বাজারে অনেক দরদাম করে সাড়ে তিন কেজি ওজনের যে বোয়াল মাছটা মাত্র ৬৪৬ টাকা দিয়ে কিনেছেন চৌধুরী মোহাম্মদ এহতেশাম, সেটার সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কী সম্পর্ক?
কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়।
কিন্তু বলা হচ্ছে, সম্পর্ক আছে।
অভিযোগ করা হচ্ছে, এই বোয়াল মাছ কেনার মধ্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে গভীর ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
তাঁর মুখের ওপর এ মুহূর্তে এই অভিযোগই করা হলো। যে লোক অভিযোগ করল, তাকে দেখতে পেলেন না এহতেশাম। শুধু তার শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠস্বর শোনা গেল। লোকটাকে দেখতে না পাওয়ার কারণ, চৌধুরী এহতেশামের চোখ এ মুহূর্তে একটা কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা। হাতও বাঁধা পিঠমোড়া করে একটা চেয়ারের সঙ্গে।
নিজের ইচ্ছায় এখানে আসেননি চৌধুরী এহতেশাম। তাঁকে জোর করে আনা হয়েছে। মাছ কিনে বাসায় ঠিকা বুয়াকে কুটতে দিয়ে তিনি নিচে নেমেছিলেন ভুলে যাওয়া গরমমসলা কিনতে। বাসার সামনে থেকে কয়েকজন লোক তাঁকে একটা সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। তারপর চোখ বেঁধে তাঁকে কোথায় যে আনা হয়েছে, তিনি ঠাহর করতে পারছেন না।
এখন তাঁকে ঘিরে অনেক কিছু ঘটছে। যেমন এই মুহূর্তে তাঁকে জেরা করা হচ্ছে—রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করাসংক্রান্ত বিষয়ে জেরা।
তবে এহতেশাম এদের প্রশ্নগুলোই ঠিকমতো ধরতে পারছেন না। বিশেষ করে, এরা বারবার ঘুরেফিরে সকালবেলায় মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট থেকে সস্তায় কেনা বোয়াল মাছটার প্রসঙ্গে আসছে কেন, তিনি বুঝতে পারছেন না। ‘বোয়াল’ শব্দটা কেমন শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করছে এরা, যেন এটা কোনো মাছের নাম নয়, অন্য কিছু। জানতে চাইছে, সেটা ঠিক কত দামে কিনেছেন তিনি, ওজন কত ছিল, কিনে বাসায় নিয়ে বঁটি দিয়ে কাটা হয়েছে, নাকি বড় নাইফ দিয়ে, আঁশ দোকানেই ছাড়ানো হয়েছে, নাকি রান্নাঘরে ইত্যাদি মামুলি সব বিষয়ে প্রশ্ন। বোয়াল মাছের যে আঁশ হয় না, এদের তিনি এই সরল ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
চৌধুরী এহতেশাম পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা বাদ দিয়েছেন। তাঁর মাথায় এখন একটা প্র্যাকটিক্যাল দুশ্চিন্তা উঁকি দিচ্ছে। এখন সম্ভবত ১০টা বেজে গেছে। তাঁর এখন থাকার কথা নতুন বাজারে সানশাইন ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দ্বিতীয় তলায়। সেখানে প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড অব স্যাম্পল কালেক্টর তিনি। রোগীদের ব্লাড, স্টুল, ইউরিনের স্যাম্পল কালেক্ট করতে হয় তাঁকে। আজ রমেশের ডিউটিটা তাঁকে বাড়তি করতে হবে। এক্সচেঞ্জ।
তিনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমাকে এভাবে ধরে এনেছেন কেন? কী চান আপনারা?’
কেউ এ প্রশ্নের জবাব দিল না। ‘কেউ দিল না’ বলা হলো এ কারণে যে উত্তর না দেওয়ার কাজটা বেশ কয়েকজন মিলে করল। চৌধুরী এহতেশাম আসলে টের পাচ্ছিলেন তাঁর চারপাশে বেশ কয়েকজন লোক আছে, যদিও তাঁর সঙ্গে কথা বলছে মাত্র একজনই।
শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠস্বরটা বলল, আপনার এত তাড়া কিসের?
তাড়া আছে। ঠিক ১০টার সময় সানশাইন ক্লিনিকে থাকতে হবে আমাকে। না হলে রমেশের চাকরি যাবে।
*
প্রৌঢ় লোকটার চোখে আতঙ্ক। দুবার ঢোঁক গিলল। একটা উদ্যত ছুরির ফলার দিকে তাকিয়ে আছে যেন। অথচ জিনিসটা মাত্র ২১ গেজ পুরুত্বের একটা মামুলি ভেনিপাংচার নিডল। মাত্র ২১ গেজ! চিন্তা করা যায়! আজকাল এরা সুইগুলোকে এমন সুতার মতো ফিনফিনে বানিয়ে ফেলেছে, দেখে বিশ্বাস করা কঠিন এর ভেতর দিয়ে রক্ত এসে জমা হবে টেস্টটিউবে।
আমি কি ব্যথা পাব? লোকটা ঢোঁক গিলে জানতে চাইল।
সামান্য পিঁপড়ার কামড়ের মতো।
লোকটা এমনভাবে মাথা দোলাল, যেন সম্মতি দিচ্ছে সুচ ফোঁড়ানোর।
কায়েদে আজম জিন্নাহর মতো শুকনা পাটকাঠি চেহারা। এ রকম লোকের হাত থেকে রক্ত নেওয়া সবচেয়ে সোজা। লোকটার বাঁ বাহুতে স্ট্র্যাপ বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে মেডিয়ান কিউবিটাল ভেইন দারুণ ফুলে উঠেছে। সুচ ফোঁড়ানোর সময় লোকটা মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে শিশুদের মতো চোখ বন্ধ করে রাখল, যেন জীবনে প্রথম রক্তের নমুনা দিচ্ছে।
একটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো—লোকটা একা এসেছে। এই বয়সের একটা অসুস্থ লোক একা চলাচল করে মানে লোকটা যথেষ্ট সাহসী। এই লোকই হয়তো অন্য সময় কবজি কেটে ফেলার জন্য সার্জনের করাতের দিকে অবলীলায় পুরো হাত এগিয়ে দেবে, অথচ এখন সামান্য ভেনিপাংচার নিডলের দিকে তাকাতে পারছে না।
রক্ত দেওয়া শেষ হলে লোকটার হাতে টিস্যুপেপারে মোড়ানো একটা টেস্টটিউব ধরিয়ে দিলেন এহতেশাম। ইউরিন স্যাম্পল। লোকটা বাধ্য ছেলের মতো সেটা নিয়ে ঢুকে গেল বাথরুমে। দীর্ঘ সময় লাগাল। এর মধ্যে এক দল পেশেন্ট ঢুকে পড়েছে। চৌধুরী এহতেশামের কিউবিক্যালে এল সাত বছর বয়সী এক শিশু। সঙ্গে মা-বাবা তো এসেছেনই, এক প্রভাবশালী, হম্বিতম্বি করা মামাও এসেছেন। শিশুটি কিছুতেই সুচ ফোঁড়াতে দেবে না। হাউমাউ করে কাঁদছে, হাত-পা ছুড়ছে। এই মহা হুলুস্থুলে প্রৌঢ় লোকটার কথা ভুলেই গেলেন এহতেশাম। লক্ষ করলেন না লোকটা কখন ইউরিনভর্তি টেস্টটিউব হাতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এক কোনায় ইউরিন স্যাম্পল রাখার র্যাকে টেস্টটিউব রেখে বেরিয়ে গেছে।
দুপুরের দিকে রোগীর চাপ অনেক কমে গেলে চৌধুরী এহতেশাম তাঁর কিউবিক্যালে একটা জিনিস পড়ে থাকতে দেখলেন—একটা বই। কেউ ভুলে ফেলে রেখে গেছে। সেই প্রৌঢ় লোকটা হবে। তবে লোকটার হাতে কোনো বই ছিল কি না, মনে পড়ছে না। চৌধুরী এহতেশাম ভেতরে স্টুল স্যাম্পল রাখার টেবিলের এক কোনায় সরিয়ে রাখলেন বইটা। যার বই, সে নিশ্চয়ই খোঁজ করবে।
*
সন্ধ্যায় ডিউটি শেষ হলো। চৌধুরী এহতেশাম সদর রাস্তায় পা দিয়েই টের পেলেন কেউ একজন তাঁর পিছু নিয়েছে। তাঁদের ক্লিনিকের সামনেই ফুটপাতের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। সিগারেট ফুঁকছিল। তিনি রাস্তায় নেমে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দিলে লোকটা সিগারেট ফেলে একটু দূরত্ব রেখে হাঁটতে শুরু করল। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকল তাঁর ঠিক পেছনে।
চৌধুরী এহতেশাম এমন একটা বিআরটিসি বাস বেছে নিলেন, যেটায় বাদুড়ঝোলা ভিড়। শেষ মুহূর্তে ছুটে গিয়ে পাদানিতে পা রেখে হাতল ধরে ঝুলে পড়লেন। সঙ্গের লোকটাও ছুটে এসেছিল। ঠেলেঠুলে ঝুলে পড়ার চেষ্টাও করল। কিন্তু পাদানিতে বাড়তি একটা পা রাখারও জায়গা নেই। লোকটা উঠতে পারল না। কোমরে হাত দিয়ে লোকটা অসহায় চোখে দাঁড়িয়ে থাকল। তাকিয়ে থাকল অপস্রিয়মাণ বাসের দিকে। এই সাফল্যে একটা ফিচেল হাসি ফুটে উঠল চৌধুরী এহতেশামের মুখে। বাসটা যখন মালিবাগে নতুন ফ্লাইওভারে উঠছে, তিনি নেমে পড়লেন। এই বাস মোহাম্মদপুর রুটের না। টিকটিকি লোকটাকে ঝেড়ে ফেলার জন্যই তিনি এটায় উঠেছেন।
*
রাতে খাবার টেবিলে মিলি গজগজ করছিল। আজ কারও পাতে কোনো আমিষ নেই। আলুর চচ্চড়ি, বেগুনভর্তা আর ডাল দিয়ে খেতে হবে। দুই পিস মুরগির মাংস আলাদা করে রাখা ছিল টুকুনের জন্য। ফলে শুধু তার পাতেই সামান্য আমিষ।
কেন? সকালে একটা আস্ত বোয়াল মাছ কিনে দিয়ে গেলাম যে?
ওমা কিনে দিয়ে যাওয়ার পরেই না অফিসের লোক পাঠিয়ে মাছ ফিরিয়ে নিয়ে গেলা!
এহতেশামের মুখ হাঁ হয়ে গেল। তিনি তো কাউকে পাঠাননি।
মিলি রান্নাঘরে আসা-যাওয়া করতে করতে ছেঁড়াছেঁড়াভাবে যা বলল, তা শুনে এহতেশামের যাকে বলে আক্কেলগুড়ুম।
সকালে এহতেশাম নিচে নামার পরপরই দুজন লোক আসে বাসায়। জোর করে ঢুকে পড়ে তারা। সোজা চলে যায় রান্নাঘরে। জানতে চায়, বোয়াল মাছটা কোথায়?
কাজের বুয়া আকলিমা ততক্ষণে পিস পিস করে কেটে ফেলেছিল মাছটা। শুধু তা-ই না, একটা অংশে লবণ-হলুদ মাখিয়ে ভাজার উপক্রম করেছে। দুটো টুকরো আধা ডুবো তেলে ছেড়েও দেওয়া হয়েছিল। বাকি কয়েকটি ভাগা প্লাস্টিকে র্যাপিং করে এক কোনায় রাখা হয়েছিল ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখার জন্য।
লোক দুজন সব কটি টুকরা টপাটপ ঢুকিয়ে ফেলল তাদের সঙ্গে রাখা ব্যাগে। এমনকি গরম কড়াইয়ের ওপর থেকে আধা ভাজা টুকরো দুটিও ঢুকিয়ে ফেলা হলো ব্যাগে। তা করতে গিয়ে একটা লোক আঙুলে গরম তেলের ছ্যাঁকা খেয়ে ‘খ্যাঁক’ করে উঠল। আরেকটি লোক ময়লা ফেলার ঝুড়িতে হাত ঢুকিয়েই ‘উফ্’ বলে আর্তনাদ করে উঠল—মাছের কাঁটা ফুটেছে বুড়ো আঙুলে। ঝুড়ি ঘেঁটে মাছের ফেলে দেওয়া নাড়িভুঁড়ি, কানকো সবই ভরে ফেলা হলো আরেকটা ব্যাগে।
দ্রুত পেশাদার ভঙ্গিতে কাজ করল লোকগুলো। এই পুরো সময়টা আতঙ্কিত মিলি এসে তিনবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তারা কে? কী চায়?
লোকগুলো ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে জানিয়েছে, তারা এহতেশামের অফিসের লোক। মাছটা নিয়েই তারা চলে যাবে।
মিলি বারবার ফোন করেও এহতেশামকে পায়নি। তার ফোন বন্ধ ছিল।
এহতেশাম অবশ্য আর বললেন না যে ওই মুহূর্তে তিনি চোখ বাঁধা অবস্থায় কতগুলো লোকের জেরার জবাব দিচ্ছিলেন।
*
রাতে বিছানায় গা এলিয়ে চৌধুরী এহতেশাম টের পেলেন, তাঁর মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। সারা দিনে তাঁকে ঘিরে ঝোড়োগতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মাথার ভেতরে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কোনটা যে আগে ঘটেছে, কোনটা পরে, তিনি সঠিক ক্রমে স্মরণ করতে পারছেন না।
এখন ঠান্ডা মাথায় ভাবতে গিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো একটা অনুভূতির মুখোমুখি হচ্ছেন, যেটা সারা দিনে টেরই পাননি। আর তা হলো ভয়। কিছু লোক যখন তাঁকে তুল নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ উল্টোপাল্টা জেরা করল, তারপর তাঁর ক্লিনিকের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল, আবার বিকেলে যখন একটা অপরিচিত লোক তাঁকে খামোখাই অনুসরণ করল, সব কটি ঘটনার সময়ই তিনি তীব্র আতঙ্কে ভুগেছেন। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে ভয়টা তিনি তখন অনুভব করেননি। এখন সেই সব বকেয়া ভয় যেন ফিরে আসছে। তিনি থরথর করে কাঁপছেন।
শুরুতে তিনি ভেবেছিলেন, পুরো ব্যাপারটা কোনো ঠাট্টা। কেউ তাঁর সঙ্গে রগড় করছে। কিংবা কোথাও কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। তাঁকে অন্য কেউ ভেবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে কোথাও ভুল হচ্ছে না। তিনিই টার্গেট। কেন? কী চায় তারা তাঁর কাছে?
একটা জিনিস এহতেশাম এখন নিশ্চিত বুঝতে পারছেন, মাছের ব্যাপারটা সিরিয়াস। নিরীহ চেহারার ওই ড্যাবড্যাবে চোখের মাছটার মধ্যে কোনো একটা ব্যাপার আছে। কী সেটা?
ইশ্, কেন যে তিনি সকালবেলা মাছ কিনতে গেলেন!
রাত তিনটা বেজে গেছে। বিছানায় মাঝখানে টুকুন শুয়ে আছে। ওপাশে মিলি। দুজনেই ঘুমাচ্ছে।
এহতেশাম বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। নিচে মহল্লার রাস্তার একটা অংশ দেখা যায়। একটা ডাস্টবিনের পাশে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। এই বাসার দিকেই তাকিয়ে আছে।
একটা লোককে চিনতে পারলেন এহতেশাম। আজ এই লোকই বাসস্ট্যান্ডে পিছু নিয়েছিল।
*
দুইটা লোক আমার কাছে আইছিল। সকালে আপনে মাছ কিন্ন্যা গেছেন, তার ঘণ্টাখানেক পর। দুইজনারই সানগ্লাস পরা। আজিব আজিব সব কথা জিগায়। জিগায়, আপনের কাছে মাছ বেচছি ক্যান। কী জবাব দিমু, কন! আপনে রেগুলার কাস্টমার। আপনার কাছে মাছ বেচুম না তো কার কাছে বেচুম। আর খালি জানতে চায়, বোয়াল মাছটা কার কাছ থাইকা আনছি। আমার সাপ্লাইয়ের নানান লোক আছে। কাওরান বাজার থাইকা মাছ আইনা দেয়। তয় এই মাছ কাওরান বাজার আড়ত থাইক্কা আসে নাই। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ থাইক্কা আসছে। বেড়িবাঁধের সাপ্লাই আসলাম শেখের। কইলাম। তখন তারা কয় আসলাম শেখের নাম-ঠিকানা দে। দিলাম। লোক দুইজন এমন হনহন কইরা চইলা গেল, মনে হইল অহনই আসলাম শেখের খোঁজে যাইতাছে। হালার পুতের খবর আছে। ইদানীং খুব উল্টাপাল্টা সাপ্লাই দিতেছে।
হেরপর স্যার আরেক আজিব কাণ্ড বিকেলবেলা। সানগ্লাস পরা আরও দুইজন লোক আইল। সকালের দুইজন না। সকালের দুইজন ছিল লম্বা কিসিমের। এই দুইজন বাইট্টা। আইসা একই মশকরা। বোয়াল মাছের কথা জানতে চায়। জিগায় কার কাছে বেচছি। আমি আর সহ্য করতে পারি নাই। খেইপা মারতে গেছিলাম। ভুল করছি স্যার। বিরাট ভুল করছি জীবনে। হেরা কুংফু-কারাত জানে। এমন কইরা প্যাঁচাইয়া আমার হাত মুচড়াইয়া ধরল, এখনো ডানা ব্যথা করতাছে।
কী কইলেন? আসলাম শেখের নাম-ঠিকানা চান? এখন আপনেও শুরু করলেন? আপনে স্যার ভদ্রলোক, এইগুলার মধ্যে আপনি পইড়েন না। বাদ দেন...আচ্ছা, নিতে চাইলে নেন। কিন্তু তারে পাইবেন বইলা মনে হয় না। শুনছি, সানগ্লাস পরা লোক দুইটা তার বছিলার বাসায় গেছিল। বাইন্ধা পিটাইছে। মাছের কথা জানতে চাইছে। কী যে শুরু হইল স্যার। আমি আর নাই এইগুলার মধ্যে। আপনার কাছে কুনো দিন আর মাছ বেচুম না।
*
তিন দিনেও বইটা কেউ ফেরত নিতে আসেনি। স্টুল স্যাম্পলের টেবিলটার এক কোনায় সেটা পড়ে আছে। বাড়তি মলাট দিয়ে বাঁধাই করা বই।
চৌধুরী এহতেশাম বইটা হাতে তুলে নেন। মলাট ওল্টান। বইয়ের নাম শকুন্তলা। লেখক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কালিদাসের মূল সংস্কৃত নাটক বিদ্যাসাগর অনুলিখন করেছেন। বেশ পুরোনো আমলের বই। পৃষ্ঠাগুলো বাদামি হয়ে গেছে। খানিকটা পোকাও কেটেছে।
এহতেশামের কেন যেন গোড়া থেকেই মনে হচ্ছিল বইটা সেই ভিতু মধ্যবয়সী লোকটার, যে ব্লাড স্যাম্পল দিতে ভয় পায়। কিন্তু এহতেশাম খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, লোকটা ইতিমধ্যে এসে তার রিপোর্ট নিয়ে গেছে ডেলিভারি সেকশন থেকে। বই নিতে এল না কেন? ভুলে গেছে? নাকি এটা তার বই না?
এহতেশাম প্রথম অধ্যায়ের প্রথম প্যারায় চোখ বোলালেন। খটোমটো ভাষা। কিন্তু পড়তে মজাই লাগছে: অতি পূর্ব কালে, ভারতবর্ষে দুষ্মন্ত নামে সম্রাট ছিলেন। তিনি, একদা, বহুতর সৈন্যসামন্ত সমভিব্যাহারে, মৃগয়ায় গিয়াছিলেন। এক দিন, মৃগের অনুসন্ধানে বনমধ্যে ভ্রমণ করিতে করিতে, এক হরিণশিশুকে লক্ষ্য করিয়া, রাজা শরাসনে শরসন্ধান করিলেন।
‘শরাসনে শরসন্ধান করিলেন’ মানে বোঝাই যাচ্ছে তৃণের মধ্যে তির খুঁজলেন। বিদ্যাসাগরী ভাষাটা এত যুগ পর কেমন কৌতুকের মতো শোনায়।
বইটা বগলদাবা করলেন এহতেশাম। বাসায় নিয়ে পড়বেন।
*
আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন বলুন তো?
