আহসান হাবীবের ভৌতিক গল্প 'কেউ না'

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

ঠিক দুপুরবেলায় রঞ্জুর ঘুমটা ভেঙে গেল। সে এসেছে দাদার বাড়িতে বেড়াতে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, এখন তো বেড়ানোরই সময়। কিন্তু যাদের ভরসায় আসা, তারা কেউ নেই, মানে তার চাচাতো–ফুফাতো ভাইবোনেরা আরকি; তারাও গেছে বেড়াতে। এটা তো খুবই স্বাভাবিক। রঞ্জু যেমন শহর থেকে গ্রামে এসেছে, ওরাও গ্রাম থেকে শহরে গেছে বেড়াতে। মাঝখান দিয়ে রঞ্জুর ছুটিটা মাটি। আসলে ওদের সারপ্রাইজ দিতে গিয়েই এই কাণ্ড। সে ভেবেছিল, একা একা এই প্রথম এসে সবাইকে চমকে দেবে। উল্টো নিজেই ‘সারপ্রাইজড’ খেয়ে গেল। মা অবশ্য বলেছে ‘কাল চলে আয়, ওখানে একা একা আর কী করবি, ওরা যখন নেই।’ তাই তো, একা একা আর কী করবে? দাদু অবশ্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, এটা–সেটা খাইয়ে ওকে খুশি করতে, নানা রকম গুড়ের পিঠা খেয়েই যাচ্ছে খেয়েই যাচ্ছে রঞ্জু, তাতেও কাজ হচ্ছে না। রঞ্জু অবশ্য ঠিক করে ফেলেছে কাল ভোরের বাসে করে চলে যাবে। দাদুকে বলেছেও।

-সত্যি কালই যাবি? দাদু মন খারাপ করেন।

-যাই দাদু, আবার আম-কাঁঠালের ছুটির সময় বাবার সঙ্গে আসব।

-ঠিক আসবি তো?

-অবশ্যই আসব।

-সত্যি এবার সবাই দল বেঁধে চলে গেল। ওদেরই–বা কি দোষ? ওরা কি জানত যে তুই আসবি?

-তাই তো...

শুয়ে–বসে যে কটা বই এনেছিল সব পড়া শেষ রঞ্জুর। তাই পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছিল। এ রকম সুনসান ফাঁকা দাদার বাড়ি আর কখনো পায়নি। অবশ্য বড় চাচা আছেন। তিনি বেশির ভাগ সময় খেতেই থাকেন। আজও নিশ্চয়ই ওখানে। খেতের ধান পাকতে শুরু করেছে। ওগুলো পাহারা দিতে হয়। বড় চাচা ওখানে বসে টিনে বাড়ি দেন একটু পরপর। ছোট ছোট চড়ুই পাখি তালে থাকে। টিনের ক্যানেস্তারার শব্দে ফুররর করে উড়ে পালায়, মজার দৃশ্য। টিনের ওই বস্তুটাকে সবাই ক্যানেস্তারা বলে। কেন এই অদ্ভুত নাম, কে জানে!

রঞ্জু ঠিক করেছে ওখানেই যাবে। মুখে পানি দিয়ে রওনা দিল। দাদু পেছন থেকে চেঁচালেন

-কই যাস এই ভরদুপুরে?

-বড় চাচার কাছে যাই

-এই ভরদুপুর সময়টা কিন্তু ছেলে-ছোকরাদের জন্য ভালো নয়। বিকেলে যাস...রোদটা পড়ুক।

-না যাই...বলে ছুট দিল রঞ্জু। খেয়াল করল না, দাদু ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যতক্ষণ তাকে দেখা যায়।

