দিনদয়ালের রহস্যময় ঝোলা

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

ওই তো হেঁটে যাচ্ছে দিনদয়াল। পরনে ছালার বস্তার পোশাক। কাঁধে ঝোলানো মস্ত বড় ঝোলা। ঝোলার মুখটা লাল-নীল রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। জোর কদমে পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে দিনদয়াল। যেন কোথাও যাওয়ার খুব তাড়া তার।

দিনদয়ালের হাতে আর পায়ে লোহার বালা। কেউ কেউ বলে, দিনদয়াল জেলপালানো আসামি। এখন পাগলের বেশ ধরেছে।

কেউ বলে, আরে নাহ্‌! দিনদয়াল আসলে সিপাহি বিদ্রোহের পলাতক সৈনিক। ব্রিটিশদের অত্যাচার সইতে না পেরে লোহার শিকল ছিঁড়ে পালিয়ে এসেছে। সেই শিকলেরই অবশিষ্ট সাক্ষী হয়ে আছে হাত-পায়ের বালাগুলো।

সিপাহি বিদ্রোহ! উরিব্বাস। সে তো ১৮৫৭ সালের কথা। দিনদয়ালের তাহলে বয়স কত? আর কী আছে তার ওই ঝোলায়?

কেউ কেউ বলে, ঝোলার মধ্যে ১৭টা ভূত আটকে রেখে ঘুরে বেড়ায় দিনদয়াল। ভূতগুলো তার পোষ মানানো। তাদের দিয়ে নানা রকম কাজ করিয়ে নেয় সে। রাত হলে ইন্দিরার মোড়ের পরিত্যক্ত কুয়ায় নেমে যায় দিনদয়াল। সেখানেই ঘুমায়। আর তখন লাল-নীল রশির গিট্টু খুলে দেয়। ঝোলার মুখ দিয়ে হু হু করে বেরিয়ে আসে ১৭টা ভূত। লাল-নীল রশিগুলো মন্ত্রবাঁধা। তাই ভূতগুলো আটক থাকে ঝোলার ভেতর। একবার খুলে দিলেই ফুড়ুৎ করে উড়ে বেরিয়ে পড়ে।

ভূতগুলোর কেউ দিনদয়ালের জন্য রাঁধে-বাড়ে, কেউ গা টিপেটুপে দেয়। এদিক–ওদিক ঘুরে বেড়ায়। ভোরের আলো ফোটার আগেই দিনদয়াল হাঁক দেয়। তখন পোষ মানা হাঁসের মতো কিলবিল করতে করতে ভূতগুলো আবার ঝোলার বস্তায় ঢোকে। দিনদয়াল বিড়বিড় করে মন্ত্র ফুঁকে ঝোলার মুখ আটকে দেয়।

আসলেই কি ভূত আছে ঝোলার মধ্যে? নাকি এই সবই গপ্পো?

দিনদয়াল নিজে কখনো বলেনি, ঝোলার ভেতর কী আছে। তবে মাঝেমধ্যেই সে ফেরিওয়ালার মতো হাঁক দেয়। অ্যাইইইই স্বওওওপ্নওওও কিইইইনবেএএএন স্বওওওপ্নওওও। কিনবেন নাকি স্বপ্ন? যেন ঝোলাভর্তি স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।

কিন্তু কে কিনবে স্বপ্ন? স্বপ্ন তো আর রুটি-ভাত-তরকারির মতো দরকারি নয়। স্বপ্ন দিয়ে পেট ভরে না। স্বপ্নের কাজটাই বা কী? স্বপ্ন কি খুব জরুরি? জরুরি কি নয়? স্বপ্ন দেখেছে বলেই তো মানুষ একদিন পাখির মতো ডানা মেলতে পেরেছে আকাশে। চাঁদে পা রেখেছে। মঙ্গলেও যাবে একদিন। স্বপ্নই তো মানুষকে এতটা পথ এগিয়ে নিয়ে এসেছে।

কিন্তু প্রথম যে মানুষ ভেবেছিল, মানুষ আকাশে উড়তে পারবে, এমন একটা বাহন বানানো খুবই সম্ভব—সবাই হেসেছিল। পাগল ঠাউরেছিল মানুষটাকে।

দিনদয়ালের স্বপ্নের কারবার দেখেও সবাই হাসত খুব। বলত, ‘দেখো পাগলের কাণ্ডটা। সের দরে স্বপ্ন বেচছে। ওরে দিনদয়াল কিসের স্বপ্ন বেচিস তুই? কত করে দাম তোর স্বপ্নের?’

তামাটে দাঁত বের করে দিনদয়াল শিশুর মতো হাসত। বলত, ‘কিনবেন বাবু, স্বপ্ন কিনবেন? আমাকে শুধু একবেলার ভাত দিবেন! তরকারি, ডাল কিচ্ছু লাগবে না বাবু। শুধু গরম গরম ভাত দিবেন। কত দিন ভাত খাই না বাবু। নেন না বাবু আমার কাছ থেকে স্বপ্ন। আর আমাকে একথালা ভাত দেন।’

পাগলটার কথা কেউ কানে তুলত না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত—‘যা ব্যাটা ভাগ। মানুষ ঠকানোর বুদ্ধি বের করেছিস ভালো। হাওয়াই মিঠাই স্বপ্ন বেচতেছিস। তার চেয়ে অন্য কিছু বেচ, যেটা মানুষ কেনে। তাহলেই তো তোর পেটের ভাতটা মিলে যায়।’

