অপারেশন ইনানী বিচ

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

গালে হাত দিয়ে বসে ছিল শৌনক। এই গ্রীষ্মে গরম পড়েছে বেশি। রাস্তায় বের হওয়ার কথা মনে হলেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হতে চায়। দুপা হাঁটলেই সারা শরীর ঘেমেনেয়ে একাকার। তাই এই বিকেলে মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলার চিন্তা বাতিল করে দিল ও। কিছুই ভালো লাগছে না। ক্লাস টেনের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা হয়ে গেছে। টেস্ট হবে কিছুদিন পর। সেন্ট যোসেফ স্কুল এক মাস এগারো দিন ছুটি দিয়ে দিয়েছে। স্কুলের শেষ বছর। এখন কি ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে? এক মাস স্কুলে যেতে হবে না—এ কথা আগের ক্লাসগুলোয় থাকতে ভাবতে ভালো লাগত। এখন মায়া লাগে স্কুলের জন্য।

দোরঘণ্টি বাজতেই শৌনকের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। বাবা এসেছেন। বাবার চোখ অন্যদিনের তুলনায় বেশি উজ্জ্বল।

‘কিরে, ছুটিতে কী করবি বলে ঠিক করেছিস?’, ঢুকেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

‘কী আর করব, পড়াশোনা করতে হবে, আর কী!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে শৌনক বলে।

‘পড়াশোনা মানে? গ্রীষ্মের ছুটির প্রথম পনেরো দিন কেউ কি পড়াশোনা করে?’

‘করে না!’ একটু দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বাবাকে জিজ্ঞেস করে শৌনক।

‘আরে না! ছুটি মানে তো ছুটি! ছুটিতে পড়াশোনা করতে হয় না! ছুটিতে গল্পের বই পড়তে হয়, খেলতে হয়, বেড়াতে যেতে হয়!’

পাশের ঘর থেকে সব শুনতে পেয়েছিল সনকা। ও পর্দার ফাঁক দিয়ে মাথাটা বের করে বলল, ‘এ কথাগুলো কি মায়ের সামনে বলতে পারবে?’

বাবা বেশ রোমাঞ্চিত, ‘কেন পারব না? সারা দিন পড়ার বইয়ের দিকে যারা তাকিয়ে থাকে, তারা শুধু বইয়ের চোখেই পৃথিবী দেখে, নিজের চোখে দেখে না।’

সনকা মেনে নেয়। বাবা কখনোই পরীক্ষার রেজাল্টকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তাই ভেবেচিন্তে সনকা বলে, ‘তুমি যেন কী বলতে চাইছ, বলে ফেলো!’

ওদের দিকে রহস্যময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা খুললেন শৌমিক মাহমুদ। তার ভেতর থেকে বের করলেন একটা খাম। সেটা সনকার হাতে দিয়ে বললেন, ‘পরশু দুপুরে কক্সবাজার যাওয়ার প্লেনের টিকিট। চারটা টিকিট। পাঁচ দিনের জন্য যাওয়া!’

‘কক্সবাজার!’ সনকা-শৌনক দুজনেই লাফিয়ে উঠল।

‘ইনানী বিচের কাছে আমরা যে রিসোর্টটা তৈরি করেছি, সেটার উদ্বোধন হবে কয়েক দিন পর। আমাদের কোম্পানি খুশি হয়ে উদ্বোধনের আগে সেখানে থাকতে যেতে বলেছে আমাদের। তোরা ঘুরে বেড়াবি, আমি শেষ সময়ের কাজগুলোতেও একটু হাত লাগাব। এই তো ব্যাপার! রিসোর্টের মালিক আমেরিকা থেকে এসেছেন, তাঁর সঙ্গেও কথা বলতে হবে।’

‘মা জানে?’

‘আমি তো টেলিফোনে ছুটি নিতে বলেছি। দেখা যাক, আসুক আগে!’

বলতে না বলতেই ইলোরা মাহমুদ হাজির। টেলিফোন পেয়েই ছুটির দরখাস্ত করেছেন তিনি। এবং সে মুহূর্তেই তা পাস হয়েছে। তার মানে এখন আর কক্সবাজার উড়ে যেতে কোনো সমস্যা নেই।

ঘটনার শুরু

ঘটনার শুরু হয়েছিল এক বছর আগে। কক্সবাজারে ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে মাইল তিনেক যাওয়ার পর একটি পোড়োবাড়ি ছিল। বিশাল জায়গা নিয়ে সে বাড়ি। মালিক থাকেন আমেরিকায়। তিনি শৌমিক মাহমুদদের রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিলেন। এই পোড়োবাড়িটিকে ছিমছাম এক রিসোর্ট বানিয়ে দিতে বলেছিলেন তিনি। ঢাকায় তাঁর আইনজীবী মারফত চুক্তি হয়েছে। রিসোর্টটি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর এর মালিকানা ভাগ হয়ে যাবে মালিক আর শৌমিক মাহমুদদের কোম্পানির মধ্যে। পঞ্চাশ-পঞ্চাশ শেয়ারে চলবে রিসোর্ট।

চুক্তির পর চিফ ইঞ্জিনিয়ার শৌমিক মাহমুদকে রিসোর্টটি বানানোর কাজে পাঠানো হয়েছিল কক্সবাজারে। সে সময়ও বেশ কয়েক দিন কক্সবাজারে গিয়ে থেকে এসেছিল সনকারা।

একটা পোড়োবাড়ি ভেঙে কী সুন্দর তিনতলা রিসোর্ট বানানো হলো তা ওরা নিজের চোখে দেখেছে! একসঙ্গে আশি জন মানুষ থাকতে পারবে এ রিসোর্টে। গেট দিয়ে বের হয়ে একটু এগোলেই সমুদ্রের জল এসে ছুঁয়ে দেবে পা।

এখানে একটা আজব ঘটনা ঘটেছিল, সে কথাও মনে পড়ে গেল শৌনক-সনকার।

সমুদ্রের উল্টো দিকে পাহাড়। সেই পাহাড়ে কিছুদূর উঠলে ডানদিকে একটা গুহা। সেই গুহায় থাকত এক ভবঘুরে। গুহা পার হয়ে আরেকটু ওপরে উঠলে একটা সমতল জায়গা। সেখানে ছিল রিসোর্টের নিরাপত্তারক্ষীদের ক্যাম্প। বছর চল্লিশেক বয়সের একজন ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক সেখানে ছবি তুলতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। হঠাৎ দেখা যায়, পাহাড়ের ওপর থেকে লোকটা পড়ে গেছেন। নিচে বালু থাকায় তাঁর মৃত্যু হয়নি বটে, কিন্তু হাত ভেঙে বেশ কয়েক দিন তাঁকে পড়ে থাকতে হয়েছিল হাসপাতালে। এখনো সেই সুঠামদেহী লোকটার কথা মনে আছে ওদের। ইনানী বিচের কাছেই কোথাও ছিল তাঁর বাড়ি। মাঝে মাঝে তিনি ঢাকায় যেতেন কাজে। কিন্তু থাকতেন এখানেই। ইশ্! তাঁর নামটা জেনে নেওয়া হয়নি!

