতা?’ বলল টিফানি। ‘কিন্তু কেন? আমার শহরটার সর্বনাশ করে কী লাভ তোমার?’

‘শহর না, উনি আসলে ক্ষতি করতে চেয়েছেন ভাস্কর্য প্রদর্শনীর,’ বলল জিমি। ‘আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, ক্যারেনের প্রাসাদটার। ভদ্রমহিলার উধাও হওয়ার পেছনেও ওরই হাত আছে।’

‘ক্যারেন কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল টিফানি। ‘জলদি বলো। হাতেনাতে ধরা পড়েছ, শাস্তি তো হবেই; কিন্তু ওর যদি কিছু হয়ে যায়, ফাঁসিতেও ঝুলতে পারো।’

হার মেনে নিল হারডিন। ভেজা শরীরে হি হি করে কাঁপছে সে। নিচু গলায় বলল, ‘প...পাহাড়ে। একটা গ...গুহায় আটকে রেখেছি।’

ক্যারেনকে উদ্ধারের জন্য সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন রওনা দিল পাহাড়ে। হাত-পা বেঁধে হারডিনকে নিয়ে যাওয়া হলো সরাইখানায়। খবর দেওয়া হলো পুলিশে।

‘ভাগ্যিস তোমরা ছিলে,’ সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে বলল টিফানি। ‘নইলে জায়ান্টস রিজের কপালে দুর্ভোগ ছিল।’

ওর কথায় সায় দিল চারদিকে বসে থাকা শিল্পীরা। এ মুহূর্তে অয়ন, জিমি আর রনিকে ঘিরে বসে আছে সবাই। আলোচনা হচ্ছে রহস্যটা নিয়ে। হারডিন হাজতে, ক্যারেনকেও উদ্ধার করে পাঠানো হয়েছে হাসপাতালে। ভাগ্যক্রমে তেমন কিছু হয়নি মেয়েটার। দুপুরের মধ্যেই ফিরে এসে যোগ দেবে ভাস্কর্য প্রদর্শনীর চূড়ান্ত অনুষ্ঠানে।

‘আমার তা মনে হয় না,’ টিফানির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করল অয়ন। ‘হারডিন শুধু প্রতিযোগিতায় জিততে চেয়েছিল—সে জন্যই এত কিছু। ক্যারেনের প্রাসাদটা দেখেই বুঝতে পেরেছিল, ফার্স্ট প্রাইজ তার কপালে নেই। তাই কৌশল খাটিয়ে নষ্ট করতে চেয়েছিল ভাস্কর্যটা, যাতে নিজে জিততে পারে। পুরস্কার পেয়ে গেলে আর কোনো ঝামেলা করত বলে মনে হয় না। টাকা নিয়ে চলে যেত সুরসুর করে।’

‘কিন্তু শহরের বদনাম তো ঘুচত না তাতে,’ মাথা নাড়ল টিফানি। ‘আচ্ছা, সব যে ওই বদমাশটারই কারসাজি, সেটা তোমরা বুঝলে কী করে? এখানে তো শয়তানি করার মতো আরও লোক ছিল।’

‘তা ছিল। কিন্তু দানব এনেই সবচেয়ে বড় ভুল করেছে সে,’ অয়ন বলল। ‘এক মুহূর্তের জন্যও ওটাকে সত্যি বলে ভাবিনি আমরা। আর তাই ভাবতে শুরু করলাম, অমন নিখুঁত একটা দানব কে বানাতে পারে। এটা তো স্বীকার করবেন, ওটার মধ্যে একধরনের শৈল্পিক সৌন্দর্য ছিল...তাই মিস হ্যাভারশ্যাম বা এড্রিয়ান ওয়েলসকে বাদ দিয়ে আমাদের নজর ফেরালাম ভাস্কর্য বানাতে আসা শিল্পীদের দিকে। হারডিনকে সন্দেহ হওয়ার পর আমাদের পরিচিত এক পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে খোঁজ নিলাম। তিনি জানালেন, হলিউডে সিনেমার স্পেশাল মেকআপ–সংক্রান্ত একটা পার্টটাইম জব করে লোকটা। ফলে বুঝতে পারলাম, অমন একটা দানব বানানো বা সাজাবার মতো দক্ষতা এই এলাকায় একমাত্র তারই আছে। একটাই খটকা ছিল—খামাখা লোকটা শহরের ক্ষতি চাইবে কেন? দানবটার কার্যকলাপ খতিয়ে দেখতেই মোটিভটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝলাম, শহর না, আসলে প্রদর্শনীটাকে টার্গেট করা হয়েছে। হামলা চালিয়ে একের পর এক ভাস্কর্য নষ্ট করছিল দানবটা। এগোচ্ছিল ক্যারেনের প্রাসাদটার দিকে। কালকের ওই বাচ্চাটা প্রাসাদের সামনে আছাড় খেয়ে পড়ায় সব গোলমাল হয়ে গেল। ওকে বাঁচাবার জন্য জিমি গিয়ে গুলি ছুড়ল ওটার দিকে। ব্যস, জানের ভয়ে পালাতে বাধ্য হলো দানবটা...’

