জীবন কখনো ব্যর্থ হয় না

অলংকরণ: তুলি

সন্ধ্যা হলো সবচেয়ে মন খারাপ করা সময়। এটা দিন আর রাতের সন্ধিক্ষণ। ভোরও দিন আর রাতের মধ্যখানের সময়, কিন্তু ভোরের সামনে থাকে আশা। থাকে আলো। সূর্য উঠছে। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাবে। মানুষ, প্রাণী, প্রকৃতি জেগে উঠবে। জেগে উঠবে জনপদ। কিন্তু সন্ধ্যার সামনে কেবলই অনিশ্চয়তা। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। আলো নিভে আসছে। তারপর আর কিছু দেখা যাবে না। পাখিরাও নীড়ে ফিরে যাবে। সবাই ঘুমিয়ে পড়বে। চারদিক সুমসাম।

ঠিক এই রকম একটা সন্ধ্যায় ঋষিকেশে গঙ্গার ধারে বসে আছে ১৮ বছরের তরুণ আবদুল কালাম। নদীতে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। নদীর ঢেউয়ে সোনালি আলো কারুকাজ ফুটিয়ে তুলে আস্তে আস্তে নিভে গেল। অন্ধকার মশারির মতো ঢেকে দিচ্ছে জগৎটাকে। পশ্চিমাকাশের লাল আভা মিলিয়ে যাচ্ছে। একঝাঁক বাদুড় উড়তে শুরু করেছে।

নদীর এই তীরটা বড় খাড়া। অনেক নিচে কালো জল। বাঁকা জল। আবদুল কালাম দুপায়ের বুড়ো আঙুলে ভর করে নদীর একদম কানিতে এসে দাঁড়াল।

সামনে একটুখানি ঝুঁকলেই সে ভারসাম্য হারিয়ে নদীতে পড়ে যাবে।

গেলেই–বা কী? তার এই জীবনের কি কোনো মূল্য আছে?

না। কোনো মূল্য নেই। ভাবতে থাকে আবদুল কালাম:

‘আব্বা, আমি আপনার স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারছি না। আম্মা, আমি কোনো কাজেরই না। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়, আম্মা, আপনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কোনো কথা বলেননি।

‘কিন্তু আমি জানতাম, আপনি দোয়া করছিলেন। আপনি বলছিলেন, যা বাবা, দেরাদুন বিমানবাহিনী রিক্রুটিং সেন্টারে যা। ভালো করে ভর্তি পরীক্ষা দে। বিমানবাহিনীর পাইলট হ। তোর মনের সাধ পূর্ণ কর। পাখা মেলে আকাশে ওঠ।’

তার বড় চার ভাইবোনও একই দোয়াই করছিলেন নিশ্চয়ই। সবাই যে বাড়ি থেকে আসার সময় উপস্থিত ছিলেন, তা নয়। কিন্তু কালাম জানে, সবাই কত ভালোবাসে তাকে। আর তার ওপরেই সবার কত আশা, কত বিশ্বাস। তাকে ঘিরে পরিবারটার কত স্বপ্ন।

ছোটবেলা থেকে আবদুল কালাম দেখে এসেছে, অভাবের সঙ্গে লড়াই করছে তাদের পরিবার। কিন্তু এ গল্প তাদের এলাকার সবাই করেন, বিশেষ করে মুরব্বিরা, আবদুল কালামরা একসময় অনেক বড়লোক ছিল। মাদ্রাজে পামবান দ্বীপে তাদের দাদারা ছিলেন সওদাগর। জাহাজভরা পণ্য নিয়ে তাঁরা যেতেন শ্রীলঙ্কা। তার বাবার ছিল বিশাল নৌকা। পামবান এই এলাকার পুণ্য আশ্রম। পুণ্যার্থী তীর্থযাত্রীরা এই দ্বীপে আসে-যায়। তাদেরই আনা–নেওয়া করা ছিল আবদুল কালামের পৈতৃক ব্যবসা। কিন্তু সেই দ্বীপে আসা-যাওয়ার জন্য সেতু হয়ে গেল। আব্বা খুশি হয়েছিলেন, আবদুল কালাম শুনেছে। এসবই তার জন্মের আগের ঘটনা। কারণ, তীর্থযাত্রীদের কষ্ট কমে গেছে। তা ছাড়া নৌকায় যাতায়াত করা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। একদিন তো প্রতিমাও পড়ে গিয়েছিল পানিতে। আবদুল কালামের আব্বা জয়নুল আবেদিন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই প্রতিমা উদ্ধার করে তুলেছিলেন। এলাকার সব ধর্মের মানুষেরা আবদুল কালামদের পরিবারকে তাই বড় শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।

