হিরের নেকলেস

অলংকরণ: সাদাত

এক

‘কী হে, গোয়েন্দারা, কী করছ বসে বসে?’

টিফিন পিরিয়ডে মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিল অয়ন আর জিমি, সঙ্গে আরও কয়েকজন। হঠাৎ করে এসে হাজির হয়েছে ভিক্টোরিয়া ওয়েস্টমোর। কথাটা বলেছে সে-ই।

‘দেখো রিয়া।’ বিরক্তকণ্ঠে বলল জিমি পারকার, ‘সব সময় ফাজলামি ভালো লাগে না।’

‘ফাজলামি করলাম কোথায়?’

‘গোয়েন্দা-গোয়েন্দা করছ কেন, অ্যাঁ?’

‘সে কী! গোয়েন্দাকে গোয়েন্দা বললে দোষ কোথায়? নাকি পাবদা-পুঁটি বলব?’

‘ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।’ জিমি রেগে যাচ্ছে, ‘আমাদের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছে।’

‘স্বীকার করি।’ বলল রিয়া, ‘কিন্তু আমার দোষটা কোথায়, শুনি?’

‘গোয়েন্দারা কখনো নিজেদের গোয়েন্দা বলে পরিচয় দেয় না।’ মুখ খুলল অয়ন, ‘পরিচয়টা যত বেশি চেপে রাখা যায়, ততই ভালো।’

‘এখানে তো সবাই জানে।’ রিয়া বলল, ‘চেপে রাখার দরকারটা কী?’

‘অভ্যাসের জন্য। যাতে মুখ ফসকে অন্য কোথাও বলে না ফেলো।’

‘ঘাট হয়েছে, বাবা! মাফ চাইছি।’

‘করা গেল। তা তুমিই বা এখানে কী করছ? খেজুরে আলাপের জন্য এসেছ?’

‘আমাকে দেখে খেজুরে আলাপের মানুষ মনে হচ্ছে?’ তীক্ষকণ্ঠে বলল রিয়া।

‘না, মনে হচ্ছে নারকেল আলাপের মানুষ। খেজুর বড্ড ছোট হয়ে যায়, তোমার মতো এত কথা গোটা স্কুলে কেউ বলতে পারে কি না, সন্দেহ!’

হো-হো করে হেসে উঠল ছেলেরা।

‘কী!’ চেঁচিয়ে উঠল রিয়া। ‘ফাজলামি হচ্ছে! আমাকে খেপিয়ো না, অয়ন হোসেন। লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে।’

‘স্যরি, স্যরি!’ দাঁত দিয়ে জিব কাটল অয়ন। ‘দুষ্টুমি করছিলাম; এতটা সিরিয়াস হয়ে যাবে, ভাবিনি। বসো ওখানটায়।’

মাটিতে বসে পড়ল রিয়া। বলল, ‘এসব দুষ্টুমি আমার একদম পছন্দ নয়।’

‘বেশ তো! তা, কী ব্যাপার? কিছু বলতে এসেছিলে?’

‘তোমাদের দাওয়াত দিতে এসেছি।’

‘দাওয়াত!’ জিমি অবাক, ‘কিসের দাওয়াত?’

‘আজ আমার জন্মদিন।’ বলল রিয়া, ‘আজ সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে পার্টি আছে, তোমরা সবাই আসবে।’

‘হ্যাপি বার্থডে!’ অভিনন্দন জানাল অয়ন।

‘থ্যাঙ্ক ইউ!’

‘তবে পার্টিতে আসতে পারছি না।’

‘মানে?’

‘সন্ধ্যায় কাজ আছে। আমাদের ক্লাবের মিটিং আছে।’

‘মিটিং-ফিটিং পরে করলেও চলবে। পার্টিতে তোমরা আসছ। ক্লাসের সবাই-ই যাবে।’

‘কিন্তু...’

‘আবার কথা বলছ!’ চোখ রাঙাল রিয়া, ‘আমার মুখের ওপর কেউ যদি না বলে, আমার মাথায় রক্তে চড়ে যায়। জন্মের শত্রুতা বেধে যাবে কিন্তু!’

‘সেরেছে!’

‘কী, আসছ তো?’

‘বুদ্ধিমান কোনো মানুষ তোমার সঙ্গে যেচে শত্রুতা করতে চায়?’

‘ভেরি গুড। সন্ধ্যা সাতটায় রেডি থেকো, গাড়ি পাঠিয়ে দেব।’

‘শিয়োর!’

চলে গেল রিয়া। জিমি অয়নকে বলল, ‘মিছে কথা বললি কেন? সন্ধ্যায় আবার মিটিং কিসের?’

‘ঠিকই তো! আরেকটু হলেই পার্টিটা মিস হয়ে যেত।’ বলল ভোজনরসিক ভিক্টর জেমস, ‘পার্টি আমার খুবই ভালো লাগে। প্রচুর খানাপিনা হয় তো!’

হেসে উঠল অয়ন। বলল, ‘দেখতে চাইছিলাম কতটুকু আন্তরিক মেয়েটা। তা ছাড়া বললেই রাজি হয়ে গেলে আমাদের দাম থাকত কোনো?’

‘যাহোক, এখন তো যাচ্ছি। নাকি?’

‘অবশ্যই। রেডি থেকো সবাই। ভুলে যেয়ো না, কোটিপতির বাড়িতে যাচ্ছি আমরা!’

সময়মতোই গাড়ি চলে এল। রাজকীয় মডেলের এক মার্সিডিজ। দেখে চোখ ট্যারা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ওয়েস্টমোর ম্যানশনে পৌঁছে বিস্ময় আরও বাড়ল। বাড়ি তো নয়, আলিশান এক প্রাসাদ। সামনে বিশাল বাগান। মাঝে মার্বেল পাথরের তৈরি একটা ফোয়ারাও আছে। পানিতে রংবেরঙের আলো খেলা করছে।

গাড়িবারান্দায় ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল রিয়া। ওরা মার্সিডিজ থেকে নামতেই এসে স্বাগত জানাল। ঝলমলে একটা পোশাক পরেছে সে—দাম কত কে জানে!

‘খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে।’ মন্তব্য করল অয়ন।

‘থ্যাঙ্কস।’ মিষ্টি করে হাসল রিয়া।

‘ডাইনির মতো।’ টুক করে খোঁচা লাগাল জিমি।

‘কী!’ গরম চোখে তাকাল রিয়া।

‘থাক, থাক!’ হাত তুলে বলল অয়ন, ‘জন্মদিনে রাগারাগি করতে নেই। সারা বছর রাগারাগি করবে তাহলে।’

‘এ রকম আজব কথা কোথায় পেলে?’

‘মহাকবি হোমার বলেছেন।’

‘চাপা, না? হোমার আবার কবে বলেছে?’

‘আহ্হা, বলেনি। বলতেও তো পারত! চলো, ভেতরে যাই। তোমার সঙ্গে মশকরাও করা যায় না। বিরাট মুসিবত দেখছি।’

বিশাল একটা হলঘরে এসে ঢুকল ওরা। সিলিং থেকে বিশাল বিশাল ঝাড়বাতি ঝুলছে, মেঝেতে নরম গালিচা। একেকটা সোফা দেখলে সিংহাসনের মতো মনে হয়। আমন্ত্রিত অতিথিদের ভিড়ে হলঘর ভরে গেছে। ঘরের মাঝখানে পাঁচ ধাপঅলা বিশাল একটা কেক দেখা গেল।

‘বাপ রে!’ বলল ভিক্টর, ‘কত্তো বড় কেক!’

হেসে উঠল রিয়া। বলল, ‘তুমি আর মানুষ হলে না! এত কিছু থাকতে শুধু কেকই চোখে পড়ল?’

চটাস করে ভিক্টরের মাথায় চাঁটি মারল জিমি।

‘পেটুক কোথাকার!’

রিয়া বলল, ‘থাক, মেরে কাজ নেই। চলো, বাবা-মায়ের সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই।’

হলঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিস্টার ভিনসেন্ট ওয়েস্টমোর আর মিসেস ওয়েস্টমোর। রিয়া ওদের সেদিকে নিয়ে গেল।

‘বাবা!’ বলল ও, ‘এরা আমার বন্ধু—অয়ন, জিমি, ভিক্টর, পল, হ্যারি।’

‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’ বললেন মি. ওয়েস্টমোর, ‘তোমাদের কথা অনেক শুনেছি। বিশেষ করে অয়ন আর জিমি...তোমাদের প্রশংসায় রিয়া তো পঞ্চমুখ!’

‘তাই নাকি!’ জিমি বলল, ‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।’

‘অবিশ্বাস্য তো বটেই! আগে ছেলেদের সহ্যই করতে পারত না। আজকাল দেখছি উল্টো কাণ্ড—জন্মদিনের পার্টিতেও দাওয়াত দিচ্ছে!’

‘বিষ না খাইয়ে দিলেই হলো।’ বিড়বিড় করল জিমি।

‘কী!’ রিয়া প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।

হেসে উঠল সবাই। অয়ন বলল, ‘ও কিছু না, আঙ্কেল। ওর ভুল ধারণা ভেঙে গেছে তো, তাই বদলে গেছে।’

‘হ্যাঁ, সেই পোড়োবাড়ির ঘটনাটা!’ বললেন মি. ওয়েস্টমোর, ‘তোমাদের অভিনন্দন জানানো হয়নি।’

‘কী শুরু করলে তোমরা?’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল রিয়া, ‘পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটছ? বাবা, আমার গিফট কোথায়?’

‘উহুঁ, এক্ষুনি দেওয়া যাবে না।’ হেসে বললেন মি. ওয়েস্টমোর, ‘আরেকটু অপেক্ষা করো। গেস্টরা সবাই আসুক, তারপর দেব।’

‘কিন্তু জিনিসটা কী?’

‘তা-ও বলা যাবে না, টপ সিক্রেট। একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য। যাও এখন, বন্ধুদের নিয়ে এনজয় করো। যথাসময়ে গিফট পাবে।’

‘ঠিক আছে।’ বলে উল্টো ঘুরল রিয়া। ওর পিছু নিল ছেলেরা।

‘আজকাল তাহলে প্রশংসাও করা হচ্ছে!’ ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল জিমি।

‘মিথ্যে কথা!’ ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল রিয়া, ‘তোমাদের প্রশংসা করব আমি? বয়েই গেছে!’

‘তা তো বটেই!’ বিজ্ঞের মতো বলল অয়ন, ‘আচ্ছা, আমাদের যদি পছন্দই না করো, তাহলে দাওয়াত দিলে কেন?’

‘যদি বলি, একটা কেস দিতে?’ দুষ্টু হাসি খেলে গেল রিয়ার ঠোঁটে।

‘ঠাট্টা করছ?’

