ভুলের খেসারত!
কোনো এক বৃহস্পতিবার। শেফিল্ড। ইংল্যান্ড। বেলা ঠিক ১১.০০। এই সময়ে ইস্টার্ন সিটি ব্যাংকের শেফিল্ড শাখায় ঢুকলেন সাদা চুলওয়ালা, সম্ভ্রান্ত পোশাক পরা একজন সুদর্শন ভদ্রলোক। রোদে পোড়া মুখ তাঁর।
১১.০৪ মিনিট। ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ব্যাংক ম্যানেজারের সেক্রেটারি সুন্দরী লিলি ওয়াকারের টেবিলের সামনে। তীক্ষ দৃষ্টিতে রুক্ষভাবে ভদ্রলোককে পর্যবেক্ষণ করল মেয়েটি। সুদর্শন ভদ্রলোক মিষ্টি হাসি উপহার দিলেন সেক্রেটারিকে। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিলেন। তারপর মনোরম কণ্ঠে বললেন, ‘মিস্টার গ্রেগরি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আগেই টেলিফোনে কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে।’ হাসিটা চওড়া হলো ভদ্রলোকের, ‘এবং আমার বিশ্বাস, আপনার মিষ্টি কণ্ঠই আধঘণ্টা আগে ফোনে শুনতে পেয়েছিলাম, যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে।’
প্রশংসায় গলে গেল লিলি।
‘এক সেকেন্ড, প্লিজ!’ বলল সেক্রেটারি, আর ম্যানেজারের অফিসে ঢুকে যাওয়ার আগে চট করে একবার চোখ বোলাল ভদ্রলোকের হাতের কার্ডটার দিকে, যাতে লেখা রয়েছে: স্যার মেলোরি ডিমান্ডার, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, শেফিল্ড পেট্রোল অ্যান্ড অয়েল কোং লিমিটেড।
১১.০৬। দুই হাত বাড়িয়ে অফিসের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন ম্যানেজার জেমস গ্রেগরি, অতিথিকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর বিলাসবহুল আসবাবে সাজানো প্রাইভেট অফিসরুমে।
‘আশা করি আমাদের টেলিফোনের আলোচনাটা পুরোপুরি ব্যক্তিগত রেখেছেন, মিস্টার গ্রেগরি, টেলিফোনে যেভাবে অনুরোধ করেছিলাম আপনাকে।’ পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে নিতে চাইছেন সাদা চুলওয়ালা ভদ্রলোক। উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে তাঁকে।
‘তা তো নিশ্চয়ই, যেভাবে বলেছেন সেভাবেই ব্যবস্থা করেছি।’ ম্যানেজার জবাব দিলেন।
ম্যানেজারের বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে সাবধানে হাতের কালো ব্রিফকেসটা টেবিলের ওপর রাখলেন ভদ্রলোক। হাসিটা মুখে ধরে রেখেই পকেট থেকে একটা চেকবুক বের করলেন তিনি। সেই সঙ্গে একটা রিভলবার। সোজা গ্রেগরির দিকে তাক করলেন রিভলবারটা। হাসি হাসি মুখটা মুহূর্তে মলিন আর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ম্যানেজারের। মোলায়েম ভদ্র ভাষায় ভদ্রলোক বললেন, ‘ভালোমতো শুনুন আমার কথা, মিস্টার গ্রেগরি। তারপর ভাবুন। আমার কিছু হারানোর নেই, বুঝতে পারছেন? আর আমি যে জন্য এসেছি, সেই টাকাগুলো না নিয়ে এই ব্যাংক থেকে বেরোচ্ছি না।’
ব্রিফকেস খুলে আরেকটা জিনিস বের করেছেন ভদ্রলোক, সেটা দেখে ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না ম্যানেজার। একটা ছোট বোতল। আর সেটা ভর্তি কোনো ধরনের ঘন তরল। একটা ছোট ঘড়িসহ একটা টাইমিং ডিভাইস লাগানো রয়েছে বোতলটায়। ঘড়িটায় লাগানো রয়েছে একটা খুদে মাইক্রোফোনের মতো জিনিস।
‘কেমিস্ট্রি সম্পর্কে কি সামান্য জ্ঞান রয়েছে আপনার, মিস্টার গ্রেগরি?’ মসৃণ কণ্ঠে বললেন ভদ্রলোক, নিজেকে যিনি স্যার মেলোরি বলে পরিচয় দিয়েছেন।
এখনো ভাষা খুঁজে পাননি মিস্টার গ্রেগরি, ভদ্রলোকের কথায় সামান্য মাথা নাড়লেন। তাতে মাথা ঝাঁকালেন সাদা চুলওয়ালা ভদ্রলোক। ‘জানতাম, জানবেন না। গ্লিসারিন আর নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রণ। আর এই জিনিসটাকে রাসায়নিক ভাষায় বলে নাইট্রো-গ্লিসারিন। অত্যন্ত শক্তিশালী একটা বিস্ফোরক।’