খটখটে রোদ চারদিকে। এর মধ্যে একটা বেশ আলিশান ছাতার নিচে বসে আছেন বড় চাচা, ছাতাটা একটা লাঠি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। লাঠিটা অনেকখানি মাটিতে গেঁথে রাখা হয়েছে। বড় চাচার হাতে সেই টিনের ক্যানেস্তারা। চারকোনা একটা টিনের বাক্সই বলা যায়। সেটাতেই মাঝেমধ্যে মুগুরের মতো একটা কিছু দিয়ে বাড়ি দিচ্ছেন...ক্যাররর ক্যাররর শব্দ হচ্ছে। খেতের ঠিক মাঝখানে একটা কাকতাড়ুয়া। কাকতাড়ুয়াটার গায়ে ময়লা ছেঁড়া একটা চেক শার্ট। শার্টটা বাতাসে দুলছে। তার মাথাটা একটা হাঁড়ি দিয়ে বানানো হয়েছে, সেখানে সম্ভবত সাদা চুন দিয়ে চোখ, মুখ আঁকা। যে এঁকেছে তাকে খুব ভালো শিল্পী বলা যাবে না। বড় চাচা রঞ্জুকে দেখে অবাক হলেন!

-কিরে, এই ভরদুপুরে কেন এলি?

-ইচ্ছা হলো বড় চাচা, বাসায় ভালো লাগছিল না।

-এখানে এই গরমে ভালো লাগবে?

-গরম কী? বেশ তো বাতাস।

-আর বাতাস। এই আছে এই নেই।

-আচ্ছা বড় চাচা, ওই কাকতাড়ুয়াটাকে পাখিরা ভয় পায় না?

-কই আর ভয় পায়, ওরা সব চালাক হয়ে গেছে। তাই তো ক্যানেস্তারা নিয়ে বসে আছি। পাখি বসলেই বাড়ি দিই। কিরে, তুইও বাড়ি দিবি নাকি?

-হ্যাঁ, দেব। চাচা লাঠি আর টিনের বাক্সটা রঞ্জুর হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার হাত পায়ে মনে হয় খিল ধরে গেছে। ক্যানেস্তারাটা নিয়ে একটা বাড়ি দিল...ক্যাররর করে শব্দ করল জিনিসটা।

-এগুলো কী পাখি চাচা?

-বেশির ভাগই চড়ুই। মাঝেমধ্যে শালিক আর কাকও আসে...রাতে মাঝেমধ্যে প্যাঁচাও আসে...আর আসে...বড় চাচা হাত-পা ছড়িয়ে হাই তুললেন।

-আর কী আসে? বড় চাচা উত্তর না দিয়ে লুঙ্গির গিট্টু থেকে বের করে একটা বিড়ি ধরালেন। ‘রঞ্জু, তুই একটু বস, আমি চট করে আমার হুঁকাটা নিয়ে আসি। বিড়ি সব ফুরিয়ে গেছে...’

-আচ্ছা।

-ভয় পাবি না তো?

-ভয় পাব কেন? বলেই কেমন যেন ভয় লাগল রঞ্জুর। রঞ্জুর বড় চাচা তখন লম্বা লম্বা পা ফেলে অনেকখানি চলে গেছেন। রঞ্জু দেখল হঠাৎ একঝাঁক পাখি নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গে ক্যানেস্তারায় বাড়ি দিল...ক্যাররর ক্যাররর করে বিশ্রী শব্দ করে উঠল ওটা; পাখিরা সব উড়ে গেল। চারদিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন ভয় ভয় লাগতে লাগল রঞ্জুর, আশপাশে কেউ নেই। সে একা আর সামনের ওই কাকতাড়ুয়াটা। তবে না, কিছুক্ষণ পর ভয়টা কেটে গেল। ব্যাপারটা মজারই পাখিগুলো বসলেই কানেস্তারায় বাড়ি...যদিও শব্দটা বিশ্রী শোনায় কিন্তু মজাই লাগে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল কোনো পাখির দল আসছে না। না এলেই ভালো। রঞ্জু ছাতার সঙ্গে বাঁধা শক্ত লাঠিটায় হেলান দিয়ে বসল। কাকতাড়ুয়াটা দুলছে বাতাসে। তার গায়ের চেক শার্টটাও দুলছে। তার হাত দুটো দুদিকে ছড়ানো। সম্ভবত বাঁশ দিয়ে আগে একটা ক্রস বানানো হয়েছে, খ্রিষ্টানদের গোরস্তানে যেমনটা থাকে। তারপর শার্ট পরানো হয়েছে; ওপরের খাড়া বাঁশটায় মাটির হাঁড়িটা বসানো হয়েছে, মানুষের মুখ এঁকে। মুখটা কে এঁকেছে কে জানে। তবে সে খুব ভালো শিল্পী নয় অবশ্যই। কেমন ভৌতিক হয়েছে চেহারাটা।

