গুড্ডুবুড়া বনাম পথকলি ফুটবল ক্লাব

অলংকরণ: নাইমুর রহমান

গুড্ডুবুড়া কি জানে, আজকালকার তরমুজ গোলও হয়? গুড্ডুবুড়ার বাবা বাসায় কিনে আনলেন একটা গোল তরমুজ। এসব তরমুজ নাকি হয় রাঙামাটিতে! ছোট্ট, গোল, কিন্তু খুব মজা। তিনি তরমুজ কিনে এনে খাবার টেবিলের ওপরে রাখলেন। তারপর কাপড়চোপড় ছাড়তে ঢুকে গেলেন বাথরুমে।

কাজের বুয়া তখন আবার টেবিল পরিষ্কার করছিলেন। তরমুজটা ছিল একটা নেটের ব্যাগে। বুয়া তরমুজটা রাখলেন মেঝেতে।

সেই সময় গুড্ডুবুড়া এল সেই ঘরে। এসে দেখল, কী সুন্দর একটা বল মেঝেতে পড়ে আছে। বাবা নিশ্চয়ই তার জন্য ফুটবল কিনে এনেছেন। গুড্ডুবুড়া দৌড়ে এসে কষে একটা লাথি মারল তরমুজে। তারপর চিৎকার, ওরে বাবা রে ওরে মা রে...

মা ছুটে এলেন। বুয়া দৌড়ে এলেন, কী হইছে...বাবাও বেরিয়ে এলেন বাথরুম থেকে।

গুড্ডু ভীষণ ব্যথা পেয়েছে পায়ে। মা তাড়াতাড়ি ফ্রিজ থেকে বরফ বের করলেন। পায়ে ধরলেন বরফ।

গুড্ডুবুড়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, ফুটবলটা আমাকে ব্যথা দিয়েছে।

বাবা বললেন, ফুটবল ব্যথা দিয়েছে! কীভাবে?

আমি ওই ফুটবলটায় কিক মেরেছিলাম।

বুয়া বললেন, কী কন গুড্ডুবাবা, এইটা তো ফুটবল না। এইটা তরমুজ!

মা আর বাবা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন।

বুয়া বললেন, খাড়ান। আমি তরমুজটা কাইটা আনি। আপনে তরমুজ খান। তাইলে বুঝবেন তরমুজ কী জিনিস।

বুয়া তরমুজ কেটে আনলেন ঠিকই, কিন্তু গুড্ডুবুড়া কিছুতেই তরমুজ খাবে না। আসলে সে তো কোনো কিছুই খেতে চায় না। না খেতে খেতে তার শরীরটা হয়ে গেছে দেশলাইয়ের কাঠির মতো। দেশলাইয়ের কাঠির ওপরে যেমন একটুখানি বারুদ থাকে, গুড্ডুবুড়ার শরীরটাও তা–ই, কাঠির ওপরে মাথাটা বসানো।

না খেয়ে খেয়ে ওর ব্রেন গেছে শুকিয়ে। সে শুধুই উল্টাপাল্টা কাজ করে।

এই তো সেদিন। স্কুলে তার এক বন্ধু তপু ফিসফিস করে কথা বলছে।

গুড্ডুবুড়া বলল, এইভাবে কথা বলছ কেন? তোমার কী হয়েছে?

তপু বলল, গলা ভেঙে গেছে।

গুড্ডুবুড়া বলল, তোমার গলা ভাঙল কী করে? রিকশা থেকে পড়ে গেছিলে নাকি গাছ থেকে?

মানে?

মানে গলা ভেঙেছে বলছ, কেমন করে ভাঙল? আঘাত পেলে কীভাবে?

ভেঙে গেছে মানে বসে গেছে। ব্রেক করেনি। তপু বলল।

তোমার গলা বসে গেছে মানে কী? গলা কি দাঁড়িয়ে থাকে? গলা কি শুয়েও পড়ে নাকি!

তপু বলল, তোমার মতো বোকার সঙ্গে কথা বলা মানে লস। এমনিতেই ডাক্তার আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছে!

