অন্য জন্ম

অলংকরণ: মাহফুজ রহমান

আকাশ কাঁপিয়ে হাতির নিনাদ শোনা যাচ্ছে কানের কাছে। আর অনেক অনেক মানুষের চিৎকার। শিশুদের কান্না। মেয়েদের গলার আওয়াজ। তারপর দুম দুম দুম করে গোলার আওয়াজ। শব্দগুলো যেন একেবারে বুকের ভেতর বাজছে। একটা শিশু অনেকক্ষণ ধরে মায়ী মায়ী বলে চিৎকার করছে। কেউ তার কান্নায় কর্ণপাত করছে না। যে যার মতো ছোটাছুটি করছে। শিশুটা কাদের যেন তাড়া খেয়ে ধপ করে পড়ে গেল একটা গর্তের ভেতর। ছোট দুটি হাত দিয়ে লতা-পাতা, শিকড়-বাকড় ধরে বাঁচার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। অতল গহ্বরে সে পড়ে যেতে থাকল। পড়েই যেতে থাকল। ভয়ে আর আতঙ্কে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল বাচ্চাটি।

ঠিক এই সময় ধড়মড় করে জেগে উঠল অয়ন। ঘামে তার ফতুয়া ভিজে সপ সপ করছে। বিছানার ডান দিকে এসি চলছে, ঠান্ডা বাতাস আসছে তার ফাঁকগুলো থেকে। অন্য দেয়ালে জ্বলছে হালকা সবুজ একটা আলো। অয়ন বিস্মিত হয়ে জিনিসগুলো দেখল। প্রথমে ঠিক চিনতে পারল না জায়গাটা। এটা কোথায়? এই অদ্ভুত চারকোনা জিনিসটা থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে কেমন করে? আর ওই গোল চাকতিটাই বা চাঁদের মতো টিমটিম করে জ্বলছে কেন? হতবিহ্বল অয়নকে আরও চমকে দিয়ে সারা ঘর আলোয় ভাসিয়ে দিয়ে বাতি জ্বেলে দিলেন অয়নের মা। অয়নকে এমন অদ্ভুতভাবে বসে থাকতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন—কী হয়েছে রে? ঘুমাসনি? চিৎকার করছিলি কেন?

অয়নও অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকল তাঁর দিকে। তারপর মোটা অপরিচিত হেঁড়ে গলায় ধমকে উঠল—বিনটু বুরাই? বিনটু বুরাই?

মাঝে মাঝে আপনার মনে হয় যে আপনি আসলে আপনি নন? টেবিলে কলম ঠুকতে ঠুকতে প্রশ্নটা করলেন ডাক্তার ধীমান। টেবিলের ওপাশে বসে আছে একুশ বছরের একটা ছেলে। ফরসা মুখ, টলটলে দুটি চোখ। মায়াকাড়া চেহারা। পাশে বসা মায়ের সঙ্গে বেশ মিল আছে ছেলেটার চেহারার। মাও বেশ ফরসা। সুন্দরী। তবে এই মুহূর্তে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায় তাঁর মুখ থমথম করছে।

অয়ন নামের ছেলেটা উসখুস করতে শুরু করল। তারপর বলল, আমি ঠিক বলতে পারব না। মা বলতে পারবেন। মাঝে মাঝে আমি নাকি এমন সব কথা বলি, যা আমার বলার কথা নয়। আর তখন আমি কাউকে চিনতেও পারি না। সবাই ভাবে যে আমি অন্য কেউ। আমি অয়ন না।

তারপর কী হয়? ডাক্তার ধীমান আরেকটু এগিয়ে এলেন—আবার কখন সব ঠিক হয়? সব চিনতে পারেন আবার?

এবার অয়নের মা মুখ খুললেন—তারপর ও ঘুমিয়ে যায়। গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠলে দেখা যায় সব ঠিকঠাক। সে আবার আমার অয়ন হয়ে গেছে। তখন ওকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে একটু আগে সে কী করছিল।

হুম্। গম্ভীর হয়ে পড়লেন ডাক্তার ধীমান। সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা অনেক গায়েবি ও অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পায়। তাদের মনে হয়, যেন কেউ তাকে দূর থেকে চালাচ্ছে। অনেক সময় মনে হয়, তার মাথার ভেতর বসে অন্য কেউ কথা বলছে। এই ছেলের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা খুব মেধাবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। এর যদি এ রকম একটা রোগ হয়, তবে ব্যাপারটা দুঃখজনক।

অয়ন—হালকা সুরে বললেন ডাক্তার ধীমান—তুমি কি মাঝে মাঝে অদৃশ্য কোনো আওয়াজ শুনতে পাও? কেউ কি তোমার সঙ্গে কথা বলে যে কি না আশপাশে নেই?

অয়ন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল—আমি জানি স্যার, আপনি ভাবছেন আমি সাইকোসিসে ভুগছি। আমারও মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে যেটা ঘটে তা হলো, হঠাৎ করে অন্য কারও স্মৃতিতে আক্রান্ত হয়ে যাই আমি। সেই অন্য একজনের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমি টের পেতে থাকি। হুবহু কী ঘটেছিল, এমনকি তার অনুভূতিগুলো পর্যন্ত টের পাই আমি। তখন সত্যি সত্যি মনে হয়, আমি আসলে আমি নই। আমি হচ্ছি সে।

অয়নের মা কাঁদতে শুরু করলেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছে বললেন—ডক্টর, আমি যদি একজন লেখাপড়া জানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হতাম, তবে নিশ্চয় ভাবতাম যে আমার ছেলেকে জিনে ধরেছে। প্লিজ, আপনি বলে দিন এসব কী ঘটছে! এসবের ব্যাখ্যা কী?

অয়ন মাকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে আবার ডাক্তারের দিকে ফিরল—স্যার, আপনি কি সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা পড়েছেন? আমার সমস্যা অনেকটা সোনার কেল্লার মুকুলের মতো। আমি যেন অন্য জন্মের অন্য কারও কথা মনে করতে পারছি। এটা কি কোনো অসুখ, স্যার?

ডাক্তার ধীমানকে একটু চিন্তিত মনে হলো। সামনে বসা এই ছেলেটার মাথা খুব পরিষ্কার। তার চিন্তা-চেতনা পরিষ্কার। ঘোলাটে নয়। সে যুক্তি দিয়ে নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে পারছে। নিজের সমস্যাগুলো ধরতে পারছে। এটাই তাকে বিব্রত করে তুলছে। সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের চিন্তা-চেতনা থাকে ঘোলাটে। সব তালগোল পাকানো। নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে তারা অক্ষম। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে তাঁরা বলেন ইনসাইট নষ্ট হয়ে যাওয়া। কিন্তু এই ছেলের ইনসাইট মানে মনের ভেতরকার জগৎ একদম ঠিক আছে। শুধু ঠিকই নেই, শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের তুলনায় এর চিন্তা-চেতনা অনেক বেশি তুখোড় ও স্পষ্ট। এই জায়গায় এসে ডাক্তার ধীমান রোগনির্ণয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে শুরু  করেছেন। না, এ সিজোফ্রেনিয়া নয়। হয়তো আরও জটিল কোনো মানসিক রোগ। তাঁকে আরও সাবধান হতে হবে। আরও বিস্তৃতভাবে ছেলেটিকে জানতে হবে। তিনি অয়নের মায়ের দিকে ফিরে বললেন, এর পর থেকে ও যা যা বলবে, আপনি তা লিখে রাখবেন। হয়তো সেখান থেকে আমরা কোনো ক্লু পেতে পারি। হয়তো ওগুলো স্রেফ উল্টোপাল্টা কথা নয়। তার কোনো মানে আছে।

অয়নের মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর যা বললেন, তার জন্য ডাক্তার মোটেই প্রস্ত্তত ছিলেন না। তিনি বললেন—ডক্টর, সে যে ভাষায় কথা বলে, তা আমার জানা নেই। আমি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনেছি। আমাদের পরিচিত কোনো ভাষা নয় এটি। সংস্কৃত বা বাংলা কোনোটার সঙ্গেই মিল নেই। তবে দু-একটা শব্দ হঠাৎ পরিচিত মনে হয়। যেমন—বুরা। বুরা সিলেট অঞ্চলে খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হয়। অথবা মিরচি। মিরচি একটি হিন্দি ঘেঁষা শব্দ। এইসব ছাড়া আর কোনো কিছুই আমার পরিচিত নয়। সে এক অদ্ভুত দুর্বোধ্য ভাষায় অবলীলায় কথা বলে চলে। আমি জানি না, এই ভাষা সে কীভাবে শিখেছে।

ডাক্তার ধীমান অদ্ভুত দৃষ্টিতে অয়ন নামের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যতটা ভেবেছিলেন, কেসটা আসলে তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। তিনি কোনো কূলকিনারা করতে পারছেন না কেসটার। তাঁর ২০ বছরের ক্যারিয়ারে এ রকমটি আর ঘটেনি।

তিন

একটা কালচে সবুজ মাটির দলা ছাড়া প্রথমে আর কিছু মনে হবে না জিনিসটাকে। কিন্তু জিনিসটার নৃতাত্ত্বিক মূল্য অনেক। মণিপুরের রাজা বিক্রমাদিত্যের কিছুদিনের জয় করা এক জংলি রাজ্যের গুহার দেয়ালের অংশ এটি। আজ থেকে কয়েক শ বছর আগে বিক্রমাদিত্য রাজ্য জয় করতে করতে পৌঁছে গিয়েছিলেন বাংলার পূর্ব-উত্তর কোণে জৈন্তা নামের এক জায়গায়। পাহাড় আর বন ঘেরা এই রাজ্যে তাঁবু গেড়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিল ৩০০ অশ্ব¼ারোহী, ৪০টা হাতি আর তাঁর সুন্দরী তরুণী স্ত্রী বিজয়া রানী। তরুণ রাজা যেন এই জায়গাটার সৌন্দর্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। এখানে নিজের একটা রাজধানী গড়ে তোলার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর সেই বাসনা কখনো চরিতার্থ হয়নি।

মাটির স্যাঁতসেঁতে টুকরাটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে রিমি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। অয়ন, তোমার কি এই সব কথা ভেবে গায়ে কাঁটা দেয় না? মনে করো এই বিক্রমাদিত্য, কেন নিজের রাজ্যপাট, প্রাসাদ আর রাজধানী ছেড়ে এই জঙ্গলে বসতি গড়তে চেয়েছিলেন, তা কেউ জানে না। কেনই বা আবার সমস্ত সৈন্যসামন্ত নিয়ে জায়গাটা ছেড়ে চলে গেলেন, তা-ও ইতিহাস জানে না। তবে ইদানীং আমাদের আবিষ্কার বলছে, এই গভীর বনে এক আশ্চর্য সভ্যতা আগে থেকেই গড়ে উঠেছিল। রাজার অনধিকার প্রবেশ হয়তো তারা মেনে নেয়নি। হয়তো স্বাধীনতার জন্য তারা লড়েছে এবং রক্ত দিয়েছে। সেই সভ্যতাও হঠাৎই হারিয়ে গেছে মাটির তলায়। কেউ তার আর খোঁজ পায়নি কয়েক শ বছরের মধ্যে। কী অদ্ভুত, আর রহস্যময়! তাই না?

