বৈশাখের দুপুরে
আমবাগানটা আমার দাদার বানানো। সেই বাগান লাগোয়া বিশাল গা ছমছমে বাঁশবাগান। বড্ড ভালোবাসি বাগানটাকে। বৈশাখের গরম বাতাস সেখানে পরাজিত হয় বাঁশের সবুজ পাতাদের কাছে। সেখানে সাপেরা আসে শীতলতা পোহাতে। আমি বাগানে যাই, কারণে-অকারণে, কাজে কিংবা বিনা কাজে। আমবন-বাঁশবনে তখন সুনসান নীরবতা। শুকনা পাতার দঙ্গলে ভরে গেছে চারপাশ। একটু বাতাস হলেই খসখস আওয়াজ আসে। আমার কুসংস্কারে ভরা মনে জাঁকিয়ে বসে ভূতের ভয়। তবু এগোই। বাগানের গহিন থেকে ঘুঘুর ডাক আসে। একটানা করুণ স্বর। বৈশাখের দুপুরের সঙ্গে এই ডাক আজীবন জড়িয়ে যায় স্মৃতিকোষে। আজও বাংলার পথে-প্রান্তরে, বিজন বাগানে ঘুঘু ডাকে—বৈশাখের উত্তপ্ত দুপুরে। কিন্তু নস্টালজিয়ার সেই ঘুঘুটি আজ কোথায় হারিয়ে গেছে শৈশবের সেই ঘোরলাগা দুপুরটাকে চুরি করে।
বৈশাখের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে পৃথিবীটা পুড়তে থাকে। দুপুরের বাতাস যেন ড্রাগনের নিশ্বাসের মতো গরম। তবু বৈশাখ আসে আমাদের জীবনে আনন্দের বার্তা নিয়ে। নতুন ধান বোনার জন্য উৎসব হয়। চাল আর খেজুর গুড়ের ভেতর কাঁচা আম দিয়ে পায়েস রাঁধেন মায়েরা, দাদিরা। সেই পায়েস সারা পাড়ায় বিলি করা হয়। দোকানে দোকানে হালখাতা শুরু হয়, টাকা পরিশোধ করে বাবা হালখাতার মিষ্টি নিয়ে ফেরেন। সেই মিষ্টির স্বাদ কেন জানি সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে অন্য রকম অনুভূতি তৈরি করে। সব মিলিয়ে বৈশাখ মাসে একটা উৎসব উৎসব ভাব শুরু হয়।
এ সময় গরমের ছুটি পেতাম আমরা। স্যাররা বলতেন, আম খাওয়ার ছুটি। বৈশাখী উৎসবের পালে হাওয়া লাগায় এই ছুটি। শুধু আম খাওয়ার ছুটি বলতে আমি রাজি নই। আমের সঙ্গে আরও কত কিছু দেখবার আছে, শোনবার আছে, গন্ধ শোঁকার ব্যাপার আছে—এসব ছেলেমানুষি ব্যাপার বোধ হয় স্যাররা ফেলে এসেছেন দূর শৈশবে। ছোট্ট আমি তো আর স্যার নই, তাই গরমকালের ছুটির অনেক রকম অর্থ আমার কাছে। এরই মধ্যে বাড়িতে আরেক উৎসব চলছে রীতিমতো। ভালোমন্দ খাওয়ার, কিংবা রংবেরঙে ঘর সাজানোর উৎসব নয়। এই উৎসব ঘর ভাঙার।
চৈত্রে গম কাটার পর নাড়া দিয়ে ঘর ছাওয়ার ধুম পড়ে যায়। বছরে একবারই হয় গম। ঘরও ছাওয়া হয় তাই একবারই। আমাদের শোবার ঘরগুলো পাকা। কিন্তু রান্নাঘর, গোয়াল কিংবা ধানের গোলা, মুরগি ঘর—এগুলো কাঁচা। চাল গমের নাড়া দিয়ে তৈরি। বৈশাখে নতুন নাড়া ঘরে আসার পর ঘর ছাওয়া হয়। আমরা অপেক্ষায় থাকি—কবে ঘর ছাইবে। ঘরের চাল থেকে পুরোনো নাড়া সরানো হয়, তখন খোলা চালের ভেতর দিয়ে আসা সূর্যের আলো এসে পাল্টে দেয় ঘরের চেহারাটাই। কেন যেন আলগা আলোকময় রান্নাঘরটাকে অন্য রকম লাগে আমার—খুব খুব ভালো লাগে।
মা নতুন গমের রুটি বানাচ্ছেন উঠানের এক কোনায় বসে। দুটি রুটি তৈরি হতেই আমার ডাক পড়ে। বাটিতে ঝরাগুড় দিয়ে হাতে রুটি ধরিয়ে দেন। মধুর মতো দেখতে এই গুড় তৈরি হয় দোকাট বা তেকাটের ঝরা রস দিয়ে। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। শীতকালে ঝরা গুড়ের ভাঁড়ের মাথা মেরে রেখে দেওয়া হয় বৈশাখে নতুন রুটি খাওয়ার জন্য। মা রুটি বেলতে বেলতে বলেন, খোকা, মাঠে যাবি নাকি?