‘না, আমি সিরিয়াস।’

‘তোমার কেস নিতে আমাদের বয়েই গেছে!’ ভেংচি কাটল জিমি।

‘নাকি ভয় পাচ্ছ?’

‘ফালতু কথা বলবে না, রিয়া। আমরা ভয় পাই না।’

‘প্রমাণ করো!’

‘কেসটা কী?’ জানতে চাইল অয়ন।

‘খুব সহজ। তবে সময় বড্ড কম। এই...মিনিট পনেরো পাবে। বাবা আমার জন্য কী গিফট এনেছে, জেনে দিতে হবে।’

‘এটা কোনো ব্যাপার হলো?’ ফস করে বলল হ্যারি।

‘তাহলে করেই দেখাও!’ বলল রিয়া, ‘পনেরো মিনিট...মনে থাকে যেন! আমি আমার বান্ধবীদের কাছে যাচ্ছি।’

চলে গেল রিয়া। চিন্তিত গলায় অয়ন বলল, ‘মাত্র পনেরো মিনিট...কাজটা একটু অসম্ভবই বটে!’

দুই

‘এর মধ্যে অসম্ভবের কী আছে?’ বিস্মিত গলায় বলল পল অ্যাডামস, ‘তুমি তো কথা বলায় ওস্তাদ, অয়ন। মি. ওয়েস্টমোরকে ভজিয়ে-ভাজিয়ে জেনে নাও না!’

‘বলবেন কি না কে জানে!’ বলল অয়ন, ‘তা ছাড়া ওভাবে কথা আদায় করাটা বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে যায়, রিয়াকে বলে দিতে হবে কি না!’

‘তাহলে?’

‘মাথা খাটিয়ে দেখা যাক। এতে মজাও আছে।’

‘তাহলেই হয়েছে!’ বলল জিমি, ‘মেয়েটার সামনে বেইজ্জতি না হতে হয়! পরে খেপিয়ে মারবে।’

‘ফালতু কথা বলিস না!’ চোখ রাঙাল অয়ন, ‘আয় ভেবে দেখি, জিনিসটা কী হতে পারে।’

‘মাথায় কিছুই খেলছে না। ভাবাভাবিটা তুই-ই কর।’

‘ওকে! মাত্র পনেরো মিনিট যখন বাকি, উপহারটা রিয়ার বাবা কাছাকাছিই কোথাও রেখেছেন। কথা হচ্ছে কোথায়?’

‘কোথায়?’

‘কেউ কোনো উপহারের বাক্স দেখতে পাচ্ছ?’

‘তা তো দেখছিই।’ বলল ভিক্টর, ‘মেইন এন্ট্রান্সের পাশে অনেক গিফট পড়ে আছে, কিন্তু ওগুলো তো গেস্টদের আনা।’

‘তার মানে জিনিসটা মি. ওয়েস্টমোরের পকেটেই আছে। পকেটে রাখার মতো ছোট গিফট কী হতে পারে? জিনিসটা নিশ্চয়ই দামি হবে।’

‘কোনো ধরনের অলংকার?’ পট করে বলল হ্যারি।

‘শাবাশ!’ বলল অয়ন। ‘অলংকারই হবে। কিন্তু কী ধরনের অলংকার?’

‘তা কী করে বলব?’

কী যেন ভাবল অয়ন। চারপাশে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, ‘আরে! মি. ব্লেক না?’

‘কার কথা বলছিস?’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল জিমি।

হলঘরের এক প্রান্তে বয়স্ক একজন ভদ্রলোক গল্প করছেন। তাঁকে ইঙ্গিত করে অয়ন বলল, ‘অ্যান্ডু ব্লেক। লস অ্যাঞ্জেলেসের সবচেয়ে বড় জুয়েলারি দোকানের মালিক।’

‘সঙ্গে ওটা কে?’ অপেক্ষাকৃত কম বয়সী লোকটাকে দেখিয়ে বলল হ্যারি।

‘রিয়ার পুলিশ মামা—লেফটেন্যান্ট জন করবিন।’ বলল জিমি, ‘সেদিন স্কুলে এসেছিল, পরিচয় হয়েছে।’

‘হুঁ!’ অয়ন বলল, ‘রিয়ার বাবার মতো লোক জুয়েলারি কিনলে ব্লেকের দোকান থেকেই কিনবেন। মনে হচ্ছে একটা সূত্র পাওয়া গেল।’

‘এবার?’

‘এবার শুরু হবে আমার কথার খেলা।’ হাসল অয়ন, ‘তোমরা সবাই আমাকে শুধু সায় দিয়ে যাবে, ওকে?’

‘ওকে!’

‘চলো এগোই।’

রিয়ার মামা ইতিমধ্যে সরে গেছেন, জুয়েলারি দোকানের মালিককে গিয়ে পাকড়াও করল ওরা।

‘হ্যালো, মি. ব্লেক! কেমন আছেন?’ পরিচিত ভঙ্গিতে বলল অয়ন।

‘তোমরা...’ মি. ব্লেক বিভ্রান্ত।

‘আমরা সবাই রিয়ার বন্ধু। আমার নাম অয়ন।’

‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’

‘আমরাও। আপনার সঙ্গে গল্প করলে অসুবিধে আছে?’

‘না না, অসুবিধে কিসের?’

‘থ্যাঙ্কস!’ এবার গলা নামিয়ে ফেলল অয়ন, ‘একটা বিষয়ে আমাদের ভীষণ কৌতূহল। রিয়ার জন্য মি. ওয়েস্টমোর যে জুয়েলারিটা কিনেছেন, ওটার দাম কি বাড়াবাড়ি ধরনের বেশি নয়?’

‘জুয়েলারির কথা কে বলল তোমাদের?’ মি. ব্লেক চমকে উঠলেন।

‘আঙ্কেলই বলেছেন, গোপনে!’ হাসল অয়ন, ‘আমরা সবাই জানি, রিয়া বাদে।’

‘তা-ই বলো,’ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন মি. ব্লেক।

‘কিন্তু দামটা বড্ড বেশি হয়ে গেল না?’

‘কী যে বলো! সপ্তদশ শতাব্দীর একটা অ্যান্টিক নেকলেস, তার ওপর হিরের তৈরি—নয় লাখ ডলার তো কমই বলা যায়। এসবের দামের ব্যাপারে তোমার বোধ হয় ধারণা নেই।’

মুচকি হাসল অয়ন—কাজ উদ্ধার হয়ে গেছে। বলল, ‘কটা হিরে যেন আছে ওটায়?’

বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেননি মি. ব্লেক। বললেন, ‘ছয়টা। একেকটার দামই লাখ ডলারের কাছাকাছি। বাকিটা অ্যান্টিক ভ্যালু।’

‘হুঁ! মনে হচ্ছে আপনার কথাই ঠিক। দামটা খুব বেশি নয়। আচ্ছা, আসি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!’

খানিকটা দূরে এসে হাসিতে ফেটে পড়ল ছেলেরা। ভিক্টর বলল, ‘তোমার আসলে সিনেমায় নামা উচিত, অয়ন! এমন অভিনয় করতে পারো!’

একটু পরেই রিয়া এসে হাজির। জিজ্ঞেস করল, ‘কী, পেরেছ জানতে? পার্টি কিন্তু এক্ষুনি শুরু হয়ে যাবে!’

‘কী মনে হয়?’ ভুরু নাচাল জিমি, মিটিমিটি হাসছে।

‘ভ্যাবলার মতো হাসছ কেন? কাজ হয়নি সোজা বলে দিলেই হয়।’

‘কী!’ জিমি রেগে গেল, ‘আমার হাসি ভ্যাবলার মতো?’

‘তুমি একটা ভ্যাবলা—হাসি তো ও রকমই হবে।’

‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!’

‘আহ্, থাম তো!’ বিরক্ত কণ্ঠে বাধা দিল অয়ন, ‘তোদের এই দা-কুমড়া সম্পর্ক নিয়ে মহাবিপদ হলো দেখছি। যাক গে, তোমার কাজ হয়ে গেছে, রিয়া। গিফটটা কী, আমরা জানি।’

‘তা-ই?’ রিয়া উত্তেজিত, ‘শিগগির বলো।’

‘এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই। তার আগে আমাদের পুরস্কার কী দিচ্ছ, শুনি।’

‘যা চাইবে, তা-ই পাবে!’

‘বেশ তো! তাহলে কথা দাও, পুরো ক্লাসকে একদিন টিফিন খাওয়াবে...’

‘ওরে বাবা! সে তো বিরাট আয়োজনের ব্যাপার!’

‘এখনো শেষ করিনি তো!’ দাঁত কেলিয়ে বলল অয়ন, ‘আরও একটা শর্ত আছে। আগামী এক সপ্তাহ আমাদের খ্যাপাতে পারবে না।’

‘ব্ল্যাকমেল হয়ে যাচ্ছে!’

‘এটা তো শোধবোধ। একটু আগে তুমিও আমাদের ব্ল্যাকমেল করেছ। পনেরো মিনিটের মধ্যে অসাধ্য সাধন করতে না পারলে খ্যাপানোর হুমকি দিয়ে।’

‘কক্ষনো আমি হুমকি দিইনি!’

‘মুখে বলোনি, তবে আভাসে-ইঙ্গিতে দিয়েছ। সেটাই বা কম কিসে?’

‘আচ্ছা যাও, তোমাদের শর্তে আমি রাজি। এখন বলো, গিফটটা কী?’

‘একটা অ্যান্টিক নেকলেস।’ বলল অয়ন, ‘ছটা হিরে বসানো। নয় লাখ ডলার দিয়ে কিনেছেন আঙ্কেল।’

‘দারুণ!’ উচ্ছ্বসিত গলায় বলল রিয়া, ‘সত্যি বলছ তো?’

‘না।’ মুখ ভেংচাল জিমি, ‘হানড্রেড পারসেন্ট ডাহা মিথ্যে! যত্ত সব! এ জন্যই বলে, নারীর মন, সন্দেহপ্রবণ...’

‘অ্যাই, খবরদার।’ চোখ রাঙাল রিয়া, ‘ছড়া বানাবে না! আর মনে রেখো, কথাটা যদি সত্যি না হয়...’

