হারানো পাণ্ডুলিপি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

শেষ বিস্কুটটা চিবিয়ে গিলে নিতেই পরপর দুবার গাড়ির হর্ন শুনতে পেল দীপ্র চৌধুরী। কোনোরকমে পানির গ্লাসে চুমুক দিয়েই ছুট লাগাল ও সদর দরজার দিকে।

রওনা হওয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে তৈরি আলেকজান্ডার উইলসন।

দিন পনেরোর ছুটি নিয়ে নিজ দেশে গিয়েছিল দীপ্রদের ব্রিটিশ শোফার; দুদিন হলো, ফিরেছে ইংল্যান্ড থেকে।

ফোর্ড সিড্যানের পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদেহী ইংরেজ যুবক। মুখে অনাবিল হাসি। নেভি ব্লেজার আর ধূসর টার্টলনেকে দারুণ দেখাচ্ছে ওকে।

‘গুড মর্নিং, দীপ্র ভাইয়া,’ বলল সে উষ্ণ হেসে।

‘গুড মর্নিং, উইলসন ভাই,’ হাসি ছড়িয়ে পড়ল দীপ্রর ঠোঁটেও।

‘তো, রেডি আপনি?’

‘হ্যাঁ, ভাইয়া, রেডি।’

‘চলুন তাহলে, যাওয়া যাক।’

গতকালের পত্রিকায় চমকপ্রদ একটা খবর চোখে পড়েছে দীপ্রর, ছোট্ট করে ছাপা হয়েছে ভেতরের পাতায়। কে একজন দাবি করেছেন, জগদ্বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমসের স্রষ্টা কিংবদন্তি লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের হারানো পাণ্ডুলিপির খোঁজ পেয়েছেন তিনি। ১৯২৮ সালে আমেরিকা ভ্রমণে এসে লেখক যে সরাইখানায় উঠেছিলেন বলে জানা যায়, সংস্কারের সময় সেখানকার কড়িবর্গার মধ্যে নাকি পাওয়া গেছে হলদে হয়ে আসা পাতাগুলো।

কাগজগুলো নিলামে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন পাণ্ডুলিপির মালিক। সর্বোচ্চ দাম যে দিতে পারবে, তার কাছেই চলে যাবে ওগুলো। তবে সবার পক্ষে কেনা সম্ভব না হলেও যারা থাকছে নিলামে, তাদের জন্য ওই পাণ্ডুলিপি দেখাটা হবে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এ রকম সুযোগ একবারই আসে জীবনে।

খবরটা বন্ধুদের জানিয়েছে দীপ্র। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যে আগ্রহ দেখাত, সেই রেজাই এখন ছুটি কাটাচ্ছে বাংলাদেশে।

যেখানে আবিষ্কৃত হয়েছে পাণ্ডুলিপিটা, সেখানেই নিলামের আয়োজন করা হয়েছে, সাগরপারের ওই সরাইখানায়। উপকূলীয় মহাসড়ক ধরে গেলে পনেরো মাইল দীপ্রদের বাড়ি থেকে। মহাসাগরের অপূর্ব দৃশ্যপটের জন্য জায়গাটা বিখ্যাত। ডয়েল যে কেন থাকার জন্য পছন্দ করেছিলেন সরাইখানাটা, সহজেই অনুমেয়।

‘অদ্ভুত লাগছে যে,’ গাড়ি চালাতে চালাতে মন্তব্য করল উইলসন, ‘তেমন প্রচার পায়নি খবরটা। এটা তো ন্যাশনাল কাভারেজ পাওয়ার মতো খবর! তার বদলে স্থানীয় কাগজের ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে গেছে বিজ্ঞাপনের মতো। নিলাম আহ্বানকারীই বোধ হয় দিয়েছে বিজ্ঞাপনটা।’

মাথা ঝাঁকাল দীপ্র। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকাল ও দূরের সাগরের দিকে।

