তিতুনি এবং তিতুনি (তৃতীয় পর্ব)

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

সকালবেলা হইচই-চেঁচামেচি শুনে তিতুনির ঘুম ভাঙল। সে ধড়মড় করে উঠে বসে এদিক-সেদিক তাকায়, মেয়েটা কোথাও নাই। তিতুনি বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে দেখল, বিছানার নিচে এবং ফ্যানের ওপরেও দেখল। সেখানেও নাই, তখন দরজার দিকে তাকাল, দরজার ছিটকিনি খোলা—তার মানে মেয়েটা ঘর থেকে বের হয়েছে। এই মেয়েটার কারণেই কি হইচই? তিতুনি কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, দরজা খোলাসংক্রান্ত একটা বিষয় নিয়ে আম্মু চিৎকার করছেন। তিতুনি তখন সাবধানে ঘর থেকে বের হলো, বাইরের ঘরে এসে উঁকি দিল।

আম্মু চিৎকার করে বলছেন, ‘এই বাসার সব দায়িত্ব আমার? দরজা খোলা রেখে সব মানুষ ঘুমিয়ে গেল? এইটা কি একটা বাসা নাকি হোটেল?’

তিতুনি পরিষ্কার করে বুঝতে পারল না, দরজা খোলার সঙ্গে হোটেলের কী সম্পর্ক। এখন সেটা নিয়ে কথা বলাটাও অবশ্যি ঠিক হবে না। দরজাটা কেন খোলা সেটাও তিতুনি বুঝতে পারল। কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগে তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটা দরজা খুলে বের হয়ে গেছে।

আম্মু বললেন, ‘কেন সবকিছু আমাকে দেখতে হবে? আমি একদিন দেখলাম না আর সবাই দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে গেল?’

আব্বুও ঘুম ঘুম চোখে উঠে এসেছেন, বললেন, ‘আমার স্পষ্ট মনে আছে দরজায় ছিটকিনি লাগানো—’

আম্মু আব্বুকে কথা শেষ করতে দিলেন না, বললেন, ‘তোমার মনে থাকলেই তো হবে না! দরজার ছিটকিনি লাগানো থাকলে সেটা খুলল কে? ভূত?’

আম্মু আরও কথা বলতে থাকলেন, তখন তিতুনি সরে এল। হাত-মুখ ধুয়ে স্কুলের ড্রেস পরতে গিয়ে আবিষ্কার করল সেটা নাই। এলিয়েন মেয়েটি সকালবেলা তার স্কুলের পোশাক পরে বের হয়ে গেছে। কী সর্বনাশ! সে কি এখন তার স্কুলে হাজির হয়ে যাবে?

তিতুনি খুঁজে তার অন্য পোশাকটা বের করে সেটা পরল। একটু ময়লা হয়ে আছে, ধোয়া দরকার, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সময় নেই।

খাবার টেবিলে সবাই যখন নাশতা খেতে বসেছে তখন আম্মু হঠাৎ করে একটুখানি হাসি এবং একটুখানি অবাক মুখ করে তিতুনিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা! তোর গত রাতে হয়েছিলটা কী?’

তিতুনির কী হয়েছিল সে জানে না। ভেতরে ভেতরে সে ভয়ানক চমকে উঠল—নিশ্চয়ই গত রাতে এলিয়েন তিতুনি কিছু একটা করেছে, যেটা সে জানে না। এটা যদি সবাই বুঝে ফেলে তাহলে বিপদ, আবার আম্মুর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে—না দিলে সেটাও বিপদ। কী করবে বুঝতে না পেরে সে মুখের মাঝে খানিকটা লজ্জা খানিকটা ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বসে রইল।

টোটন জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছিল আম্মু? তিতুনি কী করেছিল?’

আম্মু একবার তিতুনির মুখের দিকে তাকালেন, তারপর অন্যদের দিকে তাকালেন, বললেন, ‘রাতে হঠাৎ দেখি ঘরে আলো জ্বলছে, টুং টাং শব্দ। উঠে এসে দেখি ফ্রিজ খুলে খাবার বের করে তিতুনি খাচ্ছে!’

টোটন এমন একটা মুখের ভঙ্গি করল যেন খাওয়াটা একটা খুবই জঘন্য কাজ। মুখটা বিকৃত করে বলল, ‘খাচ্ছে?’

‘হ্যাঁ। সে কী খাওয়া! আমি অবাক হয়ে গেলাম—তোর হয়েছিল কী? গভীর রাতে এত খিদে লেগে গেল?’

তিতুনি কোনোমতে মুখে একটা স্বাভাবিক ভাব ধরে রেখে বলল, ‘হ্যাঁ আম্মু। রাতে হঠাৎ কেন জানি খিদে লেগে গেল!’

‘খিদে লেগেছে তো আমাকে ডেকে তুলে সেটা বল! খাবার গরম করে দিই। ঠান্ডা ভাত তরকারি যেভাবে গপ গপ করে খাওয়া শুরু করলি!’

তিতুনি কিছু বলল না। আব্বু বললেন, ‘গ্রোয়িং স্টেজ তো—এ রকম হয়। বাচ্চারা ধীরে ধীরে বড় হয় না—হঠাৎ হঠাৎ বড় হয়। তিতুনির নিশ্চয়ই সে রকম একটা স্টেজ যাচ্ছে—’

তিতুনি খুব সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিল। এলিয়েন মেয়েটা রাক্ষসের মতো খেয়ে তাকে আরেকটু হলে বিপদে ফেলে দিত!

তিতুনির স্কুলটা বাসা থেকে বেশ দূরে, বড় সড়কটা ধরে হেঁটে হেঁটে সে স্কুলে যায়। এটা মোটেও ঢাকা শহরের মতো না, বড় সড়কটায় বাস টেম্পো ট্রাক নেই। একটা-দুইটা রিকশা যায়, মাঝে মাঝে একটা মোটরসাইকেল। যদি কখনো একটা গাড়ি যায় তাহলে সবাই মাথা ঘুরিয়ে দেখে কার গাড়ি কোথায় যাচ্ছে।

