এলিয়েনের ডিম

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

গুদরি বাজারের জিনিস ততটাই খাঁটি, যতটা আসল ধোলাইখালের কলকবজা, কথাটা ভালো করে জানে সাকিব। এই শহরে এমন কেউ নেই যে গুদরি বাজার চেনে না। বাইরে থেকে দেখলে জায়গাটা হাতের মুঠোর মতো ছোট্ট। কিন্তু একবার ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায় বিশাল এই গুদরি বাজার। সাপুড়ের বাক্সে আঁটা ছোট ছোট সাপের মতো গলিগুলো বাজারজুড়ে ছড়িয়ে আছে। না চিনলে পথ হারিয়ে গোলকধাঁধার মতো পাক খাওয়ার সমূহ আশঙ্কা। শমসের আলী নামের এক দোকানদারকে চেনে সাকিব, গুদরি বাজারের সব গলি চিনে নিতে তার এক বছর লেগেছে। অথচ বাজারের মধ্যে সে সারা দিন লাট্টুর মতো পাক খায় আর ফেরি করে কলম, ছাতা, ব্যাগ বিক্রি করে।

গুদরি বাজারের নাড়ি-নক্ষত্র সাকিবের জন্ম থেকে জানা। তার বাবা হজরত সওদাগর বিক্রমপুরের মানুষ। প্রথম যৌবনে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবসা করতে গুদরি বাজারে এসেছিলেন। সেই ব্যবসা ভালো চলেনি। মানুষ তখনো মাটির সরায় ভাত খেতে অভ্যস্ত। রসুইঘরে ধাতব পাত্রের আগ্রাসনে বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি। হজরত তখন প্রসাধনপণ্যের ব্যবসায় মনোযোগ দেন। সেখান থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একটা দোকান পাঁচটা হয়েছে। কর্মী একজন থেকে বেড়ে ১৫ জনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাতে কী হবে? কামরাঙ্গীরচর ও সৈয়দপুরের সাইনবোর্ডহীন কারখানায় বানানো রাজ্যের নকল কসমেটিকসের ব্যবসা থেকে তার বাবা বিন্দুমাত্র সরেননি।

সরেনি অন্যরাও। গুদরি বাজারে খুঁজে আসল পণ্য পাওয়া খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবু লোকে গুদরি বাজারের জিনিস কেনে। কম দামে জিনিস পেলে হামলে পড়া বাঙালির স্বভাব। সেটাকে কাজে লাগিয়ে রোজ লাখো-কোটি টাকার ব্যবসা হয়। সন্দেহপ্রবণ মানুষ যে একেবারে আসে না, তা নয়। তাদের মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে দেওয়া হয়। এই কাজে ১৬ বছরের মিন্টু একজন ওস্তাদ মানুষ।

মিন্টু সাকিবের সমবয়সী। সেই সূত্রে তারা বন্ধু। মিন্টু কর্মচারী আর সাকিব মালিকের ছেলে। তাদের মধ্যে অমিলের এখানেই শেষ নয়। সাকিব স্কুলে পড়ে আর মিন্টু কোনোরকমে নিজের নাম লিখতে পারে। তৃতীয় শ্রেণির পর সে আর বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোয়নি। সাকিব অন্তর্মুখী। পরিচিত মানুষের বাইরে তার মুখে বোল ফোটে না। অন্যদিকে মিন্টু কথার জাদুকর। কোলের শিশু থেকে ত্রিকালদর্শী বুড়ো, যেকোনো মানুষকে মিন্টু মুহূর্তের মধ্যে পটিয়ে ফেলতে পারে। তিন কুলে কেউ না থাকলেও শহরজোড়া তার আত্মীয়তার সম্পর্ক পাতা।

হজরত সওদাগরের ইচ্ছা, ছেলে এসএসসি পাস করে ব্যবসার হাল ধরুক। স্কুল শেষে সাকিবকে তাই দোকানে বসতে হয়। বেচাবিক্রি নিয়ে সাকিবের অবশ্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে মূলত মিন্টুর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য দোকানে বসে। মিন্টু বুঝদার ছেলে। মনিবপুত্রকে কখনো নাম ধরে ডাকে না। সাকিব ‘মিন্টু’ বলে ডাকলেও সে সাকিবকে ‘ভাই’ বলে। দুজনের সম্পর্কে শ্রেণিবিভাগের অদৃশ্য দেয়াল থাকলেও বন্ধুত্বের ডালপালা গজাতে কোনো সমস্যা হয়নি।

