কেঁচে গণ্ডূষ

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ছোট্ট মিনিবাস, কিন্তু গাদাগাদি নেই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ৮–১০ জন যাত্রী বসে আছে এদিক-সেদিক। পুরো বাসটাই যেন ঝিমুচ্ছে। আর এটাই স্বাভাবিক—ভরা শ্রাবণের এই ঝুম বৃষ্টির ঘুম ঘুম দিনে কীর্তিমারী টু ডাকাতিয়ার বাসে কয়জন উঠবে?

তবে জেলা শহর কীর্তিমারী থেকে উত্তরে যে হাইওয়েটা বেরিয়েছে, সেটা কিন্তু ট্রাকে–বাসে মুখর আজও। সব দিনই থাকে—হাতিয়াপাড়া স্থলবন্দর এই রাস্তা ধরেই যেতে-আসতে হয়। বাসটা স্থলবন্দরের দিকে মুখ করে যাত্রা শুরু করেছে বটে, কিন্তু এক-তৃতীয়াংশ পথ যাওয়ার পর ডানে একটা মোড় নিয়ে ঢুকে যাবে ডাকাতিয়া ন্যাশনাল ফরেস্টের দিকে। থামবে একদম ফরেস্ট অফিসের গেটে।

লোকাল বাস হলেও হাতে গোনা স্টপেজ এটার। স্বাভাবিক, আধা রাস্তাই তো জনবিরল জঙ্গুলে পাহাড়ি জায়গার ভেতর দিয়ে। কীর্তিমারীর উপকণ্ঠে তিন মাথার মোড়ের বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু। খানিক দূর পর্যন্ত শহুরে রিকশা-ভ্যান-অটোর জ্যাম ঠেলে এগোনোর পর রাস্তার দুপাশে ঘরবাড়ি পাতলা হতে শুরু করে। আনুপাতিক হারে বাড়তে দেখা যায় ধান-ভুট্টার খেত আর হাঁড়িভাঙা আমের বাগান। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দূরে দেখতে পাবেন তিন চূড়াওয়ালা লাল পাহাড়ের নীলচে ছায়া। আকাশ বেশি পরিষ্কার থাকলে আর সেই সঙ্গে ভাগ্যের যোগ থাকলে দিগন্তে দেখতে পাবেন বরফঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার রুপালি ঝিলিক।

দুই বন্ধু বাসে উঠলেন তিন মাথার মোড় থেকেই। খালি বাস দেখে ভেবেছিলেন ছাড়তে দেরি হবে, কিন্তু বৃষ্টি আবার আসি আসি করছে দেখে সিটে বসে পড়লেন চা খাওয়ার প্ল্যানটা ত্যাগ করে।

বাসে-টাসে উঠলে মানুষ আপনা থেকেই বাঁ দিকের সিটগুলো বেশি পছন্দ করে, নিরাপত্তার কথা ভেবে সম্ভবত। ঢ্যাঙা বন্ধু স্বভাবতই বাঁয়ের একটা ফাঁকা সিটে বসতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু চশমা পরা বন্ধু তার পোলো শার্টের আস্তিন ধরে টান দিলেন ডানের সারির দিকে। ‘আয় এদিকে বসি, কাওসার! শহর ছেড়ে বেরোলেই লাল পাহাড় দেখতে পাব।’

কাওসার, ঢ্যাঙা বন্ধু, সেই সিটটায় বসলেন বটে। কিন্তু ফোড়ন কাটতে ছাড়লেন না, ‘সত্যিই দেখতে পাবি তো, শোভন? বৃষ্টির দিনে কিন্তু লাল পাহাড় মেঘে ঢেকে যায়।’

চশমা পরা বন্ধু শোভন নিজের সিটে বসতে বসতে বললেন, ‘হোক বৃষ্টি! ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে পাহাড় দেখার মজাই আলাদা।’

কাওসার মুচকি হাসলেন। বন্ধুর পাগলামি জানা আছে, তাই কথা বাড়ালেন না। বয়স ৩৫ ছুঁই ছুঁই, কিন্তু দারুণ অ্যাথলেটিক গড়ন লোকটার। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। মাথায় ক্যাপ। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরা পায়ের পেশিই বলে দেয়, দৌড় আর পাহাড়ে ট্রেকিংয়ে কোনো আলসেমি করেননি কোনো দিন।