তিতুনি সড়কটা ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, একটু আগে বাসা থেকে বের হয়েছে, তাই সড়কটাতে স্কুলের ছেলেমেয়ে বেশি নেই। একটু পরেই তাদের গার্লস স্কুলের মেয়ে আর সরকারি স্কুলের ছেলেদের দিয়ে সড়কটা ভরে যাবে। তিতুনি একটু অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে, সে এমন একটা ঝামেলায় মধ্যে পড়েছে যার থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তাই খোলা নেই। ছোটখাটো ঝামেলা হলে সে তার ক্লাসের বন্ধু রিতু কিংবা মাইশা কিংবা ঝিনুর সঙ্গে কথা বলতে পারত—একটু বুদ্ধি পরামর্শ নিতে পারত। কিন্তু এই সমস্যাটা এমনই জটিল যে কারও সঙ্গে সেটা নিয়ে কথাও বলতে পারছে না। কাউকে বললে সে বিশ্বাসও করবে না। এলিয়েন মেয়েটি আজকে তার স্কুলের ড্রেস পরে বের হয়ে গেছে—এখন যদি স্কুলে এসে হাজির হয় তখন কী হবে? ব্যাপারটা চিন্তা করেই তার গায়ে কেমন জানি কাঁটা দিয়ে উঠল।

ঠিক তখন তিতুনির একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। সড়কের পাশে একটা ডোবার মতো আছে, সেই ডোবার পাশে একটা বড় গাছ, গাছটা ডোবার দিকে হেলে পড়েছে। একটা বড় ডাল ডোবার মাঝামাঝি পর্যন্ত গিয়েছে, সে ডালটা থেকে আরও ডাল এমনভাবে বের হয়েছে যে দেখে মনে হয় কেউ একজন খুব আরাম করে সেখানে হেলান দিয়ে বসতে পারবে। শুধু তাই না, সেখানে বসে ডালটাকে দুলিয়ে দিলে মনে হয় সেটা দোলনার মতো দুলতে থাকবে। তিতুনি যখনই সড়কের কাছে এই ডোবা আর এই গাছটার পাশ দিয়ে গেছে তখনই সে মনে মনে ভেবেছে, ‘একদিন আমি ডালে বসে বসে দোল খাব।’ কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দিনই তার এই ডালে উঠে দোল খাওয়া হয়নি। আজকে তিতুনি দেখল, ডোবার ওপর হেলে পড়া গাছের ডালটাতে হেলান দিয়ে একটা মেয়ে বসে আছে, মেয়েটা তাদের স্কুলের ড্রেস পরে আছে, শুধু তাই না, তিতুনি যেভাবে ভেবেছিল ঠিক সেভাবে গাছের ডালটাকে দোল দিচ্ছে।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

এক মুহূর্ত পরে তিতুনি বুঝতে পারল গাছের ডালটাতে যে বসে আছে সে অন্য তিতুনি! সে এত দিন ধরে যে কাজটা করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল কিন্তু কোনো দিন করতে পারেনি, আজকে এই মেয়েটা সেই কাজটাই করে ফেলছে। তিতুনি প্রথমে আশপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ তাদের দেখছে কি না, তারপর গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, ‘এই মেয়ে।’

মেয়েটা তার দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘আমার নাম তিতুনি।’

তিতুনি হিংস্র গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। এই তিতুনি।’

মেয়েটা ঘুরে তিতুনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী হলো?’

‘তুমি এখানে কী করছ?’

‘গাছে দোল খাচ্ছি।’

‘কেন?’

‘তার কারণ হচ্ছ তুমি। তুমি সব সময় এই গাছে উঠে দোল খেতে চেয়েছ কিন্তু খাও নাই। আমার এত সময় নাই—তাই আজকেই দোল খাচ্ছি।’

‘যদি কেউ দেখে ফেলে?’

‘দেখলে দেখবে।’

তিতুনি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুমি আসলে কী চাও আমাকে বলবে?’

মেয়েটা কিছুক্ষণ গাছের ডালে বসে তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর গাছ থেকে নেমে আসতে শুরু করল। তিতুনি ভয়ে ভয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে থাকে, তার পরিচিত কেউ যদি এখন হঠাৎ করে চলে আসে তখন কী হবে?

মেয়েটা নিচে নেমে এসে বলল, ‘চলো।’

‘কোথায়?’

‘স্কুলে।’

তিতুনি ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘স্কুলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘দুজন একসাথে?’

মেয়েটা মাথা নাড়ল, ‘না, ঠিক একসাথে না, একটু আগে-পরে। তাহলে ঝামেলা কম হবে।’

‘ঝামেলা কম হবে?’ তিতুনি গরম হয়ে বলল, ‘একটা ক্লাসে দুইজন তিতুনি আর সেটা ঝামেলা কম?’

মেয়েটা ভালো মানুষের মতো হাসল, বলল, ‘তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি স্কুলের কেউ আমাদের দুইজনকে একসাথে দেখবে না। হয় তোমাকে দেখবে নাহয় আমাকে দেখবে। কখনোই বুঝবে না আমরা দুইজন আলাদা মানুষ।’

‘সেটা কেমন করে হবে?’

মেয়েটা বলল, ‘সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।’

‘তোমার ওপর ছেড়ে দিলে কী হয় সেটা আমার খুব ভালো জানা আছে। টোটন আমাদের দুইজনকে একসাথে দেখার পর কী ঝামেলা হয়েছিল মনে আছে?’

মেয়েটা বলল, ‘মনে আছে। আর সেটা আমার জন্যে হয় নাই, সেটা হয়েছে তোমার মাতবরির জন্যে।’

তিতুনি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আমার মাতবরি? আমি কী মাতবরি করেছিলাম?’

‘পুরো একটা নাটক করলে—আমাকে ফ্যানের ওপর বসে থাকতে হলো।’

‘তাহলে আমার কী করা উচিত ছিল।’

‘আমার ওপরে ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল।’

‘তাহলে তুমি কী করতে?’

‘আমি টোটনের মাথার ভেতরে ঢুকে তার নিউরন থেকে দুইজনকে একসাথে দেখার দৃশ্যটা মুছে দিতাম।’

তিতুনি মুখ হাঁ করে বলল, ‘তুমি কী করতে?’

‘বললাম তো, যেসব নিউরনে দৃশ্যটা আছে সেটা মুছে দিতাম। দুইজনকে একসাথে দেখার কোনো স্মৃতি থাকত না। কেস কমপ্লিট।’

তিতুনি মুখ হাঁ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী করতে?’

মেয়েটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এক কথা কয়বার বলব?’

তিতুনি রীতিমতো কষ্ট করে তার হাঁ হয়ে থাকা মুখটা বন্ধ করে বলল, ‘তুমি যখন ইচ্ছা যার মাথার ভেতরে ঢুকে যা খুশি তাই করতে পারো?’

মেয়েটা কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল, যেন এটা এমন কোনো ব্যাপারই না। তিতুনি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কীভাবে?’

