দুষ্টু মেয়ের দল (শেষ পর্ব)

অলংকরণ: তুলি

রাশেদা কাঁদতে কাঁদতে ফোন করল মারিয়াকে। কোরবানির ঈদের দুই দিন আগে। রাশেদার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। তার শরীরে কোনোই বল নেই। সে যেন পড়ে যাবে। যেন তার মাথার ওপরে আকাশ ভেঙে পড়বে।

রাশেদা কান্নাভেজা স্বরে বলল, মারিয়া শুনছস? কথা কি সত্য?

মারিয়া ফোন কানে দিয়ে বলল, কী হইছে? কানতাছস ক্যান?

রাশেদা বলল, বীণা আপার বাস নাকি অ্যাকসিডেন্ট করছে?

কস কী? কী রকম অ্যাকসিডেন্ট?

রাশেদা বলল, মনে হয় বীণা আপা বাঁইচা নাই!

মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে।

মারিয়ার মা দৌড়ে এলেন। ধপাস করে শব্দ হলো কেন? এসে দেখলেন, মারিয়া উঠানে পড়ে আছে। তার মোবাইলটা তার কাছ থেকে তিন হাত দূরে পড়ে আছে। মোবাইলে এখনো সবুজ আলো জ্বলছে।

মারিয়ার মা মারিয়াকে ধরে ঘরে নিলেন। তারপর তার চোখে-মুখে পানি ছিটাতে লাগলেন। একটু পরে মারিয়া চোখ খুলল।

গ্রামের মানুষ সবাই চলে এসেছে ধলু মাতব্বরের বাড়িতে। বাড়ির সামনে ভিড়। সন্ধ্যা হয় হয়। ধলু মাতব্বর ছুটে গেছেন উপজেলা সদরে। সেখানকার হাসপাতালে আছে বীণা আপা। তবে সে আর বেঁচে নেই। আজ বেলা দুইটার দিকে তার বাস অ্যাকসিডেন্ট করে। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই সে মারা যায়। এখন সেই লাশ রাখা হয়েছে উপজেলা হাসপাতালে।

ধলু মাতব্বর পুলিশের ঝামেলা সামলাচ্ছেন। লাশ মর্গে নেওয়ার দরকার নেই। বাস অ্যাকসিডেন্টে মোট ৫ জন মারা গেছে। ১৭ জন আহত। আহত ব্যক্তিদের জেলা হাসপাতালেও নেওয়া হয়েছে। দুজনকে নেওয়া হবে ঢাকায়। কিন্তু ধলু মাতব্বরের সামনে আর কোনো হাসপাতালে নেওয়ার তাগাদা নেই। বীণা সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে গেছে।

এখন তার বডিটা পেলেই হয়। তিনি তাঁর মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন।

রাশেদা, মারিয়া, তহুরা, রুনা, লুনা—সব খেলোয়াড় মেয়ে এসে ভিড় করেছে ধলু মাতব্বরের বাড়িতে।

সন্ধ্যা নেমে আসছে। এমন করুণ সন্ধ্যা সুন্দরপুর গ্রামে আর কোনো দিনও আসেনি। আজকের আকাশে সূর্যের শেষ আভা মেঘের গায়ে পড়ে সমস্ত ধরণিকেই যেন শালিকের রোগা পায়ের মতো ফ্যাকাশে করে তুলেছে। একঝাঁক কাক সমবেত হয়েছে পেছনের বাঁশঝাড়ে। তারা কা কা শব্দে সন্ধ্যাটাকে আরও বিষণ্ন করে তুলছে।

রাশেদা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল।

মারিয়া বলল, রাশেদারে, কান্দিস না। বলে সে জড়িয়ে ধরল মারিয়াকে।

তহুরা দুপা ছড়িয়ে বসে পড়ল মাটিতে। আমি আর বাঁচুম না।

***

মইন স্যার তাঁর ঘরের বিছানায় শুয়ে পড়েছেন।

তিনি কী করবেন, বুঝতে পারছেন না। তাঁর মনে হচ্ছে তিনিই সমস্ত দুর্ভাগ্যের কারণ। বীণা বলেছিল, সামনের মাসে নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল ফাইনালটা হয়ে গেলে, আর বাংলাদেশ যদি চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে মইন স্যারকেই বিয়ে করবে সে।