গুড্ডুবুড়ার খালা বললেন, আমার ল্যাপটপটাতে ভাইরাস অ্যাটাক করেছিল। অ্যান্টিভাইরাস ডাউনলোড করলাম। এখন আমার ল্যাপটপে আর ভাইরাস অ্যাটাক করতে পারবে না।

শুনে গুড্ডুবুড়া তার বাবার ল্যাপটপটা সাবানপানি দিয়ে ধুতে আরম্ভ করে দিল। সাবান পানি দিয়ে ধুলে ভাইরাস মরে যায়। সে জন্য তারা করোনার সময় সাবান দিয়ে হাত ধুত।

খালা চিৎকার করে উঠলেন, এই গুড্ডু, কী করিস?

বাবার ল্যাপটপটাকে ভাইরাস থেকে বাঁচাচ্ছি। ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় হলো নিয়মিত সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া।

গুড্ডুবুড়ার কাণ্ডকারখানা দেখে চারপাশের সবাই অনেক মজা পায়। ক্লাসে টিচার জিজ্ঞেস করলেন, মানুষের কয় পা?

সবাই বলল, দুই পা।

টিচার বললেন, চার পা আছে কার?

গুড্ডুবুড়া হাত তুলল।

বলো, গুড্ডু, চারপাওয়ালা একটা...

গুড্ডু বলল, চেয়ার।

টিচার বললেন, না। জিনিস না। তুমি একটা প্রাণীর নাম বলো। যার প্রাণ আছে।

গুড্ডু বলল, টেবিল।

টিচার বললেন, টেবিলের প্রাণ আছে?

জি। টেবিলের ওপরে একটা প্রাণ সস আছে। প্রাণ সস, সসের বস।

ক্লাসের সবাই হাসতে লাগল।

এ ধরনের মজা ক্লাসে অনেক হয়।

টিচার বললেন, পাখা যার আছে, তাকে পাখি বলে। একটা পাখির নাম বলো।

গুড্ডু বলল, টেবিল ফ্যান।

টিচার বললেন, কী রকম?

টেবিল ফ্যানেরও পাখা আছে।

টিচার বললেন, শুধু পাখা থাকলে হবে না। পা থাকতে হবে। মাথা থাকতে হবে। প্রাণ থাকতে হবে।

গুড্ডু বলল, মশা।

তো গুড্ডুবুড়া তরমুজে লাথি মেরে আহত। পা ফুলে গেল। ডাক্তারের কাছেও নিতে হলো। কয়েক দিন পরে তার পা ভালো হলো। সে ভুলেই গেল ব্যথার কথা।

এবার বাবা তার জন্য একটা ফুটবল কিনে আনলেন। সবুজ রঙের ফুটবল।

গুড্ডুবুড়া ভাবল, এটাও তরমুজ। তো তরমুজটাকে তো কাটতে হবে। সে একটা ছুরি রান্নাঘর থেকে এনে ডাইনিং টেবিলের ওপরে ফুটবল রেখে বলটা কাটতে আরম্ভ করল। বল তো খানিকটা কাটলই, হাতটাও কাটল খানিক।

সে চিৎকার করে উঠল। ও বাবা রে ও মা রে...

মা ছুটে এলেন। দেখলেন, গুড্ডুর হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে। ওদিকে ফুটবলের বাতাস গেছে বেরিয়ে...

কেমন করে হলো? মা বললেন।

আমি তরমুজটা কাটতে চেষ্টা করছিলাম...

মা বললেন, এই ছেলেকে নিয়ে আর পারি না। একে নিয়ে কী করি?

খালা বললেন, একে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।

গুড্ডুবুড়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার সব শুনলেন। তারপর বললেন, গুড্ডুবুড়া, তোমাকে একটা ইনজেকশন দিতে হবে।

গুড্ডু ভয়ে চিৎকার করে উঠল, না না, আমি ইনজেকশন নেব না...

ডাক্তার বললেন, আসলে তোমার কোনো সমস্যা নেই। তোমার একটাই সমস্যা। তুমি খাও না। তোমাকে ঠিকঠাক খেতে হবে। ভাত খেতে হবে, রুটি খেতে হবে। দুধ খেতে হবে, ডিম খেতে হবে। মাছ খেতে হবে, মাংস খেতে হবে। ফল খেতে হবে। শাকসবজি খেতে হবে। তাহলে তোমার ব্রেন ভালো থাকবে। তখন তুমি দেখবে তুমি হয়ে যাবে ক্লাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলে। আর ভালো খাওয়ার পাশাপাশি তোমাকে প্রচুর খেলাধুলা করতে হবে।