বাসটা বেশি দেরি করল না, ছেড়ে দিল। কীর্তিমারীর সবচেয়ে বড় পর্যটন আকর্ষণ ডাকাতিয়া ন্যাশনাল ফরেস্ট। এমন ‘ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে’ বেশি যাত্রী ওমুখী হবে না অন্য দিনের মতো, কিন্তু আগের দিনের যাত্রীরা যারা কটেজ আর বাংলোতে রয়ে গেছে, তারা ফিরবে। ফাঁকা বাস নিয়ে গেলেও ক্ষতি নেই।

শহর ছেড়ে বেরিয়েছে বাস, ধানখেত দেখা যাচ্ছে একটা-দুটো। সেদিকে স্বপ্নমাখা চোখে তাকিয়ে শোভন বললেন, ‘তবে যা–ই বল, নীরবের সঙ্গে পরিচয় না হলে জীবনের এই আনন্দগুলো থেকে আরও অনেক দিন বঞ্চিত থাকতাম।’ এক সেকেন্ডের নাটকীয় বিরতির পর যোগ করলেন, ‘হয়তো সারা জীবন!’

কাওসার আবার আরেকটু হাসলেন। ‘তোর নয়া বন্ধুর সঙ্গে তো পরিচয় করিয়ে দিলি না। অথচ তার কথা সারাক্ষণ বলিস।’

‘ও যা মুখচোরা!’ শোভন চোখ বড় বড় করে বললেন। ‘আর ঘরকুনোও। মাঝেমধ্যে কেবল আমার ব্যাংকে আসে, তা–ও ভেতরে ঢোকে না, লাঞ্চ আওয়ারে বাইরের কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটু গল্পটল্প করে চলে যায়। আর মাঝেমধ্যে পাবলিক লাইব্রেরির পাশে আড্ডা দিই সন্ধ্যার পরে, সেটাও মাত্র দুজন মিলে।’

‘তোর থেকেও বড় ঘরকুনো?’ আরেকটা ফোড়ন কাটলেন কাওসার। ‘সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই দেখছি, কোনো পিকনিক বা শিক্ষাসফরে যেতি না। কলেজে পড়ার সময় কক্সবাজার-বান্দরবান ট্যুর দিলাম ব্যাচের সবাই মিলে, সেটাতেও ছিলি না! আর আমার বন-পাহাড়ের পাগলামি কিন্তু ওই ট্যুর থেকেই শুরু।’

‘জড়তার কারণে যাওয়া হতো না, তবে প্রকৃতি আর নিসর্গের প্রতি ভালোবাসা কিন্তু আমার তখনো ছিল,’ লজ্জা মেশানো গলায় বললেন শোভন। ‘নীরবের সঙ্গে বন্ধুত্বটা হওয়ার পর এখন বেরোতে শুরু করেছি, এ-ই যা।’

‘হ্যাঁ। আমার সঙ্গেই তো ডাকাতিয়া গেলি এই নিয়ে তিনবার, গত তিন মাসে। আর সামনের মাসে বোধ হয় ভারতে যাবি? আন্দামানে, তাই না?’ কাওসার বললেন।

‘হ্যাঁ। জাহাজে করে যাব আন্দামানে, ফিরব প্লেনে করে। জাহাজ ভাড়া করে আন্দামানের আগ্নেয়গিরির পাশ দিয়ে ঘুরব, জংলি-অধ্যুষিত নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপ চক্কর দিয়ে আসব, যে দ্বীপে নামলে কেউ বেঁচে ফেরে না। আহা!’ অ্যাডভেঞ্চারের কথা কল্পনা করে চোখ বুজে আসতে চাইল প্রকৃতিপ্রেমী শোভনের।

‘বহু খরচের ব্যাপার কিন্তু।’ কাওসার বললেন।

‘তা বটে। কিন্তু তুই-ই তো ব্যবস্থা করে দিচ্ছিস। ভাগ্যিস, তুই ট্যুর গ্রুপের পরিচালক, না হলে অনেক খরচ পড়ে যেত।’

‘ওই সময়ে আমার সাকা হাফং ট্রেকটা না থাকলে আমিও হয়তো যেতাম আন্দামানে। সেই কবে একবার গেছি।’ কাওসার বললেন। ‘প্রায় ৪০ জনের গ্রুপ নিয়ে যাচ্ছি, বলেছিলাম তোকে...’