খবরটা শুনে তিনি প্রথমে ছুটে যেতে লাগলেন উপজেলা সদরের দিকে। সাইকেল চালিয়ে। মাঝপথে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো গ্রামের দুজন প্রবীণ মানুষের। তাঁরা তাঁকে ডাকলেন, ও মইন মাস্টার, ও মইন মাস্টার, কই যাও। খাড়াও।

মইন স্যার থামালেন তাঁর সাইকেল। সিটে বসে রাস্তার এক দিকের উঁচু মাটিতে পা ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।

বশির মিয়া আর শ্যামপ্রসাদ। তাঁরা বললেন, শুনছ খবরটা?

কোন খবর?

বীণার খবর। আরে ধলু মিয়ার মাইয়া বীণার খবর।

জি শুনছি। তারে দেখতে যাইতাছি উপজেলা হসপিটালে।

আরে মাস্টার, বীণা তো ইন্তেকাল করেছে। বশির মিয়া দুঃখিত গলায় বললেন।

শ্যামাপ্রসাদ বাবুর মাথায় টাক। তিনি মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, খুব ভালা মানুষ আছিল। ভালা মানুষ বেশি দিন থাকে না গো! অহন ধলু মিয়া বাঁচব কেমনে গো!

মইন স্যার এখন কী করবেন?

তিনি কি উপজেলা সদরে যাবেন?

কিন্তু তাঁর হাত-পা চলছে না। তিনি সাইকেল প্যাডেলও ঠিকমতো করতে পারছেন না।

এই সময় তাঁর পকেটের মোবাইল ফোন বেজে উঠল।

একটার পর একটা কল আসছে। তাঁর ফুটবলার ছাত্রীরা ফোন করছে। স্যার, স্যার, শুনছেন? ঘটনা কি সত্য? স্যার, বীণা আপা নাকি আর নাই!

হ্যাঁ মা। শুনছি।

স্যার, আমরা বাঁচুম না...

মেয়েরা কাঁদে। মইন স্যারও কাঁদেন।

মইন স্যার ধপাস করে পড়ে গেলেন রাস্তার ওপরে।

তাঁকে লোকজন ধরে নিয়ে গেল রাস্তার ধারের একটা দোকানে। দোকানের সামনের বেঞ্চিতে তাঁকে শোয়ানো হলো। তাঁর চোখে-মুখে পানি ছিটানো হলো।

খানিক পরে জ্ঞান ফিরলে তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, বীণা বীণা, আসতেছ কি না!

তাঁকে একটা রিকশাভ্যানে তুলে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো।

গ্রামের মন্টু, বয়স তার ১৬, মইন স্যারের প্রাক্তন ছাত্র, স্যারের সাইকেলটা নিজে চালিয়ে নিয়ে গেল স্যারের বাড়িতে।

মইন স্যারের বৃদ্ধা মা বললেন, এই কী হইছে? আমার মইনের কী হইছে?

কিছু হয় নাই চাচি। এই একটু ফিট হয়া গেছল!

মা বিলাপ করে উঠলেন, ফিট হয়া গেছল। হায় আল্লাহ আমার মইন ফিট হয়া গেছল! ও আমার বাপধন রে! তোর কী হইছে রে?

মইন বললেন, কিছু হয় নাই মা। কিছু হয় নাই। আর এক মাস পরে আমার বিয়া। তুমি ছেলের বউ ঘরে আনবা না?