‘এসে গেছি,’ একসময় বলে উঠল উইলসন। গাড়ি থেকে নামতে নামতে যোগ করল, ‘দেখা যাক, কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।’

সরাইখানার প্রশস্ত লবিতে প্রবেশ করতেই ওদের উদ্দেশে হাতছানি দিল ইকবাল আর পাভেল। দীপ্র আর উইলসনের জন্য সামনের সারিতে জায়গা রেখে দিয়েছে ওরা।

উত্তেজনার ছোঁয়াচ লেগেছে লবিজুড়ে। উপস্থিত দর্শকদের তর সইছে না পাণ্ডুলিপিটা দেখার জন্য।

খালি চেয়ার দুটো দখল করল দীপ্ররা।

একটু পরই কমে এল আলোর আভা। চুপ হয়ে গেল দর্শক।

কোঁচকানো টুইড স্যুট পরা লম্বা এক ব্যক্তি উঠে এলেন মঞ্চে। বাজপাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা নাক, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর সামান্য পিছিয়ে যাওয়া হেয়ারলাইনে খোদ শার্লক হোমসের মতো দেখাচ্ছে তাঁকে। চওড়া হাসি দিয়ে গলা খাঁকরালেন।

‘সুপ্রভাত সবাইকে!’ বক্তার কণ্ঠস্বরে ব্রিটিশ টান স্পষ্ট, ‘টিমোথি কার্লটন নাম আমার। সমুদ্রবিলাস নামের চমৎকার এই সরাইখানার মালিক হেনরি কামবারব্যাচ আমার বন্ধু মানুষ। জরুরি পারিবারিক প্রয়োজনে দুর্ভাগ্যক্রমে আজ ও হাজির থাকতে পারেনি এখানে। সে জন্য আমিই ওর হয়ে নিলাম পরিচালনা করছি।’

মৃদু গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল জমায়েতের মধ্যে।

হাড্ডিসার, ফ্যাকাশে একটা হাত তুলে আওয়াজটা থামিয়ে দিলেন মিস্টার কার্লটন। বললেন, ‘দ্য নরউড বিল্ডার্সের পঁচিশ বছরের পুরোনো সদস্য আমি। স্যান্টা বারবারার শার্লকিয়ান সোসাইটি এটা। এ ছাড়া হোমস-চর্চার জন্য বিখ্যাত রাক্সটন ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য পড়াচ্ছি আমি। লন্ডনের সদাবি মিউজিয়ামকে আমিই পরামর্শ দিয়েছিলাম ওদের সংগ্রহে থাকা কোনান ডয়েলের পাণ্ডুলিপি দুটো নিলামে তোলার।’

হাততালির আওয়াজ উঠল একপশলা।

আকর্ণ হেসে হাত তুললেন আবার কার্লটন। অপেক্ষা করছেন তালির শব্দ থিতিয়ে আসার।

‘আমার বাঁ দিকে কাচের কেসটার মধ্যে রাখা পৃষ্ঠাগুলো পাওয়া গেছে গেল গ্রীষ্মে সমুদ্রবিলাসের রেনোভেশনের সময়। আপনারা জানেন, ১৯২৮ সালের শরৎকালে আধ্যাত্মবাদ ও মৃত্যুর পরের জগতের ওপর এক কনফারেন্সে অংশ নিতে এ দেশে এসে দুই সপ্তাহের জন্য উঠেছিলেন এখানে আর্থার কোনান ডয়েল।’

‘সুন্দর করে ভাঁজ করা অবস্থায় খামের ভেতর ছিল বারোটা পৃষ্ঠা। খামটা আবার সযত্নে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল কড়িবর্গার একটা ফাঁকের মধ্যে, নিচ থেকে দেখা যায় না। বোঝাই যাচ্ছে, অনেক চেষ্টাচরিত্র করে জায়গাটা খুঁজে বের করেছেন লেখক। কী কারণে, কখনোই সেটা জানতে পারব না আমরা। হয়তো নিছকই কৌতুক করে, কিংবা হয়তো এখানকার আতিথেয়তায় তুষ্ট হয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এভাবে। উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, অসাধারণ এক উপহার যে তিনি দিয়ে গেছেন আমাদের, এতে তো কোনো সন্দেহ নেই, নাকি?’