পিছু নিইনি।
আপনি আমাকে ফলো করছেন। কয়েক দিন ধরে।
ফলো করছি না।
আমি ক্লিনিক থেকে বের হলেই আপনি একটা দূরত্ব রেখে পেছন পেছন হাঁটেন। এই যেমন এখন বাসস্ট্যান্ডে আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বাসে উঠলে আপনিও বাসে উঠছেন। আমি নামলে আপনি নামছেন। লক্ষ করেছি, আমার বাসার সামনে সারারাত পাহারায় থাকছেন আপনারা দুজন লোক। আপনারা কারা, বলুন তো? কী চান আমার কাছে?
আমি আপনাকে ফলো করছি না।
আমি আপনাকে পুলিশে দেব। এক্ষুনি।
হা-হা-হা-হা।
হাসছেন যে? আপনি কি পুলিশের লোক?
না।
ডিবি?
না।
সিআইডি? এসবি?
না।
অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থা?
আমি কোনো সংস্থার লোক না। আমি আপনাকে ফলো করছি না।
তাহলে পিছু পিছু আসছেন কেন?
ধরে নিন, কেউ আপনাকে ফলো করছে কি না, আমি সেটা লক্ষ করছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কেউ কি আমাকে ফলো করছে?
করছে।
আপনি তাকে ফলো করছেন?
হ্যাঁ।
করুন। নো প্রবলেম। দেখবেন, আপনাকে আবার কেউ ফলো করে কি না। ফলোয়ারের ফলোয়ারের ফলোয়ার।
*
লোকটা চিত হয়ে শুয়ে আছে। মাথাটা ডাঙায়, কোমর থেকে দেহের নিচের অংশটা পানিতে। আসলাম শেখ প্রথমটায় লাশ ভেবেছিলেন। ফলে ঘুরে উল্টো দিকে হাঁটা দিতে চেয়েছিলেন। কী দরকার লাশটাশের ঝামেলায় পড়ার? বছিলায় ব্রিজ হওয়ার পর এদিকে আঁটিবাজারে জায়গা-জমির দাম বেড়েছে, জমি দখল নিয়ে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বেড়েছে। খুনটুন এখন নিয়মিত ঘটনা।
ঘুরে চলে যাওয়ার সময় একবার মনে হলো, লোকটার হাতের আঙুলগুলো একটু যেন নড়তে দেখলেন। সামান্য এগিয়ে গেলে মনে হলো চাপা একটা গোঙানির শব্দ কানে আসছে। কোনো ভুল নয়, লোকটা গোঙাচ্ছে।
আঁটিবাজার খালের ওপর পুলটা এখান থেকে দেখা যায়। তার নিচ দিয়ে ফোরকানের ছিপ নৌকাটা আসছে। নালার নোংরা পানিতে মাছ ধরছে জাউল্যা ফোরকান।
আসলাম শেখ হাঁক দিলেন, ‘ফোরকাইন্যা রে....! নৌকাডা নিয়া জলদি আয়। একডা লোক...কেউ মাইরা থুইয়া গেছে....নড়তাছে।’
*
দুই ঢোঁক পানি মুখে যাওয়ামাত্র লোকটা ভীষণ কাশতে শুরু করল। কাশির দমকে তার পেট থেকে খালের নোংরা পানি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অনেকখানি। সারা শরীরে কালশিটে দাগ। চাবুক কষা হয়েছে নাকি? মাথার পেছন দিকটা থেঁতলে আছে। ভোঁতা কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। যারা মেরেছে, তারা লোকটাকে হত্যাই করতে চেয়েছিল মনে হয়। বরাতজোরে বেঁচে গেছে।
পোশাক-আশাক দেখলে বোঝা যায়, শহরের শিক্ষিত লোক। দামি শার্টের হাতা গোটানো। পরনে জিনস। পায়ের জুতাটাও দামি, যদিও সেটা এখন খুলে রাখা হয়েছে। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে।
লোকটা চোখ মেলল। তাকাল আসলাম শেখ আর ফোরকানের দিকে। তাকিয়েই আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল মুখটা।
এই যে! আপনি কি আমাদের শুনতে পাচ্ছেন? আপনি আঁটিবাজার খালের ধারে পড়ে ছিলেন। আমরা আপনাকে তুলে এনেছি। ভয় পাবেন না। আপনি এখানে নিরাপদ। কেউ আপনার গায়ে হাত দেবে না। এটা এই লোকটার ঘর। এর নাম ফোরকান। এখানে আপনি শুয়ে থাকুন। আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি। থানাতেও খবর দেব। কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
আসলাম শেখ যাওয়ার উপক্রম করতেই লোকটা খপ করে তার জামার একটা কোনা আঁকড়ে ধরল।
পুলিশকে খবর দেবেন না, প্লিজ!
*
চৌধুরী এহতেশাম এ মুহূর্তে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। হাতও পিঠমোড়া করে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা।
আপনারা আবার আমাকে ধরে আনলেন?
না। আমরা আপনাকে আবার ধরে আনিনি। এবারই প্রথম আপনাকে ধরে আনা হলো।
ওহ্। তা বলুন কী জানতে চান।
আপনাকে এর আগে যারা ধরে এনেছিল, তাদের সম্পর্কে জানতে চাই।
কী জানতে চান, বলুন।
জানতে চাই, তারা আপনার কাছে কী জানতে চেয়েছিল।
আমি ওই দিন সকালে মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের মাছের বাজার থেকে যে বোয়াল মাছটা কিনেছিলাম, তারা সেটার দাম জানতে চেয়েছিল।
আর কিছু?
তারা আমাকে ষড়যন্ত্রকারী বলে গালাগালি করল। আর জানতে চাইল, মাছটা কীভাবে কাটা হয়েছে।
আর কিছু?
তারপর তারা আমার বাসায় গিয়ে মাছের কাটা টুকরোগুলো একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে গিয়েছিল।
উঁহু, ওটা ‘ওরা’ নয়, আমরা ছিলাম।
মানে?
আমাদের লোকেরা আপনার বাসায় গিয়েছিল। মাছটা আমরা আগে হাত করেছি।
তার মানে আপনারা ‘ওরা’ নন?
রাইট ইউ আর। আর ‘ওরাও’ নয় আমরা। মানে হলো, আমরা আসলে আমরাই। ক্লিয়ার?
ক্রিস্টাল ক্লিয়ার।
ওকে। এখন বলুন দেখি, গতকাল বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে একটা লোকের সঙ্গে আপনি কথা বলছিলেন। ঠিক না?
ঠিক।
লোকটা কে?
চিনি না।
একটা অপরিচিত লোকের সঙ্গে আপনি কেন কথা বলছিলেন?
লোকটা আমাকে ফলো করছিল।
কবে থেকে?
প্রথম দিন থেকে।
কোন প্রথম দিন?
যেদিন আপনারা...স্যরি...‘ওরা’ আমাকে প্রথমবার ধরে এনে জেরা করল।
বেশ। লোকটা আপনাকে কী বলল?