গুড্ডুবুড়া এরপর থেকে ঠিকঠাক খেতে আরম্ভ করল। আর শুরু করল খেলাধুলা। ঠিকঠাক খাওয়ার ফলে তার বুদ্ধি আসলেই খুলে গেল। আর প্রচুর খেলাধুলা করার ফলে তার শরীরটা হয়ে উঠল একেবারে ফার্স্টক্লাস, কোনো রোগশোক নেই। চমৎকার।

গুড্ডুবুড়া যখন বোকা ছিল, তখন তাকে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল, এই তুই ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা। গুড্ডুবুড়া জবাব দিয়েছিল, আমি গুড্ডু! তবে আমার এক ফুপু আছে, তার নাম চায়না। আর আমার একটা ভাই আছে, তার নাম রিয়াদ। রিয়াদ হলো সৌদি আরবের রাজধানী।

গুড্ডুবুড়া এখন ভীষণ স্মার্ট।

তার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বিশ্বকাপের মৌসুমে পাগল হয়ে উঠল। কেউবা আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে চাপাচ্ছে, কেউবা ব্রাজিলের পতাকা টাঙাচ্ছে। কেউবা আবার জার্মানির ভক্ত। কেউবা বলছে, রোনালদোর পর্তুগালই আমার ফেবারিট। স্পেন স্পেন...আরেক বন্ধুর চিৎকার। ইশ্‌, নেদারল্যান্ডেসর মতো দল আছে নাকি! আরেক বন্ধু বলল।

গুড্ডু বলল, শোন, খেলা তো আমরা দেখবই। খেলা নিয়ে মাতামাতিও করব। আনন্দ তো আমাদের করতেই হবে। কিন্তু মেসি আর নেইমার তো ঠিকই বন্ধু। জানিস, আমি নেটফ্লিক্সে একটা ছবি দেখেছি, নাম, নেইমার: দ্য পারফেক্ট কেওয়াস। তাতে দেখলাম, নেইমার যখন ইউরোপে খেলতে গেল, গোল করতে পারে না, তখন বাথরুমে ঢুকে কাঁদছিল। মেসি এসে বলেছিল, চিন্তা কোরো না, পরের ম্যাচেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ওরা বন্ধু। আর আমরা কেন শত্রু হব? এসো, আমরা বিশ্বকাপের এই উত্তেজনাটাকে ভালো কাজে ব্যবহার করি।

আমরা স্কুলে চারটা দল বানাই। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, পর্তুগাল সাপোর্টার্স ক্লাব। আমরা একটা টুর্নামেন্ট খেলি। দেখি কে চ্যাম্পিয়ন হয়। তাতে আমাদের খেলা হলো, মজাও হলো। খেললে আমাদের এক্সারসাইজ করা হবে। সবটা মিলিয়ে জিনিসটা খুবই আনন্দের হবে।

শেষ পর্যন্ত চারটা দল করা গেল না। পর্তুগাল, স্পেন, জার্মানির সাপোর্টাররা মিলে ১১ জনের দল হয় না।

শেষে দুইটা দলই হলো। ব্রাজিল সাপোর্টার্স ক্লাব আর আর্জেন্টিনা সমর্থক দল। সবাইকে জার্সি পরে আসতে হবে।

গুড্ডুর ক্লাসে পড়ে কাঞ্চন। সে খুব ভালো খেলে। সে বলল, দোস্ত, আমি তো জার্সি কিনতে পারব না।

কেন পারবি না কেন?

আমার আব্বার চাকরি চলে গেছে। আম্মার শরীর খারাপ। বিছানাতেই পড়ে থাকেন। আমাদের সংসারে এখন খুব টানাটানি চলছে। আব্বা টাকা ধার করে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন।

গুড্ডু বলল, ঠিক আছে। অসুবিধা নাই। আমার দুইটা জার্সি আছে। একটা তুই নিবি।

ওরা বিকেলে স্কুলের মাঠে এসে প্র্যাকটিস করে। প্র্যাকটিস শেষে সবাই বসে মাঠের এক পাশে। গল্প-গুজব হয় খানিকক্ষণ।

