ঘটনাটা কিন্তু সত্য। বানিয়ে বলছি না। তবে আমি একজন গল্পকার। গল্পকারেরা কোনো কথা রং না চড়িয়ে বলতে পারেন না। আমিও পারি না। কিন্তু আমি তোমাদের বলতে পারি, এই একটা ঘটনার বিবরণ আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কোনোরকমের রং আমি চড়াব না।
আমরা একবার গিয়েছিলাম জামালপুর। ভাষা প্রতিযোগের আঞ্চলিক উৎসব ছিল। শীতকালের দিন হয় ছোট। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে চারটা বেজে গেল। আমরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক তারিক মনজুর, আবৃত্তিকার পরিতোষ চক্রবর্তী, জাহাঙ্গীরনগরের বাংলার অধ্যাপক শামসুল চৌধুরী, কবি সৌরভ শান্তনু এবং সংগীতশিল্পী প্রিয়া হায়দার, আমাদের সহকর্মী রাশেদ শামস, আর একজন কর্মী জয়নাল আবেদিন দৌড়ে মাইক্রোবাসে উঠলাম।
ভালো ভালোয় আসছিলাম। সন্ধ্যার দিকে হাইওয়ের পাশে একটা চায়ের দোকানে থামা হলো। আমি ২০ টাকা বের করে দোকানির হাতে দিলাম। বললাম, ওই যে দুধের কড়াইয়ে সর দেখা যাচ্ছে, পুরো এক গেলাস সর দিন। তারপর চিনি দিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে দিন। সর-চা।
দোকানি খুশি হলো। তার সর-চায়ের দাম নাকি ছিল ৭ টাকা। আমি বেশি টাকা দিয়েছি।
এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা। গাড়ি বন থেকে আর বের হতে পারছে না। একই রাস্তায় ঘুরেফিরে আসছে। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আমরা একটা বাঘের মতো বনবিড়ালের জ্বলজ্বলে চোখও দেখলাম।
আমার দেখাদেখি এগিয়ে এলেন কবি সৌরভ। তিনি ধবধবে ফরসা, তাঁর গোল গোল চোখ, মাথায় খানিকটা টাক। নিজের নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করতে তিনি পকেটে রেখেছেন একটা পারফিউমের শিশি। একটু পরপর শার্টে পারফিউম স্প্রে করেন।
তিনি বললেন,
আজ সন্ধ্যার কড়চা,
আনিস ভাইয়ের সর-চা।
আবৃত্তিকার পরিতোষও তো কম যান না! তিনি বললেন,
আনিস ভাইয়ের সর-চা,
টাকা হলো খরচা। তারিক মনজুর দুধ-চা খাবেন না। তিনি র-চা খেতে শুরু করলেন।
এটাকে বাংলায় বলে রং-চা।
সবাই চা খাচ্ছেন। শামসুল স্যার বললেন, দুধ ছাড়া চাকে আমরা ছোটবেলায় বলতাম, র-চা। পরে এটার নাম হলো রং-চা। আমার ভালোই লাগে। এই রকম হয়। ইংরেজি শব্দের আমরা একটা বাংলা করে নিই। যেমন নাম্বার হলো ইংরেজি, নম্বর হলো বাংলা। ডেঙ্গি হলো ইংরেজি, ডেঙ্গু হলো বাংলা। তেমনি র-চা যদি রং-চা হয়, ভালোই হয়।
ভাষা প্রতিযোগ থেকে ফেরার পথে ভাষা নিয়ে কথা হবে, তাই তো স্বাভাবিক।
আমিও সুযোগ বুঝে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলাম, চা-স্পৃহা চঞ্চল চাতক-চাতকী দল, চলো চলো চলো হে।
এরপর আমরা মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম, কিন্তু আমাদের ড্রাইভার সাহেব আলী কই? তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
তাকে ফোন দেওয়া হলো। সে ফোন ধরছে না।
অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। আমরা মহাবিপদে। দূরে মসজিদে এশার নামাজের আজান হলো।
একটু পরে সাহেব আলী ফিরে এল। চায়ের দোকানের লাইটের আলোয় তার হাতে একটা মাছের আঁশ ঝিলিক মারছে। কানকোর মধ্যে দড়ি ঢুকিয়ে মুখের মধ্য দিয়ে বের করে মাছটাকে ঝুলিয়ে আনছে সে। সব কটি দাঁত বের করে বলল, আরে কী সস্তায় রুই মাছ পাইলাম। না নিয়া পারলাম না।
রাশেদ শামস বললেন, ওহে শকটচালক, তোমার ওই রুহিৎ মৎস্যের মূল্য কী পরিমাণ?
স্যার, কী কইলেন?
ড্রাইভার, তোমার রুই মাছের দাম কত?
খুব সস্তা স্যার। তিন শ টাকা।
বলো কী?
হ স্যার। ৫০ টাকা কেজি পড়ল।
চাষের মাছ।
না স্যার। ব্রহ্মপুত্র নদীর মাছ।
তারিক মনজুর শুধরে দিলেন, ব্রহ্মপুত্র নদী নয়, নদ। পুত্র কখনো নদী হয় না।
আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলছে। একটু পরে সবাই ঘুমে ঢুলুঢুলু। ড্রাইভার যেন ঘুমিয়ে না পড়ে। আমি বললাম, প্রিয়া হায়দার, এটা গান ধরেন।
না না, আমার গানের গলা খারাপ।
আরে রাখেন। চা খেয়েছেন না। পারবেন।
প্রিয়া গান ধরলেন, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...
আমি বললাম, আজ তো জ্যোৎস্না রাত না। আজ অমাবস্যা।
অমাবস্যা নাকি? বললেন, তারিক মনজুর।
গানের সুরেই বোধ হয় আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছি।
সাহেব আলী পেছনের সিট থেকে খিচুড়ির প্যাকেট বের করল। তারপর শুকনো মরিচ বের করল দুইটা। হাতের দেশলাই দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সে তাতে মরিচ ধরল। পোড়া মরিচের গন্ধে আমরা সবাই হাঁচি দিতে লাগলাম।
যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখি, আমাদের গাড়ি একটা ঘন শালবনের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিঁঝি ডাকছে। জোনাকির আলো নিভছে-জ্বলছে। দূরে শিয়ালের ডাকও শোনা যাচ্ছে। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ। সাহেব আলী গাড়িতে নেই।
সাহেব আলী, সাহেব আলী—আমি চিৎকার করে উঠলাম।
বনের শালগাছের ডালে ডালে বাড়ি খেয়ে আমার ডাক আমার কানেই ফিরে এলে।
বনের মধ্যে সরসর শব্দ। কে যেন দৌড়ে পালাল।
জয়নাল ফোন করতে লাগল সাহেব আলীকে। স্যার, ফোন বন্ধ।
কী ঘটনা। সে কোথায় কোন বনের মধ্যে আমাদের এনে নিজে পালিয়ে গেল।
তারিক মনজুর বললেন, জামালপুর থেকে ফিরতে জঙ্গল আসবে কোত্থেকে? আমরা হাইওয়ে ছেড়ে কোথায় এসেছি।
প্রিয়া হায়দার কাঁদতে লাগলেন। বললেন, কোনো ডাকাত দলের চক্রান্ত নয়তো। আমাদের মেরেকেটে সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যাবে? এই ড্রাইভারকে আপনারা আগে থেকে চেনেন তো!
একটু পরে সাহেব আলী এল।
কোথায় গিয়েছিলে? আমরা সবাই একযোগে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম।
সে কোনো জবাব দিল না। সিটে বসল। গাড়ি স্টার্ট দিতে চেষ্টা করছে। গাড়ি স্টার্ট নেয় না।
জয়নাল বলল, কী হয়েছে?
সাহেব আলী কথা বলে না।
তারিক মনজুর বললেন, কী সর্বনাশ। এই অমাবস্যার রাতে এই ঘন বনের মধ্যে আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল।
আর কেউ কোনো কথা বলছে না। আমরা মুঠোফোনে যাঁর যাঁর বাড়ির সঙ্গে কথা বলার জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম। আমি চাইলাম অন্তত আমার অফিসকে জানাই যে আমরা বিপদে পড়েছি। দেখা গেল, কারও ফোনে নেটওয়ার্ক নেই।
জয়নাল কী মনে করে তার দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালাল। অমনি গাড়ি স্টার্ট নিল।
তারপর গাড়ি চলছে। এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা। গাড়ি বন থেকে আর বের হতে পারছে না। একই রাস্তায় ঘুরেফিরে আসছে। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আমরা একটা বাঘের মতো বনবিড়ালের জ্বলজ্বলে চোখও দেখলাম।
কী হয়েছে, সাহেব আলী?
