৮ বন্ধুর দুর্গম পাহাড়ি এলাকা জয়

অলংকরণ: আপন জোয়ার্দার

‘মনে হয় প্রায় পৌঁছে গেছি।’ ম্যাপের দিকে তাকিয়ে বলল নুসরাত। ‘হ্যাঁ, ওই যে পাহাড় দেখা যায়।’ পাহাড়টার দিকে আঙুল তাক করে দেখিয়ে বললাম, আমি। ‘যাক, শেষ পর্যন্ত!’ আফরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। ‘এই দাঁড়া, একটু বসে নিই। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা করছে।’ এ কথা বলে তাসনিম বসে পড়ল পথের ধারে।

আমরা আটজন বের হয়েছি ভ্রমণে। জায়গাটা একটা প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল। আমাদের মূল উদ্দেশ্য, এখানকার সবচেয়ে বেশি উচ্চতার পাহাড়ে ওঠা। হাইকিং, ক্যাম্পিং ও পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ আছে সবারই। ভ্রমণপিপাসুদের বেলায় যা হয় আরকি, সময় পেলেই বেরিয়ে পড়া। আমাদেরও সে রকম অবস্থা। সময় পেয়েই বেরিয়ে পড়লাম। এখন আমরা পাহাড়টার একদম কাছে।

‘এবার যাওয়া যাক?’ আরশি বলল। ‘হুম, যাওয়া যায়।’ উঠতে উঠতে বলল তাসনিম। ‘হ্যাঁ, না হয় পরে দেরি হবে।’ নাজিফা হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল। ‘এমনিতেও কদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছে, আকাশ এখনো মেঘলা। কখন বৃষ্টি নামে কে জানে!’ ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল মিহা। ‘আচ্ছা জায়গা তো! নেটওয়ার্কই নেই!’ আয়রা বলল ফোন হাতে নিয়ে। ‘আজব তো! এখানে ভালো নেটওয়ার্ক আশা করিস কীভাবে?’ আমার কণ্ঠে বিস্ময়। ‘তা ঠিক...’ আয়রা বলল।

এটা আমাদের প্রথম পর্বতারোহণ হতে যাচ্ছে। এর আগে সময়ের অভাবে করা হয়নি। ঘোরাঘুরি হয়েছে কিন্তু যাওয়া বা আসা হয়নি পাহাড়ি এলাকায়। পাহাড়ের একদম নিচে এলাম আমরা। তাসনিম ওপরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, ‘এই, দেখ না, কত উঁচু, দেখলেও তো ভয় লাগে।’

‘এখানে আসার আগে কে যেন বলেছিল, এখানকার পাহাড়গুলো খুব উঁচু, কেউ তাই পর্বতারোহণ করতে সাহস করে না।’ আফরা বলল।

‘আমাদের আসতেও তো মানা করেছিল। তাই না?’ নাজিফা মাথা একদিকে কাত করে বলল।

‘আমরা তো তা–ও এসেছি।’ নুসরাত বলল।

‘এখন কী? তোরা কি উঠতে চাইছিস না?’ আয়রা তার ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘সাহসে কুলাচ্ছে না যে!’ আরশি আঙুল কামড়াতে কামড়াতে বলল।

এমন সময় তাদের কথায় বাধা দিয়ে আমি বললাম, ‘এখন কি তোরা উঠতে চাইছিস না? এত দূর এসে থেমে যেতে চাইছিস?’ সবাই আমার দিকে তাকাল বটে, কিন্তু কিছু বলল না। ‘সেটাই তো। এত দূর যখন এসে গেছি, তখন ফিরবার দরকার কী? আর কেউ পারেনি বলে কি আমরাও পারব না? আমরা কতজন দেখ তো।’ মিহা বলে উঠল। ‘এটা ঠিক বলেছিস।’ নুসরাত তাকে সমর্থন দিল। ‘তো, রাজি?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘হ্যাঁ, রাজি।’ সবাই বলল। ‘যা হবার হোক। কিন্তু আমরা উঠবই। আরশি জোরগলায় বলল। ‘হ্যাঁ, চল, হয়তো আমরাই প্রথম হব। আমাদের দেখায় অন্যরা আসবে।’ আফরা বলল। ‘এই তো! চল, আমি আগে উঠি, নাকি? তারপর তোরা উঠতে থাক।’ আমি বললাম, ‘আর সবাই সায় দিল।’