ষাট বছরের এক বৃদ্ধাকে ত্বক টানটান করার ক্রিম বেচে মিন্টু সাকিবের দিকে তাকাল। সাকিবের সব মনোযোগ ফোনে। মিন্টু মুখের হাসি ধরে রেখে বলল, ‘কীভাবে ক্রিমটা বেচলাম খেয়াল করছ সাকিব ভাই? মহিলা আমার কথা শুনে হাঁ হয়ে গেছে। জীবনেও আর অন্য কোনো ক্রিম কিনবে না।’

সাকিব একবার মিন্টুর দিকে তাকিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দিল।

মিন্টু বলল, ‘তোমাকে এই সব শিখতে হবে। কাস্টমারকে পটানোর জন্য কিছু কথা বলতে হয়। কিছু কথা বলতে হয় দামদর করার জন্য। কোনো কোনো কাস্টমার খুব চালাক। আসল জিনিস চেনার হাজারটা কৌশল জানে। তাদের চোখে ধুলা দিয়ে প্রোডাক্ট সেল করতে হয়। মনে রাখবা, লাভ ছাড়া কখনো নিজের বাপেরেও মাল দিবা না।’

সাকিব ফোনটা বন্ধ করে বলল, ‘তুই আছিস লোক ঠকানো ব্যবসা নিয়ে। এটা একটা ব্যবসা হলো? আমি এই সব শিখব না। এই ব্যবসা করব না। তোদের ব্যবসা আর গুদরি বাজার, দুইটাকেই আমি ঘৃণা করি।’

মিন্টুর মুখের হাসি অমলিন। সে চট করে সাকিবের হাত টেনে বাইরে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় দোকানটা দেখার ভার দিল আরেক সেলসম্যান কামরুলকে।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সাকিবের হাতে মৃদু চাপ দিল মিন্টু। মুরব্বিদের মতো ভারিক্কি গলায় বলল, ‘গুদরি বাজারে ছোটবেলা থেকে আসছ। কিন্তু কোনো দিন ভালো করে বাজারটা খেয়াল করেছ?’

সাকিব অবাক হয়ে বলল, ‘কী খেয়াল করব? গলি দিয়ে ঢোকামাত্র হাজারটা জিনিসের মিশ্র একটা গন্ধ নাকে ঝাপটা মারে। যত ভেতরে যাওয়া যায়, শুধু অন্ধকার আর গলির দৈর্ঘ্য বাড়ে। মানুষের ঘামের গন্ধে বমি আসে।’

মিন্টুর চোখে বুদ্ধি ঝিলিক মেরে গেল, ‘আরে না। এই যে এত শত শত দোকান, অধিকাংশই সারা দিন বন্ধ থাকে। তারপরও তারা কীভাবে ব্যবসা চালায় খেয়াল করেছ?’

সাকিব বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে মিন্টুর দিকে তাকাল। মিন্টু রহস্যময় হাসি হেসে চাপা গলায় বলল, ‘এইখানে দিনে এক রকম, রাতে আরেক রকম ব্যবসা চলে। দিনের ব্যবসা নিয়ে যাদের আগ্রহ নেই, তারা রাতে আসে ব্যবসা করতে। এই জন্য ওদের দোকান সারা দিন বন্ধ থাকে। বুঝলা সাকিব ভাই?’

সাকিব মিন্টুর দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে গুল মারছে। বলল, ‘তুই বললেই হলো? রাতে ব্যবসা করা নিষেধ। ৯টার পর বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাজারের সব গলির মুখে কলাপসিবল গেটে বিরাট তালা ঝোলে। মেইন গেটে বসে পাহারা দেয় বুড়ো দিলীপ দারোয়ান। বাইরের লোক ভেতরে আসবে কী করে?’

মিন্টু পকেট থেকে এক টুকরা সুপারি বের করে মুখে পুরে বলল, ‘আজ রাতে একটু সময় দিতে পারবা? তোমাকে মজার একটা জিনিস দেখাব।’

পৌনে ৯টার মধ্যে মার্কেটের সব মানুষ বেরিয়ে গেল। মিন্টু ও সাকিব আরও তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করে দোকানের শাটার খুলে বেরিয়ে এল।

পুরো গুদরি বাজার অন্ধকারে খাঁ খাঁ করছে। পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার চমকে দিচ্ছে। দোকানপাট সব বন্ধ। সাকিব ফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালানোমাত্র মিন্টু ইশারায় নিভিয়ে ফেলতে বলল। কে বলবে দিনের বেলায় এখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়? রাতের বেলায় মনে হচ্ছে, জায়গাটা অনেক দিন ধরে পরিত্যক্ত। শুধু ইঁদুর, ছুঁচো ও তেলাপোকারা ডেরা থেকে বেরিয়ে ছোটাছুটি করছে।

সাকিব ফিসফিস করে বলল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

মিন্টু জবাব না দিয়ে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল। হারিয়ে ফেলার ভয়ে সাকিব তার পেছন পেছন প্রায় ছুটতে আরম্ভ করল।

মিনিট দশেক হেঁটে অনেক গলিঘুপচি পেরিয়ে তারা হাজির হলো একটা কানাগলির মাথায়। মিন্টু আঙুলের ডগা দিয়ে তিনবার টোকা দিতেই পুরোনো কাঠের দরজা ক্যাঁচ করে খুলে গেল।

গুদরি বাজারের এই অংশে সাকিব আগে কখনো আসেনি। মাথার ওপর অসংখ্য সবুজ ডিমলাইট জ্বলছে। আলোয় চারপাশ অপার্থিব মনে হয়। তার ভেতর মানুষে গিজগিজ করছে।

বিস্মিত হয়ে চারপাশে লক্ষ করতে লাগল সাকিব। এ যেন বাজারের ভেতর বাজার, এক জগতের মধ্যে আরেক জগৎ। ছায়ার মতো নিঃশব্দে মানুষের বিকিকিনি চলছে। বিক্রেতারা বিচিত্র জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে। গন্ডারের শিং, মৃগনাভি, হাতির দাঁত, বাঘের দুধ, ড্রাগনের জিব, সাপের মণি—ফিসফাস করে কত কিছুর নাম ভাসছে বাতাসে। গামছায় চোখ–মুখ বাঁধা এক লোক সাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পরি লাগবে? পরি?’

বলে সে লুঙ্গির প্যাঁচ থেকে একটা কাঠের কর্ক আঁটা কাচের বোতল বের করে আনল। বোতলের মধ্যে লাল লেহেঙ্গা পরা তিন ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের জীবন্ত নারীমূর্তিকে দেখে সাকিবের চোয়াল বিস্ময়ে ঝুলে গেল। সে কিছু বলার আগেই মিন্টু একঝটকায় টান মেরে সামনে নিয়ে গেল তাকে। ফিসফিস করে বলল, ‘আমরা দেখতে এসেছি, কিছু কিনতে না। না জেনেশুনে এই বাজার থেকে কিছু কেনা বিপজ্জনক হতে পারে।’

‘বিপজ্জনক কেন হবে?’

মিন্টু বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় কে যেন সাকিবের হাত টেনে ধরল। সে তাকিয়ে দেখল, প্রায় দুই ফুট লম্বা এক লোক তার হাত ধরে টানছে। সাকিব আতঙ্কে দুই পা পিছিয়ে এল। ১৬ বছরের জীবনে সে কোনো দিন এমন বীভৎস চেহারা দেখেনি। লোকটার মুখ দেখলে তেলাপিয়া মাছের কথা মনে হয়। তেমন হাঁ করা মুখ, নিষ্পলক চোখ, দাঁতবিহীন মাড়ির গা শিউরানো প্রদর্শনী। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, লোকটার পুরো শরীর ছোট ছোট আঁশে ঢাকা।

খোলা মুখ আরও খুলে হাসির মতো শব্দ করে লোকটা বলল, ‘সারা দিন কিছু খাইনি। কয়টা টাকা দেবে?’