মা ফ্যাল ফ্যাল করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলে তাঁর কী বলছে।

মইন স্যারকে তাঁর ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তিনি ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ শুয়ে আছেন।

তাঁর মোবাইলের চার্জও চলে গেছে।

*****

সন্ধ্যার পর একটা মাইক্রোবাস হেডলাইট জ্বালিয়ে আসতে লাগল গ্রামের দিকে। পুরা গ্রাম সেই গাড়ির পেছনে পেছনে এসে হাজির হলো ধলু মাতব্বরের বাড়ির উঠানে।

বীণার বডি নামানো হলো মাইক্রো থেকে।

ধলু মাতব্বর গাড়িতেই ছিলেন।

তিনি নামলেন।

পাকা বারান্দায় বডি রাখা হলো।

গ্রামের মধ্যে কুলসুমের মা মুর্দাকে গোসল করানোর কাজ করে থাকেন। তিনি এসে গেছেন। এরই মধ্যে বারান্দায় আগরবাতি জ্বালানো হয়েছে।

গাড়ি দেখেই রাশেদা, মারিয়ারা কাঁদতে শুরু করেছে। বীণা আপার চাদরে ঢাকা বডিটা যখন নামানো হলো, তখন তারা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

রাশেদা মাটিতে বসে পা ছড়িয়ে কাঁদছে।

তহুরা হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে।

মারিয়া তাদের সামলানোর চেষ্টা করছে।

রুনা আর লুনা দুজনে দুজনার হাত ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে জল বইছে অঝোর ধারায়।

দীপা রানীও এসেছেন। তিনিও ভিড়ের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মাথায় কাপড়।

এরই মধ্যে একদল মহিলা এসেছেন। তাঁরা মাথায় কাপড় দিয়ে একটা ঘরে বসে গুন গুন সুরে কোরআন শরিফ পড়ছেন।

রাত আটটার মধ্যেই বীণার জানাজা পড়ানো হয়ে গেল।

সাড়ে আটটার মধ্যে গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফনও করা হলো।

শূন্য হৃদয় নিয়ে ধলু মাতব্বর ফিরে এলেন তাঁর বাড়িতে। এরই মধ্যে তাঁর বড় মেয়ে রিনাও এসে গেছে। তাঁর বড় জামাই সেকেন্দারও এসেছে।

রিনা বলল, আব্বা, আসেন। ঘরের মধ্যে বিছানাত বসেন। আপনার শরীরটার যত্ন নেওয়া লাগবে। আপনি আবার অসুস্থ হইয়া পইড়েন না।

রাত অনেক হয়েছে। মইন বিছানা ছাড়ছেন না। তাঁর মা এসে বলছেন, বাবা রে, বিছানা থাইকা উইঠা বস। ভাত রানছি। ভাত খা।

মইন বললেন, মা, আপনি বুড়া হয়ে গেছেন। আপনি ক্যান ভাত রাঁধবেন। আপনার একজন বউমা লাগবে। আমি এনে দেব।

মা বললেন, আমি কি রান্ধুনি আনার লাইগা পোলারে বিয়া দিমু। বউ আমি পাকঘরে লাগামু না। শিক্ষিত বউ আইব। সে নিজে চাকরিবাকরি করব।

মইন বিছানায় বসে বললেন, হ মা। আমি আপনেরে শিক্ষিত বউ আইনা দিমু। মা, বীণা রে কি তোমার পছন্দ?

মা কাঁদতে লাগলেন।

মইন স্যার একটা ছোট টুলে বসেছেন। সামনে আরেকটা বড় টুল। বড় টুলে তাঁকে থালা ভরে মা ভাত দিয়েছেন। সেই ভাত সামনে নিয়ে মইন স্যার নীরবে তাকিয়ে আছেন। ভাত তিনি নাড়ছেনও না।

একটা বিড়াল তাঁর পায়ের কাছে বসে আছে। মইন স্যার ভাত খেতে খেতে মাছের কাঁটা দিয়ে থাকেন বিড়ালটাকে!

***

খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল রাশেদার।

সারারাত ভালো করে ঘুমুতেই পারেনি সে।    ছটফট করেছে। ছেঁড়াখোঁড়া স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্নে সে দেখে যে তহুরার বিয়ে হচ্ছে। তাতে বর হয়ে এসেছে তার বড় ভাই। একটু পরে দেখে, বউ তহুরা না।            বউ হলো বীণা। আরেকটু পরে সে দেখে মইন স্যার একটা নৌকা নিয়ে একা একা লগি ঠেলছেন।             তিনি গান ধরেছেন, আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে...