কথাটা শেষ করল না ও, গটমট করে হেঁটে চলে গেল। জিমি বলল, ‘দেমাগ কত! ওকে আবার শিক্ষা দিতে হবে, অয়ন।’

‘গিফটটা পেয়ে নিতে দে।’ হাসল অয়ন, ‘আগামী এক সপ্তাহ ও আমাদের খ্যাপাতে পারবে না, কিন্তু আমরা পারব না এমন কোনো চুক্তি হয়নি।’

কথাটা শুনে হি-হি করে হেসে উঠল অন্যরা।

আমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই এসে পড়েছে। হলঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে একজন ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন।

‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান!’ হঠাৎ গমগম করে উঠল মি. ওয়েস্টমোরের গলা, ‘আমার একমাত্র মেয়ে ভিক্টোরিয়ার জন্মদিনে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাই।’ বিশাল কেকটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, মেয়েকে বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। রিয়ার বাঁ পাশে ওর মা।

‘এই অনুষ্ঠানে কষ্ট স্বীকার করে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’ বলে চললেন মি. ওয়েস্টমোর, ‘এখন আমার মামণি কেক কাটবে।’

‘নেকলেসটা কখন দিচ্ছ?’ ফিসফিসিয়ে জানতে চাইল রিয়া।

‘নেকলেস!’ চমকে উঠলেন মি. ওয়েস্টমোর, ‘তুমি কী করে জানলে?’

‘আমি থটরিডিং জানি।’ মুখ টিপে হাসল রিয়া, ‘যাক গে, কখন দেবে বললে না?’

‘কেক কাটার পরে। কিন্তু... কে বলেছে তোমাকে?’

জবাব না দিয়ে বাবার পাশে দাঁড়ানো বেয়ারার ট্রে থেকে ছুরি তুলে নিল রিয়া। অতিথিরা সবাই ঘন হয়ে কেকের চারপাশ ঘিরে দাঁড়াল। তুমুল করতালির মধ্যে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভাল রিয়া। তারপর কেক কাটার জন্য ঝুঁকল। আর তখনই ঘটল এক আজব ঘটনা।

হঠাৎ করে নিভে গেল সমস্ত বাতি।

অন্ধকারে তীব্র গুঞ্জনে মেতে উঠল সবাই। মি. ওয়েস্টমোর বললেন, ‘প্লিজ, প্লিজ, সবাই শান্ত হোন! এক্ষুনি কারেন্ট চলে আসবে—নিশ্চয়ই কোথাও শর্টসার্কিট হয়েছে। অ্যাই, হ্যারল্ড!’ কাকে যেন ডাকলেন তিনি, ‘দেখো না কী হয়েছে!’

মিনিট দুয়েকের মধ্যে কয়েকটা ইমার্জেন্সি লাইট জ্বালানো হলো। আর পাঁচ মিনিটের মাথায় আবার সমস্ত বাতি জ্বলে উঠল। একজন মি. ওয়েস্টমোরের দিকে এগিয়ে গেল, পরে জানা গেল তার নামই হ্যারল্ড, এই বাড়ির বাটলার।

‘কী হয়েছিল?’ জানতে চাইলেন মি. ওয়েস্টমোর।

‘কীভাবে যেন একটা সার্কিট ব্রেকার খুলে গিয়েছিল।’ বলল হ্যারল্ড, ‘তবে সব ঠিক হয়ে গেছে, সার। আর কোনো অসুবিধে নেই।’

‘থ্যাঙ্ক গড! আর কোনো ঝামেলা চাই না। অ্যানিওয়ে, লেট আস কন্টিনিউ।’

এক টুকরো কেক তুলে রিয়াকে খাওয়ালেন ওর বাবা-মা, সে-ও তাঁদের খাওয়াল। এবার উপহার দেওয়ার পালা। কোটের ভেতরের পকেটে হাত ঢুকিয়েই থমকে গেলেন মি. ওয়েস্টমোর। তাড়াতাড়ি বাকি সব পকেট দেখলেন। অতিথিরা সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। অপ্রস্তুত হাসি দিলেন তিনি। বিড়বিড় করে বললেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে! নেকলেসটা নেই!’

তিন

পরিস্থিতিটা সামাল দিলেন মিসেস ওয়েস্টমোর। চট করে সবার অলক্ষে নিজের হাত থেকে একটা আংটি খুলে নিলেন। তারপর রিয়ার আঙুলে সেটা পরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মামণি, এই হলো তোমার উপহার।’

অতিথিরা কিছু বুঝতে পারেনি, সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। কিন্তু অয়নরা তার ব্যতিক্রম। বিস্মিত গলায় জিমি বলল, ‘আংটি কেন? নেকলেস কোথায়?’

‘কিছু একটা ঘাপলা হয়েছে।’ চিন্তিত গলায় অয়ন বলল।

কয়েকজন বেয়ারা এসে কেক কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অতিথিরা সবাই টেবিল থেকে প্লেট তুলে নিচ্ছে, কিন্তু অয়ন এগিয়ে গেল রিয়াদের দিকে।

‘ওদিকে যাচ্ছ কেন?’ অধৈর্য কণ্ঠে বলল ভিক্টর, ‘নাশতা করবে না?’

‘পরে’ সংক্ষেপে বলল অয়ন।

‘এসব কী?’ বাবাকে প্রশ্ন করছে রিয়া, ‘আমার নেকলেস কোথায়?’

‘বুঝতে পারছি না।’ বিভ্রান্ত দেখাল মি. ওয়েস্টমোরকে, ‘পকেটেই তো ছিল।’

‘আমি ধারণা করতে পারি।’ ওদের সামনে গিয়ে বলল অয়ন, ‘ওটা চুরি গেছে।’

‘কী বলছ!’

‘কারেন্ট চলে যাওয়াটা, আঙ্কেল, মোটেই কাকতালীয় নয়। নেকলেসটা গায়েব হয়ে যাওয়া একই সূত্রে গাঁথা।’

পেছনে কপাল চাপড়াল জিমি। বলল, ‘এই রে! শুরু হলো হিব্রু ভাষা!’

‘কী বলতে চাও, অয়ন?’ প্রশ্ন করল হ্যারি।

‘একটা সার্কিট ব্রেকার আপনা-আপনি খুলে পড়ে যেতে পারে না।’ অয়ন বলল, ‘পরিকল্পনামাফিকই ঘটেছে সব।’

‘ব্যাপার কী?’ হঠাৎ এসে হাজির হয়েছেন রিয়ার মামা, ‘জটলা কিসের, ভিনসেন্ট?’

‘কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে, জন।’ বললেন মি. ওয়েস্টমোর, ‘নেকলেসটা অন্ধকারে কেউ আমার পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে।’

‘কী সর্বনাশ! আপনি চুপচাপ বসে আছেন কেন? এক্ষুনি সবাইকে তল্লাশি করা দরকার।’

‘তোমার কি মাথা খারাপ হলো? গেস্টদের তল্লাশি করলে আমার মান-ইজ্জত কিছু থাকবে?’

‘কিন্তু তাই বলে তো চোরকে ছেড়েও দেওয়া যায় না।’ বলল রিয়া, ‘আমার নেকলেস নিয়ে গেছে ব্যাটা!’

‘লক্ষ্মী মা, এটা নিয়ে কথা বাড়িয়ো না।’ মিনতি করলেন মি. ওয়েস্টমোর, ‘তোমাকে আরেকটা কিনে দেব।’

‘এটা কোনো কথা হলো না, ভিনসেন্ট।’ প্রতিবাদ করলেন করবিন, ‘একজন পুলিশ হিসেবে আমি অপরাধকে প্রশ্রয় দিতে পারি না। আমি আমার লোকজন ডাকছি।’

‘অসম্ভব!’ কড়া গলায় বললেন রিয়ার বাবা, ‘ইউনিফর্ম পরা কোনো লোককেই আমি আমার বাড়িতে ঢুকতে দেব না।’

অলংকরণ: সাদাত

‘সে ক্ষেত্রে আপনার কিছু প্রাইভেট ডিটেকটিভ দরকার।’ এবার মুখ খুলল অয়ন, ‘আমাদের মতো।’

‘কী! বিস্মিত কণ্ঠে বললেন করবিন, ‘তোমরা?’ পরমুহূর্তে তাঁর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, ‘আরে... অয়ন হোসেন আর জিমি পারকার না? এখানে কী করছ?’

‘ওরা আমার বন্ধু।’ বলল রিয়া, ‘একই সঙ্গে পড়ে।’

‘দেখো, খুদে গোয়েন্দারা।’ বললেন করবিন, ‘ইতিমধ্যে তোমরা বেশ কিছু চমক দেখিয়েছ বটে, তবে এখানে তোমাদের আমি চাই না। পুলিশের কাজ পুলিশকেই করতে দাও, ওকে?’

‘আঙ্কেল তো পুলিশ ডাকতে চাইছেন না।’ যুক্তি দেখাল জিমি।

‘সেটা আমি দেখছি।’ বলে ভগ্নিপতির দিকে ফিরলেন করবিন, ‘এক কাজ করা যাক। সাদাপোশাকে আমার কিছু লোক আসুক। গোপনে তদন্ত করবে ওরা। গেস্টরা কিচ্ছু টের পাবে না।’

‘কিন্তু...’ ইতস্তত করলেন মি. ওয়েস্টমোর। শেষে বললেন, ‘ঠিক আছে। কিন্তু গেস্টদের যেন কোনো অসম্মান না হয়।’

‘হবে না।’ কথা দিয়ে চলে গেলেন করবিন।

অয়নরাও সরে এল, ওদের পিছু নিল রিয়া। খানিক দূর এসে থেমে বলল, ‘হুঁহ্! বললেই হলো? অয়ন-জিমি, আমি চাই চোরটাকে তোমরা ধরো।’

‘আবার কেস দিচ্ছ?’ ভুরু নাচাল জিমি, ‘বিনিময়ে কী দেবে?’

‘কচু আর ঘণ্টা। আগের কেসটায় ফেল করেছ। গিফট হিসেবে নেকলেস পাইনি আমি। পেয়েছি আংটি।’

‘কিন্তু আসল গিফট ছিল নেকলেসটাই! আঙ্কেল নিজে স্বীকার করেছেন।’

‘তাতে কী? আমি তো পেয়েছি আংটি!’

‘তাহলে কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব!’ হুমকি দিল জিমি।

‘বললেই হলো? চোর ধরার জন্য মাথা কুটে মরছ তোমরা—আমি জানি।’

‘ভুল!’ এবার বলল অয়ন, ‘আগ্রহ একটু আছে বটে, তবে পুরস্কার না পেলে বেগার খাটতে রাজি নই। তোমার মামার যে রকম আগ্রহ দেখলাম, চোরটা উনিই ধরবেন। তাহলে শুধু শুধু আমরা খাটতে যাব কেন?’

‘মামাকে হারাতে পারলে কিন্তু তোমারই লাভ।’ উসকানি দিল হ্যারি, ‘ক্রেডিট তোমার হবে।’

দ্বিধায় পড়ে গেল রিয়া। শেষে বলল, ‘ঠিক আছে, মানলাম। পুরস্কার দেব।’

‘যা চাইব তা-ই?’ জিমি জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ।’

‘গুড, তাহলে কাজে নেমে পড়া যায়।’

‘আলোচনার জন্য নিরিবিলি জায়গা দরকার।’ বলল অয়ন।

‘এসো আমার সঙ্গে।’ বলে হাঁটা ধরল রিয়া।

‘আরে! ভিক্টর কোথায়?’ পল বলল।

‘ওই তো!’ আঙুল তুলে দেখাল হ্যারি, ‘দেখো পেটুকটার কাণ্ড!’

বড়সড় একটা প্লেটভর্তি খাবার নিয়ে ব্যস্ত ভিক্টর। কাছে গিয়ে ওর পিঠে একটা কিল বসাল জিমি, ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না! এখন খাওয়ার সময় হলো?’

‘বারে!’ ভিক্টর অবাক, ‘খাব না!’

‘পরে।’ বলল জিমি, ‘এখন এসো।’

প্লেটটা রেখে দিতে বোধ হয় মায়া হলো বেচারার। ওটা হাতে নিয়েই ওদের পিছু নিল ভিক্টর। হলঘরের পাশে একটা ছোট্ট সিটিংরুমে এসে ঢুকল সবাই।

‘এখন!’ সোফায় বসে বলল অয়ন, ‘আমাদের ভেবে বের করতে হবে, নেকলেসটা চুরি করার সুযোগ কার কার ছিল। কারও কোনো মতামত আছে?’

‘আমার কিন্তু ট্রে হাতে ওই বেয়ারাকেই সন্দেহ হয়।’ বলল জিমি, ‘কারেন্ট যখন চলে যায়, তখন ওয়েস্টমোর আঙ্কেলের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সে।’

‘ফালতু কথা বোলো না।’ প্রতিবাদ করল রিয়া, ‘বার্টি আমাদের অনেক পুরোনো লোক, খুবই বিশ্বস্ত। ও এমন কাজ করতে পারে না।’

‘কিন্তু সন্দেহের তালিকা থেকে কাউকেই বাদ দেওয়া উচিত হবে না।’ বলল অয়ন, ‘আচ্ছা, আশপাশে আর কে ছিল, বলতে পারবে?’

‘অত কিছু কেউ খেয়াল করে নাকি?’ বলল পল, ‘তবে এক হাতঅলা একজন ভদ্রলোকের কথা মনে আছে আমার। বেয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।’

‘আমারও মনে আছে।’ সায় দিল অয়ন, ‘কোটের বাঁ হাতা ঢলঢল করছিল। ব্যতিক্রম, মনে রাখার কারণ এটাই। লোকটা কে, রিয়া?’

‘বিল পামার, একটা ক্যাটারিং কোম্পানির ম্যানেজার।’ জানাল রিয়া, ‘আজকের পার্টির সমস্ত আয়োজন ওরাই করেছে। আমাদের বাড়িতে লোকজন কম—এত বড় পার্টি করা সম্ভব নয়।’

‘ওর হাতের কী হয়েছে?’

‘কী একটা দুর্ঘটনায় যেন বাঁ হাত কাটা পড়েছে, আমি ঠিক জানি না।’

‘মাত্র এক হাতে এমন চুরি—প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।’ মন্তব্য করল হ্যারি।

‘আমার মনে হয় অন্য কেউ করেছে।’ বলল পল, ‘অন্ধকারে ভিড় ঠেলে এসে নেকলেসটা মেরে দিয়েছে। কেউ দেখতে পায়নি।’

‘এটা সম্ভব।’ স্বীকার করল হ্যারি।

‘আমি রীতিমতো অন্ধকার দেখছি।’ বলল জিমি, ‘ঘরভর্তি লোক, কাজটা যে কারও হতে পারে। শরীর তল্লাশি ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।’

‘বাবা কিছুতেই রাজি হবে না।’ বলল রিয়া, ‘দরকার হলে নয় লাখ ডলার গচ্চা দেবে, কিন্তু প্রেস্টিজ নয়।’

‘আমার ধারণা, চোর সেটা জানে।’ চিন্তিত দেখাল অয়নকে, ‘জানে বলেই ঝুঁকিটা নিয়েছে। তা ছাড়া তল্লাশি করলেও নেকলেসটা পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ আছে।’

‘তার মানে কোনো ক্লু নেই!’ হতাশ কণ্ঠে বলল জিমি, ‘এগোবার কোনো রাস্তা দেখছি না।’

‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে দেয়ালের গায়ে ফুটো খুঁজে বের করতে হয়।’ গম্ভীর গলায় অয়ন বলল।

‘আমরা ক্রিমিনোলজি নিয়ে আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ ফিলোসফি এল কোত্থেকে?’ খোঁচা লাগাল জিমি।

‘কথাটার মানে কী, অয়ন?’ জানতে চাইল রিয়া।

‘অন্য পথে চেষ্টা চালাতে হবে।’ ব্যাখ্যা করল অয়ন, ‘চোর নয়, তার সহকারীকে ধরতে হবে।’

‘মানে! সহকারী পেলে কোথায়?’

‘কারেন্ট চলে যাওয়াটা...মোটেই কাকতালীয় নয়। এক্কেবারে সময়মতো গেল। এর আগ পর্যন্ত কেকের ওপর মোমবাতি জ্বলছিল। চুরির জন্য ঘুটঘুটে অন্ধকার পাওয়া যেত না এবং শুধু ওই সময়েই সব গেস্ট ওয়েস্টমোর আঙ্কেলের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।’

‘অর্থটা কী দাঁড়াল?’

‘চোর একা নয়। অন্তত আরও একজন আছে। সে-ই মেইন সুইচ বোর্ড থেকে সার্কিট ব্রেকার খুলে নিয়েছে।’

‘কিন্তু সুইচ বোর্ডটা বাড়ির পেছনে। ওখান থেকে হলঘরে কী ঘটছে, বোঝা সম্ভব নয়। টাইমিং মেলাল কী করে?’

‘সংকেত দেওয়ার ব্যবস্থা একটা নিশ্চয়ই ছিল। যাহোক, লোকটাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাহলেই সমস্ত প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে। তবে আরেকটা খটকা রয়ে যাচ্ছে।’

‘কী?’ সাগ্রহে জানতে চাইল সবাই।

‘নেকলেসটার কথা চোর জানল কী করে? আঙ্কেল তো ব্যাপারটা চেপে রেখেছিলেন।’

‘হুঁ।’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল জিমি, ‘ইনফরমেশন লিক করেছে কেউ। নয়তো যে জানত, সে-ই চোর।’

‘অ্যান্ডু ব্লেক?’ সবার প্রথমে এই নামটাই মনে এল পলের।

‘মনে হচ্ছে ক্লু পাওয়া গেছে।’ বলল অয়ন, ‘দুই গ্রুপে কাজ করতে হবে। এক গ্রুপ হলঘরে ব্লেক সাহেবের ওপর নজর রাখবে। অন্য গ্রুপ যাবে শাগরেদটার খোঁজে।’

টস হলো। অয়ন, রিয়া আর ভিক্টর পড়ল এক গ্রুপে—ওরা হলঘরে থাকবে, বাকি তিনজন যাবে বাড়ির পেছনে। সুইচ বোর্ডটা কোথায়, চিনিয়ে দিল রিয়া।

‘তাহলে কাজে নেমে পড়া যাক।’ প্রস্তাব দিল জিমি।

‘হ্যাঁ।’ বলল অয়ন, ‘যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। গেস্টরা বেশিক্ষণ থাকবে না, এরই মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। আধা ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। এর পরে হলঘরে সবাইকে চাই আমি।’

‘ওকে!’ বলে বেরিয়ে গেল সবাই।

চার

হলঘরে গেস্টরা খাওয়াদাওয়ায় ব্যস্ত, সেই সঙ্গে গল্পগুজব করছে। ভেতরে ঢুকেই মি. ব্লেককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করল অয়ন। কিন্তু তাঁকে কোথাও দেখা গেল না।

‘গেল কোথায়?’ বিড়বিড় করল ও। রিয়া আর ভিক্টরকে বলল, ‘ছড়িয়ে পড়ো। মি. ব্লেক কোথায়, জানতে চাই আমি।’

মাথা ঝাঁকিয়ে ছড়িয়ে পড়ল তিনজনে। অতিথিদের জটলার মাঝে ঢুঁ মারছে, কিন্তু ব্লেক সাহেবকে কোথাও পাওয়া গেল না। হঠাৎই তাঁকে দেখতে পেল অয়ন। হলঘরের পাশের একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। বেরোতেই একহাতি বিল পামারের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। দুজনে গল্প শুরু করলেন।

তাড়াতাড়ি সেদিকে এগোতে গেল অয়ন, কিন্তু পথিমধ্যে বাধা পেল। বরফভর্তি একটা ওয়াইনকুলার নিয়ে যাচ্ছিল একজন ওয়েটার, তার সঙ্গে ধাক্কা খেল ও। প্রায় পড়েই যাচ্ছিল ওয়েটার, চট করে ধরে ফেলল ও।

‘স্যরি!’ ক্ষমা চাইল অয়ন, ‘আমি দেখতে পাইনি।’

‘ইটস্ ওকে!’ বলল ওয়েটার। তারপর চলে গেল।

মি. ব্লেকের সামনে গিয়ে হাজির হলো অয়ন।

‘আরে! অয়ন যে!’ মি. ব্লেকের মুখে হাসি ফুটল, ‘তোমাকেই খুঁজছিলাম মনে মনে।’

‘আমাকে!’ অয়ন অবাক, ‘কেন?’

‘ওই সময় নেকলেস নিয়ে কত কিছু জিজ্ঞেস করলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওটা রিয়াকে দিলেন না কেন মি. ওয়েস্টমোর? বলতে পারো?’

‘আমি ঠিক জানি না।’

‘হুঁ। আমার একটু চিন্তা হচ্ছে। কোনো সমস্যা হয়নি তো?’

‘সমস্যা?’ মনে মনে সতর্ক হয়ে উঠল অয়ন, ‘ও-কথা বলছেন কেন?’

‘আর বোলো না!’ বিরক্ত কণ্ঠে বললেন মি. ব্লেক, ‘আমার ওপর যেন কুফা ভর করেছে। গত দুই মাসে আমার দোকান থেকে বিক্রি করা বেশ কিছু দামি জুয়েলারি মালিকদের কাছ থেকে চুরি হয়ে গেছে। কী বিশ্রী কাণ্ড!’

‘তা তো বটেই!’ স্বীকার করল অয়ন, ‘আশা করি এবার তেমন কিছু ঘটেনি। আচ্ছা, ওই রুমে কী করছিলেন আপনি?’