চারদিকে করা রোদ হলেও সুন্দর বাতাস। রঞ্জুর কেমন ঘুম ঘুম লাগছে। কোনো পাখি নেই এখন। তখনই বুকটা ধক করে উঠল। ভালো করে তাকিয়ে দেখে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে তার সামনের ধানখেতটায়, একটু আগেও তারা বাতাসে দুলছিল, এখন কেমন যেন স্থির হয়ে আছে! কিন্তু বাতাস তো আছে। এমন হয় নাকি? রঞ্জু বুঝতে পারছে না। কিন্তু এটা সে নিশ্চিত, ভয়ানক কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। ঠিক তখনই তার মাথার ভেতর ক্লিক করল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই তার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। খেতের মাঝখানের কাকতাড়ুয়াটা যেখানে ছিল, ওটা সেখানে নেই। সে এখন অনেকটা সামনে চলে এসেছে। এটা কীভাবে সম্ভব। অনেক...অনেকটা সামনে। এত সামনে তো ছিলই না, কখনোই না। ছিল একদম মাঝখানে। এখন...এখন...একবারে কাছে চলে এসেছে যেন। বাতাসে দুলছে, কিন্তু পুরো ধানখেতটা স্থির হয়ে আছে। তার চেক শার্টটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রোদে পুড়ে রং জ্বলে গেছে, তারপরও বোঝা যাচ্ছে ছেঁড়া-খোঁড়া লাল স্ট্রাইপের একটা ফুলহাতা চেক শার্ট। নিচে একটা সাদা পায়জামা পরানো। আগে দূরে ছিল বলে বোঝা যাচ্ছিল না যে নিচে একটা ছেঁড়া-খোঁড়া পায়জামাও পরা আছে। অসম্ভব ভয় লাগছে। একটাও পাখি নেই। পাখি থাকলে ক্যানেস্তারায় বাড়ি দেওয়া যেত। পাখি নেই। কই গেল ওরা? রঞ্জু তবু কাঁপা হাতে ক্যানেস্তারায় একটা বাড়ি দিল। ক্যাররর শব্দটা খুব জোরালো হলো বলে মনে হলো না। বড় চাচা আসছে না কেন? রঞ্জুর মনে হলো ওর হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে আটকে আছে...ওর দম বন্ধ লাগছে।

রঞ্জু একদৃষ্টে কাকতাড়ুয়াটার দিকে তাকিয়ে আছে। ওটা কি আরও সামনে চলে এসেছে? তাই তো মনে হচ্ছে। শার্টের বোতামগুলো পর্যন্ত এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঢোক গেলার চেষ্টা করল রঞ্জু। কিন্তু পারল না। গলাটা এখন ব্যথা করছে। ঠিক তখনই পেছনে পা ঘষটানোর মতো একটা শব্দ হলো। ঘাড় ফিরিয়ে দেখতেও ভয় হচ্ছে রঞ্জুর। কী দেখবে?

-কিরে ভয় পেয়েছিস নাকি?

