লাল পাহাড় (শেষ পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

একসময় বিনয় স্যার রাব্বির দিকে ভ্রু নাচালেন, অর্থাৎ কী বই পড়েছিস? লাল পাহাড় বলতে গিয়েও বলল না রাব্বি। কেন যেন মনে হচ্ছে এই বইয়ের নামটার মধ্যেই সমস্যা আছে। বললেই ফের কিছু একটা গোলমাল বেধে যাবে।

‘কী হলো, বইয়ের নাম ভুলে গেছিস?’

‘স্যার...’

বিনয় স্যার এরপর বই পড়া নিয়ে একটা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। এই বক্তৃতা স্যার প্রায়ই দেন। এভাবেই দিনটা গেল। অবশ্য লম্বা ছুটির পর প্রথম দিন বলে সব ক্লাসে ছাত্রও এসেছে বেশ কম কম।

টিফিন পিরিয়ডে নেলির সঙ্গে দেখা রাব্বির। সে মিতুর সঙ্গে টিফিন খাচ্ছিল ওদের ক্লাসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে।

‘অ্যাই রাব্বি?’

‘কী?’ রাব্বি দাঁড়াল নেলির ডাকে। সে যাচ্ছিল লাইব্রেরি রুমে।

‘কৌশিকদার সঙ্গে আর দেখা হয়েছিল তোর?’

‘না।’

‘আমার হয়েছিল।’

‘তাই ? কী বলল?’

‘বলল...থাক, স্কুল ছুটির পর বলব বাসায় যাওয়ার সময়।’

‘আচ্ছা।’

স্কুল ছুটির পর অবশ্য নেলিকে আর পাওয়া গেল না, মনে হয় আগেই চলে গেছে। তা ছাড়া সবার সঙ্গে মিলে মাঠে কিছুক্ষণ ফুটবল খেলল অনেক দিন পর। দারুণ লাগল। স্কুলের মাঠে স্কুলের ৫ নম্বরি হার্ডপাম্প বল দিয়ে ফুটবল খেলার মজাই আলাদা।

স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরছিল রাব্বি আর মজনু। হঠাৎ দেখে কৌশিকদা একা একা চা খাচ্ছে টংদোকানে দাঁড়িয়ে। রাব্বি দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘মজনু, তুই যা। আমি কৌশিকদার সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।

‘আচ্ছা।’ মজনু এগিয়ে যায়।

রাব্বিকে দেখে আগের মতোই ভ্রু নাচালেন কৌশিকদা।

‘কী রে, তোদের স্কুল খুলে গেল?’

‘হুঁ।’

‘বাসায় আসিস না ক্যান?’

‘কৌশিকদা?’

‘বলে ফেল। চা খাবি?’ মাথা নাড়ে রাব্বি। রাব্বির মনে হচ্ছে এটা আগের কৌশিকদাই।

‘কৌশিকদা, তোমার সঙ্গে কথা ছিল।’

‘তুই কী বলবি আমি জানি। যা বলবি, সবই সত্যি। সবই ঘটেছে। ওই যে লাল বিল্ডিংটার ওখানে একসময় একটা লাল পাহাড় ছিল। ওখানে একটা ব্যাপার আছে। মনে আছে, আমি একটা কম্পাস নিয়ে গিয়েছিলাম? কম্পাস কাজ করছিল না?’

‘মনে নেই।’

‘আসলে ওখানে একটা প্যাসেজ আছে, মহাজাগতিক জানালা বলতে পারিস। ওই পথে একটা ছেলে এসেছিল।’

‘কোন ছেলে?’

‘কে জানে! হয়তো আমি কিংবা তুই।’ কৌশিকদা হেসে উঠল। রাব্বির মনে হলো কৌশিকদা বানিয়ে বানিয়ে লাল পাহাড়ের গল্পটাই বলছে।

‘বুঝলি, থার্মোডাইনামিকসের দ্বিতীয় সূত্রানুযায়ী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এনট্রপি বাড়ে...আর এটাও জানিস তো প্রকৃতি এনট্রপি মানে বিশৃঙ্খলা পছন্দ করে না...’

কৌশিকদা কঠিন কঠিন সব কথা বলতে শুরু করল। তারপর হঠাৎ গলা নামিয়ে ফেলল।

‘বাদ দে। এসব নিয়ে আর ভাবিস না। বাড়ি যা। তবে একটা জিনিস মনে রাখিস...’

‘কী?’

