হুতুতুকে নিয়ে সাইবেরিয়া

আচ্ছা, আমি কীভাবে সাইবেরিয়ায় পৌঁছে গেলাম, সেই গল্পটা আজকে তোমাদের বলব। ভালো কথা, আজকের গল্পটা আষাঢ়ে হলেও ঘটনাটা যখন ঘটছে, তখন কিন্তু শীতকাল। মানে শীতটা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। শীতের পাখিরাও প্রায় চলে যেতে ধরেছে আমাদের নদী-নালা, খাল-বিল ছেড়ে। আমি আমার বন্ধু রবিনকে নিয়ে এক সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরিয়েছি। ঝিরিঝিরি বাতাস আছে বলে একটু শীত শীত লাগছিল ঠিকই, কিন্তু আমরা হাঁটতে হাঁটতে পদ্মপুকুরের ধারে ঠিকই পৌঁছে গেছি। আর যেই না পৌঁছেছি, তখনই শুনলাম চিঁ চিঁ শব্দ। আরে, পাখির ডাক নাকি? রবিন বলল, চল দোস্ত, খুঁজে দেখি। বড় কোনো পাখি হলে একটা বারবিকিউ পার্টি হয়ে যাবে!

আমি বললাম, গাধা! পাখি খাওয়া নিষিদ্ধ, জানিস না!

রবিন মন খারাপ করল। অবশ্য ওর মন খারাপ না ধরলেও চলে। ও ক্ষণে ক্ষণে মন খারাপ করে। আমি বরং শব্দ ধরে এগিয়ে গেলাম। ঠিকই, যা ভেবেছিলাম! একটা ঝোপের তলায় একটা পাখি। পাখি কী! পাখির ছানা! চিঁ চিঁ করে কাঁদছে!

রবিন বলল, হায় হায় রে! মা হারিয়ে ফেলে কাঁদছে বোধ হয়! দেখি আশপাশে ওর মা আছে কি না!

আমিও এদিক-ওদিক যেই তাকাতে যাব, কে যেন বলে উঠল, কাউকে খুঁজে লাভ নেই! কেউ নেই এখানে!

বুকটা ধড়াস করে উঠল। খনখনে কণ্ঠ। ভূতটুত নাকি?

তখন কণ্ঠটা আবার বলল, গবেটের মতো এখানে-ওখানে চাইছ কেন? আমি কথা বলছি বুঝতে পারছ না? আরে আমি আমি...আমি হুতুতু!

এবার সোজা তাকালাম। দেখলাম, আরে যাহ্! পাখির ছানাটা কথা বলছে! রবিন ভড়কে পিছিয়ে গেল, কিন্তু আমার তো বেজায় সাহস। বললাম, এই, তুমি কথা বলতে পারো?

: পারি না আবার? পাখিরা কথা না বললে, গান না গাইলে মানুষের চলে নাকি আবার? আচ্ছা শোনো, ভীষণ বিপদে পড়েছি আমি। আমার মা আমাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে চলে গেছে। আমাকে আমার মায়ের কাছে দিয়ে এসো তো!

: আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে। দিয়ে আসব! কিন্তু তোমার মা কোথায় থাকে, এটা জানতে পারলে না সুবিধা! তোমার মা কোথায় থাকে, হুতুতু?

: মা? মা থাকে সাইবেরিয়া!

: সাইবেরিয়া? কী বলো এটা?

২.

আমাদের সাইবেরিয়া যাওয়া যে অসম্ভব একটা ব্যাপার এটা সারারাত ধরে বোঝাল রবিন। কিন্তু রবিন যখন একদিকে আমাকে এই সব বোঝাতে থাকল, হুতুতু তখন গম্ভীর হয়ে টেবিলের ওপর বসে থেকে বলে চলল তার দুঃখের কথা। তার বয়স মাত্র তিন মাস। সে এবারই প্রথম মাইগ্রেশন করে বাংলাদেশ এসেছে। তার কত উৎসাহ ছিল এ দেশে আসা নিয়ে। সাইবেরিয়ায় তো এখন শুধু বরফ আর বরফ! তার মা বলেছিল, বাংলাদেশ একটা সোনার দেশ। এখানে গাছের পাতার রং কচকচে সবুজ। আর রুপালি রঙের ঝিলমিলে মাছ পাওয়া যায় নদীতে-বিলে-পুকুরে। একবুক আশা আর দুই চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে হুতুতু বাংলাদেশে এসেছিল। কিন্তু এখানে কিছুদিন কাটতেই একদল শিকারি তাদের আক্রমণ করে বসল। রাইফেল দিয়ে গুলি চালাল ঠাস ঠাস। পাখিদের পুরো দল ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল। মা হুতুতুকে অনেকক্ষণ খোঁজার চেষ্টা করল ঠিকই, কিন্তু গুলির শব্দে হুতুতু তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তাকে না পেয়েই চলে যেতে হলো মাকে। হুতুতুর যখন জ্ঞান ফিরল, দেখল কোথাও কেউ নেই!