মেয়েটা কেমন যেন হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, ‘তুমি কেন ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার মতো দেখতে হলেও শুধু তোমার মতো বোকাসোকা সাদাসিধে মানুষ না—আমি অনেকদূর গ্যালাক্সি থেকে এসেছি—অনেক উন্নত অনেক বুদ্ধিমান একটা প্রাণী—যার ক্ষমতা তুমি কিংবা তোমাদের মানুষের চৌদ্দ গুষ্টি কল্পনা করতে পারবে না—’

তিতুনি মুখ শক্ত করে বলল, ‘তুমি যে মহাবিশ্বের যত বড় লাটসাহেবই হও না কেন তুমি কিন্তু খুবই খারাপ ভাষায় কথা বলছ।’

‘সেটা আমার দোষ না—সেটা তোমার দোষ। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি তোমার ব্রেন ব্যবহার করছি, তুমি যেভাবে কথা বলো আমি সেভাবে কথা বলছি। এইগুলি আমার কথা না, এইগুলি তোমার কথা। তুমি নিজে ভদ্রভাবে কথা বলা প্র্যাকটিস করে তারপর আমাকে উপদেশ দিয়ো।’

তিতুনি বকুনিটা হজম করে বলল, ‘তোমরা কীভাবে কথা বলো?’

‘আমরা কথা বলি না।’

‘কথা বলো না? একজনের সামনে আরেকজন মুখ ভোঁতা করে বসে থাকো?’

মেয়েটা ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, ‘আমাদের মুখ নাই, তাই মুখ ভোঁতা করার উপায় নাই।’

‘মুখ নাই?’ তিতুনি রীতিমতো চিৎকার করে বলল, ‘তাহলে খাও কোন দিক দিয়ে?’

মেয়েটা বলল, ‘তোমাকে এগুলো বোঝাতে সময় লাগবে। তুমি ধরেই নিয়েছ মহাজাগতিক প্রাণীদেরও তোমাদের মতো হাত পা মুখ থাকতে হবে, খেতে হবে, কথা বলতে হবে। সেটা সত্যি নয়। হাত পা মুখ ছাড়াও প্রাণী হওয়া সম্ভব। তোমাদের সাথে মহাজাগতিক প্রাণীর শুধু একটা জায়গায় মিল আছে।’

‘সেটা কী?’

‘তোমরা নতুন জিনিস জানতে চাও। আমরাও চাই।’

তিতুনি মুখ শক্ত করে বলল, ‘সরি।’

মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, ‘সরি?’

‘হ্যাঁ, আমার নতুন জিনিস জানার কোনো ইচ্ছা নাই। কেন আমার অ্যালজেবরা শিখতে হবে? বাংলা ব্যাকরণ শিখতে হবে? তেলাপোকা কীভাবে খাবার হজম করে জেনে আমার কী লাভ?’

মেয়েটা আবার হেসে ফেলল, বলল, ‘আমি জানি। কিন্তু তোমাদের পৃথিবীর বোকাসোকা মানুষেরা যে এ পর্যন্ত টিকে আছে তার কারণ হচ্ছে মানুষ নতুন জিনিস জানতে চায়।’

‘আমি চাই না।’

‘চাও। তাই একটু পরে পরে আমার কাছে আমাদের সম্পর্কে জানতে চাইছ। আমরা কীভাবে কথা বলি। কীভাবে খাই।’

তিতুনি মুখ শক্ত করে বলল, ‘সেটা অন্য কথা।’

‘অন্য কথা না, একই কথা।’

হঠাৎ করে তিতুনি কেমন যেন আতঙ্কে জমে গেল, বলল, ‘সর্বনাশ।’

‘কী হয়েছে?’

‘মাহতাব চাচা।’

মেয়েটা সামনে তাকাল, দেখল আব্বুর দূরসম্পর্কের ভাই মাহতাব চাচা বগলে একটা ছাতা আর হাতে একটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে সড়ক ধরে আসছেন। তিতুনি শুকনো গলায় বলল, ‘এখন কী হবে?’

মেয়েটা বলল, ‘আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি যা বলব তুমি ঠিক তাই করবে।’

‘ঠিক আছে।’

দুজনে হেঁটে যেতে লাগল, মাহতাব চাচা আরেকটু কাছে আসার পর হঠাৎ মেয়েটা বলল, ‘এখন।’

‘এখন কী?’

‘তুমি নিচু হয়ে ভান করো তোমার জুতার ফিতে খুলে গেছে, সেটা বাঁধার চেষ্টা করো। মাথাটা নিচু করে রেখো যেন তোমার চেহারা দেখতে না পায়।’

তিতুনি মাথা নিচু করে জুতার ফিতা বাঁধার ভান করতে লাগল আর মাহতাব চাচা কাছে এসে দাঁড়ালেন। মেয়েটা বলল, ‘স্লামালেকুম চাচা।’

‘ওয়ালাইকুম সালাম তিতুনি। স্কুলে যাচ্ছিস?’

‘জি চাচা।’

‘স্কুলে লেখাপড়া হয়?’

মেয়েটা তিতুনির মতো হি হি করে হাসল, বলল, ‘মাঝে মাঝে!’

‘আজকালকার লেখাপড়ার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝি না। তোর বাবা ভালো আছে?’

‘আছে।’

‘মা? টোটন?’

‘আছে। সবাই ভালো আছে।’

‘ঠিক আছে। স্কুলে যা।’ বলে মাহতাব চাচা তাদের পেছনে ফেলে হেঁটে গেলেন।

তিতুনি তখন উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা রাজ্য জয় করার ভঙ্গি করে তিতুনিকে বলল, ‘দেখলে, কোনো সমস্যা হয়েছে?’

তিতুনি চাপা গলায় বলল, ‘মাহতাব চাচা আমার চেহারা দেখেন নাই সে জন্যে। এখানে তোমার কোনো ক্রেডিট নাই।’

‘দেখলেও কোনো সমস্যা ছিল না—’ মেয়েটার কথা প্রমাণ করার জন্যই কি না কে জানে হঠাৎ করে পেছন থেকে মাহতাব চাচা ডাকলেন, ‘এই তিতুনি! একটু দাঁড়া।’

তিতুনি এবং তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়ে দুজনেই দাঁড়াল। তিতুনি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘এখন? এখন কী করব?’

মেয়েটা বলল, ‘কিছুই করতে হবে না।’

মাহতাব চাচা লম্বা পা ফেলে এসে তিতুনিকে বললেন, ‘একটা কথা বলতে ভুলে গেছি! তোর বাবাকে বলিস—’

মাহতাব চাচা হঠাৎ করে থেমে গেলেন, তিতুনির পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি তার চোখে পড়েছে আর কেমন যেন ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। আমতা আমতা করে বললেন, ‘এ-এ-এইটা কে?’