এবার সবকিছু তৈরি করতে লাগলাম। পাহাড়ে ওঠার জন্য দড়ি ঠিক করলাম, পরীক্ষা করে দেখলাম, ঠিক আছে কি না। এরপর আমরা সুরক্ষাসামগ্রী পরে নিলাম। এরপর শুরু করলাম ওপরে ওঠা। সবার আগে আমি, তারপর তাসনিম, নুসরাত, আরশি, মিহা, আফরা, নাজিফা ও সবশেষে আয়রা। ‘প্রভা, শুভকামনা। উঠতে থাক।’ নুসরাত বলল, ‘তোদেরও শুভকামনা।’ আমি হেসে বললাম।

ওপরে উঠতে উঠতে মনে হলো, এই পথ আর কোনো দিন শেষ হবে না। এ পাহাড়কেও মনে করলাম অসীম, এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়, তা–ও উঠতে লাগলাম। এ পাহাড়টা আহামরি বড় নয়, একেবারেও ছোটও নয়। তবু পাহাড় জয় করার ইচ্ছা নিয়ে উঠতে লাগলাম।

জান যখন প্রায় যায় যায়, তখন দেখতে পেলাম, আমরা পাহাড়ের চূড়ার প্রায় কাছাকাছি। ‘ও হো! এসে গেছি প্রায়।’ পেছন থেকে নাজিফা চিৎকার করে বলে উঠল। চূড়া দেখে মনে হয় গতি আরও বেড়ে গেল। ওপরে উঠতে উঠতে হুঁশ প্রায় নেই হয়ে গিয়েছিল, যখন একটু হুঁশ এল, তখন দেখি, ওমা, চূড়ায় উঠে গেছি। একলাফে উঠে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। অন্যরা সবাইও হইহই করে উঠল। ওপরে উঠে নিশ্বাস নিতে থাকলাম জোরে জোরে। জানি, ওপরে অক্সিজেনের পরিমাণ কম। তাতে কি! সেটা তো আর পর্বতারোহণের পথে কাঁটা হতে পারেনি। নুসরাত কোথা থেকে একটা বাংলাদেশের পতাকা লাঠিতে বাঁধানো অবস্থায় এসে মাটিতে গেঁথে দিল। ‘এটা কই পাইলি?’ আফরা জিজ্ঞেস করল। ‘এনেছিলাম, এটা রাখলে ভালোই হয়।’ নুসরাত দাঁত বের করে হেসে বলল।

‘দাঁড়া।’ এই বলে আমি ব্যাগ থেকে আরেকটা পতাকা বের করলাম। তবে এটা বাংলাদেশের না, এখানে আমাদের আটজনের নাম লেখা আছে।’ এটা নিয়ে আমি ওই লাঠিতে বাংলাদেশের পতাকার নিচে বেঁধে দিলাম। ‘এবার এটা কোথা থেকে আনলি?’ আয়রা বলল। ‘এটাও আমার সাথে থাকে। লাগতে পারে ভেবেছিলাম, লেগেছেও।’ আমি বলে হাসলাম। ‘তোদের দুজনের বুদ্ধি ভালো।’ আরশি বলল। এই দেখ!’ তাসনিম চিৎকার করে উঠল। সে আঙুল তাক করে রেখেছিল আকাশের দিকে। আমরাও তাকালাম, আর যা দেখলাম তাতে হতবাক হয়ে গেলাম। রংধনু উঠেছে আকাশে। এবার আমরা সবাই চিৎকার করে উঠলাম। ওপর থেকে রংধনু অনেক সুন্দর আর বিশাল দেখাচ্ছিল। ‘দাঁড়া, ছবি তুলি।’ আমি আমার ডিএসএলআর ক্যামেরা বের করে ছবি তুললাম। ‘আমাদের সবার একটা তোলা যায় না?’ আরশি বলল। ‘দাঁড়া, দেখি।’ আমি বলে ব্যাগ থেকে ক্যামেরাস্ট্যান্ড বের করলাম। ক্যামেরাকে অটো ছবি তোলার মোডে সেট করে নিয়ে আমরা সবাই রংধনুর সামনে দাঁড়ালাম। উঠে গেল আমাদের একটা ছবি।

এরপর একদিন খবরের কাগজে বের হলো এক খবর ‘৮ বন্ধুর দুর্গম পাহাড়ি এলাকা জয়।’