লোকটা বলল, আমাকে কেউ ফলো করছে কি না, সেটা তিনি ফলো করছেন।
বেশ। তারপর?
তারপর লোকটা আপনাদের উদ্দেশে মুখ খারাপ করে গালি দিল।
কী গালি দিল?
বলল, খচ্চরের বাচ্চা।
*
ওরা আসলে দুই সেট লোক, বুঝেছ?
কিসের? কারা?
না, মানে এমনই বলছিলাম, আরকি।
চৌধুরী এহতেশাম সাবধান হয়ে গেলেন। বিছানায় শুয়ে তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। অসতর্ক মুহূর্তের ফাঁক গলে কিছু চিন্তা ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো মিলি মনোযোগ দিয়ে কিছুই শুনছে না। সে বিছানার আরেক কোনায় শুয়ে গভীর অভিনিবেশে একটা কোনো বই পড়ছে।
বিছানার কাছেই মেঝেতে একটা খেলনা রেলগাড়ি নিয়ে খেলছে টুকুন। হাত দিয়ে রেলগাড়িটা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সেটা দিয়ে ধাক্কা লাগাচ্ছে খেলনা ট্রাক আর প্রাইভেট কারের গায়ে। এই ধাক্কাটুকু লাগানোর জন্য টুকুনের রেলগাড়িটাকে মাঝেমধ্যেই লাইন থেকে নেমে আসতে হচ্ছে। নামতে ট্রেনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। লাইন থেকে নেমে ধাক্কা মেরেই আবার লাইনে উঠে যাচ্ছে ট্রেন।
আচ্ছা, সত্কার করা মানে কী?
মিলি বই থেকে মাথা তুলে জানতে চাইল।
সৎকার মানে...ধরো...মৃতের সৎকার করে না? মানে, দাহ করা আরকি।
তাহলে অতিথি সৎকার কথাটার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? এখানে লিখেছে, শকুন্তলাকে অতিথি সৎকারের দায়িত্ব দিয়ে রাজা কণ্ব সোমতীর্থে গিয়েছেন।
তুমি শকুন্তলা পড়ছ নাকি?
হ্যাঁ। তোমার ব্যাগে পেলাম বইটা। নীলক্ষেত থেকে কিনেছ মনে হচ্ছে, পুরোনো বাঁধাই করা বই। এ রকম সুন্দর বাঁধাই এখন খুব একটা দেখা যায় না। শকুন্তলার এত নাম শুনেছি, আগে তো কখনো পড়া হয়নি।
কেমন লাগছে?
কাহিনিটা খুব মজার। খুব নাটকীয়।
কোনটা নাটকীয়?
রাজা দুষ্মন্তের স্মৃতি হারানো। শকুন্তলাকে আর চিনছে না। বেচারা!
মিলি আবার বইয়ের পাতায় ডুবে গেল। চৌধুরী এহতেশাম খেলায় ব্যস্ত টুকুনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবারও দুই সেট অনুসরণকারী, দুই দফা জেরা আর একটা বোয়াল মাছের মধ্যে সম্পর্কের গোলকধাঁধায় তলিয়ে যেতে থাকলেন।
রাতে স্বপ্ন দেখলেন এহতেশাম। দুঃস্বপ্নই বলতে হবে। দেখেন মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে যাচ্ছে একটা বোয়াল মাছ। আর তার পিছু পিছু একটা বাস যাচ্ছে। সেই বাসের দরজায় বাদুড়ঝোলা হয়ে আছেন তিনি। কেউ একজন তাঁকে নিচে তাকাতে বলছে। সেই শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠস্বরটা। বলছে, ‘নিচে দ্যাখ, সব প্রশ্নের জবাব পাবি। ভালো করে নিচে দ্যাখ।’
চৌধুরী এহতেশাম নিচে তাকিয়ে দেখেন নিচে টুকুন। মেঝেতে খেলনা রেলগাড়ি নিয়ে খেলছে। হঠাৎ খেলা থামিয়ে টুকুন তাঁর দিকে তাকাল। মেঘের মধ্যে বাসের দরজায় বাদুড়ঝোলা এহতেশামের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে টুকুন। হাতে একটা খেলনা ট্রাক। ঠিক তখন স্বপ্নের মধ্যেই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা চিন্তা এহতেশামের মাথায় খেলা করে গেল। মনে হলো পুরো ঘটনার জটটা তিনি যেন ধরে ফেলতে পেরেছেন। দিনের আলোর মতো পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
ঘুমটা ভেঙে গেল। অন্ধকারে বিছানায় উঠে বসলেন চৌধুরী এহতেশাম। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। গলির মাথায় ডাস্টবিনের ধারে ল্যাম্পপোস্টের নিচে সেই লোক দুটি আজও দাঁড়িয়ে আছে।
বিদঘুটে স্বপ্নটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না। এহতেশামের কেন যেন মনে হচ্ছে, স্বপ্নের ভেতর তিনি তাঁর রহস্যের জট সত্যি সত্যি খুলে ফেলেছিলেন, যদিও এখন কিছুই মনে পড়ছে না। জটটা খুলে গিয়েছিল টুকুন তাঁর দিকে তাকানোর পর। তার মানে কি টুকুনের সঙ্গে এই রহস্যের কোনো যোগ আছে?
অসম্ভব। কী যা-তা ভাবছেন তিনি।
*
মিস্টার আসলাম শেখ, আমাদের কথার জবাব ঠিকমতো না দিলে আমরা আপনার আঙুলগুলো একটা একটা করে ভেঙে ফেলব।
আপনেরা যা জিগাইবেন, আমি ঠিক ঠিক জবাব দিমু।
লোকটা কোথায়?
কোন লোক?
যাকে আপনি সকালবেলা খালের পাড় থেকে তুলে নিয়ে গেছেন।
আমি জানি না।
জানেন না সে কোথায়?
না। পয়লা তারে জাউল্যা ফোরকানের বাসায় নেওয়া হইছিল। আমি ফোরকানরে লোকটার কাছে রাইখ্যা পুলিশের কাছে গেছি। আঁটিবাজার ফাঁড়ির ওসি আমার ভগ্নিপতি। তারে সব খুইল্যা বলছি। তারপর তারে নিয়া ফোরকানের বাসায় গিয়া দেখি, জাউল্যাটারে খুঁটার সঙ্গে বাইন্ধা রাখছে। পাখি নাই, উইড়া গেছে।
ফোরকান কী বলল?
বলে, দুইটা লোক আইসা নাকি তারে মারছে। খুঁটার সঙ্গে বানছে। তারপর ওই আধমরা লোকটারে তুইল্যা নিয়া গেছে।
কী করেন আপনি?
মাছের ব্যবসা।
মাছের সাপ্লাই কোথা থেকে পান?
জাউল্যাদের কাছ থাইকা মাছ কিনি। মোহাম্মদপুর বাজারে বেচি।
ওই দিন আপনি কোথায় কোথায় কয়টা মাছ সাপ্লাই দিয়েছিলেন?