‘এক মিনিট,’ বাধা দিয়ে বলল এক শিল্পী। ‘এই ব্যাপারটা ঠিক ক্লিয়ার না। হামলার কয়েক মিনিট আগেও চত্বরে হারডিনকে দেখেছি আমরা। তা হলে দানব সাজল কখন? তা ছাড়া দানবের শরীরের গঠন মোটেই ওর মতো ছিল না। ওটার তুলনায় অনেকটাই ছোটখাটো মানুষ সে।’

‘ওটা হারডিন ছিল না, ছিল তার এক সহকারী,’ বলল জিমি। ‘বিশাল দেহী কোনো লোককে ভাড়া করেছিল কাজটার জন্য...নিজেকে সন্দেহের তালিকা থেকে দূরে রাখার জন্য। সে-ই গত কিছুদিন থেকে দেখা দিচ্ছিল এখানে-সেখানে। আমরাও দেখেছি, গতকাল শহরে ঢোকার পরপরই তাকে পাহাড়ের মাথায় উঁকি দিতে দেখেছি আমরা। বিপদের কোনো ভয় সে করেনি, ভেবেছিল একবার হামলা করেই কাজ হাসিল করতে পারবে। কিন্তু গুলি ছোড়ার পর ভড়কে গেল। হারডিনকে সাফ সাফ জানিয়ে দিল, এই কাজে আর সে নেই, বিশেষ করে যেহেতু গুলি খাওয়ার ভয় আছে। ফোনে ওদের এ নিয়ে ঝগড়া করতে শুনেছি আমি আর অয়ন।’

‘ক্যারেনকে কিডন্যাপ করল কখন?’ জানতে চাইল টিফানি। ‘কেনই–বা করল?’

‘দানবের হামলার সময়েই,’ জানাল রনি। ‘পেছন থেকে ক্লোরোফর্ম ভেজা রুমাল নাকে চেপে ধরে বেহুঁশ করে ফেলেছিল। গোলমালের ফাঁকে পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে একটা গুহার ভেতর হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে এসেছিল। ভেবেছিল, পালিয়ে যাওয়ার গুজব যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, হয়তো প্রতিযোগিতা থেকে ডিসকোয়ালিফাই করে দেওয়া হবে। তা ছাড়া ক্যারেন যদি থেকে যায়, প্রাসাদটার ক্ষয়ক্ষতি হলেও আবার মেরামত করে ফেলতে পারবে। ঝুঁকি নিতে চায়নি।’

‘কিন্তু ঘটল না কোনোটাই,’ খেই ধরল অয়ন। ‘প্রাসাদের কিছু করতে পারল না হারডিনের দানব; আপনিও ঘোষণা দিলেন, কেউ অনুপস্থিত থাকলেও তাকে প্রতিযোগিতায় পুরস্কার দেওয়া হবে। উপায়ান্তর না দেখে বাইরে রাত কাটাবার নাম করে চলে গেল হারডিন। ওর সহকারীর কাছ থেকে দানবের পোশাকটা নিয়ে রাতে নিজেই সাজ নিল, জঙ্গলের ভেতরে লুকানো স্পিকারে গর্জনের আওয়াজ ছেড়ে হামলা চালাতে এল। কিন্তু বিশাল পোশাকটা ফিট করেনি তার গায়ে, ঢলঢল করছিল। আর দূর থেকে সেটা দেখেই পুরোপুরি শিওর হয়ে গেলাম, দানবটা ভুয়া।’

‘মূর্তিগুলো গলাচ্ছিল কী দিয়ে?’ প্রশ্ন ছুড়ল আরেকজন।

‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট,’ বলল অয়ন। ‘ওই যে, যা দিয়ে রাস্তায় জমে থাকা বরফ পরিষ্কার করা হয়। হারডিনের গাড়িতে ওই লবণের একটা বস্তা দেখতে পেয়েছিলাম—নিশ্চয়ই তার সহকারীকে কিছুটা দিয়ে বাকিটুকু রেখে দিয়েছিল নিজের কাছে। ওটা দেখেই প্রথম সন্দেহ হলো। পরে প্রদর্শনীতে গিয়ে একটা গলে যাওয়া মূর্তি চেক করে নোনা স্বাদ পেলাম। বুঝে ফেললাম ব্যাপারটা।’

‘কিন্তু লবণ ব্যবহার করতে গেল কেন? এমনিতে ভাঙচুর করলেই কি সেটা স্বাভাবিক দেখাত না?’

‘ভাঙচুর করতে সময় লাগে। তা ছাড়া অল্পসময়ে অনেকগুলো মূর্তি ভাঙা দরকার, কারণ, শুধু প্রাসাদটা ভাঙলে লোকে সন্দেহ করবে। তাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট ব্যবহার করেছে, ভেবেছে কেউ কিছু বুঝতে পারবে না।’

‘কিন্তু তোমরা বুঝেছ,’ বলল টিফানি। ‘আর বুঝেছ বলেই ধরা পড়ল লোকটা। ৫০ হাজার ডলারের লোভে এখন জেল খাটবে।’

‘এ জন্যই কখনো লোভ করতে হয় না,’ বলল রনি। ‘ব্যাটার প্রতিভা ছিল, এসব না করে যদি নিজের ভাস্কর্যটার পেছনে শ্রম দিত, হয়তো সে-ই ফার্স্ট প্রাইজ পেত ন্যায্যভাবে।’

মাথা ঝাঁকিয়ে তার কথায় সায় জানাল সবাই।

(শেষ)