লোকটার গলায় জলজ ভাবটা প্রবল। নদীতে বৈঠা চালালে যেমন ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হয়, ঠিক তেমন। মিন্টু সাকিবের হাত টেনে দূরে নিয়ে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে সাকিব পকেট থেকে একটা ৫০ টাকার নোট বের করে লোকটার হাতে দিল। বড় বড় নখওয়ালা আঁশযুক্ত আঙুল দিয়ে লোকটা খপ করে টাকাটা মুঠোবন্দী করে বলল, ‘আমি ভিক্ষা করি না। আমার কাছে একটা ডিম আছে। নেবে?’

মিন্টু তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, ‘আমাদের ডিমটিম লাগবে না। আপনি যান তো।’

লোকটা মুখ টিপে কিছুক্ষণ হাসল। তারপর বলল, ‘আমার কাছে যা ছিল, সব বেচে ফেলেছি। ক্রেতাদের কপাল ফিরে গেছে। স্পেসশিপের প্রতিটা যন্ত্র খুলে খুলে বিক্রি করেছি। ধোলাইখালের মর্কট মেকানিকরা সেগুলো গলিয়ে মোটরগাড়ির পার্টস বানিয়েছে। সবাই সবকিছুর মর্ম বোঝে না।’

সাকিব ঢোক গিলে বলল, ‘স্পেসশিপ মানে?’

লোকটা কোনো ভণিতা না করে বলল, ‘রকেটের কথা বলছি। যে যানে চড়ে আমি পৃথিবীতে এসেছিলাম, তার কথা বলছি।’

সাকিবের হাত-পা হিম হয়ে গেল। সে কাঁপা গলায় বলল, ‘আপনি ভিনগ্রহী? এলিয়েন?’

দুই হাতে তালির মতো শব্দ করে লোকটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সায় দিল।

সাকিব বলল, ‘একা এসেছেন? আপনার স্পেসশিপ কই?’

‘ছিলাম দুজন। আমি আর কোপাইলট নরগট। চিকলির বিলে আমাদের স্পেসশিপ ক্রাশ করে। আমরা জলে-স্থলে সমানভাবে বাঁচতে পারি। নরগট সাহায্য আনার জন্য শহরে গিয়েছিল। ওখানে কিছু দুষ্ট লোক তাকে ধরে সার্কাসওয়ালাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আমি এখন চিকলিতেই থাকি। মাঝেমধ্যে শহরে আসি খাবার জোগাড় করতে।’

‘আপনি কী খান?’

‘ভাত, ডাল, চটপটি, ফুচকা—যা পাই সব খাই। তবে মাছ খেতে সবচেয়ে পছন্দ করি।’

তারপর কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে নীরবতা নেমে এল। মিন্টু লোকটার কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনি। সে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উসখুস করছিল। লোকটা বুদ্ধিমান। ব্যাপারটা ধরতে পেরে বলল, ‘ডিমটা নেবে? এক হাজার টাকা দিতে হবে।’

সাকিব মিন্টুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘টাকা দিয়ে কী করবেন?’

লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘নরগটকে খুঁজতে যাব। বন্দী থাকতে বেচারার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি কিছু টাকা জমিয়েছি। ওই টাকা দিয়ে ওকে ছাড়িয়ে আনব। তারপর দুজন মিলে আমাদের গ্রহে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করব।’

সাকিব পকেট থেকে এক হাজার টাকার একটা কড়কড়ে নোট বের করে আনল। মিন্টু বাধা দিতে গিয়েও পারল না। লোকটা চটের ঝোলার ভেতর থেকে শিল–নোড়ার মতো একটা বস্তু বের করে সাকিবের সামনে ধরল। সে হাত বাড়িয়ে ডিমটা নিল। বেশ গরম। ওপরের অংশটা মসৃণ হলেও কেমন যেন অসমান। মোম বা ওই–জাতীয় কোনো জিনিস দিয়ে ডিমটা পালিশ করা মনে হলো।

লোকটা টাকা নিয়ে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। মিন্টু মাথা ডানে-বাঁয়ে নেড়ে বলল, ‘তোমার চালু হইতে এখনো দেরি আছে সাকিব ভাই। লোকটা ধুরন্ধর। আমি গ্যারান্টি দিতে পারি। ওই লোক ওস্তাদ লেভেলের সেলসম্যান। তোমাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে একটা পাথর হাতে ধরিয়ে দিয়ে এক হাজার পঞ্চাশ টাকা বাগিয়ে নিল। এই রকম হইলে তুমি ব্যবসা করতে পারবা না। কাউরে কখনো বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করবা না। আমাকেও না। বুঝছ?’