চিন্তিত ভঙ্গিতে বাঁ হাতে নিজের কপাল ডললেন ভদ্রলোক। ‘তো, যা বলতে চাইছি, সেটা বলি। এখন আপনি আপনার চিফ ক্যাশিয়ারকে ফোন করে বলুন পুরোনো এক হাজার পাউন্ড নোটের পঞ্চাশটি বান্ডিল তৈরি করতে, প্রতিটি বান্ডিলে এক শটি করে নোট থাকবে। মানে, পঞ্চাশ লাখ পাউন্ড। তাঁকে বলুন, কয়েক মিনিটের মধ্যে শেফিল্ড পেট্রোল অ্যান্ড অয়েল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর তাঁর সঙ্গে দেখা করে টাকার চেকটা জমা দেবেন, যেটা আপনার দ্বারা অনুমোদন করে সই করা। প্লিজ! তাড়াতাড়ি করুন।’
বুড়ো আঙুলের সাহায্যে বোতলের গায়ে লাগানো একটা সেফটি ডিভাইস অন করলেন সাদা চুলওয়ালা ভদ্রলোক।
ভয়ানক বিপজ্জনক বোতলটা থেকে চোখ না সরিয়ে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন ম্যানেজার। দুবার কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। জোর করে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে আনলেন। ফোনের রিসিভার কানে লাগিয়ে চিফ ক্যাশিয়ারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। কথা বলে ম্যানেজার টেলিফোনটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে এক টানে ফোনের তারের মাথায় লাগানো প্লাগটা সকেট থেকে খুলে আনলেন সাদা চুল ভদ্রলোক। চেকবুকটা ম্যানেজারের দিকে ঠেলে দিলেন। ‘এতে পঞ্চাশ লাখ পাউন্ডের একটা চেক লেখা আছে।’ বললেন তিনি, ‘অনুমোদন করে সই করে দিন।’
গ্রেগরিকে যেভাবে যা করতে বলা হলো তা-ই তিনি করলেন।
এরপর যে ঘটনাটা ঘটল, গ্রেগরির কাছে রীতিমতো অদ্ভুত মনে হলো সেটা। অতি সাবধানে আলতো করে বোতলটা ব্রিফকেস থেকে তুলে নিলেন স্যার মেলোরি, ঘড়ি আর মাইক্রোফোনটাসহ। সরু একটা রুপালি তার লাগানো ঘড়িটার সঙ্গে। ঘড়ির কাচ নেই, ভেঙে ফেলা হয়েছে। ডায়ালের গায়ে দাগ পড়েছে, সম্ভবত ভাঙা কাচের। গ্রেগরির মনে হলো হয় ইচ্ছা করে কাচটা ভাঙা হয়েছে, কিংবা হাত ফসকে হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল ঘড়িটা।
তারের একটা মাথা গ্রেগরির দিকে বাড়িয়ে দিলেন সাদা চুলওয়ালা লোকটা। আদেশের সুরে বললেন, ‘ধরুন এটা!’
দ্বিধা করছেন ব্যাংক ম্যানেজার। রিভলবারটা তুলে নিয়ে তাঁর কপাল বরাবর তাক করলেন ভদ্রলোক। হুমকির ভঙ্গিতে নল নাচালেন। অগত্যা কাঁপা হাতে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের সাহায্যে তারটা টিপে ধরলেন ম্যানেজার। ‘হাতের কাঁপুনি থামান, নইলে বিপদ হতে পারে।’ ভদ্রলোক সাবধান করলেন।
ম্যানেজারের হাতের সঙ্গে তারের কাঁপুনিও বন্ধ হলে ভদ্রলোক বললেন, ‘এখন বাজে ১১.১২। এই যে এই লাল বোতামটা যখন টিপব আমি, টাইম সুইচটা চালু হয়ে যাবে। তারপর থেকে ঠিক ষাট মিনিট চালু থাকবে বোমাটা। মিনিটের কাঁটাটা যখন বারোর ঘর পার হয়ে বারো মিনিট স্পর্শ করবে, আপনা-আপনি সুইচ অফ হয়ে যাবে, বোমাটাও অচল হয়ে যাবে, আর বিপজ্জনক থাকবে না তখন। কিন্তু এর আগে আপনার হাতের তারের সামান্য নড়াচড়ায় কিংবা তারটা ছেড়ে দিলেই বোমাটা ফাটবে। এটার যা ক্ষমতা, আপনার ব্যাংক বিল্ডিংটা উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আশা করি, এই ঘরটা সাউন্ডপ্রুফ। চেঁচিয়ে কাউকে ডাকলে শুনতে পাবে না। আর যদি পায়ও, ডেকে আনানও, সেই একই কথা—তার সরানোর চেষ্টা করলেই ‘‘বুমমম!’’ সুতরাং, সাবধান!’