অলংকরণ: তুলি

অয়ন চুপ করে রইল। মাটির দলাটার কথা তার মনেই ছিল না। মাস খানেক আগে রিমির কাছ থেকে এটা এনে এই জানালার কাছে ফেলে রেখেছিল। নৃতত্ত্বের ছাত্রী হিসেবে রিমি কদিন আগে জৈন্তায় তাদের ডিপার্টমেন্টের একটা প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়েছিল। জৈন্তা এলাকায় মণিপুরি রাজার হারিয়ে যাওয়া কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হচ্ছে ইদানীং। এ নিয়ে রীতিমতো হইচই চলছে চারদিকে। কিন্তু অয়নের এসব দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই। ধীমান স্যার তাকে কিছু মেন্টাল এক্সারসাইজ দিয়েছেন। নিয়মিত সেগুলো করতে হয়। আজকাল সমস্যা একটু কমে এসেছে। কিন্তু দেখা দিয়েছে নতুন এক সমস্যা। ভুলে যাওয়া। ইদানীং সবকিছুই ভুলে যাচ্ছে সে। একটা হাই তুলে সে রিমিকে বলল, তুমি যাওয়ার সময় মাকে দরজাটা বন্ধ করে দিতে বলো। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

রিমি অবাক হয়ে বলল, ঘুমিয়ে পড়লাম মানে? তুমি না একটু আগেই ঘুম থেকে উঠলে? আর আমাদের না বাইরে যাওয়ার কথা? তোমার কি শরীর খারাপ, অয়ন?

অয়ন কিছু বলার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল। রিমি অবাক হতে হতে এবার রেগেও গেল। কী আশ্চর্য! অয়নই না ওকে টেলিফোন করে আনিয়েছে কোথায় যেন যাবে বলে! আর এখন সে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ছে। সে উঠে গিয়ে অয়নকে ধাক্কা দিল—এই অয়ন। ওঠো। খবরদার ঘুমাবে না। এক্ষুনি ওঠো। 

জবাবে অয়ন পাশ ফিরে বিড়বিড় করে যা বলে উঠল, তার জন্য মোটেও প্রস্ত্তত ছিল না রিমি। জুমবারা লাই ক্রিতু। রাফাখুল কুসিমা জানি। হার ফুরি, হার ফুরি, হার ফুরি।

চমকে উঠে প্রায় ছুটে বেরিয়ে এল রিমি। বসার ঘরেই পেয়ে গেল অয়নের মাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে ব্যাপারটা খুলে বলল তাঁকে। অয়নের মাও ছুটে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। কথাগুলো লিখে রাখার কথা বলেছিলেন ডাক্তার। কিন্তু অয়ন এখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।

ফিরে এসে অয়নের মা দেখলেন, রিমি ফ্যাকাশে মুখে বসে আছে সোফার ওপর। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। ভয় তো পাওয়ারই কথা। অয়নকে বোধ হয় পাগল-টাগল ভাবছে সে। রিমির পাশে বসে ওকে সান্ত্বনা দিতে গেলেন অয়নের মা।

—ডাক্তার দেখিয়েছি ওকে। ডাক্তারের ধারণা, জটিল কোনো মানসিক রোগ। সামনের সপ্তাহে আবার যেতে বলেছেন।

রিমি মুখ ঢেকে ফেলল—না না আন্টি। অয়নেরও এই রোগটা হয়েছে। আর...আর এর জন্য বোধ হয় আমিই দায়ী। হায় হায় আন্টি, আমি এটা কী করলাম! অয়ন তো আর বাঁচবে না।

শুনে একেবারে চমকে গেলেন অয়নের মা। কী বলছ এসব? কী রোগ? খুলে বলো তো দেখি?

রিমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল কথাগুলো। ওদের প্রজেক্ট টিমে ১৬ জন সদস্য ছিল। একজন অধ্যাপক, একজন সহকারী অধ্যাপক, ১০ জন শিক্ষার্থী আর বাদবাকি সব দিনমজুর। জৈন্তার পাহাড়ি এলাকায় তিন ধাপে মোট ৫২ দিন খোঁড়াখুঁড়ি করেছে তারা। যা পাওয়া গেছে তা দেশের এক অমূল্য ইতিহাস বহন করে। এই দুর্গম পাহাড়ি আর জংলা এলাকায় আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার শ বছর আগে গড়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত সভ্যতা। সে সময় এ এলাকায় আদিবাসী পাহাড়ি কিছু মানুষ ছাড়া আর কেউ বাস করত না। কোনো এক বিচিত্র কারণে মণিপুরের এক রাজা বিক্রমাদিত্য এখানে আস্তানা গাড়েন এবং এই জংলি মানুষদের নিয়ে রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু এরা তীব্রতার সঙ্গে রুখে দাঁড়ায়। তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন। তবে সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলো প্রমাণ দিচ্ছে যে একজন সভ্য নারী, হয়তো তিনি রানি বিজয়া, তাদের সঙ্গে রয়ে যান। এখানকার জনগণ শিকার করে, ফলমূল ও শিকড়-বাকড় খেয়ে দিনযাপন করত, রানিও তা-ই করতেন। এরা পাহাড়ের গুহায় আর প্রাসাদের দেয়ালে সেই সব রেখাচিত্র এঁকে রেখেছিল। এক পাল উদোম গা, কালো ও চ্যাপ্টা নাকের মানুষের মধ্যে মোটামুটি সুন্দর চেহারার কাপড় ও প্রচুর গয়না পরা একজন নারীর ছবি পাওয়া যায়। এই নারী যে মণিপুরের রানি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন এই রানি রাজ্যপাট ছেড়ে এদের সঙ্গে এভাবে বাস করতেন? সে এক বিপুল রহস্য। এই রহস্য অধ্যাপক জুলকারনাইনকে পাগল করে তুলেছিল। ঢাকা ছেড়ে দিনের পর দিন তিনি গিয়ে পড়ে রইতেন জৈন্তার সেই পাহাড়ে। খুঁজে বেড়াতেন কোনো নিশানা, কোনো ক্লু। একবার দীর্ঘদিন পার হয়ে যাওয়ার পরও ফিরে না আসায় পরিবার ও ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে খুঁজতে গিয়ে দেখে, তিনি কী সব আবোল-তাবোল বকে চলেছেন সমানে। সেই ভাষা বোঝার সাধ্য কারও নেই। কাউকে চিনতে পারলেন না তিনি। এমনকি নিজের সন্তানদেরও না। কিছু জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইতেন। জোর করে ঢাকায় নিয়ে আসার পর সারা দিন পড়ে পড়ে ঘুমোতেন। যখন তখন ঘুম। তারপর এমন হলো যে ঘুমের জন্য খাওয়াদাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। ঘুম ভেঙে গেলে সেই দুর্বোধ্য ভাষায় বকাবকি। শেষ পর্যন্ত এক দুরূহ জটিল অজানা রোগে মারা গেলেন জুলকারনাইন স্যার।

শুনতে শুনতে শরীর যেন হিম হয়ে এল অয়নের মায়ের। এসব কী বলছে রিমি? এটা কেমন অসুখ? কিন্তু অয়ন তো ওখানে যায়নি। অধ্যাপক জুলকারনাইনকে সে চেনেও না। তবে ওর কেন এই রোগ হবে?

রিমি দুই হাতে চোখ মুছল। বিশ্বাস করবেন না আন্টি, স্যার মারা যাওয়ার ঠিক দিন বিশেক পরের কথা। স্যারের সার্বক্ষণিক সঙ্গী রহমত পাগল হয়ে গেল। সেই অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলা শুরু করল সেও। চিনতেও পারে না কাউকে। অনেক চেঁচামেচি করে পরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। রহমত আলী বাঁচল মাস খানেকেরও কম।

অয়নের মা দিশেহারা বোধ করছেন এবার। কী ভয়ংকর সব কথা বলছে এই মেয়ে? ডাক্তাররা কোনো কূলকিনারা করতে পারলেন না। অয়ন কি তবে বাঁচবে না? ডা. ধীমানের সঙ্গে এক্ষুনি দেখা করা দরকার।

চার

অন্ধকার গভীর এক গহ্বরে সে আটকা পড়ে ছিল তিন দিন। এই তিন দিন না কোনো খাবার পেয়েছে, না এক ফোঁটা পানি। মায়ী মায়ী বলে চেঁচাতে চেঁচাতে শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষ। ওপরে মানুষের সাড়া-শব্দও সব এই তিন দিনে বিলীন হয়ে গেছে। খিদের চোটে সে তখন অন্ধকারেই গুহার ভেজা দেয়াল থেকে পানি চেটে চেটে খেতে শুরু করেছে। হাতড়ে হাতড়ে পেয়ে গেছে একধরনের পোকামাকড়ও। গুহার ভেজা স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে এই পোকাগুলো জন্মে। শ্যাওলা খেয়ে বেঁচে থাকে এরা। পোকাগুলো আর গুহার শ্যাওলা তার খিদে মেটাল। তারপর ভাগ্যিস, চতুর্থ দিন এল প্রবল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে জঙ্গল সয়লাব। বৃষ্টির পানি আঁজলা ভরে পান করল সে। পেটটা ভরে গেল। মনের আনন্দে সে তখন চেঁচিয়ে গান গাইতে শুরু করল। মা যে গান গেয়ে তাকে একসময় ঘুম পাড়াত। জিম্বু বারা জিম্বু বারা, খুলে লাই খুলে লাই। হুরুম ধুরা হুরুম ধুরা, বিকেব লাই বিকেব লাই। গলা ফাটিয়ে গাইতে শুরু করল সে আর মায়ের কথা মনে করে কাঁদতে লাগল। হাতি আর ঘোড়া নিয়ে ওই দুষ্টু লোকগুলো আচমকা ওদের শান্ত ছোট্ট গ্রামটিতে হামলা না চালালে আজ ওরা কত সুখেই না থাকত। মা তাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে অবলীলায় পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে চলে যেত ফলপাকুড়ের সন্ধানে। সারা দিন মা-ছেলে দুজনে খুঁজে আনত কত রকমের খাবারদাবার। কখনো পাথর ছুড়ে একটা খরগোশ কি একটা শজারু মারত মা। তারপর ছাল ছাড়িয়ে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত মা-ছেলে। সেসব কথা ভেবে চোখে জল ভরে এল তার। ঠিক সেই সময় কে যেন অনেক ওপর থেকে কথা বলে উঠল। সেই ভাষা বুঝতে না পারলেও সে চেঁচিয়ে উত্তর দিল—জিম বারাই জিম বারাই। আমি এখানে আমি এখানে। তারপর কে যেন লতার দড়ি তৈরি করে ছুড়ে দিল তার দিকে। সে ওটা বেয়ে বেয়ে উঠে এল ওপরে। ওপরে উঠে চার দিন পর সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। দুই চোখে কিছুই দেখতে পেল না সে। জ্ঞান হারানোর আগে কেবল দেখতে পেল, অনেক সাজগোজ করা অনেক গয়না পরা একটা মেয়ে তাকে দুই হাতের মাঝে তুলে নিয়েছে।

জিম্বু বারা জিম্বু বারা, খুলে লাই খুলে লাই। হুড়ুম ধুরা হুড়ুম ধুরা। বিবেক লাই বিবেক লাই। সুর করে গাইছে অয়ন। মাথাটা দুলছে গানের তালে তালে। গানটা ভারি সুন্দর! একটা মিষ্টি তাল আছে।

অয়ন, এই অয়ন। তাকা তো আমার দিকে।

অয়ন চোখ মেলে বলল—মা, তুমি না খুব সুন্দর নাচতে জানো? তাহলে এই গানের সঙ্গে নাচছ না কেন?