লোকটার সঙ্গে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছিল ওদের। হাসপাতালেও তাঁকে দেখতে গিয়েছিল ওরা।

হাসপাতালের কেবিনে এক হাতে একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন বহু কষ্টে।

‘কী বই পড়ছেন?’ জিজ্ঞেস করেছিল শৌনক।

ফেলুদা। মুখ টিপে হেসে বললেন তিনি।

‘এই বয়সেও ফেলুদা পড়েন?’

‘ফেলুদা পড়ার আবার বয়স আছে নাকি? আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন থেকেই ফেলুদা পড়ি। বারবার পড়ি। ভালো লাগে।’

‘পাহাড় থেকে পড়ে গেলেন কীভাবে?’

লোকটা শৌনকের দিকে তাকিয়ে একটু ভাবলেন। তাঁর চোখ কুঁচকে গেল, ভ্রু দুটো একসঙ্গে লেগে গেল। কী যেন ভাবলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘আমি একটা নাম না-জানা পাখি দেখলাম ওই ভবঘুরের গুহার কাছে। লেন্স ঠিক করে ক্যামেরাটা তাক করলাম পাখিটার দিকে। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সে জায়গাটা একটু বিপজ্জনকই ছিল। ঢালু। রাতে বৃষ্টি হয়েছিল, তাই একটু পিচ্ছিলও ছিল জায়গাটা। আমি যে-ই ছবি তুলতে গেছি, তক্ষুনি কে যেন পেছন থেকে আমাকে জোরে ধাক্কা দিয়েছে। আমি টাল সামলাতে পারিনি। একেবারে পপাত ধরণিতল!’

‘তার মানে, আপনি নিশ্চিত, কেউ আপনাকে ধাক্কা মেরেছে? আপনি পিছলে পড়ে যাননি?’

‘প্রশ্নই আসে না!’

‘কে ধাক্কা মারল?’

‘সেটা যদি জানতে পারতাম, তাহলে তো রহস্য উদ্ধার করেই ফেলতাম।’ তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওই লোককে জীবনেও ধরতে পারব না। আমি তো ওকে দেখিইনি!’

‘আপনার সঙ্গে কারও শত্রুতা আছে?’

লোকটা হো হো করে হেসে বললেন, ‘তুমি দেখি গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করছ! এখানে কেন আমার শত্রু থাকবে?’

‘শত্রুতা না থাকলে কেউ কি কাউকে ধাক্কা মারে? নিচে বালু না থাকলে তো আপনি মরেও যেতে পারতেন!’

‘হ্যাঁ, আমি বেঁচে গেছি ভাগ্যগুণে! আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই ধাক্কা মেরেছিল লোকটা।’

এই রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি তখন। সে সময় শৌনকেরা ফিরে এসেছিল ঢাকায়। কিছুদিনের মধ্যেই ভুলে গিয়েছিল এই ঘটনার কথা। নতুন করে কক্সবাজার যাওয়ার সময় সে কথা মনে পড়ে গেল।

নিঝুম দ্বীপ

রিসোর্টের নাম রাখা হয়েছে ‘নিঝুম দ্বীপ’। শহরের কোলাহলের বাইরে বলে নামটা মানানসই হয়েছে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো এই এলাকায় বসতি গড়ে উঠবে। তখন এ রিসোর্টকে নিঝুম দ্বীপ নামে ডাকলে মানুষ হাসবে।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ওদের মাইক্রোবাস রিসোর্টের দরজায় এসে দাঁড়ালে নিরাপত্তারক্ষী আনোয়ার হাসিমুখে দরজা খুলে দিল। ‘স্যার, আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি। তিনতলার দুটো এসি রুম খুলে দেওয়া হয়েছে।’

শৌমিক মাহমুদ বললেন, ‘অনেক ধন্যবাদ, আনোয়ার। তবে শুধু আমাদের থাকার ঘর দুটো খুললেই তো হবে না। আমি তো সবগুলো ঘর ঘুরে ঘুরে দেখব। পত্রিকায়, টেলিভিশনে রিসোর্টের বিজ্ঞাপন গেছে, বুক হয়ে গেছে ঘরগুলো। তিন দিন পর থেকেই পর্যটকেরা আসতে শুরু করবেন। তার আগে আমি সবগুলো ঘর চেক করব।’

‘ঠিক আছে, স্যার। আমি ম্যানেজার সাহেবকে বলে দিচ্ছি। তিনি মনে হয় জানেন আপনার কী কী দরকার।’

‘হ্যাঁ, সিরাজুল জানেন।’ বললেন শৌমিক মাহমুদ।

অভ্যর্থনা, লবি বেশ প্রশস্ত। নিচতলায় রুম নেই। মূলত একটি মিলনায়তন, দুটি রেস্তোরাঁ, একটি কফি শপ, কয়েকটি দোকান। স্টাফদের থাকার ঘর রয়েছে একদিকে। আর রয়েছে গোটা পাঁচেক ঘর, যা অতিথিদের জন্য খুলে দেওয়া হবে না। একান্ত প্রয়োজন হলে তা অতিথিকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

দোতলা আর তিনতলাজুড়ে ঘর।

অভ্যর্থনায় যিনি আছেন, তিনি ওঁদের দেখে এগিয়ে এলেন, ‘স্যার, কেমন আছেন? পোর্টারদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনারা একটু ওই সোফায় গিয়ে বসুন।’

সুবেশধারী, ইউনিফর্ম পরা দুজন পোর্টার চলে এল অল্প সময়ের মধ্যেই। তারা ওদের লাগেজ নিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল।

শৌমিক জিজ্ঞেস করলেন, ‘রিসোর্টের মালিক এসেছেন?’

‘জি, স্যার, এসেছেন। তিনি উঠেছেন তিনতলার ৩১৮ নম্বর রুমে। রাতে খাবার টেবিলে আপনার সঙ্গে তাঁর দেখা হবে।’

‘ঠিক আছে।’

‘স্যার, রাতে কী খাবেন, যদি একটু...’ বিনয়ে গলে যাচ্ছেন অভ্যর্থনাকারী।

শৌমিক মাহমুদ বললেন, ‘বেশি কিছু নয়। রুপচাঁদা ফ্রাই, চিকেন, একটা সবজি আর ডাল।’

‘ইয়েস স্যার! সাড়ে আটটায় টেবিল লাগাতে বলে দেব। মিজ ফারহানা আলম তখনই আসবেন।’

‘মিজ ফারহানা আলম! তার মানে রিসোর্টের মালিক একজন নারী?’

‘জি, স্যার।’

‘তা তো জানা ছিল না। আমি তো তাঁর লইয়ারের সঙ্গেই কথা বলেছি। সে ভদ্রলোক তো কখনোই বলেননি যে তাঁর ক্লায়েন্ট একজন নারী। অবশ্য তাতে কিছু যায়-আসে না। ঠিক আছে। আমরা নেমে আসব সাড়ে আটটায়।’

লিফটে উঠে ইলোরা মাহমুদ বললেন, ‘তোমরা রিসোর্টটা ভালোই বানিয়েছ।’

শৌমিক বললেন, ‘এক বছর এটার পরিচালনাও করব আমরা। তারপর মালিকের লোকজন পরিচালনার ভার বুঝে নেবে। আমাদের স্টাফদেরও চাকরি দিতে পারে এখানে! তখন থেকে লাভের পঞ্চাশ ভাগ আমরা পাব।’

শৌনক বলল, ‘তার মানে, এই এক বছরে যতবার ইচ্ছে ততবার আমরা এখানে আসতে পারব?’

‘একদম ঠিক!’

খাবার টেবিলে

একতলার রেস্তোরাঁটা পরিচ্ছন্ন।

আলো-আঁধারির মধ্যে একেবারে শেষ দিকে বড় একটা টেবিলের সামনে বসে আছেন এক নারী। তাঁর সামনে স্যুপের বাটি। তিনিই যে ফারহানা আলম তা বলে দিতে হলো না।

সেদিকেই এগিয়ে গেল ওরা। ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হাসলেন।

‘আপনি নিশ্চয়ই শৌমিক মাহমুদ?’

‘জি। আর ইনি হলেন ইলোরা মাহমুদ। এরা দুজন সনকা আর শৌনক।’

‘আপনাদের সন্তানেরা খুব কিউট!’ বলে আবার হাসলেন মহিলা।

ফারহানা আলমের পরনে জামদানি শাড়ি। স্যান্ডেল। হাতে দামি সোনালি ঘড়ি। চোখে রোল গোল্ডের চশমা।

শৌনক চেষ্টা করল ভদ্রমহিলার বয়স আন্দাজ করতে। কিন্তু পারল না। ষাট-সত্তর না আশি, সেটা তাঁকে দেখে বোঝা সম্ভব নয়।

‘আমি রাতে বেশি কিছু খাই না। শুধু স্যুপ খাব। আপনারা?’

‘আমরা বলে রেখেছি। আমরা ফুল ডিনার খাব।’

‘ঠিক আছে। এর মধ্যে আমরা তো কথা বলতে পারি?’

‘নিশ্চয়ই পারি।’ বললেন শৌমিক মাহমুদ।

‘আমি খুব অল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছি। চুক্তিমাফিক কাজটা হয়ে গেলেই ফিরে যাব আমেরিকায়। কাজটা শেষ হলে আমি একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারব।’

শৌমিক হেসে বললেন, ‘কাজটা খুব সহজ। আপনি একেবারেই টেনশন করবেন না।’

ফারহানা আলম বললেন, ‘ডিলিংসটা কোথায় হবে? এই রিসোর্টেই?’

‘আপনি যদি মনে করেন, এখানে হতে পারে, আমাদের আপত্তি নেই। আমার কোম্পানি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে, আপনাকে আপনার পাওনা বুঝিয়ে দিতে।’

‘আমি আপনার পাঠানো সব কাগজপত্র সই করে রেখেছি। আপনি আপনার সই বসিয়ে দেবেন।’

‘ঠিক আছে। এ নিয়ে আপনি ভাববেন না।’

‘আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আপনি আমাকে ১০ কোটি টাকা দেবেন।’, বললেন ফারহানা আলম।

‘নিশ্চয়ই। কেন মনে থাকবে না?’

‘আমি চাই, টাকাটা ক্যাশে দেবেন।’

‘১০ কোটি টাকা ক্যাশ! এটা তো একটু কঠিন হয়ে যাবে। এত টাকা ক্যাশ দিতে হলে ব্যাংককে আগে বলতে হবে। ব্যাংক অনুমতি দেবে। তারপর তো!’, একটু চিন্তিত হয়ে বললেন শৌমিক।

‘সে তো আপনারা ঠিক করবেন! দেখুন, কীভাবে টাকা জোগাড় করতে পারেন! আমি বোনপোর হাতে নগদ টাকা দিয়ে চলে যেতে চাই।’ মিজ ফারহানা আলম হাসলেন।

এ সময় একটি ট্রলিতে করে ওঁদের খাবার চলে এল। গরম পানিতে ধোয়া প্লেট রাখা হলো সামনে।

স্যুপের চামচ নাড়তে নাড়তে ফারহানা আলম বললেন, ‘বিয়াল্লিশ বছর পর দেশে এসেছি। এই টাকাটা আমার একমাত্র বোনপোর হাতে দিয়ে যাব। তাহলেই আমি দায়মুক্ত হব।’

এর উত্তরে কিছু বলা যায় না, কারণ এটা কোনো প্রশ্ন নয়।

‘আপনারা হয়তো জানেন না, মনসুর আহমেদ নামে আমার যে বোনপো এখানে থাকে, তার জীবনটা খুব দুঃখের।’

সবাই শোনার জন্য কান পাতে।

‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা থাকতাম চট্টগ্রামে। আমি বোনের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতাম। আমার বোন ফারজানা, দুলাভাই নূরুল আহমেদ আর তাঁদের ছোট মেয়ে তানিয়াকে রাজাকারেরা হত্যা করে। খুবই নৃশংসভাবে হত্যা করে। আমি আর দুই বছর বয়সী মনসুর বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। ওরা আর বাথরুম পর্যন্ত আসেনি। আমরা বেঁচে যাই। সেই ভয়াবহ দৃশ্য আমার চোখ থেকে এখনো সরে যায়নি!’

ফারহানা আলম বলে যেতে থাকেন, ‘আমার আর কোনো ভাইবোন ছিল না। বাবা-মাও মারা গেছেন অনেক আগে। বোনপোকে নিয়ে কী করব, তা ভেবে বের করতে পারিনি। ছাত্রী খারাপ ছিলাম না। এ সময় আমি একটা স্কলারশিপ পাই। ইউএসএতে। মনসুরকে কোথায়, কার কাছে রেখে যাব! অনেক ভেবে একজন উকিলের কাছে আমার বোনপোর দেখভালের দায়িত্ব দিলাম। আমেরিকায় চলে গেলাম। বছরে একবারে অনেকগুলো টাকা পাঠাতাম। তিনি মনসুরের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। ওকে দেখে রাখতেন। বছর দুই হলো তিনি মারা গেছেন। তাঁর ছেলেও আইনজীবী। সে-ই এখন সবকিছু দেখভাল করে।’

তিনি থামতেই শৌনক প্রশ্ন করে, ‘আপনি মনসুর আহমেদকে কত দিন ধরে দেখেন না?’

হাসলেন ফারহানা আলম। ‘তা বিয়াল্লিশ বছর তো হবেই। যুগ পাল্টেছে। সবাই এখন ইন্টারনেট ইউজ করে। ফেসবুকে ছবি দেয়। আমি কিন্তু সেকেলেই রয়ে গেছি। আমি বছরের পর বছর ওকে চিঠি লিখিনি। চিঠি লিখেছি আমার উকিলকে। দেড় বছর আগে যখন এই ইনানী বিচের জমিটা ওকে দিয়ে দেব বলে ভেবেছি, তখনই প্রথম ওকে চিঠি লিখেছি। নিজ হাতে চিঠি লিখেছি।’

‘আপনি কোনো দিন বোনপোকে দেখতে চাননি?’

‘না। ওর কথা মনে হলেই আমার সেই হত্যাকাণ্ডের কথা মনে পড়ে। আমি ঘুমুতে পারি না। তাই আমি চেয়েছি ও দূরেই থাকুক।’

‘মনসুর আহমেদ কি আপনাকে চিঠি লিখতেন?’

‘কম্পিউটারে লিখে প্রিন্ট আউট বের করে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ইদানীং পাঠাত।’

‘মনসুর আহমেদের ছবি কত দিন দেখেন না?’

‘কোনো দিন দেখিনি! কেউ পাঠায়নি আমাকে। আমারও দোষ আছে। আমি ওর ছবি চাইওনি কারও কাছে!’

বিস্মিত শৌনক বলে, ‘কী বলছেন? তাহলে আপনি মনসুরকে চিনবেন কী করে?’

‘দেখলেই চিনব! ওর ছোটবেলার চেহারাটা আমার হুবহু মনে আছে! তা ছাড়া আমার উকিলই তো ওকে নিয়ে আসবে।’

‘হুম।’ বলে নীরব হলো শৌনক।

ঠিক এ সময় ফোন বেজে উঠল ফারহানা আলমের। ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ গানের কয়েক পঙিক্ত বেজে উঠল তাতে। ফোনটা ধরবেন কি ধরবেন না, ভেবে শেষ পর্যন্ত ধরলেন তিনি।

‘হ্যালো। হ্যাঁ হ্যাঁ। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সব ঠিক আছে। কাল সময়মতো চলে এসো।’ বলে ফোন কেটে দিলেন ফারহানা আলম। তারপর হেসে বললেন, ‘আমার লইয়ার। জানতে চাইছিল, সব ঠিকঠাক আছে কি না।’

নীল সাগরে

পরদিন সকালে রিসোর্ট থেকে বের হলো ওরা। তখন জোয়ার। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বালুতটে।

সনকা আর শৌনক স্যান্ডেল খুলে পানিতে নেমে গেল। শৌমিক মাহমুদ আর ইলোরা মাহমুদ বালুর ওপরই বসে পড়লেন।

সনকা বলল, ‘তুই কাল একটা “হুম” করলি কেন?’

শৌনক বলল, ‘কেমন রহস্যময় না সব ঘটনা? ফারহানা আলম এসেছেন বিয়াল্লিশ বছর পর! তিনি তাঁর বোনপোকে এই পুরোটা সময় দেখেননি। এখন বোনপোর হাতে ১০ কোটি টাকা তুলে দিয়ে যাবেন। ভাবা যায়! আমার কিন্তু খটকা লাগছে। মনসুর আহমেদ কোনো দিন তাঁর ছবি পাঠায়নি কেন খালাকে? খালা না হয় প্রযুক্তি নিয়ে ভাবেন না, তাই বলে মনসুর কেন খালার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না? খালা কক্সবাজারে এসেছেন কিন্তু তিনি তো খালাকে এখনো দেখতে এলেন না! তোমার কাছে এসব রহস্যময় মনে হয় না?’

সনকা বলল, ‘তুই ঠিকই বলেছিস। আমারও সেটা মনে হয়েছিল। দেখা যাক। আজ তো উকিলের সঙ্গে মনসুর আহমেদ আসবেন। তখনই বোঝা যাবে খালার প্রতি ভদ্রলোকের ভালোবাসা আছে কি না। আর হ্যাঁ, বিয়াল্লিশ বছর আগে দেখা শিশুকে এখন কী করে চিনবেন তিনি!’

শৌনক বলল, ‘ফারহানা আলম বোনপোকে পুরো ১০ কোটি টাকা দিয়ে যাবেন কেন? নিজের জন্য কেন কিছু রাখবেন না?’

সনকা বলল, ‘এসব নিয়ে আমাদের ভাবার দরকার কী? আয়, হাঁটুপানিতে নামি।’

ওরা হাঁটুপানিতে নামল। এ এলাকা এতটাই জনমনুষ্যহীন যে যত দূরেই চোখ যাক না কেন, শুধু বালু, পানি, পাহাড় আর গাছ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।

ঠিক এ সময় যেন একেবারে ভুঁই ফুঁড়ে হাজির হলেন একজন মানুষ। মাথায় একটা ক্যাপ। চোখে সানগ্লাস। মুখভর্তি দাড়ি। একটা ফেড জিনস আর গাঢ় নীল রঙের টি-শার্ট পরনে। পায়ে গামবুট।

ওদের কাছে এসে ক্যাপটা তুলে ধরে বলল, ‘হাই, বহুদিন পর আবার তোমরা! কেমন আছ? কবে এলে?’

‘ভালো আছি! কাল এসেছি।’ বোকার মতো বলল শৌনক।

‘আমি আজই এসে পৌঁছালাম। আসার কথা ছিল কাল, কিন্তু রিসেপশনে ফোন করে জানতে চাইলাম, আজ থেকেই এখানে থাকতে পারি কি না। রিসেপশনিস্ট বললেন, হ্যাঁ, চলে আসুন। ব্যস, চলে এলাম। আমার ঘর দোতলায়। ২৬৭।’

‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’

‘মঙ্গল গ্রহ থেকে!’

‘মজা করছেন কেন?’

‘মজা না তো! সত্যিই আমি এসেছি মঙ্গল গ্রহ থেকে।’

সনকা বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তা মঙ্গল গ্রহে কি বাংলা ভাষায় কথা বলে? নাকি টিচার রেখে এই ভাষা শিখেছেন?’

লোকটাও গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আমরা কোনো ভাষা শিখি না। আমরা যা ভাবি, সেটাই কথা হয়ে বের হয়ে আসে।’

‘তা এত জায়গা থাকতে আপনি মঙ্গল গ্রহ থেকে ইনানী বিচে এলেন কেন?’

পেছন দিকের পাহাড়টা দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘ওখানে আমার ফ্লাইং সসারটা রেখে এসেছি। তেল শেষ হয়ে গেছে ফ্লাইং সসারের। তেল ম্যানেজ করেই ফিরে যাব।’

‘তাহলে রিসোর্টে রুম ভাড়া করেছেন কেন? ফ্লাইং সসারেই থাকতেন!’

‘আরে না! ফ্লাইং সসারে নির্দিষ্ট পোশাকে থাকতে হয়। আমার ও সব ভালো লাগে না। আমি স্যাটেলাইট টেলিভিশনে পৃথিবীর পোশাক-আশাক, জীবনযাত্রা দেখে পৃথিবীর প্রেমে পড়ে গেছি। তাই একটু মানুষের মতো জীবনযাপন করে দেখতে চাই।’

লোকটার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না ওরা। কিন্তু এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, তিনি যা বলছেন, তা ডাহা মিথ্যে।

লোকটা এবার শৌনকের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘তোমরা আমার একটা উপকার করবে?’

‘কী করতে হবে?’

‘তোমরা কি আমাকে মিজ ফারহানা আলমের কাছে পৌঁছে দেবে? একটু কথা বলতে চাইছিলাম তাঁর সঙ্গে!’

‘কী কথা!’

