অন্তঃস্থ

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

‘ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল দরজাটা। ভূত নয়, আমিই খুলেছি। ছাদের টিনের দরজা। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে জং ধরে গেছে একেবারে। বাঁ পা’টা প্রথমে দিলাম। শেওলায় পিচ্ছিল হয়ে আছে ছাদের মেঝে। সাবধানে আরেকটা পা রাখলাম। নিজের অজান্তেই হেসে ফেললাম আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই যে আমার জীবনের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না, সেই আমি কি না শেওলায় পিছলে পড়ার ভয় পাচ্ছি। টিনের দরজাটা ভিড়িয়ে দিলাম। আবার সেই বিকট ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ।

হাঁটু মুড়ে বসলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি বিরাট চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমা নাকি? হতেও পারে। একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল জীবনের নানা ভুলত্রুটি আর হতাশার চিত্রগুলো। কেউ যখন জানে যে কিছুক্ষণের মধ্যে তার মৃত্যু হবে, তখন সবারই কি এমন মনে হয়? কেমন যেন অনুভূতিশূন্য লাগছে। বুঝতে পারছি না, সব পাপের জন্য এটাই কি ক্ষমা চাওয়ার সময়? কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার সময় তো বহু আগেই চলে গেছে। আর কার কাছেই বা ক্ষমা চাইব?

উঠে দাঁড়ালাম। আর দেরি করা ঠিক হবে না। এক পা, দু পা করে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ঠিক যেভাবে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম জীবনের প্রত্যেকটা সফলতার দিকে। কিন্তু বিধিবাম। সফলতায় পৌঁছানোর সব পথ যে বন্ধ করে রেখেছিল আমার নিয়তি!

পৌঁছে গেছি রেলিংয়ের পাশে। রেলিংটা বেশ চওড়া। উঠে দাঁড়াতে পা কাঁপল না একবারও। এবার কী করব? ‘বিদায় পৃথিবী’ টাইপের কিছু বলে চিৎকার দেব? জীবনের প্রতিটা মুহূর্তই যেখানে একেকটা নাটকীয় দৃশ্য, সেখানে বিদায়বেলায় এই নাটকীয়তাটুকু না করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?

নিচে তাকালাম। মাথা ঘোরাল না। দৃষ্টি ঝাপসা হলো না। কিচ্ছু না...। সাততলা থেকে নিচে তাকানোটা যতটা স্বাভাবিক লাগার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশিই স্বাভাবিক লাগল সবকিছু। দুই হাত প্রসারিত করলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস, শেষ দীর্ঘশ্বাস। ঝুঁকে পড়লাম সামনে। শোঁ শোঁ একটা শব্দ...।

হঠাৎ! কোথায় যেন আটকে গেলাম। হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করছি! ‘খ্যাচ’ করে একটা শব্দ, তারপর ধুপ্!

অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল পুরো শরীর। চোখ মেললাম। সব অন্ধকার। হঠাৎ আলোর ঝলকানি! আধা খোলা চোখ দিয়ে দেখলাম, কে জানি গভীর মনোযোগ দিয়ে ঝুঁকে দেখছে আমাকে। সঙ্গে তীব্র ঝাঁকুনি! আর একটা কণ্ঠ, ‘কী রে! ক্যামনে ঘুমাস? মশারি ছিঁড়ে বিছানা থেকে একেবারে পড়েই গেলি? কী অদ্ভুত!’

আধা খোলা চোখ দুটো পুরোপুরি খুলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম। বিছানার পাশে ফ্লোরে বসে আছি আমি। ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত ঘরের মতো দেখাচ্ছে ছেঁড়া মশারিটা। উফ্ বাবা! কী স্বপ্নটাই না দেখলাম! আছাড় খেয়ে পড়ে ঘাড়টা এখনো টনটন করছে! বড় ভাই তখনো বলে যাচ্ছে, ‘কী বেগ ঘুমের! বাপ রে বাপ...।’