–ওহ বড় চাচা। হুট করে সব ভয় চলে গেল।

-তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? বড় চাচাকে একটু উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে যেন।

-কই না, ঠিক আছি। আড়চোখে তাকিয়ে দেখে কাকতাড়ুয়াটা আগের মতোই মাঠের মাঝখানে।

-আমার ভুল হয়েছে।

-কী ভুল বড় চাচা?

-তোকে এখানে একা রেখে যাওয়াটা। ঠিক এই সময়টায় ওরা আসে।

-ওরা কারা বড় চাচা?

-বাদ দে। তুই কিছু দেখিসনি তো?

-কী দেখব? ব্যাপারটা বলতে গিয়ে বলল না রঞ্জু। কেউ যেন ভেতর থেকে সতর্ক করল তাকে। ‘রঞ্জু বোলো না...রঞ্জু বোলো না।’

-যা বাসায়। তোর দাদু তোর জন্য চিন্তা করছে। তোকে একা রেখে গেছি দেখে বকল আমাকে। যা, বাড়ি যা।

রঞ্জু হাঁটা দিল। ফেরার পথটা, মানে যে পথ দিয়ে সে এসেছে, সেটাও বেশ নির্জন। এক পাশে টানা ধানখেত। মাঝেমধ্যে দু–একটা ভুট্টাখেতও আছে; আরেক পাশে জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর দু–একটা বাড়িঘর আছে। তারপরও মনে হয়, এটা যেন একটা জঙ্গলই। দ্রুত পা চালাল রঞ্জু। তখনই কেমন একটা শব্দ হলো। যেন কেউ ছুটে আসছে পেছনে। ঝট করে পেছনে তাকাল রঞ্জু। কেউ নেই। কিন্তু বাঁ দিকে তাকিয়েই হিম হয়ে গেল বুকটা! ডান দিকের ধানখেতটার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই কাকতাড়ুয়াটা। যা হয় আরকি, খুব বেশি ভয় পেলে মানুষ আবার সাহসী হয়ে ওঠে, শরীরের ভেতর হরমোনের কী একটা ব্যাপার নাকি ঘটে। তা–ই হলো রঞ্জুর। দৌড় দিল সে। দৌড়...দৌড়...দৌড়...এক দৌড়ে বাড়িতে। গিয়ে দেখে, দাদু একটা কাঁসার গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

-নে তো, লবণ–পানিটা খা।

-কেন?

-আহ্, খা বলছি।

ঢক ঢক করে পানি খেল রঞ্জু। সে যে ভয় পেয়েছে এটা কি দাদু বুঝতে পেরেছে?

-তোর বাবা এসেছে তোকে নিতে। দাদু ফিসফিস করে বলেন। ঠিক তখনই পেছন থেকে বাবা তার কাঁধে হাত রাখলেন।

-কিরে, বাসায় যাবি না। তোদের স্কুলে তো বুকলিস্ট দিচ্ছে। স্কুল খুলেও গেছে।

-তাই? যাব যাব।

-একি তোর গায়ে তো অনেক জ্বররে।

-আমি এই ভয়টাই পেয়েছিলাম। দাদু বিড়বিড় করে। ছোট ছেলেপেলেকে খালি ময়দানে একা পেলে ওরা আসে...

-ওরা কারা? আবার প্রশ্নটা করে রঞ্জু। কেউ উত্তর দেয় না। বাবা বলে

-ওরা কেউ না। চল বাসায় চল। এখন রওনা দিলে দিনে দিনে পৌঁছে যাব। রাতে আমার একটা জরুরি মিটিংও আছে। মা যাই।

-এভাবে কেউ যায়? ওর জ্বর।

-কিছু হবে না মা। আমি তো আছি...বলে বাবা নিচু হয়ে দাদুর পা ছুঁয়ে সালাম করে। রঞ্জুও করে।

গাড়িতে যেতে যেতে ‘কেউ না’র কথা ভাবে রঞ্জু। যে আসলে ‘কেউ না’ তাকে কেন এত ভয়?