‘সেটা তো এখন বলা যাবে না। তাঁকে সরাসরি বলতে চাই।’

‘চেনা নেই, জানা নেই, হঠাৎ তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন কেন?’

লোকটা হেসে বললেন, ‘সে কথা যে তাঁকেই বলতে চাই!’

শৌনক লোকটার দিকে তাকাল। লোকটা দারুণ রহস্যময়।

সৈকত থেকে ইলোরা মাহমুদ চেঁচিয়ে ডাকলেন ওদের, ‘তোমরা এসে পড়ো, ফিরতে হবে!’

ওদের সঙ্গে লোকটাও তাকালেন ইলোরা মাহমুদের দিকে। বললেন, আমারও ফিরতে হবে।’

‘কোথায়?’ জানতে চাইল সনকা।

ফিসফিস করে ভদ্রলোক বললেন, ‘মঙ্গল গ্রহে।’

কিন্তু দেখা গেল লোকটা ওদের সঙ্গে সঙ্গেই রিসোর্টের দিকে রওনা হয়েছে।

রিসিপশনিস্ট লোকটাকে দেখে বললেন, ‘মি. মনসুর, আপনি স্বাক্ষর করে যাননি। আপনাকে এই এখানে একটা স্বাক্ষর করতে হবে।’

বলে একটি কার্ড এগিয়ে দিলেন রিসিপশনিস্ট।

লোকটি কার্ডে সই করলেন।

অলংকরণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

রহস্য

ব্রেকফাস্ট টেবিলে ওরা চারজন বসল। ফারহানা আলম ঘরেই ব্রেকফাস্ট সারবেন বলে দিয়েছেন। মনসুর আহমেদ নামের রহস্যময় লোকটা আসেননি নাশতা করতে।

শৌনক শৌমিক মাহমুদকে বলল, ‘২৬৭ নম্বর ঘরে যে লোকটা উঠেছেন, তাঁর নাম মনসুর।’

শৌমিক হাসলেন। ‘হতেই পারে।’

অধৈর্য হয়ে শৌনক বলল, ‘বাবা, মনসুর মানে বোঝো?’

‘তোমার কি মনে হয় না, একই নামে পৃথিবীতে অনেক মানুষ থাকতে পারে? আর মনসুরের পর আহমেদ আছে কি না, সেটা তো তুমি জানতে পারোনি।’

শৌনক চুপ করে থাকে। তারপর বলল, ‘সনকা আপু, চলো আমরা একটু হাঁটতে বের হই।’

ইলোরা মাহমুদ বলেন, ‘সেই ভালো। এখানে এখন টাকাপয়সার ডিলিংস হবে। ছোটরা শুধু শুধু এখানে বসে থাকবে কেন?’

কাল রাতেই শৌমিক মাহমুদ তাঁর প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানকে ফোন করে নগদ ১০ কোটি টাকার কথাটা জানিয়েছেন। রাতেই ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে ফেলেছেন বস। টাকাটা জোগাড় করা কঠিন হবে না। ব্যাংকের কক্সবাজার শাখা থেকে টাকাটা চলে আসবে রিসোর্টে। সঙ্গে থাকবে এক জিপ পুলিশ। সুতরাং এখন আর টাকা নিয়ে টেনশন নেই।

সনকা আর শৌনক লবিতে এসে দাঁড়াল।

শৌনক রেস্তোরাঁর দিকে পেছন ফিরে বলল, ‘সনকা আপু, আমার কিন্তু কেমন লাগছে। একটা রহস্য আছে এখানে!’

‘দূর দূর! এ নিয়ে এত ভাবিস না। টাকা আসবে। ফারহানা আলম টাকা নেবেন। তিনি টাকা দিয়ে দেবেন তাঁর বোনপোকে। ব্যস, খেলা শেষ!’

‘আমার কেমন যেন লাগছে! কাউবয় মনসুর সাহেব খুব রহস্যময় একজন মানুষ! আমাদের দেখে তিনি কী বলেছিলেন, মনে আছে? বলেছিলেন, “বহুদিন পর আবার তোমরা।” এর মানে তিনি আমাদের আগেও দেখেছেন। কোথায় দেখেছেন?’ বলতে বলতে শৌনক বেরিয়ে এল লনে। তারপর ওরা দুজন সামনের দিকে এগোতেই পেছন থেকে কে একজন ওদের দুজনের মুখ চেপে ধরল। গায়ে প্রচণ্ড জোর লোকটার। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা ওদের নিয়ে তুলল একটা জিপের পেছনে। মুখে তার রুমাল বাঁধা। কিন্তু সনকা আর শৌনক বুঝতে

পারল লোকটি মঙ্গল গ্রহের মানুষ!

ওদের মন ভয়ে আতঙ্কে নীল হয়ে গেল!

লোকটা জিপের পেছনের দরজা আটকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিলেন। মুখে বললেন, ‘চুপ!’

তারপর জিপের সামনে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলেন।

ঠিক তখনই শৌনকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ও বলল, ‘আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি মঙ্গল গ্রহের মানুষ।’

লোকটা ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, ‘চুপ, অনেক কাজ আছে!’

রিসোর্টে মনসুর আহমেদ

একটা কালো টয়োটায় করে এলেন দুজন মানুষ। একই বয়সী। এঁদেরই একজন মনসুর আহমেদ।

শৌমিক মাহমুদকে দেখে এদিকেই এগিয়ে এলেন তাঁরা। কালো কোট পরা ভদ্রলোক শৌমিক মাহমুদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি কায়সার আহমেদ। মিজ ফারহানা আলমের লইয়ার। আর ইনি হচ্ছেন...’

তাঁকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রসিকতা করে শৌমিক বললেন, ‘ইনি হচ্ছেন নব্য কোটিপতি মনসুর আহমেদ।’

মনসুর আহমেদ আর কায়সার আহমেদ হো হো করে হেসে উঠলেন।

কায়সার আহমেদ বললেন, ‘এইমাত্র আমি মিজ ফারহানাকে ফোন করেছিলাম। তিনি বললেন তাঁর ঘরে চলে যেতে। সেখানেই টাকাপয়সার লেনদেন হবে।’

‘ঠিক আছে। আপাতত এখানে বসুন। চা খান। টাকা এসে পৌঁছাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। আসুন, ততক্ষণ গল্প করি।’ বললেন শৌমিক মাহমুদ।

সময় কাটানোর জন্যই ইলোরা মাহমুদ জিজ্ঞেস করলেন মনসুর আহমেদকে, ‘এতগুলো টাকা নিয়ে কী করবেন?’

‘কিছু টাকা মা-বাবাকে পাঠাব!’

আকাশ থেকে পড়লেন ইলোরা মাহমুদ, মা-বাবাকে পাঠাবেন মানে?’

মনসুর আহমেদ হাসলেন। বললেন, ‘মা-বাবার নামে একটা পাঠাগার বানাব। শহীদ স্মৃতি পাঠাগার!’