ঘড়ির লাল সুইচটা টিপে দিলেন ভদ্রলোক। নিঃশব্দে তুলে নিলেন চেক, চেকবুক আর ম্যানেজারের দেওয়া অনুমোদনের কাগজ। রিভলবারটা তুলে জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে রাখলেন। তারপর নিঃশব্দে রওনা হলেন দরজার দিকে।
মিস লিলি, টেলিফোনে কথা বলতে বলতে অবাক হয়ে তাকাল ভদ্রলোকের দিকে। রিসিভারটা রেখে দিল সে। আশা করেছিল, তার বস বেরোবে ভদ্রলোকের পেছন পেছন। এত দামি একজন ক্লায়েন্টকে নিশ্চয়ই স্বাগত জানিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে দেওয়ার কথা। যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরেই হাসিমুখে মোলায়েম গলায় বললেন স্যার মেলোরি, ‘জরুরি কাজে ব্যস্ত আপনার বস। পরের একটি ঘণ্টা কোনো রকম বিরক্ত করা হোক, চান না। এবং তিনি আমাকে আপনাকে জানাতে বলে দিয়েছেন, কেউ যেন এক ঘণ্টা তাঁর ঘরে না ঢোকে। খুব জটিল একটা হিসাব মেলাচ্ছেন তিনি।’
বুঝতে পেরেই যেন মাথা ঝাঁকাল মিস লিলি।
১১.২৪ মিনিট। চিফ ক্যাশিয়ার ডেভিড টমাস হাজার পাউন্ডের নোটের শেষ বান্ডিলটি স্যার মেলোরির ব্রিফকেসে সাজিয়ে রাখল। ‘এই যে হয়েছে, স্যার মেলোরি।’ বলে সৌজন্য দেখিয়ে মেলোরির হয়ে নিজেই ব্রিফকেসের ডালা লাগিয়ে দিল।
১১.২৮ মিনিট। সাদা চুলওয়ালা ভদ্রলোক বারান্দার দেয়ালের পাশের একটা টেলিফোন বুথের পাশ কাটিয়ে প্রধান প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেলেন।
দরজার কাছে যখন পৌঁছালেন, তখন বাজে ১১.৩২। হঠাৎ তীক্ষ একটা হুইসেলের শব্দ হলো। দুজন সাদাপোশাক পরা পুলিশের লোক দুই দিক থেকে জাপটে ধরল ভদ্রলোককে। বারান্দা দিয়ে ছুটে এল কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হলো ভদ্রলোককে। পেছনে, ব্যাংকের ভেতর থেকে এসে দাঁড়ালেন জেমস গ্রেগরি। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভয়ানক একটা মানসিক যন্ত্রণা আর ধকলের মধ্য দিয়ে আধঘণ্টা সময় পার করেছেন তিনি।
বিস্মিত সাদা চুলওয়ালা ভদ্রলোক ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মুক্তি পেলেন কী করে? যে জিনিসটা আপনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এসেছিলাম, সেটা তো আসল জিনিস। তার থেকে হাত সরালেই বিস্ফোরিত হওয়ার কথা!’
হাসিমুখে মাথা নাড়লেন ম্যানেজার, ‘না, আপনার জিনিসটা আসলই। তবে একটা খুঁত আপনি রেখে দিয়েছেন ঘড়ির কাচটা ভেঙে। বাঁ হাতে তার ধরে রেখেছিলাম আমি, কিন্তু ডান হাত খোলা ছিল। সেই হাতে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে ১২টা ১২ মিনিটে নিয়ে গেছি। ব্যস, অফ হয়ে গেছে বোমা। তারপর টেলিফোন সকেটে প্লাগ লাগানো, পুলিশকে টেলিফোন ইত্যাদি করতে খুব একটা সময় লাগল না। পঞ্চাশ লাখ পাউন্ড গুনে দিতে ক্যাশিয়ারের যেটুকু সময় লেগেছে, সেটুকু সময়ে পৌঁছে গেছে পুলিশ।’
‘নাহ্, আপনিই জিতলেন, ম্যানেজার।’ বিড়বিড় করলেন স্যার মেলোরি, ‘আমার ছোট্ট একটা ভুলের জন্য। কাজ করার সময় হাত থেকে পড়ে গিয়ে ঘড়িটা ভেঙেছিল। বদলে একটা নতুন ঘড়ি লাগানো উচিত ছিল। কিন্তু তাচ্ছিল্য করে ভাবলাম, ভাঙাটাই লাগিয়ে দিই। সামান্য এতটুকু তাচ্ছিল্যই আমার এত সুন্দর প্ল্যানটা বরবাদ করে দিল। ভুলের খেসারত।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক।