ঝড়

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

সৌরজগতের সবচেয়ে বড় ঝড়ের অবস্থান বৃহস্পতি গ্রহে। বিজ্ঞানীরা আদর করে ঝড়টির নাম দিয়েছেন ‘গ্রেট রেড স্পট’।

সেই ঝড় আয়তনে পৃথিবীর চেয়ে বড়। বৃহস্পতি গ্রহের সবকিছুই বড় বড়। ফলে সেখানকার একটা ঝড়ও যে দানবাকৃতির হবে, এ আর অবাক কী!

কথা সেটা নয়। কথা হলো, এই ঝড়ের বয়স। এটি কবে শুরু হয়েছে, কেউ জানে না। এটি আছে, সব সময়। এর যেন কোনো শুরু ও শেষ নেই।

টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হওয়ার পর ৩৫০ বছর ধরে পৃথিবীর লোকেরা বৃহস্পতি গ্রহের এ ঝড় দেখছে। টেলিস্কোপের নলে চোখ লাগালেই দেখা যায়, বৃহস্পতি গ্রহের বিষুব রেখা থেকে ২২ ডিগ্রি দক্ষিণে এক বিশাল গ্যাসের চাকা ঘণ্টায় ২৬৮ মাইল বেগে ঘুরছে তো ঘুরছেই। একটা অতিকায় লালরঙা চোখ যেন তাকিয়ে আছে মহাবিশ্বের নিঃসীম শূন্যের দিকে। হয়তো হাজার হাজার অথবা লাখ লাখ বছর ধরে এটি ‘তাকিয়ে আছে’ এভাবে। আমি ‘তাকিয়ে আছে’ কথাটার ওপর জোর দিতে চাই। এটা আমি এমনি এমনি কাব্য করতে ব্যবহার করিনি। এটার তাৎপর্য বোঝাতে আমি এখানে কিছু ঘটনার উল্লেখ করব। পৃথিবীতে ঘটা। আপনারা ভয় পাবেন না আশা করি। তবে আমি খুব একটা অভয়ও দেব না।

দুনিয়ার সবচেয়ে পুরোনো যে ঝড়ের কথা লিখিত ইতিহাসে পাওয়া যায়, সেটা ঘটেছিল খ্রিষ্টের জন্মের ৫২৪ বছর আগে, মিসরে। আমুন মন্দিরের পুরোহিতেরা ঘোষণা দিলেন, তাঁরা পারস্যের রাজা দ্বিতীয় কাম্বিসেসের আনুগত্য মানেন না। বিশাল সাম্রাজ্য কাম্বিসেসের। এখনকার ইরান থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকাজুড়ে। যেদিকে চোখ যায়, সম্রাট কাম্বিসেসের সাম্রাজ্যের শুরু আর শেষ নেই। তো, মরুভূমির কোন এক মামুলি কোণে, কোন এক অখ্যাত মন্দিরের গোটা কয়েক অর্বাচীন পুরোহিত তাঁকে মানলেন কি মানলেন না, তাতে কার কী এল, গেল!

কিন্তু আঁতে ঘা লাগল সম্রাট কাম্বিসেসের। তিনি দুর্বিনীত পুরোহিতদের শায়েস্তা করতে পাঠিয়ে দিলেন বিশাল এক সৈন্যবাহিনী। ৫০ হাজার সৈন্যের এক বহর রওনা দিল মিসরের থিবিস শহর থেকে। গন্তব্য সাহারা মরুভূমির অপর পারে সিওয়া মরুদ্যান, আমুন মন্দির। কিন্তু কাম্বিসেসের সৈন্যরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি। মাঝপথে এক ধূলিঝড়ে পড়লেন তাঁরা। তারপর? তারপর হারিয়ে গেলেন। ৫০ হাজার সৈন্য মিশে গেলেন হাওয়ায়। এই ছিল, এই নেই।

এটা প্রাচীনকালের পুরাণ কাহিনি। কিংবদন্তি। মিথ। সন্দেহ নেই। তবে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের বইতে এই ঘটনা ইতিহাস আকারে লিপিবদ্ধ আছে। হেরোডোটাস লিখেছেন, ‘দক্ষিণ দিক থেকে একটা ঝোড়ো বাতাস উঠে এল, প্রবল ও ভীষণ। সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে এল ধুলার অতিকায় সব স্তম্ভ যা সম্পূর্ণ ঢেকে দেয় সৈন্যদের এবং তাঁরা হারিয়ে যান।’

কোথায় হারিয়ে গেলেন সৈন্যরা? কবর হয়ে গেলেন মাটিতে? নাকি উড়ে গেছেন মহাকাশে?

কেউ জানে না। এ রকম একটা পৌরাণিক গালগল্পকে কে আর সিরিয়াসলি নেবে! আর হেরোডোটাসের কথা মানারও কোনো মানে নেই। তিনি যেখানে যা লোকশ্রুতি প্রচলিত ছিল, যাঁর মুখে যা শুনেছেন, সবই গ্রন্থিত করেছেন ইতিহাস হিসেবে। ফলে তাঁর ইতিহাস আসলে ওই সময়ের মানুষের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ইতিবৃত্ত।

তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, অনেকেই এই গল্পকে খুব সিরিয়াসলি নিলেন। বিভিন্ন সময় সাহারা মরুভূমিতে কাম্বিসেসের হারিয়ে যাওয়া সৈন্যদের অবশেষ খুঁজে বেরিয়েছেন নানান অভিযাত্রী এবং তাঁদের অনেকে নানা রকম নিদর্শন খুঁজে পাওয়ার দাবিও করেছেন নানা সময়ে। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত অভিযাত্রীর নাম কাউন্ট লাজলো আলমাসি। হাঙ্গেরীয় এই অভিজাত যুবককে নিয়ে গল্প–উপন্যাস কম লেখা হয়নি। একটা সিনেমাও তৈরি হয়েছে তাঁর অমর প্রেমকাহিনি নিয়ে।

সাহারার যে অংশ এখন ওয়েস্টার্ন ডেজার্ট নামে পরিচিত, যেটা নীলনদের পশ্চিম তীরে লিবিয়া সীমান্ত ঘেঁষে, সেই বিস্তীর্ণ মরুতে যুগ যুগ ধরে পশ্চিমা অভিযাত্রী ও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অনুসন্ধান চালিয়েছেন। খুঁজে ফিরেছেন একদল হতভাগ্য সৈন্যের নিশানা। ২০০৯ সালেও দুই ইতালিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক দাবি করেন, তাঁরা সেখানে বালিয়াড়ির মধ্য থেকে খুঁড়ে তুলেছেন বেশ কিছু ব্রোঞ্জের অস্ত্র, একটি রুপার বাহুবন্ধনী, একটি কানের মাকড়ি এবং শত শত মানুষের হাড়গোড়।

নানা রকম দাবিই করা হয়। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর দাবিটি করেছেন হার্ভার্ডের আবহাওয়াবিদ চার্লস ম্যাকলাফলিন। কাম্বিসেসের হারিয়ে যাওয়া সৈন্যদের অবশেষ নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাঁর কৌতূহলের বিষয় ছিল সেই ধূলিঝড়। কোথা থেকে অকস্মাৎ এসেছিল এই ঝড়? কতটা প্রবল ছিল সেটার বাতাসের বেগ? আর এত বেগ কীভাবে অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল? তিনি এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছিলেন। আর তিনি খুবই অসংলগ্ন কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছান।

সুদূর অতীতে ঘটে যাওয়া ঝড়ঝাপটা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের বলা হয় প্যালিও-টেমপেস্টোলজিস্ট। চার্লস ম্যাকলাফলিন ছিলেন এই বর্গের পুরোধা। তিনি সম্রাট কাম্বিসেসের ওই ঝড়ের জন্মরহস্যের একটা কম্পিউটার সিম্যুলেশন তৈরি করার চেষ্টা করেন। কীভাবে শূন্যে ছুটে আসা বাতাসের তোড়ের মধ্যে ধূলিকণার সংঘর্ষ ঘটে এবং ভারী ও হালকা ধূলিকণা কীভাবে ঘূর্ণনের এক অন্তহীন চক্র তৈরি করে ক্রমাগত বড় হতে থাকে, তার একটা গাণিতিক ছক তিনি তৈরি করলেন। এই সিম্যুলেশন ব্যবহার করে ম্যাকলাফলিন এমন এক উপসংহারে পৌঁছান, যেটাকে পরবর্তীকালে তাঁর অনেক সহকর্মী ‘অপেশাদার’ বলে উড়িয়ে দেন। ম্যাকলাফলিন দাবি করেন, ওই ঝড় প্রাকৃতিকভাবে যতক্ষণ স্থায়ী হওয়ার কথা, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল। মধ্যদুপুরে শুরু হওয়া এই ধূলিঝড় থেমেছিল পরদিন সন্ধ্যার আগে আগে। রে স্মিথকে দেওয়া এক টিভি সাক্ষাৎকারে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ওই ঝড়ের সবচেয়ে আশ্চর্য এবং ব্যাখ্যাহীন দিক হলো, এটি যেন থামতেই চাইছিল না। যেন কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে এটি নিজেকে টিকিয়ে রাখার কৌশল শিখে ফেলেছিল এবং বেশ কিছুটা সময়ের জন্য এটি তা করতে সফলও হয়।

শোনা যায়, এই মন্তব্য শুনে চার্লস ম্যাকলাফলিনের শিক্ষক মরিস শিলটন বলেছিলেন, ম্যাকলাফলিনের কিছুদিন ছুটি নিয়ে কোনো সামুদ্রিক অবকাশ যাপনকেন্দ্রে ঘুরে আসা উচিৎ। তাঁর ওপর চাপ পড়ে যাচ্ছে।

ঝড়ের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ঝড়প্রবণ এলাকা বঙ্গোপসাগরের কথা না বলে পারা যায় না। ভারত মহাসাগরের উত্তর অংশে এই উপসাগর একদিক থেকে বলতে গেলে ঘূর্ণিঝড়ের উর্বর বীজতলা। এখানে প্রতিবছর যত লঘুচাপ তৈরি হয়, তা দুনিয়ার আর কোথাও হয় না। আর এসব লঘুচাপের অনেকগুলোই গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে ঘূর্ণিঝড়ের আকার নিয়ে ফেলে। তারপর ছুটে যায় ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে থাকা উপকূলের দিকে। তামিলনাড়ুর বিশাখাপত্নম থেকে শুরু করে উড়িষ্যা উপকূল, বাংলা ভূখণ্ডের কলকাতা, খুলনা, চট্টগ্রাম আর মিয়ানমারের আকিয়াব পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গা এদের টার্গেট। মহাকাশ থেকে কেউ যদি একটা পুরো মৌসুম এ অংশের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাহলে তাঁর মনে হবে, সমুদ্র যেন একটার পর একটা ঘূর্ণিঝড়ের গোলা ছুড়ে মারছে এ উপকূলের দিকে। শুরু হয় জুলাই মাস থেকে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে।

এ রকমই একটি ঘূর্ণিঝড়ের মুখে পড়েছিলেন ফরাসি পর্যটক ফ্রাসোয়া বার্নিয়ের। ইনি পেশায় চিকিৎসক। দার্শনিকও ছিলেন। ১৬৫৯ সালে তিনি ভারতবর্ষে পা রেখে বছর চারেক দিল্লিতে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের চিকিৎসক ছিলেন। তারপর মোগল দরবার থেকে তিনি আবার বেরিয়ে পড়েন। শুরু করেন ঘোরাঘুরি, সারা ভারতবর্ষে। তো এ রকম ঘুরতে ঘুরতে তিনি ১৬৬৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলা অঞ্চলে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন আরেক ফরাসি পর্যটক তাভের্নিয়ের। তাঁরা একসঙ্গে রাজমহল পর্যন্ত এসেছিলেন। এখান থেকে দুই পর্যটক বন্ধু আলাদা হয়ে যান। তাভের্নিয়ের রওনা দেন পুবে। গন্তব্য ঢাকা, বিশেষ করে সোনারগাঁও। তিনি জহুরি। ইউরোপ থেকে মণিমাণিক্য এনে স্থানীয় রাজা-বাদশা, আমির-ওমরাদের কাছে বিক্রি করা তাঁর ব্যবসা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আওরঙ্গজেবের মামা বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানের দরবারে পৌঁছানো। ওদিকে বার্নিয়ের রওনা দিলেন দক্ষিণে, কাসিমবাজারের উদ্দেশে। সেখান থেকে নদীপথে আরও দক্ষিণে নেমে তিনি সুন্দরবন এলাকার দিকে চলে যান। ভোলা-ঝালকাঠি এলাকায়ও তখন সুন্দরবনের ঘন জঙ্গল। মগ জলদস্যুদের উৎপাতে এসব দ্বীপ তখন জনশূন্য। এ রকমই এক জঙ্গলের খাড়িতে এক রাতে ঘূর্ণিঝড়ের মুখে পড়েন বার্নিয়ের। বাংলার ঝড় কী জিনিস, ইউরোপের চিকিৎসক সেটা স্বচক্ষে দেখে ভড়কে যান। বলতে গেলে তাঁর শিক্ষা হয়ে যায়। অনেক পরে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে তিনি যে ভ্রমণকাহিনি লেখেন, সেখানে এই ঝড়ের কথা তিনি বিস্তারিত লিখেছেন।

বার্নিয়ের লেখেন, ‘পঞ্চম রাত ছিল ভীষণ বিপজ্জনক। সে রাত্রে ভীষণ এক ঝড় ওঠে। আমরা যদিও গাছের তলায় বেশ নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলাম আর আমাদের নৌকা বেশ ভালোভাবে বাঁধা ছিল, তবু আমাদের দড়ি ছিঁড়ে যায়। আরেকটু হলেই আমরা বড় খাড়ির দিকে ভেসে যেতাম আর শেষ হয়ে যেতাম। আমি আর সেই দুজন পর্তুগিজ সে সময় হঠাৎ একটা গাছের ডাল ধরে ফেলতে পারি আর তা–ই ধরে আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা ছিলাম। ঝড় তখন প্রবল বেগে বইছে। এদেশি দাঁড়িদের কাছ থেকে কোনো সাহায্যের আশাই ছিল না। তাঁরা তখন ভয়ে মৃতপ্রায়। সেই গাছ জড়িয়ে ধরে থাকার সময় আমাদের অবস্থা যে বেশ কষ্টকর ছিল, তা বলাই বাহুল্য। তার ওপর এমন বৃষ্টি পড়ছিল যে মনে হচ্ছিল কেউ যেন বালতিতে করে পানি ঢেলে দিচ্ছে। আর চারদিকে কেবল বিদ্যুতের আলো আর বজ্রের গর্জন। সেই ভয়ংকর রাতে আমরা জীবনের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।’

বাংলার ঝড়ের সেই রুদ্রমূর্তি ফরাসি এ দার্শনিকের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক উপলব্ধির একটা বাঁকবদল ঘটেছিল এখান থেকে। শোনা যায়, ইউরোপে ফিরে তিনি তাঁর এক বন্ধুর কাছে এ ঝড়ের এক অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ঝড়টি নাকি মানুষের মতো গোঙাচ্ছিল। যেন এক অচেনা ভাষায় কথা বলছিল এ ঝড়। আর সেটা কথা বলছিল তাঁরই উদ্দেশে।

ঘন শ্বাপদসংকুল জঙ্গলের মধ্যে ও রকম এক দুর্বিপাকে অনেক উদ্ভট জিনিসই মনে হয়ে থাকতে পারে বার্নিয়েরের। সেটাকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।

এর প্রায় ২০০ বছর পর ১৮৭৬ সালের অক্টোবরে ভোলা-নোয়াখালী উপকূলে আরেক ঐতিহাসিক ঝড় আঘাত হানে। বাংলা তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ। ফলে এই ঝড়ের অনেক লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় ইংরেজ প্রশাসকদের নথিপত্রের বরাতে। বিশেষ করে আবহাওয়াবিদেরা এই ঝড়ের গতিপথ অনুসরণ করতে পেরেছিলেন প্রায় একালের মতোই বিস্তৃতভাবে। তাঁদের হিসাব অনুযায়ী এ ঝড়ের জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে। ৩০ অক্টোবর এটি রওনা দিয়েছিল উত্তর দিকে। ‘ব্রিটিশ সেপ্টার’ নামের একটি সওদাগরি জাহাজের ক্যাপটেন সাগরের ভেতর এ ঝড়কে এগিয়ে যেতে দেখেন। অজস্র ঘূর্ণায়মান মেঘের রাশিকে পুঞ্জীভূত করে এটি এমনভাবে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছিল যে দেখে তাঁর মনে হয়েছে, এক সমুদ্রদানব ছুটে চলেছে প্রবল পদবিক্ষেপে। মেঘনা উপকূলে ঢুকে এটি যে প্রলয়কাণ্ড ঘটায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে, তার নজির পাওয়া ভার। লন্ডভন্ড অবস্থা। সোয়া দুই লাখ লোক মারা যায় এ ঝড়ে। ঢাকায় তখন বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন ফ্রেডেরিক পিকক। তিন দিন পর তিনি বাকেরগঞ্জের কমিশনারের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ করে কলকাতার সদর দপ্তরে পাঠান। তাতে তিনি অনেক কিছুর পাশাপাশি ফুটনোটে নোয়াখালীর তাঁতিদের এক অস্বাভাবিক দাবির কথা উল্লেখ করেন। তাঁদের দাবি, এ ঝড় তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিল। হাতিয়া চরের এক মসজিদের ইমাম নাকি মিনারে উঠে সোজা তাকিয়ে ছিলেন ঝড়ের চোখের দিকে। ‘ঝড়ের চোখ’ বলতে গ্রামের লোকেরা কী বুঝিয়েছে, গোরা বিভাগীয় কমিশনার তা আর ব্যাখ্যা করতে পারেননি। গ্রামের লোকেরা নানান কুসংস্কারে ভোগে।

এ ঘটনার ১৫০ বছর পর ২০১৫ সালে প্যারিসে আমার দেখা হয়ে যায় বলিভিয়ার অ্যামেচার আবহাওয়াবিদ ভিনসেন্ত হুদোব্রোর সঙ্গে। ওই সময় প্যারিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বসেছিল জাতিসংঘের আয়োজনে। সারা দুনিয়ার জনপ্রতিনিধিরা তাতে হাজির হয়েছিলেন। হাজির হয়েছিলেন আবহাওয়াবিদ ও বিজ্ঞানীরা। সেটা ছিল পৃথিবী নামক গ্রহটিকে এক আসন্ন অমোঘ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে দুনিয়ার বুদ্ধিমান লোকেদের ‘শেষ সম্মিলিত চেষ্টা’। মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে পৃথিবী ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে। আর সে কারণে উল্টেপাল্টে যাচ্ছে আবহাওয়ার ভারসাম্য। পুরো গ্রহে ডুমস ডে বা কেয়ামত ঘনিয়ে আসছে। পৃথিবীর সবাই হাতে হাত মিলিয়ে এ মহাদুর্যোগ ঠেকাতে এখনই পদক্ষেপ না নিলে মানুষের সভ্যতার ইতি ঘটতে পারে।

ওই কনফারেন্সে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়, সেটা ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ নামক একটি কমিটির তৈরি করা। এটি দুনিয়ার বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের একটি কমিটি। তারা সেবার যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন, তাতে বলা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রে লঘুচাপ, লঘু নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং যেটাকে সুপার সাইক্লোন বা অতিকায় ঘূর্ণিঝড় বলা হয়, সেটির সংখ্যাও বাড়ছে। আগামীতে ঝড়ের সংখ্যা এভাবে বাড়তেই থাকবে।

জলবায়ু সম্মেলনের বদ্ধ কক্ষের ভেতর মানবজাতির জন্যে এসব বিষণ্ন দুঃসংবাদ উপস্থাপনের পালা চললেও বাইরে এ আসরকে কেন্দ্র করে পুরো প্যারিস শহর উৎসবে মেতে উঠেছিল। সারা দুনিয়ার সাংবাদিকেরা এটি কাভার করতে ভিড় জমিয়েছিলেন তো বটেই, আরও হাজির হয়েছিলেন পৃথিবীর জন্য উদ্বিগ্ন অ্যাক্টিভিস্ট, গায়ক, অভিনেতা ও সেলিব্রিটিরা। সেই সঙ্গে প্যারিসজুড়ে তখন গিজগিজ করছিলেন দুনিয়ার তাবৎ অ্যামেচার বা হাতুড়ে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ। জলবায়ুকর্মীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁরাও রাস্তার মোড়, ক্যাফে বা রেস্তোরাঁ—যেখানে পাচ্ছিলেন, লোকজনকে ডেকে ছোটখাটো ভিড় জমিয়ে খালি কণ্ঠে তাঁদের গবেষণার ফলাফল প্রচার করছিলেন। এ যেন কে কত বড় দুঃসংবাদ দিতে পারে, তার প্রতিযোগিতা। কেয়ামতের উৎসব।

এ রকমই এক জটলার মধ্যে আমি ভিনসেন্ত হুদোব্রোর দেখা পাই। তার দিকে আমার চোখ যায়, কেননা সে বৃহস্পতি গ্রহের একটা স্যাটেলাইট ছবির প্রিন্ট দুই হাতে তুলে ধরে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বক্তৃতা দিচ্ছিল। অবসাদের কারণে তার বক্তৃতা আমার কানে পৌঁছাচ্ছিল না। তবে বৃহস্পতি গ্রহের ওই ছবি আমি চোখ থেকে তাড়াতেও পারছিলাম না। কাছেই একটি বেঞ্চে বসে আমি তাকিয়ে ছিলাম সেটার দিকে। হাবল টেলিস্কোপের তোলা ছবি। বৃহস্পতি গ্রহের আকাশে পাক খেতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম মেঘের মধ্যে একটা লালচে গোলাকার দাগ। একটা ঝড়। স্থায়ী। কোন কালে সেটা শুরু হয়েছিল, কেউ জানে না। কবে শেষ হবে, অনুমান করার উপায় নেই। কিন্তু দূর গ্রহের এক অপ্রাসঙ্গিক ঝড় নিয়ে কেন মাথাব্যথা এই শৌখিন বিজ্ঞানীর, সেটা মাথায় ঢুকছিল না।

হুদোব্রোর গড়ন লম্বা, একহারা। টিকোলো নাক, প্রশস্ত কপালে কিছুটা রেড ইন্ডিয়ানদের আদল। লম্বা চুল পনিটেইল করা। ছেঁড়া জিন্স, টি-শার্টে তাঁকে গবেষকের চেয়ে বরং রকস্টার বলে মনে হচ্ছিল।

বাংলাদেশের এক অখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে আমি ওই দিনই প্যারিসে পা রেখেছি এবং সস্তায় কোনো হোটেলকক্ষ জোগাড় করতে না পারায় রাতটা প্যারিসের গ্যারে দু নর্দ রেলস্টেশনে কাটিয়ে দেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। দৈবের বশে প্ল্যাটফর্মে আমার ঠিক করে রাখা বেঞ্চটার দখল নিয়ে নেয় ভিনসেন্ত এবং এ নিয়ে দুজনে বচসায় জড়ানোর বদলে কাগজের কফির ঠোঙা আর সিগারেট হাতে রাতটা গল্পগুজব করে নির্ঘুম কাটিয়ে দেওয়া উত্তম হবে বলে আমরা একমত হই।

ভিনসেন্তের ইংরেজি ভালো নয়। তার ওপর তার তোতলামি এবং বাচালতা রোগ আছে। ফলে তার নিজস্ব গবেষণার নামে সে যা তুলে ধরে, তা কতটা তার নিজস্ব, আর কতটা ভাষার দূরত্বহেতু আমার নিজের কল্পনা, আমি সীমানা টানতে পারব না। শুধু এটুকু বলা যায়, ভিনসেন্তের অনুসিদ্ধান্তের মধ্যে বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের চেয়ে ফ্যান্টাসির মালমসলাই বেশি ছিল।

ভিনসেন্ত বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া গত ২০০ বছরের সব লঘুচাপ, লঘু নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতির উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে পৃথিবীতে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে বটে, তবে তা অন্ধ, উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘটছে না। তা ঘটছে একটি সুনির্দিষ্ট অভিমুখে। জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও স্থায়িত্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। যেন বা কেউ ঘূর্ণিঝড়ের অনুকূলে গোপনে, কৌশলে পুরো পৃথিবীকে ঢেলে সাজাচ্ছে। আর ভিনসেন্তের অনুমান, এর পেছনে ঘূর্ণিঝড়গুলোর নিজেদের হাত আছে।

তার মানে? আমি সবিস্ময় জিজ্ঞেস করি।

তার মানে হলো, ঘূর্ণিঝড়রা নিজেরা নিজেদের টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আর তাদের টিকে থাকার স্বার্থে তারা পৃথিবীর সম্পদগুলো ব্যবহার করছে।

আমি ভিনসেন্তের দিকে বিশেষ অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছি দেখে সে বলল, তুমি গাইয়া হাইপোথিসিসের নাম শুনেছ? শোনোনি? বলি। জেমস লাভলক নামের এক আবহাওয়াবিদ এমন এক অদ্ভুত কথা শোনালেন, যা আমরা কেউ শুনতে প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন, পৃথিবীর সব জীব আসলে একটা অভিন্ন জৈবসত্তা আর এই সত্তার নাম তিনি দিলেন ‘গাইয়া’। এই সত্তা কী করে? কী চায়? সে চায় নিজেকে টিকিয়ে রাখার উপযুক্ত করে পৃথিবীর পরিবেশকে, জলবায়ুকে সাজাতে। ঠিক যতটুকু অক্সিজেন আর কার্বন ডাই-অক্সাইডের অনুপাত হলে প্রাণ টিকে থাকার সুবিধা, গাইয়া বা মহাপ্রাণ ঠিক সেই অনুপাত টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে, আবহাওয়াকে সেভাবে সাজায়। এখন ঘূর্ণিঝড়রা নিজেরা যদি নিজেদের টিকিয়ে রাখতে, নিজেদের সারভাইভালের উপযোগী করে পৃথিবীটাকে সাজাতে শুরু করে, সেটা দেখতে কেমন হবে? সেটা দেখতে হবে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের মতো।

তা, ঘূর্ণিঝড়রা কি চিন্তা করতে পারে? তাদের কি প্রাণ আছে? আমি বললাম।

এখানেই তো বন্ধু আসল ভুলটা করো তোমরা, ভিনসেন্ত বলল তার কফির মগ একটা ওয়েস্ট বিনের দিকে ছুড়ে দিয়ে, তোমরা ‘চিন্তা করতে পারা সত্তা’ বা সেন্টিয়েন্ট বিং এবং প্রাণকে অবিচ্ছেদ্য মনে করো। এটা ভুল ধারণা। কিংবা প্রাণের কথাই ধরো। তোমরা প্রাণ এবং জীবদেহকে অবিচ্ছেদ্য ধরো। যেন একটা ছাড়া আরেকটা থাকতে পারে না। কে বলেছে? প্রাণ নামক জিনিসটার যদি কোনো সত্যিকার বৈশিষ্ট্য থেকে থাকে, সেটা হলো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পুরো গ্রহের সম্পদকে ব্যবহার করতে পারার, ম্যানিপুলেট করতে পারার ক্ষমতা। এসব ঘূর্ণিঝড় ঠিক সেটাই করছে। যেমনটা করতে পেরেছে বৃহস্পতি গ্রহের ওই ঘূর্ণিঝড়, যেটার নাম আমরা দিয়েছি গ্রেট রেড স্পট। পুরো গ্রহের সব সম্পদ কাজে লাগিয়ে এবং অন্য সব ছোটখাটো ঝড়কে আত্মীকৃত করে এ ঝড় সফলভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে অনাদি, অনন্তকাল। সম্ভবত পৃথিবীতে ডাইনোসরদের চেয়ে বেশি পুরোনো এ ঝড়। মানুষের বিদায় নেওয়ার পরও এটা টিকে থাকবে। যদি ‘জীবিত’ কথাটা নিতে তোমার আপত্তি থাকে, তাহলে অন্তত এটুকু অনায়াসে বলতে পারো যে এই ঝড় বৃহস্পতি গ্রহের একমাত্র ‘সেন্টিয়েন্ট বিং’ বা চিন্তাশীল সত্তা। আর সবচয়ে খারাপ খবর হলো, সেটা অন্য গ্রহগুলোয় ইনভেড করতে শুরু করেছে।

মানে?

এই ঝড় তার সন্তান-সন্ততিদের পাঠাতে শুরু করেছে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহে।

কীভাবে?

আমি জানি না।

পৃথিবীতেও?

হ্যাঁ। পৃথিবীতেও। কবে এখানে তাদের পদার্পণ ঘটেছে, বলতে পারব না। হেরোডোটাস যে ঝড়ের বিবরণ দিয়েছেন, হতে পারে, সেটা এই জায়ান্ট রেড স্পটেরই বংশধর।

তার মানে এলিয়েন ইনভেশন এখানে ঘটেছে?

ঘটেছে। আর, আনফরচুনেটলি মাই ফ্রেন্ড, সেটা ঘটেছে ঘূর্ণিঝড়ের আদলে।

মানুষকে রক্ষা করার উপায় কী তাহলে?

উপায় খোঁজার দরকার কী? কোষভিত্তিক এই প্রাণব্যবস্থাকে কেন টিকিয়ে রাখতেই হবে? এটা তো অলরেডি অচল, তামাদি হয়ে যেতে শুরু করেছে। প্রাণের ভিন্ন এবং উন্নততর পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোর জন্য আমাদের জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি থাকতে হবে, ডিয়ার কার্বনবেজড বাইপেডস।

ওরা আমাদের চেয়ে উন্নত? কী অর্থে?

অনেক অর্থে। আমি শুধু একটা দিকের কথাই বলব। মহাবিশ্বকে তার সঠিক চেহারায় বুঝতে পারার ক্ষেত্রে ওরা, মানে ঘূর্ণিঝড়েরা আমাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে। আমাদের চিন্তা একটা কারাগারে বন্দী। ইন্দ্রিয়ের কারাগার। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় আমাদের সামনে একটা বিকৃত, অসত্য বিশ্বজগতের বিভ্রম হাজির করে। বিপরীতে ওদের চিন্তাকে কোনো ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করতে হয় না। ফলে বিভ্রমের কোনো ফাঁদে পা না দিয়ে ওরা পুরো জগতটাকে তার সত্যিকার রূপে দেখতে পায়। দার্শনিক কান্ট যে ‌‘থিং-ইন-ইটসেলফ’-এর কথা বলেছেন, ওরা সেই ‘থিং-ইন-ইটসেলফ’-কে দেখতে পায়।

এটাকে তুমি ‘দেখতে পাওয়া’ বলবে?

অবশ্যই। চোখ না থাকলেই তুমি সবচেয়ে ভালো দেখতে পাবে। চলো, ভোরের ট্রেন আসছে। আমরা সেন্ট্রাল প্যারিসে সম্মেলনস্থলের উদ্দেশে রওনা হই। আগে গিয়ে জায়গা দখল করি।

দক্ষিণ দিক থেকে একটা ট্রেন আসছে। তার পেছনে আকাশে একটা ফ্যাকাশে হলুদ আলোর রেখা। টের পেলাম একটা ঝড় আসছে। হয়ত এটাও অন্য কোনো বড় ঝড়ের বংশধর।