কিন্তু আবদুল কালামদের পরিবারে যে বড় অভাব। আবদুল কালামের মনে হয়, অভাব সাঁড়াশি দিয়ে তাদের পরিবারকে চাপ দিচ্ছে। আম্মা তাকে কত ভালোবাসেন। একদিন রাতের খাবার খেয়ে কালাম পড়ছে। তার মেজ ভাই এসে বলল, ‌‘কালাম কী করেছিস? তুই তো আম্মার রুটিও খেয়ে ফেলেছিস। আম্মা আজ রাতে না খেয়ে থাকবেন।’ শুনে আবদুল কালাম ছটফট করতে লাগল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল আর আটা নেই। এত রাতে কোনো দোকানও খোলা পাওয়া যাবে না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সে গিয়েছিল দোকানে। পরদিন আম্মা ওঠার আগেই রুটি বানিয়ে রুটি সেঁকে সে আম্মার শিয়রের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আব্বার কাছ থেকেও কত–কী শেখার আছে। আব্বা একদিন রাতের বেলা ফিরলেন। ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত। আবদুল কালাম তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘আব্বা, আপনি কি না খেয়ে আছেন? আপনার মুখ বড় শুকনো দেখাচ্ছে।’

আব্বা বললেন, ‘সেই সকালে খেয়ে বেরিয়েছি। একটু তো খিদে পাবেই।’

খেতে বসলেন আব্বা। মা পাকঘরে রুটি সেঁকছেন। এদিকে জানালায় বাতাস এসে ঝাপটা দিচ্ছে। আম্মা জানালা বন্ধ করতে গেলেন। এসে দেখলেন, বাতাসের ধাক্কায় চুলার আগুন উসকে গেছে। রুটি পুড়ে গেছে।

হারিকেনের আলোয় আবদুল কালাম দেখল, আব্বা সেই পোড়া রুটি খুব আয়েশ করে খাচ্ছেন। বললেন, আজকের রুটিটা মচমচে। এই রকম মাঝেমধ্যে খেতে পারলে ভালো লাগে। স্বাদের বদল হয়।

পরে রাতের বেলা আব্বার পাশে শুয়ে আবদুল কালাম জিজ্ঞেস করেছিল আব্বাকে, ‘আব্বা আপনি কেন পোড়া রুটিকে ভালো বললেন?’ আব্বা বলেছিলেন, ‘তোমার আম্মা সারা দিন কত পরিশ্রম করে। বাইরে বাতাসের ঝাপটা ছিল, উনি জানালা বন্ধ করতে গিয়েছিলেন, রুটি পুড়ে গেছে। আমাদের এত আটা নেই যে তিনি আরেকটা রুটি বানাবেন। তাঁর সারা দিনের পরিশ্রম, আন্তরিকতা আর চেষ্টাটাকে আমাদের সম্মান করতে হবে। একদিন সামান্য পোড়া রুটি খেলে কী অসুবিধা?’

আবদুল কালাম সংবাদপত্রের হকারের কাজ নিল। তার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে। স্টেশনে সকালে যেতে হয়। ভেতর থেকে সংবাদপত্রের প্যাকেট ছুড়ে মারা হয়। সেটা তুলে তারা বিক্রি করে। ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। সন্ধ্যায় পয়সা গোনে। আজ লাভ হয়েছে ৫ পয়সা। আজ লাভ হয়েছে ১০ পয়সা।

সোয়ার্জ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে এইচএসসি পাস করেছে আবদুল কালাম। এরপর যদি সে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়, তাহলে পড়ার খরচ লাগবে। পড়া শেষ করার আগে চাকরি পাবে না। টাকা পাবে না। সে ভারি কষ্টের ব্যাপার হবে। সহজ হলো, বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়া।