কথাচ্ছলে প্রশ্নটা করা হলো, তবে ব্লেকের ভেতরে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। স্বাভাবিক কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘একটা জরুরি ফোন করতে গিয়েছিলাম।’ কথা শেষ করে ঠোঁটে একটা সিগারেট ঝোলালেন তিনি। পকেট হাতড়াতে শুরু করলেন। ‘লাইটারটা কোথায় রাখলাম!’

‘আমার কাছে লাইটার আছে।’ বলে উঠল পামার।

লাইটারটা প্যান্টের বাঁ পকেটে ছিল। বাঁ হাত নেই, কাজেই ডান হাতে সেটা বের করতে বেশ কষ্ট করতে হলো তাকে। শেষে মি. ব্লেকের সিগারেট ধরিয়ে দিল।

‘থ্যাঙ্কস।’ বললেন জুয়েলারি ব্যবসায়ী। তারপর দুজনে হাঁটতে হাঁটতে একদিকে চলে গেলেন।

একটু পর ভিক্টর আর রিয়া এসে পড়ল।

‘কী কথা হলো?’ জানতে চাইল ভিক্টর।

‘ফোন করতে ওই রুমে ঢুকেছিল ব্লেক।’ আঙুল তুলে দেখাল অয়ন, ‘তবে আমার সন্দেহ আছে।’

‘ওটা আমাদের রিডিংরুম।’ জানাল রিয়া, ‘ফোন একটা আছে বটে।’

‘ওখানে চোরাই মালও লুকানো যায়।’ বলল অয়ন, ‘চলো, খুঁজে দেখি।’

রিডিংরুমটা তেমন বড় নয়। বুকশেলফ আছে; আর আছে একটা বড় টেবিল, সঙ্গে কয়েকটা চেয়ার। দেরি না করে ঘর তল্লাশিতে লেগে পড়ল ওরা। তবে বৃথাই কষ্ট করল ওরা। নেকলেস তো দূরের কথা, সন্দেহজনক কোনো কিছুই পেল না।

‘ধ্যাত্তেরি!’ বিরক্তি প্রকাশ করল রিয়া, ‘বেহুদা খাটলাম।’

‘ধীরে, বৎস, ধীরে!’ বলল অয়ন, ‘এত অল্পে অধৈর্য হলে চলবে কী করে?’

‘এ-ই বুঝি গোয়েন্দাগিরি? শুধু শুধু হাত-পা ময়লা হলো।’

‘এ জন্যই বলি, সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না। সারা জীবন শুয়ে-বসে কাটিয়েছে তো! এটুকু কষ্ট সহ্য হচ্ছে না।’

‘প্যান প্যান না করে কাজের কথা বলো তো।’ মুখ ঝামটা দিল রিয়া।

‘হুঁ!’ একটু চিন্তা করল অয়ন, ‘ব্লেক যদি সত্যিই চোর হয়, আর এখানে নেকলেসটা লুকিয়ে থাকে, তাহলে জিনিসটা নেওয়ার জন্য ফিরে আসবে সে।’

‘কী করতে চাও তাহলে?’ জানতে চাইল ভিক্টর।

‘একজনকে লুকিয়ে থাকতে হবে এই ঘরে।’ সিদ্ধান্ত নিল অয়ন, ‘তুমিই থাকো, ভিক্টর। সময় কাটাতে সমস্যা হবে না। খাবার এনে দিচ্ছি। ব্লেক ফিরে এলে কী করে, লক্ষ রাখবে।’

‘শিয়োর!’ খাবারের কথায় বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে গেছে ভিক্টরের।

‘চলো, রিয়া।’ বলে রিডিংরুম থেকে বেরিয়ে এল অয়ন।

হলঘরে পা দিয়েই চমকে উঠল ওরা দুজন। সাদাপোশাকে বেশ কয়েকজন পুলিশ ডিটেকটিভ এসে গেছে, সেই সঙ্গে ইউনিফর্ম পরা সাধারণ পুলিশও আছে। বাড়ির সামনেটা ভরে গেছে পুলিশ কারে। রিয়ার বাবা উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচামেচি করছেন।

‘অসম্ভব! আমার বাড়িতে আমি এসব হতে দেব না। জন, তোমার সঙ্গে কী কথা হয়েছিল?’

‘আমি দুঃখিত, ভিনসেন্ট,’ করবিন বললেন, ‘এমনটা ঘটবে ভাবিনি।’

‘আমাদের আপনি বাধা দিতে পারবেন না, মি. ওয়েস্টমোর।’ বললেন একজন সাদাপোশাকধারী অফিসার। ‘আমাদের সঙ্গে ওয়ারেন্ট আছে। বেশ কিছুদিন ধরে এ রকম ঘটনা ঘটছে। আজ লোকটাকে ধরার সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, তা আমরা হাতছাড়া করব না।’

কথাটা শুনে মি. ওয়েস্টমোর হইচই বাধিয়ে দিলেন।

‘সেরেছে!’ বলল অয়ন, ‘চোরটা সতর্ক হয়ে যাবে এবার। গোপনে কাজ চেয়েছিলাম, সেটা গেল ভজঘট হয়ে।’

‘যে রকম আয়োজন দেখছি, আমাদের কষ্ট বৃথা গেল।’ হতাশ কণ্ঠে বলল রিয়া, ‘চোরটাকে পুলিশই ধরবে।’

‘এত সহজে হাল ছাড়ছি না আমি।’ দৃঢ় গলায় বলল অয়ন, ‘চোর ইতিমধ্যে যথেষ্ট ধূর্ততা দেখিয়েছে, পুলিশের কথাও নিশ্চয়ই প্ল্যান করার সময় মাথায় রেখেছে সে।’

‘মানে পুলিশকে ফাঁকি দেওয়ার ব্যবস্থা সে করে রেখেছে? তাকে তাহলে ধরা যাবে কেমন করে?’

‘ওর প্ল্যানে পুলিশ আছে, আমরা নেই। আমাদের ফাঁকি দিতে পারবে না। ওকে আমরাই ধরব।’

‘মুখে তো বড় বড় কথা।’ ভেংচি কাটল রিয়া, ‘কাজের বেলায় দেখব, কত বড় বীর। যাক গে, এখন কী করবে?’

‘নজরদারি।’ বলল অয়ন, ‘তুমি বরং এক কাজ করো। ভিক্টরকে কিছু খাবার দিয়ে এসো।’

‘আমি কেন? মেয়ে বলে?’

‘জি না!’ দাঁত কেলাল অয়ন, ‘হাজার হোক, ভিক্টর তোমার গেস্ট। আর গেস্টকে আপ্যায়নের দায়িত্ব হোস্টেরই। বুঝলে?’

হলঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পেছন দিকে রওনা দিল জিমিরা। কিচেনে এসে ঢুকল। মস্ত বড় কিচেন। সঙ্গে একটা প্যান্ট্রিও আছে। অ্যাপ্রোন পরা বাবুর্চিরা রান্না নিয়ে ব্যস্ত, ওয়েটাররাও ছোটাছুটি করছে। আচমকা ওদের তিনজনকে ঢুকতে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল।

কাজ তদারক করছিল বাটলার হ্যারল্ড; এবার এদিকে এগিয়ে এল। বলল, ‘আপনারা...’

‘আমরা রিয়ার বন্ধু।’ চটপট বলল জিমি, ‘আমি জিমি...’

ওর কথা শেষ হলো না। বাটলার বলল, ‘আপনাদের আমি চিনি, মাস্টার পারকার। মিস ওয়েস্টমোরের সব বন্ধুকেই চিনি। কিন্তু আপনারা এদিকে কী মনে করে?’

‘বাড়িটা ঘুরেফিরে দেখছিলাম।’ জানাল জিমি, ‘আচ্ছা, পেছনে যাওয়ার রাস্তা কোনটা?’

‘ওই তো!’ কিচেনের উল্টো দিকে একটা করিডর দেখাল হ্যারল্ড, ‘আমি আসব আপনাদের সঙ্গে?’

‘দরকার নেই, আপনি কাজ করুন। আচ্ছা, আসি।’

করিডর ধরে কিছুদূর এগোতেই চওড়া দরজা পাওয়া গেল। সেটা খুলে পেছনের আঙিনায় বেরিয়ে এল ওরা। চারপাশটা দেখে নিল জিমি। তিনটি ভ্যান দেখা যাচ্ছে। সেগুলোর গায়ে লেখা: ওয়েস্টার্ন ক্যাটারিং কোম্পানি। ইউনিফর্ম পরা কয়েকজন কাজে ব্যস্ত—জিনিসপত্র ওঠাচ্ছে-নামাচ্ছে।

‘মেইন সুইচ বোর্ডটা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল পল।

‘বাঁয়ে যেতে হবে।’ বলল জিমি, ‘এসো।’

বাড়ির দেয়ালের সঙ্গে সুইচ বোর্ডটা দেখা গেল একটু পরে। লাল রঙের একটা চৌকো বাক্স—ওপরে সাদা রঙে মড়ার খুলি আর একটা ক্রস আঁকা। তলায় বড় করে লেখা:

বিপজ্জনক!

বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি।

কাছে গিয়ে বাক্সটা পর্যবেক্ষণ করল ওরা। খানিক পরে জিমি বলল, ‘আজব ব্যাপার! এসব বক্সে তালা দেওয়া থাকে, কিন্তু এটাতে নেই কেন?’

‘তালা দেওয়ার ব্যবস্থা কিন্তু আছে।’ হুড়কো দেখাল হ্যারি, ‘কিন্তু তালা নেই।’

কী ভেবে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল জিমি। ঘাস হাতড়াতে শুরু করল। খানিক পর একটা ছোট ভাঙা তালা হাতে সোজা হলো। বলল, ‘তালা দেওয়াই ছিল। কেউ এটা ভেঙে ফেলেছে। অয়নের সন্দেহের পেছনে যুক্তি দেখতে পাচ্ছি।’

‘কিন্তু কে ভাঙল এটা?’

‘সেটাই বের করতে হবে। এসো।’

একটা ভ্যানের কাছে গেল ওরা। ড্রাইভার তার সিটে বসে ঝিমুচ্ছিল। কাছে গিয়ে জিমি ডাকল, ‘এই যে! শুনতে পাচ্ছেন?’

‘কী ব্যাপার?’ বিরক্তকণ্ঠে বলল ড্রাইভার।

‘আপনি এখানে কতক্ষণ ধরে আছেন?’

‘অনেকক্ষণ। কেন?’

‘আচ্ছা, ওই সুইচ বোর্ডের কাছে কাউকে যেতে দেখেছেন?’

‘না। কেন?’

‘একটু দরকার ছিল।’

‘কাউকে দেখিনি আমি।’ খেঁকিয়ে উঠল ড্রাইভার, ‘যাও, ভাগো!’