‘প্রকৃতি একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে আমাদের মধ্যে, সে সব ঠিক করে ফেলেছে...’

‘কে সে?’

‘তা জানি না। হবে কেউ চেনাজানার মধ্যে। কৌশিকদা মিটিমিটি হাসে। যা যা, এখন বাড়ি যা।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বাসায় এসে দেখে ঝর্ণা খালা এসেছে। সেই হাসিখুশি ঝর্ণা খালা, সে ডাক্তার হয়ে গেছে। এখন শুধু ইন্টার্ন বাকি। সে রাতে ভালো খাওয়াদাওয়া হলো। ঝর্ণা খালা বাইরে থেকে বিরিয়ানি আনিয়েছে। খেয়েদেয়ে মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে ঘুম দিল রাব্বি। অনেক রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙল। বাথরুমে যাওয়া দরকার। দেখে মায়ের রুমে তখনো দুই বোন গল্প করছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। তাকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছে...

‘আপু, রাব্বিকে কখনো কি বলেছিলি ঘটনাটা?

‘কোন ঘটনা?’

‘ওই যে একদিন ভোরবেলায় ছোট্ট একটা ছেলে তোর বাসায় এসে হাজির হলো। দুই পায়ে লাল ভেজা মাটি। তুই নাম জিজ্ঞেস করলি আর সে নাম বলল না, বিড়বিড় করে একটা সংখ্যা বলল ১৮১-৪০-৫৭৭...’

‘না। কখনোই না। ও সব সময় আমার বাচ্চা। যেখান থেকেই আসুক। ও আমার বাচ্চা।’

সে রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখল রাব্বি। সে লাল মাটির ওপর দিয়ে ছুটছে, দুই পাশে লাল মাটির উঁচু উঁচু পাহাড়। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। লাল মাটিগুলো তার সাদা জুতায় চটচট করে লেগে যাচ্ছে। তারপরও সে ছুটছে। পেছন থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলছে, ‘পালাও! পালাও!’

সেই লাল বাড়িটা একদম ভেঙে ফেলা হয়েছে। তার আর চিহ্নমাত্র নেই। সেই ছোট্ট চায়ের টংদোকানটাও আর নেই। নেই সেই বুড়া তিনজনও; যারা এসে বসে চা খেত আর নিজেদের মধ্যে অদ্ভুত সব গল্প করত। শুধু আছে সেই টংদোকানের সামনের ছোট্ট ভাঙা বেঞ্চটা। রাব্বি বেঞ্চটায় এসে বসেছে। তার পায়ের কাছে বসে আছে ক্লান্টু। কৌশিকদা বলছিল, এখানে একটা প্যাসেজ ছিল, একটা মহাজাগতিক জানালার মতো ব্যাপার...সত্যিই কি তাই? হঠাৎ একটা দমকা বাতাস ছুঁয়ে গেল ওদের। এলোমেলো করে দিল রাব্বির চুলগুলোকে, অন্য রকম একটা বাতাসের ছোঁয়া। রাব্বির বুকের ভেতর কেমন একটা হাহাকারের মতো লাগে। মনে হয়, কী যেন একটা কিছু পেছনে ফেলে এলাম! সেই পেছনটাই-বা কোথায়? কত দূর? হঠাৎ তার হাতের ওপর কেউ যেন হাত রাখে। তাকিয়ে দেখে নেলি। সে কখন এসে বসল তার পাশে! অবাক হতে গিয়েও ঠিক অবাক হতে পারল না রাব্বি। তার তখন মনে হলো কৌশিকদার কথাটা...প্রকৃতি আমাদের চেনাজানার মধ্যেই একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে...নেলি কি সেই প্রতিনিধি, যে সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছে? রাব্বি একধরনের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে নেলির দিকে। নেলি কিছু বলে না, তাকিয়ে থাকে শান্ত চোখে। তারপর হঠাৎ ফিসফিস করে বলে, ‘রাব্বি, আমি সব জানি রে...!’ রাব্বির নেলিকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, ‘তুই ঠিক কী জানিস, নেলি?’

সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগেই, ওরাও ফিরে চলল যার যার বাসায়। তখনো ওদের অস্পষ্ট তিনটা ছায়া ওদের সামনে সামনে হেঁটে চলেছে, ওদেরই ছায়া কিন্তু অন্য রকম দেখায়, যেন দুটো আলাদা জগতের মানুষ পাশাপাশি হেঁটে চলেছে।

(শেষ)