আহা রে!

আমার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে বেচারারা অতিথি হয়ে এসেছে আমাদের দেশে। আর আমরাই কিনা তাদের...

রবিনকে বললাম, যেভাবেই হোক হুতুতুকে সাইবেরিয়ায় পৌঁছে দিতে হবে!

রবিন মাথা নাড়িয়ে বলল, অসম্ভব! কিন্তু তার চোখও ছলছলে।

বুঝলাম সাইবেরিয়া আমাদের যেতেই হবে, যে করেই হোক!

৩.

মুখে বলা যত সহজ, বিষয়টা তত সহজ না। সাইবেরিয়া যেতে চাইলে প্লেনে চড়তে হবে। প্লেনে চড়তে গেলে চায় পাসপোর্ট আর ভিসা। আমার পাসপোর্ট নেই, ভিসা পাওয়ার কোনো প্রসঙ্গই আসতে পারে না। রবিনের এখনো পাসপোর্ট করানো হয়নি। তা ছাড়া প্লেনের টিকিট, এটা-সেটা মিলিয়ে যে খরচ হবে, সেটাই বা পাব কীভাবে? বাসায় যদি বলি একটা পাখির ছানাকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা সাইবেরিয়া যেতে চাই, তাহলে আমাদের পিটিয়ে সোজা চাঁদে পাঠিয়ে দেবে।

রবিন বলল, ইউটিউব দেখে সে একটা কাজ করতে পারে!

কী কাজ, জিজ্ঞেস করলে সে শুধু মিটিমিটি করে হাসল। তারপর পাক্কা তিন দিন সে উধাও হয়ে থাকল। হুতুতু বলল, তোমার বন্ধুটা তো আচ্ছা! আমাদের সবাইকে বিপদে ফেলে একেবারে হাওয়া হয়ে গেল!

এক রাতে হঠাৎ জানালায় টোকা পড়ল। গ্লাস সরাতেই জানালাজুড়ে রবিনের মুখ। বলল, চল, সাইবেরিয়া চল!

: মানে?

৪.

রবিনদের বাড়ির পেছনের বড় জায়গাটা ঝোপঝাড়ে ভরপুর। সাপখোপও থাকতে পারে। কিন্তু রবিন এসবের তোয়াক্কা না করে সোজা ধুপধাপ এগিয়ে গেল। বুঝলাম এ পথে খুব চলাফেরা করে। আমি হুতুতুকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে চললাম। হঠাৎই রবিন থমকে দাঁড়ালে তার শরীরের ওপর প্রায় আছাড় খেতে ধরলাম। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম রেগেমেগে, কিন্তু তার আগেই হুতুতু বলে উঠল, আরে এটা কী?

রবিন ততক্ষণে নীল পলিথিন সরিয়ে দিতে শুরু করেছে আর ভেতর থেকে বেরোতে শুরু করেছে কাগজ, কার্ট, প্লাস্টিক দিয়ে বানানো একটা অদ্ভুত জিনিস। পুরো পলিথিন সরিয়ে রবিন বলল, দেখ!

: কী দেখব? কী এটা?

: আরে আচ্ছা তো, বুঝতে পারছিস না কী এটা? এই যে এর প্রপেলার! এই যে ফ্যান...দুইটা ডানা...তাও বুঝছিস না?

: না, বুঝছি না! মনে হচ্ছে একটা বড় কোনো খেলনা বানিয়েছিস! কিন্তু কোন খেলনা, সেটা বুঝতে পারছি না!

: খেলনা? পাগল? তিন দিন খেটেখুটে আমি একটা খেলনা বানাব নাকি?

: তাহলে?

হুতুতু গম্ভীর গলায় বলল, এটা একটা প্লেন!

আমারও যেন হঠাৎ আকৃতিটা চেনা মনে হলো। পুরোটা আবার দেখে বললাম, হুম! প্লেনের মতো...কিন্তু এটা রেপ্লিকা, তাই না?

রবিন বলল, মোটেও না! এটা আকাশে উড়বে! আর এটাতে করেই আমরা হুতুতুকে সাইবেরিয়া দিয়ে আসব!

