মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘অন্য জীবন’ (দ্বিতীয় পর্ব)

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পরদিন স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বু আমাকে একটা খাম দিয়ে বললেন, ‘এইটা তোর বন্ধুকে দিবি।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘বন্ধু? কোন বন্ধু?’ আমি ততক্ষণে ফজলের কথাটথা সবকিছু ভুলে বসে আছি।

আব্বু বললেন, ‘ওই যে তোর যে বন্ধু স্কুলের বেতন দিতে পারেনি দেখে পড়তে পারছে না।’

‘ও আচ্ছা। সে তো—’ আমি বলতে যাচ্ছিলাম সে আসলে আমার বন্ধু না, আমাদের ক্লাসে পড়ে মাত্র। কিন্তু আমার মনে হলো এ কথাটা বলা ঠিক হবে না। আব্বু-আম্মুদের ধারণা, ক্লাসের সবাই বুঝি একজন আরেকজনের প্রাণের বন্ধু, আমরা একে অন্যের জন্য জান দিয়ে দিই।

আব্বু ভুরু কঁুচকে বললেন, ‘সে তো কী?’

‘সে তো আজকে আসবে কি না কে জানে। মাঝে মাঝে আসে না।’

‘না আসলে নাই। যেদিন আসবে সেদিন দিবি।’

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, ‘ঠিক আছে।’

আমি চলে যাচ্ছিলাম, আব্বু বললেন, ‘আর শোন—’

আমি বললাম, ‘কী?’

‘এই খামে তোর বন্ধুর স্কুলের বেতন আছে। আমি যে ওর বেতনটা দিচ্ছি, সেটা কাউকে বলবি না।’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম, ‘কাউকে বলব না?’

‘না।’

আমাদের তখন সেই বয়স যখন বন্ধুরা একজন আরেকজনের কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা করি আমাদের নিজ নিজ আব্বুরা কত ভালো। ফজলের কথা শোনামাত্র আব্বু কীভাবে তার বেতনের টাকাটা দিয়ে দিলেন সেই গল্পটা কত রকম রং চং চড়িয়ে সবাইকে বলব, সেটা এর মাঝে ঠিক করে ফেলেছিলাম। আব্বুর কথা শুনে তাই একটু থতমত খেয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করে বললাম, ‘কেন? বললে কী হবে?’

‘কী হবে মানে? আমি বলেছি বলবি না—তাই কাউকে বলবি না। মনে থাকবে?’

আমি মাথা নাড়লাম, মনে থাকবে। তার অর্থ এখনো আমি সবাইকে বলব শুধু বলার আগে সবাইকে কসম খাইয়ে নিতে হবে যে সে কাউকে বলবে না। আমাদের প্রায় প্রতিদিনই এ রকম কিছু না কিছু করতে হয়।

স্কুলে গিয়ে দেখলাম আমার ধারণা সত্যি, ফজল স্কুলে আসেনি। একদিক দিয়ে ভালোই হলো আমি তখন ক্লাসের সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে আব্বুর দেওয়া খামটা দেখিয়ে পুরো কাহিনিটা বলতে পারলাম। ফজলের কাহিনি শুনে কীভাবে আব্বুর চোখে পানি চলে এসেছিল (একটু বাড়িয়ে বলেছি কিন্তু একটা গল্প ভালোভাবে বলতে হলে সব সময় একটু-আধটু বাড়াতে হয়, এর মাঝে দোষের কিছু নেই), আব্বু কীভাবে ফজলের বেতনের টাকাটা দিলেন, শুধু যে দিলেন তা না, কেউ যেন না জানে সেটাও আমাকে বলে দিলেন সেটা বললাম। কেউ মুখে বলল না কিন্তু সবাই যে মনে মনে স্বীকার করে নিল আমার আব্বুই সবচেয়ে ভালো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

দুই দিন পরে ফজলের দেখা পাওয়া গেল। সে ক্লাসে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার কাছে হাজির হয়ে বলল, ‘দে।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কী দেব?’

‘তোর বাবা আমার বেতনের টাকা দিছে না?’

আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, ‘তুই কেমন করে জানিস?’

সে ক্লাসের ছেলেদের দেখিয়ে বলল, ‘এরা বলছে।’

আমি এত কসম কাটিয়ে সবাইকে বলেছি কিন্তু এরা ফজলকে দেখামাত্রই সবকিছু বলে দিয়েছে। কী আশ্চর্য!

আমি ব্যাগ খুলে খামটা বের করে ফজলকে দিলাম। সে খামটা খুলে টাকাগুলো গুনে বলল, ‘কম আছে মনে হয়। তুই কত সরিয়েছিস?’

যতটুকু সরালে ফজল বুঝতে পারবে না আমি তার থেকে এক পয়সা বেশি সরাইনি কিন্তু পাঁজিটা তার পরেও বুঝে গেল। আমি অবশ্য সেটা স্বীকার করলাম না, মুখ শক্ত করে বললাম, ‘সরিয়েছি কে বলল তোকে?’

‘কেউ বলেনি।’ ফজল বলল, ‘দেখে বোঝা যায়। বড় মানুষেরা যখন টাকা দেয় তখন খুচরা দেয় না। এইখানে খুচরা পয়সা, সেই জন্য জিজ্ঞাসা করলাম।’

আমি মুখ আরও শক্ত করে বললাম, ‘তোর বেতন হবে কি না সেটা বল।’

ফজল মাথা নাড়ল, ‘হবে।’

‘তাহলে ফ্যাচ ফ্যাচ করছিস কেন?’

ফজল তখন ফ্যাচ ফ্যাচ বন্ধ করে তার বুকপকেট থেকে সেদিনের ফুটো তামার পয়সাটা বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল। বলল, ‘নে।’

‘কী?’

‘একটা পয়সা।’

‘আমি একটা পয়সা দিয়ে কী করব?’

‘এইটা অনেক মূল্যবান।’

আমি পয়সাটা হাতে নিলাম। অনেক দিন আগের কথা, তখন নোট অনেক বড় ব্যাপার, আমরা খুচরা পয়সা দিয়েই দিন চালাতাম। এক পয়সার বিশেষ গুরুত্ব নেই, তবু মাঝেমধ্যে ব্যবহার হয়। ফুটো পয়সাটা উল্টেপাল্টে দেখে বললাম, ‘এইটা কেন মূল্যবান?’

ফজল মাথা চুলকালো, বলল, ‘জানি না।’

‘জানিস না?’

‘না। কিন্তু যে দিয়েছে সে বলেছে এইটা মূল্যবান।’

‘কে দিয়েছে?’

ফজল এবার একটু থতমত খেয়ে গেল। ইতস্তত করে বলল, ‘আমার বন্ধু। তুই চিনবি না।’

‘তোর বন্ধু তোকে কেন মূল্যবান পয়সা দেয়? আর পয়সা তো পয়সাই। সেটা মূল্যবান হয় কেমন করে?’

ফজল এইবারে একটু রেগে গিয়ে বলল, ‘নিলে নে। না নিলে দিয়ে দে। আমি এত কথা বলতে পারব না।’

কথা শেষ করে সে তার বিড়ালের মতো চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকাল। সেই চোখ দেখে আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগল, আমি পয়সাটা নিয়ে নিলাম।

আব্বু কয় দিন থেকেই খোঁজ নিচ্ছিলেন ফজলের সঙ্গে দেখা হয়েছে কি না, তাকে বেতনের টাকা দিয়েছি কি না। সেদিন তাকে জানালাম যে শেষ পর্যন্ত খামটা তাকে দেওয়া হয়েছে। শুনে আব্বু খুশি হলেন। আমি বললাম, ‘তবে একটা সমস্যা আছে—’

আব্বু ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন, ‘কী সমস্যা?’

‘মনে হয় মাথার গোলমাল আছে।’

‘কেন?’

‘আমাকে তামার পয়সাটা দিয়ে বলেছে, এইটা নাকি অনেক মূল্যবান।’ আমি হতাশার মতো ভান করে বললাম, ‘পয়সা মূল্যবান হলেও তো পয়সা—টাকা তো হবে না!’