‘ও আচ্ছা।’ আস্তে করে বললেন ইলোরা মাহমুদ।

কায়সার আহমেদ বললেন, ‘হঠাৎ করেই এত ঘটনা ঘটল। বছর দেড়েক আগে হঠাৎ মিজ ফারহানা বললেন, তিনি ইনানীতে একটা রিসোর্ট বানাবেন। আমরা আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। আপনারা খুব দ্রুত রিসোর্ট তৈরি করে ফেললেন। গেল বছর তিনি আমাকে জানালেন, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সব টাকা তিনি বোনপোকে দিয়ে যেতে চান। আজ সেই শুভদিন। এ কাজটি হয়ে গেলে

এখান থেকে আমার ছুটি।’

‘আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি আগে!’

‘হ্যাঁ, আমি ইনানীতে এই প্রথম এলাম। আমাদের ফার্ম থেকে আমার জুনিয়রকে পাঠিয়েছিলাম চুক্তির কাগজসহ।’

এ সময় বাইরে শোনা গেল গাড়ির চাকার আওয়াজ। একটি গাড়ি আর একটি জিপ এসে হাজির হলো রিসোর্টের সামনে। প্রথমে জিপ থেকে তড়াক করে চারজন পুলিশ নামল। সামনের গাড়ির সামনে দুই সারিতে দাঁড়াল তারা। এবার গাড়ি থেকে নামলেন ব্যাংকের একজন অফিসার। তাঁর হাতে মস্ত বড় এক স্যুটকেস। তিনি নামার পর আরও একজন অফিসার নামলেন। একই রকম স্যুটকেস তাঁর হাতে। স্যুটকেসগুলো যে খুবই ভারী, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। দেখা গেল দুজন পুলিশও সেগুলো বহন করার জন্য হাত লাগাচ্ছে।

লবি পেরিয়ে ওঁরা লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। শৌমিক মাহমুদ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আরেকটি লিফটের কাছে গেলেন। টাকা যে মিজ ফারহানা আলমের ঘরে নিয়ে যেতে হবে, সে কথা আর বলে দিতে হলো না ওঁদের।

গল্পটা প্রায় শেষ

ফারহানা আলম বসে ছিলেন বিছানায়। মনসুর আহমেদকে দেখেই তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। চিত্কার করে কেঁদে উঠলেন। ‘মনসুর, তোকে কত দিন দেখি না! কেমন আছিস তুই, বাবা! তোর জন্যই তো এত দিন আমি বেঁচে আছি। এবার তোর হাতে আমার সম্পত্তি দিয়ে শান্তিতে মরতে পারব!’

মনসুরও খালাকে দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। বিয়াল্লিশ বছর পর খালা-বোনপোর দেখা হওয়ার দৃশ্য দেখে বাকিদের গলায়ও দলা পাকিয়ে কান্না এসে আটকে থাকল। একটু ধাতস্থ হয়ে মিজ ফারহানা বললেন, ‘শৌমিক সাহেব, আমার বোনপোর জন্য ক্যাশ টাকা এনেছেন তো?’

‘নিশ্চয়ই! এই যে স্যুটকেস দুটো দেখছেন, এগুলোর মধ্যেই ১০ কোটি টাকা আছে। আপনি কিছু ভাববেন না।’

এবার লইয়ারের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘কায়সার, এই টাকা আমার বোনপোকে দিয়ে আমি কিন্তু আমেরিকা চলে যাব। আমার টিকিট করার দায়িত্ব তোমার!’

‘সে কথা তো আমি জানি খালাম্মা। এ কাজ তো আমাকেই করতে হবে।’

‘তাহলে শৌমিক সাহেব, আপনি আপনার সিগনেচারটা করুন। আমি কালই করে রেখেছি।’

শৌমিক আগের কাগজপত্রের স্বাক্ষরের সঙ্গে নতুন কাগজে মিজ ফারহানার স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখলেন। একই স্বাক্ষর। চিন্তা নেই। পকেট থেকে কালো কালির কলম বের করে শৌমিক খচখচ করে বাংলায় তাঁর স্বাক্ষর দিয়ে দিলেন।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল মিজ ফারহানার চোখ। তিনি বোনপোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মনসুর, এবার এই স্যুটকেসগুলো তুই নে। তোর খালা তোর জন্য এটুকুই করতে পারল। এখন থেকে আমি দায়মুক্ত হলাম!’

এ কথা বলার পরপরই ঘরের দরজা থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ‘এত সহজেই কি দায়মুক্ত হওয়া যায় খালা?’

মঙ্গল গ্রহের মানুষটা দাঁড়িয়ে আছেন দরজা ঘেঁষে।

চমকে উঠলেন মনসুর আহমেদের খালা, ‘কে?’

‘আমার নাম মনসুর আহমেদ। চিনতে পারছেন না?’

‘আ আ আ আপনি কে?’ সভয়ে আর্তচিত্কার করে উঠলেন মিজ ফারহানা।

‘খালা, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আপনি আমাকে নিয়ে একাত্তর সালের সেই দিনটিতে বাথরুমে লুকিয়েছিলেন, মনে নেই?’ লোকটার কণ্ঠে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে।

‘আমার বোনপো তো এই যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে! আমি তো এক দেখায় ওকে চিনে নিয়েছি।

আপনি কে? কেন এখানে এসে গণ্ডগোল পাকাচ্ছেন?’, রাগে অগ্নিশর্মা হলেন ফারহানা আলম।

এবার মুখ খুললেন অন্য মনসুর আহমেদ, ‘আপনি কে ভাই? কেন এখানে ঝামেলা করছেন? আপনি আর একটা কথা বললে আপনাকে পুলিশে দেব। আপনি জানেন আমি কে?’

মঙ্গল গ্রহবাসী বললেন, ‘আপনি কে, সে কথা আমি জানব না কেন? আপনি কক্সবাজার পোস্ট অফিসের সহকারী পোস্টমাস্টার। দুই বছর হলো ভারপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার হিসেবে কাজ করছেন!’

‘আমার নাম কী, সেটা জানেন?’

‘কেন জানব না? আপনার নাম মনসুর আহমেদ। আপনি হচ্ছেন লোভী মনসুর আহমেদ। পৃথিবীতে যতগুলো মনসুর আহমেদ আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে লোভী মনসুর আহমেদ হচ্ছেন আপনি। আর পৃথিবীতে যতগুলো ক্রিমিনাল আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ক্রিমিনাল হচ্ছেন আপনি!’

‘কী যা-তা বলছেন?’ এবার উকিল সাহেব মুখ খোলেন। ‘আমি এখানে উপস্থিত থাকতে আপনি বানোয়াট কথা বলে যাবেন? এ হতে পারে না। আপনি আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন!’

‘উকিল সাহেব! আপনি বেশ ভালো কাহিনিই ফেঁদেছেন!’

‘চুপ! একদম চুপ!’ চিৎকার করে উঠলেন মি. কায়সার। ‘এই যে পুলিশ! আপনারা এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? লোকটাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন?’

দুজন পুলিশ এসে মঙ্গল গ্রহবাসীর দুহাত ধরল দুদিক থেকে।

এবার দুই পুলিশের ফাঁক দিয়ে শৌনক ঢুকল ঘরে। ‘উকিল সাহেব, এই ভদ্রলোক মিথ্যেটা বলল কোথায়?’