সাকিব লজ্জিত হয়ে বলল, ‘আরে টাকা গেলে যাক। লোকটাকে দেখেছিস? ওই রকম বীভৎস চেহারা কোনো পৃথিবীর মানুষের হতে পারে? আমার মনে হয়, লোকটা সত্যি এলিয়েন।’

মিন্টু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সাকিবকে হিড়হিড় করে টেনে রাতের রহস্যময় বাজার থেকে বেরিয়ে এল। জাহাজ কোম্পানির মোড়ে দুই বাটি গরম ছোলা সেদ্ধ খেয়ে মিন্টু মেস ও সাকিব বাসার পথ ধরল।

পুরো শহর আশ্চর্য রকম নীরব। মাঝেমধ্যে সিটি করপোরেশনের কিছু ময়লার ট্রাক উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে হেলেদুলে যাচ্ছে। সোডিয়াম বাতির আলোয় রোড ডিভাইডারের লাল বাগানবিলাস ফুলগুলো দেখে কালো মনে হচ্ছে। সাকিব পকেটে হাত দিয়ে ডিমটা পরীক্ষা করে নিল। আছে, পড়েটড়ে যায়নি।

বাসায় ফিরে সে পড়ার টেবিলে বসে অনেকক্ষণ ডিমটা নেড়েচেড়ে দেখল। এটা সত্যি সত্যি এলিয়েনের ডিম হলে একটা আশ্চর্য ব্যাপার হবে। জিনিসটা অর্ধগোলাকার। হাতের মুঠোয় পোরা যায়। একটানা বেশিক্ষণ হাতে ধরে থাকা যায় না। গরম লাগে।

সকালে ভালো করে দেখবে ভেবে সাকিব ডিমটা টেবিলে রাখল। মাঝরাতে একবার পানি খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠে সে আবার ডিমটা ধরে দেখল। ডিমটা আরও গরম হয়েছে দেখে কী মনে করে এক মগ পানির মধ্যে চুবিয়ে রাখল। আর তাতেই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা।

ভোরবেলা তীব্র আলোর বিচ্ছুরণে সাকিবের ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে ফজরের আজান হচ্ছে। আকাশ এখনো ফরসা হয়নি। অথচ তার ঘর উজ্জ্বল সবুজ আলোয় ভেসে যাচ্ছে।

সাকিব ভয় পেয়ে উঠে বসল। দেয়ালের সঙ্গে শরীর সিঁটিয়ে দিয়ে লক্ষ করল, আলো আসছে মগ থেকে। ওখানেই রাখা আছে সেই এলিয়েনের ডিম।

ভয়ে ভয়ে খাট থেকে উঠে এল সাকিব। এক পা, দুই পা করে এগিয়ে এসে মগের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখল, ভেতরে পানির কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু উজ্জ্বল সবুজ বলের মতো ডিমটা পড়ে আছে। সেটা থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে উজ্জ্বল সবুজ আলো।

আলোর ছটায় সাকিবের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বাবাকে তার ভীষণ ভয়। বাবা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের নামাজ পড়ার জন্য উঠবেন। সাকিবের ঘরে এই সব ভুতুড়ে কাণ্ড দেখলে রেগে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসতে পারে।

সাকিব তাড়াতাড়ি ডিমটা তুলে একটা কাঁথার ভেতর লুকিয়ে ফেলল। তারপর স্কুলের ব্যাগে কাঁথাটা ভরে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইল।

সাকিবের মনের মধ্যে ভাবনাগুলো মেইল ট্রেনের মতো দ্রুত ছোটাছুটি করতে লাগল। ডিমটা আসলে কিসের? মিন্টু বলেছিল, গুদরি বাজারের জিনিস বিপজ্জনক হতে পারে। কেন বলেছিল কথাটা? মিন্টু কি কিছু জানে?