কিন্তু দিনদয়াল একরোখা। অন্য কিছু তো সবাই বেচে। দেদার মেলে। সেসব বেচে লাভ কী? দিনদয়াল এমন কিছু বেচবে, যা কেউ কখনো বেচেনি।

দিনদয়ালের কাছ থেকে কেউ কোনো দিন স্বপ্ন কেনেনি। রতনপুর গ্রামের মানুষ স্বপ্নও দেখে না। স্বপ্ন দেখাটা জরুরি নয়। ভাত-রুটি দরকারি।

স্বপ্ন বিক্রি করতে না পেরে দিনদয়াল অন্য ব্যবসা ধরল। কাঁধের ঝোলা ঝুলিয়ে গ্রামময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। আর বলতে লাগল, ‘রোদ কিনবেন, রোদ?’

আবার রতনপুর গ্রামের মানুষ হাসে। এ পাগলটা সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। এবার রোদের ব্যবসা করছে দেখো। কেউ বলে, ‘ওকে কবরেজি ওষুধ খাওয়াও।’ কেউ বলে, ‘ধরে–বেঁধে মাথায় দুইটা বাড়ি দিলেই পাগল ঠিক হয়ে যাবে। পাগলামি ছুটে যাবে ব্যাটার। সুখে আছে তো, তাই ভূতে কামড়েছে।’

দিনদয়াল এসব কথায় কান দেয় না। ঝোলাভর্তি রোদ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর হাঁক দেয়, ‘রোওওওদ কিইইইনবেএএএন রোওওওদ? কিনবেন নাকি রোদ!’

গ্রামে মিটিং বসে। ‘নাহ্, এই পাগলকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না। কিছু একটা বিহিত করা দরকার।’ কেউ কেউ বুদ্ধি দেয়, ‘ইন্দিরার মোড়ের কুয়াটা তো আর কোনো কাজে আসছে না। ওটাকেই তো ব্যাটা আস্তানা করেছে। কুয়াটা বন্ধ করে দিলেই তো হয়।’ কেউ আবার বলে, ‘কিন্তু ব্যাটার কাছে তো ভূত আছে। কিছু করতে গেলে যদি ভূত লেলিয়ে দেয় পেছনে!’ মিটিং-ফিটিং হয়, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত আসে না।

গ্রামের মানুষ আছে তাদের মতো। দিনদয়ালও আছে তার মতো।

রোদের ব্যবসায় ফেল মেরে দিনদয়াল জ্যোৎস্নার ব্যবসায় নামল। পূর্ণিমার রাতের দুধসাদা জ্যোৎস্না নাকি আছে তার ঝোলায়। এক ছটাক, দুই ছটাক করে জ্যোৎস্না বেচতে চায় সে। হাঁক দেয়, ‘জোওওওছনাআআআ কিইইইনবেএএএন জোওওছনাআআআ!’

পাগলটার কথায় কেউ কান দেয় না। থাকুক সে তার মতো। ইট–পাথর খেয়ে পেট ভরাক। আর এসব আজব জিনিস বিক্রি করুক। একদিন না খেয়ে মরে নিজেই ভূত হয়ে যাবে। তখন বুঝবে ব্যাটা।

দিনদয়াল হাল ছাড়ে না। একদিন ঠিকই কেউ না কেউ তার কাছ থেকে কিছু কিনবে। মুঠোভর্তি রোদ কিংবা জ্যোৎস্না। কিনবে—দুচোখভর্তি স্বপ্ন।

দিনদয়াল এবার শেষ ব্যবসায় নামে। এবার সে ঝোলাভর্তি মেঘ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আগের মতোই হাঁক দেয়, ‘মেএএঘ কিনবেন, মেএএএঘ? কিনবেন নাকি মেএঘ?’

লোকে এখন আর হাসেও না। দিনদয়ালের পাগলামি তাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। সত্যি বলতে কি, দিনদয়ালকে দেখেও যেন আর তারা দেখতে পায় না। চোখের সামনে দিব্যি একটা মানুষ আকুতি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার কাছ থেকে মেঘ কেনার জন্য; কিন্তু মানুষ অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে।

এক রাতে দিনদয়ালের নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হয়। ইন্দিরার মোড়ে নিজের আস্তানায় গিয়ে কুয়াটার বাইরের দিকে হেলান দিয়ে বসে থাকে। নিচে নামার আর শক্তি পায় না। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেছে দিনদয়াল। ফুরিয়ে এসেছে জীবনী শক্তি। শেষ কবে সে ভালোমতো একথালা ভাত খেয়েছিল, মনে করতে পারে না। পাগলের মাথাটা পাগলের হলেও পেটটা আর সব মানুষের মতোই। কেউ তা বুঝতে চায় না।

পরদিন সকালে রতনপুর গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে আবিষ্কার করে, নিথর দিনদয়াল পড়ে আছে কুয়ার পাশে। দূর থেকে তাকালেই বোঝা যায়, পাগলটা আর বেঁচে নেই। পাশে পড়ে আছে তার সেই ঝোলা। ঝোলার মুখ খোলা। আর সত্যি সত্যি ঝোলা থেকে ফুরফুর করে বেরিয়ে আসছে পেঁজা পেঁজা মেঘ!