বিকেলে হয়তো যেতাম, মা যখন বলছে, এখনই যেতে হবে। উঠানে তিতির মুরগিগুলো চরে বেড়াচ্ছে, মা সেগুলো দেখিয়ে বলে, ওদের খাবার শেষ।
ওদের খাবার কী জানি আমি। তিতির আমার খুব পছন্দের পাখি। প্রথম যেদিন শহর থেকে কয়েকটা তিতিরছানা আসে বাড়িতে, সারা পাড়ার লোক দেখতে আসে। এত আজব মুরগি কখনো দেখেনি কেউ। আমিও অবাক হয়েছিলাম, মাঠের ভারুই পাখির মতো দেখতে। ভারি সুন্দর গায়ের রং। যত বড় হয়, ছানাগুলোর চেহারা পাল্টায় তত। লালচে বাদামি ছানাগুলোর গায়ে কালো ডোরা, তার ওপর ছোট ছোট গোল গোল ছিটা। কড়াক কড়াক আওয়াজ করে ডাকে।
ছানা বাড়ি আসার পর কে যেন বলেছিল, এ মুরগি উইপোকা খুব ভালোবাসে। ব্যস কথাটা মনে রেখেছিলাম। তারপর একদিন মাঠ থেকে ফেরার পথে ধানখেতের আলের ওপর বিশাল যে উইঢিবিটা আছে, সেখান থেকে ভেঙে এনেছিলাম এক টুকরা উইয়ের বাসা। কথা ঠিক, উইপোকা বেশ মজা করে খায় তিতিরছানারা। তারপর নিয়মিত উইয়ের বাসা ভেঙে আনি। মা-দাদি খুশি হলেও সাবধান করে দিয়েছিলেন— ভালো করে দেখেশুনে হাত দেবে উইয়ের বাসায়। ভেতরে সাপ থাকতে পারে।
সাপে আমার বড্ড ভয়। তবু সাহস নিয়ে উইবাসা ভাঙতে যাই। মেজ চাচার ধানি জমিতে চারটা ঢিবি ছিল আলের ওপর। এগুলো প্রায় শেষ। তবে চেঁছেপুছে নিলে চলে না। কিছু রাখতে হয়, দু–তিন সপ্তাহের মধ্যে আবার ঢিবি ভরে ওঠে।
২.
কিছুদিন আগে দুটি নতুন উইঢিবি আবিষ্কার করেছি আমাদের বাঁশবাগানে। বাগানটা ভাঁট-আশশেওড়া দঙ্গলে ঠাসা। শীত-গ্রীষ্মে ঝোপজঙ্গলে কিছুটা মলিন, ধূলি-ধূসরিত হয়ে ওঠে। যদিও ভাঁটের বনে এখন ফুলের হরষ, তবু পাতা ঝরে অনেকটাই হালকা-ফাঁকা। তাই সঙ্গোপনে বানানো উইঢিবির মাথা বেরিয়ে আসে ভাঁটঝোপের ফাঁক গলে। আজ সেই ঢিবিতেই হামলা করব।
বাগানে শুকনা পাতার ওপর আমার খালি পায়ের আওয়াজ ওঠে। মর্মর, খসখস। ভাঁটঝোপ ঠেলে এগোই। হঠাৎ একটা ভয়ংকর ডাক শুনতে পাই—ট্রাউট ট্রাউট…ট্রাউট!