সাতটা নাগাদ সাকিব বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্য মিন্টুর মেস। রাতের ঘটনাটা মিন্টুর সঙ্গে শেয়ার করার জন্য সাকিবের তর সইছে না।

নূরপুর মোড়ে রিকশা থেকে নামতেই মিন্টুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে সকাল সকাল নাশতা করতে বেরিয়েছে। সাকিব মিন্টুর হাত ধরে টানতে টানতে মেসের ভেতর নিয়ে গেল।

মিন্টুর মেস এই সকালেও প্রায় অন্ধকার। ঘরের ভেতর শুধু একটি চৌকি ও টেবিল পাতা। হাঁটাচলারও জায়গা নেই। খাটে মিন্টুকে বসিয়ে গত রাতের ঘটনা যতটা সম্ভব গুছিয়ে বলল সাকিব। পুরো সময় মিন্টু মূর্তির মতো নিশ্চুপ বসে রইল। সাকিব শেষ করামাত্র সে বলল, ‘আগেই বলেছিলাম, গুদরি বাজারের জিনিস বিপজ্জনক হতে পারে।’

সাকিব ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘এখন আর সে কথা বলে লাভ আছে? কী করা যায়, সেটা বল।’

মিন্টু বলল, ‘তুমি বললে, ডিমটা মগের পানি শুষে নিয়েছে। পাথর হলে পানি শুষে নেওয়ার কথা না।’

‘শুধু তা–ই না, পানিতে থেকে আরও উজ্জ্বল হয়েছে। চোখধাঁধানো আলোতে আমার ঘুম ভেঙেছে।’

মিন্টু কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে থেকে বলল, ‘লোকটা কোথায় যেন থাকে বলেছিল?’

‘চিকলি বিলে। ওখানে ওর স্পেসশিপ ক্রাশ করেছিল।’

‘চল। যার জিনিস, তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসি।’

সাকিব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তাকে পাত্তা না দিয়ে মিন্টু চট করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ওর পিছু নিয়ে রিকশায় উঠল সাকিব।

বর্ষায় চিকলি বিল একেবারে টইটম্বুর। গত দুই দিন বৃষ্টি হয়নি। তারপরও শুষ্কতার কোনো চিহ্ন চিকলির বুকে নেই। একসময় চিকলি ছিল নদী। বড় বড় সওদাগরি নৌকা আসামে যাওয়ার পথে এখানে জিরিয়ে নিত। এখন আর সেই স্রোতস্বিনী নদী নেই। টুকরা টুকরা হয়ে চিকলি বিল আকারে টিকে আছে।

বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে মিন্টু বলল, ‘ডিমটা ছুড়ে ফেলে দাও। যার জিনিস, সে কুড়িয়ে নিয়ে যাক।’

সাকিব ব্যাগ থেকে কাঁথাটা বের করে আলগোছে ভাঁজ খুলতেই তীব্র আলোর ছটায় দুজনের চোখ ঝলসে গেল। কয়েকটা কুকুর দল বেঁধে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছিল, ভৌ ভৌ করে মরণচিৎকার শুরু করল। সাকিব ডিমটা ধরে সর্বশক্তি দিয়ে বিলের পানিতে ছুড়ে ফেলল। ডিমের উত্তাপ এখনো একটুও কমেনি।

ফিরে আসার পর দুজনই ব্যাপারটা ভুলে গেল। সাকিব স্কুলের পড়াশোনা আর মিন্টু দোকানের বেচাবিক্রি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সপ্তাহখানেক পর শহরজুড়ে হঠাৎ আলোড়ন উঠল। চিকলির বিল শুকিয়ে গেছে! বর্ষা মৌসুমে যা অবিশ্বাস্য ঘটনা।

সরকারের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী তদন্ত করে কোনো কারণ উদ্‌ঘাটন করতে পারলেন না। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটা মানুষ ভুলে গেল। শুধু ভুলল না সাকিব ও মিন্টু। চিকলিতে না ফেলে কোনো নদী বা বঙ্গোপসাগরে ডিমটা ফেললে কী হতো, ভাবলেই তাদের গা শিউরে ওঠে।

রাতের গুদরি বাজারে এরপরও ওরা গেছে। আঁতিপাঁতি করে রহস্যময় বেঁটে লোকটাকে খুঁজেছে। পায়নি। লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে তার একসময়ের বাসস্থান চিকলির বিলকেও।