অয়নের মা থমকে গেলেন। জীবনেও কখনো নাচেননি তিনি। কিন্তু সে কথা এখন না বলে তিনি মিষ্টি সুরে বললেন—ডাক্তার ধীমান তোকে আজ নিয়ে আসতে বলেছেন। কী যেন পরীক্ষা করবেন। সিটি স্ক্যান না কী যেন।

আমার অনেক অসুখ হয়েছিল মা। অয়ন আপন মনে বলে চলে—অনেক দিন না খেয়ে গুহার ভেতর পড়ে ছিলাম তো। খাওয়া ছিল না, পানি ছিল না। আমি প্রায় মরেই গিয়েছিলাম। জুজুমা আমাকে ঠিক সারিয়ে তুলেছিল। জুজুমা অনেক বড় ডাক্তার। অনেক তুকতাক জানে। অনেক রকমের চিকিৎসা জানে। জুজুমাই তো ছিল আমাদের গাঁয়ের ভরসা। আমাদের গুনিন। এইটুকু বলে অয়ন আবার চোখ বুজল।

নার্স এবার তাকে একটা ইনজেকশন দিল। অয়ন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। অয়নকে এবার সিটি স্ক্যান মেশিনের বিছানার সঙ্গে বেল্ট দিয়ে বেঁধে ফেলা হলো। মেশিনটা ধীরে ধীরে তাকে টেনে নিল ভেতরে। অয়নের সুন্দর মুখটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর তার মা বেরিয়ে এলেন ওই ঘর থেকে। কাচের জানালার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সন্তর্পণে। কে সেই জুজুমা? তাঁর অয়নের জীবন বাঁচিয়েছিলেন কয়েক শ বছর আগে? সৃষ্টিকর্তা তাঁর মঙ্গল করুন।

পাঁচ

স্যার, প্রফেসর জুলকারনাইন আর তাঁর সহকারী রহমত আলী—দুজনের সব রিপোর্ট আমি খুঁটিয়ে দেখেছি। চশমা ঠিক করতে করতে বলল জিনিয়া—কিছু অদ্ভুত মিল আছে দুজনের রিপোর্টে।

কী রকম? ডা. ধীমান মাথা তুললেন বই থেকে।

—তাদের রক্তে লিম্ফোসাইট আর মনোসাইট কাউন্ট অনেক বেড়ে গিয়েছিল। হয়তো কোনো ধরনের ভাইরাল ইনফেকশন হয়েছিল তাদের। আর সিটি স্ক্যান—হ্যাঁ। ওতে তাদের ফ্রন্টাল, প্যারাইটাল আর মিড ব্রেনে অস্বাভাবিক রকমের অ্যাট্রফি দেখা যায়। সালকাইগুলো বড় বড়, যেন পানিতে ভরা। আর জাইরিগুলো নিভাঁজ। প্রফাউন্ড ব্রেন ডিজেনারেশন। এটাই তাদের ডিমেনশিয়ার কারণ।

—ভাইরাস, ভাইরাস। এটা কি তবে জীবাণুবাহী রোগ? বিড়বিড় করতে লাগলেন ডাক্তার ধীমান। না হয় রহমত আলী আক্রান্ত হয়েছে তার স্যারের কাছ থেকে। কিন্তু অয়ন? অয়নের তো তাদের সঙ্গে পরিচয়ই নেই।

—স্যার, একটা কথা বলব?

—বলো।

—এটা কি আফ্রিকান স্লিপিং সিকনেসের মতো কিছু হতে পারে? অথবা কুরু ডিজিজের মতো কিছু? স্লো কোনো ভাইরাস ইনফেকশন? যা স্মৃতি ধ্বংস করে, মস্তিষ্কের কাজকর্ম উল্টোপাল্টা করে দেয়। ধীরে ধীরে ব্রেনের ক্ষয় করতে থাকে?

জিনিয়ার কথা শুনে টেবিলে খুলে রাখা জার্নালগুলো থেকে মুখ তুললেন ডাক্তার ধীমান। এই দুই দিন তিনি তন্নতন্ন করে খুঁজছেন স্মৃতি ধ্বংসকারী রোগগুলোর কোনো একটা নিশানা। ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ওপরে আছে। এর পর আছে হেভি মেটাল কোনো পয়জনিং, যাতে জুলকারনাইন আর তাঁর সহকারী আক্রান্ত হতে পারেন ওই পাহাড়ি এলাকায় থাকতে গিয়ে। হতে পারে ওখানকার খাবার বা পানি কোনো একটা খনিজে দূষিত হয়ে আছে, যা মস্তিষ্কের ক্ষতি করে। কিন্তু দুটো জট কিছুতেই খুলছে না। এক. অয়নের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পথটা। দুই. স্মৃতি ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে অন্য কারও স্মৃতি মাথার ভেতর ঢুকে পড়াটা।

ডাক্তার ধীমান এক দৃষ্টে ভিউবক্সে টানানো অয়নের সিটি স্ক্যানটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। একুশ বছরের এক তরতাজা যুবকের মস্তিষ্কে এমন ডিজেনারেশন কোনোক্রমেই স্বাভাবিক নয়। তার ওপর ডিজেনারেশনটা মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় বেশি। মিড ব্রেন ও থ্যালামাস এই দুটি অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু কেন? কীভাবে?

অয়নের রক্ত ল্যাবরেটরিতে পাঠাও। বললেন ডাক্তার ধীমান—সব ধরনের কালচার করবে। ট্রিপানোসোমাসহ। আর মেটাল অ্যানালাইসিসও করবে। কিছু যেন বাদ না পড়ে। বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে সব রিপোর্ট চাই।

ছয়

স্মৃতি কীভাবে সংরক্ষিত হয়?

মস্তিষ্ক কীভাবে ঠিক করে কোন স্মৃতিটি রাখবে আর কোনটা ফেলে দেবে?

কেন তিন বছর বয়সে ঘটে যাওয়া ছোট্ট একটা অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মনে থাকে কিন্তু আজ সকালে চাবিটা কোথায় রেখেছি, তা কিছুতেই মনে করা যায় না?

বিজ্ঞানীরা বলেন, স্মৃতি বা মেমোরি মস্তিষ্কের এক জটিল প্রক্রিয়া, যার আছে এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। এর কোনো কোনো অংশ চেতনার গভীরে প্রোথিত, তাকে খুঁড়ে বের করতে হয় না। যেমন একজন মানুষ কীভাবে খাবার তুলে মুখে দেয় বা বাথরুম লাগলে কী করতে হয়, তা কখনো শিখিয়ে দিতে হয় না। এই অভিজ্ঞতাগুলো তার অভ্যাস এবং মনের গভীরে সযত্নে সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে। কিন্তু কিছু কিছু অংশ দিনে দিনে পরিবর্তিত হয়। এরা বাড়ে-কমে। এরা আসে-যায়। যেমন কারও নিজের জীবনের স্মৃতি। সবটুকু হয়তো মনে থাকে না, আবার অনেক কিছুই মনে থাকে। কিছু কিছু আবার সময়ের সঙ্গে মুছেও যায়।

তবে আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি হলো সেমেনটিক মেমোরি। অর্থাৎ বিশ্ব সম্পর্কে আমার ধারণকৃত স্মৃতি বা ধারণা। চারপাশের দুনিয়াটা কী ও কেমন, এর মধ্যে একজন মানুষ হিসেবে আমার অবস্থানটা কোথায়—এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সন্নিহিত থাকে সেমেনটিক মেমোরির ভেতর। খুবই জটিল একটা নেটওয়ার্ক এটি। মস্তিষ্কের ঠিক কোন কোন অংশ এই সেমেনটিক মেমোরিকে ধারণ করে, তা আজও স্পষ্ট নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি মানুষের মস্তিষ্কের একটি স্বাধীন প্রক্রিয়া, যার যার মস্তিষ্ক যার যার মতো করে এটিকে সাজিয়ে নেয় ও লালন করে।

আমার প্রধান সমস্যা হচ্ছে যে আমার মস্তিষ্কে সেমেনটিক মেমোরির নেটওয়ার্কে কোনো গন্ডগোল হয়ে গেছে। কথা নেই বার্তা নেই, মুহূর্তের মধ্যে আমার চারপাশের দুনিয়া পাল্টে যাচ্ছে। অন্য কোনো সময়, অন্য কোনো দুনিয়া এসে দখল নিচ্ছে পুরো নেটওয়ার্কটাকে। আমি তখন একেবারেই অন্য কেউ হয়ে যাচ্ছি। আবার আমার নিজের দুনিয়াটাও একেবারে বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। তার মানে আমার ভেতর এখন বাস করছে দুজন মানুষ। দুটি বিশ্ব। দুটি সমাজ। দুইজন ব্যক্তিত্ব।

এই পর্যন্ত লিখে অয়ন থামল। ধীমান স্যার তাঁর নিজের সম্পর্কে নিজের ধারণাগুলো লিখে রাখতে বলেছেন। অয়ন এই লেখালেখির আগে ব্যাপক হোমওয়ার্ক করে নিয়েছে। এটা তার চিরকালের অভ্যাস। যেকোনো বিষয় নিয়ে আগ্রহভরে পড়াশোনা করা।

অয়ন লেখার ডায়েরিটা টেবিলের ওপর রেখে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। আকাশটা আজ অসাধারণ নীল। শরতের আকাশ। পানির মতো টলটলে পরিষ্কার। হাজার বছর কি শত বছর আগেও এই দেশে শরতের আকাশ এই রকম নীলই থাকত। এটি নিশ্চয় বদলে যায়নি। অয়ন নিশ্চিত যে ৪০০ বছর আগেও সে এই রকম এক শরতের সকালে টলটলে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিল।

অয়নের দ্বিতীয় সত্তাটির কোনো নাম নেই। কেননা ওই সমাজে নাম ব্যাপারটার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তবে ওকে রানি আয়ি বলে ডাকতেন। আয়ি হয়তো ‘এই’ শব্দটার কোনো আদি রূপ। মাকে জিজ্ঞেস করলে হতো। মা তো ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক। কিন্তু ধীমান স্যার কারও মতামত না নিয়ে স্বাধীনভাবে লিখতে বলেছেন, যাতে এই চিন্তাগুলো কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়। যা-ই হোক, অয়ন নিশ্চিত যে আয়িও এ রকম আকাশ দেখতে ভালোবাসত। ওদের সুকুমারবৃত্তিগুলো কেমন ধরনের ছিল, সে সম্পর্কে এখনো ধারণা করতে পারছে না অয়ন। কিন্তু সে নিজে ছবি এঁকেছে। একটা গুহার স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে খড়ি আর বাকলের রং দিয়ে ছবি আঁকত সে। কখনো দাঁতঅলা শূকরের ছবি, কখনো পাথর কেটে তৈরি করা অস্ত্রের ছবি। ইদানীং অয়ন নিজের সত্তাগুলোকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে। এটা করতে তাকে সাহাঘ্য করছে ধীমান স্যারের সহকারী জিনিয়া। জিনিয়া তাঁকে নিয়মিত মেডিটেশন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে সাহাঘ্য করে। সে কারণে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর প্রাণপণ চেষ্টা করে কিছু জিনিস সে আবার মনে করতে পারে। যেমন একদিন সে ঘুম ভেঙে উঠেই হাতে তুলে নিল আর্টপেপার আর একটা সাইনপেন। তারপর খসখস করে একটা ছবি এঁকে ফেলল। ছবিটা একজন নারীর, যে কিনা একটা মৃত শূকরের শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটা দেখে রিমি রীতিমতো উত্তেজিত। অ্যানশিয়েন্ট আর্ট! মাই গড, অয়ন তুমি এটা কী এঁকেছ? এটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে। এত প্রাচীন কোনো চিত্রকলার নিদর্শন আমাদের আছে বলে আমার জানা নেই।

অয়ন ক্লান্ত গলায় বলেছিল, হ্যাঁ। আমি তো ছবি আঁকতাম। আমার একটা গোপন গুহা ছিল। তার খবর আমি আর রানি ছাড়া আর কেউ জানত না।

রিমি ওর পাশে বসে নরম গলায় বলল—তোমার কি অনেক কষ্ট হয়, অয়ন? এই যে তুমি দুই জায়গায় ঘুরে বেড়াও? তোমার নিশ্চয় এটা ভালো লাগে না?

অয়ন জানালাটা বন্ধ করে দিল। আকাশের কোনে মেঘ জমেছে। মেঘ আর ঝড়কে সে ভয় পায়। কেননা এমনই এক ঝড়ের রাতে সে সবকিছু হারিয়েছিল। আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নেমেছিল সেদিন। আর পাহাড় থেকে নেমে এসেছিল জলের দানব। ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সবকিছু। তার ঘর, রানি, তার গোপন গুহা। তার বন, যাকে সে ভালোবাসত। সবকিছু চাপা পড়ে গিয়েছিল বিস্মৃতির অতলে। অয়ন কি সেই বিস্মৃতির জঞ্জাল সরিয়ে তাকে আবার উদ্ধার করতে পারবে?

সাত

অয়নের সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে প্রোটিনের উপস্থিতি বিস্ময়করভাবে বেশি। কিন্তু তাতে সংক্রমণের কোনো লক্ষণ নেই। সাধারণত মস্তিষ্ক বা এর আবরণীতে সংক্রমণ হলেই সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে প্রোটিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ডাক্তার ধীমান এই প্রোটিনকে অ্যানালাইসিস করতে দিয়েছেন।

ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে তিনি এবার অয়নের ইইজি রিপোর্টটাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করলেন। একটা ট্রাই ফেজিক অস্বাভাবিক ডিসচার্জ মাঝে মাঝে দেখা যায়। বাকি সব সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কখনো কখনো প্রায়োন ডিজিজে এমনটা হতে দেখা যায়।

মানুষের মস্তিষ্কে প্রায়োন প্রোটিনের কাজটা যে কী, তা এখনো এক রহস্য। তবে এই প্রোটিন নিউরনের গায়ে আঠার মতো লেগে থাকে এবং নির্দিষ্ট রিসেপটরের সঙ্গে জোট বেঁধে সিনাপসিসগুলোতে কোনো একটা প্রভাব বিস্তার করে। প্রায়োন প্রোটিনের গঠনকে এনকোড করার জন্য মানুষের ২০ নম্বর ক্রোমোজোমে আছে ডিএনএ এনকোডিং পদ্ধতি। এই ক্রোমোজোমে কোনো কারণে মিউটেশন হলে অস্বাভাবিক প্রায়োন প্রোটিন তৈরি হবে, যা মস্তিষ্কের অনেক স্বাভাবিক কাজকে অস্বাভাবিক করে তুলতে পারে।

ঘরের দরজা ঠেলে জিনিয়া ঢুকল—স্যার। রিপোর্টগুলো পেয়েছি।

ডাক্তার ধীমান মুখ তুলে তাকালেন। জিনিয়া বলল—কোনো রকমের ইনফেকশন নেই। সব রকমের জানা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও প্যারাসাইট কালচার করা হয়েছে। আফ্রিকান স্লিপিং সিকনেসের জন্য দায়ী যে ট্রিপানোসোমা, সেটাও দেখা হয়েছে। ওগুলো সব নেগেটিভ।

—জিনিয়া—ধীরে ধীরে মুখ খুললেন ডাক্তার ধীমান—কেন যেন আমার মনে হয় প্রফেসর জুলকারনাইন ও তঁর সহকারী রহমত আলীর সঙ্গে অয়নের রোগটার একটা যোগসূত্র আছে। কিন্তু সেটা যে কী, তা কিছুতেই ধরতে পারছি না।

জিনিয়া বলল—আপাতদৃষ্টে একমাত্র যোগসূত্রটা হলো অয়নের ছোটবেলার বন্ধু রিমি। রিমি জুলকারনাইনের সঙ্গে প্রজেক্টে কাজ করেছে। কিন্তু রিমি নিজে আক্রান্ত না হয়ে কী করে অয়নকে আক্রান্ত করল? সংক্রমণে একটা চেইন তো লাগবে?

ডাক্তার ধীমান রিভলবিং চেয়ারে হেলান দিয়ে দোল খেলেন। তারপর বললেন—তুমি কী করে নিশ্চিত হলে যে রিমি নামের মেয়েটা কোনো কিছুতেই আক্রান্ত হয়নি? আমরা তো তাকে পরীক্ষা করিনি?

জিনিয়ার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল—এমনও তো হতে পারে স্যার যে রিমি আক্রান্ত হলেও তার মধ্যে রোগটা প্রকাশ পায়নি। কোনোভাবে তার ইমিউন সিস্টেম একে মোকাবিলা করে ফেলেছে?

হুম্। ডাক্তার ধীমান ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করতে লাগলেন। রিমি হচ্ছে সেই হারিয়ে যাওয়া যোগসূত্র। ঠোঁট কামড়ানো শেষ করে তিনি বললেন—আমরা কখনো তার সঙ্গে কথা বলিনি কেন? জিনিয়া, তুমি রিমিকে আসতে বলো। জাস্ট ফর আ চেকআপ।

ওকে স্যার। বলে জিনিয়া বেরিয়ে যেতে যেতে একটু থেমে দাঁড়ায়—স্যার। সিএসএফের প্রোটিন অ্যানালাইসিসও করা হয়েছে। এটা একধরনের সিক্সটিন থ্রি থ্রি প্রোটিন। নরমাল প্রায়োনের চেয়ে এর গঠন একটু অস্বাভাবিক। ২১ নম্বর পজিশনে লাইসিনের জায়গায় গ্লুটামিক অ্যাসিড। এইটকুই পার্থক্য। 

—ওয়েল ডান। ডাক্তার ধীমান আবার দোল খেতে শুরু করলেন—আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। হি হ্যাজ বিন অ্যাফেক্টেড বাই সাম কাইন্ড অব স্লো প্রায়োন ডিজিজ। কিন্তু কীভাবে? এটা এক নম্বর প্রশ্ন। আর দুই নম্বর এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, এখানে দ্বৈত সত্তার আবির্ভাব ঘটল কেন? বাকিটা কি তবে কোনো মানসিক রোগ? অয়নের ফ্যান্টাসি?

আট

একটা গোটা জনপদ, একটা গোটা সম্প্রদায় হারিয়ে গেল।

সেই সঙ্গে হারিয়ে গেল তাদের গান, তাদের ভাষা, তাদের ছবি, তাদের ভালোবাসা।

হারিয়ে গেল কত কত গল্প। কত কাহিনি।

কিন্তু এমনটা যে হতে পারে, তা তাদের গুনিন জুজুমা আগেই বলেছিল। বলেছিল যে অচিরেই তারা ধ্বংস হবে আর সেই সঙ্গে ধ্বংস হবে তাদের স্মৃতি। কেননা বাইরের মানুষকে নিজেদের সমাজে থাকতে দিয়ে তারা মহাপাপ করেছে আর এই পাপের শাস্তি দেবতা হুড়ুম্বা দেবেনই।

তাহলে তোমাদেরও দেবতা ছিল! হুড়ুম্বা? তোমরা নিশ্চয় পুজোর সময় নাচ-গান করতে? কেমন ছিল সেই গান? রিমি কাগজ-কলম আর টেপরেকর্ডার নিয়ে তৈরিই থাকে। কেননা কখন যে অয়ন কথা বলতে শুরু করবে আর কখনই বা থেমে যাবে তা বোঝা মুশকিল। একটা গোটা সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের সংকট অয়ন এখন বহন করে চলেছে একা। হারিয়ে যাওয়া এই সম্প্রদায় যেন ওকে ভর দিয়ে আবার বেঁচে উঠতে চাইছে।

কিন্তু অয়ন রিমির প্রশ্নের উত্তর দিল না।

প্রবল বৃষ্টিপাতের আগের দিন নাকে গয়না পরা রানি যখন গাঁয়ে বেড়াতে যাচ্ছিলেন, তখন সে তাঁকে নিষেধ করেছিল যেতে। রানি হেসেছিলেন কেবল, কোনো কথা বলেননি। হ্যাঁ, রানি তাকে ভালোবাসতেন, যেমনটা তার মা তাকে ভালোবেসেছিল একদিন। রানি তাকে প্রায়ই কোলে তুলে নিতেন, চুমু খেতেন আর তার মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতেন। তাকে কোলের ওপর বসিয়ে বেদানা ভেঙে খাওয়াতেন। বেদানার রসে ঠোঁট আর গাল রাঙিয়ে দিতেন রানি। কিন্তু রানি তার নিষেধে কর্ণপাত করেননি। রানি খুব সাহসী ছিলেন। সাহসী আর একগুঁয়ে।

রিমি মনোযোগ দিয়ে শোনে। মনে হচ্ছে বাইরে থেকে আসা রানি এই সম্প্রদায়ের প্রধান ক্ষমতাধর নারী জুজুমা গুনিনের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছিলেন। আশ্চর্য, সেই সমাজেও তাহলে হিংসা ছিল, ছিল ক্ষমতার কাড়াকাড়ি, মসনদের যুদ্ধ!

তুমি এখন চলে যাও—অয়ন ক্লান্ত স্বরে বলল—আমার ঘুম পাচ্ছে এখন। আমার কেবলই ঘুম পায়। কেন যে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারি না!

অয়ন ঘুমিয়ে পড়লে রিমি ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এবার তাকে যেতে হবে ডাক্তার ধীমানের কাছে। তিনি জরুরি তলব করেছেন রিমিকে। অয়নের কেসটা নিয়ে বিরাট বিপদে পড়েছেন ডাক্তার ধীমান। কিছুতেই কূলকিনারা করতে পারছেন না বিষয়টার। এটা তাঁর আত্মবিশ্বাসে রীতিমতো চিড় ধরিয়ে দিয়েছে।

ডাক্তার ধীমানের অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ডাক্তার ও তাঁর সহকারী ওর জন্যই অপেক্ষা করে ছিলেন।

তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে রিমি—ডাক্তার বললেন—কিছু খাবে?

রিমি টের পেল যে সত্যি তার খুব খিদে পেয়েছে। ডাক্তার তিনজনের জন্য স্যান্ডউইচ আর কফি আনতে দিলেন। তারপর রিমির দিকে তাকিয়ে বললেন—কিছু কথা জিগ্যেস করতে তোমাকে ডেকে এনেছি রিমি। আমাদের একটু সাহাঘ্য করবে?

নিশ্চয়ই। রিমি মাথা দোলায়।

প্রফেসর জুলকারনাইনের সঙ্গে তুমি কত দিন কাজ করেছ?

উম্...প্রথমবার সাত দিন। তারপর ১১ দিন। তারপর আমার শরীরটা খারাপ হয়ে যাওয়ায়—

শরীর খারাপ?—মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিলেন ডাক্তার—শরীর খারাপ মানে? কী হয়েছিল?

জ্বর স্যার। আমার প্রবল জ্বর হলো একদিন। টেম্পারেচার ১০৪ ছাড়িয়ে গেল। আমি ভুল বকতে শুরু করলাম। স্যার ভয় পেয়ে আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন।

আই সি—ডাক্তার ধীমান আবার ঠোঁট কামড়াতে শুরু করলেন। তারপর? জ্বর সেরে গেল?

রিমি কাঁধ থেকে ব্যাগটা এবার টেবিলে রাখে—বেশ কিছুদিন ভুগেছি স্যার। প্রায় দিন পনেরো। শুধু থেকে থেকে জ্বর। কাশি নেই কিচ্ছু নেই। তবে একটা অদ্ভুত জিনিস ছিল।

ডাক্তার নড়েচড়ে বসলেন—কী?

আমার তখন শুধু কান্না পেত। ডিপ্রেশনের মতো হয়েছিল। কথা নেই বার্তা নেই, হাপুস নয়নে কাঁদতে বসতাম। সেই সময় আমার বন্ধু অয়ন আমাকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছে।

কী রকম?—এবার প্রশ্নটা জিনিয়ার।

এর মধ্যে স্যান্ডউইচ আর কফি এসে গেছে। রিমির খুব খিদে পেয়েছিল। সে খেতে শুরু করে দিল। অদ্ভুত ব্যাপার, সে দুই হাত দিয়ে খাবারটা ধরে মুখের কাছে না এনে বরং মুখটা নামিয়ে আনল প্লেটের ওপর। তারপর কামড়ে কামড়ে খেতে লাগল। ডাক্তার ধীমান সেদিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতে লাগলেন। প্রিমিটিভ আচরণ। খুবই প্রিমিটিভ আচরণ। কী আশ্চর্য!

রিমি খাওয়া শেষ করে মুখ মুছে হাসল। তারপর বিব্রত স্বরে বলল—খুব খিদে পেয়েছিল। ধন্যবাদ স্যার। ও, তারপর যা বলছিলাম—

—অয়ন তোমাকে কি সাহাঘ্য করেছিল?

—অয়ন আমাকে প্রায়ই দেখতে আসত। আমাকে নানা গল্প বলে হাসাতে চাইত। কখনো খাবারদাবার নিয়ে আসত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, একদিন সে একটা মাটির পাত্রে বৃষ্টির পানি জমিয়ে এনে বলল, এটা খাও। বৃষ্টির পানি খেলে ভালো হয়ে যাবে। আমি খেলাম।

—তারপর আপনি ভালো হয়ে গেলেন?—এবার কথা বলল জিনিয়া।

—আশ্চর্যের ব্যাপার, জ্বর আর আসেনি।

ডাক্তার ধীমান আরও দ্বিধান্বিত বোধ করতে লাগলেন। মেয়েটা কি গল্প বানাচ্ছে? এই দুই বন্ধু কি ক্রমাগত ফ্যান্টাসি তৈরি করে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে? নাকি তারা এক ধরনের ইলিউশনে ভুগছে?

—রিমি-জিনিয়া ঠান্ডা গলায় বলল এবার—আমরা যদি আপনার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি, তবে আপনি কি রাজি হবেন?

পরীক্ষা? আমাকে?—রিমি হেসে ফেলল—কেন? যদি লাগে নিশ্চয় করবেন।

দু-একটি রক্ত পরীক্ষা। আর প্রয়োজনে একটা সিএসএফ স্টাডি আর একটা সিটি স্ক্যান।

রিমি মাথা ঝাঁকাল—ওকে। নো প্রবলেম। গো অ্যাহেড।

রিমির পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হতে রাত হয়ে গেল। জিনিয়া তাই তার স্কুটারে রিমিকে পৌঁছে দিতে গেল বাসায়। বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আবারও ধন্যবাদ জানাল সাহাঘ্য করার জন্য। স্কুটার স্টার্ট দিয়ে ঘোরার সময় হঠাৎ রিমি কী যেন মনে পড়তে ডাকল জিনিয়াকে—ড. জিনিয়া, একটা কথা বলা হয়নি। জৈন্তা প্রজেক্ট থেকে আমি কিছু নিদর্শন ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম। তেমন কিছু না। গুহাচিত্রের কিছু ভাঙা টুকরা। মাটির দলা। দুটি ভাঙা তৈজসপত্রের টুকরা। ওগুলো অয়ন দেখতে নিয়ে যায়। আন্টির কাছে শুনেছি, সে নাকি ওগুলো বালিশের পাশে রেখে ঘুমোত।

জিনিয়া থমকে গেল। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল—ওগুলো এখন কোথায়?

অয়নের কাছেই রয়ে গেছে।

জিনিয়া স্কুটার ঘুরিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল।

নয়

মানুষের মস্তিষ্ক পৃথিবীর জটিলতম কম্পিউটার। এর নেটওয়ার্ক বিশাল এবং ডেনড্রাইটের সুড়ঙ্গ অন্তর্জাল দিয়ে এর তথ্যগত আদান-প্রদানের কাজ চলে। তথ্য সরবরাহের বিন্দুগুলো হচ্ছে সিনাপস, যেখানে এই সিস্টেমকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আছে অনেক রকমের নিউরোট্রান্সমিটার। এই কম্পিউটার এমনই নিখুঁত আর এতই এক্সপার্ট যে হাজার হাজার সিনাপসে হাজার হাজার তথ্য সরবরাহের কাজে কখনো সামান্যতম ভুল তথ্যও পাচার হয়ে যায় না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার ক্ষেত্রে তা-ই ঘটছে। যেন ইচ্ছে করে আমার ব্রেনের সিনাপসগুলো নানা রকম ভুল তথ্য এদিক-ওদিক পাঠিয়ে দিচ্ছে। যখন ঘুমোনোর কথা নয়, তখন আমি ঘুমিয়ে পড়ছি। যখন যা বলার কথা নয়, তা-ই বলছি। যা আমার ভাবার কথা নয়, তা-ই ভাবছি। সবচেয়ে বড় কথা, যা আমার জীবনে নেই, তাও আমার স্মৃতিতে জমা হচ্ছে।

সিনাপসগুলো থেকে এসব মারাত্মক ভুল তথ্য সরবরাহের জন্য তবে কাকে দায়ী করা যায়? নিউরোট্রান্সমিটারকে? নাকি যে তথ্যগুলো পরিবেশন করেছে সেই নিউরনকে? কিন্তু নিখুঁতভাবে সন্নিবেশিত নিউরনগুলো অকারণে ভুল করবে কেন? আর বারবারই বা কেন করবে? গোলমালটা কোথায়?

ল্যাপটপের স্ক্রিনে এটুকু লিখে অয়নের মাথা ধরে গেল। ঝুমুর বাজার মতো শব্দ হচ্ছে মাথার ভেতর। আর ভেসে আসছে তীব্র বুনোফুলের ঘ্রাণ। হলুদ রঙের সেই ফুল কানের পাশে গুঁজে জুজুমা নাচতে শুরু করে। দিরিম দিরিম কারোকা, দিরিম দিরিম কারোকা...। কারা যেন গান গাইতে শুরু করে। অপরিচিত বুনো ভাষার গান হলেও বুঝতে মোটেই অসুবিধে হচ্ছে না অয়নের। এই বন আমার, তাই বনকে ভালোবাসি। এই হাওয়া আমার, তাই হাওয়া ভালোবাসি। ভারি চমৎকার সুরটা। কিন্তু এই উৎসবের মধ্যে রানি চেঁচাচ্ছেন। বিপদ আসন্ন। জল আসছে। এখন নাচ-গানের সময় নয়, প্রাণে বাঁচতে হবে। হয় জনপদ ছাড়তে হবে। নয়তো সবাই মিলে ঝরনার মুখে বাঁধ দিতে হবে। কিন্তু তারা শূকরের মাংস আর ফুলের মধু খেয়ে মাতালপ্রায়। মেয়েরা পায়ে বেঁধে নিয়েছে শুকনো পাতার তৈরি ঘুঙুর। ঝুম ঝুম শব্দে তাল ঠুকছে অন্যরা। কে শোনে কার কথা!

যা খুশি হোক গে, অয়ন ল্যাপটপের টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। ওর ঘুম ভাঙল ডাকাডাকিতে।

অয়ন, অয়ন। ওঠ, বাবা। খাবি না?

অয়ন জেগে উঠে কিছু বুঝতে পারে না। জলের তোড়ে সে যে ভেসে যাচ্ছে। গান শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাই জলের দানব আসার পরও বুঝতে পারেনি। ওদিকে রানির হাত-পা বাঁধা। সবাই দৌড়ে পালাচ্ছে। সে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে রানির কাছে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু জলদানবের শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠে না। ওর পাশ দিয়ে দু-দুটো বিশাল গাছ ভেসে চলে যায়। তারও পর ভেসে যেতে থাকে দুটি মরা হরিণ। অয়ন খপ করে রানির হাতটা ধরে ফেলতে পারে অবশেষে।

আরে, ছেড়ে দে হাতটা। অয়ন, খামচে ধরেছিস কেন? ছাড় তো দেখি!

অয়ন তার মাকে চিনতে পারে না। তার নাক মুখ দিয়ে পানি ঢুকছে। পেট ফুলে উঠছে পানিতে। দম বন্ধ হয়ে আসছে অয়নের। তবু সে রানির হাত ছাড়ে না।

অয়নকে জোরে জোরে শ্বাস নিতে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলেন ওর মা। মনে হচ্ছে যেন খাবি খাচ্ছে ছেলেটা। ডাক্তার ধীমানকে এক্ষুনি ফোন করা দরকার। নাকি অ্যাম্বুলেন্স ডাকবেন? হাসপাতালে নিয়ে যাবেন এখনই? অয়নের মা দিশেহারা হয়ে পড়লেন।

ডাক্তার ধীমান তখন ল্যাবরেটরিতে জিনিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

জিনিয়া বলছিল—রিমির সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডেও প্রোটিন অনেক বেশি স্যার। আর সেই একই অ্যাবনরমাল প্রোটিন—সিক্সটিন থ্রি থ্রি।

ডাক্তার ধীমান ঠোঁট কামড়াতে শুরু করলেন। কে পাল্টে দিল প্রোটিনের গঠন নির্দেশ করার কোড? ভাইরাস? কোত্থেকে এসেছে এই ভাইরাস? জৈন্তার প্রাচীন নিদর্শন থেকে? গুহা থেকে? ঝরনার জল থেকে?

এই সময় তাঁর সেলফোন বেজে উঠল। অয়নের মায়ের ফোন। অয়ন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সর্বনাশ!

 দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে বললেন তিনি। অয়নের কিছু হতে দেওয়া যাবে না। অয়নের সঙ্গে তাহলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই আজব ভাইরাস বা আজব রোগ বা অমীমাংসিত এক রহস্য। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তা তিনি মেনে নিতে পারেন না। এই রহস্য তাঁকে উন্মোচন করতেই হবে।

ডাক্তার ধীমান কোটটি গয়ে চাপাতে চাপাতে বলেন—দুটো আলাদা মিডিয়ায় অয়ন আর রিমির সিএসএফ কালচার করো। নরমাল নিউরনের সেল মেমব্রেনের রিসপেটরের ওপর এর প্রভাবটা দেখো। স্টেপ বাই স্টেপ সব পর্যবেক্ষণ করো। আমি এখনই আসছি।

অলংকরণ: তুলি

দশ

মিনিটে প্রায় হাজারবার রিভোলিউশন করে ল্যাবরেটরির সেন্ট্রিফিউজ মেশিনটি। এর ফলে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডের শ্বেতকণা, লিম্ফোসাইট, মনোসাইটগুলো থিতিয়ে পড়ে টেস্টটিউবের তলায় আর কথিত ভাইরাসগুলো মনের আনন্দে ভাসতে থাকে দ্রবণের ওপর। এরপর ওপরের ভাইরাস দ্রবণটিকে আবার সেন্ট্রিফিউজ করতে হবে—এবার মিনিটে লাখবার। তারপর ঘনীভূত দ্রবণটিকে জীবাণুমুক্ত টেস্টটিউবে ঢেলে সাবধানে মেশাতে হবে অনুঘটক বা এনজাইম। এই মেশানোর কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য তারতম্যে ঘটে যেতে পারে মহা ভুল। ভুল করে করেই কাজটা বেশ কয়েকবার করতে হলো জিনিয়াকে। প্রতিবার ভুলের পর ভাইরাসটার গুষ্টিসুদ্ধ গালাগাল করল সে। বদমাশটা হাতের নাগালে আসি আসি করেও আসছে না। বড্ড জ্বালাচ্ছে।

বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় শেষ অবধি একটা চমৎকার প্রাইমার তৈরি করা সম্ভব হলো। এবার যোগ করতে হবে বেটিং ডিভাইস, যা ভাইরাসগুলোর জন্য একটা টোপ হিসেবে কাজ করবে। এই টোপ গিলে তারা খুশিতে দামাল হয়ে উঠবে এবং দ্রুত বিভাজিত হতে শুরু করবে। দ্রবণে মেশানো রেডিও অ্যাকটিভ পদার্থ উন্মোচন করে দেবে তখন তার সব জারিজুরি।

ইনকিউবেটর চলল এক ঘণ্টা ধরে। ২০০ ডিগ্রি তাপে গরম করে পেট্রিডিশে ঢেলে দিল দ্রবণটাকে জিনিয়া। তারপর ডিজিটাল কাউন্টার লাগানো ইলেকট্রনিক মেশিনে সাবধানে রেখে দিল পেট্রিডিশগুলো। অপারেশন শেষ। এবার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা। ডিজিটাল মেশিনের বিশাল সবুজ স্ক্রিনে যদি তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে ফুটে ওঠে, তবে নিশ্চিত হবে যে এই ফ্লুইডে এক বিশেষ ধরনের ভাইরাস বিদ্যমান। কিন্তু তার জন্য সময় দিতে হবে ওকে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না আবারও দেখে-শুনে ল্যাবরেটরির আলো নিভিয়ে দিল জিনিয়া। তারপর ভারী স্টিলের দরজা টেনে দিল বাইরে থেকে। ওদিকে অয়নের অবস্থা কী কে জানে! নিজের কাজে এতই মগ্ন হয়েছিল জিনিয়া যে অয়নের কথা একবারও মনে পড়েনি। কিন্তু হঠাৎ এত ক্লান্তি পেয়ে বসল ওকে যে আর হাসপাতালের দিকে যেতে ইচ্ছে করল না ওর। পা দুটো তাকে টেনে নিয়ে গেল নিচে। পার্কিংয়ে রাখা স্কুটারটাতে উঠে কোনোমতে স্টার্ট দিল জিনিয়া। ভীষণ ঘুম পেয়ে যাচ্ছে তার।

সকালবেলা জিনিয়ার ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। ওহ মাই গড, স্যারের প্রায় বিশটা কল লিস্টে উঠে আছে। কী আশ্চর্য, সে কি এমনই গভীর ঘুম ঘুমিয়েছে যে কিছু শুনতে পায়নি? তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করল সে—স্যার। সরি স্যার, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। শুনতে পাইনি।

ডাক্তার ধীমান একটু বিরক্তই হলেন। বেশ চটপটে ছিল তাঁর এই ছাত্রীটি। ইদানীং একটু অমনোযোগী আর আলসে হয়ে উঠছে। এখন বাজে সকাল ১০টা আর এখনো নাকি পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন—ঠিক আছে। টেক ইওর টাইম। ফ্রেশ হয়ে হাসপাতালে এসো।

—অয়ন কেমন আছে স্যার?

—আগের মতোই। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম। হয়তো ভেন্টিলেটর লাগবে। আপাতত আইপিপিভি দেওয়া আছে। তুমি একবার দেখে যেয়ো। বাই দ্য ওয়ে, ভাইরাস আইসোলেশনের রেজাল্টটা দেখে আমাকে জানিয়ো।

জিনিয়া অনেকক্ষণ ধরে গোসল করল। ক্লান্তিটা ধুয়ে ফেলে পোশাক পরে বেরিয়ে এসে স্কুটারে উঠল সে। তার বাসা থেকে ল্যাবরেটরি মিনিট দশেকের পথ। পার্কিংয়ে স্কুটারটা রেখে শিস দিতে দিতে ওপরে উঠে এল সে। স্যার রেজাল্টটা জানাতে বলেছেন। আইডি কার্ড পাঞ্চ করে সুরক্ষিত ল্যাবরেটরির ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সে। কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভাসছে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা। ১১ হাজার হার্টজ! চোখ দুটো প্রায় বিস্ফারিত হয়ে গেল তার। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া গেছে বলে নয়। বরং এই যন্ত্রে আসলে সে কী বসিয়েছিল, তা এখন আর মনে করতে পারছে না বলে। বিহ্বল হয়ে একটা টুলে ধপ করে বসে পড়ল সে। কী ভয়ংকর, কী ভয়ংকর। কিছুই যে মনে পড়ছে না। এটা আসলে কিসের রেজাল্ট? স্যার আসলে কী করতে বলেছিলেন?

ডাক্তার ধীমান চিন্তিত মুখে তাঁর প্রিয় ছাত্রীটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটা প্রবল অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর। পুরো ব্যাপারটা জিনিয়া ভুলে গেল কী করে! সে কি একটু ওভারস্ট্রেসড? ইদানীং কি ওকে বেশি কাজের চাপ দেওয়া হচ্ছে? তিনি ধীরে ধীরে বললেন, তুমি দুটো আলাদা পেট্রিডিশে অয়ন আর রিমির সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড প্রাইমার করেছিলে। ভাইরাস আইসোলেশন দেখার জন্য রেডিও অ্যাকটিভ ম্যাটার যোগ করেছ। দুটো ডিশই উচ্চ মাত্রার রেডিও অ্যাকটিভিটি শো করছে। তার মানে এতে এক বিশেষ ধরনের ভাইরাস আছে। বেশ তীব্র মাত্রায়ই আছে। আর এটা একধরনের আরএনএ ভাইরাস। যে ভাইরাস কিনা আক্রমণ করতে ভালোবাসে মানুষের মস্তিষ্কের আবরণীর নিচে ও ভাঁজগুলোর মধ্যে যে তরল সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড থাকে, তাকে। হয়তো এই ফ্লুইডের মাধ্যমেই পুরো ব্রেনের বিভিন্ন এলাকায় সে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর উল্টোপাল্টা করে দেয় সবকিছু।

জিনিয়া মুখ নিচু করে আছে। হ্যাঁ, মনে পড়ছে তার। কাল গভীর রাত পর্যন্ত সে তো এই কাজই করেছে। আর সকাল হতেই ভুলে গেল! স্ট্রেঞ্জ! ওর বিপন্ন মুখ দেখে মায়া হলো ডাক্তার ধীমানের। তিনি একটু হাসলেন—ইউ হ্যাভ ডান আ গ্রেট জব। কনগ্র্যাচুলেশন মাই চাইল্ড। তুমি বরং দুই দিন ছুটি নিয়ে বিশ্রাম নাও।

জিনিয়া মাথা নাড়ল—না, স্যার। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি। এক. যদি কোনো অ্যান্টিবডি তৈরি করা যায়, তবে অয়নকে বাঁচানো যাবে। আমাদের সেই চেষ্টা করতে হবে। আর দুই, স্যার, আমি বুঝতে পারছি না ভাইরাসটা একজনের মেমোরি কীভাবে অন্য একজনের মস্তিষ্কে ট্রান্সফার করে?        

ইয়েস—ডাক্তার ধীমান মাথা নাড়লেন—এটা একটা আশ্চর্য ক্ষমতা। তবে আরও কত আশ্চর্য জিনিস হয়তো অপেক্ষা করে আছে সামনে। জিনিয়া ভুলে যেয়ো না, আরএনএ ভাইরাসের আছে একধরনের আজব অস্ত্র-রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ এনজাইম। এই এনজাইমের সাহাঘ্যে সে হোস্টের কোষের ভেতর বসে ডিএনএ কপি তৈরি করতে পারে। এটা একটা এরর-প্রোন প্রসেস। অর্থাৎ এই ডিএনএ কপি তৈরি করার সময় অনেক ভুল-ভাল এনকোডিং হয়। ভাইরাস তার নিজের ডিএনএর অনেক উপাদান হোস্টের কোষের ডিএনএতে মিশিয়ে দেয়। আর জানোই তো, ডিএনএ হচ্ছে হেরেডিটি বা বংশগতির প্রধান বাহক। হয়তো সে তার নিজের ডিএনএতে বহন করে এনেছে আরেক হোস্টের জেনেটিক ম্যাটেরিয়ালকে, যে হয়তো সংক্রমিত হয়েছিল ৪০০ বছর আগে। নতুন হোস্টের মস্তিষ্কের ভেতর বসে সে সেই বহন করে আনা জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল এনকোড করে দিয়েছে ব্রেন সেলের নিউক্লিয়াসে।

জিনিয়া এবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে। স্যারের ধারণাগুলো লিখে রাখতে হবে। গতকাল পুরো প্রক্রিয়াটি লিখে না রেখে চরম ভুল করেছে সে। বিজ্ঞান এ ধরনের ভুল বরদাশত করবে না। বেশ, তবে আমাদের হাইপোথিসিস হলো যে সাড়ে চার শ বছরের পুরোনো ডিএনএ বহনকারী ভাইরাস নতুন করে অন্য কাউকে আক্রমণ করে নিজের জাল বিস্তার করতে শুরু করেছে। সে অল্প অল্প করে নতুন হোস্টের নিউরনে মেশাচ্ছে পুরোনো জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল। আর তাতেই প্রাচীন সেই হোস্টের যাবতীয় স্মৃতি আর চেতনা আক্রান্ত করছে নতুন হোস্টকে। এটুকু লিখে নিজের কাছেই হাস্যকর মনে হলো হাইপোথিসিসটা। ৪০০ বছর ধরে ভাইরাসটা কোনো হোস্ট ছাড়াই বেঁচে ছিল! কেউ বিশ্বাস করবে এসব গাঁজাখুরি গল্প? কিন্তু বিশ্বাস না করেই বা উপায় কী!