হিসাব দিমু?
প্রতিটা মাছের হিসাব দেবেন।
*
সেই লোকটা আজ আবার এসেছে। সেই ভিতু প্রৌঢ় লোকটা। আজ অবশ্য তার হাত থেকে ব্লাড স্যাম্পল নেওয়া হচ্ছে না। আজ শুধু ইউরিন। লোকটা বাথরুম থেকে বেরিয়ে র্যাকের মধ্যে স্যাম্পলভর্তি টেস্টটিউব রেখে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
শুনুন।
আমাকে বলছেন?
আপনি বোধ হয় একটা বই ফেলে গেছেন।
ও, হ্যাঁ।
শকুন্তলা।
ঠিক।
মালিক না পেয়ে আমি বইটা বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম পড়ার জন্য। ডেলিভারিতে দিয়ে রাখব। রিপোর্ট নেওয়ার সময় নিয়ে যাবেন।
কিন্তু আমি তো ওটা আপনার পড়ার জন্যই রেখে গিয়েছিলাম।
কেন? আমার পড়ার জন্য কেন?
আপনি একটা জিনিসের জবাব খুঁজছেন। আমাদের মুশকিল কি জানেন, আমরা বইয়ের বাইরে জবাব খুঁজি। অথচ সব প্রশ্নের জবাব তো আসলে বইয়ের মধ্যে লুকানো থাকে। আপনাকে কেবল সঠিক বইটা সঠিক সময়ে বেছে নিতে হবে। আপনার জন্য এ মুহূর্তে ওটাই সঠিক বই।
লোকটা আর কিছু না বলে চলে গেল।
এহতেশাম হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। এই লোক তো আরেক পরত হেঁয়ালির প্রলেপ মেরে দিয়ে গেল। কদিন ধরে সবাই তাঁর সঙ্গে হেঁয়ালি করছে।
*
আপনি একটা জিডি লিখুন। গ্রিন রোড থেকে ভূতেরগলিতে ঢোকার মুখে আজ বিকেলে আমাকে ছিনতাই করা হয়েছে...বিকেল সাড়ে পাঁচটায়...দুজন ছিল তারা। সানগ্লাস পরা ছিল। আমার হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে গেছে। ছয় হাজার টাকা ছিল। একটা ক্রেডিট কার্ড। আর গা থেকে খুলে খুলে নিল সব গয়নাগাটি। এক ভাগনির বিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছিলাম সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে। সঙ্গে বন্দুক ছিল বোধ হয়, তবে শুধু চাকু দেখিয়েছিল। আশপাশে রাস্তায় এত লোক, একটা কেউ এগিয়ে এল না, জানেন। রিকশায় আমি ছিলাম আর আমার ছেলে। ক্লাস টুয়ে পড়ে। আমার নাম? লিখুন মিলি চৌধুরী। আমার ছেলের নাম টুকুন। ডাকনাম। ভালো নাম মির্জা খালিদ আনাদেল। না, টুকুনকে কিছু বলেনি। তবে ও খুব ভয় পেয়েছিল।
*
আপনার কিছুই মনে পড়ছে না? টোটাল অ্যামনেশিয়া? ভালো করে মনে করার চেষ্টা করুন। এই জায়গায় আপনি পড়ে ছিলেন। এই খালের পাড়ে। আধমরা হয়ে পড়ে ছিলেন আপনি। গভীর রাতে একদল লোক আপনার ওপর হামলা চালিয়েছিল। আপনি তাদের কাছ থেকে পালাচ্ছিলেন। লোকগুলো এইখানে, এই খালের পাড়ে আপনাকে ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। তারা আপনার ওপর ভয়ানক নির্যাতন চালায়। কাউকে চিনতে পেরেছেন আপনি? পারেননি? আপনি ভেবেছিলেন, ওরা আপনাকে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু আপনাকে হত্যা করা ওদের প্রধান লক্ষ্য ছিল না। ওরা আপনার কাছে একটা জিনিস খুঁজছিল। তন্ন তন্ন করে খুঁজছিল। পায়নি। ওরা খুব হতাশ হয়েছে। ওরা নিশ্চিত ছিল জিনিসটা আপনার কাছেই আছে। আপনার কিছুই মনে পড়ছে না? ওরা আপনাকে খালের ধারেই ফেলে রেখে যায়। এই খালের ধারে। দেখুন তো জায়গাটা চিনতে পারেন কি না। ভোরবেলা দুজন লোক এসে আপনাকে উদ্ধার করে। তাদের দাবি, তারা মাছ ব্যবসায়ী। আমরা প্রথমটায় তাদের কথা বিশ্বাস করিনি। ওরাও আপনার পকেটটকেট হাতড়েছে। কিছু পায়নি। এবার আমরা আপনাকে শেষবার একটা অনুরোধ করব। মনে করার চেষ্টা করুন, জিনিসটা কোথায়।
*
বিছানায় শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছেন এহতেশাম।
ওই স্বপ্নটার কথা আবার মনে পড়ছে। মেঘের মধ্য দিয়ে সাঁতার কেটে যাচ্ছে একটা বোয়াল মাছ। টুকুন খেলনা হাতে মেঝেতে বসে থেকে ওপরে ভাসমান এহতেশামের দিকে তাকিয়ে আছে। স্বপ্ন দেখার আগে ওই দিন রাতে টুকুন সত্যি সত্যি মেঝের মধ্যে খেলনা ট্রেন নিয়ে খেলছিল। সেই দৃশ্যটাই স্বপ্নে ফিরে এসেছে। কেন? কারণ, টুকুনের ওই খেলার দৃশ্যটার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু একটা ছিল। কিছু একটা টুকুনের সঙ্গে মিলছিল না। কিছু একটা খটকা ছিল। খাটের মধ্যে বসে থেকে সেটা এহতেশামের চোখে পড়েছিল। কিন্তু অন্যমনস্ক ছিলেন বলে তিনি সেটা ভুলে গেছেন। তাঁর অবচেতন মন সেটা মনে রেখেছে। এ কারণে স্বপ্নে দৃশ্যটা আবার ফিরে এসেছে। অবচেতন মন তাঁকে বলেছে, টুকুনের খটকাটা মনে করতে পারলেই সবকিছু খাপে খাপে মিলে যাবে।
আচ্ছা, মিলি, আজ ভূতেরগলিতে ছিনতাইকারী দুজনের চেহারা তোমার কি মনে আছে?
আমি কোনো দিন ওই চেহারা ভুলব না। যেদিন দেখা হোক, যেখানে দেখা হোক, দূর থেকেও চিনতে পারব।
বারান্দায় যাও তো। দেখবা দুটো লোক গলির মাথায় ডাস্টবিনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দেখো তো, চিনতে পারো কি না।
মিলি বারান্দায় গিয়ে ফিরে এল।
কী সর্বনাশ! সেই দুটো লোকই তো। এরা বাসার সামনে কী করছে?