: মাথা খারাপ? এটা কখনো আকাশে উড়তে পারে না!

: অবশ্যই পারে, দেখ!

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

রবিন একটা লাফে প্লেনটার ওপর বসে পড়ল। প্লাস্টিকের চেয়ার তাতে বাঁধা আছে। চেয়ারসহ পুরো প্লেন একটা ঝাঁকুনি খেল রবিনের শরীরের ভারে। এই জিনিস কীভাবে উড়বে?

রবিন চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিন চালু করল ঠিকই, কিন্তু অল্প পরেই তা বন্ধ হয়ে গেল। আমি হাঁফ ছাড়লাম। ইঞ্জিন চালু হলে রবিন আবার আমাকে উঠে আসার জন্য বলত! যা হয় ভালোর জন্য হয়! কিন্তু ওমা, আমার কথা শেষ হতে না হতেই ইঞ্জিনটা এবার সত্যি সত্যি চালু হয়ে গেল। প্রচণ্ড জোরে কাঁপতে থাকল হাস্যকর বস্তুটা। রবিন বলল, উঠে আয়!

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, পাগল হয়েছিস? এতে করে কোথাও যাওয়া যাবে নাকি?

: আয়! আমি বলছি এতে করেই আমরা সাইবেরিয়া যাব!

: আমি যাব না! অসম্ভব!

আমার কথাটা শেষ হতে না হতেই দেখি হুতুতু আমার ঘাড় থেকে ফুড়ুৎ করে উড়ে প্লেনে গিয়ে চড়ে বসল। বেইমান একটা!

রবিন বলল, কী হলো যাবি, নাকি আমরাই চলে যাব?

৫.

প্রথম প্রথম প্লেন ভ্রমণটা বেশ মনোরম হতে থাকল। রবিন দক্ষ পাইলটের মতো প্লেন চালাচ্ছে। ম্যাপট্যাপ হাবিজাবি কী সব দেখেও নিচ্ছে মাঝেমধ্যে। আমি যদিও গোমড়ামুখে বসে আছি। এই মুড়ির টিন যেকোনো সময় আকাশ থেকে খসে পড়তে পারে! তবে সাদা সাদা পেঁজা তুলার মতো মেঘ, মৃদুমন্দ বাতাস, ওপর থেকে অনেক নিচের সব ছোট ছোট আলো জ্বলা বাড়িঘর...এসব দেখা কিন্তু অত্যন্ত আনন্দের! রবিন আর হুতুতুর ওপর রাগ করে আছি বলে মুখে আনন্দ টানা যাচ্ছে না! চাঁদকে এত কাছ থেকে আগে তো কখনো দেখিনি।

বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর রাত ফুরাল। দিগন্ত ঘেঁষে আমাদের নিচ দিয়ে সূর্য ওঠা দেখলাম। এমন দৃশ্য কখনো দেখিনি বলে অবাক হতে গিয়েও পারলাম না। আমি না ওদের ওপর রাগ করে আছি! এর মধ্যে হুতুতু আর রবিনের খুব ভাব হয়ে গেছে। তারা বকরবকর করেই যাচ্ছে। বলছে এই সূর্যের আলোটা নাকি তাদের খুব দরকার! কারণ, প্লেনটা চলে সোলার এনার্জিতে! আমি ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে জানব কি না, ভাবতে থাকলাম! কিন্তু কোনো প্রশ্ন ওদের করলাম না। রাগ করে থাকলে এত প্রশ্ন করতে নেই!

পরের পুরো দিন আর রাতটা খুব ভালো গেল। এতক্ষণ ধরে যে প্লেনটা আকাশে উড়তে পারবে তা আমার কল্পনার মধ্যেও ছিল না। রবিন বলল, আর কতক্ষণ এ রকম রাগের ভান করে থাকবি?

কী, আমি ভান করে আছি? আমার রাগ আরও বাড়ল। তাতে হুতুতু আরও বেশি মজা পেল। বেশি মজা পেলে হুতুতু গান গায়। সে একটা অচিন সুরের গান ধরল। গানের সুর মিলিয়ে যেতে না যেতেই আমরা একটা কালো মেঘের দেখা পেলাম আকাশে। আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। রবিন বলল, নো চিন্তা! ওটাকে পাশ কাটিয়ে যাব!

কিন্তু একটা মেঘকে পাশ কাটাতে না কাটাতেই দেখি আরও কালো মেঘ। আসলে আকাশজুড়েই কালো আর কালো মেঘ। আর আমাদের প্লেন নিয়ে সেই কালো মেঘে ঢুকে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকল না!