‘কোনটা?’ প্রশ্নটা খুবই বোকার মতো হয়ে গেল কিন্তু তিতুনি আর কী করবে বুঝতে পারল না।

মাহতাব চাচা তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘দু-দু-দু-দুইটা তিতুনি?’

তিতুনি মাথা নাড়ল, ‘জি চাচা। দুইটা।’

‘দুইটা কেমন করে হয়?’ মাহতাব চাচার মুখটা কেমন যেন হাঁ হয়ে গেল। মাছের মতো কেমন যেন খাবি খেলেন। তিতুনি মাথা চুলকে বলল, ‘আমিও ঠিক জানি না চাচা।’

মাহতাব চাচা হঠাৎ কেমন যেন মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। তিতুনি খপ করে মাহতাব চাচার হাতটা ধরে ফেলল, ডাকল, ‘মাহতাব চাচা!’

মাহতাব চাচা কোনো উত্তর না দিয়ে কেমন যেন ঘোলা চোখে তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, ‘আমি সরে যাই। স্মৃতি মুছে দিয়েছি—’

মেয়েটি ঘুরে জোরে জোরে পা ফেলে স্কুলের দিকে যেতে শুরু করল আর মাহতাব চাচা হঠাৎ কেমন করে জানি জেগে উঠলেন, তিতুনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তিতুনি? স্কুলে যাচ্ছিস?’

বোঝাই যাচ্ছে তার আগের কথা কিছু মনে নেই।

তিতুনি শুকনো মুখে বলল, ‘জি চাচা।’

‘স্কুলে লেখাপড়া হয়?’

তিতুনি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘মাঝে মাঝে।’ মাহতাব চাচা মাথা নেড়ে বললেন, ‘আজকালকার লেখাপড়ার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝি না।’

তিতুনি মাথা নাড়ল, ‘আমিও বুঝি না।’

‘তোর বাবা ভালো আছে।’

‘আছে।’

‘মা? টোটন?’

‘আছে। সবাই ভালো আছে।’

তিতুনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মাহতাব চাচা আব্বুকে কিছু একটা বলার জন্য ফিরে এসেছিলেন, সেটা শুনে নেওয়া যাক। মাহতাব চাচা অবশ্যি কিছু বললেন না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তিতুনি জিজ্ঞেস করল, ‘মাহতাব চাচা। আব্বুকে কিছু একটা বলতে হবে?’

মাহতাব চাচা মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। তোর বাবাকে বলবি—’ বলে মাহতাব চাচা দাঁড়িয়ে মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। খানিকক্ষণ চেষ্টা করলেন কিন্তু মনে করতে পারলেন না। মেয়েটা মাহতাব চাচার স্মৃতি থেকে ওই কথাটাও মুছে দিয়েছে!

মাহতাব চাচা কেমন যেন বোকার মতো একটু হেসে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! মনে করতে পারছি না।’ তারপর তিতুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিন্তু তুই কেমন করে বুঝতে পারলি তোর বাবাকে একটা কথা বলতে চাইছি?’

তিতুনি কাঁধ ঝাঁকাল, বলল, ‘জানি না! কেন জানি মনে হলো!’

মাহতাব চাচা কথাটা শুনে খুব অবাক হলেন বলে মনে হলো না। হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন। তিতুনিও একটা বড় নিশ্বাস ফেলে স্কুলের দিকে হাঁটতে লাগল। সে সামনে তাকাল, তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটি হনহন করে স্কুলের দিকে যাচ্ছে। মেয়েটা আসলেই একজনের মাথার ভেতরে ঢুকে তার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে। কী আশ্চর্য! মুছতে যখন পারে তাহলে কি উল্টোটা সম্ভব? কারও মস্তিষ্কে কি স্মৃতি লিখে দিতে পারবে? অ্যালজেবরা কিংবা বাংলা ব্যাকরণ কিংবা তেলাপোকার পাচক প্রণালি কী মেয়েটা তার মগজে লিখে দিতে পারবে? তাহলে আর কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হবে না!

স্কুলে গিয়ে তিতুনি ক্লাসে তার ব্যাগটা রেখে বের হয়ে এল। সাধারণত সে সামনের দিকে বসে, কী ভেবে সে আজকে সবচেয়ে পেছনে তার স্কুলের ব্যাগ রাখল। স্কুলে এখনো সব মেয়ে আসেনি—তিতুনি চোখের কোনা দিয়ে অন্য তিতুনিকে খুঁজতে থাকে। তাদের দুজনকে একসাথে কেউ দেখে ফেলবে আর তখন সেটা নিয়ে মহা কেলেঙ্কারি শুরু হয়ে যাবে, সেটা নিয়ে এখন আর তার ভেতরে কোনো রকম আতঙ্ক নেই।

তিতুনি স্কুলের বারান্দায় এসে ডানে-বাঁয়ে তাকাল। তখন দেখল বারান্দার অন্য মাথা থেকে অন্য তিতুনি হনহন করে হেঁটে আসছে। মুখটা খুবই গম্ভীর!

তিতুনি দাঁড়িয়ে রইল আর অন্য তিতুনি কাছাকাছি এসে নিচু গলায় বলল, ‘সর্বনাশ হয়েছে।’

‘কী সর্বনাশ?’

মেয়েটা ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে বলা যাবে না।’

‘কোথায় বলবে?’

‘লাইব্রেরিতে যাও। আমিও যাচ্ছি।’

তিতুনি মাথা নাড়ল, লাইব্রেরিটাই ভালো জায়গা। তাদের স্কুলে কীভাবে কীভাবে জানি একটা বেশ সুন্দর আর বড় লাইব্রেরি আছে, সেই লাইব্রেরিটা ফাঁকাই থাকে, পেছনে বসে নিরিবিলি কথা বলা যাবে। তিতুনি হেঁটে হেঁটে লাইব্রেরিতে গিয়ে পেছনের দিকে একটা বইয়ের আলমারির পেছনে বসে পড়ল। কী সর্বনাশ হয়েছে সেটা চিন্তা করে তার বুকটা ধুঁকপুঁক করছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্য তিতুনি এসে তার সামনে বসে এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘মাহতাব চাচার স্মৃতি মুছে দিয়েছি মনে আছে?’