‘হ্যাঁ, তোর যেটা রুটিরুজির কাজ, সেটা তো করতেই হবে।’ বললেন শোভন। ‘তবে তোকে আজ ফ্রি পেয়ে ভালো হয়েছে। বৃষ্টির দিনে ডাকাতিয়া বনে যাচ্ছি, নতুন অভিজ্ঞতা! তুই না থাকলে ঝামেলা হয়ে যেত।’

‘বৃষ্টির দিনে ডাকাতিয়া ফরেস্টের ট্রেইলে ঘুরে অর্কিড দেখা। হুম, তোর এই নতুন বন্ধুটা একদম নিখাদ প্রকৃতিপ্রেমী, তা বলতে হবে। আনকমন ট্রেকে পাঠিয়েছে তোকে।’ কাওসার বললেন। ‘কী যেন করেন উনি? বলেছিলি, ভুলে গেছি।’

‘বই আর ম্যাগাজিনের ডিলার। লেখালেখিও করে। ম্যাগাজিনে লেখা দেখেছিস বোধ হয়, “নীরব অরণ্য” নামে লেখে।’

খকখকিয়ে কাশির শব্দ হলো একটা, ঠিক কানের কাছেই। চমকে ঘুরে তাকালেন দুই বন্ধু। পেছনের দুই সিট মিলিয়ে একজনই লোক বসে আছে, খাবি খাওয়ার ভঙ্গিতে আড়ষ্ট কাশিটা সে-ই কেশেছে। শুকনো চেহারা, বসা গাল, চুল এলোমেলো, একটা চাদর গায়ে। বয়স ত্রিশের মতো। নিম্নবিত্ত, দেখলেই বোঝা যায়। দুই বন্ধুর চোখে চোখ পড়তে অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠল, ‘মাফ করি দেবেন ভাই। শীত লাগতেছে তো, কাশি আসি গেছে হঠাৎ। আপনাদের পাশের জানালাটা একটু টানি দেন কষ্ট করিয়া।...হ্যাঁ হ্যাঁ, হইছে।’

‘পড়েছিস ওর লেখা?’ শোভনের প্রশ্ন।

জবাব দেওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের লোকটাকে আরেক নজর দেখে নিলেন কাওসার। খুব সাধারণ লোকটার মধ্যে কী একটা ব্যাপার যেন চোখে পড়েছে ওনার। দ্বিতীয়বার তাকিয়েও অবশ্য ধরতে পারলেন না। লোকটা একটা সস্তা স্মার্টফোনে কী যে পড়ছে, চোখ তুলে কাওসারকে একবার দেখেই নজর নামিয়ে নিল।

‘না রে, ম্যাগাজিন পড়ার সময়ই পাই না।’ একটু দেরিতে হলেও উত্তর দিলেন কাওসার।

‘দারুণ কালচারাল ছেলে এই নীরব!’ চশমার আড়ালে সেই স্বপ্নীল চোখ ফিরে এসেছে শোভনের। ‘বৃষ্টির দিনে অর্কিড দেখতে যাওয়ার বুদ্ধি তো কিছুই না। ওর থেকে শিখে আরও কত কিছু যে করেছি আমি, তার ইয়ত্তা নেই। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, কীর্তিমারীর আনাচকানাচে ঘুরে শহরের রহস্য আর কিংবদন্তিগুলো চিনেছি।’

‘কী রকম?’ কাওসারের প্রশ্ন।

‘এই যেমন, নেহালের পুরি, জলযোগের সন্দেশ—এগুলোর খালি নামই শুনেছি এত দিন, অথচ এই শহরে জন্মের পর থেকে থাকি! বন্ধ হয়ে যাওয়া লক্ষ্মী সিনেমা হলের পাশে একটা ছোট্ট ঠেলাগাড়িতে আমার খাওয়া সেরা ঝালমুড়ি বেচে, সেটা চিনেছি। দেশের সেরা বই বাঁধাইকারী থাকেন পৌর বাজারের পেছনের একটা চিপাগলিতে। আজব দোকান—চারপাশে তালা–চাবির দোকান আর অক্সি–অ্যাসিটিলিন টর্চ দিয়ে লোহা কাটার ওয়ার্কশপ, তার মাঝখানে বই বাঁধাইয়ের দোকান! হা হা...’