গুড্ডু বলল, ওই দ্যাখ, ওখানে বস্তির বাচ্চারা খেলছে। ওরাও কিন্তু ভালো খেলে। ব্রাজিলের বেশির ভাগ খেলোয়াড় কিন্তু বস্তি থেকে উঠে আসা। আমরা কিন্তু একটা কাজ করতে পারি। আমাদের ম্যাচ শেষ হয়ে গেলে আমাদের জার্সিগুলো ওদের দিয়ে দিতে পারি। সামনে শীত আসছে। ওদের জার্সিও পাওয়া হলো, একটা কাপড়ও পাওয়া হলো।

তপু বলল, ঠিক বলেছিস। আমরা এটা করব। এ জন্য আমাদের ধরতে হবে সোলায়মান স্যারকে। সোলায়মান স্যার বিকেলে বস্তিতে পড়ান।

ঠিক ঠিক। কাঞ্চন সমর্থন জানাল ব্যাপারটাকে।

সোলায়মান স্যারের কাছে পরের দিন টিফিন পিরিয়ডে গেল গুড্ডুরা। তাকে বলল, স্যার, আমরা আমাদের স্কুলের সামনের বস্তির ফুটবলার ছেলেমেয়েদের জার্সি দিতে চাই। আমরা আগে খেলব। তারপর আমাদের জার্সিগুলো ওদের দেব।

স্যার বললেন, আমি খুব খুশি হয়েছি যে তোমরা এই রকমভাবে ভাবতে পেরেছ।

তখন এগিয়ে এলেন জামশেদ স্যার। সব শুনে তিনি বললেন, বাবারা, আসলে তো এইভাবে সমস্যার সমাধান হয় না। আসলে এই পৃথিবীটাকে বদলাতে হবে। এমন একটা সমাজ দরকার, যেখানে ধনী–গরিব পার্থক্য কমে আসবে। বস্তিতে কেউ থাকবে না। কারও কাপড়ের অভাব থাকবে না।

সোলায়মান স্যার বললেন, সেই স্বপ্ন থেকে আমরা সরছি না। কিন্তু যতক্ষণ বস্তি আছে, বস্তিতে শিশু-কিশোরেরা আছে, ততক্ষণ আমাদের চেষ্টা করা উচিত ওদের জন্য একটা কিছু করার। আমাদের ছাত্ররা ওদের জার্সি দিতে চাচ্ছে, সেটা খারাপ কী।

গুড্ডু বলল, স্যার শুধু জার্সি না। আমরা ওদের ফুটবলও দিতে পারি।

গুড্ডুবুড়াদের টুর্নামেন্ট দারুণ জমে উঠল। পরপর তিনবার খেলা হলো। প্রথম দিন জিতল ব্রাজিল। দ্বিতীয় দিন আর্জেন্টিনা। তৃতীয় দিন হয়ে গেল ড্র...

খেলা দেখতে বস্তির ছেলেরাও ভিড় করেছিল।

তাদের নেতা টিপু। সোলায়মান স্যার তাকে আনলেন। বললেন, তোমাদের আমাদের ছেলেরা জার্সি দেবে। ফুটবল দেবে। টিপু বলল, স্যার, তাইলে আমরা কাইলকা জার্সি পইরা আসুম। আমরা আপনাগো স্কুলের লগে ম্যাচ খেলুম।

আসেন টস করি। আপনাগো স্কুল ব্রাজিলের জার্সি পাইব নাকি আর্জেন্টিনার।

টস হলো। গুড্ডুদের স্কুল পেল ব্রাজিল। বস্তির ছেলেরা পেল আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার জার্সি পেয়ে ওরা খুব খুশি। ফুটবল পেল দুটো।

দুই দিন পরে এই মাঠেই ম্যাচ হবে। গুড্ডুদের স্কুল বনাম পথকলি ক্লাব।

ম্যাচের দিন দেখা গেল, গুড্ডুরা পরে এসেছে ব্রাজিলের জার্সি। আর পথকলি ক্লাবের খেলোয়াড়েরা পরে এসেছে লাল–সবুজ গেঞ্জি।

টিপু বলল, আমরা আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করি। কিন্তু আর্জেন্টিনার জার্সি পইরা খেলতে নামুম না। তাই আপনাগো দেওয়া জার্সি বেইচা দিয়া আমরা এই জার্সি কিইনা আনছি...

সোলায়মান স্যার কাঁদতে লাগলেন। খেলার আগে সবাই মিলে গাইতে লাগল: আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...