‘হ্যাঁ। মাহতাব চাচার কিছু মনে নাই।’ তিতুনি তখনো বুঝতে পারল না ঠিক কোন ব্যাপারটা সর্বনাশ।

‘মাহতাব চাচা আব্বুকে একটা জিনিস বলতে চেয়েছিলেন মনে আছে!’

‘হ্যাঁ।’ তিতুনি মাথা নাড়ল, ‘মাহতাব চাচা সেটা মনে করতে পারে নাই। সেটাও ভুলে গেছে।’

তিতুনির মতো দেখতে মেয়েটা মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘আমি যখন স্মৃতি মুছে দিচ্ছিলাম তখন সেটা মুছে গেছে।’

তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, ‘আমারও তা-ই মনে হচ্ছিল।’

‘কত বড় সর্বনাশ!’

তিতুনি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোন জিনিসটা সর্বনাশ?’

‘এই যে আমি অন্য একটা স্মৃতি মুছে দিলাম—’

‘সর্বনাশের কী আছে? আমরা সব সময় এইটা-সেইটা ভুলে যাই। সবকিছু মনে রাখার উপায় আছে?’

মেয়েটা কঠিন মুখ করে বলল, ‘তোমরা ভুলে যাও সেটা তোমাদের ব্যাপার, কিন্তু আমাদের একটা নিয়ম মানতে হয়।’

‘নিয়ম?’

‘হ্যাঁ। খুবই কঠিন একটা নিয়ম। আমরা যখন কোনো গ্রহে যাই, সেই গ্রহটাতে যদি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে তাহলে সেই গ্রহের কোনো কিছু আমরা পরিবর্তন করি না। কিন্তু আমি পরিবর্তন করে ফেলেছি। যেটুকু মোছা দরকার তার থেকে বেশি মুছে ফেলেছি। আমরা যে সেই গ্রহে গিয়েছি, সেটা গ্রহের একটা প্রাণীও জানতে পারে না।’

‘আমি যে জানলাম?’

‘সেটা সাময়িক।’

‘সাময়িক মানে?’

মেয়েটা বলল, সাময়িক মানে হচ্ছে আমি যাওয়ার সময় তোমার সব স্মৃতি মুছে দিয়ে যাব।’

তিতুনি চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কী বললে?’

‘কী বলেছি তুমি শুনেছ।’

তিতুনি হিংস্র চোখে বলল, ‘তুমি খালি চেষ্টা করে দেখো। আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।’

তিতুনি খুন করে ফেলবে শুনেও মেয়েটা খুব ঘাবড়ে গেল মনে হলো না, বলল, ‘সেটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু এখন কী করি বলো দেখি? আমি যে মাহতাব চাচার নিজস্ব কিছু স্মৃতি মুছে ফেললাম। এত বড় একটা নিয়ম ভেঙে ফেললাম—’

তিতুনি বলল, ‘তোমার নিয়মের খ্যাতা পুড়ি। আমার উল্টো একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। ফাটাফাটি মারামারি কাটাকাটি আইডিয়া।’

‘কী আইডিয়া?’ অন্য তিতুনি বলল, ‘আমি ইচ্ছে করলে তোমার মাথায় ঢুকে দেখতে পারি।’

তিতুনি চোখ কাঁপিয়ে বলল, খবরদার, তুমি আমার মাথায় ঢুকবে না। খবরদার।’

‘তাহলে বলো।’

‘আজকে ফার্স্ট পিরিয়ড ফাক্কু স্যারের ক্লাস। ফাক্কু মানে হচ্ছে ফখরুল—’

‘জানি।’

‘ফাক্কু স্যার হোমওয়ার্ক দিয়েছে। আজকে জমা দেওয়ার কথা।’

‘জানি।’

‘আমি হোমওয়ার্ক করি নাই। করতে ভুলে গেছি, তুমি এসে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে—’

‘জানি।’

‘হোমওয়ার্ক না আনলে ফাক্কু স্যার মারে।’

‘জানি।’

‘খপ করে চুলটা ধরে ফেলে। এমনি করে ঝাঁকুনি দেয়।’ তিতুনি হাত দিয়ে দেখাল। ‘গত মাসে ফারিয়ার চুল ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বেঞ্চে মেরেছে, নাকটা বোঁচা হয়ে গেছে।’

‘জানি।’

‘ফারিয়ার নাকটা অবশ্যি আগে থেকেই একটু বোঁচা।’

‘জানি।’

‘তাই আমি বলছিলাম ফাক্কু স্যারের ক্লাসে গিয়ে তুমি তার মাথার মাঝে ঢুকবে। ঢুকে সে যে হোমওয়ার্ক দিয়েছে সেটা ভুলিয়ে দেবে।’

অন্য তিতুনি মুখটা শক্ত করে বলল, ‘অসম্ভব।’

‘অসম্ভব?’

‘হ্যাঁ। তোমাদের পৃথিবীর কোনো কিছু আমাদের পরিবর্তন করার কথা না।’

তিতুনি গরম হয়ে বলল, ‘এই রকম বড় বড় বোলচাল করা বন্ধ করো। আমাদের পৃথিবীতে এসেছ, পৃথিবীর নিয়ম মেনে চলো।’

‘পৃথিবীর নিয়ম?’

‘হ্যাঁ। পৃথিবীর নিয়ম হচ্ছে বদ মানুষকে সাইজ করা। ফাক্কু স্যার হচ্ছে বদ নাম্বার ওয়ান। কাজেই তাকে সাইজ করা দরকার।’

অন্য তিতুনি মুখটা আরও শক্ত করে বলল, ‘অসম্ভব।’

‘তুমি করবে না? শুধু ছোট একটা জিনিস তাকে ভুলিয়ে দেবে না?’

‘না।’

তিতুনির এমন রাগ উঠল সেটা আর বলার মতো না। কিন্তু রাগ করে তো আর লাভ নেই, তাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিক আছে তুমি তাহলে ফাক্কু স্যারের ক্লাসে যাও। আমি যাচ্ছি না।’

‘তুমি কী করবে?’

‘আমি এইখানে বসে থাকব।’

অন্য তিতুনি রাজি হয়ে গেল, বলল, ‘ঠিক আছে।’

‘যখন দেখবে তুমি হোমওয়ার্ক আনো নাই, তখন তোমার চুলগুলো খপ করে ধরে যখন ডেস্কের মাঝে তোমার নাকটা থেঁতলে দেবে, তখন আমার কাছে নালিশ করতে এসো না।’

অন্য তিতুনি কোনো কথা বলল না, তিতুনি বলল, ‘আমি ক্লাসে সবার পেছনে বসেছি। আমার ব্যাগটা খুঁজে বের করতে পারবে তো?’