আর মেঘের ভেতর ঢুকতেই ভয়ংকরভাবে নড়েচড়ে উঠল প্লেনটা। ভেতরে বইছে প্রবল ঝড়। প্লেন ভীষণভাবে ঝাঁকি খাচ্ছে—রবিন শক্তভাবে সামলানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আরেকটু এগোতেই একেবারে সবকিছু উল্টেপাল্টে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ডানা স্রেফ উড়ে গেল, অন্যটা গেল মুচড়ে! আর তারপর হঠাৎই যেন সবকিছু স্লো মোশন সিনেমার মতো হয়ে গেল। প্লেনটা আক্ষরিকভাবে আকাশ থেকে খসে পড়তে শুরু করল।

ধীরে, অনেক অনেক অনেক ধীরে, আমরা যেন পড়ে যেতে থাকলাম নিচের দিকে। আমি বলতে চাইলাম, রবিন, সব শেষ...পারলাম না! নিচে তাকাতেই দেখলাম এবার যেন আল্ট্রা ফাস্ট স্পিডে অন্ধকার ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। চোখ বন্ধ করলাম না, অন্ধকার ভেদ করে এবার পাহাড়ি মাটি দেখলাম। ধেয়ে আসছে, আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে! হুতুতু ভীষণ চিৎকার করে উঠল! রবিনের চোখ কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে!

সব শেষ হয়ে গেল, এত সহজেই!

কিন্তু মাটিতে থেঁতলে যাওয়ার আগে আরেকটা ঝোড়ো হাওয়া আমাদের একেবারে উড়িয়ে নিয়ে ফেলল একটা সমুদ্রে। স্রেফ এক সেকেন্ডে ঘটনাটা ঘটল মনে হয়। শীতল পানিতে পড়েই ডুবতে শুরু করলাম আমরা। আমি আর পারলাম না, জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম!

৬.

চোখ যখন খুললাম, দেখলাম তালগাছ। একটা না, দুইটা।

আমার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে রবিন আর হুতুতু। বললাম, বেঁচে আছি?

হুতুতু বলল, অজ্ঞান হয়ে সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছিলে তুমি! রবিন আর আমি প্লেনটাকে নৌকা বানিয়ে এই দ্বীপে উঠিয়েছি! আমাদের জন্য তোমার জীবন বেঁচেছে!

: তোমাদের জন্যই মরতে বসেছিলাম!

ঝগড়াটা আরও চালিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু পিপাসা আর ক্লান্তিতে শরীরে কোনো শক্তিও তো পাচ্ছি না। কাঁহাতক এত কথা বলা যায়। ঘুমিয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলাম!

সকালে দেখলাম দ্বীপটা বড় অদ্ভুত। দ্বীপের ভেতর লম্বা লম্বা তালগাছের মতো গাছ। কিন্তু তাদের মাথায় একটা করে চোখ। চোখগুলো একবার খোলে, একবার বন্ধ হয়। রবিন বেশি পাকনা, তাই একটা ঢিল ছুড়ে বসল চোখ বরাবর। ওর ঢিল কখনোই এত ভালো ছিল না...অথচ ঢিলটা গিয়ে চোখেই লাগল। আর সঙ্গে সঙ্গে পুরো দ্বীপটা কেঁপে উঠল। আমরা তাল সামলাতে না সামলাতেই দেখলাম যে গাছগুলো এতক্ষণ গাছ ছিল, সেগুলো আসলে একটা প্রাণীর লিকলিকে প্রত্যঙ্গ হয়ে বেরিয়ে পড়ছে। ঠিক যেন হাতির শুঁড়। আকৃতিতে বড় এই যা! আমি বললাম, পালা রবিন, পালা!

কিন্তু পালাব কোথায়! চারদিকে পানি আর পানি! আমার গলা শুকিয়ে এল। আর তখন দেখলাম পানির ভেতর থেকে এক অতিকায় বিকট দর্শন মাথা বেরিয়ে এল। বুঝতে পারলাম দ্বীপ বলে এতক্ষণ যেটার ওপর খুশি হয়ে ঘুরছিলাম, সেটা আসলে এই রাক্ষস প্রাণীটার পিঠ!