ভুরু কোঁচকালেন কাওসার। ‘কয়েক দিন আগে একটা তালা সারাতে গেছিলাম ওই গলিতে। কোনো বুক বাইন্ডিংয়ের দোকান দেখিনি তো।’

‘আছে আছে, আমি তো অনেক দিন গেলাম তার কারুকাজ দেখতে। যা–ই হোক, আরও কী কী নান্দনিক জিনিস শিখেছি নীরবের থেকে, বলি। বাবুপাড়া বস্তির পাশে একটা গলির ঠিকানা দিয়েছিল নীরব, সেখানে গিয়ে এক সেতারবাদকের সন্ধান পেয়েছি। লোকটা আসলে বাদ্যযন্ত্র ঠিক করে, আমার ইউকুলেলেটা তার কাছ থেকে সারিয়েও নিয়েছি, কিন্তু কাজের ফাঁকে যখন সেতার বাজাতে বসে, আহা! সাক্ষাৎ যেন রবিশঙ্কর।’

রাস্তার দুই পাশে বাড়িঘর আর নেই বললেই চলে, হয় খেত নাহয় বন-জঙ্গলের টুকরোটাকরা। বাসটা গতি কমিয়ে হাতের ডানে একটা রাস্তায় নেমে পড়ল। এবার সোজা ডাকাতিয়া ফরেস্টের গেটে, মিনিট দশেক লাগবে।

‘সেদিন যখন তোর ব্যাংকে গেলাম নতুন ট্রিপের টাকাটা জমা করতে, দেখলাম তোর কলিগরা ভালোমতোই জানে তোর এসব নতুন অ্যাডভেঞ্চারের খবর,’ কাওসার বললেন। বাইরে চোখ। গাছপালার ফাঁক দিয়ে লাল পাহাড়ের মাথা দেখা যাওয়ার কথা এখন, কিন্তু যাচ্ছে না। মেঘে মেঘে ছেয়ে আছে পাহাড়-অরণ্য।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে গিয়েও চেপে গেলেন শোভন। আনন্দে ঝলমল শিশুর মতো সরল মুখটা একটু যেন মলিন হলো। ‘হ্যাঁ, সবই জানে। আসলে জানিস কি, ওদের কাছে আমি সব সময়ই হাসির পাত্র। আমার বই পড়া, কবিতা লেখা, জোছনা দেখতে ত্রিস্রোতা নদীর পাড়ে যাওয়া, এগুলো নিয়ে ওরা আগে থেকেই হাসাহাসি করত। নীরবের সঙ্গে পরিচয়ের পরে যখন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম, তখন আরও বেশি মজা পেয়ে গেল ওরা। আগে খালি বিরক্ত করত বিয়ে কবে করবেন, কবিতা এত লেখেন কিন্তু কাউকে পটাতে পারলেন না কেন, এসব বলে, এখন বলে কী, “বাবুপাড়া বস্তিতে সেদিন যেতে দেখলাম, ওখানে নাকি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর দেখা পেয়েছেন?” বা টিটকিরি দেয়, “আন্দামানে গেলে একটু জংলিদের সঙ্গে সেলফি তুলে আসবেন।” আবার সেদিন বলে, “আপনার নতুন বন্ধুকে এত দিনেও দেখলাম না, সে কি বাস্তব না আপনার কবিতার মতোই কাল্পনিক?” কী সব বিচ্ছিরি কথাবার্তা!’

‘কান দিস না ওসবে,’ কাওসার সান্ত্বনা দিলেন। ‘সবাই যদি নন্দনত্ব বুঝত, তাহলে দেশে রবীন্দ্রনাথ আরও এক ডজন জন্মাতেন। বাদ দে। আজকের দিনটা এনজয় কর।’

‘হ্যাঁ। শনিবারটা এমনিতেও আমার রিল্যাক্স করার দিন। ব্যাংকের চাকরিতে অনেক খাটুনি, সপ্তাহে দুই দিন ছুটিতেও মন ভরে না। পারিবারিক কোনো ব্যস্ততা বা অন্য কোনো কাজ থাকলে সেটা শুক্রবারেই সেরে ফেলি। শনিবারটা কাটাই একদম নিজের মতো করে।’

‘আপনি স্বাধীন ব্যাংকের কোন শাখাত কাম করেন?’