ভোরবেলা মোরগ ডাকতেই রাশেদা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ছুটে গেল মারিয়ার বাড়িতে। মারিয়া, মারিয়া ওঠ।

মারিয়াও জেগেই ছিল। সে দরজা খুলে বাইরে এল।

বলল, এত বিহানে ক্যান আইছস?

রাশেদা বলল, চল, কবরস্থানে যাই।

চল।

রাশেদা আর মারিয়া হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছে কবরস্থানের দিকে।

বাঁশঝাড়, ধানখেত। ভোরের বাতাস বইছে। ভেজা ভেজা বাতাস। কোথাও নিশ্চয়ই বৃষ্টি হচ্ছে।

খালপারে ঘাসের ওপরে শিশির। স্যান্ডেলে মরা ঘাস, শিশির আর মাটি মাখামাখি হয়ে আছে।

দুটো খেজুরগাছ। তারপর একটা ঝাঁকড়া বটগাছ। তারপর কবরস্থান। কবরস্থানে একটাই নতুন কবর। শিয়রে খেজুরগাছের একটা পাতা পোঁতা।

রাশেদা আর মারিয়া দাঁড়িয়ে রইল কবরের পাশে।

রাশেদা দোয়া পড়ল বিড়বিড় করে।

মারিয়া যিশুর নাম জপতে লাগল।

তারপর রাশেদা বলল, মানুষ মারা গেলে কই যায়?

মারিয়া বলল, মানে কী?

রাশেদা বলল, বীণা আপা এখন কোথায়?

মারিয়া বলল, এইখানে। কবরের মধ্যে।

রাশেদা বলল, তাইলে কি মাটির নিচে তাঁর কষ্ট হইতেছে?

রাশেদা কবরের পাশে বসে পড়ল। তার পাশে বসল মারিয়া।

একটু পরে পায়ের আওয়াজ আসতে লাগল। কে যেন আসছে!

তারা দুজনই দাঁড়াল।

তাকাল পেছনের দিকে।

দেখতে পেল, মইন স্যার আসছেন। তাঁর চুল উষ্কখুষ্ক। চোখ লাল।

তিনি আসতেই মারিয়া আর রাশেদা দাঁড়িয়ে পড়ল।

তারা চুপ করে আছে।

মইন স্যারও চুপ করে এসে কবরের পাশে দাঁড়ালেন। এদিক-ওদিক তাকালেন।

তারপর তিনি কবরের পাশে বসলেন।

রাশেদা বলল, স্যার, আল্লাহ তাআলার এইটা কী বিচার!

মইন স্যার বললেন, আমি স্বপ্ন দেখছি, বীণা মরে নাই। এইটা বীণা না। বীণা ঢাকায় আছে। ফাইনাল খেলা দেখে তারপর আসবে।

মারিয়া বলল, তাইলে এইটা কার কবর?

মইন স্যার বললেন, আল্লাহ জানে। আল্লাহ জানে।

রাশেদা বলল, স্যার, আমি তো বীণা আপার মুখ দেখছি। এইটা বীণা আপাই।

মইন স্যার বললেন, একই রকমের চেহারা তো থাকতে পারে! পারে না?