অন্য তিতুনি মাথা নাড়ল। জানাল, সে পারবে।

ফাক্কু স্যারের ক্লাসটা ঠিক যেভাবে শুরু হওয়ার কথা সেভাবে শুরু হলো। ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ফাক্কু স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। হাতে চক, ডাস্টারের সঙ্গে সঙ্গে রেজিস্টার খাতা, বই, কলম আর একটা রুলার। যে কেউ মনে করতে পারে ক্লাসে পড়ানোর জন্য একজন স্যার এগুলো তো আনতেই পারে, আসলে ব্যাপারটা মোটেই সে রকম না। এর সবগুলো হচ্ছে ক্লাসের মেয়েদের শাস্তি দেওয়ার অস্ত্র। তখনো বেত নিয়ে ক্লাসে আসতেন, সরকার বেত মারা বেআইনি করে দেওয়ার পর প্রথম প্রথম ফাক্কু স্যারের খুব মন খারাপ ছিল, তারপর আস্তে আস্তে শাস্তি দেওয়ার এই অস্ত্রগুলো আবিষ্কার করেছেন। যেমন চক কিংবা কলম দুই আঙুলের মাঝখানে রেখে আঙুল দুটো চেপে ধরা ফাক্কু স্যারের খুবই প্রিয় শাস্তি। বই আর রেজিস্টার খাতা দিয়ে ধরাম করে মাথার মাঝে মারা তার আরেকটা প্রিয় শাস্তি। দূর থেকে কাউকে শাস্তি দিতে চাইলে ডাস্টারটা ক্রিকেট বলের মতো ছুড়ে মারেন। পুরোনো দিনের মতো বেত মারার ইচ্ছা করলে স্টিলের রুলারটা দিয়ে হাতের মাঝে মারেন। ফাক্কু স্যারের সবচেয়ে প্রিয় শাস্তি হচ্ছে খাড়া করে চুলগুলো ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ডেস্কের মাঝে মাথাটা ঠুকে দেওয়া। স্যারকে প্রমোশন দিয়ে ছেলেদের স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, স্যার রাজি হননি। তার আসল কারণ হচ্ছে ছেলেদের মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা থাকে বলে খপ করে ধরা যায় না। মেয়েদের চুল এভাবে ধরা সোজা।

ক্লাসে ঢুকেই স্যার সবাইকে একনজর দেখে মুখে একটু লোল টানলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোরা সবাই হোমওয়ার্ক এনেছিস?’

ক্লাসের প্রায় সবাই মাথা নাড়ল, কেউ মুখে কোনো কথা বলল না। যারা হোমওয়ার্ক আনেনি শুধু তাদের চেহারা কেমন যেন রক্তশূন্য হয়ে গেল। ফাক্কু স্যার কেমন যেন ক্ষুধার্ত বাঘের মতো সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কারা কারা হোমওয়ার্ক আনিসনি?’

পাঁচজন খুব ধীরে ধীরে হাত তুলল। তাদের চেহারা দেখে মনে হলো তাদের শরীরে এক ফোঁটা রক্ত নেই। ফাক্কু স্যার মুখে একটা হিংস্র হাসি ফুটিয়ে কাছাকাছি মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলেন, নাগালের মাঝে চলে আসতেই খপ করে মেয়েটার চুল ধরে ফেললেন, মেয়েটা একটা আর্তচিৎকার করল। ফাক্কু স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কেন হোমওয়ার্ক আনিসনি?’

‘শরীর খারাপ ছিল স্যার। জ্বর আর মাথাব্যথা।’

ফাক্কু স্যার চুল ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, মাথাটা টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলি? তাহলে তো আর মাথাব্যথা থাকবে না?’

মনে হলো মেয়েটা সত্যি সত্যি ভাবল ফাক্কু স্যার তার মাথাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলবেন। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘না স্যার। না স্যার! প্লিজ স্যার। প্লিজ স্যার।’

ফাক্কু স্যার বড় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে পরের মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলেন। মুখে লোল টেনে বললেন, ‘তুই কেন হোমওয়ার্ক করিসনি?’

‘করেছি স্যার, খাতাটা আনতে ভুলে গেছি।’

ফাক্কু স্যার খপ করে মেয়েটার চুল ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ‘শুধু যে হোমওয়ার্ক আনিসনি তা না, আবার আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা?’

মেয়েটা প্রায় হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, ‘না স্যার, সত্যি স্যার। সত্যি হোমওয়ার্ক করেছি স্যার।’

ফাক্কু স্যার গর্জন করে বললেন, ‘আবার মিথ্যা কথা?’ তারপর চুলের মুঠি ধরে মেয়েটার মাথাটা প্রচণ্ড জোরে ডেস্কে মেরে বসলেন। খটাশ করে এত জোরে শব্দ হলো যে মনে হলো মেয়েটার মাথাটা বুঝি দুই টুকরো হয়ে ভেতরের মগজ বের হয়ে এসেছে।

ক্লাসের সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল আর ফাক্কু স্যার তখন তিন নম্বর মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেলেন। এতক্ষণে এই মেয়েটি বুঝে গেছে যে শুধু শুধু কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে লাভ নেই, তাতে শাস্তিটা বরং আরও বেশি হতে পারে, তাই সে একেবারে সরাসরি সারেন্ডার করে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে স্যার। আর কখনো ভুল হবে না!’

ফাক্কু স্যার তার চুলের ঝুঁটি ধরে তাকে টেনে মেঝে থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে তুলে নিয়ে বললেন, ‘ভুল? আর যদি ভুল হয় তাহলে তোর মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলব।’

মেয়েটা কোনোমতে বলল, ‘আর ভুল হবে না স্যার।’

চতুর্থ মেয়েটির কাছে যাওয়ার আগেই মেয়েটি ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে কাঁদতে শুরু করেছে। ফাক্কু স্যার তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলল, ‘মাফ করে দেন স্যার। মাফ করে দেন।’

‘কী জন্য মাফ করব? চুরি করেছিস, নাকি কারও পকেট মেরেছিস?’

‘না স্যার!’ মেয়েটা ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘হোমওয়ার্ক আনি নাই স্যার।’

ফাক্কু স্যার খুবই অবাক হয়েছেন সে রকম ভান করে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! হোমওয়ার্ক আনিস নাই বলে এত কান্না।’ তারপর খপ করে মেয়েটার চুল ধরে হঠাৎ করে মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘কান্না বন্ধ করবি কিনা বল। না হলে চোখ দুটো খাবলে বের করে নেব।’

ভয়ে মেয়েটার কান্না বন্ধ হয়ে গেল, শুধু হেঁচকি উঠতে লাগল। ফাক্কু স্যার চুল ধরে মাথাটা ডানে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে এক পাক ঘুরিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলেন আর সে একেবারে পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সেটা দেখে ফাক্কু স্যার খুবই তৃপ্তির একটা শব্দ করে বললেন, ‘আর কে যেন হোমওয়ার্ক আনে নাই?’