বোকার মতো ডানে-বাঁয়ে তাকালেন শোভন, প্রশ্নকারীকে খুঁজছেন। তারপর কাওসারের দৃষ্টি অনুসরণ করে খুঁজে পেলেন—পেছনের সিটের লোকটা। এলোমেলো চুলওয়ালা, মলিন চাদর পরা বছর ত্রিশেকের লোকটা।

সে নিজের সিটে সামনে ঝুঁকে বসে আছে, চেহারায় গভীর আগ্রহের ছাপ। শোভনের আরও দুই সেকেন্ড পর মনে পড়ল, লোকটার প্রশ্নের জবাব দেওয়া এখনো বাকি। ‘আ-আমি কালীপাড়া শাখায় কাজ করি। কেন?’

লোকটা সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল, ‘ও, যে ব্যাংকটার পাশের প্লটত একটা অনেক তলা বিল্ডিং উঠতেছে, তাই না? ফাউন্ডেশন দেওয়ার জন্য জমি খুঁড়ছে, দেখি আসছি। সেইদিন গেছলাম তো কালীপাড়ার দিকে, তখন দেখছি।’

শোভন মাথা ওপর-নিচ করলেন কেবল। ভেবে পাচ্ছেন না, লোকটা এসব বলছে কেন। আর লোকটা আসলে কে? পরিচয় কী?

লোকটা নিজে থেকেই বলতে শুরু করেছে, ‘হু, কালীপাড়া ব্র্যাঞ্চের স্বাধীন ব্যাংকটা ফির নিচতলাত। হুম।’

কাওসারের ভুরু কুঁচকে গেছে। ‘আপনি কিছু মনে না করলেন?’

লোকটা কিন্তু কানেই তুলল না কথাটা। ‘আমাদের হাতত সময় বেশি নাই। বাসখান আর পাঁচ মিনিট পর ডাকাতিয়া ফরেস্টের গেটত দাঁড়াবে। আমরা নামিয়াই আবার ফেরত যাব শহরে।’

বাসে বোমা পড়লেও বোধ হয় এতটা অবাক হতেন না কাওসার আর শোভন। বিস্ময়ে ঝুলে পড়া চোয়াল নিয়ে পরস্পরের দিকে দুই সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন দুই বন্ধু।

‘মানে!’ প্রথম কথা ফুটল কাওসারের গলাতেই।

লোকটা ততক্ষণে তার সস্তা স্মার্টফোনে কাকে যেন কল দেওয়ার চেষ্টা করছে। লাভ হওয়ার কথা নয় খুব একটা—এই পাহাড়ি অঞ্চলে ফোনের নেটওয়ার্ক জঘন্য। পাঁচবার চেষ্টা করলে একবার কল যায়। চেহারায় অধৈর্যের ছাপ।

‘আপনি কীভাবে জানলেন আমি স্বাধীন ব্যাংকে কাজ করি?’ শোভনের প্রশ্ন।

‘আপনি কে, সেটা জানতে পারি?’ কাওসারের প্রশ্ন।

লোকটার কানে যেন শুধু কাওসারের কথাটাই ঢুকল। ‘অধমের নাম কামাল। মাইনষে টিকটিকি কামাল কয়া ডাকে।’ নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিল সে, যেন নিজেকে টিকটিকি বলাটা খুব স্বাভাবিক বিষয়।

‘আমরা শহরে কেন ফেরত যাব?’ শোভনের জিজ্ঞাসা।

‘আপনাদের কথা শুনতেছিলাম, মাফ চায়া নিতেছি সে জন্য,’ কামাল বলল। ফোনটা এখনো কানে ঠেকানো। ‘আমার কাজই মানুষের কথা শোনা, অভ্যাস হয়া গেছে। অবশ্য আপনাদের পিছনে ইচ্ছা করিয়া বসি নাই, পুরাই আচানক ব্যাপার। মন দিয়া কিছুই শুনতেছিলাম না, বিশ্বাস করেন। কিন্তু এমন কিছু জিনিস কানে পড়ল, তাতে আর থামি থাকবার পারলাম না।’ বলে সরাসরি শোভনের দিকে তাকালো কামাল। ‘আপনার সামনত অনেক বড় বিপদ, শোভন ভাই। আমাদের হাতত সময় খুব কম।’

‘মা-মানে...’ শোভন বেচারা ভড়কে গেছেন।

‘সব মিলি যাচ্ছে। একটা ষড়যন্ত্র হইতেছে, খুব চালাক কিছু লোক মিলিয়া করতেছে। তাদের কাম ঠিকই হাসিল হয়া যাবে, আর বিপদত পড়বেন আপনি।’ কামালের ফোনটা এখনো কানে ঠেকানো, কল সম্ভবত দিতে পারেনি সে এখনো।