কী ভাবছিস? আনমনা দেখে সাইফুল জিজ্ঞেস করে। সংবিৎ আসে আমার। জড়ো করা শুকনা পাতায় দেশলাই ঠুকে দিই। আগুন জ্বলে ওঠে, শুকনা মরিচটা পুড়িয়ে নিই সেই আগুনে। কাজ শেষ, আগুন নিভিয়ে ইটচাপা দিই।
নির্ঘুম রাতে এই প্রাণীটা কত জ্বালিয়েছে! রাতে ভয় লাগে, এই ভরদুপুরে লাগছে না। বাগানে ভূতের ভয় আছে। কিন্তু আজ সে ভয় করছে না। বাগানের পাশেই মিন্টু ভাই খেতে কাজ করছেন। ভয় আসলে নির্জনতায় পেয়ে বসে, এটা বেশ বুঝি তখন। নইলে আরেকজন মানুষ কাছেপিঠে থাকলে ভয় কেন দূরে পালায়! সাহস যখন রয়েছে আজ, দেখতে চাই ভয়ংকর ডাকের প্রাণীটা আসলে কী? মা বলেছেন দিনকানা পাখি। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি, রাতদুপুরে বাতাবিলেবুর তলায় এসে এমন ডাকাডাকি করার মানে কী? মানুষকে ভয় দেখাতে আসে নিশ্চয়ই, হয়তো অমঙ্গলের বার্তা দিয়ে যায়। আজ যখন ভয় করছেই না, দেখেই ছাড়ব ওটাকে।
শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে যাই। বাঁশবাগানের ঠিক মাঝখান দিয়ে বেশ চওড়া একটা নালা। বাগানটাকে দুভাগ করার পাশাপাশি উঁচু-নিচুর ব্যবধানও তৈরি করেছে। বাগানের পশ্চিম পাশে জলা জমি। নালার পশ্চিম পাড়টা পুব পাড়ের চেয়ে বেশ নিচু। নালার জন্যই বাগানের ঠিক মাঝখানটাতে ঝোপঝাড় বেশি জমাট বাঁধতে পেরেছে। নালার ভেতর থেকে আসছে ডাকটা। খুব কাছে চলে যাই আমি। কিন্তু নিজে দেখা না দিলে এ জিনিস দেখা অত সহজ নয়, দেশের অন্যতম ছদ্মবেশী পাখি ওটা।
আন্দাজেই খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম ওর, মাড়িয়ে দিত হয়তো। পাতার ফাঁকে ঘাপটি মেরে বসে থাকা পাখিটার ছদ্মবেশ তখন খসে পড়ে। ভয়ে পালানোর জন্য ডানা মেলে বাতাসে। বেশি দূরে যায় না। আবার নিজেকে মিশিয়ে দেয় শুকনা পাতার সঙ্গে গায়ের রং মিশিয়ে। বোকা পাখি ভাবে, আমি বুঝি আর দেখছি না ওকে। হাসি পায় আমার, পাখির বোকামিতে। এগিয়ে যাই ধরার জন্য। পাখিও দেখে না দেখার ভান করে। খুব কাছে গিয়ে যখন ভাবি, এবার যাবে কোথায় বাছাধন! তখন পাখি আমাকে বোকা বানায়। ফরফর করে উড়ে গিয়ে প্রতিশোধ নেয়। সামনেও কোথাও গিয়ে বসে ছদ্মবেশী রাতচরা। কিন্তু আর ওটাকে খুঁজে পাই না।
পাখি বাদ দিয়ে উইঢিবিতে মনোযোগ দিই। উইঢিবি যেন একেকটা পর্বতশ্রেণি। পর্বতশৃঙ্গগুলো যেমন পাশাপাশি মাথা উঁচু করে থাকে, সুচালো শৃঙ্গের উইঢিবিগুলোও দেখতে তেমন। শুধু আকারে ক্ষুদ্র, এ–ই যা। পাহাড়ের সেই মিনিয়েচারগুলো সাদা মাটির তৈরি। ভেতরে ফাঁপা। তাই ভঙ্গুর। ভেতরে পুরোপুরি ফাঁপা বললেও ভুল হবে। ঢিবির ভেতরে অজস্র চেম্বারের বাদামি বাসা। বাইরের সাদা মাটি আসলে সেই বাসারই আবরণ। ভেতরে বাতাস চলাচলের প্রচুর জায়গা। আর খুব ঠান্ডা। উই রানি আর তার এলিট সন্তানদের জন্য কর্মী উইগুলো আরাম–আয়েশের খামতি রাখেনি।