‘মানে কী! এরা সবাই মিলে কি আমাদের ফাঁদে ফেলতে চায়! অ্যাই, তুমি কে হে ছোকরা?’

‘আমি কে, তা নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আপনি যে তুলসীধোয়া পাতা নন, সেটা আমরা বুঝে গেছি। এবার কীভাবে নিজের চামড়া বাঁচাবেন, সেটা ভাবুন!’

‘সবাই চুপ করো!’ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মিজ ফারহানা। ‘শৌনক, কী হয়েছে বলবে? এই লোকটাই বা কে?’

শৌনক বলল, ‘এই লোকটাই আসল মনসুর আহমেদ। এই লোকটাই মিজ ফারহানার বোনপো।’

‘আমার বোনপো! অথচ আমিই তাকে চিনতে পারছি না! আমার বোনপো তো ওই যে, ওখানে!’ এ কথা বলে তিনি ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে পোস্টমাস্টার মনসুরের দিকে ইঙ্গিত করলেন।

শৌনক এবার একটু হেসে বলল, ‘আপনার বোনপোর কথা তো হচ্ছে না। আমি না এইমাত্র বললাম মিজ ফারহানার বোনপোর কথা? আপনি কি শুনতে পাননি?’

‘শুনতে পাব না কেন? আমি তো সে কথাই বললাম, আমার বোনপোকে তো আমি চিনিই!’

‘আপনি তো মিজ ফারহানা নন খালাম্মা! আপনি যে কে, সেটা এই পোস্টমাস্টার আর উকিলকে পেটালে বের হয়ে আসবে!’

‘কী, কী বলছ!’ বলে তোতলাতে থাকলেন উকিল।

‘আমার বাড়িতে একটু কাজ আছে, আমি আসছি’ বলে ঘর থেকে ছুটে বের হতে গেলেন পোস্টমাস্টার মনসুর। কিন্তু দরজায় ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছেন অন্য দুই পুলিশ সদস্য আর ব্যাংকার। পালানোর পথ নেই।

অগত্যা নিরুপায় হয়ে নকল মনসুর পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে আসল মনসুরের দিকে তাক করলেন। ঘরে একটা আর্তরব উঠল। ‘আমার প্ল্যান নষ্ট করেছিস তুই! কোত্থেকে এলি! তোকে না খুন করেছিলাম! এবার আর কোনো কথা নয়। এবার তোকে মরতেই হবে’—হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কথা বলে যেতে লাগল নকল মনসুর।

কিন্তু তাদের দুজনের দূরত্ব এতটাই কম ছিল যে আসল মনসুর একঝটকায় কুংফুস্টাইলে পিস্তলের হাতটায় মারলেন এক কোপ। ছিটকে পড়ল পিস্তল। তারপর আসল মনসুরের হাতের বিরাশি শিক্কার এক চড় গিয়ে পড়ল নকল মনসুরের গালে। টাল সামলাতে না পেরে নকল মনসুর চিতপটাং হয়ে পড়ে গেল মেঝেয়।

শেষ

‘কী হচ্ছে এসব, কেউ কি আমাকে বলবে?’ ইলোরা মাহমুদ প্রশ্ন করলেন। তারপর জুড়ে দিলেন সঙ্গে, ‘সনকাই বা কোথায়?’

বিছানার ওপর নকল খালাম্মা, নকল মনসুর আর আসল উকিলকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ঘরে লোক বোঝাই, তাই তারা কেউ বের হতে পারেনি।

‘মা, সনকা আপুকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। ও ভালো আছে। জেনারেল হাসপাতালে আসল খালাম্মাকে সঙ্গ দিচ্ছে!’

‘মানে?’

‘মানেটা বুঝতে হলে পুরো একটা গল্প শুনতে হবে সবাইকে। আমি বলব, নাকি আপনি বলবেন মনসুর কাকু?’

আসল মনসুর আহমেদ হাসলেন। বললেন, ‘তুমিই শুরু করো।’

শৌনক বলল, ‘ঠিক আছে। কোথাও ভুল হলে আপনি আমাকে শুধরে দেবেন।

‘এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের শুরু দেড় থেকে দুই বছর আগে। নকল মনসুর আহমেদ যখন ভারপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার হলেন, তখন একদিন পোস্ট অফিসেই তাঁর চোখে পড়ল মনসুর আহমেদের নামে একটি চিঠি। আমেরিকা থেকে এসেছে। নিজের নামের সঙ্গে মিল আছে দেখে কৌতূহলী হয়ে চিঠিটি খুললেন তিনি। আর তারপরই পেলেন সোনার খনি। চিঠিতে মিজ ফারহানা তাঁর বোনপোকে লিখে জানিয়েছেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। ইনানী বিচে একটা রিসোর্ট হবে। সেই রিসোর্ট থেকে পাওয়া টাকা তিনি মনসুরকে দিতে চান, খুব শিগগির দেশে আসবেন, এসব তথ্য জেনে একটা ফন্দি আঁটেন নকল মনসুর। তিনি ভাবতে থাকেন কীভাবে এই টাকা হাতিয়ে নেওয়া যায়।

‘এর মধ্যে আরও চিঠি আসে বোনপোর নামে। বোনপো আর পান না। সব চিঠিই নকল মনসুর খুলে খুলে পড়েন। ওই চিঠি মারফতই তাঁর জানা হয়ে যায় আইনজীবী মারা গেছেন, এ বছর এই সময় মিজ ফারহানা আসবেন দেশে, এই ইনানীর রিসোর্টেই টাকার লেনদেন হবে।

‘তাহলে এই টাকা বাগিয়ে নেওয়ার জন্য এমন কিছু করতে হবে, যাতে পরিকল্পনায় কোনো ত্রুটি না থাকে। তিনি লইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মি. কায়সারকে বোঝান, খুব সহজেই এই টাকা তাঁরা ভাগ করে নিতে পারবেন। পাঁচ কোটি করে দুজনের হাতে আসবে। কেউ বুঝবেই না যে এখানে এমন একটা কাণ্ড ঘটে গেছে।

‘প্ল্যানটা ছিল খুব সরল। কক্সবাজারের একটি নাটকের দল থেকে মোটা টাকার বিনিময়ে দু-তিন দিন অভিনয় করার জন্য একজন অভিনেত্রীকে ভাড়া করেন তাঁরা দুজন। মিজ ফারহানার জীবনকাহিনি তাঁকে বলে দেওয়া হয়। কোথায় কী বলতে হবে, করতে হবে তা-ও শিখিয়ে দেওয়া হয়। টাকার লেনদেন হয়ে গেলেই তাঁর ছুটি, সে কথাও তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়।’ এটুকু বলে শৌনক নকল ফারহানার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী, ঠিক বলছি তো খালাম্মা?’