সাহেব আলী কথা বলে না।
সাহেব আলী, কথা বলো।
সাহেব আলী একটা কথাও বলছে না।
জয়নাল খেপে গিয়ে সাহেব আলীর কলার চেপে ধরল। সাহেব আলী তবু নির্বিকার।
আমরা বুঝলাম, খুব বড় বিপদে পড়েছি।
গাড়ি থামাও সাহেব আলী—বললেন সৌরভ।
গাড়ি থামে না।
শেষে শামসুল স্যার বললেন, সাহেব আলী, তোমার কী হয়েছে।
তবু সাহেব আলী একমনে গাড়ি চালাচ্ছে, কিছু বলছে না।
জয়নাল বলল, আমি বুঝেছি, কী হয়েছে।
কী হয়েছে?
সাহেব আলীকে ওনারা ধরেছেন।
ওনারা কারা?
মুখে নাম নেওয়া যাবে না।
তাহলে আমরা কী করব?
আমি জানি কী করতে হবে। আমার কাছে দুপুরের খিচুড়ির প্যাকেট আছে। সেখানে শুকনা মরিচ আছে।
সাহেব আলী পেছনের সিট থেকে খিচুড়ির প্যাকেট বের করল। তারপর শুকনো মরিচ বের করল দুইটা। হাতের দেশলাই দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সে তাতে মরিচ ধরল। পোড়া মরিচের গন্ধে আমরা সবাই হাঁচি দিতে লাগলাম।
সাহেব আলীও হাঁচি দিল। তারপর বলল, মঁরিচ পোঁড়াবেন নাঁ। আঁমার কঁষ্ট হয়।
জয়নাল বলল, আরও পোড়াব। তুই সাহেব আলীকে ছেড়ে দে।
কেঁন দিঁব? ও সঁন্ধ্যার সঁময় মাঁছ কিঁনছে কেঁন?
মাছ নিবি? নে। এই যে মাছটা আমরা ফেলে দিচ্ছি বাইরে। যা বাইরে যা। নাইলে মরিচ পুড়িয়ে তোকে মেরেই ফেলব।
মাঁছটা বাঁইরে ফেঁলেন।
জয়নাল পেছন থেকে মাছটা ধরে মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিল।
অমনি আমাদের গাড়ির জানালার একটা কাচ ভেঙে গেল।
আর সাহেব আলী বলতে লাগল, আমরা এখন কোথায়?
তা আমরা কেমন করে বলব? তুমি জানো।
আমি তো ঘুমায়া ছিলাম। গাড়ি এতক্ষণ কে চালাইছে?
কে চালাইছে, তার নাম মুখে আনা যাইব না—জয়নাল বলল।
আমরা দেখলাম, আমাদের ফোনে নেটওয়ার্ক এসেছে। তারিক মনজুর স্মার্ট। তিনি গুগল ম্যাপ বের করে বললেন, যাও, সোজা হও। তিন কিলোমিটার পরে বাঁয়ে গেলেই হাইওয়ে।
তিন কিলোমিটার যেতে লাগল ৮ মিনিট। এই ৮ মিনিট কেউ কথা বলল না।
তারপর হাইওয়েতে উঠে সাহেব আলী গতিবেগ বাড়াল।
তারপর বলল, আমার মাছটা কি ঠিক আছে?
জয়নাল বলল, তোমার মাছ যাদের দরকার, তারা এখন আরাম করে খাচ্ছে। তুমি চলো।
আমি বললাম, সাহেব আলী, তোমার মাছের দাম আমি দিয়ে দেব। আর কোনো দিন গ্রামের হাট থেকে সন্ধ্যার পর মাছ কিনবে না।
****
তোমরা কি আমার এই গল্প বিশ্বাস করছ না? তোমরা তারিক মনজুর স্যার, শামসু স্যার বা প্রিয়া হায়দারকে জিজ্ঞেস কোরো। কবি সৌরভের একটা কবিতাও আছে এটা নিয়ে:
অরণ্যে গভীর রাত, অমাবস্যা ঘন হয়ে নামে,
আমাদের বিধিলিপি লেখা ছিল অশরীরী খামে;
বাতাস চালায় গাড়ি, ভৌতিক চালক বোধহীন,
যাত্রীরা সেলাই-মুখ সবার অবস্থা সঙিন।
আর আবৃত্তিকার চক্রবর্তী ছড়া লিখেছিলেন:
ভূতে চালাল গাড়ি যে,
বনে গেলাম হারিয়ে।