আব্বু বললেন, ‘দেখি পয়সাটা।’

আমি পকেট থেকে তামার পয়সাটা বের করে আব্বুকে দিলাম। আব্বু হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে চমকে উঠলেন, বললেন, ‘ও মাই গুডনেস!’

আমি বললাম, ‘কী হয়েছে!’

‘তোর বন্ধু ঠিকই বলেছে! এটা আসলেই মূল্যবান।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘সত্যি? এটা কি সোনার?’

‘না, না। সোনার না। পয়সাটা তামার—ব্রিটিশ আমলের পয়সা, কিন্তু সেই জন্য মূল্যবান না। এইটা মূল্যবান তার কারণ, এইখানে ভুলভাবে লেখা আছে—’

আমি বললাম, ‘ভুলভাবে?’

‘হ্যাঁ, এই দেখ—’ আমি দেখলাম এবং কিছুই বুঝতে পারলাম না। আব্বু বললেন, ‘তার মানে পয়সাটা তৈরি করার সময় দুইবার ছাপা পড়েছে, লেখাটা উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য। এটা একটা রেয়ার কয়েন।’

আমি তখনো কিছু বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘আব্বু, যদি পয়সাটার ওপর উল্টাপাল্টা লেখা থাকে, তার মানে এইটা আসলে এক পয়সাও ঠিকভাবে হয়নি! এটা আধা পয়সা—’

‘উঁহু।’ আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, কয়েনে ভুল লেখা হলে সেটা অনেক মূল্যবান হয়ে যায়।

‘কত মূল্যবান?’

আব্বু বললেন, ‘সেটা জানি না। যারা কয়েন কালেক্ট করে, তারা বলতে পারবে।’

আব্বু পয়সাটা খানিকক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে আমাকে ফেরত দিয়ে বললেন, ‘এইটা তোর বন্ধুকে ফেরত দিয়ে বলিস যত্ন করে রাখতে।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে।’

পরদিন আমি ফজলকে তার ফুটো পয়সাটা ফেরত দিয়ে বললাম, ‘আব্বু বলেছেন, এইটা অনেক মূল্যবান। তুই এটা যত্ন করে রাখিস।’

ফজল বলল, ‘আমি জানি।’ কিন্তু পয়সাটা নিল না।

আমি বললাম, ‘নে। তোর মূল্যবান পয়সা।’

‘আমার লাগবে না।’

‘লাগবে না?’

‘না।’

‘কেন?’

ফজল মুখটা সুচালো করে বলল, ‘আমার আরও আছে।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তোর আরও আছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোথায় পেয়েছিস?’

ফজল উত্তর দিল না। বলল, ‘এই তো, পেয়েছি আর কী—’

আমি বললাম, ‘মিত্থুক। তোর আর নেই।’

‘আছে।’

‘তাহলে দেখা—’

ফজল বলল, ‘আমি পকেটে নিয়ে ঘুরব নাকি?’ বাড়িতে আছে। আমি মুখ শক্ত করে বললাম, ‘তোর বাড়িতে গেলে দেখাতে পারবি?’

ফজল মাথা নাড়ল। বলল, ‘পারব।’

‘কোথা থেকে পেয়েছিস?’

ফজল হাই তুলল। বলল, ‘আমাকে দেয়।’

‘কে দেয়?’

‘এই তো—’ বলে ফজল তার ডেস্কে মাথা রেখে চোখ পিট পিট করে তাকাল।

আমি জিগ্যেস করলাম, ‘এই তো মানে?’

ফজল উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

আমি বললাম, ‘কী হলো? কী করিস?’

ফজল বলল, ‘ঘুম পাচ্ছে।’

‘এখন ঘুম পাচ্ছে?’

ফজল ঘুম ঘুম চোখে বলল, ‘হ্যাঁ। সারা রাত জেগে ছিলাম তো—’

‘সারা রাত জেগেছিলি?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’

ফজল কোনো জবাব দিল না, আমার মনে হলো সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে গেল।

আরও পড়ুন