নকল খালাম্মা মাথা নিচু করে থাকেন।

এবার মুখ খোলেন আসল মনসুর, ‘একটা কথা বলতে ভুলে গেছ শৌনক। এক বছর আগে থেকেই এই পোস্টমাস্টার আমার পেছনে লেগেছে। একবার তোমাদের উপস্থিতিতেই আমাকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। এ বছরের শুরুর দিকেও আমার বাড়িতে গুণ্ডাদের পাঠিয়েছিল আমাকে খুন করার জন্য। ওরা বাড়িতে ঢোকার সময়ই আমি টের পেয়ে অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যাই। বুঝতে পারি, আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করছে কেউ। তৃতীয়বার আবার ইনানী বিচেই দূর থেকে গুলি করে আমাকে। আমি ইচ্ছে করেই পড়ে যাই। ভাড়াটে মাস্তানেরা কাছে আসার আগেই টহল পুলিশের একটা জিপ আসে। আমাকে উঠিয়ে নেয় জিপে। ওরা মনে করে, আমি মারা গেছি। কাকতালভাবে সেদিন ইনানী বিচের কাছে একটা খুনের ঘটনা ঘটেছিল। অজ্ঞাতনামা সেই লোকের খুনের খবর বের হয় পত্রিকায়। আমি আর বেঁচে নেই, সে ব্যাপারে ওরা নিশ্চিত হয়।’

শৌমিক বললেন, ‘আপনার ওপর চড়াও হলো কী করে? আপনাকে চিনল কী করে?’

‘বছর দুয়েক আগে খালাম্মার চিঠি পাচ্ছিলাম না বলে আমি নিজেই গিয়েছিলাম পোস্ট অফিসে খোঁজ নিতে। আমার পরিচয় পেয়ে তখনই আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করে ফেলে এই মহামান্য পোস্টমাস্টার আর উকিল সাহেব।’

‘গত বছর পাহাড়ের ওপর থেকে আপনাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল কেন, তা এখন বুঝতে পারছি।’ একটু দম নিয়ে শৌনক আবার শুরু করে, ‘এই খালাম্মাকে দেখে শুরু থেকেই আমার খটকা লাগছিল। একজন মানুষ চল্লিশ বছর তাঁর বোনপোকে দেখেন না, তাঁকে চিঠি লেখেন না, তাঁর ছবি দেখেন না, এটা কি হতে পারে? মানুষ কি এতটাই নিরাবেগ হতে পারে? এ কথা আমার মনে হয়েছে। তারপর তিনি যে শাড়িটা পরে আছেন, জামদানি, সেটা সদ্য কেনা বলে মনে হয়েছে। দামি এই জামদানির সঙ্গে তিনি যে স্যান্ডেল পরেছেন, তা ফুটপাতের স্যান্ডেল। মানানসই নয়। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছে খালাম্মাকে।

‘তিনি ১০ কোটি টাকা ক্যাশ দেওয়ার জন্য যেভাবে কথা বলছিলেন, তাতেও তাঁর প্রতি সন্দেহ হচ্ছিল। কিন্তু কোনো প্রমাণ তো পাওয়া যাচ্ছিল না! তাঁর ফোনের রিংটোনটাও খটকার জন্ম দিল। আমেরিকা থেকে আসা এক মহিলার ফোনে ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ রিংটোন থাকাটাও একটু অস্বাভাবিক। আমি সবচেয়ে বেশি সতর্ক হলাম তখন, যখন তিনি বাবাকে বলছিলেন, আমি তো সই করেই রেখেছি। আপনি আপনার সই করবেন। আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, এই ভদ্রমহিলা আসল মিজ ফারহানা নন। মিজ ফারহানার নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে! এবার কি মনসুর কাকু ব্যাপারটা খোলাসা করে দেবেন?’

‘আমি ওদের ভয়ে বাড়ি বদলালাম। নিজের চেহারা-পোশাক পরিবর্তন করলাম। একদিন পোস্ট অফিসে নকল মনসুরের সঙ্গে কথাও বলে এলাম। আমাকে চিনল না সে। তাই ওদের ওপর নজর রাখা আমার পক্ষে সহজ হলো। আমি খালাকে চিঠি লিখে বললাম, আমাকে যেন এখন আর চিঠি না লেখেন। কারণটা বললাম না। কিন্তু খালাম্মা সরল বিশ্বাসে চিঠি লিখে জানালেন এই গ্রীষ্মে তিনি আসছেন দেশে। নকল মনসুর সেটা জেনে নিজের পরিকল্পনা তৈরি করল।’

শৌনক বলল, ‘পরিকল্পনাটা এ রকম: খালাম্মাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করবেন উকিল সাহেব। প্রয়োজনীয় দলিলপত্রে সই নেবেন, তারপর খাওয়ার সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে লুকিয়ে রাখবেন কোথাও। টাকার লেনদেন শেষ হয়ে গেলে তাঁকে মেরে ফেলবেন।’

‘কেন, টাকার লেনদেন পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন কেন?’

‘কারণ, যদি আরও কোথাও সই নেওয়ার দরকার থাকে! মেরে ফেললে সই পাবে কোথায়?’

‘খুবই ধুরন্ধর!’ বললেন ইলোরা মাহমুদ। ‘এই নকল মনসুরকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, টাকা দিয়ে কী করবেন। তিনি বলেছিলেন মা-বাবাকে পাঠাবেন। পরে ভুল বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে শুধরে নিয়েছিলেন। চালাক আর ধড়িবাজ লোকটা!’

‘এই সরো সরো’ বলতে বলতে ঘরে এসে ঢুকে পড়লেন সনকা আর মিজ ফারহানা। সৌম্য চেহারার এক নারী। তিনি এসে লইয়ারের দিকে তাকিয়ে প্রথমেই বললেন, ‘মাত্র কয়েকটা টাকার লোভে তুমি এতসব করতে চেয়েছিলে! দুজন মানুষকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে!’

লইয়ারের চিবুক গিয়ে ঠেকল তাঁর বুকে।

রিসেপশন থেকে কল করা হয়েছিল পুলিশে। ততক্ষণে থানা থেকে ওসি সাহেবও এসে পড়েছেন। মনসুর আহমেদ বললেন, ‘আমি একা সামলাতে পারছিলাম না। তাই সনকা আর শৌনককে আমার সঙ্গে নিলাম। খালাম্মাকে আটকে রেখেছিল ওই ভবঘুরের গুহায়। ভবঘুরেকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে গড়ে তুলেছিল আধুনিক এক বাড়ি! বাইরে থেকে তার কিছুই বোঝা যায় না! ওখানে এমনকি বিদ্যুতের ব্যবস্থা, ফ্রিজ, কম্পিউটারও রেখেছে! কেউ ওই গুহায় ঢোকে না বলে জানে না এখানে একটা ঘাঁটি করা আছে!

‘সনকা আর শৌনককে নিয়ে প্রথমে আমরা ওই গুহায় গিয়ে খালাকে মুক্ত করলাম। সনকাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। আমরা চলে এলাম এখানে। নকলদের নাটক দেখতে!’

এবার নকল খালাম্মা ঢোক গিলে বললেন, ‘আমার তো ফাঁসি হবে না, আমি তো ভাড়াটে খালাম্মা, তাই না?’

ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মনসুরের হাতের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে ওঠল। যেন এ কথাকেই ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখবেন তিনি।

এই ভয়ানক গুমোট আবহাওয়াতেও ভাড়াটে খালাম্মার কথা শুনে হেসে উঠল সবাই।