একেবারে পেছনে বসে থাকা তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটি হাত তুলে বলল, ‘আমি স্যার!’

গলার স্বরে ভয়ভীতি আতঙ্ক কিছু নেই দেখে ফাক্কু স্যার খুব অবাক হয়ে অন্য তিতুনির দিকে তাকালেন, বললেন, ‘তুই হোমওয়ার্ক আনিসনি?’

‘স্যার’ এবারও গলায় স্বর বেশ স্বাভাবিক, প্রায় হাসিখুশি বলা যায়।

ফাক্কু স্যারের মুখটা দেখতে দেখতে কেমন যেন হিংস্র হায়েনা কিংবা বেজির মতো হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, ‘কেন আনিসনি?’

অন্য তিতুনি খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কেন আনিনি সেটার ইতিহাস খুবই জটিল। আপনাকে সেটা বললে আপনি বুঝবেন বলে মনে হয় না।’

মেয়েটার কথা শুনে ফাক্কু স্যার যত অবাক হলো ক্লাসের মেয়েরা তার থেকে অনেক বেশি অবাক হয়ে তিতুনির দিকে তাকাল। বলে কী মেয়েটা, তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ফাক্কু স্যার নাক দিয়ে বড় একটা নিশ্বাস ফেলে ক্লাসের পেছনের দিকে এগোতে লাগলেন, মুখে বললেন, ‘তুই কী বললি? আমি বুঝব বলে মনে হয় না?’

অন্য তিতুনি বল, ‘না স্যার।’

‘একবার বলেই দেখ আমি বুঝি কি না।’

‘কোনো লাভ নাই স্যার। আমার মনে হয়—’

‘কী মনে হয়?’

‘অন্যদের যে রকম শাস্তি দিয়েছেন, আমাকেও দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলেন।’

ফাক্কু স্যার কেমন যেন হাঁ হয়ে গেলেন। একবার খাবি খেয়ে বললেন, ‘ঝামেলা চুকিয়ে ফেলব?’

মেয়েটা মাথা নাড়ল, ‘জি স্যার।’

শিকার ধরার আগে বাঘ যে রকম এক পা এক পা করে আগায় ফাক্কু স্যার ঠিক সে রকম এক পা এক পা করে তিতুনির মতো মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে খপ করে তার চুলগুলো ধরলেন। তারপর একটা ঝাঁকুনি দিতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন তার ঘাড়টা লোহার মতো শক্ত, ঝাঁকুনি দিয়ে একবিন্দু নাড়াতে পারলেন না। ফাক্কু স্যার চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে আবার খাবলা দিয়ে আরও ভালো করে চুলগুলো শক্ত করে ধরে আরও জোরে একটা ঝাঁকুনি দেওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু মেয়েটার মাথাটা এক বিন্দু নাড়াতে পারলেন না, মনে হলো ঘাড়টা বুঝি কংক্রিট দিয়ে তৈরি।

ফাক্কু স্যার আরও কয়েকবার ঝাঁকুনি দেওয়ার চেষ্টা করে চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে ক্ষিপ্ত চোখে মেয়েটার দিকে তাকালেন। মেয়েটা হাসি হাসি মুখে বলল, ‘আমার শাস্তি শেষ স্যার?’

ফাক্কু স্যার বললেন, ‘তুই তুই তুই।’

ফাক্কু স্যারের কথা শেষ হওয়ার জন্য মেয়েটা অপেক্ষা করতে লাগল কিন্তু ফাক্কু স্যার কথা শেষ করতে পারলেন না। মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, ‘আর কিছু বলবেন স্যার?’

ফাক্কু স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, ‘তোকে আজকে খুন করে ফেলব। পিটিয়ে তক্তা করে দেব। বেয়াদব মেয়ে—আমার সাথে টিটকারি?’

তারপর ফাক্কু স্যার পিটিয়ে তক্তা করার জন্য ক্লাসের সামনে টেবিলের ওপর থেকে স্টিলের রুলারটা হাতে নিলেন, তারপর সেটা ঘোরাতে ঘোরাতে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ক্লাসের পেছনে অন্য তিতুনির দিকে এগোতে লাগলেন।

ক্লাসের সব মেয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে লাগল। ফাক্কু স্যার রুলারটা তরবারির মতো ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ করে মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন, তাঁকে দেখে মনে হলো কী করছেন কোথায় যাচ্ছেন হঠাৎ করে ভুলে গেছেন। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, দেখে মনে হতে লাগল যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে গেছেন। তারপর হঠাৎ করে যেন জেগে উঠলেন, জেগে উঠে হাতে ধরে রাখা স্টিলের রুলারটা অনিশ্চিতের মতো ঘোরাতে লাগলেন এবং এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলেন। দেখে বোঝা যাচ্ছে ফাক্কু স্যার কী করছেন নিজেই ভালো করে জানেন না।

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে স্টিলের রুলারটা ঘোরাতে লাগলেন, ঘোরাতে ঘোরাতে একসময় হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ল, তখন আবার তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটির দিকে তাকালেন আর তার চোখ দুটি ধক করে জ্বলে উঠল। হিংস্র গলায় বললেন, ‘তোকে আমি খুন করে ফেলব।’

তারপর নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তক অম খন কর ফলব।’ বলেই কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। কী বললেন স্যার?

ফাক্কু স্যার আবার বলার চেষ্টা করলেন, সবাই শুনল স্যার বললেন, ‘তক অম খন কর ফলব।’ নিশ্চিতভাবেই বলার চেষ্টা করছেন ‘তোকে আমি খুন করে ফেলব’, কিন্তু বলছেন অন্যভাবে।

তিতুনির মতো মেয়েটাকে খুন করে ফেলার কাজটা আপাতত বন্ধ করে ফাক্কু স্যার ঠিক করে কথা বলার চেষ্টা করলেন, বিড়বিড় করে বললেন, ‘ক হল অমর? অম ঠক কর কথ বলত পরছ ন কন?’