নিড়ানি দিয়ে পাহাড়ি আবরণে মৃদু টোকা মারি। তাতেই ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়ে মাটির দেয়াল। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে সাবধানে বাদামি ওলের মতো কয়েকটা চাক ভেঙে নিই। নাইলনের ঝোলায় ভরে ফিরে আসি। তিতিরের কয়েক দিনের খাবার নিশ্চিত।
ফেরার সময় শুকনা বাঁশপাতার ওপর কিসের যেন আওয়াজ শুনি। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, সাপের ভয়ে। বৈশাখী গরমে সাপেদের উৎপাত বড্ড বেশি। এই বাগানেই সাপের খপ্পরে পড়েছি কয়েকবার। বিরাট একটা সাপ বাস করে। নিয়মিত দেখা হয় ওর সঙ্গে আমার। ছয় ফুট লম্বা কমসে কম। গরমের দুপুরে ওর ভয়ে খালি হাতে মাঠে যাইনি কখনো। হাতে লাঠি বা নিড়ানি থাকলেই–বা কী, কোনো দিন যদি তেড়ে আসে সাপ, তাহলে হাতের লাঠি কিংবা নিড়ানি উঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারব বলে মনে হয় না! বহুদিন দেখেছে সাপটাকে। কী সাপ জানি না। তবে এই আকারের সাপ হয় গোখরা, না হলে দাঁড়াশ। ফণা দেখে সাপ চেনার বয়স তখনো হয়নি আমার। কিন্তু ভয় পাওয়ার জন্য তো বয়স লাগে না। তাই যতবার দেখি, রক্ত হিম হয়ে যায়।
৩
আরেক বৈশাখী দুপুরে আমরা চলেছি ইছামতীর দিকে। আমি আর বন্ধু সাইফুল। কয়েক মিনিট হাঁটার পর খালের পাড়ে পৌঁছে যাই আমরা। খাড়া পাড় বেয়ে দৌড়ে নামি। ভাঙা ইটের টুকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেগুলো জড়ো করে, শুকনা পাতা কুড়াতে হবে। কিন্তু বন্ধুর চোখ আটকে যায় পাড়ের গায়ে গভীর গর্তে। খালের খাড়া পাড়ের এখানে-সেখানে গর্ত। মাছরাঙার। উড়ে ভেতরে ঢুকছে মা কিংবা বাবা পাখি। পোকা ঠোঁটে নিয়ে। বাচ্চাকে খাইয়ে বেরিয়ে আসছে। পাখি উড়ে গেলে বাসার ভেতরে উঁকি মারি আমি। ঘন অন্ধকার। হাত ঢুকিয়ে দেখার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু দাদির বারণ মনে পড়ে। ইতিহাসের কোন অতলে নাকি কোনো এক বালক হাত ঢুকিয়েছিল পাখির গর্তে। ছানার বদলে জুটেছিল জাত গোখরার কামড়। রক্ত হিম হয়ে যায় আমার। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে আসে। ভয়ের। বিদ্যুতের গতিতে হাত সরিয়ে নিই। সাপে যে বড্ড ভয় আমার! সেই হতভাগা কিশোরের জন্য মন খারাপ হয়, রাগ হয় সাপের ওপর।
কী ভাবছিস? আনমনা দেখে সাইফুল জিজ্ঞেস করে। সংবিৎ আসে আমার। জড়ো করা শুকনা পাতায় দেশলাই ঠুকে দিই। আগুন জ্বলে ওঠে, শুকনা মরিচটা পুড়িয়ে নিই সেই আগুনে। কাজ শেষ, আগুন নিভিয়ে ইটচাপা দিই।
লবণের কাগজের ভেতর পোড়া মরিচ ঢুকিয়ে সেটা রাখতে হবে থান ইটের ওপর। তারপর ভাঙা আধলা একটা ইট দিয়ে কাগজের ওপর ডলা দিতে হবে, যেভাবে শিলের ওপর পাটা দিয়ে বাটনা বাটেন মায়েরা, সেভাবে। আম খাওয়ার মসলা তৈরি। এবার যেকোনো একটা বাগানে গেলেই পাওয়া যাবে আম। ঢিলিয়ে না পাড়লেও চলে, বাতাসের তোড়ে ঝরে পড়ে কত আম!