ভ্যান থেকে সরে এল ওরা। বিস্মিত কণ্ঠে হ্যারি বলল, ‘ব্যাটা এমন করল কেন?’

‘জানি না, তবে মিছে কথা বলেছে সে।’ জিমি বলল, ‘তালাটা যেভাবে ভাঙা হয়েছে, শব্দ হতে বাধ্য। ভ্যান থেকে সুইচ বোর্ডটা পরিষ্কার দেখা যায়। তা ছাড়া পরে লোক এসে সার্কিট ব্রেকার জোড়া দিয়েছে। ওদেরও দেখতে পায়নি, এটা আমি বিশ্বাস করি না।’

‘কিন্তু মিথ্যে বলবে কেন?’

‘সেটাই প্রশ্ন। কাজটা ওরই হতে পারে। নজর রাখা দরকার। পল, তুমি থাকো এখানে। আমরা অয়নকে ব্যাপারটা জানিয়ে আসি।’

‘ওকে!’ মাথা ঝাঁকাল পল।

চলে গেল জিমি আর হ্যারি। পল এবার লক্ষ করল, সন্দেহভাজন ড্রাইভার একজন ওয়েটারের সঙ্গে কথা বলছে। কথাগুলো শোনার সিদ্ধান্ত নিল ও। গা ঢাকা দিয়ে ভ্যানের উল্টো পাশে পৌঁছাল, তারপর কান পাতল ও।

‘...কী বলছ তুমি?’ ওয়েটারের কণ্ঠ শোনা গেল।

‘ঠিকই বলছি। তিনটা ছেলে এসে সুইচবক্সের কথা জিজ্ঞেস করছিল।’ ড্রাইভার বলল।

‘কটা বাচ্চাকে নিয়ে এত ভাবনার কী আছে?’

‘আছে। কিছুই প্ল্যানমতো এগোচ্ছে না। বাড়িতে পুলিশ এসেছে, জানো?’

‘সেটা নিয়ে চিন্তা নেই। পুলিশের নজর ফেরানোর ব্যবস্থা আছে।’

‘কিন্তু বাচ্চাগুলো...’

কথা শোনায় এতই মগ্ন ছিল, পেছনে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসা বিপদ টের পায়নি পল। আচমকা কানের কাছে একটা বজ্রকণ্ঠ গর্জে উঠল, ‘অ্যাই ছেলে! কী করছ এখানে?’

পালানোর চেষ্টা করল পল, কিন্তু শক্ত হাতে তার কাঁধ চেপে ধরল লোকটা। ঘাড়ের ওপর রদ্দা পড়ল একটা—জ্ঞান হারাল ও।

পাঁচ

হলঘরে তীব্র শোরগোল, অতিথিরা সবাই তারস্বরে চেঁচামেচি করছে। কেউ শরীর তল্লাশি করাতে রাজি নয়। তবে পুলিশ বাহিনীর ইনচার্জ লোকটা ঘাগু মাল, নাছোড়বান্দাও বটে। লোকবল রয়েছে তার, কারও প্রতিবাদের তোয়াক্কা করছে না। লোকটার নাম ডিটেকটিভ পিটার হালাস—ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে সবার।

অয়ন আর রিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল, এ সময় হাজির হলো জিমি আর হ্যারি।

‘বাপ রে!’ অবস্থাটা দেখে বলে উঠল হ্যারি, ‘এ দেখছি মাছের বাজার বসে গেছে।’

‘এসে গেছিস?’ বলল অয়ন, ‘পল কোথায়?’

‘বাড়ির পেছনে।’ জবাব দিল জিমি, ‘পাহারায় রেখে এসেছি।’

‘কিছু পেয়েছিস মনে হচ্ছে?’

মাথা ঝাঁকাল জিমি। তারপর নিজেদের অভিজ্ঞতা খুলে বলল।

‘পলকে পাহারায় রেখে ভালো কাজ করেছিস।’ মন্তব্য করল অয়ন।

‘তোদের খবর কী?’

‘ভালো না। পুলিশ এসে ঝামেলা বাধিয়ে দিয়েছে।’

‘বাবা যা খেপেছে না মামার ওপর!’ রিয়া বলল, ‘আর কোনো দিন বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। পারলে এখনই ঝাঁটাপেটা করত।’

‘কী করবে এখন?’ জিজ্ঞেস করল হ্যারি।

‘এখানেই থাকি কিছুক্ষণ।’ বলল অয়ন, ‘পুলিশ কোনো মূল্যবান ক্লু পেলে জানতে পারব।’

ঘরের এক কোণে একটা সোফায় বিধ্বস্তের মতো বসে ছিলেন মি. ওয়েস্টমোর। তাঁর অবস্থা হয়েছে ঝড়ে পড়া কাকের মতো। পাশে বসে মিসেস ওয়েস্টমোর সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। সেদিকে এগিয়ে গেল ওরা। আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকল।

সামান্য পরেই ডিটেকটিভ হালাসকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। তার হাতে একটা মখমলে মোড়া লাল ছোট বাক্স। কাছে এসে প্রশ্ন করল, ‘এটা চিনতে পারছেন?’

জবাব না দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন মি. ওয়েস্টমোর।

‘নেকলেসের বাক্স।’ বলল হালাস, ‘র্যাপিং পেপারটাও পাওয়া গেছে। একটা টেবিলের তলায় পড়ে ছিল।’

‘নেকলেসটা...’

‘নেই। খালি বাক্স ফেলে গেছে চোর। তবে চিন্তা করবেন না, অল্প সময়ের ভেতরেই উদ্ধার করে ফেলব।’

‘আপনাকে ধরে জুতোপেটা করা দরকার।’ হঠাৎ খেপে গেলেন মি. ওয়েস্টমোর।

আশ্চর্যের ব্যাপার, হালাসের ভেতরে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না, সে শুধু একটু হাসল। বলল, ‘এখন গালি দিচ্ছেন বটে, কিন্তু নেকলেসটা পেলে ঠিকই পিঠ চাপড়াবেন।’

‘নেকলেসটা উদ্ধার করতে কেউ বলেছে আপনাকে? আমি তো মানাই করলাম।’

‘সমস্যাটা আপনার একার নয়, মি. ওয়েস্টমোর। গত দুই মাসে এ রকম আরও কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো উদ্ধার করতে হলে চোরটাকে ধরা একান্ত প্রয়োজন।’

‘ধরবেন কী করে?’ প্রশ্ন করলেন মিসেস ওয়েস্টমোর, ‘কোনো সূত্র আছে? নাকি এসব তল্লাশিই ভরসা?’

‘আছে, ম্যাডাম, আছে।’ আশ্বাস দিল হালাস, ‘আপনাদের ব্যাপারটা খুলেই বলি, হয়তো মত পাল্টাবেন। এসব চুরির পেছনে একজন লোককেই সন্দেহ করছি আমরা। তার নাম ডন ডুগার্ড—কুখ্যাত জুয়েলারি অ্যান্ড আর্ট থিফ, বড়সড় একটা দল আছে তার। গোপন সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি, সে এখন লস অ্যাঞ্জেলেসে। আর সে আসার পর থেকেই চুরিগুলো শুরু হয়েছে।’

‘আপনার ধারণা, সে এখন এই বাড়িতে?’

‘হতে পারে। তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, তার বাঁ হাতের তালুর উল্টো পিঠে একটা উল্কি আছে—হাঙরের ছবিঅলা। ওটা দেখে সহজেই চিনে ফেলা সম্ভব তাকে।’

‘কিন্তু অমন কোনো লোক দেখিনি আমরা...’ প্রতিবাদ করলেন মি. ওয়েস্টমোর।

‘হয়তো ছদ্মবেশ নিয়েছে। নইলে কোনো শাগরেদকেও পাঠিয়ে থাকতে পারে। তবে আরেকটা সূত্র আছে আমাদের হাতে—অ্যান্ডু ব্লেক।’

‘মি. ব্লেক!’

‘হ্যাঁ। গত দুই মাসে যে কটা চুরি হয়েছে, তার সমস্ত জুয়েলারি কেনা হয়েছিল ব্লেকের দোকান থেকে। তার সঙ্গে ডুগার্ডের যোগাযোগ না থেকে পারে না। আজ আমরা আসলে ব্লেককেই ফাঁদে ফেলতে চাইছি। তাকে চাপ দিলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।’

‘তাহলে অন্যদের হয়রানি করার মানেটা কী?’ আবার রেগে যাচ্ছেন মি. ওয়েস্টমোর।

‘আপনি বুঝতে পারছেন না।’ মাথা নাড়ল হালাস, ‘নির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া একা তাকে সার্চ করা যাবে না—আইনি সমস্যা হবে। বাধ্য হয়ে সবাইকে টেনে আনতে হচ্ছে।’

‘এটা কোনো কথা হলো না...’ তর্ক শুরু করলেন মি. ওয়েস্টমোর।

কিন্তু তাঁর কথা শেষ হলো না। কোত্থেকে যেন একজন পুলিশ ছুটে এসেছে, একটা গ্রুপ নিয়ে সে গিয়েছিল বাড়ির কর্মচারীদের তল্লাশি করতে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, ‘লোকটাকে পাকড়াও করেছি আমরা, স্যার।’

‘ডুগার্ড?’ ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল হালাস।

‘না, তবে তার শাগরেদ হতে পারে। লোকটা একজন বেয়ারা—নাম বার্টি।’

‘বার্টি!’ রিয়া প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ‘অসম্ভব! ও আমাদের অনেক পুরোনো লোক।’

‘তার পকেটে এটা পাওয়া গেছে।’ একটা সোনার চেইন হালাসের হাতে তুলে দিল পুলিশটা।

‘কী এটা?’ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল হালাস।

‘নেকলেসের চেইন। হিরেগুলো সঙ্গে গাঁথা ছিল, চেইন কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

‘কোথায় সেগুলো?’

‘পাইনি, স্যার। নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে।’

‘পেয়েছি ব্যাটাকে, নিশ্চয়ই ডুগার্ডের দোসর। দু’ঘা দিলেই সব বেরিয়ে পড়বে। সব দরজায় পাহারা বসাও। ডুগার্ডের আরও সাঙ্গপাঙ্গ থাকতে পারে। কেউ যেন হিরে নিয়ে পালাতে না পারে। সারা বাড়ি সার্চ করো। হিরেগুলো আমার চাই।’

‘দেখুন ডিটেকটিভ।’ শান্ত স্বরে বললেন রিয়ার মা, ‘নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। বার্টিকে খুব ভালো করে চিনি আমরা। ও এমন কাজ করতে পারে না।’

‘এক্ষুনি সেটা জানা যাবে।’ বলল হালাস, ‘তবে লোকটাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ দেখতে পাচ্ছি। চুরির সময় সে মি. ওয়েস্টমোরের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, তাই না? আচ্ছা চলি।’

চলে গেল হালাস। তার পেছনে পেছনে ছুটলেন রিয়ার বাবা-মা।

‘চোর তাহলে ধরা পড়ল?’ হুফ করে শ্বাস ফেলল জিমি, ‘কী হে, ভিক্টোরিয়া...আমি বলিনি, ওই বেয়ারাই চোর?’