‘কিসের ষড়যন্ত্র? কিসের বিপদ?’ কাওসারের জিজ্ঞাসা।

সামনে, বাসের বিশাল উইন্ডশিল্ড ভেদ করে দেখা যাচ্ছে ডাকাতিয়া ন্যাশনাল ফরেস্টের বিশাল খিলানওয়ালা গেটটা। বাসের গতি কমতে শুরু করেছে। কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে, ‘লাস্ট স্টপেজ, লাস্ট স্টপেজ।’

উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুলেও আবার বন্ধ করে ফেলল কামাল। কলটা ঢুকেছে তার। ফোনে কাউকে বলল, ‘স্লামালেকুম স্যার। সিকান্দারের দলটার খোঁজ পাইতেছিলাম না অনেক দিন ধরে, এবারে মিলছে মনে হয়। কালীপাড়ার স্বাধীন ব্যাংকের শাখাটাত ডাকাতি করবে। ...হ্যাঁ, সুড়ঙ্গ খুঁড়িয়া।...হ্যাঁ, পাশের যে বিল্ডিংটার ফাউন্ডেশনের কাজ চলতেছে সেদিক দিয়াই সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে নিশ্চিত। আজকাই করবে—শিওর! জি স্যার, আমি আসতেছি আধা ঘণ্টার ভেতরে।’

বিস্ময়ে অসাড় দুই বন্ধুকে বসিয়ে রেখে লাফ দিয়ে সিট ছেড়ে সামনে এগিয়ে বাসের ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরের কানে কানে কী যেন বলে এল কামাল। ফিরতি পথে যাত্রা শুরু আগে বাসটার অন্তত ১৫ মিনিট বিরতি নেওয়ার কথা, কিন্তু যে কয়জন যাত্রী উঠেছে, তাদের নিয়েই দ্রুত নাক ঘোরাল ড্রাইভার। আবার কীর্তিমারী ফিরছে ওরা।

‘কীভাবে জানলেন এত কিছু?’ গলায় জোর ফেরার পর শোভন প্রশ্ন করলেন।

‘ভাবিয়া দেখেন আপনার অবস্থা। ব্যাংকের সবাই জানে আপনি লোকটা মিশুক না। নিজের মতো থাকেন। কিন্তু কয়েক দিন হইল, খুব ঘুরতেছেন সারা শহরত। অদ্ভুত সব জায়গাত যাইতেছেন। পৌর বাজারের পেছনের গলি, য্যাটে তালা–চাবি আর লোহা কাটার দোকান। বাবুপাড়া বস্তির পাশের গলি, যেইখানে সব ডাকাইতের আড্ডা, আর অবৈধ অস্ত্রও পাওয়া যায়। তা ছাড়া সবাই জানে আপনি ভারতে যাবেন সামনেই। আরও জানে, আপনার অনেক টাকার দরকার।’ কামাল ধীরে ধীরে বলে চলল। কাওসার ঢোঁক গিললেন। লোকটার মধ্যে অনেকক্ষণ আগে কী যেন একটা দেখেছিলেন, এখনো ধরতে পারেননি।

‘কি-কিন্তু আমি তো বই বাঁধাইওয়ালার কাছে গেছিলাম! সেতারওয়ালার কাছে গেছিলাম।’ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে শোভনের মুখ, প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।

‘সেটা কেউ বিশ্বাস করবে না, ভাই। পুলিশ আর আদালত ওই সব কৈফিয়ত কানেতেই লাগাবান্নয়। সবাই জানবে, আপনি লোহালক্কড়ের গলিতে গেছিলেন ব্যাংকের ভল্ট কাটা জিনিসপাতি জোগাড় করতে, আর বাবুপাড়া বস্তির গলিতে গেছিলেন অস্ত্র কিনতে আর ডাকাইতদের সাথে দোস্তি পাতাইতে।’ কামাল শান্ত গলায় বলল।

কাওসারের মাথায় এতক্ষণে জিনিসটা ঢুকতে শুরু করেছে। ‘আর সেইখান থেকে তোর ইউকুলেলে নিয়ে এসেছিস বাক্সতে করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা পরে আদালতে বলবে, তুই ওভাবে অস্ত্র এনেছিস।’