‘শার্লক হোমসের অপ্রকাশিত গল্পের পাণ্ডুলিপি এটি। যে কাগজে গল্পটা লেখা হয়েছে, রাক্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসররা তা নির্ভেজাল বলে রায় দিয়েছেন। এমনকি হাতের লেখাটাও নিঃসন্দেহে ডয়েলের বলে প্রমাণিত হয়েছে। টান টান উত্তেজনায় ভরা দুর্দান্ত গল্পটার নাম “দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য রাইভাল আর্টিস্ট”। এগিয়ে এসে দেখতে পারেন আপনারা পাতাগুলো। তবে কোনো ছবি তোলা চলবে না, প্লিজ। দশ মিনিটের মধ্যেই শুরু হচ্ছে নিলাম।’

আসন ছেড়ে ডিসপ্লে কেসের দিকে লাইন ধরে এগোতে আরম্ভ করল দর্শকেরা।

চার মূর্তিও লাইনে দাঁড়াল ওদের পালা আসার জন্য।

শেষমেশ যেন অনন্তকাল পর মহামূল্য পাতাগুলো দেখার সৌভাগ্য হলো ওদের।

পাণ্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠাটা শুরু হয়েছে এভাবে:

‘১৮৯৩ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকের ঘটনা। ভারী গড়নের এক ভদ্রলোক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন আমাদের কোয়ার্টারে। পাতলা হয়ে আসা ব্যাকব্রাশ চুল আর লালচে চেহারার মানুষটি অস্থির ভঙ্গিতে মাথার টুপিটা ঘোরাচ্ছিলেন দুই হাতে।

‘কৌতূহল নিয়ে লালমুখো লোকটাকে দেখছিল শার্লক হোমস, ইগলের নজর বোলাচ্ছিল মাথা থেকে কর্দমাক্ত জুতা পর্যন্ত। ওর ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে কোনো কিছুই অজানা থাকছিল না যেন।

‘খানিক পর জ্বলন্ত ক্লে পাইপ থেকে নীলচে ধোঁয়া উগরে দিয়ে হাসল বন্ধু অতিথির উদ্দেশে। বলে উঠল, “দেখতেই পাচ্ছি, সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরেছেন আপনি। তা, আবহাওয়া কেমন ওখানে? বর্ষাকালটা একটু আগেভাগেই চলে এসেছে, না? ঘোরাঘুরির জন্য অসময়ই বলতে হবে এটা।’

এ পর্যন্ত পড়ার পরই এ–ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল দীপ্র, ইকবাল, পাভেল।

‘আমি যা ভাবছি, তোমরাও কি তা-ই ভাবছ?’ জিজ্ঞেস করল ইকবাল।

মাথা ওপর-নিচ করল পাভেল আর দীপ্র।

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তিন বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছে উইলসন, কিছু বুঝতে পারেনি ও।

‘গল্পটা যদি সত্যিই স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা হতো, সে ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা নামটা ব্যবহার করতেন না তিনি,’ ফিসফিস করে বুঝিয়ে বলল পাভেল, ‘কারণ, ১৯৭২ সালের আগপর্যন্ত শ্রীলঙ্কা পরিচিত ছিল সিলন নামে।’

‘পুলিশকে ফোন করা উচিত না, দীপ্র ভাইয়া?’ চাপা কণ্ঠে বলে উঠল উইলসন, উত্তেজিত হয়ে পড়েছে ইংরেজ যুবক, ‘এ রকম প্রতারণা…।’

‘করলে এক্ষুনি করতে হবে সেটা,’ সায় জানাল দীপ্র, ‘নিলাম ডাকা শুরু হওয়ার আগেই। পুলিশ এসেই করুক যা করার।’