ঝিনুক কই? সাইফুল জিজ্ঞেস করে। ঝিনুক লাগে আম ছিলতে। ঝিনুকের পেটের ঠিক মাঝখনটা শানে ঘসে ছিদ্র করা হয়, ধারালো ছিদ্র। সেই ছিদ্র দিয়ে আম ছেলার বড্ড সুবিধা। কিন্তু আম কাটতে অত সুবিধা নেই ঝিনুকে। তাই অনেক দিন ধরেই বিকল্প খুঁজছিলাম। অবশেষে সেটা হাতে পেয়েছি। সাইফুলকে বলিনি, চমকে দিতে চেয়েছিলাম ওকে। প্যান্টের পকেটে কাগজে মোড়ানো একটা সরু কাঠি বের করি। সত্যিই চমকে গেছে সাইফুল। কাগজের আবরণ সরাতেই রোদে রুপালি ইলিশের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে ওদের আম খাওয়া ছুরি।
শীতকাল থেকে আট আনা চার আনা করে জমিয়ে দশটা টাকা জোগাড় করেছিলাম। পাঁচ টাকা দিয়ে দোকানে গিয়ে একটা উখো কিনি। বাকি পাঁচ টাকা লাগে ছুরি বানাতে।
ছোট এই ছুরিখানা বানাতেও কত্ত হ্যাপা। কামারের কাছে কিছু বানাতে গেলে জনম জনম চলে গেলে তা আর তৈরি হবে কি না, গ্যারান্টি দেওয়ার কেউ নেই। সত্যি কামারকে উখোটা দিয়ে পাঁচ টাকা আগাম দিয়ে এসেছিলাম। কামার আজ দিই কাল দিই করে খালি ঘোরায়। মাসখানেক লেগে থেকে অবশেষে জিনিসটা হাতে পেয়েছি।
ইছামতীর তীর ঘেঁষে, পথের দুপাশে সোনালুগাছের সারি। যেন সোনার তৈরি নেকলেস কিংবা হলুদ রত্নের মালা ঝুলে আছে লম্বা লম্বা মঞ্জুরিতে ভর দিয়ে। কবেকার কোন শৌখিন বুড়ো ইছামতীর দুই পাশটাকে এভাবে সোনায় মুড়িয়ে দিয়েছিল, কে জানে? এই সৌন্দর্য সহ্য করা যায় না। মেঠো পথের দুই পাশ যদি সোনালি-হলুদে ঝিঁকিয়ে ওঠে, পথচারী-স্বপ্নাবিষ্ট কিশোরের বুকের ভেতর হু হু করবেই! হু হু করে আমার বুকেও।
বহুদিন পর, গ্রামে গিয়ে সেই মেঠো পথ আজও সেই মেঠো পাই। তবে এখন পিচঢালা শহুরে পথে রূপ নিয়েছে। কিন্তু সেই সোনালি আলো কোথায় হারিয়ে গেছে! বড় বড় সোনালুগাছ কে কবে কেটে ফেলেছে, তার খবর কেউ রাখে না। সোনালুগাছকে অত সহজে মারা যায় না। কেটে ফেললে মোঁথা থেকে বেরোয় নতুন গাছ। সে গাছ বেড়ে উঠে ফুলবতী হওয়ার আগেই আবার কে বা কারা দা চালায়, সৌন্দর্য তাদের আক্ষরিক অর্থেই সহ্য হয় না। এখন তাই সোনালুগাছ নয়, গাছের ফসিলই চোখে পড়ে। সোনাঝরা ফুলে মন হু হু করার দিন আর নেই। হারিয়ে গিয়েছে আমাদের সেই আম আর বাঁশের বাগানটাও। হারিয়ে গেছে আমার সেই বন্ধু সাইফুল—সোনালুগাছগুলোর মতো কিংবা বৈশাখের দুপুরে প্রথম যেদিন ঘুঘুর ডাকে মন কেমন করেছিল, সেই ঘুঘুটার মতোই। শহরে বসে আজও সেই ঘুঘু, তিতিরছানা, সোনালুগাছ, সোনাঝরা দুপুরের সেই রাতচরা পাখি কিংবা বিশাল সেই সাপটা খুঁজে ফিরি; সেই বন্ধু সাইফুলকেও খুঁজে ফিরি স্মৃতির ঝাঁপি মেলে।