কিছু থিওরির কাজ করে জিনিয়া শেষে গেল অয়নকে দেখতে। আইসিইউয়ের কাচের দরজার এপার থেকে অয়নের ঘুমন্ত মুখটা দেখে খারাপ লাগতে থাকল তার। ছেলেটা জানে না তার নিউরনে নিউরনে বিষ ছড়াচ্ছে নাম না জানা এক প্রাচীন ভাইরাস। ওই আশ্চর্য প্রাণীটা ৪০০ বছর ধরে পুষে রেখেছে নিজের শরীরে এক আদি বালকের মানসচেতনা। অয়নকে দেখতে দেখতে একটা আশ্চর্য প্রশ্ন উদয় হলো জিনিয়ার মনে—প্রাণ, আসলে কী? একটা চেতনা মাত্র? বুকের ধুকপুকানি নয়, শ্বাসের ওঠানামা নয়, প্রাণ কি তবে বাস করে মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর? নিউরন আর সিনাপস আর নিউরোট্রান্সমিটারের জলকেলিতে?

অলংকরণ: তুলি

এগারো

এক পাল বুনো কালো হিংস্র মানুষের কাছে আমাকে ফেলে পালিয়ে গেলেন রাজা। রাজ্য জয় করতে করতে রাজা ভেবেছিলেন, এ জীবনে আর পরাজিত হবেন না। কিন্তু এই জংলি লোকগুলো বল্লম আর তির দিয়ে তাঁর দলবলকে রুখে দিল। লোকগুলোর তাড়া খেয়ে দলবল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমার কথা কেউ ভাবলই না। হয়তো তারা ভেবেছিল, আমি মারাই গিয়েছি অথবা ধরা পড়ে গেছি ওদের হাতে। কিন্তু আমি আসলে মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম জঙ্গলের ভেতর, একটা বড় লতাপাতায় ঢাকা গুহার পাশে। তিন দিন দিনরাত না খেয়ে ওখানেই ঘাপটি মেরে ছিলাম আমি। ওরা আমায় খুঁজে পায়নি। আশ্চর্য, বুনো শূকর আর গেছো বাঘও আমায় কিছু করেনি। চার দিনের দিন প্রবল বৃষ্টি এল। বৃষ্টিতে জঙ্গল সয়লাব। একটু পানি গলায় যেতে আমার জ্ঞান ফিরে এল। জ্ঞান ফিরেই শুনতে পেলাম শিশুটির গলা। কী এক দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করছে। আওয়াজটা গুহার ভেতর থেকেই আসছিল মনে হলো। গুহার মুখের লতাপাতা সরিয়ে দেখি অনেক নিচে একটা কুচকুচে কালো বাচ্চা বড় বড় দুটি চোখে তাকিয়ে আছে। আমি একটা লম্বা শক্ত লতাকে দড়ির মতো পাকিয়ে নিচে ছুড়ে দিলাম। বাচ্চাটি ওটা ধরে তরতর করে ওপরে উঠে এল। ওপরে এসে সে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমাকে দেখতে লাগল। আমার নাকে, গলায়, হাতে, কপালে অজস্র গয়না। আমার গায়ের রং ওর মতো কালো নয় বরং মহলের রানিদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে সুন্দরী বলে রাজার প্রিয় পাত্রী ছিলাম। বেশ, এখন নিশ্চয় মহলের রানিরা খুব আনন্দে আছেন। রাজার চোখের মণি বিজয়া রানী যে জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। আমার কেন যেন খুব মায়া হলো। রানি হয়েছি আজ চার বছর, কিন্তু ঈশ্বর যে আমার কোল এখনো শূন্য করে রেখেছেন। ভবিতব্যে এই আশ্চর্য ঘটনা লেখা ছিল বলেই হয়তো। আমি দুই হাত বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে—আয়। আয়।

ছেলেটা আমার চুড়ি ভরা হাতের ওপর ঢলে পড়ল। ঠান্ডায় ওর হাত, পা, শরীর যেন জমে গেছে।

খুব সন্তর্পণে অয়নের মুখটা হাত দিয়ে স্পর্শ করল রিমি। এখনো জীবনের উষ্ণতা জড়িয়ে আছে ওর শরীরটাকে। আইসিইউর শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ঘরটাকে হিম শীতল করে রাখলেও অয়নের কপালটা এখনো গরম।

টাইম ওভার। সাদা পোশাক পরা নার্স পাশে এসে দাঁড়ালে রিমি শীতল চোখে তাকাল একবার তার দিকে। তারপর ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এল কাচের দরজা দিয়ে। ডাক্তার ধীমান তাকে দেখা করতে বলেছেন। জ্বালিয়ে খেল এই ডাক্তার আর তাঁর সহকারী মেয়েটা।

ডাক্তারের রুমে নক করতেই বেরিয়ে এল জিনিয়া। আসুন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। 

রিমি চেয়ারে বসল। জিনিয়া বসল ওর পাশের চেয়ারে। আর ডাক্তার তার মুখোমুখি।

কেমন আছ তুমি রিমি?—ডাক্তার ধীমান তাকে প্রশ্ন করলেন। জবাবে রিমি একটু মাথা ঝাঁকাল কেবল—ভালো। তবে অয়নকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

একটুখানি কাশলেন ডাক্তার ধীমান—তোমাকে একটা কথা বলতে চাই রিমি। মন দিয়ে শুনবে। একটা নতুন অপরিচিত আর আজব ধরনের ভাইরাস অয়নকে আক্রমণ করেছে। ভাইরাসটা তার সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বেয়ে বেয়ে পুরো ব্রেনটাকে দখল করে নিয়েছে। তার নিউরনের মধ্যে বসে ভাইরাসটা বংশবৃদ্ধি করছে এবং অয়নের কোষে মিশিয়ে দিচ্ছে আনন্যাচারাল ও আউটসাইডার ডিএনএ প্রোটিন। ভয়াবহ রকমের ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে সে। তার চেতনালুপ্তি ঘটেছে। আর সে বাস করছে এমন একজনের চেতনার ভেতর যে আসলে সাড়ে চার শ বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

জিনিয়া লক্ষ করল যে রিমি খুব একটা অবাক হলো না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ডাক্তার ধীমানের দিকে। ডাক্তার আরেকটু সময় নিয়ে বললেন—খারাপ খবরটা হলো, আমাদের ধারণা, তুমি নিজেও এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছ। তোমার মধ্যে ডিমেনশিয়ার লক্ষণগুলো অতটা প্রকট হয়ে ওঠেনি কেন সেটা একটা বিস্ময়, কিন্তু তোমার সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডে সেই একই প্রোটিনের উপস্থিতির প্রমাণ আমরা পেয়েছি। তাই তোমাকে নিয়ে আমাদের ভয় হচ্ছে।

রিমি অপ্রস্ত্তত ভঙ্গিতে হাসল কেবল—আমি একদম ঠিক আছি স্যার। আমার মনে হয়, আপনারা ভুল করছেন। আমার কোনো সমস্যা নেই।

সমস্যা আছে—জিনিয়া উত্তেজিত হয়ে উঠল—আপনাকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। আপনাকে আমাদের অবজারভেশনে থাকতে হবে।

রিমি উঠে দাঁড়াল—এটা হতেই পারে না। আমাকে শুধু শুধু কেন আটকে রাখবেন? আমার অনেক কাজ আছে। আমি এখন যাই।

ডাক্তার ধীমান ব্যস্ত হয়ে বললেন—তুমি বোঝার চেষ্টা করো রিমি। তুমি একটা বিপদের মধ্যে আছ। আমরা তোমাকে সাহাঘ্য করতে চাই।

আমার আপনাদের সাহাঘ্য লাগবে না—ঠান্ডা গলায় বলল রিমি—আমি হানড্রে্রড পারসেন্ট ভালো আছি। বলেই দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল রিমি। সেদিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন ডাক্তার ধীমান। মেয়েটা এমন অদ্ভুত একগুঁয়ে আচরণ করছে কেন? শিক্ষিত আধুনিক একটা মেয়ে নিজের ভালোমন্দ কেন বুঝতে চাইছে না। কিন্তু তিনি নিরুপায়। মানুষ হিসেবে রিমির পূর্ণ স্বাধীনতা আছে তাঁদের সাহাঘ্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার। হতাশ ভঙ্গিতে জিনিয়ার দিকে ফিরে তিনি বললেন—অ্যান্টিবডি তৈরির কাজটা জোরেশোরে শুরু করতে হবে জিনিয়া। তুমি আমার বন্ধু ইমিউনোলজিস্ট ডক্টর কামালের সাহাঘ্য নাও। কালই ওর সঙ্গে দেখা করো। টেস্টটিউবটা সঙ্গে করে নিয়ে যাও। সে তোমাকে সাহাঘ্য করতে পারবে।

এরা বিশ্বাস করে, গোত্রের কেউ বিপদে পড়লে তাকে সাহাঘ্য করতে এগিয়ে আসেন স্বয়ং দেবতা হুড়ুম্বা। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে গোত্রপ্রধানের ছেলেকে রক্ষা করেছে যে সে সাক্ষাৎ দেবতারই অনুচর। কিন্তু আমার গায়ের রং আর কাপড়চোপড়ের ওপর চরম অবিশ্বাস আর সন্দেহ তাদের সিঁটিয়ে রাখে অনেক দিন। তারপর একসময় অনেকটা সহজ হয়ে আসে সবকিছু। বিশেষ করে মেয়েগুলো আমার গা-ভর্তি গয়না আর রঙিন পোশাক-আশাক দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে যায়। আমিও বুদ্ধি করে আমার পক্ষে আনার জন্য বেশ কিছু তরুণীকে কিছু চুড়ি, বালা আর দুল দিয়ে দিই। তারা রীতিমতো আমার ভক্ত হয়ে ওঠে। আর মায়াকাড়া ছোট্ট ছেলেটা তো আছেই। ছেলেটার বাবা-মা দুজনেই যুদ্ধে নিহত হয়েছে। যদিও এই যুদ্ধের জন্য আমার দলের লোকেরা, এমনকি আমার প্রাণাধিক স্বামীও দায়ী, তবু ছেলেটা আমার ভীষণ ন্যাওটা হয়ে উঠল। সারাক্ষণ আমার পেছনে ঘুরতে লাগল সে। আমিও তাকে পরম স্নেহে বুকে তুলে নিলাম। একদিন সে তার এক গোপন গুহা দেখাতে নিয়ে গেল, যেখানে মন খারাপ হলে সে বসে ছবি আঁকে। তার ছবি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। শিল্পী মন আছে ছেলেটার। আরেক জন্মে আমি বোধ করি ওর মা ছিলাম। নইলে কোথাকার আমি কী করে এই গভীর জঙ্গলে বুনো মানুষের মাঝে এসে পড়লাম। ঈশ্বরের কী লীলা! কেবল এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী যে নারী গুনিন জুজুমা—সে আমাকে মোটেও সহ্য করতে পারছে না। আমার প্রতি অন্যদের মুগ্ধতা, মনোযোগ আর ভালো লাগা তার চক্ষুঃশূল হয়ে উঠেছে। একজন মেয়ে হিসেবে তার ঈর্ষা আমি ঠিক টের পাই। কিন্তু জুজুমা আমার কিছু করতে পারবে না। কেননা নিয়ম অনুযায়ী এই ছোট্ট ছেলেটাই আর কদিন পর গোত্রপ্রধান হবে। আর যত দিন ছেলেটা আমার পক্ষে আছে, তত দিন আমার কোনো চিন্তা নেই। 

রিমি লেখা বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্প নেভাল। ওই বুড়ো ডাক্তার আর তাঁর সহকারী তো বেশ চিন্তায় ফেলে দিল ওকে। আঠার মতো লেগে আছে ওর পেছনে। আজ ডেকে পাঠায় তো কাল এসে উপস্থিত হয় ওকে দেখতে। কাজটা ঠিকমতো করতেই দেবে না দেখছি। আজ ফোন করে আবার নতুন আবদার। কী একটা অ্যান্টিবডি না কী যেন তৈরি করেছে ওরা, ওটা নাকি তাকে ইনজেকশন দিয়ে নিতে হবে। ওর ক্ষেত্রে ভালো কাজ দিলেই তবে অয়নের ওপর প্রয়োগ করা হবে ওটা। জিনিয়া পইপই করে বলে দিয়েছে যে খুব একটা তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই ইনজেকশনের। বিজ্ঞানের ও মানবতার স্বার্থে এটুকু করতে অসুবিধে কোথায়?