রাশেদা আর মারিয়া বলল, স্যার চলেন যাই।

মইন স্যার বললেন, তোরা যা। আমি একটুখানি এইখানে থাকি।

***

দিন চলে যায়। সব শোকই ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। মেয়েরা আবার চলে যায় ঢাকায়। জাতীয় দলের ফাইনাল খেলা সামনে। তারা নেপালের সঙ্গে খেলবে। মারিয়া তহুরা রাশেদা প্রমুখ চলে গেছে ঢাকায়। ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের হোস্টেলে থাকে তারা। রোজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে তারা মাঠে যায়। শরীরচর্চা করে। খেলে।

বাবুল স্যার তাদের কোচ। আর আছেন রোকেয়া আপা। তিনি সহকারী কোচ। তাদের আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে।

মেয়েরা মন দিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

মইন স্যার শুধু শোক সামলাতে পারেন নাই। তিনি রোজ সন্ধ্যায় কবরস্থানে যান। বীণার কবরের পাশে একটা মোমবাতি জ্বালান।

তারপর বাড়ি ফিরে আসেন।

তাঁর মা বলেন, মইন আসছিস বাবা। হাত-মুখ ধো। আয়, ভাত খা।

ভাত খাব না মা।

ক্যান, খাবি না ক্যান?

খিদা নাই।

এই সব কী কথা? না খায়া না দায়া শুকাইয়া কাঠ হয়া যাইতাছিস। আয় খা।

আমার কিছু ভালো লাগে না মা।

বাবা রে, তুই ছাড়া আমার কেউ নাই। তুই আমার পেটে ধরা পোলা। তুই যদি এই রকম করিস, আমি বাঁচি কেমনে?

মা, তুমি দোয়া করো। বীণা ঢাকায় আছে। ২০ তারিখে ফাইনাল খেলা। ওই দিন বাংলাদেশ যদি জেতে, তাইলে বীণা সুন্দরপুর আইব।

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ছেলেটা কি তাঁর পাগল হয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, মসজিদের ইমামের কাছে যাবেন। পানি পড়া নিয়ে আসবেন। সেই পানি পড়া ছেলেকে খাওয়াতে হবে। ছেলে তো বীণার শোক সামলাতেই পারছে না।

***

আজ বিকেলে ফাইনাল খেলা। নেপাল দল ঢাকায় এসে গেছে। সকালবেলা সবাই মিলে হোস্টেলের ডাইনিং রুমে এসেছে নাশতা করতে।

তাদের বাবুল স্যার বললেন, আজকে আমাদের খেলা। আজকে আমরা সবাই ফুরফুরে মেজাজে থাকব। গান শুনব। গান করব। হালকা খাওয়াদাওয়া করব। আমাদের ফুর্তিতে থাকতে হবে।

বিকেল তিনটায় বাসে উঠে সবাই গেল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। নেপাল দলও এসে গেছে।

তারা ড্রেস পরে মাঠে গেল। খানিকক্ষণ ওয়ার্মআপ করল।

চারটায় শুরু হলো খেলা।

নেপাল দলও ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। তারা খুব ডিফেন্সিভ খেলা খেলছে। এগারো জন খেলোয়াড়ই গোলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুতেই তাদের গোল দেওয়া যাচ্ছে না।

হাফটাইম গোলশূন্য।

হাফটাইমের সময় খেলোয়াড়দের কাছে চলে এলেন মইন স্যার।

সুন্দরপুরের ১০ জন মেয়ে আছে এই দলে। ৭ জন খেলছে আজকের ম্যাচে।

মইন স্যারকে দেখে তারা তাঁর কাছে গেল।

মইন স্যার বললেন, এই তোরা কী করছিস? তোরা কি জানিস বীণা আমাকে কী বলেছে? বীণা বলেছে, আজকের ম্যাচে জিতলে সে ফিরে আসবে। আমার সঙ্গে তার বিয়ে ফাইনাল। তোরা কি চাস না বীণা ফিরে আসুক। যা। ভালো করে খেল।

রাশেদা বলল, স্যার, আপনি চিন্তা কইরেন না। খেলা শুরু হইলেই আমরা গোল দিমু। মারিয়া, কী কস?