ক্লাসের মেয়েদের ভেতর অবাক হওয়ার বিষয়টা শেষ হয়ে হঠাৎ করে একধরনের মজা পাওয়ার বিষয়টা শুরু হলো। কে যেন খুক খুক করে হেসে উঠল। হাসি ব্যাপারটা সংক্রামক এবং হঠাৎ করেই অনেকে খুক খুক করে হাসতে শুরু করল। ফাক্কু স্যার ক্লাসের দিকে তাকালেন এবং হুংকার দিয়ে বললেন, ‘খবরদর! চপ কর সবই।’

যদিও কথার উচ্চারণ বিচিত্র কিন্তু সবাই বুঝল, ফাক্কু স্যার সবাইকে চুপ করতে বলছেন, তাই আপাতত তারা হাসি থামিয়ে আর কী মজা হয় সেটা দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। স্যার একবার ঢোঁক গিললেন তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ‘হল। হল হল মক্রফন টস্টং। ওন ট থ্র ফর ফভ—’

মাইক টেস্ট করার সময় যেভাবে বলে, ‘হ্যালো। হ্যালো হ্যালো মাইক্রোফন টেস্টিং। ওয়ান টু থ্রি ফোর ফাইভ’ ঠিক সেভাবেই ফাক্কু স্যার তার কথা বলার সিস্টেম টেস্ট করে দেখছেন, কাজ হচ্ছে না।

ফাক্কু স্যার ক্লাসের দিকে তাকালেন, ফ্যাকাশে মুখে বললেন ‘ক হল অমর?’

অন্য তিতুনি হাসি হাসি মুখে বলল, ‘স্যার, আপনি আকার উকার একার ব্যবহার না করে কথা বলার চেষ্টা করছেন।’

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

স্যার ফ্যাকাশে মুখে মাথা নাড়লেন। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল যে সবকিছু জানে সে বলল, ‘স্যার আপনার মনে হয় ব্রেনস্ট্রোক করেছে।’

ফাক্কু স্যার চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘ব্রন র্স্টক?’

‘জি স্যার। ব্রেনস্ট্রোক হয়ে ব্রেনের যে জায়গায় আকার উকার একার আছে সেটা ড্যামেজ হয়ে গেছে। তাই আকার উকার একার বলতে পারছেন না।’

ফাক্কু স্যারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, স্যার বললেন, ‘তই কমন কর জনস?’ কারও বুঝতে সমস্যা হলো না স্যার বলেছেন ‘তুই কেমন করে জানিস?’

মেয়েটা উত্তর দেওয়ার আগেই অন্যরা বলল, ‘ওর আব্বু ডাক্তার।’

ডাক্তারের মেয়ে নিশ্চয়ই অর্ধেক ডাক্তার হবে, তাই ফাক্কু স্যার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওখন ক হব?’ অর্থাৎ ‘এখন কী হবে?’

ডাক্তারের মেয়ে মাথা চুলকাতে থাকে, এখন কী হবে সে জানে না। তখন অন্য তিতুনি বলল, ‘স্যার, আপনাকে আবার নতুন করে শিখতে হবে।’

ফাক্কু স্যার মুখ কালো করে বললেন, ‘নতন কর শখত হব?’

‘জি স্যার, প্রথমে আকার বলা প্র্যাকটিস করেন।

তারপর ইকার, তারপর ওকার এভাবে। আস্তে আস্তে শিখতে হবে।’

ফাক্কু স্যার একটু আগে স্টিলের রুলার দিয়ে পিটিয়ে অন্য তিতুনিকে খুন করে ফেলতে চেয়েছিলেন। ঠিক করে কথা বলতে না পারার এই ভয়াবহ বিপদে পড়ে এখন সেসব ভুলে গেছেন। যে যেই পরামর্শ দেবে সেটাই মেনে নিতে রাজি! অন্য তিতুনির পরামর্শ খুব আগ্রহ নিয়ে শুনলেন।

অন্য তিতুনি বলল, ‘জি স্যার, একটা কবিতা আবৃত্তি করার চেষ্টা করেন। সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি—কবিতাটা আপনি জানেন স্যার?’

ফাক্কু স্যার মাথা নেড়ে জানালেন যে কবিতাটি জানেন। তিতুনি বলল, ‘তাহলে আপনি এখন প্রথমে এটাকে বলবেন, এভাবে—

সকল উঠয় অম মন মন বল

সরদন অম যন ভল হয় চল

তারপর এর সঙ্গে আকার লাগিয়ে বলার চেষ্টা করবেন।

তখন এটা হবে

সাকালা আঠায়া আমা মানা মানা বালা

সারাদান আমা যানা ভালা হায়া চালা—

যখন আকার প্র্যাকটিস হয়ে যাবে তখন ইকার লাগাবেন।

তখন বলবেন:

সিকিলি ইঠিয়ি ইমি মিনি মিনি বিলি

সিরিদিন ইমি যিনি ভিলি হিয়ি চিলি।

যখন এইটা প্র্যাকটিস হবে তখন—’

ফাক্কু স্যার হাত তুলে অন্য তিতুনিকে থামালেন, বললেন, ‘বঝছ। অম বঝছ।’ অর্থাৎ বুঝেছি। আমি বুঝেছি।

একটু পরে দেখা গেল ফাক্কু স্যার চেয়ারে গুটিসুটি হয়ে বিড়বিড় করে কবিতা বলার চেষ্টা করছেন।

ক্লাস শেষ হওয়ার আগে ক্লাসের বেশির ভাগ মেয়েই আকার ইকার ছাড়া কথা বলতে এবং সেই কথা বুঝতে শিখে গেল।

স্কুল ছুটির পর আসল তিতুনি যখন বাসায় ফিরে যাচ্ছে তখন তাদের ক্লাসের একদল মেয়ে ছুটে এসে তাকে ধরে বলল, ‘ততন, ও ততন!’

তিতুনি অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলছিস তুই?’

মেয়েটি হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, ‘অম বলছ অজক ক মজ হল, তই ন?’

তিতুনি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল অন্য তিতুনি ক্লাসে নিশ্চয়ই কোনো একটা অঘটন ঘটিয়েছে! কী অঘটন ঘটিয়েছে এখন জানার উপায় নেই, কিন্তু যেটাই ঘটে থাকুক সেটা নিশ্চয়ই খুবই মজার। তা না হলে সবাই এই বিচিত্র ভাষায় কথা বলছে কেন?

মেয়েটা বলল, ‘ক হল? তই কথ বলস ন কন?’

তিতুনি বলল, ‘বলছ। অম কথ বলছ!’

তারপর দুজনে মিলে হি হি করে হাসতে লাগল। শুধু তিতুনি তখনো জানে না সে কেন হাসছে।

আরও পড়ুন