প্রাণীটা ঘোঁত করে নিশ্বাস ফেলতেই আমাদের উড়ে যাওয়ার দশা হলো। হুতুতু ফট করে আমার শার্টের পকেটে ঢুকে পড়ল ভয়ে। আমিও কোনো একটা পকেটে ঢুকে যেতে পারলে ভালো হতো! প্রাণীটার চোখ ঘোলা। হঠাৎই প্রাণীটি হেসে ফেলল। ভীষণ চিঁ চিঁ ধরনের কণ্ঠে বলল, কত দিন পর কেউ এখানে এল! তোমরা সবাই ভালো তো!

আরে এ তো দেখছি বাচ্চা রাক্ষস!

কিন্তু বাচ্চাই যদি বড় হয়, তাহলে বড়টা না জানি কী সাইজের!

প্রাণীটি বলল, নিশ্চয়ই প্লেন ক্র্যাশ! না হলে কি এদিকে কেউ আসে! আমি খুব খুশি হয়েছি! এই, তোমরা কি খেলা পারো? আমার সঙ্গে খেলবে? একটা খেলা আছে না চুবাচুবি...তুমি আমাকে চুবাবে পানিতে, আমি তোমাদের!

খাইছে!

ওকে আমরা চুবালে ও ডুববে না! আর ও যদি আমাদের চুবায় তাহলে কি আর আমরা উঠতে পারব?

আমি বললাম, না না, এ রকম খেলা আমরা পারি না!

হঠাৎই রাক্ষস প্রাণীটার চোখ জ্বলে উঠল। বলল, কী, খেলা পারো না তোমরা? তোমরা খালি স্কুলে যাও, না? এই তোমাদের মতো গুডবয়দের জন্য আমাদের মতো ছোট ছোট বাচ্চার কত ঝামেলা পোহাতে হয় জানো! মা-বাবা প্রতিদিন আমাকে স্কুলে পাঠাতে চায়! আর শিক্ষকগুলো এমন বদ বাজখাঁই, শুধু মারে! তোমরা, তোমাদের জন্যই আমাকে প্রতিদিন মার খেতে হয়!

: কী বলো এসব, আমাদের জন্য কেন...

: যা বলছি শোনো! তোমরা যারা খেলতে পারো না, তাদের কোনো দরকার নেই এখানে!

: আমরাও তো যেতে চাই!

: যেতে চাও না, কোথায় যাবে? মা-বাবার কাছে গিয়ে বলে দেবে না যে আমি শুধু খেলতে যাই? কোত্থাও যেতে পাবে না! হয় তোমাদের চুবাব...না হয় মেরে ফেলব!

এই সেরেছে!

প্রাণীটা এবার মুখ বাড়িয়ে নিয়ে এল আমাদের কাছে। চোখে যেন আগুন জ্বলছে। হিসহিস করে বলল, খেলবে না?

রবিনের মাথায় ভাগ্যিস তখন বুদ্ধিটা খেলে গেল। সে চট করে বলল, খেলব তো! কিন্তু চুবাচুবি আর কত দিন খেলবে তুমি! আমি একটা নতুন খেলার কথা বলছি শোনো!

: নতুন খেলা? কী খেলা, কী খেলা, বলো না!

: খেলার নাম সাইবেরিয়া!

: সাইবেরিয়া?

: হুম! তুমি আমাদের সবাইকে সাইবেরিয়া নিয়ে যাবে! আর আমরা হুতুতুকে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দেব!

: এটা আবার কেমন খেলা?

: খুবই ইন্টারেস্টিং খেলা! ও, তুমি খেলোনি এই খেলাটা?

প্রাণীটার মুখ যদি দেখতে! এ ধরনের খেলা খেলেনি সে এটা স্বীকার করতেও চায় না, আবার বুঝেও উঠতে পারছে না কী করবে!

রবিন বলল, সাইবেরিয়া চেনো তুমি?

: চিনি না আবার!

: তাহলে তোমার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে চলো সেখানে? খেলার নিয়ম হলো, যাদের নিয়ে যাবে, তাদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়!

: আচ্ছা...!

: উমহু! মনে হচ্ছে তুমি এ খেলা আগে কখনো খেলোনি! তোমার সঙ্গে এই খেলাটা খেলা যাবে না!

: কে বলেছে খেলিনি। অনেকবার খেলেছি! তোমাদের এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি, চলো...

৭.

পরের গল্পটা খুব সরল। ভয়ানক প্রাণীটার পিঠে চড়ে আমরা সাইবেরিয়া পৌঁছলাম হেসেখেলে। তারপর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলাম হুতুতুকে। মা জানাল পরের শীতে বাংলাদেশে এসে সে আমাদের সঙ্গে দেখা করবে! আর আমরা ফিরলাম কীভাবে দেশে? সেই গল্পটা আরেক কোনো আষাঢ়ে!