রিমি বিছানায় শুয়ে একটুখানি হাসল। জুজুমা অনেক কূটকচাল করেও ওর সঙ্গে পেরে ওঠেনি। আর এই ফালতু ডাক্তার আর তাঁর সহকারী ভাবছে ওকে জালে আটকাতে পারবে? কস্মিনকালেও নয়।

বারো

অণুজীবের কি বুদ্ধিবৃত্তি আছে? পৃথিবীর আদি প্রাণ হচ্ছে এককোষী অণুজীব। প্রবল বৈরী পরিবেশ আর ধ্বংসযজ্ঞের পরও সেই এককোষী অণুজীব বহাল তবিয়তে বিশ্বে টিকে আছে এবং বংশ বিস্তার করছে। একটা ভাইরাসের মস্তিষ্ক না থাকতে পারে কিন্তু তার আছে ডিএনএ কপি করার অসীম ক্ষমতা। ছয়টা রেগুলেটরি জিন নিয়ন্ত্রণ করে এই ভাইরাসের তিনটি মূল জিন—গ্যাগ, পল এবং এনভিকে। এই জিনগুলো অবিরাম কোড করে চলে প্রোটিন তৈরির নির্দেশিকা আর কপি করতে থাকে ডিএনএ। হোস্টের টার্গেট কোষকে ধ্বংস করে সে যখন বেরিয়ে আসে, তখন সেই মুকুল থেকে তৈরি হয় নতুন নতুন ভিরিয়ন। হোস্ট কোষের সেল মেমব্রেনকে ভেঙে সেই শিশু ভিরিয়নের কোষের লিপিড বাই লেয়ার কোট তৈরি করে নেয় সে। প্রতিদিন প্রায় ১০ মিলিয়ন নতুন ভিরিয়নের জন্ম দেয় সে আর আক্রমণ করতে থাকে নতুন নতুন হোস্ট কোষকে। কী অবিশ্বাস্য ক্ষমতা এই এক রত্তি এককোষী জীবের। তার অবিরাম অবিশ্বাস্য গতিতে বংশ বৃদ্ধি করে চলাটাকে থামাতে পারে না কেউ।

তবে একসময় মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমও রুখে দাঁড়ায়। রক্তের লিম্ফোসাইটগুলো একযোগে তৈরি করতে চেষ্টা করে এমন এক রাসায়নিক-অ্যান্টিবডি, যা ওই বহিরাগত এককোষীকে প্রতিহত করবে। কিন্তু এই অদ্ভুত ভাইরাসের বিশেষত্ব হলো যে এটি মানবদেহের সম্পূর্ণ স্বাভাবিক প্রবণতাকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তুলতে জানে। মানুষের মস্তিষ্কের নেটওয়ার্কে সে এমন এক জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাতে পারে যে সেই মানুষ নিজেই এক আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগতে শুরু করে। কে কার বিরুদ্ধে লড়বে, এটাই যদি ঠিক না হয়, তবে যুদ্ধে পরাজয় অবধারিত।

এই মুহূর্তে আইসিইউতে অয়ন সেই অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। সে জানে না যে সে কে, কোথায় এবং কী তার করা উচিত। সহজ নির্দেশগুলো না পাওয়ার কারণে তার রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা প্রায় পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। ডাক্তার ধীমান হাল ছেড়ে দিয়েছেন প্রায়। তাঁর বন্ধু ইমিউনোলজির দিকপাল অধ্যাপক কামালও কোনো সুরাহা করতে পারেননি। শত্রুর বিপরীতে লড়ার জন্য সবচেয়ে জরুরি রসদ হলো নিজের সম্পর্কে সচেতনতা। আজব ভাইরাসটি অয়নের সত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাকে উল্টে দিয়েছে।

আর রিমি নামের মেয়েটার কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহাঘ্যই পাওয়া যায়নি। একধরনের রহস্যময় নীরবতা পালন করে চলেছে মেয়েটি। কাজের মধ্যে কাজ তার একটিই, রোজ একবার অয়নের পাশে কিছু সময় কাটানো। এই সময় সে অয়নের হাত স্পর্শ করে কখনো চোখ বুজে থাকে, কখনো একা একা কথা বলে, কখনো কিছু না করে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। জিনিয়ার বদ্ধমূল ধারণা যে অদ্ভুত ভাইরাসটি রিমিকেও আক্রমণ করেছে কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গি এ ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন।

অয়ন যে রাতে মারা যাবে, তার আগের দিন অপ্রত্যাশিতভাবেই রিমি জিনিয়ার ল্যাবরেটরির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়। তাকে দেখে রীতিমতো চমকে যায় জিনিয়া। যাকে এত দিনের চেষ্টায়ও একবার আনা যায়নি, সে কিনা নিজে থেকেই এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। রিমি জিনিয়ার অবাক হয়ে যাওয়াটা যেন উপভোগ করে—ওয়েল জিনিয়া। আমার এখন একটু কৌতূহল হচ্ছে বৈকি। কী যে সব ভাইরাসের কথা বলছিলেন আপনারা! কোন কূলকিনারা হলো বিষয়টার?

জিনিয়া রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বিশদ বর্ণনা শুরু করে দেয় তাদের আবিষ্কারের। এই যে দেখছেন সেন্ট্রিফিউজ মেশিন, এখানে ঘনীভূত হচ্ছে অয়নের দেহের বিভিন্ন ফ্লুইড। ভাইরাস আইসোলেশনের পথটা আমরা অনেক আগেই পেয়ে গেছি। কেবল একটা জুতসই অ্যান্টিবডি তৈরি করার ব্যাপারটা বাকি। একেক দিন একেক লাইনে চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্রতিবারই বিফল হচ্ছি, কিন্তু হাল ছেড়ে দিচ্ছি না। একদিন ঠিক পেয়ে যাব। তখন ভাইরাসের বাচ্চাটা মজা বুঝবে।

আমি আপনাকে সাহাঘ্য করতে পারি।—মিটিমিটি হাসতে থাকল রিমি।

নিশ্চয়! জিনিয়াও হাসতে শুরু করল—দ্যাট উইল বি ভেরি নাইস। সত্যি সাহাঘ্য করবেন আমায়?

কেন করব না? খুব সুন্দর করে হাসছে রিমি।

আমার কেবল আপনার কিছু রক্তের স্যাম্পল চাই। অয়নের ইমিউন সিস্টেম কনফিউজড অবস্থায় রয়েছে। তাই যথেষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। জিনিয়া বলতে থাকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে—কিন্তু আপনি এখনো সুস্থ-সবল আছেন। আপনাকে দিয়েই হবে। আমি কি আপনার তিন মিলিলিটার রক্ত নিতে পারি?

হাসতে হাসতে ডান হাত বাড়িয়ে দেয় রিমি—শিওর। ইউ টেক ইট।

জিনিয়া বোধ হয় সারা রাত ল্যাবরেটরিতেই ছিল। সকালবেলা ল্যাবের আলো জ্বলতে দেখে অবাক হয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন ডাক্তার ধীমান। হ্যাঁ, যা সন্দেহ করেছিলেন তা-ই। ল্যাপটপের সামনে মাথা রেখে গভীর প্রশান্তিতে ঘুমোচ্ছে জিনিয়া। তিনি সহকারীর মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন—জিনিয়া, জিনিয়া।

অলংকরণ: তুলি

বেশ কয়েকবার ডাকাডাকির পর সে চোখ মেলে তাকাল। তারপর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল—কে তুমি? তুমি কে?

সে রাতেই অয়ন মারা গেল। তার রেসপিরেটরি ফেইলিউর হয়েছিল। মস্তিষ্ক তার রেসপিরেটরি সেন্টার থেকে কমান্ড পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল পুরোপুরি। অয়নের মৃত্যুর পর সেই একই বেডে জিনিয়াকে ভর্তি করাতে হলো। কেননা জিনিয়া ততক্ষণে প্রবল ডিমেনশিয়া, ডিজেনারেটিভ ব্রেন ডিজিজ আর খিঁচুনিতে আক্রান্ত। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, জিনিয়ার ল্যাপটপ থেকে ভাইরাস-সম্পর্কিত সব তথ্য উধাও হয়ে গেছে। সেন্ট্রিফিউজ মেশিনে কোনো দ্রবণ নেই। ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেছে সব গবেষণার উপাত্ত। অধ্যাপক কামাল একটি মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে প্রায় কোমা অবস্থায় রয়েছেন। তাঁর স্ত্রী জানাচ্ছেন যে রাতের বেলা উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি। সকালে তাঁর গাড়িটি পাওয়া যায় শহরের পাশে এক খালে।

আইসিইউতে জিনিয়াকে দেখে এসে ডাক্তার ধীমান অস্বস্তি নিয়ে তাঁর রুমে বসে রইলেন। কিছু একটা তাঁর করার কথা ছিল, কিন্তু কিছুতেই এখন আর মনে করতে পারছেন না। কোথায় যেন চিন্তার যোগসূত্রগুলো সব হারিয়ে যাচ্ছে। একসঙ্গে মেলাতে পারছেন না কিছুই। টেবিলের ওপর রাখা বইপত্র, জার্নাল, কম্পিউটারের পর্দা—সবকিছু কেমন অপরিচিত ঠেকছে। মনে হচ্ছে এগুলো কিছুই তাঁর নয়, অথবা তিনিই এই ঘরের কেউ নন।

কয়েক দিন পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ঘোষণা দিল যে অধ্যাপক ধীমান চৌধুরী স্মৃতি বিনষ্টকারী আলঝেইমারস ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ায় নিজ দায়িত্ব আর চালিয়ে যেতে পারছেন না। তাঁকে একটি উন্নত মানের অ্যাসাইলামে ভর্তি করে দেওয়া হয়।

আর রিমি নামের রহস্যময় মেয়েটাকে আর কোনো দিন এই শহরে দেখা যায়নি।