রিয়ার মুখ থমথম করছে। খোঁচাটা গায়েই মাখল না। বলল, ‘আমি বিশ্বাস করি না। অয়ন, কিছু একটা করো! বার্টি আর যা-ই হোক, ডুগার্ডের শাগরেদ না।’

‘চোরকে বাঁচাতে বলছ?’ অয়ন প্রশ্ন করল।

‘বার্টি চোর না!’ চেঁচিয়ে উঠল রিয়া।

‘শান্ত হও, শান্ত হও!’ তাড়াতাড়ি বলল অয়ন, ‘খটকা একটা অবশ্য আমার মনেও লাগছে। নেকলেস থেকে হিরেগুলো আলাদা করে ফেলা হলো কেন? ডুগার্ডের ব্যাপারে যা শুনলাম, বিনা মতলবে কোনো কাজ করার মানুষ বলে তো মনে হলো না।’

‘মনে হচ্ছে তোমার মাথায় কোনো আইডিয়া এসেছে?’ হ্যারি প্রশ্ন করল।

‘হুঁ!’ মাথা ঝাঁকাল অয়ন, ‘আচ্ছা, এমন হতে পারে না—বার্টির ব্যাপারটা জাস্ট একটা ডাইভারশন? পুলিশের ব্যস্ততার ফাঁকে হিরেগুলো সরিয়ে ফেলার একটা বুদ্ধি?’

‘যুক্তি আছে তোমার কথায়।’

‘হুঁ। একটা ব্যাপারে আমি শিয়োর। ডুগার্ড উপস্থিত আছে, এই বাড়িতেই।’

‘অসম্ভব! উল্কিওয়ালা কোনো লোক দেখিনি আমরা।’ প্রতিবাদ করল জিমি।

‘ছদ্মবেশ নিয়েছে সে।’ বলল অয়ন, ‘মেকআপের রং দিয়ে উল্কি ঢাকা সম্ভব। কিংবা...’ কী যেন মনে পড়ায় চমকে উঠল ও। ‘মাই গড! হাতটাই গায়েব করে দিয়েছে সে!’

‘মানে!’ সবাই অবাক।

‘বিল পামার।’ রুদ্ধশ্বাসে বলল অয়ন, ‘সে-ই ডুগার্ড।’

‘তা কী করে হয়?’ বোকার মতো বলল রিয়া, ‘তার কোম্পানির এত লোক এসেছে, তারা বুঝে ফেলবে না?’

‘সব ওর সাঙ্গপাঙ্গ, আসল লোকেরা কেউ আসেনি। সর্বনাশ হয়েছে, জিমি। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে মৌচাকে ঢিল ছুড়েছিস তুই। এরপর পলকে একা রেখে আসা মোটেই উচিত হয়নি।’

‘কিছু একটা করতে হবে...এক্ষুনি!’ তাগিদটা বুঝতে পারছে জিমি।

‘চলো, মামাকে সব বলি।’ প্রস্তাব দিল রিয়া।

‘না।’ মাথা নাড়ল অয়ন, ‘আগে পলের অবস্থা দেখা দরকার। সেই সঙ্গে কিছু প্রমাণও চাই। ডুগার্ড এখন অসতর্ক অবস্থায় আছে। এই-ই আমাদের সুযোগ। সব ঠিকঠাক থাকলে পুলিশের কাছে যাব।’

‘এখন তাহলে কী করবে?’

‘পেছনের আঙিনায় যাব। দরজা না, বিকল্প পথ দরকার। আমাদের সন্দেহ করে থাকলে দরজা দিয়ে বেরোতে দেখলেই সাবধান হয়ে যাবে।’

‘ওদিকে বাবার প্রাইভেট স্টাডি আছে।’ জানাল রিয়া, ‘ওখানকার জানালা দিয়ে বেরোনো সম্ভব।’

‘চলো যাই।’

ছুটল চার বন্ধু।

ছয়

জানালা দিয়ে লনে নামল ওরা। আশপাশে তাকাল, কেউ দেখতে পেয়েছে কি না। ভাগ্য ভালো, নেই কেউ।

‘এদিকে!’ চাপা গলায় ডাকল রিয়া।

দেয়াল ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করল ওরা। সামান্য পরেই বাড়ির পেছনে পৌঁছে গেল। পলকে দেখা গেল না কোথাও।

‘সবাই ছড়িয়ে পড়ো—পলকে খুঁজে বের করো।’ নির্দেশ দিল অয়ন, ‘রিয়া, তুমি এখানেই থাকো , কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।’

‘কেন? আমি বসে থাকব কেন?’ রিয়া রেগে গেল।

‘যা একখানা পোশাক পরেছ, দশ মাইল দূর থেকেও দেখা যাবে। ড্রেস তো না, যেন লাইটহাউস!’

‘ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আমি লাইটহাউস পরেছি?’

‘নয়তো কী? এ রকম ঝলমলে পোশাক পরে গোয়েন্দাগিরি হয়? যা বলছি শোনো। চুপচাপ বসে থাকো এখানে।’

ছেলেরা চলে গেল।

‘ধ্যাত্তেরি!’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল রিয়া।

পলকে কোথাও খুঁজে পেল না ওরা। একটু পর হতাশ হয়ে ফিরে এল।

‘গেল কোথায়?’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল হ্যারি।

‘নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছে।’ আন্দাজ করল অয়ন।

‘চলো, মামার কাছে যাই।’ বলল রিয়া, ‘আর অপেক্ষা করাটা ঠিক হবে না।’

অলংকরণ: সাদাত

‘আরে!’ হঠাৎ বলে উঠল জিমি, ‘ডুগার্ড বেরিয়ে এসেছে।’

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল অন্যরা। হ্যাঁ, ডুগার্ডই। একটা ভ্যানে ওয়াইনকুলার ওঠাচ্ছিল দুজন ওয়েটার। তাদের সঙ্গে কথা বলছে। ড্রাইভারকে কী যেন নির্দেশ দিতেই মাথা ঝাঁকাল লোকটা। গিয়ে ভ্যান স্টার্ট দিল। ডুগার্ড গিয়ে বসল তার পাশে।

‘চলে যাচ্ছে নাকি?’ বিস্ময় ফুটল রিয়ার কণ্ঠে, ‘তা কী করে সম্ভব?’

‘পুলিশ নিশ্চয়ই কিছু পায়নি।’ বলল অয়ন, ‘যেতে বাধা দেবে কেন?’

‘হিরেগুলো কি তাহলে ফেলে যাচ্ছে?’

‘না। সঙ্গেই আছে।’

‘কী করে...বাড়ি থেকে হিরেগুলো বের করার কোনো ব্যবস্থা নেই।’

মাথার ভেতর কী যেন অনেকক্ষণ ধরে খোঁচাচ্ছিল অয়নের, এবার ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। উত্তেজিত কণ্ঠে ও বলল, ‘আমি জানি হিরেগুলো কীভাবে পাচার করা হয়েছে। জলদি এসো, ভ্যানটাকে থামাতে হবে!’

পেছনের গেটের দিকে ছুট লাগাল অয়ন, পিছু পিছু বাকি তিনজনও। খোলা গেটের সামনে গিয়ে থামল ওরা। মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে অয়নের। ভ্যানটাকে থামানোর বুদ্ধি দরকার। পেয়েও গেল।

‘গেট বন্ধ করো! জলদি!’

হ্যারি আর রিয়া কাজে লেগে পড়ল। জিমি আর অয়ন রাস্তার পাশ থেকে দুটি বড় পাথর হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

‘আরে!’ ভ্যানের ভেতর ড্রাইভার অবাক, ‘কে যেন গেট বন্ধ করে দিচ্ছে। এ তো দেখছি সেই বাচ্চাগুলো!’

‘থামবে না।’ কড়া গলায় হুকুম দিল ডুগার্ড, ‘গেট ভেঙে বেরিয়ে যাও!’

গোঁ গোঁ শব্দের সঙ্গে বেড়ে গেল ভ্যানের গতি। গেটের কাছাকাছি আসতেই অয়ন চেঁচিয়ে উঠল, ‘অ্যাটাক!’

পাথর ছুড়ল দুই বন্ধু। কাচ ভাঙার শব্দ হলো। চুরচুর করে ঝরে পড়ল ভ্যানের উইন্ডশিল্ড। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে মুখের সামনে দুহাত তুলল ড্রাইভার, এক পায়ে চেপে ধরল ব্রেক প্যাডেল। টায়ারের কর্কশ শব্দ হলো, ওই অবস্থায় গেটের ওপর আছড়ে পড়ল গাড়িটা। লোহার কবজা ভাঙার বিশ্রী শব্দ হলো, পাল্লা ভেঙে বেরিয়ে গেল ভ্যান, তবে কয়েক গজ গিয়ে থেমে গেল।

ভ্যানের সামনেটা ভচকে গেছে। অনেক কষ্টে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ডুগার্ড। এই মুহূর্তে তার দুটি হাতই দেখা যাচ্ছে। ভ্যানের ড্রাইভার প্রচণ্ড ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারেনি, বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ডুগার্ডের শরীর জায়গায় জায়গায় কেটে গেছে। যন্ত্রণাটা বোধ হয় সহ্য হলো না তার, উপরন্তু অয়নদের দেখে মাথায় আগুন চড়ে গেল। এত সাধের প্ল্যান এই বিচ্ছুগুলোর জন্য বানচাল হয়ে গেছে। চিৎকার করে দুহাত তুলে ছুটে এল সে।

কত বড় বোকামি হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারল না ডুগার্ড। রিয়ার দিকে এগিয়ে বোকামির মাত্রা আরও বাড়াল সে। বাউলি কেটে ডুগার্ডের হাতের তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল রিয়া, শত্রুর হাঁটুর পেছনে একটা লাথি ঝাড়ল। হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল ডুগার্ড। আবার উঠে দাঁড়াল, কিন্তু সামলে ওঠার আগেই তার একটা হাত চেপে ধরল রিয়া। পিঠের ওপর দিয়ে ছুড়ে দিল। ধপাস করে ভারী বস্তার মতো আছড়ে পড়ল চোর মহাশয়। হাততালি দিয়ে উঠল ছেলেরা।

‘ব্রাভো, রিয়া।’ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল অয়ন, ‘দারুণ তোমার মার্শাল আর্ট!’

‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ মাথা নিচু করে বাউ করল রিয়া।

মাটিতে পড়ে থাকা ডুগার্ড আর নড়ছে না। বোধ হয় বেহুঁশ হয়ে গেছে। দূরে কোলাহল শোনা গেল, পুলিশ আসছে। ভ্যানের দিকে এগিয়ে গেল অয়ন, পেছনের দরজা খুলে ফেলল।

‘পল, আছ তুমি এখানে?’ ডাকল ও।

গোঙানির মতো শব্দ হলো, একটা বস্তা নড়ছে। তাড়াতাড়ি বস্তার মুখ খুলে পলকে বের করল ও। বেচারার হাত-পা বাঁধা—মুখেও রুমাল গুঁজে দেওয়া হয়েছে। মুক্ত হয়ে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সে।

ভ্যান থেকে নেমেই অবাক হয়ে গেল ওরা দুজন। ইতিমধ্যে উঠে পড়েছে ডুগার্ড, অসতর্ক অবস্থায় হ্যারিকে জিম্মি করে ফেলেছে। তাকে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। রিয়া আর জিমি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ানো। ডুগার্ডের পিঠ ভ্যানের দিকে।

বেকায়দা পরিস্থিতি। তবে মোকাবিলার জন্য তৈরি অস্ত্র হাতের কাছেই পাওয়া গেল। ভ্যানের ভেতর থেকে একটা মদের বোতল তুলে নিল অয়ন, তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল।

পুলিশের দিকে ফিরে বেশ তর্জন-গর্জন করছিল ডুগার্ড। ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় বোতলটা ভাঙল অয়ন। চোখে সর্ষে ফুল দেখতে দেখতে ধরাশায়ী হলো বেচারা।

সব পুলিশ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে বোতলের ভাঙা মুখটা তুলে দেখাল অয়ন। বলল, ‘এটা...মার্শাল আর্টের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।’

সাত

এক ঘণ্টা পর। মি. ওয়েস্টমোরের স্টাডিতে বসে আছে সবাই—অয়নরা, বাবা-মাসহ রিয়া, লেফটেন্যান্ট করবিন আর ডিটেকটিভ হালাস। রহস্যটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।

‘গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত তোমাদের, মামা।’ খোঁচা মেরে বলল রিয়া, ‘এতগুলো পুলিশ নিয়ে যা পারলে না, আমরা এ কজন মিলে কেমন করে ফেললাম?’

‘এ অবিশ্বাস্য।’ বলল হালাস। ‘তোমরা নিশ্চয়ই কোনো জাদু জানো।’

‘জাদুটাদু কিছু না।’ এবার অয়ন বলল, ‘এটা হচ্ছে কাজ করার পদ্ধতির ব্যাপার। আপনারা খোলাখুলিভাবে সবার শরীর তল্লাশি করেছেন—এতে সব সময় কাজ হয় না। অন্যদিকে, আমরা তদন্ত করেছি গোপনে—একটা সুবিধাও পেয়েছি আমরা। ছোট বলে কেউ আমাদের গুরুত্ব দেয়নি। ফলে ক্লু জোগাড় করা সহজ হয়েছে।’

‘কী রকম?’

‘ডুগার্ডকে চেনার ব্যাপারটাই ধরুন। মি. ব্লেককে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়েছিল সে। কিন্তু তার লাইটারটা ছিল বাঁ পকেটে। কথা হচ্ছে, যে লোকের বাঁ হাতই নেই, সে বাঁ পকেটে লাইটার রাখে কী করে? আমার মনে একটা খটকা লেগে গেল। কাজেই আপনি যখন বললেন, ডুগার্ডের বাঁ হাতে একটা উল্কি আছে, তখন বুঝে ফেললাম, উল্কি লুকানোর জন্য পুরো বাঁ হাতই কোটের আড়ালে ঢেকে রেখেছে সে। কিন্তু পুলিশের সামনে এ-ধরনের ভুল সে কিছুতেই করত না।’

‘কিন্তু ডুগার্ড যদি পামার না হয়ে থাকে।’ বললেন মি. ওয়েস্টমোর, ‘আসল পামার কোথায়?’

‘আমার ধারণা, পামারকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোথাও বন্দী করে রেখেছে সে।’ বলল অয়ন, ‘সঙ্গে কোম্পানির বাকি কর্মচারীদেরও। একটু চাপ দিলেই জানা যাবে। ভীষণ ধুরন্ধর লোক এই ডুগার্ড। নিশ্ছিদ্র একটা প্ল্যান খাড়া করে কাজে নেমেছিল সে। পামারকে দেখেই সম্ভবত তার মাথায় বুদ্ধিটা আসে। বাঁ হাত না থাকাটা ওর জন্য একটা বিরাট প্লাস পয়েন্ট হিসেবে দেখা দেয়।’

‘কিন্তু ব্লেকের ব্যাপারটা কী? সে কি এতে জড়িত?’

‘মনে হয় না। তাঁর মতো নামীদামি লোক জেনেশুনে এসবে জড়াবেন না। আমার আন্দাজ হলো, তাঁর দোকানে ডুগার্ডের কোনো একজন চর আছে। বড়সড় কেনাবেচা হলে সে-ই ডুগার্ডকে ক্রেতা সম্পর্কে তথ্য পাচার করে। একটু চেষ্টা করলেই লোকটাকে ধরা যাবে। ভালো কথা, ডুগার্ডের সমস্ত লোক কি ধরা পড়েছে?’

‘হ্যাঁ।’ বললেন করবিন, ‘একটাকেও পালাতে দিইনি।’

‘গুড। ওই ব্যাটা তাহলে সাবধান হওয়ার সুযোগ পাবে না।’

‘কিন্তু হিরেগুলো এখনো পাইনি আমরা।’ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন হালাস, ‘সেগুলো কোথায়, তুমি জানো, অয়ন?’

‘ঠিক ঠিক বলতে পারব না, তবে অনুমান করতে পারি।’

‘তাহলে বলছ না কেন? শিগগির বলো!’

‘একটু ধৈর্য ধরুন, সব বলছি।’ হাসল অয়ন, ‘কীভাবে চুরিটা হলো, এটা আগে বলি। ডুগার্ড তার একজন লোককে বসিয়ে রেখেছিল মেইন সুইচ বোর্ডের কাছে। যথাসময়ে তাকে সংকেত দেয় সে—সংকেতটা কী রকম, ঠিক বলতে পারব না। হয়তো মোবাইলে মিসড কল দিয়েছিল। যাহোক, কারেন্ট চলে যেতেই ওয়েস্টমোর আঙ্কেলের পকেট থেকে নেকলেসটা হাতায় ডুগার্ড—বার্টির ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সে। অন্ধকারে নেকলেসের চেইনটা কেটে হিরেগুলো আলাদা করে সে। বাক্সটা ফেলে দেয় টেবিলের তলায়, চেইনটা বার্টির পকেটে...আর হিরেগুলো লুকিয়ে ফেলে।’

‘কোথায়?’ সমস্বরে বলল সবাই।

‘আপনারাই ভাবুন, আমি সূত্র দিচ্ছি। পুরো নেকলেস নিয়ে বেরোনো সম্ভব নয়, কাজেই শুধু হিরেগুলোর ওপর নজর দেয় ডুগার্ড—ভীষণ বাস্তববাদী মানুষ সে, স্বীকার করতেই হবে। তা ছাড়া চেইনটা একটা ডাইভারশন হিসেবেও কাজ করে। এখন কথা হচ্ছে সবার অলক্ষে কীভাবে হিরেগুলো বের করা যায়? একটা কথা মনে রাখতে হবে, কোনো জিনিস লুকানোর সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হচ্ছে একই রকম দেখতে আরও কিছু জিনিসের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া...’

‘এক মিনিট!’ বলে উঠল জিমি। ‘হিরের সঙ্গে মিল আছে এমন একটা জিনিসের কথাই মাথায় আসছে আমার...বরফ!’

‘ওয়াইনকুলার!’ চেঁচিয়ে উঠল রিয়া। ‘ডুগার্ডের লোকেরা ভ্যানে ওয়াইনকুলার তুলছিল।’

‘শাবাশ!’ বলল অয়ন, ‘ঠিক ধরেছ। ডুগার্ডের ভ্যানের ওয়াইনকুলারের বরফগুলো গলালেই ছয়টা হিরে পাওয়া যাবে। আমি শিয়োর!’

‘এক্ষুনি যাচ্ছি।’ বলে ছুটে বেরিয়ে গেল হালাস।

উঠে দাঁড়ালেন করবিন। বললেন, ‘আমি সত্যি ইমপ্রেসড, অয়ন। তোমাদের ছোট করে দেখা মোটেই উচিত হয়নি। সত্যি তোমরা দারুণ বুদ্ধিমান।’

‘সে কী!’ বলে উঠল রিয়া, ‘সমস্ত ক্রেডিট ওদের দিয়ে দিচ্ছ। আমি বুঝি বেগার খেটেছি?’

‘তোকে আর কী ক্রেডিট দেব? পারিস তো শুধু ঝগড়া আর মারামারি করতে।’

‘কী! আমি ঝগড়াটে?’

‘তোমাদের একটা পুরস্কার পাওনা হয়েছে, অয়ন।’ বললেন মি. ওয়েস্টমোর। ‘বলো কী চাও?’

‘স্যরি, আঙ্কেল।’ মাথা নাড়ল অয়ন। ‘পুরস্কার পাওনা হয়েছে বটে, তবে সেটা আপনার নয়, রিয়ার কাছে।’

‘কী চাও?’ জিজ্ঞেস করল রিয়া।

‘পার্টিটা বলব ৎ রইল।’ বলল অয়ন, ‘তবে, ঝগড়াঝাঁটি আর খ্যাপানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা এক সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে এক মাসে উন্নীত করা হলো।’

‘কী হে, কাউয়া বুড়ি।’ হুল ফোটাল জিমি, ‘রাজি?’

‘কী!’ হুংকার দিল রিয়া, ‘পাবদা-পুঁটি কোথাকার, এত্ত বড় সাহস...’

‘অ্যাই, অ্যাই!’ ওকে থামাল অয়ন, ‘শর্ত ভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!’

‘কিন্তু ও যে আমাকে খ্যাপাল!’

‘তাতে কী? ওর ওপর তো নিষেধাজ্ঞা নেই।’ একগাল হাসল অয়ন, ‘তা ছাড়া...মাই ডিয়ার ভিক্টোরিয়া, এক মাসের সময়সীমা শুরু হচ্ছে এখন থেকেই!’

(শেষ)