মারিয়া বলল, জি স্যার। আপনি যান। গ্যালারিতে গিয়া বসেন। আমরা জিতুমই।

তহুরা বলল, হ। আপনে দেখেন। কী করি।

হাফটাইমের পর খেলা শুরু হলো।

তহুরা বল পেয়েছে। সে দিল মারিয়াকে।

মারিয়া দেখল, মাঠের ডান পাশে রাশেদা একা। তাকে সে বল দিল।

রাশেদা বল পেয়ে দ্রুত ঢুকে যেতে লাগল পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে। কিন্তু ওরা ভিড় করে আছে গোলবারের সামনে। কয়জনকে কাটাবে রাশেদা।

রাশেদা মনে মনে বলল, বীণা আপা। দোয়া করেন। এইবার আমি গোল দিমুই।

সে দুজনকে কেটে একেবারে গোলের সামনে চলে গেছে। সামনে শুধু একজন গোলকিপার।

এবার ডান পাশে ঝুঁকে বাঁ দিকে বল মারলেই হলো। গোল হয়ে যাবে।

উফ। কে যেন তার পায়ে মারল লাথি। সে পড়ে গেল। রেফারির বাঁশি উঠল বেজে।

পেনাল্টি।

রাশেদা পেনাল্টি মারবে।

মারিয়া বলল, মাথা ঠান্ডা। নিচ দিয়া মারবি। জোরে মারবি। গোলকিপারের চোখের দিকে তাকায়া থাকবি। তাইলে বুঝবি সে কোন দিকে ডাইভ দিব। আর শোন। বীণা আপা আছে এই গ্যালারিতে। দোয়া করতেছে। আমরা জিতুমই। তুইও গোল দিতে পারবি।

রাশেদা এগিয়ে যাচ্ছে বলের দিকে।

মারল রাশেদা।

গোল।

এরপর নেপাল গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ করতে লাগল। তাতে সুবিধা হলো বাংলাদেশের মেয়েদের।

তারা পাল্টা আক্রমণ করে গোল দিতে লাগল।

একে একে চারটা গোল দিল তারা। সবগুলো গোলই দিল সুন্দরপুরের মেয়েরা।

খেলা শেষে কাপ তুলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নিজে।

তারপর তারা যখন বাসে উঠবে, তখন মইন স্যার এলেন তাদের কাছে। বললেন, তোরা আমার ইজ্জত রাখছিস। বীণাকে এখন আমি বলতে পারব, আমার মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

***

সারা দেশে আনন্দের বন্যা। খেলা দেখানো হয়েছে টেলিভিশনে। সবাই রাশেদা, তহুরা, মারিয়া বলতে অজ্ঞান। খবরের কাগজে তাদের বড় বড় ছবি ছাপা হলো।

তারপর তারা ফিরে এল গ্রামে।

গ্রামের মানুষ তাদের বাসস্ট্যান্ড থেকে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে ঘরে আনল।

তারপর ফুটবলার ১০ মেয়ে চলে গেল কবরস্থানে।

বীণা আপার কবরে ফুল দিল তারা।

জীবন জীবনের নিয়মে চলে যাচ্ছে। শুধু মইন স্যার আর ঠিক হলেন না। তিনি উদাস হয়ে ঘুরে বেড়ান। একা একা বিড় বিড় করেন। ২৩৪টা কবিতা লিখেছেন তিনি। তিনি বলেন, একটা কবিতার বই বের করব। বইয়ের নাম বীণা বাজে অন্তরে।

ধলু মাতুব্বর মেয়েদের সবাইকে বৃত্তি দেন। বৃত্তির নাম বীণা স্মৃতি বৃত্তি। মেয়েরা ভালোই আছে। তাদের গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। কারণ মেয়েরা খেলে, সেই খেলা টিভিতে দেখানো হয়, তাদের মা-বাবা সেই খেলা দেখবেন কী করে। গ্রামে যে বিদ্যুৎ নেই। এই খবর ছাপা হলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নিজে ঘোষণা দিয়েছেন বিদ্যুৎ দেওয়ার। এক মাসের মধ্যে গ্রামে বিদ্যুৎ চলে এল। প্রতিমন্ত্রী নিজে এসে সুইচ টিপে বিদ্যুৎ সংযোগের উদ্বোধন করলেন।

গ্রামে আর কোনো অন্ধকার নেই।

গ্রামে কোনো বাল্যবিবাহও নেই।

(শেষ)