আমাদের ফলো করছে।
দাঁড়াও, পুলিশ ডাকি। ধরিয়ে দিই।
শান্ত হও। বসো। আমার কয়েকটা কথার জবাব দাও আগে। শকুন্তলা বইটা শেষ করেছ?
এখন এই রাত তিনটার সময় বই নিয়ে আলাপ করতে পারব না আমি। আগে ওই ছিনতাইকারী দুইটার ব্যবস্থা করি।
ওরা ছিনতাইকারী না। আমার কথা শোনো। চিল্লাফাল্লা করে লাভ নাই। তুমি শকুন্তলা বইটার সম্পর্কে আমাকে বলো। এটা কবি কালিদাসের নাটক একটা, জানো তো?
জানব না কেন।
আচ্ছা, ওই দিন তুমি বলছিলা, ঘটনাটা খুব নাটকীয়। কোন ঘটনাটা নাটকীয় বলো তো।
রাজা দুষ্মন্তের স্মৃতি হারিয়ে ফেলা।
তার আগে বলো, দুষ্মন্ত কে, শকুন্তলা কে?
তুমি তো সবই জানো।
জানি। কিন্তু তবু তুমি আবার বলো, প্লিজ।
দুষ্মন্ত হলো এক মহাপরাক্রমশালী রাজা। আর শকুন্তলা বনের মধ্যে ঋষিদের আশ্রমে বেড়ে ওঠা এক মেয়ে। এসব আশ্রমকে বলে তপোবন।
তারপর কী হলো?
রাজা একদিন হরিণ শিকার করতে করতে তপোবনে গিয়ে হাজির হলেন। শকুন্তলাকে দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। তাকে বিয়ে করলেন। তারপর শকুন্তলাকে রেখে নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন। শকুন্তলা পরে কোনো এক সময় ঋষি কণ্বের অনুমতি নিয়ে রাজপ্রাসাদে আসবে। কিন্তু নিজ রাজ্যে ফিরেই রাজা দুষ্মন্ত ভুলে গেলেন শকুন্তলার কথা।
কেন?
টোটাল অ্যামনেশিয়া।
বুঝলাম তো। কিন্তু কেন?
মুনী দুর্বাসার অভিশাপে।
তার ফলে কী হলো?
তার ফলে রাজা ভুলে গেলেন তপোবনে গিয়ে শকুন্তলাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। শকুন্তলা গেল রাজপ্রাসাদে। কিন্তু রাজা তাকে চিনতে পারলেন না। উল্টো অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন।
শকুন্তলা কি কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারল না?
প্রমাণ একটা ছিল বটে। একটা অভিজ্ঞান।
আহ্, বিদ্যাসাগরী ভাষা ছাড়ো তো। অভিজ্ঞান মানে কী?
অভিজ্ঞান মানে স্মৃতিচিহ্ন। সার্টিফিকেট।
তো কী সেই স্মৃতিচিহ্ন? শকুন্তলার দাবির কী সেই অকাট্য প্রমাণ?
রাজার দেওয়া একটা অঙ্গুরীয়।
আবার বিদ্যাসাগর ফলাচ্ছ!
আরে বাবা, আংটি।
কিন্তু সেটা তো শকুন্তলা দেখাতে পারেনি। পেরেছে?
না, পারেনি।
কেন পারেনি?
তুমি তো জানোই, তবু প্রশ্ন করছ কেন?
ফোড়ন কেটো না। যা প্রশ্ন করছি, চটজলদি জবাব দাও। র্যাপিড ফায়ার। আংটিটা গেল কই?
মাছে খেয়ে ফেলেছে।
কীভাবে?
শকুন্তলা নদীতে গোসল করার সময় আংটিটা তার আঁচলের খুঁট থেকে খসে নদীতে পড়ে গিয়েছিল। তখন পানির তলায় সেই আংটি মাছে খেয়ে ফেলেছে। হয়েছে?
না হয়নি। আরেকটা গুরুতর প্রশ্ন। কী মাছ?
কী মাছ মানে?
কী মাছ খেয়েছে শকুন্তলার আংটি?
উম....একটা রোহিত মৎস্য।
মানে?
রুই মাছ।
বোয়াল মাছ নয়?
না। রুই মাছের কথাই তো লেখা আছে।
পরে শকুন্তলার আংটিটা কীভাবে উদ্ধার হলো?
এক জেলের জালে মাছটা ধরা পড়েছিল। জেলে মাছ কেটে পিস পিস করার সময় আংটিটা পায়।
এই সময় বিদ্যুৎ ঝলকের মতো স্বপ্নদৃশ্যটা ফিরে আসে এহতেশামের মাথায়। এবার তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন দৃশ্যটা: টুকুন মেঝেতে খেলছে। তিনি এবার টুকুনের হাতটা দেখতে পাচ্ছেন। ধীরে ধীরে তাঁর দৃষ্টি টুকুনের হাতের আঙুলের দিকে গেল।
এহতেশাম আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন। তড়াক করে উঠে বসলেন। ইউরেকা!
পাশে টুকুন ঘুমাচ্ছে। এহতেশাম ঘুমন্ত টুকুনের ডান হাতের দিকে তাকালেন। টুকুনের মধ্যমায় একটা আংটি।
টুকুনের হাতের এই আংটি কোথা থেকে এল?
বুয়া আকলিমা দিয়েছে।
আকলিমা কোথায় পেল?
ওই দিন ওই বোয়াল মাছ কুটতে গিয়ে মাছের পেট থেকে।
মাই গড। এই আংটির জন্যই তো এত কিছু! ওরা সবাই এটার পেছনে পাগল হয়ে ছুটছে।
*
বাসে যাত্রী নেই বললেই চলে। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী সবাই সামনের দিককার আসনগুলোয় বসেছে। দুটি লোক ব্যতিক্রম। মাঝখানের শূন্য আসনগুলো ছেড়ে লোক দুটো একেবারে শেষের টানা লম্বা বেঞ্চের মতো সিটটায় বসেছে। একজন মধ্যবয়স্ক। অপরজন প্রৌঢ়। প্রৌঢ় লোকটা শুকনো হাড়জিরজিরে। নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলছে লোক দুটো।
আপনি কিন্তু সঠিক বলেননি। সব প্রশ্নের জবাব বইয়ের মধ্যে লেখা থাকে না।
যেমন?
যেমন, শকুন্তলা পড়ে কোনো দিনও জানা যাবে না আমাদের এই আংটিটার মধ্যে আসলে কী আছে। তা ছাড়া যে দুটি পক্ষ এটার পেছনে ছুটছে, তারা কারা, কেন তারা এভাবে ছুটছে, তা-ও জানা সম্ভব না।
সত্যি? আপনি বলতে চান, আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না?