কামাল মাথা ওপর–নিচ করল, মুখে রহস্যময় হাসি। ‘আর আপনাকে আপনার বন্ধু আজকে ডাকাতিয়া ফরেস্টে পাঠাইছে অর্কিড দেখতে, কাদার মধ্যে! হাসিয়া কূল পাই না। এইখানে একমাত্র আপনার বন্ধু ছাড়া কেউ সাক্ষী নাই। একজনের সাক্ষী টিকবে না। সবাই বলবে, আপনিও ছিলেন ব্যাংকের ভেতরে, সুড়ঙ্গ দিয়া ঢুকিয়া ভল্ট কাটিয়া টাকা চুরি করতেছিলেন।’

শীত শীত দিনেও কপালের ঘাম মুছলেন শোভন কাঁপা হাতে। ‘কিন্তু-কিন্তু আমার বন্ধু নীরব! সে এই সবের সঙ্গে জড়িত! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না!’

কামাল এমনভাবে হাসল যেন কোনো শিশুর বোকামি দেখে নির্দোষ মজা পাচ্ছে। ‘সে-ই তো নাটের গুরু, পুরো ব্যাপারটা তারই মাথা থেকে বেরিয়েছে। শুধু সে না, ওই বই বাঁধাইকারী আর ওই সেতারবাদক, তারাও তার চ্যালা। স্বাধীন ব্যাংকের ভল্টে তারাই ঢুকছে এখন, তিনজন মিলে। নাটের গুরু আপনার তথাকথিত বন্ধু। এমন শিক্ষিত-মার্জিত আর সুচারু তিন ডাকাতকে চিনি আমি। ঘাঘু ডাকাত সিকান্দার ও তার দলবল!’

‘কি-কিন্তু সে বলেছিল তার নাম নীরব! নীরব অরণ্য, লেখালেখি করে! নিজের ছাপানো লেখাও দেখিয়েছিল!’ নাছোড়বান্দার মতো বলেই চলেছেন শোভন, পুরো ব্যাপারটা যেন এখনো মানতে পারছেন না বেচারা।

কামাল এবারে জোরে হেসে ফেলল। ‘ওটা কানত পড়ছে দেখিয়াই তো আপনাদের কথাবার্তা মন দিয়া শোনা শুরু করলাম। শোনেন, নীরব অরণ্য নামে পত্রিকাত লেখে কীর্তিমারীরই এক লেখক। না, লেখক কওয়া ভুল হইল, লেখিকা! কলেজত পড়ে মাত্র। আমি চিনি তারে। সুতরাং আপনার তথাকথিত বন্ধু ওই লেখক হবারই পারে না!’

বাস শোঁ শোঁ করে ছুটছে পাকা রাস্তা দিয়ে, আর দুই বন্ধু বসে আছেন থ হয়ে। মুখে কথা ফুটছে না।

কামাল ধীর গলায় বলল, ‘চিন্তা করিয়েন না। আমার বস ইন্সপেক্টর রইস স্যার নিজে গেছেন জিনিসটা দেখতে। সিকান্দার ডাকাইতও ধরা পড়বে, আপনাকও কেউ ফাঁসাবার পারবে না।’

কাওসার একটা মলিন হাসি দিলেন এতক্ষণে। কামালের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। একটা খটকা ছুটেছে ওনার। লোকটার রহস্যময় ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন তিনি। তার চোখজোড়া। কামাল আপাদমস্তক সাদাসিধে মনে হলেও তার চোখ দুটো ঝকঝকে, ক্ষুরের মতো বুদ্ধির ধার সেখানে।

অনেক প্রশ্ন করবার ছিল। শোভন কিন্তু ফেরত গেলেন তার শুরুর দিকের একটা জবাব না পাওয়া জিজ্ঞাসায়। ‘আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি স্বাধীন ব্যাংকে চাকরি করি? একবারও তো বলিনি।’

কামালের তীক্ষ্ণ চোখের গভীরে একটা ঝিলিক উঠল। ‘বলেন কি সাহেব? এতগুলা কঠিন রহস্য সমাধান কইরলাম, আর এটা কোনো ব্যাপার হইল! আপনার পিঠের ব্যাগটাত স্বাধীন ব্যাংকের লোগো লাগানো আছে বড় করিয়া!’

কামাল হো হো করে হেসে উঠল। বড় নির্মল সেই হাসি।