বিমানসেনা হব আমি। পাইলট। জেট প্লেন নিয়ে উড়ব আকাশে। চিলের মতো উড়ব। হাউইয়ের বেগে ছুটব। পড়ার টাকা লাগবে না। বেতনও এসে যাবে তাড়াতাড়ি।

স্কুল–কলেজে আবদুল কালাম ফার্স্ট বয় না। কিন্তু সে খারাপ ছাত্রও না। শিক্ষকেরা প্রশংসা করেন। বিশেষ করে গণিতের স্যাররা তাকে বেজায় ভালোবাসেন।

দেরাদুনে আসার আগে আরেকটা ধাপ পেরোতে হয়েছে। দিল্লির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ছিল প্রথম বাছাই। কয়েক শ ছাত্রের মধ্যে এখন আছে পঁচিশজন। এরপর দেরাদুনের বিমানবাহিনী রিক্রুটিং সেন্টার। আবদুল কালাম একটু নার্ভাস ছিল পরীক্ষায়। এটাই ফাইনাল। লিখিত পরীক্ষা ভালো হলো। অঙ্কে ভালো করল। ভাইভায় বোধ হয় নার্ভাসনেসটা ধরা পড়ে গেল। বিমানবাহিনীতে সাহসী আত্মবিশ্বাসী লোক দরকার। সে–ও সাহসী। সে–ও লড়াকু। তার জীবনটাই লড়াইয়ের। পামবানে জলের তরঙ্গের ওপরে সে সাঁতার কাটতে জানে। গাছের ডাল থেকে ঝাঁপ দিতে পারে। ডুবে যাওয়া নৌকার যাত্রীদের সে উদ্ধার করে শাবাশি অর্জন করেছে।

আটজন নেওয়া হবে। দুপুরবেলা রেজাল্ট টাঙিয়ে দেওয়া হলো বোর্ডে। প্রথম আটজনের মধ্যে তার নাম নেই। তার নাম আছে ৯ নম্বরে।

খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল আবদুল কালাম। কতক্ষণ সময় কাটল কে জানে। তারপর সে কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে সোজা চলে এল বাসস্ট্যান্ডে। মাথার ওপরে সূর্য আলো ঢালছে। পিচ গলে তার জুতা আটকে যাচ্ছে পথে। সেসবের দিকে তার খেয়াল নেই। সামনে যে বাসটা পেল, তাতেই উঠে পড়ল আবদুল কালাম।

বাস এসে থামল ঋষিকেশে। এটা একটা তীর্থভূমি। এখানে আছে এক বিখ্যাত আশ্রম। আশ্রমের দিকে হাঁটতে লাগল আবদুল কালাম। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার দিকে।

আবদুল কালাম গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়াল। একটা পাথরের খণ্ডের ওপরে বসল। ১৮ বছরের জীবনটা নিয়ে ভাবতে লাগল। আবার বাড়ি ফিরে গিয়ে পেপারের হকারগিরি করতে হবে। টাকা জমলে পড়ার খরচ আসবে। স্থানীয় কোনো কলেজে যাবে? ফেরার পর আব্বা কী বলবেন? আম্মা কি কাঁদবেন?

আমি হতে চেয়েছিলাম বিমানবাহিনীর পাইলট। তা আমি হতে পারলাম না। এই জীবনের কোনো মানে নেই।

আবদুল কালাম উঠল। সন্ধ্যার অন্ধকারের নীরবতা ভেঙে শোনা গেল বাদুড়ের পাখার ঝাপটা। দূরে একটা শিমুলগাছ থেকে মানবশিশুর কণ্ঠে কেঁদে উঠল শকুনছানারা।

নদীর খাড়া পাড়ের একেবারে কানায় গিয়ে দাঁড়াল আবদুল কালাম। একটু ঝুঁকলেই সে ৬০ ফুট নিচের পানিতে পড়ে যাবে। অন্ধকার খরস্রোতা নদীর ঘূর্ণি এক নিমেষেই তাকে তলিয়ে দেবে অনন্ত অতলে।

‘বাবা, তোমার কী হয়েছে?’