কিছু জিনিস আঁচ-অনুমান করছিমাত্র। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছুই তো জানতে পারছি না।
আপনি আসলে সবই বুঝতে পারছেন। না বোঝার ভান করছেন। তবু আমি আপনাকে বলি। একটু আড়েঠারে বলি। গুপ্তচর সংস্থা কী জিনিস, জানেন তো? নানান দেশের নানান গুপ্তচর সংস্থা থাকে। এরা এক দেশের হয়ে আরেক দেশে তৎপরতা চালায়, গোপনে। আমাদের দেশটা যেহেতু দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, এখানে নানান দেশের এই সব সংস্থার তৎপরতা আপনি দেখতে পাবেন। বিশেষ করে প্রতিবেশী দুটি দেশের দুই সংস্থার শক্ত প্রতিযোগিতা আছে বলে শোনা যায়। তারা বুদ্ধিতে, চৌকসতায় একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে আছে বহু বছর ধরে। সারাক্ষণই একে অপরের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছে তারা। বোঝার চেষ্টা করছে, অপর পক্ষের পরবর্তী চাল কী। অনেকটা দাবা খেলার মতো। প্রতিপক্ষের সম্পর্কে তথ্য পেতে এই দুই সংস্থা প্রচুর মেধা ও শ্রম ব্যয় করে। এভাবে প্রতিযোগিতা চলতে চলতে কোনো এক সময় একটি সংস্থার একটি লোক অনেক বেশি তথ্য পেয়ে যায়। শুধু বেশি না, বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। বলা যায়, তথ্যের একটা বিরাট খনির সন্ধান পেয়ে যায় সে। লোকটা নিজেও শুরুতে বিশ্বাস করতে পারেনি এত তথ্য সে পেয়ে যাবে। অনুমান করছি, প্রতিপক্ষের প্রায় সবার ছদ্ম পরিচয় ফাঁস করে দেওয়ার উপযুক্ত তথ্য পেয়ে গেছে সে। বড় বিপজ্জনক সেই তথ্যভান্ডার। সেটা পেয়ে লোকটা অত্যন্ত সাবধানি হয়ে গেল। পুরো ডেটাবেইসটা সে একটা মেমোরি চিপের মধ্যে নিয়ে নিল। চিপটা সে লুকিয়ে রাখল...কিসের মধ্যে লুকিয়ে রাখল অনুমান করতে পারেন?
পারি। একটা আংটির মধ্যে।
এই তো, বুঝে ফেলেছেন। এবার যে পক্ষের হয়ে সে কাজ করছে, তাদের সে আগাম আভাস দিল, তারা কী পেতে যাচ্ছে। মোটা অঙ্কের ইনাম প্রস্তুত করতে বলল সে। কিন্তু ওই পক্ষের ভেতরে কি ছদ্মবেশে প্রতিপক্ষের লোকজন লুকিয়ে নেই? আলবত আছে। তারা জেনে গেল পুরো ব্যাপারটা। তারা তখন লোকটাকে ঠেকানোর চেষ্টা করল। উপায়ান্তর না দেখে লোকটা পালাল। পিছু ধাওয়া করল প্রতিপক্ষের লোকজন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হলো তোলপাড়। আপনি পেপার খুললে দেখবেন, কিছুদিন ধরে অপরিচিত লোকজনের বেওয়ারিশ লাশ এখানে-সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। এটা হচ্ছে সেই ঝড়ের আলামত। এ রকম অস্থির সময়ে লোকটা একদিন প্রতিপক্ষের হাতে ধরা পড়ল ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজারে। রাতের অন্ধকারে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে লোকটার হাতের আংটিটা খুলে পড়ে গেল খালের পানিতে। অনুমান করছি, আংটিটা ছোট্ট আকারের। আঙুলে ঠিকমতো ঢুকত না। যে কারণে আপনার ছেলের আঙুলে সেটা অনায়াসে ঢুকে গেছে। যাহোক, খালটায় এমনিতেই পানি কম। তার ওপর মাছচাষিরা মাটির আল তুলে দিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে স্থানে স্থানে বদ্ধ জলাশয় বানিয়েছে। এ রকমই এক বদ্ধ জলাশয়ে পড়ল আংটিটা। পরদিন একপক্ষ সেই জলাশয়ের পানি ছেঁকে কাদার মধ্যে তন্ন তন্ন করে আংটি খুঁজল। কোথাও সেটা নেই। জলাশয়ের সব মাছের পেট চিরে দেখা হলো। নেই। কোথায় গেল? চুলচেরা হিসাব কষে দেখা গেল, জলাশয়ের একটি মাছ এখান থেকে অন্যত্র বেরোতে পেরেছে। ভোরবেলা মাছটি ধরা পড়েছিল এক জেলের জালে। খাল থেকে একটিই মাছ ধরেছিল সেদিন জাউল্যা ফোরকান। একটি বোয়াল মাছ। সেটা সে বেচেছে আসলাম শেখের কাছে। মাছের পিছু ধাওয়া করতে করতে মোহাম্মদপুর বাজারে গিয়ে জানা গেল, সেই মাছ কিনে নিয়ে গেছেন আপনি। এরপর বাকি ঘটনার তো আপনিও সাক্ষী। এখন নিশ্চয়ই পুরোটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে?
পুরোটা না।
কেন? আর কোথায় খটকা?
খটকা আপনার ভূমিকায়। এই পুরো খেলায় আপনার ভূমিকাটা আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কোন পক্ষে খেলছেন আর আমাকেইবা শকুন্তলা পড়তে দিয়ে ইশারা-ইঙ্গিত দিতে চাইছিলেন কেন?
পুরো খেলায় আমাকে দর্শক বলতে পারেন। দর্শক কী করে? একটু দূরত্বে, গ্যালারির নিরাপদ উচ্চতায় বসে বসে দুই পক্ষের কলাকৌশল দেখতে পারে, খেলা উপভোগ করতে পারে। এর বেশি কিছু এখন বলতে পারছি না। আপনি অনুমান করে নিন।
আমি নিজের মতো করে অনুমান করে নিলাম।
ভালো। এবার বলুন দেখি, আংটিটা নিয়ে আপনি কী করতে যাচ্ছেন? পকেটে ওই সাংঘাতিক জিনিসটা নিয়ে আপনি ঢাকার রাস্তায় ঘুরছেন। ওটা নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
এই বাস বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত যাবে। আমি সেখানে নামব। ওখান থেকে সামান্য হেঁটে গেলে সোয়ারীঘাট। সেখান থেকে একটা নৌকা নেব। নৌকাটা যখন বুড়িগঙ্গার মাঝনদীতে যাবে, তখন পকেট থেকে আংটিটা বের করে টুপ করে ফেলে দেব বুড়িগঙ্গার কুচকুচে কালো পানিতে। শুনেছি এই দূষিত পানিতে কোনো মাছ নেই। ফলে এটা আর কোনো মীনের পেটে যাওয়ার ঝুঁকি নেই। সলিলসমাধি গ্যারান্টিড।
ভালো সিদ্ধান্ত। সঠিক সিদ্ধান্ত।
আংটির ভেতরের তথ্যভান্ডারের একটা কপি আপনি রাখবেন না?
ওর চেয়ে অনেক বড় তথ্যের ভান্ডার আমাদের কাছে আছে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।