একজন কেঁদো ভূত

অলংকরণ: রাজীব

শহরের শেষ মাথায় বিশাল শেওড়াগাছটা আকাশে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহুদিন ধরে। দক্ষিণ দিকের ডালটার শেষ মাথায় হাত-পা ছড়িয়ে একটা কেঁদো ভূত বসে আছে। কিছুদিন ধরেই সে যথেষ্ট ডিপ্রেসড! কারণও আছে। কারণটা হলো, হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করেছে, তাকে মানুষেরা আজকাল আর ভয় পায় না। এই তো সেদিন এক লোক দা নিয়ে গাছে উঠেছে গাছের শুকনা ডাল কাটতে। সময়টা বিকেলের দিকে। সূর্য তখনো পুরোপুরি ডোবেনি, তবে ডুবো ডুবো ভাব। লোকটাকে দেখে ভূতটা ভাবল, ব্যাটাকে ভয় দেখিয়ে দূর করে দেবে। নিজের বিকট চেহারাটা একটু দেখিয়েওছিল, তাতেই কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু লোকটার কোনো ভাবান্তর হলো না। উল্টো দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘এই ব্যাটা ভূতের বাচ্চা, দিনে–দুপুরে ভেচকি দেও কেন? দেখো না, শুকনা ডাল কাটতে উঠছি। বাসায় চুলা বন্ধ। সিলিন্ডারের গ্যাসের খর্চা কত বাড়সে খবর রাখো?’ বলে ধুপধাপ করে গাছের শুকনা ডাল কাটতে লাগল। মান–ইজ্জত বাঁচাতে নিজেকে সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য করে ফেলল কেঁদো ভূত।

কিংবা আরেক দিনের কথা, সেদিনও বিকেল। একটা আড়াআড়ি লম্বা ডালে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে কেঁদো ভূত। একটু চোখটা লেগে এসেছে; এই সময় সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দে ঘুমটা ছুটে গেল। বেশ বিরক্ত হলো কেঁদো ভূত। নিচে তাকিয়ে দেখে, এক পিচ্চি সাইকেল চালাচ্ছে। ‘দাঁড়াও বাছাধন, তোমার সাইকেল চালানোর দফারফা করছি’ বলে শরশর করে গাছ বেয়ে নেমে এল কেঁদো ভূত। আর কী আশ্চর্য! পিচ্চিটা মানে মানুষের বাচ্চাটা তাকে দেখে ব্রেক কষে সাইকেল থামাল। তারপর হি হি করে হেসে উঠল। বলল, ‘তুমি একটু অপেক্ষা করবে? বাসা থেকে মোবাইলটা নিয়ে আসি! তোমার সঙ্গে একটা সেলফি তুলব...’ সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলল কেঁদো ভূত।

শেষ পর্যন্ত কেঁদো ভূত একদিন গভীর রাতে উড়ে গেল পাশের একটা মজা পুকুরে। পুকুরটার দোষ আছে বলে শোনা যায়। এই পুকুরে এক মানুষ মাছ ধরতে এসেছিল ভরদুপুরে। পরে তার লাশ পাওয়া যায়। তারপর থেকেই এই পুকুরের ধারেকাছে কেউ আসে না। মানে কোনো মানুষ আসে না। আজকাল কেউ গোসল করতেও আসে না এই পুকুরে। চারদিকে জঙ্গল হয়ে উঠেছে। তবে কেঁদো ভূত জানে, এই পুকুরপাড়ে ঘুরে বেড়ায় একটা জ্ঞানী স্কন্ধকাটা ভূত। প্রচণ্ড জ্ঞান তার। কিন্তু মাথা নেই। এত জ্ঞানবুদ্ধি কোথায় রাখে, কে জানে। আবার অনেকে বলে, মানে অন্যান্য ভূতেরা বলে, স্কন্ধকাটা ভূতের সব বুদ্ধি আছে তার দুই হাঁটুতে। তবে তার কিন্তু ভালোই খাতির আছে সেই স্কন্ধকাটা ভূতের সঙ্গে।

দাদা!

কী খবর কেঁদো বাছা?

জি মানে...একটা সমস্যা ছিল।

কী সমস্যা?

আমাকে মানুষেরা আজকাল আর ভয় পায় না।

তা তো হবেই। মানুষেরা আজকাল নিজেদের ভয়েই বাঁচে না, ভূত দেখে ভয় পাবে?

কিন্তু আমি তো প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে আছি।

হুম। ডিপ্রেশন হওয়ারই কথা। এক কাজ করতে পারো।

কী কাজ দাদা?

গাছ বদলাও, তেঁতুলগাছে যাও।

তাতে কাজ হবে?