প্রশান্ত একটা কণ্ঠস্বর শুনে পেছন ফিরে তাকাল আবদুল কালাম।

পশ্চিমাকাশের লাল আভা পড়েছে সেই কণ্ঠস্বরের মানুষটির চোখে–মুখে লম্বা দাড়ি–চুলে। তাকে প্রতিমার মতো মনে হচ্ছে।

আবদুল কালাম বলল, ‘কিছু হয়নি।’

‘এসো। তুমি আমার সঙ্গে এই পাথরের ওপরে বসো।’

আবদুল কালাম বসল।

তিনি বললেন, ‘তোমাকে দেখেই বুঝেছি তোমার মনে অনেক দুঃখ। তুমি অনেকটাই হতাশ।’

‘আপনি ঠিকই ধরেছেন।’

‘কেন তুমি হতাশ? কেন তুমি দুঃখী?’

‘আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে। আমি হতে চেয়েছিলাম বিমানবাহিনীর পাইলট। তা হতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। ভর্তি পরীক্ষায় আটজন নেওয়া হয়েছে। আমি নবম হয়েছি। এই জীবনের কোনো মানে নেই। আমি এই জীবন কেন রাখব? কী করে রাখব?’

সাধু বললেন, ‘বাবা, জীবন কখনো ব্যর্থ হয় না। তোমার এই ব্যর্থতার ঘটনার একটা মানে আছে।’

‘কী সেই মানে?’

‘মানেটা হলো, নিয়তি তোমাকে বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়ার জন্য সৃষ্টি করেনি।’

‘তাহলে আমার নিয়তি কী?’

‘তুমি ওঠো। অন্বেষণ করো। তোমাকেই বের করতে হবে যে নিয়তি তোমাকে কী হওয়ার জন্য সৃষ্টি করেছেন।’

‘সেটা ভালো, না খারাপ?’

‘এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমাদের ভালোর জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। চাঁদ ওঠে। সূর্য ওঠে। আলো দেয়। আবার ডুবে যায়। দিন আসে। রাত আসে। ভোর হয়। রোদ হয়। বৃষ্টি হয়। এই পৃথিবীর সবকিছুই আমাদের মঙ্গলের জন্য চেষ্টা করছে। আমাদের সেই মঙ্গলের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে হবে। বুক মিলিয়ে ধরতে হবে। তুমি ওঠো। অন্বেষণ করো তুমি কী হবে। তোমাকে আমি বললাম, একদিন তুমি বলবে, বিমানবাহিনীর পাইলট না হয়েই আমি ভালো করেছিলাম।’

আরেকজন সাধু এসে এই সাধুর হাতে একটা প্রদীপ ধরলেন। সেই আলোয় সাধুকে দেবদূত বলে মনে হলো।

‘চলো। আমাদের আশ্রমে কিছু খেয়ে নাও।’

আবদুল কালাম বললেন, ‘আমি চললাম।’

শিবানন্দ বললেন, ‘কোথায় যাবে? রাতটা আমাদের এখানে থেকে যাও। তুমি ক্ষুধার্ত। তোমার আগে খাবার দরকার। ভোরে চলে যেয়ো।’

আবদুল কালাম রাজি হলেন। আশ্রমের একটা ঘরে আরও আরও পুণ্যার্থীর পাশে শুয়ে পড়লেন আবদুল কালাম। আশ্রমের অন্যদের সঙ্গে বসে পাত পেতে রাতের খাবারটা তাকে প্রশান্ত করেছিল। শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

শিবানন্দ তাঁর শিষ্যকে রাতের বেলায় খাওয়ার পরে বললেন, ‘এই যুবক বড় হয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি হবে বলে আমার মনে হচ্ছে।’

শিষ্য বললেন, ‘আপনি কি ওকে এই কথা বলবেন?’

শিবানন্দ বললেন, ‘না বলব না। রাষ্ট্রপতি হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করলে কেউ রাষ্ট্রপতি হয় না। নিজের কাজ ভালো করে করলেই একজন মানুষ সফল হয়। এই ছেলে নিজের নিয়তি নিজেই অনুসরণ করুক। যে সাবজেক্ট তার ভালো লাগে, তা–ই পড়ুক। সেই বিষয়ে সে নিজেকে আলোকিত করুক। সেই আলোতে চারপাশ আলোকিত করুক। আমি তাকে কিছুই বলব না।’

বহু বছর পর ভারতের রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম তাঁর জীবনীতে শিবানন্দ সাধুর কথা লিখেছিলেন।