হওয়ার কথা।

তাই করল কেঁদো ভূত। গাছ বদলাল। শেওড়াগাছ থেকে উড়ে গিয়ে শহরের আরেক প্রান্তের এক ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছে উঠল। পরিবেশটা বেশ ভালোই লাগল, নিরিবিলি। ভালোই চলছিল। কিন্তু একদিন নিচে তাকিয়ে দেখে, এক বুড়ো চেয়ারে বসে বই পড়ছেন। সময়টা সন্ধ্যা হয় হয় এমন। তেঁতুলতলায় এই বুড়ো হঠাৎ কোত্থেকে এলেন? চেয়ারই বা আনল কে? যাহোক, বুড়োকে ভয় দেখানো যাক, দেখি গাছ বদলানোয় কাজ হয় কি না। শরশর করে নেমে এসে বুড়োর সামনে দাঁড়াল। বুড়ো একনজর তাকিয়ে দেখল, তবে কোনো ভাবান্তর হলো না। তারপর বইটা বন্ধ করে পাশে রাখল। বইয়ের নাম ‘তেঁতুলবনে জোছনা’। বুড়ো কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,

বাছা, তুমি যা ভেবেছ, তা কিন্তু নয়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তেঁতুলগাছ কার্বন ডাই–অক্সাইড ছাড়তে শুরু করেছে। যেসব গাছে টক ফল ধরে, তারা কার্বন ডাই–অক্সাইড বেশি ছাড়ে। তার ওপর আমার হাই ডায়াবেটিস আছে, প্রায়ই হাইপো হয়...অর্থাৎ বেশ বুঝতে পারছি আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে...মনে হচ্ছে, সামনে একটা বিটকেলে চেহারার ভূত দাঁড়িয়ে আছে। অভিজ্ঞতাটা মন্দ নয়। ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন ফোরটি থ্রিতে একবার আমি সত্যি ভূত দেখেছিলাম। তখন সলিমুল্লাহ হলে থাকি, রাতে সেকেন্ড শো সিনেমা দেখে হলে ফিরছি, হঠাৎ দেখি...

এই সময় তেঁতুলতলায় এক কিশোর এসে হাজির হলো, ‘দাদা, কার সঙ্গে কথা বলছ একা একা? চলো, বাড়ি চলো, সন্ধ্যা হয়ে গেছে।’

‘নিজের সঙ্গেই কথা বলছিলাম। আমার হঠাৎ হ্যালুসিনেশন হচ্ছিল, ভূতের মতো বিটকেলে কী একটা দেখলাম যেন, তাই ভাবলাম একটু কথা বলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখি। চলো...’ বলে বুড়ো হাঁটা দিলেন বইটা নিয়ে আর পিচ্চিটা প্লাস্টিকের ফোল্ডিং চেয়ারটা ভাঁজ করে চলল তাঁর সঙ্গে। তার আগেই অবশ্য কেঁদো ভূত মান–ইজ্জত বাঁচাতে নিজেকে অদৃশ্য করে গাছে উঠে পড়েছে।

সত্যি কথা বলতে কী, মানুষ হলে এতক্ষণে কেঁদো ভূত বোধ হয় সুইসাইডই করে ফেলত। প্রচণ্ড ডিপ্রেসড হয়ে গাছের মগডালে উঠে এল। আর তখনই তার মাথায় বুদ্ধিটা এল, আচ্ছা ‘ভূতজীবন’ বাদ দিয়ে ছদ্মবেশে মানুষ হয়ে গিয়ে ‘মানুষজীবন’ শুরু করলে কেমন হয়, মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে! তা–ই করল কেঁদো ভূত।

তারপর অনেক দিন গেছে। সেই তেঁতুলগাছের পাশের ড্রেন দিয়ে শত শত হাজার হাজার গ্যালন গ্যালন ময়লা পানি বয়ে গিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ে তার দুর্গন্ধ বাড়িয়ে দিয়েছে শত গুণ। আর ওই ফাঁকে...সেই কেঁদো ভূত এখন মানুষের ছদ্মবেশে হিসাববহির্ভূত শত হাজার কোটি টাকার মালিক। দেশে-বিদেশে তার নামে–বেনামে নানান ব্যবসা। শত শত বিঘা জমির মালিক আর ফ্ল্যাটের তো কোনো হিসাবই নেই। দুদক অবশ্য তাকে ধরার চেষ্টা করছে। পুলিশ, র৵াবও নজর রাখছে। হয়তো শিগগিরই ধরা পড়বে। তবে ছদ্মবেশী কেঁদো ভূত মনে মনে হাসে আর ভাবে, ‘আমাকে ধরা এত সোজা? দাঁড়াও না সামনের নির্বাচনে ইলেকশনে এমপি হয়ে নিই। তারপর দেখো, রাস্তার মোড়ে মোড়ে শেওড়াগাছ, তেঁতুলগাছ আর বটগাছ লাগানোর ব্যবস্থা করব। ভূতেদের অভয়ারণ্য হবে এই দেশ। আগে মাত্র বারো ভূতে লুটপাট করত, তখন করবে ১২ লাখ (নাকি কোটি) ভূত! হিঁ হিঁ হিঁ।’ গা কাঁপিয়ে হাসে কেঁদো ভূত। পাশের রুমে তার মানুষ পিএ ভাবে, স্যার মাঝেমধ্যে এমন একা একা অদ্ভুতভাবে হাসে কেন, কে জানে!!